আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা তরুণ প্রজন্মের সমর্থন কাড়তেই শুধু সক্ষম হয়নি—সরকার গঠনের পর সে ঘোষণা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রগতভাবেও বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। একইভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যে গ্রামে সব নাগরিক সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামগুলোকে বসবাসের জন্য শহরের মতোই আকর্ষণীয় করে তোলার ঘোষণা দিয়েছে, যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সে ঘোষণাও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ডিজিটাল খাতের ভূমিকার মতোই অনন্য সাধারণ হয়ে উঠতে পারবে বলে আশা করা যায়। এবং সেটি ঘটলে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোতে প্রথম যে পরিবর্তনটি ঘটবে তা হচ্ছে, গ্রাম আর শুধু কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং কৃষিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড সেখানে দিন দিন মুখ্য হয়ে উঠবে। আর সে রকম একটি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক খাতের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরো জোরদার করা এবং ক্রমান্বয়ে সেটিকে ব্যাপক হারে গ্রামমুখী করে তোলা।
উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমকে জোরদার করার ক্ষেত্রে এত দিন পর্যন্ত মনে করা হতো যে এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত তরুণের মানসিক গঠন, যে গঠনের আওতায় ওই তরুণরা পড়াশোনা শেষের গন্তব্য হিসেবে চাকরি ভিন্ন অন্য কিছুর কথা ভাবত না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ ক্ষেত্রে তরুণদের মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অনেক শিক্ষিত মেধাবী তরুণ এখন চাকরির কথা না ভেবে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবছে এবং অনেকেই সরাসরি উদ্যোক্তা হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করে দিয়েছে এবং সে ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট ভালোও করছে। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এতটাই ভালো করছে যে তাদের কেউ কেউ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ছোট-বড় বিনিয়োগ করার সাহস দেখাচ্ছে বা নিদেনপক্ষে বিদেশিদের সঙ্গে কাজকারবার ও ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে।
শিক্ষিত তরুণের মানসিক গঠনের ক্ষেত্রে সাধিত উপরোক্ত রূপান্তর নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সামাজিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিটি এখনো প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। এখনো বেশির ভাগ কৃষিজীবী বা চাকরিজীবী অভিভাবক ভাবেন যে তাঁর সন্তান যদি ভালো চাকরিই করতে না পারল, তাহলে তাঁর সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থানের উন্নয়ন ঘটল কোথায়? আর অভিভাবকদের দিক থেকে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ ও সন্তানের ওপর তা প্রয়োগের ফলে লক্ষ করা যাচ্ছে যে (একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলা), অনেক তরুণ-তরুণীর মধ্যেই উদ্যোক্তা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও উল্লিখিত বাধার কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে আর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা হচ্ছে না। অবশ্য প্রকৃত সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাকে বাধা অতিক্রম করেই এগোতে হয়—এরূপ দৃঢ়সংকল্প যাদের মধ্যে আছে, তারা অবশ্য এ বাধাকে উপেক্ষা করে এগোচ্ছে এবং তারা সফলও হচ্ছে। তবে উল্লিখিত বাধার মুখে ফিরে যাওয়া তরুণের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শেষোক্ত এই তরুণদের যদি তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী উদ্যোক্তাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত করা যেত, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চলমান হারের ক্ষেত্রে তা অনেকটাই বাড়তি গতি যুক্ত করতে পারত বলে মনে করি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে অভিভাবক ও সমাজের রক্ষণশীল ও পশ্চাত্মুখী এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করা যাবে কিভাবে? কাজটি রাষ্ট্রকেই করতে হবে। নারীকে যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গেরস্তালি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সহায়ক প্রণোদনা দিয়ে নিজেদের অধিকার রক্ষায় এরই মধ্যে অনেকটাই উদ্যোগী করে তোলা গেছে এবং আরো উদ্যমী করে তোলাসংক্রান্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে, শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেও সে ধারার কার্যক্রমই প্রবর্তন করতে হবে।
উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকায় জনগণ এখনো পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। এসব কার্যক্রমকে আরো দক্ষ এবং সর্বশেষ বৈশ্বিক চাহিদা ও দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি স্তরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তুলতে হবে।
কয়েক বছরের মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট ও আনুষঙ্গিক খাতে পল্লী অবকাঠামো পরিস্থিতির যখন ব্যাপক উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায় তখন সেখানে ব্যাপকভিত্তিক কৃষিবহির্ভূত নানা অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নিকট ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সে অবস্থার কথা চিন্তা করে সরকারের উচিত হবে এখন থেকেই স্থাপিতব্য সে সুযোগের পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহারের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা এবং চিহ্নিত সেসব ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সে সময়ের জন্য যথেষ্টসংখ্যক উদ্যোক্তা গড়ে তোলা। এটি করতে না পারলে একসময় দেখা যাবে যে গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত গতিতে তা বিকশিত হচ্ছে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গতানুগতিক বিষয়ে পাঠদানের দেখাদেখি অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে এসে উদ্যোক্তা উন্নয়ন বা তদসহায়ক বিষয়গুলোতে শিক্ষাদানের রীতি চালুর বিষয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টীকরণের জন্য উদাহরণ হিসেবে বলি—ধরুন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আগে থেকেই বিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞানের কতিপয় মৌলিক বিষয়ে পাঠদান করে আসছে। এখন উদ্যোক্তা উন্নয়নের সঙ্গে এ পাঠদান কার্যক্রমকে যুক্ত করার লক্ষ্যে প্রচলিত বিষয়টি বাদ দিয়ে নতুন কোনো বিষয় প্রবর্তন করতে হবে—প্রস্তাবটি মোটেও এমন নয়। বরং আগে থেকে চলে আসা বিষয়ের পাঠ্যসূচিতে নতুন উদ্ভাবিত জ্ঞান ও তথ্য যুক্ত করার পাশাপাশি সেসব অধীত জ্ঞানকে কিভাবে উদ্যোক্তাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত করা যাবে—নতুন করে চিন্তা করতে হবে সেটি। আর পুনরাবৃত্তি করে বলা এই যে নতুন সরকারের গ্রামে শহরের সুবিধা সৃষ্টি সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নের আওতায় বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য বস্তুতই স্বকর্মস্থানের অর্থাৎ উদ্যোক্তাবৃত্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা করা যায়। আর সে সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষিত তরুণসহ দেশের সব শ্রেণির সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তারা এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করবেন এবং সে সুযোগকে যাঁরা কাজে লাগাতে চান, তাঁদের সহায়তাদানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর দক্ষ সেবা নিয়ে এগিয়ে আসবে বলেই আশা রাখি। বাংলাদেশের আগামী দিনের গ্রামগুলো শহরের সব নাগরিক সুবিধা নিয়ে তার নিজস্ব নিসর্গ ও অনিন্দ্যতা নিয়ে টিকে থাকুক, আবার পাশাপাশি সে গ্রাম হয়ে উঠুক নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তার চারণক্ষেত্র—সেটিই প্রত্যাশা।
লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com
Source:
http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2019/01/11/724703