ডেঙ্গুজ্বরের কারণঃ
ডেঙ্গুজ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস নামক মশার কামড়ে হয়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে ৫ ধরণের ডেঙ্গু ভাইরাসারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে- ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩, ডেনভি-৪ এবং ডেনভি-৫ (২0১৩, ইন্ডিয়া)। ডেঙ্গুজ্বর ৪ প্রকারেরঃ ১) ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর ২) ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ৩) ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং ৪) এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। মানুষের শরীরে যদি প্রথমবার এই ৫ ডেঙ্গু ভাইরাসের যেকোন একটি দিয়ে সংক্রমিত হয়, তাহলে লক্ষ্মণসমূহ প্রকাশিত অথবা অপ্রকাশিত হতে পারে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথমবার ডেঙ্গু সংক্রমণ হলে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর হয়। এটি কোণ ধরনের জটিলতা ছাড়াই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় এবং ওই নির্দিষ্ট প্রকারের ডেঙ্গু ভাইরাস বিপরীতে রোগ প্রতিরোধকারী এন্টিবডি তৈরি হয় যা ভবিষ্যতে ওই নির্দিষ্ট প্রকারের ডেঙ্গু সংক্রমণকে প্রতিহত করে। আশংকার কথা এই যে, দ্বিতীয়বার ওই ব্যক্তি যদি বাকী ৪ প্রকারের ডেঙ্গু ভাইরাসের যেকোন একটি দিয়ে সংক্রমিত হয়, তাহলে তা মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে যা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম নামে চিকিৎসকগনের কাছে পরিচিত। এতে সময়মত চিকিৎসা গ্রহণ না করলে ওই ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
সাধারণ ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষ্মণসমূহঃ ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর
- জ্বর (১০৪-১০০°F)
- চোখের পেছনে ব্যথা
- মাথাব্যথা
- মাংসপেশীতে ব্যথা
- অস্থি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা (হাড়ভাঙ্গাব্যথা-ব্রেকবোন ফিভার)
- খাবারে অরুচি
- বমি বমি ভাব এবং বমি
- Rash (মুখমণ্ডল, গলা এবং বুকের চামড়ায় লালচে বর্ণ বা দানা)
ডেঙ্গুজ্বরের সতর্কতামূলক লক্ষণসমূহঃ ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম
- চামড়ায় ছোট, মাঝারি অথবা বড় আকারের লালচে দানা
- দাঁততে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া
- নাক দিয়ে রক্তপড়া
- চোখের কোণে রক্তজমা
- প্রচণ্ড পেটে ব্যথা এবং কালো পায়খানা
- অনবরত বমি এবং রক্তবমি
- মেয়েদের মাসিকের সাথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
- অতিরিক্ত দুর্বলতা, খিটখিটে স্বভাব এবং অস্থিরতা
- রক্তের চাপ কমে যাওয়া
- ত্নদ্রাচ্ছন্ন, বিভ্রান্ত ও অজ্ঞান হওয়া
- শ্বাসকষ্ট
- পেটের ডানদিকে উপরিভাগে ব্যথা এবং চাকা অনুভব (লিভার বড় হলে)
- শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া (<৯৬°F)
- চোখ কোঠরে যাওয়া
- মুখমণ্ডল, জিহ্বা এবং ঠোঁট শুকিয়ে যাওয়া
- ৬ ঘন্টার মধ্যে প্রস্রাব না হওয়া
ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা :-
সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর কোন ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই ৭ দিনের মধ্যে সাধারণত ভাল হয়ে যায়। ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা মূলত শরীরের পানির সমতা রক্ষা করা এবং বিশ্রাম। জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ধরণের NSAID ব্যবহার করা যাবে না । শরীর স্পঞ্জ করা যেতে পারে। বিশ্রাম এবং সেই সাথে প্রচুর পানি, খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি এবং পছন্দ সই তাজা ফলের রস খেতে হবে এবং সেই সাথে ডেঙ্গুজ্বরের সতর্কতামূলক লক্ষণ গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে। এর যেকোন একটি লক্ষণ ও যদি প্রকাশ পায় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব হসপিটালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে অন্যথায় মৃতু ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তবে ২০১৯ সালের ডেঙ্গুর ভাইরাসের সংক্রমনের ফলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম দেখা যাচ্ছে এবং এর কারনে অনেক প্রান অকালে ঝরে যাচ্ছে। দু’একদিনের জ্বরে শরীরের রক্তচাপ কমে গিয়ে রোগী শকে চলে zaচ্ছেন। জ্বরে শরীরের তাপমাত্রাও থাকছেও কম, ১০০-১০২°F। এসব জটিলতা এড়াতেই অপেক্ষা না করে প্রথমদিনের জ্বরেই বি.এম.ডি.সি কতৃক রেজিস্টৃত একজন এম.বি.বি.এস চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরী। চিকিৎসক যদি মনে করেন রোগী বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার জন্য উপযোগী তা হলে বাসায় চিকিৎসা নেয়া যেতে পারে।
এছারাও চিকিৎসকগণ কিছু রোগীগনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যাদের জ্বর হলে প্রথম দিনেই হসপিটালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন, যেমনঃ
(১) এক বছরের কম বয়সী বাচ্চা
(২) গর্ভবতী মা
(৩)বৃদ্ধ
(৪)ডায়াবেটিক
(৫) হার্টেরসমস্যা
(৬)উচ্চরক্তচাপ
(৭) কিডনির সমস্যা
(৮) লিভারের সমস্যা
ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়ঃ
ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে এসিড মশার বংশ বৃদ্ধি রোধ এবং এর কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া। নিম্নলিখিতভাবে বিষয় গুলো সম্পর্কে সচেতন হলে এডিস মশাকে নিয়ত্রন করা সম্ভব। দরকার সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেকের স্বতন্ত্র উদ্যোগ। নিম্নলিখিত উপায়ে ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভবঃ
- ঘরের ভিতরে এবং বাহিরে জমে থাকা পানি ৩ দিনের মধ্যে অপসারণ, যেমনঃ ফুলের টব, ফুলদানী, একুরিয়াম, আর্টিফিশিয়াল ঝর্ণা, ডাবের খোসা, টায়ার এমনকি বার্থরুমের ভেজা ফ্লোর, বেসিন এবং কমোড।
- ঘরের দরজা-জানালায় নেট ব্যবহার
- দিনের বেলায় মশারী টানিয়ে ঘুমানো
- লম্বা জামা এবং প্যান্ট পরিধান
- মশার রিপিল্যান্ট (ওডোমস) ব্যবহার
- আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখা এবং অসুস্থ অবস্থায় অন্য এলাকায় ভ্রমন থেকে বিরত থাকা
ডেঙ্গু জ্বরের ভাক্সিনঃ-
ডেংভাক্সিয়া (Dengvaxia) নামে সানোফি পাস্তুরের একটি ভ্যাকসিন রয়েছে যা এখনও বাংলাদেশে অনুমোদিত নয়। এই ভাক্সিনটি ২০১৬ সালে ১১ টি দেশে অনুমোদিত হয়েছিল, যেমন, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, ইন্দিনেশিয়া, ব্রাজিল, সাল্ভাদর, কোস্টারিকা্, পারাগুয়ে, গুয়েতিমানা, পেরু, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর। তন্মধে, ফিলিপাইনে দু’বছর ভ্যাকসিন ব্যাবহারের পর তা বন্ধ করে দেয়া হয়। কারন, এই ভাক্সিন শুধুমাত্র পূর্ববর্তী সংক্রমিত ব্যাক্তিদের কার্যকর কিন্তু, অসংক্রমিত ব্যাক্তিদের ক্ষেত্রে এটি জটিলাকার ধারন করে। ভাক্সিন দেয়ার পর কিছু বাচ্চার মৃত্যু হলে তাদের পিতা-মাতা দাবী করেন যে এটি ভ্যাক্সিনজনিত জটিলতার ফল। হয়তো ভবিষ্যতে আরো গবেষনার পর এই ভাক্সিন গ্রহণযোগ্য হবে আর ততদিন আমাদের ডেঙ্গু প্রতিরোধের একমাএ উপায় হচ্ছে এসিড মশা দমন।
২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহতা এবং নিজস্ব কিছু মতামতঃ-
যেহেতু, প্রথমবার ডেঙ্গু সংক্রমনে অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষণ অপ্রকাশিত থাকে এবং এমনকি লক্ষণ থাকলেও অনেক চিকিৎসগণই ডেঙ্গুর সনাক্তকরনে কোন টেস্ট করানোর জন্য আগ্রহী নন, কারণ, ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য আলাদা কোন ঔষধ নাই, চিকিৎসা শুধু উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করা, তাই, প্রথম ডেঙ্গু সংক্রমণ অনেক ক্ষেত্রেই নির্ণয় হয় না, সেহেতু এবার যেসব রোগীগন ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এ আক্রান্ত হয়েছেন অথবা মৃত্যুবরন করেছেন, তাদের পূর্ববর্তী ডেঙ্গু সংক্রমনের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রথমবার এবং দ্বিতীয়বার সক্রমনে কোন গবেষনাপত্র তেমনভাবে খুজে পাওয়া যায় না। IEDCR এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে ডেনভি-১, ডেনভি-২ এবং ডেনভি-৩ এর অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে । IEDCR এর তথ্যমতে ২০১৯ সালে ডেন-৩ দিয়ে সক্রমনের হার বেশী লক্ষ করা যাচ্ছে । পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা যায় যে ডেন-৩ দিয়ে সংক্রমনে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হার অন্যান্য দেশে ছিল তুলনামুলকভাবে বেশি। আবার এমনও হতে পারে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাসগুলোর মিউটেশনের ফলে নতুন প্রকারের একটি ডেঙ্গুভাইরাস তৈরী হয়েছে যেজন্যে জটিলটা বেশী হচ্ছে। এজন্য দরকার ভবিষ্যত গবেষণা। তবেএকজন Virologist হিসেবে আমি মনে করি যে, প্রত্যেক চিকিৎসকগণকে রোগীদের প্রথমবার ডেঙ্গু জ্বরের আশংকা হলে ডেঙ্গু ভাইরাস সনাক্ত করণ জরুরী।
লেখিকা,
ডা: বুশরা তানজীম
এম.বি.বি.এস, এম.ডি (ভাইরোলজি)