বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে অনেক
লেখক: মুনমুন শবনব বিপাশা, লেকচারার, অর্থনীতি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি | সোম, ২৭ জুন ২০১১, ১৩ আষাঢ় ১৪১৮
প্রতি বছরের মতো এ বছরেও বাংলাদেশের জনগণের বাজেটের ওপর আগ্রহের কমতি ছিল না। জুন-জুলাই মাস অন্যান্য যে কোনো মাসের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অর্থনীতির গতি, রূপরেখা এ বছরেই অঙ্কিত হয়। এ বছর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন। এ ব্যয়ের বিপরীতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ করা হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। এ হিসাবেই দেখা যায়, আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতায় ঘাটতি হলো ৪৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। তবে এক্ষেত্রে আমরা যদি অনুদান বাদ দিই তাহলে দেখতে পাই, সামগ্রিক ঘাটতি হবে ৪০ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।
এ বছরে বাজেট যেমন বিশাল, তেমনি উচ্চাকাঙ্ক্ষাও কম নয়। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘাটতিও বিশাল। এই বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তাও এক বিশাল প্রশ্নসাপেক্ষ। বৈদেশিক ঋণ এক্ষেত্রে ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ ২৭ হাজার ২০৮ কোটি টাকা নেওয়া হবে বিশাল এ ঘাটতি পূরণের জন্য। এর মধ্যে দেখা যায়, সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ৬ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র এবং দরিদ্র দেশে বিশাল জনসংখ্যা (১৬ কোটি মানুষের জন্য) অর্থমন্ত্রীর হিসাব মতে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ হবে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। আবার আমরা দেখি যে, এ ক্ষেত্রে বাজেটের ঘাটতি ৪৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। অর্থাত্ ঘাটতি বাজেটও উন্নয়ন ব্যয় প্রায় সমান। আবার প্রতি বছর আমরা এডিপির ব্যর্থতাও দেখতে পাই। এ উন্নয়ন ব্যয়ের ৪৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে কত কোটি টাকা বাস্তবিক অর্থেই উন্নয়নে ব্যয় হবে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
এ অনিশ্চিত এক বিশাল বাজেট ভবিষ্যতে যাতে সঠিকভাবে কাজ সম্পাদন করতে পারে এই জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর। ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। সেই দিক থেকে এ নতুন অর্থবছরে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। এ হিসাবেই বোঝা যাচ্ছে যে প্রায় ২৪ শতাংশ আদায় বাড়াতে হবে।
রাজস্ব আদায়ের জন্য অবশ্যই সরকারকে করের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। এ বাজেটে দেখা যায় যে, পরোক্ষ করের আওতা বাড়ানো হয়েছে। আর প্রত্যক্ষ করের আওতা কমানো হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে। দরিদ্ররা আরও কষ্ট করবে। আর এটা হবে ধনীদের জন্য আরও ধনী হবার উপায়। এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কষ্ট আরও বাড়বে। বাড়বে মূল্যস্ফীতি, বাড়বে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় ও যোগাযোগ ব্যয়। সরকারকে যেখানে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া দরকার সেখানে অতিরিক্ত পরোক্ষ কর বাড়ানো হয়েছে। এ পরোক্ষ করের বেশির ভাগই দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।
বর্তমান বাজেটে বেসরকারি খাতকে উত্সাহিত করার তেমন কোনো ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়নি। এ ঘাটতি বিশাল একটা ঘাটতি বাজেট লক্ষ্য করা যায়। এ ঘাটতি সংগ্রহ করার জন্য সরকারকে অবশ্যই ঋণ নেয়া ও ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে, বৈদেশিক সাহায্যের হার বাংলাদেশে কমে যাচ্ছে। এ বছরেও এমন চলতে থাকলে সরকারকে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর থাকতেই হবে। যা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে এটা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তিকে অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং ডিসিসিআই উভয়ই মনে করে যে, এ ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য সরকার ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর করলে এবং বড় ঋণ নিতে হবে। ফলে সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতা লেগে থাকবে বছরজুড়েই। যা অবশ্যই নেতিবাচক নিদর্শন। এমন কি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখার জন্য সরকার এ বাজেটে বেসরকারি খাতকে উত্সাহিত করেনি।
বর্তমান অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মুদ্রাস্ফীতি কাটিয়ে সাড়ে সাত শতাংশ করা হবে। শুধু তাই নয়, বেসরকারি পর্যায়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাস করে ২০ শতাংশ করেছেন। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানো এতটা সহজ নয়। এজন্য সরকারকে নতুন ও যৌক্তিক রাজস্ব নীতি উদ্ভাবন করতে হবে। সরকার মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের কথা বলেছে, কিন্তু এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ আমানতের অনুপাতের হার ছিল ৮১ শতাংশ। কিন্তু তা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মেনে চলেনি। ফলে মুদ্রা সরবরাহ ও অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ দুটিই অনেক উচ্চ হারে পৌঁছে গেছে।
আমরা দেখেছি, ২০১০-১১ সালে প্রতি মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৬৯ দশমিক ৩৬ টাকা এবং ২০১১ সালে প্রতি মার্কিন ডলারের মূল্য ৭২ দশমিক ৮৫ টাকা। এতেই টাকার অবমূল্যায়ন ব্যাপারটা বোঝা যায়।
এ অবমূল্যায়নের কারণে আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে আমদানি ব্যয়। এর ফলে বেড়ে যায় অভ্যন্তরীণ মূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতি। সিপিডির মতে, সামপ্রতিক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতি এককভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না। কেননা মুদ্রাস্ফীতি অনেকটাই আমদানি করা মুদ্রাস্ফীতি। যার ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। তবে সময়ানুগ এবং সুচিন্তিত আর্থিক ও রাজস্ব নীতিমালার সমন্বয়ে সহনীয় পর্যায়ে মুদ্রাস্ফীতি আনা সম্ভব হতো।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, নতুন অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ শতাংশ। বর্তমানে গ্রাম থেকে শহরে শ্রমশক্তি স্থানান্তরিত হচ্ছে ব্যাপক হারে। শহরে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আবার গ্রামেও কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে মাথাপিছু আয় বেড়েছে এবং সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে বিনিয়োগের উত্পাদনশীলতা।
আমরা যদি বিগত কয়েক বছরের হিসাব নিই তাহলে বুঝতে পারব যে, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার বেড়েই চলেছে। দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি মানেই দেশের উন্নতি। তবে একথার মানে এই নয় যে, প্রবৃদ্ধি আর দারিদ্র্য দুটোই একই হারে ওঠানামা করে। অর্থাত্ প্রবৃদ্ধি বাড়লেই দারিদ্র্য কমে না। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেন জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পায়— তা অবশ্যই সরকারকে দেখতে হবে।
বর্তমান সরকারের আমলে বাজেট যেমন বিশাল, তেমনি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাও বিশাল। বেশ কিছু ইতিবাচক দিকও লক্ষ্য করা যায়। করমুক্ত আয়ের সীমা বেড়েছে। গাড়ি, সিগারেটের ওপর কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা অবশ্যই ইতিবাচক। এ বাজেটের অন্যতম চমক হলো সরকারি কর্মকর্তাদের আয়কর দেওয়া এবং সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করলে কালো টাকা সাদা হওয়া। শুধু তাই নয়, নারী উন্নয়ন, পরিবেশ উন্নতিকরণ, বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে প্রণোদনা, প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন এবং ২০১৩ সালের মধ্যে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধের উদ্যোগ নেয়।