ঘুরে এলাম জাপান
সাড়ে সাত ঘণ্টা আকাশে ওড়ার পর আমাদের বিমান কানসাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করলো ।জাপানের মাটিতে পা রেখেছি না বলে জাপানের পানিতে পা রেখেছি বল্লে ভুল হবে না ।কানসাই এয়ার পোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে গভীর সমুদ্রের উপড়ে । বিশ মিনিটের মধ্যে ইমিগ্রেসনের ঝামেলা শেষ করে বাইরে বেড়িয়ে এলাম । বাইরে আমদের জন্য অপেক্ষা করছেন প্রফেসর নাজমুল এবং জাপানের স্বনাম ধন্য বাঙালি অধ্যাপক ডাঃ আশির আহমেদ । ডাঃ আশিরের লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে আমরা অপর টার্মিনালে চলে গেলাম প্রফেসর ইউনুসকে রিসিভ করার জন্য । ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রফেসর ইউনুস চলে আসলেন তার সাথে প্রফেসর ওকাদা । আমরা এবং আগে থেকে উপস্থিত ইউ বি এস ব্যাংকের কর্মকর্তারা ইউনুসকে বরণ করে নিলাম ।
আজ এক অতি সাধারণ ইউনুসকে সামনে থেকে দেখতে পেলাম (তার এত নিকটে যাবার সুযোগ আমার আগে কখন হয়নি) । বিশ্বের প্রভাবশালী এই লোকটা অত্যান্ত সাদামাটা একজন মানুষ । পার্সনাল সেক্রেটারি বা বডি গার্ড বিহীন এই মানুষটা নিত্যান্ত একা একা সারা বিশ্বময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ।
আমদের গাড়ি সাই সাই করে ওসাকার দিকে ছুটে চলেছে । রাস্তার দুইধারে সাউন্ড প্রুফ গ্লাসের দেয়াল । রাস্তা তৈরি করার সময় সাউন্ড প্রুফ গ্লাসের দেয়াল গুলা দেওয়া হয়েছে যাতে রাস্তার শব্দ পাশের লোকালয়ে প্রবেশ না করে, আর এতেও যদি কেউ সড়ক প্রশাসনের বিরুদ্ধে শব্দদুশনের অভিযোগ তোলেন তবে তাকে প্রমান করতে হবে তিনি মানুষ নন, বাদুর ।
তিনদিন ধরে চোখে ঘুম নেই অথচ ক্লান্তি আমকে স্পর্শ করছে না । আমি প্রফেসর মাসুদ আর ডাঃ আশির শেষ রাত অবধি কাজ করে চলেছি সকালের জন্য ।
রাত শেষ হয়েছে । ওসাকা জেগে উঠেছে ভোরের আলো ফুটবার আগে । হোটেলের জানালার গ্লাস সরিয়ে আমি ঝলমলে এক সকাল দেখতে পেলাম । দিনের আলোয় আমি প্রথম জাপানকে দেখতে পেলাম । জাপানের কর্মিক মানুষ গুলো ছুটে চলেছে অনেকটা নিঃশব্দে ।
আমি ওয়েস্টইন ওসাকার লবিতে বসে আছি । এটাকে কাঁচের ঘর বলা যেতে পারে । পুরো লবিতে কৃত্রিম ভাবে শিতের সকালের আবহ তৈরি করা হয়েছে ( যদিও বাইরের তাপমাত্রা পঁয়ত্রিশ ডিগ্রির কম হবে না) । সূর্যের মিষ্টি আলো গায়ে এসে পড়ছে । দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকী ।আমকে এবং প্রফেসর মাসুদকে বক্তব্য রাখতে হবে সোশ্যাল বিজনেস ফোরাম ইন এশিয়াতে । আমকে হল রুমে যেতে বলা হল । হল রুমে পাঁচশত লোকের সমাগম দেখে আমি বিস্মিত হলাম , তারা এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে প্রফেসর ইউনুসের কথা শোনার জন্য ।আমার ধারণা ছিল প্রফেসর ইউনুস শুধু ইউরোপ-আমেরিকাতে জনপ্রিয় কিন্তু আশাতীত লোক সমাগম আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করল ।
প্রফেসর ইউনুস ২৫ মিনিট কথা বললেন । তার যাদুকরি কথার মায়াজালের কারণে কিনা জানিনা ওয়েস্টইন ওসাকার হল রুম ২৫ মিনিটের জন্য থমকে দাঁড়ালো । দর্শক তার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনল । হল রুমে পিনপতন নিরবতা শুধু ভেসে আসছে ইউনুসের বানী, এটা বিস্ময় এটা ইন্দ্রজাল ।
সোশ্যাল বিজনেস ফোরাম এশিয়া বাম দিক থেকে, প্রফেসর ওকাদা, প্রফেসর ইউনুস,মাসুদ ইবনে রাহমান এবং লেখক
ইউনুসের পর আমি আর ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাসুদ ইবনে রহমান বক্তব্য রাখলাম ।আমার বক্তব্যের শেষে প্রফেসর মাসুদ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন । বুঝতে পারলাম আমি ঠিকঠাক বলতে পেরেছি । ইউনুসের বক্তব্যের পর আমরা দুজন বক্তব্য দেবার সুযোগ পেয়েছিলাম । বাঙালি হিসেবে আমদেরকে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে তাতে আমরা গর্বিত । আমদের এই গর্বে হয়ত প্রফেসর ইউনুস খুশি হয়েছিলেন তাই তিনি আমদেরকে তার পাশে এসে বসতে ইশারা করলেন ।
ঐ দিন রাতেই আমরা রওনা করলাম কিয়থোর (Kyoto) উদ্দেশ্য । কিয়থো হল জাপানের প্রাচীন রাজধানী । ঐতিহ্যবাহী এই শহরকে মন্দিরের শহর বললে ভুল হবে না । এই শহরের আনাচে কানাচে প্রাচীন জাপানের আমেজ । সারি সারি কাঠের তৈরি দুতলা বাড়ি গুলো মনে করিয়ে দেয় জাপানের হাজার বছর ধরে লালিত কৃষ্টি , কালচারকে
যখন কিয়থো পৌছাই তখন রাত দশটা । এখানে রাত দশটা মানে অনেক রাত । তখন আমরা জাপানের রাজপথ ধরে হাঁটছি । চারিদিকে শুনশান নীরবতা, মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে লাগছে তবে এটা কৃত্রিম ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক নয় , সত্যিকারে ঝিঁঝিঁ পোকা গুলো এভাবেই সুরের লাহিড়ী তুলে মাতিয়ে রাখে জাপানের রাজপথ গুলো। আমি চোখ বন্ধ করে ক্ষণিকের জন্য ফিরে গেলাম বাংলাদেশের কোন এক নিভৃত পাড়াগাঁয়ে যেখানে আতাবনের মাথার উপর জ্যোৎস্নার বান নেমেছে , বাংলার অভাগা ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে অবিরাম ।
সকাল সাড়ে দশটায় আমাদেরকে একটা সেমিনারে বক্তব্য রাখতে হল । ইউনুস সোশ্যাল বিজনেস ক্লাব কানসাই এর এক দল তরুন এই সেমিনারের আয়োজন করেছে । সেমিনার শেষে আমদের সাথে যোগ দিলেন মিস নউমাছি (Mitsuka Noumachi) আর তার স্বামী মি. ওয়াতামাবে (Tomoya Watanbe) । তারা দুজন জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এসেছেন । দুপুরে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে খেলাম । এখানকার রেস্টুরেন্টে গুলোর প্রবেশ পথে লম্বা করিডোর থাকে ।অতিথিদের অভ্যাথনা জানানোর জন্য এধরনের করিডোর রাখা এখানকার ঐতিহ্য । খাবার আইটেম হল কাঁচা মাছ , পানিও ,কয়েক প্রকার সূপ , চিটচিটে ভাতের সাথে চিংড়ির লার্ভা ভাঁজি, সালাদ আর শুশি ।খাবার গুলোর স্বাদ মনে রাখার মত না হলেও নজরকাড়া পরিবেশন দীর্ঘ দিন চোখে লেগে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই । শুশি অসাধারন একটা খাবার,জাপানের ঐতিহ্যবাহী এই খাবার প্রস্তুত করতে ব্যাবহার করা হয় কাঁচা মাছ আর গাঁজানো ভাত ।
খাওয়া শেষে আমরা কিয়থো পরিদর্শনে বেরুলাম । প্রথমে যে মন্দিরে গেলাম তার নাম মনে আসছে না । তবে এটা জাপানিদের বিদ্যা দেবতার মন্দির । ধর্ম কর্মে জাপানিরা খুব একটা সময় ব্যয় করে না । আমার মনে হয় জাপানীদের কাছে ধর্ম হোলো নৈবেত্তিক ব্যপার । তাদের আসল ধর্ম হল সিস্টেম যা তারা শ্রদ্ধার সাথে পালন করে ।
বিদ্যার দেবতা গরু । গরু পরিশ্রমী প্রানি , বিদ্যাও পরিশ্রম করে অর্জন করতে হয় মজার ব্যাপার হোলো , এখানে গরু কে পূজা করে স্মার্ট হতে হয় । গরু স্মার্টনেস এর দেবতাও বটে। আমদের দলের সদস্য মিস ফারিয়া এবং মিস জেসিকা তাদের ইচ্ছার কথা একটা কাঠের প্লেটে লিখে নির্ধারিত স্থানে ঝুলিয়ে দিলেন তাঁরা দেবতার কাছে কি আশীর্বাদ চেয়েছিলেন জানি না তবে গত বছর প্রফেসর ইউনুস একই উপায়ে দারিদ্র মুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রতয়ের কথা জানিয়েছিলেন।
মিস নউমাছি অসাধারন একটা মহিলা । কাওকে অল্পসময়ের মধ্যে আপন করে নেবার অসাধারন গুন তার আছে । জাপানি ট্র্যাডিশনাল পোষাকে তাকে অসাধারন লাগছে । ট্র্যাডিশনাল পোষাক পরার একটা সুবিধা আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পেয়েছি । ট্যাক্সি চালক এই পোশাক পরার দরুন আমদেরকে বিশেষ ছাড় দিয়েছে । জাপানিদের নিজ ঐতিহ্যর প্রতি শ্রদ্ধ্যা দেখে আমরা বিস্মিত হলাম ।
কিয়থো ইউনিভার্সিটি ঘুরে দেখার সুযোগ হল । এটা জাপানের একটি প্রাচীন পাবলিক ইউনিভার্সিটি । জাপানের ষোল জন নোবেল বিজয়ীর মধ্যে এই ইউনিভার্সিটি আটজন নোবেল বিজয়ীকে ধারন করছে যার মধ্যে ২০১২ সালের নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইয়ামানাকা (Yamanaka) অন্যতম । এই ইউনিভার্সিটির স্মকিং জোন আমাকে বিশেষ ভাবে আকর্ষিত করেছিল কেননা আমি ভেবে ছিলাম এটা ধূমপান মুক্ত ইউনিভার্সিটি । তবে হ্যা এখানে সবজায়গায় ধূমপান করা যায় না , ধূমপান করতে হলে আপনাকে স্মকিং জোন খুজে বের করতে হবে এবং এটা সবাই মেনে চলে । আমি বুঝতে পারলাম কোন কিছু নিষেধ বা বাতিল করতে হলে আগে তার বিকল্প বের করতে হয় তবেই না সেই আইন কার্যকর করা সম্ভব হয় ।
কিওমিযু ডেরা (Kiumizu Dera) জাপানের অতি প্রাচীন একটি বুদ্ধ মন্দির । মূল স্থাপনা ৭৯৮ সালে তৈরি করা হলেও ১৬৩৩ সালে এটিকে সংস্কার করা হয় । বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া এই স্থাপনাটি যেন এক স্বর্গ পূরী । চারিদিকে ঘন সবুজ পাহাড় আর উপড়ে নীল আকাশ । তবে এই নীল আকাশ বেশীক্ষণ নীল থাকে না যখন তখন মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় ডেরাটিকে । বৃষ্টি সিক্ত ডেরা তখন অন্য এক রুপে হাজির হয় যে রুপ মায়াবি বন্য বালিকার মতো শুধু কাছে ডেকে নিতে চায় ।
পাহাড়ে কিছুদূর উঠতেই বৃষ্টি আরম্ভ হল । আমদের গাড়ির চালক দৌড়ে গেলেন ছাতা নিয়ে আসতে । তার ভদ্রতা দেখে আমি মুগ্ধ হলাম । পরে আমরা যতক্ষণ ডেরাই অবস্থান করলাম গাড়ী চালক ততক্ষন ছাতা নিয়ে আমাদের পিছু পিছু ঘুরলো । যদি আবার ছাতার প্রয়োজন হয় ।
আসলে কর্তব্য বোধ মানুষকে বড় করে । জাতি হিসেবে জাপানিরা খুবই কর্তব্য পরায়ণ তার প্রমান আমি বেশ কয়েকবার পেয়েছিলাম । আমি মনে করি জাপানিরা যে কাজ করে সেটা তারা আনন্দের সাথে করে । যে গাড়ি চালাই সে আনন্দের সাথে গাড়ি চালায় আবার যে রাস্তা ঝাড়ু দেয় সেও আনন্দের সাথে রাস্তা ঝাড়ু দেয় ।
রাতে প্রফেসর সিগিরু (Shigeru Imasato ) বাসায় দাওয়াত করলেন । ভদ্রলোক অবসর নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল ।এক জন ৭০ ঊর্ধ্ব বৃদ্ধ এত উদ্দম নিয়ে কাজ করতে পারে এটা আমদের আগে জানা ছিল না । তিনি আর তার স্ত্রী একটা ইউনিভার্সিটি পরিচালনা করছেন । এই ইউনিভার্সিটি বৈশিষ্ট্য হল এটা দিনে ইউনিভার্সিটি কিন্তু রাতে রেস্টুরেন্ট । তার উদ্ভাবিত অরগানিক সবজি দেখতে অনেকটা খেলনা , সত্যি সবজি বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ।
প্রফেসর সিগিরু আর তার জার্মান ও জাপানি ছাত্রদের আথিতিওতায় আমরা মুগ্ধ হয়েছি ।
প্রফেসর সিগিরুর বাসাটা অসাধারণ । কাঠের তৈরি এই বাড়িটিতে আধুনিক সব টেকনলজি ব্যাবহার করা হলেও জাপানি ঐতিহ্যকে সেটা অম্লান করতে পারেনি ।বাড়ির মাঝে ছোট উঠান, উঠানে স্বচ্ছ পানির জলাধার । জলাধারটিতে লাল নীল বাহারি মাছ খেলা করছে । এই বাড়ির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এর কোন সদর দরজা নেই তার পরিবর্তে আছে মোটা পর্দা । বাড়ির বাইরে জুতা রাখাতে জুতা চুরির ভয়ে আমরা বিচলিত ছিলাম । কিন্তু পরে জানতে পারলাম এখানে চুরির মত অতি স্বাভাবিক ঘটনা ঘটে না । বুঝলাম ধর্ম পালন না করেও এরা ধার্মিক ।
প্রফেসর সিগিরুর ইউনিভার্সিটি কাম রেস্টুরেন্টে আমরা
কিয়থো থেকে বিদায় নিতে হবে । পরদিন সকালে আমরা কিয়থো স্টেশনে ট্রেন এর জন্য অপেক্ষা করছি । কিয়থো থেকে ফুকুওকার (Fukuoka) দূরত্ব ৫১৭ কি.মি. । ভাড়া ১৫০০০ ইয়েন। জাপান ব্যায়বহুল শহর । সব কিছুর দাম আকাশ ছোঁয়া হলেও মানুষের মূল্য আরও বেশি । এখানে একজন শ্রমিক যা উপার্জন করে সেটা দিয়ে তারা বিলাসবহুল জীবন যাপনের ক্ষমতা রাখে আর সেই কারণে সমাজে তাদের যথেষ্ট মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । এ কথা অনুস্বীকার্য যে শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পূর্ব সর্ত হল শ্রমের যথাযথ মূল্য প্রতিষ্ঠা করা ।
আমদের ট্রেন ঘণ্টায় ২০০ কিমি গতিতে চলছে । ২ .৫ ঘণ্টা পর আমরা হাকাতা (Hakata) স্টেশনে পৌছাই । আমদেরকে রিসিভ করতে প্রফেসর ওকাদা (Masaharu Okada) এসেছেন আরও এসেছেন প্রফেসর ওসুজি (Osuji) এবং প্রফেসর আশির । সাগর আর পাহাড়ে ঘেরা ফুকুওকা । এটা জাপানের বন্দর নগরী। বিশ্বের ১৬ টি বসবাস যোগ্য শহরের মধ্যে ফুকুওকা ১২ তম ।বাঙালি খাবারের জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে গেছি । আমদেরকে নেপালি রেস্টুরেন্টে নেওয়া হল কিন্তু খাবারে নারকেলতেল ব্যাবহারের জন্য আমি বেশ সুবিধা করতে পারলাম না । দুপুরের খাবার শেষে আমরা কিউশু ইউনিভারসিটিতে (Kyushu) গেলাম । পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠা এর নতুন ক্যাম্পাস সত্যি অসাধারণ ।আমদের দলের সহকর্মী বিখ্যাত ফটোগ্রাফার নাসির আলি মামুন জাপান সাগর দেখার বায়না ধরছেন । ৬0 বছরের বৃদ্ধের মধ্যে যে শিশুটি বিরাজ করে এটা যেন তার আবদার । জাপান সাগর ভ্রমনের কর্মসূচী না থাকলেও ৬0 বছরের শিশুর আবদার রাখা হল । আমদের গাড়ী জাপান সাগরের বিচের দিকে চলেছে । সাগরের পাড়ে সারি সারি কটেজ । প্রত্যেক কটেজের সামনে বাহারি বনসাই । জাপানে এই প্রথম পাখির দেখা মিলল এর আগে কবুতর বাদে অন্য পাখি দেখার সুযোগ হয়নি ।
আমরা জাপান সাগরের বীচে । পাহাড়ে ঘেরা নীল সাগর । সাগরে এসে সবার মাঝের ঘুমন্ত শিশুটি জেগে উঠেছে । কেউ ছবি তুলছে , কেউ বালি নিয়ে খেলছে কেউ বা পানিতে ঝাপ দেবার আয়োজন করছে । প্রফেসর আশির , প্রফেসর মাসুদ দুরন্ত কিশোরের মত বিশেষ এক ঝুলনায় উঠে ঝুলতে লাগলেন । সাগরে না নামার সংকল্পে অটুট প্রফেসর নাজমুল আর থাকতে পারলেন না । তিনিও আমদের সাথে যোগ দিলেন । সাগরের বিশালতা মানুষকেও বিশাল করে তার প্রমান পেলাম ।
জাপান সাগরের তীরে , প্রফেসর আশির আহমেদ
বিকালে সোশ্যাল বিজনেস রিসার্চ সেন্টারে আমাদের সম্মানে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে । তার আগে মিস ইকো কাই (Eiko Kai) এবং প্রফেসর ওসুজি ফুকুওকা শহর ঘুরে দেখালেন । ফুকুওকা টাওয়ার , জাপান ডোম এবং সাগরের কোল ঘেঁষে চলা দ্বিতল রাস্তা আমদের নজর কারল । প্রত্যেক গাড়িতে রক্ষিত ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অটোমেটিক ভাবে উড়াল সড়ক এবং সেতুর টোল আদায় করা হয় ।
যখন সোশ্যাল বিজনেস রিসার্চ সেন্টারে পৌছাই তখন সূর্য নিবু নিবু করছে । এটা এশিয়ার প্রথম সোশ্যাল বিজনেস রিসার্চ সেন্টার। সোশ্যাল বিজনেস ধারনা প্রচার এবং প্রসারের লক্ষ নিয়ে ২০১০ সালে এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে কিউশু ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাসে ।
প্রফেসর ওকাদা আমদেরকে স্বাগতম জানালেন । তিনি রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক । রিসার্চ সেন্টারে আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু আনানের সাথে দেখা হল ।আনানের সাথে এটি ছিল আমার প্রথম সাক্ষাৎ, গত বছর ও বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশের অশান্ত রাজনীতির পেক্ষাপটে সফর বাতিল করা হয় । পার্টিতে একঝাক জাপানি তরুন আমদের সাথে যোগ দিয়েছে । তারা ইউনুস সোশ্যাল বিজনেস ক্লাবের সদস্য । বাংলাদেশ নিয়ে তাদের নানান ভাবনা আমদেরকে অভিভূত করেছে । কয়েকজন বাঙ্গালিও আমদের সাথে আড্ডা দিতে এসেছেন ।
প্রফেসর ওকাদাকে অবাক করে দিয়ে আমরা তার ৬o তম জন্মদিন পালন করলাম । গান, আড্ডা আর জাপানিদের হাতে তৈরি বাংলাদেশি খাবারে আমাদের পার্টী এগিয়ে চলল । জাপানের বরফ মিশ্রিত ঠাণ্ডা চা (চিনি বিহিন) আমার ভাললাগতে শুরু করলো, এতদিন আমি এই চা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছি রাত বাড়তে লাগলো ।আমাদের পার্টী শেষ হল । আমরা বিদায় নিলাম হোটেলের উদ্দেশে । রাতের ঝলমলে জাপান দেখতে দেখতে আমদের গাড়ী এগিয়ে চলল । সাগরের শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগছে, সাগরের বুকে জেগে উঠছে কৃত্রিম দ্বীপ, দ্বিপের উপর জেগে উঠছে নতুন নতুন শহর ।
আজ সকাল দশটাই আমাদের ফ্লাইট । আমরা ফুকুওকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে । পাহাড়ের পাদদেশে এই বিমানবন্দরটি তৈরি করা হয়েছে । মিস ইনুয়ি (Ryoko Inoue) যে আমদের সাথে সবসময় ছিলেন তিনি বিদায় জানাতে এসেছেন । বিমানবন্দরেও ঝিঁঝিঁ পোকা সুরের লাহিড়ী তুলেছে তবে তাদের গানে আজ বিদায়ের সুর ।