আলকাপ গানকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন [কালের কণ্ঠ]

Author Topic: আলকাপ গানকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন [কালের কণ্ঠ]  (Read 1049 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
আলকাপ গানকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
২০ মে, ২০১৯ 

গম্ভীরা গানের মতো বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী ও নিজস্ব লোকসংগীত ‘আলকাপ’। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গম্ভীরার চর্চা এখানে এখন পর্যন্ত কিছুটা থাকলেও আলকাপের চর্চা এখন একেবারে নেই বললেই চলে। এমনকি বর্তমান প্রজন্মসহ শহুরে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও জানে না আলকাপ গান কী? অথচ নাচ-গান, বন্দনা-ছড়া, নাটকীয় পালাসহ নানা আয়োজনে এ রকম সমৃদ্ধ লোকসংগীত বাংলাদেশে খুব কমই চোখে পড়ে। ‘আলকাপ’ একটি আরবি শব্দ, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে মসকরা, ঢং বা কৌতুক। এটি এক ধরনের পালাগান বা অন্য অর্থে লোকনাট্য। এই গান পালাগানেরই একটি অঙ্গ। অনেকটা কবিগানের মতোই বিভিন্ন আসরে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে। এই ধরনের গানের প্রধান উপজীব্য হলো ছড়া ও গান। লৌকিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাসহ নানা ধরনের বিষয় আলকাপ গানের মধ্যে লক্ষ করা যায়। তবে রাধাকৃষ্ণের কথা আলকাপ গানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। লৌকিক জীবন নিয়ে যে ছড়া আলকাপের গানে স্থান পায়, তা সব সময় শ্লীল হয় না। গ্রাম্য জীবনের সহজ-সরলতা এই গানের সহজ বিশেষত্ব। মুসলমান সমাজের বিশাল অংশের মধ্যে একসময় এই গান আদৃত হলেও ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্য সংস্কৃতির চাপে এর প্রচলন কমে আসছে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে আলকাপ গানের চর্চা শুরু হলেও বিশ শতকের গোড়ার দিকে গৌড়ীয় অঞ্চলে আলকাপের একটি উল্লেখযোগ্য বিকাশ লক্ষ করা যায়। আর আলকাপ গান তখন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে জনপ্রিয় ও পেশা হিসেবেও বেশ লাভজনক হয়ে উঠেছিল। আগের দিনে সাধারণত পূজা-পার্বণ, নবান্ন-অন্নপ্রাশন, বিয়েবাড়ি, বৈশাখী মেলা উপলক্ষে আলকাপ গানের আয়োজন করা হতো। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ গৌড়ীয় অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় আগের মতো পূজা-পার্বণ, নবান্ন-অন্নপ্রাশন, বিয়ে, বৈশাখী মেলাসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান হলেও সেখানে আর আলকাপ গানের অনুষ্ঠান হতে দেখা যায় না। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আলকাপ শিল্পীর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪১৯ জন। বর্তমানে যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫২ জনে, যাদের মধ্যে বেশির ভাগ শিল্পীই অনিয়মিত।

আলকাপ গানের দল গঠনের দিকে তাকালে দেখা যায়, আলকাপ গান অন্যান্য গানের মতো নয়। একটু আলাদা। আলকাপ গানের দলের প্রধানকে সরকার বা মাস্টার বলা হয় আর তার সঙ্গে থাকে একজন ভাঁড়, যাকে আলকাপের ভাষায় ‘কাপ্যাল’ বলা হয়। আলকাপ গানে সরকার এবং কাপ্যালের চরিত্র সব সময় দুই ভাই হিসেবে দেখা যায়। এই দলে আরো থাকে দুজন পুরুষ মানুষ, যারা গানের সময় মেয়ে সেজে নাচ-গান আর অভিনয় করে। তাদের ‘ছোকরা’, ‘ছুকরি’ বা ‘ছুরকি’ নামে ডাকা হয়। গানের দলে থাকে কয়েকজন যন্ত্রবাদক। তারা বিশেষ করে ঢোলক, হারমোনিয়াম, ডুগি, তবলা, খঞ্জনি, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। সম্পূর্ণ গানের দল গানের আসরেই বসে থাকে। যন্ত্রীরা বসে থেকেই বাদ্যযন্ত্র বাজায় আর সরকার, কাপ্যাল, ছোকরা এবং আরো দু-একজন, যারা অভিনয় করে, তারা অভিনয়ের সময় আসরের মাঝখানে নির্ধারিত জায়গায় অভিনয় করে। আলকাপ গানের আসরে দর্শক-শ্রোতারা মাঝখানে কিছু জায়গা ফাঁকা রাখে। আগের দিনে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আলোর উৎস হিসেবে আলকাপ গানে ব্যবহার করা হতো হ্যাজাক লাইট। আলকাপ গানের আসর চলাকালে বাদ্যযন্ত্রী, দোহার, অংশগ্রহণকারী কলাকুশলী, সরকার (আলকাপ রচয়িতা), ছোকরা এবং লাবাড়া (জোকার) গোল হয়ে বসে। আর তাদের বসার পরে মাঝের ফাঁকা গোলাকার জায়গাটুকু হচ্ছে আলকাপের মঞ্চ। আর এ মঞ্চেই চলে নাচ, গান ও অভিনয়। চরিত্র অনুযায়ী অভিনয়ের সময় দাঁড়িয়ে অভিনেতারা অভিনয়ে নৈপুণ্য প্রদর্শন করে থাকে। আগমন-নির্গমন, পদচারণ, ছোকরার নাচ—সব কিছুই একই স্থানে হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, আলকাপ গানে কোনো নারী অংশগ্রহণ করে না। পুরুষের মধ্য থেকে সুন্দর ও মিষ্টি চেহারার অল্প বয়সী কেউ মেয়েদের পোশাক পরে ছোকরা সেজে নারীর অভিনয় করে। অভিনেতা, ছোকরা ও সরকার ছাড়াও আলকাপ গানে একজন হারমোনিয়াম বাদক, তিন-চারজন জুড়ি বাদক, একজন তবলা বাদক, এক থেকে দুজন জোকারসহ আরো ছয়-সাতজন শিল্পী অংশগ্রহণ করে। আলকাপ গানের মূলে থাকে ছয়টি অংশ। এগুলো হলো—জয়, আসর বন্দনা, দেশ বন্দনা ও অন্যান্য ছড়া, খ্যামটা, ফার্স বা দ্বৈতসংগীত এবং আলকাপ পালা। আলকাপ গানের সূচনায়ই যন্ত্রসহযোগে মিউজিক বাজানো হয়। একে ‘গদ’ নামে অভিহিত করা হয়। এর পরপরই সমবেত কণ্ঠে দলের সরকার, দেবী সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক প্রমুখের নামে ‘জয়’ দেওয়া হয়। যেমন—‘সরস্বতী দেবী কি জয়...’ ইত্যাদি। আর বন্দনা আলকাপ গানে তার জন্মলগ্ন থেকেই রয়েছে। এসব বন্দনা হচ্ছে শিব বন্দনা, গণেশ বন্দনা, কার্তিক বন্দনা ইত্যাদি। বন্দনার পর সরকার দাঁড়িয়ে দেশ বন্দনা ও ছড়া বন্দনা পরিবেশন করে থাকে। দেশ বন্দনার পর যন্ত্রে প্রথমে খ্যামটার সুর বাজানো হয়। খ্যামটার সুর অনুসরণ করে ছোকরা নৃত্য ও গান পরিবেশন করতে থাকে এবং এ নাচ-গান দর্শক-শ্রোতাকে অভিভূত করে তোলে। প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে দুজন শিল্পী ফার্স বা দ্বৈত গান পরিবেশন করে থাকে। ছোকরার নৃত্য শেষ হলে একজন গায়ক বন্দনা ছড়া পরিবেশন করে। আর এ ছড়া শেষ হলেই শুরু হয় অভিনয়সহ আলকাপ পালা। আলকাপ পালায় সাধারণত সমাজ ও পারিবারিক জীবনের চিত্র প্রতিফলিত হয়ে থাকে। আলকাপ গান বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচিত হয়ে থাকে। যেমন ঐতিহাসিক বিষয় সম্পর্কিত আলকাপ (যেমন—কৃষক আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ); সমাজ সমস্যামূলক আলকাপ (যেমন—যৌতুক, মাদক, দুর্নীতি); ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কিত আলকাপ (যেমন—মহররমের বিয়োগান্তক ঘটনা, মনসা-চণ্ডীর কাহিনি); শিল্পসম্পর্কিত আলকাপ (যেমন—রেশমশিল্প, কুটিরশিল্পের বর্ণনা), ব্যক্তিপরিচিতিমূলক আলকাপ (যেমন—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইত্যাদি)।

আলকাপ গানের অবলুপ্তির কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের ফলে বহু হিন্দুর (যারা বিভিন্নভাবে আলকাপ গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল) এ দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়া, পেশা হিসেবে আলকাপ শিল্পীদের পারিশ্রমিক অতি নগণ্য এবং তা অলাভজনক হওয়া, বিভিন্ন দলে সরকারদের শিল্পী ও ছোকরা নিয়ে দ্বন্দ্ব ইত্যাদি। যারা এই পেশার সঙ্গে অনেক দিন ধরে যুক্ত ছিল, তারা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বয়সের কারণে। এখনই এই লোকসংগীত রক্ষা করতে না পারলে হয়তো একসময় কেউই থাকবে না আলকাপ গান করার জন্য। তখন আর হয়তো কোথাও বসবে না আলকাপ গানের আসর। বলা বাহুল্য, সময়ের সঙ্গে জনগণের রুচিবোধের পরিবর্তন, সরকারি ও বেসরকারিভাবে এ গানের রক্ষণাবেক্ষণ ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতার যথেষ্ট অভাব, দ্রুত নগরায়ণের বিকাশ ঘটাসহ তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার লাভের ঘটনা আলকাপ গানের অবলুপ্তির অন্যতম কারণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, অবলুপ্তপ্রায় লোকসংগীত আলকাপ গানকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে একে সংগ্রহ ও যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে এ গান বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের বৈচিত্র্যের ভাণ্ডারে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। তা ছাড়া ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র মতো সারা পৃথিবীর লোকসংগীতপ্রিয় গবেষকদের দৃষ্টিনন্দিত হবে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেশীয় ঐতিহ্যবাহী এ লোকসংগীতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ প্রয়োজন সবার আন্তরিক প্রয়াস, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি;
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/05/20/771217
Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd