'ভেজাল থেকে রেহাই মিলবে কি?'- [যুগান্তর, ২৫ মে, ২০১৯ (পৃষ্ঠা নং ৪)]

Author Topic: 'ভেজাল থেকে রেহাই মিলবে কি?'- [যুগান্তর, ২৫ মে, ২০১৯ (পৃষ্ঠা নং ৪)]  (Read 1138 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
ভেজাল থেকে রেহাই মিলবে কি?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
২৫ মে ২০১৯ [যুগান্তর, ২৫ মে, ২০১৯ (পৃষ্ঠা নং ৪)]

ভেজালযুক্ত খাদ্য থেকে জনগণ মুক্তি চাইলেও যেন কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না। তবে একদিনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতির ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভেজালমুক্ত খাদ্য যেমন দেহের ক্ষয় পূরণ, বৃদ্ধি সাধন এবং রোগ-প্রতিরোধ করে, তেমনি ভেজালযুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবন বিপন্ন পর্যন্ত হতে পারে। তাই ‘সকল সুখের মূল’ নামক স্বাস্থ্যকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে ভেজালমুক্ত খাবার গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের দেশে শাকসবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংস, দুধ, গুড়, মসলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যই ভেজালে পরিপূর্ণ।

এমনকি এদেশে শিশুখাদ্যসহ জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মেশানো হয়েছে এবং ভেজালযুক্ত ওষুধ খেয়ে অনেক শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। আবার এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত ছাড়ও পেয়েছেন, যা গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়।

বলাবাহুল্য, নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এমনই এক বিষয় যে, এক্ষেত্রে কাউকে ন্যূনতম ছাড় পর্যন্ত দেয়ার সুযোগ নেই। অথচ আমাদের দেশে বাস্তবে ঘটছে উল্টো ঘটনা। অনেক সময় দেখা যায়, ফল পাকানোর ক্ষেত্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে।

ফল পাকানোয় ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিকের কিছু অংশ ফলের খোসার সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আর এ ধরনের ফল খাওয়ার ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের অংশবিশেষ শরীরে ঢুকে পড়ে লিভার, কিডনিসহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে থাকে।

বিকল্প উপায় না থাকায় জনগণকে এক ধরনের বাধ্য হয়েই এসব ভেজাল খাদ্য খেতে হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই মারা যাচ্ছে।

খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল (যেমন- ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার বা পিপিটি, ইথেফেন ইত্যাদি) মেশানোর বিষয়টি দেশে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত ও নিন্দিত হয়ে এলেও জনগণ যেন এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে শিল্পখাতে ফরমালিনের প্রয়োজন ৪০-৫০ টন। কিন্তু গত অর্থবছরে ফরমালিন আমদানি করা হয়েছে ২০৫ টন। তার মানে বাড়তি ১৫০ টনের বেশি ফরমালিন বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে দেশবাসীর পেটে গেছে।

অনেক সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে বিভিন্ন বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করতে দেখা যায়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ফরমালিনমুক্ত ঘোষিত ওই বাজারে নিয়মিত কোনো পরীক্ষাই করা হয় না।

ভেজালযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে অগণিত শিশু, যাদের বলা হয় আগামীর ভবিষ্যৎ। এ ধরনের পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সবার জন্যই উদ্বেগজনক।

আমাদের পুরো খাদ্যচক্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাতে করে মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা বেশ দ্রুতগতিতেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অথচ এসব বন্ধ করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তেমন কোনো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না, এমনকি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ প্রশাসন’ ধরনের কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান।

শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালতের নির্দেশ জারির দীর্ঘদিনেও খাদ্যে ভেজাল রোধে সারা দেশে স্বতন্ত্রভাবে খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি।

অবস্থা এমন যে, জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। খাদ্যে ভেজাল রোধে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যেই যেন কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। অথচ এর মাধ্যমে দূরদর্শিতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রতি বছর ১৫ মার্চ এলে ঘটা করে ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়।

সারা দেশ ভেজালযুক্ত খাদ্যে সয়লাব হওয়ার প্রেক্ষাপটে কনজ্যুমার রাইটস সোসাইটি এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একসঙ্গে আন্দোলন করার পর ২০১০ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গঠন করা হয়। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটি বিশেষজ্ঞনির্ভর না হয়ে আমলানির্ভর হওয়ায় তা অনেকটা অচল হয়ে রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর নামক এ প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো কার্যকর তৎপরতা নেই বললেই চলে।

কর্তৃপক্ষের অব্যাহত গাফিলতি এবং দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বহীনতার কারণে কোনোভাবেই খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবেই চলছে মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর ভেজাল খাদ্য খেয়ে তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন মরণব্যাধি ক্যান্সারে। আর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ডায়াবেটিস ও প্রায় দুই লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশু ও গর্ভবতী মহিলারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ভেজাল খাদ্যের ফলে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয় এবং গর্ভজাত অনেক শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে।

শিশুখাদ্যে ভেজাল মেশানো ও ভেজাল খাদ্যের কারণে শিশুর বিকলাঙ্গ হওয়া আগামী প্রজন্মের জন্য নিঃসন্দেহে একটি অশনিসংকেত। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে বেশি মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছে।

অনেক সময় এদের কাউকে হাতেনাতে ধরা হলেও তারা ঘুষ, পেশিশক্তিসহ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা এবং জনগণ সচেতন ও সোচ্চার না হওয়ায় খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে আগামীতে এর কুফল কী ভয়ানক ও বিপজ্জনক হবে, তা সময়মতোই টের পাওয়া যাবে।

খাদ্যে ভেজাল রোধ এবং খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন নিয়ন্ত্রণে এদেশে একটি আইন রয়েছে- যার নাম ‘বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ-১৯৫৯’। কিন্তু এ আইনটি প্রচলিত হওয়ার পর এর বেশিরভাগ বিধানই কার্যকর না হওয়ায় তা মূলত কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।

তাছাড়া পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় যারা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা, তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের রাস্তাটা খুলে দিয়েছে। শাকসবজি, ফল-মূল, গুড়, মুড়ি, মাছ-মাংস, দুধ, মসলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের খাদ্যসামগ্রীতে বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে বেশি মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে এসব বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছেন।

অনেক সময় এদের কেউ হাতেনাতে ধরা পড়লেও টাকা ও পেশিশক্তির জোরে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা, সর্বোপরি জনগণের অসচেতনতার কারণে খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে তা কী ভয়ানক বিপদ ডেকে আনবে, ভাবলে গা শিউরে ওঠে। তখন হয়তো করার মতো তেমন কিছুই থাকবে না।

আশার কথা, সরকার সম্প্রতি ফরমালিন আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। এর পাশাপাশি ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ যেন বাস্তবায়িত হয় সেই লক্ষ্যে নিরলসভাবে সবার কাজ করে যাওয়া উচিত। এ আইনে খাদ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর অভিযোগে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্য নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন ছাড়া খাদ্য বিপণন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত এমন কাউকে দিয়ে খাদ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

তবে স্মরণ রাখতে হবে, কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। সরকার জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে দেশের সব জেলায় খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা করতে আন্তরিক হবে বলে সবার প্রত্যাশা। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকার ও গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন; প্রয়োজন নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তবে খাদ্যে ভেজাল রোধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রত্যেকের নৈতিকতাবোধ ও বিবেক জাগ্রত করা।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/181191/%E0%A6%AD%E0%A7%87%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BF
Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd