১৯৯৯ সাল। টেক্সটাইলে চতুর্থ বর্ষ চলতেছে। আমাদের টেক্সটাইলের কারিকুলাম অনুযায়ী দুই মাসের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং চলবে। আমি ছিলাম এডভান্সড ফেব্রিক মান্যুফ্যাকচারিং্যের ছাত্র। সেই হিসেবে আমার তিনটা ফ্যাক্টরিতে ট্রেনিং করতে হবে। উইভিং এ ১ মাস, নিটিং এ ২০ দিন ও জুট ফ্যাক্টরিতে ১০ দিন ট্রেনিং ঠিক করে দেয়া হল কলেজ থেকে। উইভিং ফ্যাক্টরি ঠিক হল শামসুল আল আমিন কটন মিলস লিমিটেড। আমি থাকি উত্তরাতে। আর শামসুল আল আমিন কটন মিলস হল নারায়নগঞ্জে। প্রতিদিন সকালে ৭ঃ১৫ তে উত্তরা থেকে বি আর টি সি দোতালা বাসে উঠি। সোজা চলে যাই গুলিস্থান। (ঢাকায় তখনও জ্যাম ছিল। তবে এতটা নয়।) গুলিস্থান থেকে লক্কর ঝক্কর বাসে করে যাই আদমজী জুট মিলে। সেখানে পৌছে যতটুকু মনে পড়ে রিক্সা নিতে হত। রিক্সায় পৌঁছুতাম শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে। নদীর অন্যপারে ছিল শামসুল আল আমিন কটন মিলস। নদীর ঘাটে পৌঁছুলে সেখানকার ফ্যাক্টোরির গার্ড অপরপারে পতাকা দেখাতেন। তখন ফ্যাক্টোরির ইঞ্জিনচালিত নৌকা এইপারে এসে আমাদের নিয়ে নদী পার হয়ে অপরপারে পৌছে দিত। মনে আছে আমরা ফাইনালি ফ্যাক্টরিতে পৌঁছুতাম ঘড়ির কাটা যখন ১০ঃ৩০ এ থাকতো।
১ মাস সেইখানে প্রতিদিন গেলাম। এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। এই ফ্যাক্টরিটি ছিল অনেক পুরানো। ফ্যাক্টরিটি আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে রানিং ছিল। আর পুরানো অংশটি সেই কোন ব্রিটিশ টাইমের যন্ত্রপাতি নিয়ে স্থবির পড়ে থাকতো। সেই অংশের স্মৃতি এখনও মনে দাগ কেটে আছে। সেই অংশের সকল যন্ত্রপাতি ধুলোর পুরো আস্তরে ঢাকা ছিল। পুরো অংশটিতে একেবারে ছাদ থেকে মাকড়শার জালে আলপনা কাঁটা ছিল। সূর্যের দিনের আলো যতটুকু ঢুকতে পারতো সেই অল্পটুকুই আলোকিত হত। সেখানে লাইটের কোন ব্যাবস্থা ছিল না। বিশাল শেডে এক ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করতো।
আমি এমনিতেই খুব নস্টালজিয়া উপভোগ করি। আমার মনে হল আর মানুষ পাইলো না। আমি অভিভূত যে আমি এইরকম একটি জায়গা দেখতে পেয়েছি। স্থবির যন্ত্রপাতির মাঝে কল্পনার চোখে ভেসে উঠত আগের সেই ব্যস্ত মানুষের সারাদিনের কর্ম চাঞ্চল্য। সেইখানে আরেকটি মজার জিনিষ দেখেছিলাম। সেইটা হল একটি পুরানো বিশাল বয়লার। এই বয়লারটির নীচে বিশাল একটি উনুন বা চুলা। নীচের এই চুলাতে কয়লা জ্বালিয়ে বয়লারটি থেকে বাষ্প তৈরি করে ফ্যাক্টরিতে বিভিন্ন কাজের জন্য সাপ্লাই দেয়া হত। এখন তার সব ব্যস্ততা শেষ হয়ে গেছে। অলস পড়ে আছে অতীতের সাক্ষী হিসেবে।
আমরা সব জিনিসের লেটেস্ট টেকনোলজি নিয়ে অনেক কর্ম ব্যস্ত সময় কাটাই। আমাদের নিঃশ্বাস ফেলার সময় নাই। আমার সব সময়ই মনে হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং এর শুরুর প্রাথমিক বিষয় গুলো শেখার জন্য কনভেনশনাল মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতিই বেশী উপযুক্ত। কেননা সেখানে খালি চোখেই বিভিন্ন মেকানিজম কিভাবে কাজ করে তা সহজেই দেখা যায়। আর প্রাথমিক টপিক গুলো পরিস্কার ভাবে বোঝা হয়ে গেলে আধুনিক মেশিনের সাহায্যে শেখা অনেক দ্রুত ও সহজ হয়। আমার মতে নিটিং শেখার জন্য প্রথমে হোস নিটিং মেশিন ও ভি বেড নিটিং মেশিন সব থেকে সহজ। একই ভাবে উইভিং শেখার জন্য কনভেনশনাল শাটেল লুম দিয়ে শুরু করা উচিৎ।