বই নিয়ে গ্রামের পথে পলান সরকার। প্রথম আলো ফাইল ছবিবই নিয়ে গ্রামের পথে পলান সরকার। প্রথম আলো ফাইল ছবিপলান সরকারের মৃত্যুর খবর শুনে মলি রানী কুণ্ডু খুব কেঁদেছেন। তাঁর বাড়ি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার গালিমপুর গ্রামে। ২০১৭ সালে মলি রানী ও তাঁর ছেলে পিয়াল কুণ্ডু একসঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছিলেন। মা ও ছেলের একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে পাসের খবর শুনে পলান সরকার গিয়ে হাজির হন মলি রানীর বাড়িতে। মা ও ছেলের জন্য তিনি উপহার হিসেবে দুইখানা বই নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের হাতে বই দুইখানা তুলে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আমার বই পড়ার আন্দোলন সার্থক হলো।’
লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মলি রানী সুযোগ পাননি। তাঁকে অসময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। বাবার সংসারে লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও নিজের সংসারে এসে তিনি তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করেছেন। তাঁর পুরস্কার হিসেবে স্বয়ং পলান সরকারের হাত থেকে বই উপহার পেয়ে সেদিন তিনি আনন্দে কেঁদেছিলেন। তাই পলান সরকারের মৃত্যু তাঁকে দ্বিতীয়বার কাঁদিয়েছে। মলি রানী এবার এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করেছেন। আগামী ১ এপ্রিল তিনি এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। মুঠোফোনে মলি রানী বলেন, ‘পলান সরকার সেদিন আমাকে বলেছিলেন, “মা, তোমার আর পেছন ফিরে তাকানোর সময় নেই। তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে।” সেই দিনই আমি ভেবে নিয়েছি, যেভাবেই হোক আমি পড়াশোনা শেষ করব। আমার বাড়িতে কোনো ছেলেমানুষ না থাকার কারণে আমি পলান সরকারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যেতে পারিনি। কান্নাকাটি করেছি। সারা দিন খুব মন খারাপ ছিল।’
পলান সরকার হেঁটে হেঁটে মানুষের বাড়িতে যেতেন। খুঁজে বের করতেন এ রকম মায়েদের। তাঁদের হাতে বই তুলে দিতেন। মাইনর (চতুর্থ শ্রেণি) পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় পলান সরকারের নিজের জুতা ছিল না। প্রতিবেশীর একটি রাবারের জুতা ধার নিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন। অভিভাবক না থাকার কারণে মাইনর পাস করলেও পরে আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। অদম্য ইচ্ছা থাকার পরও পড়া ছেড়ে দেওয়ার কী জ্বালা, শিশু বয়সেই তিনি খুব ভালো করে বুঝেছিলেন। তাই যে মায়েরা ছোটবেলায় পড়তে শিখেছিলেন, কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি, তিনি আগে সেই মায়েদের খুঁজে বের করতেন। আর মাঝেমধ্যেই নেপোলিয়নের প্রসঙ্গ টেনে মায়েদের শিক্ষিত হওয়ার কথা বলতেন।
মনে আছে, প্রথম যেদিন পলান সরকারের সঙ্গে কথা বলতে যাই, তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘অত নামের দরকার কী।’ পরে আমি তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হই, আপনার বই পড়ার এই গল্প অন্যরা জানলে তারাও এটা অনুসরণ করতে পারে। সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ কথা শুনে তিনি রাজি হন। তাঁকে রাজি করানোর জন্য সেদিন কথাটা বলেছিলাম। অতটা ভেবেও বলিনি। পরে সেই কথাটিই এভাবে ফলে যাবে—ভাবতেও পারিনি। পলান সরকারের গল্প যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন দেশের আনাচকানাচে বইপড়ার আন্দোলন গড়ে ওঠার অনেক খবর পেয়েছি। খবর পেয়েছিলাম নওগাঁর নিয়ামতপুরে সবুজ সরকার নামের এক কলেজশিক্ষার্থী এই কাজ শুরু করেন। রাজশাহীর চারঘাটের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ওরা ১১ জন’ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দেওয়ার কর্মসূচি চালু করে। পলান সরকারকে দেখে বাঘার জুবায়ের আল মাহমুদ স্কুলভিত্তিক বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তোলেন। বইমেলা করেন। আরও অনেক জায়গা থেকে এ রকম খবর পেয়েছিলাম। রাজশাহী নগরের তেরখাদিয়া উত্তরপাড়ার সোহাগ আলী নামের এক যুবক ২০১৫ সাল থেকে ‘পলান সরকার বইপড়া আন্দোলন’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করেছেন। কেউ ফোন করলে তিনি তাঁর বাড়িতে পছন্দমতো বই পৌঁছে দিয়ে আসেন। পড়া শেষ হলে পুরোনো বই ফেরত নিয়ে আবার নতুন বই দিয়ে আসেন। শহরের ৫০-৬০ জন পাঠক তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত বই নিয়ে থাকেন। সোহাগ সম্প্রতি শহরের সেলুনে সেলুনে বই রাখছেন, যাতে সেলুনে আসা অপেক্ষমাণ লোকজন বই পড়ে সময়টা পার করতে পারেন।
Eprothom Alo
১ মার্চ সকালে মৃত্যুর সংবাদ শুনেই ঢাকা থেকে ফোনে মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল আলম আহা করে উঠলেন। বললেন ১৯৬৩ সালের কথা। অমিয় চক্রবর্তীর লেখা তমালতলার ঘাট ও উজানতলীর হাট বই দুটি কোথাও না পেয়ে পলান সরকারের কাছে গিয়ে পেয়েছিলেন। এই মানুষ আর কোথায় মিলবে! নাট্যকার মলয় ভৌমিকের নেওয়া পলান সরকারের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে তিনি সেই সাক্ষাৎকারটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেন।
জানাজায় গিয়েছিলেন রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ গ্রামের জুলফিকার রহমান। তাঁর একটি গৃহপাঠাগার রয়েছে। তিনি বললেন, ‘বইয়ের টানে বহুবার আমি পলান সরকারের কাছে এসেছি। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে আমি না এসে থাকতে পারিনি।’ রাজশাহী শহর থেকে তাঁর ভক্ত আরাফাত রুবেল এসেছিলেন। পলান সরকারের দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
খুবই অবাক লাগে, একুশে পদকের একটি টাকাও পলান সরকার খরচ করেননি। সন্তানদের দেননি। সব টাকা ডাক বিভাগে জমা রেখেছেন। প্রতি মাসে সেখান থেকে যে মুনাফা আসে, তা তাঁর পাঠাগার পরিচালনার জন্য বরাদ্দ করে গেছেন।
হেঁটে তিনি বহুদূর চলে গেছেন। আর কেউ পলান সরকার হতে পারবেন না। তবু রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটি আমরা আপাতত ভাবতে পারি—
‘কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি—
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।।’