বর্তমান বিশ্বে টেলিভিশনই সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম। ঘটনা ও বিষয়ের বিবরণ শোনার পাশাপাশি সেসবের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক চিত্র তাতে দেখা যায় বলে সহজেই তা মানুষকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী না হয়েও সচক্ষে সেটি দেখতে পাওয়া অবশ্যই একটি চিত্তাকর্ষক ব্যাপার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া অসংখ্য মানুষের ও আগুনে পুড়ে যাওয়া অগণিত ঘরবাড়ির ছবি টেলিভিশনে দেখে মুক্তিযুদ্ধ না-দেখা বহু মানুষও ঘটনার বিভৎসতা উপলব্ধি করতে পারে। আবার সরাসরি মাঠে উপস্থিত না থেকেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের লাখ লাখ মানুষই-যে ৩০ মে থেকে যুক্তরাজ্যে শুরু হওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেট চরম উত্তেজনা নিয়ে উপভোগ করছে, তাও এই টেলিভিশন আছে বলেই। অনুর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদেরকে পোলিও টিকা খাওয়নোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-যে বিশ্বে শীর্ষস্থান অধিকার করতে পারলো, সে ক্ষেত্রেও টেলিভিশনভিত্তিক প্রচারপ্রচারণার অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। তো, এই যে এত প্রভাবশালী গণমাধ্যম, সে মাধ্যমটি মানুষের মধ্যে এরূপ বহুমাত্রিক প্রভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে ভাষা ব্যবহার করছে, বাংলাদেশে তার হালহকিকতটি কেমন? জবাবটি বাঙালি টেলিভিশন দর্শকমাত্রেরই কমবেশি জানা আছে। তারপরও বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত কিছু নমুনা সামনে রেখে এ নিয়ে এখানে খানিকটা আলোকপাত করার চেষ্টা করা হলো।
একমাত্র খবর বা সংবাদ ব্যতীত বাংলাদেশভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অধিকাংশ অনুষ্ঠানেই শুদ্ধ বাক্য ও শব্দ সম্বলিত প্রমিত মানের ভাষা ব্যবহার একেবারেই লক্ষ্য করা যায় না। এমনকি প্রমিত মানের খবরের ভেতরেও যেসব মাঠ-প্রতিবেদন থাকে, সেগুলোর ভাষাও আবার প্রমিত পর্যায়ের নয়--উচ্চ মানসম্মততো নয়ই। নাটক বা চলচ্চিত্রের কথা যদি বাদও দিই (নাটক ও চলচ্চিত্রে পাত্রপাত্রী, স্থান ও সময়ভেদে অপ্রমিত ভাষার ব্যবহার থাকতেই পারে), তাহলেও এ বক্তব্য প্রায় সর্বাংশে সত্য বলে দাবি করা যায়। আর টেলিভিশনের স্ক্রল ও অন্যান্য লেখাজোখায় যেসব বাক্য ও বানান থাকে, সেগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম করুণ। বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করার জন্য এবার কিছু উদাহরণ টানার চেষ্টা করা যাক।
এই সেদিনও প্রশ্নপত্রের উপর লেখা থাকতো, ‘সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ দোষণীয়’। তো, এই সাধু ও চলিত রীতির উর্ধ্বে ওঠে সকল অনুষ্ঠানে (নাটক ও চলচ্চিত্রের কথা বাদ) যেকোনো একটি রীতিতে কথা বলার প্রমাণ বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে আছে কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সাধু ও চলিতের মিশ্রণ থেকে এবার আসা যাক বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণ প্রসঙ্গে। টেলিভিশনের অধিকাংশ পাত্রপাত্রীই এ দোষে দুষ্ট। এবং সত্যি কথা বলতে কি, এ মিশ্রণ এড়িয়ে যেকোনো একটি ভাষায় কথা বলার মতো পর্যাপ্ত ভাষাজ্ঞান ঐ পাত্রপাত্রীদের বেশির ভাগেরই আছে কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকর’-এর ছায়া পড়ে এদের অনেকে আবার বাংলার সাথে ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলতে পারাটাকে বাড়তি সামর্থ বলেও মনে করেন। যদিও তিনি বুঝেন না বা বুঝতে পারেন না যে, এটি তার দুর্বল ভাষাজ্ঞানেরই বহিঃপ্রকাশ। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আছেন, যাদের ন্যূনতম ব্যাকরণ জ্ঞানও নেই--না বাংলায়, না ইংরেজিতে। টেলিভিশনের পর্দায় বহু ‘শিক্ষিত’ লোকজনও বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে কথা বলতে যেয়ে বহুবচনের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত ও অন্যান্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পাত্রপাত্রীদের কাছে এ ধরনের অধঃমানের বহুবাচনিক কথাবার্তা যেন অনেকটাই ফ্যাশনের মতো। তারা বলেন: ‘‘আমার ফ্যানসদেরকে জানাই, আমি আমার সকল ভিউয়ারগণের ওপিনিয়নসগুলোকে মূল্য দিই’’।
এখানে ফ্যান, ভিউয়ার ও ওপিনিয়ন--এই প্রতিটি শব্দের চমৎকার বাংলা প্রতিশব্দ থাকা সত্তে¡ও এখানে তারা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছেন। দ্বিতীয়তঃ এই তিনটি শব্দের ক্ষেত্রেই প্রতিবার তারা দু’বার করে বহুবচন ব্যবহার করছেন, যা ভাষাজ্ঞানের ব্যাপারে তাদের চরম অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু টেলিভিশনের বাংলাভাষী দর্শকশ্রোতাকে অত্যন্ত নিম্মমানের এ অত্যাচার অনেকটা যেন অসহায়ের মতোই সয়ে যেতে হচ্ছে।
বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের কথা না হয় বাদই দিলাম। সংবাদের ভেতরও দেখি এই একই ধারার অত্যাচার। প্রায় সব টিভি চ্যানেলের অধিকাংশ মাঠ প্রতিবেদকের প্রতিবেদনেই শুনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে ‘কিন্তু’ ব্যবহারের প্রবণতা, আর ভেতরে দোষণীয় মাত্রায় সাধু ও চলতি শব্দের মিশ্রণ এবং কখনো কখনো অতিনিম্মমানের শব্দচয়ন। টেলিভিশনের সংবাদকর্মীদের জন্য ন্যূনতম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাটা কি খুব ব্যয়বহুল কিংবা ন্যূনতম মানসম্পন্ন সংবাদকর্মীর কি বাংলাদেশে এতোটাই অভাব? নাকি ভালো মানের কর্মীর জন্য-যে কিছুটা ভালো বেতনভাতাও দরকার, সংশ্লিষ্ট মালিকপক্ষ সেটা ব্যয় করতে চান না বলেই ‘কিন্তু’মুক্ত ভালো মানের সংবাদকর্মীর দেখা মিলছে না? অবশ্য সংবাদের জন্য বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণমুক্ত পান্ডূলিপি তৈরির ব্যাপারে সংবাদ-সম্পাদনা বিভাগের দায়িত্বই সর্বাধিক। কিন্তু দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব কিংবা মনোযোগের ঘাটতি, যে কারণেই হোক, এ ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে, যা রুচিবান শিক্ষিত দর্শক-শ্রোতার জন্য সত্যি অস্বস্তিকর। অথচ, সামান্য কিছু বাড়তি অর্থ ব্যয় করলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্তে¡ও এটি নিরন্তর ঘটে চলেছে যা দেখে মনে হচ্ছে যে, এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা অর্থ নয়--আসল ঘাটতি উদ্যমের এবং তারচেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে, ঘটনাটি যে মানহীন তা উপলব্ধি করতে পারার দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।
টেলিভিশনের বিভিন্ন মাত্রিক পরিবেশনার মধ্যে সর্বাধিক দৃষ্টি আকর্ষক, প্রভাবশালী ও কার্যকর অনুষঙ্গ সম্ভবত এর স্ক্রলবার্তা। স্ক্রলে প্রচারিত তথ্য ও সংবাদ খুব সহজেই দর্শকের চোখে পড়ে এবং অনেক সংবাদ ও তথ্যের সারাংশ হিসেবে এটিকেই সে গ্রহণ করে। শিশু-কিশোর বয়সী যেসব দর্শকের কাছে সংবাদ ও তথ্য অনেকটা কম আবর্ষণীয়, স্ক্রলবার্তা তাদেরকেও কমবেশি আকর্ষণ করে বা আকর্ষণ না করলেও সহজ দৃষ্টিগ্রাহ্যতার কারণে এটি তাদের চোখ এড়িয়ে যায় না। অথচ স্ক্রলে প্রচারিত তথ্য ও সংবাদেই ভুল বানান ও ভাষার আধিক্য থাকে সর্বাধিক। এটি একদিকে শিক্ষিত-সচেতন দর্শকের জন্য পীড়াদায়ক ও অস্বস্তিকর, অন্যদিকে তেমনি তরুণ শিক্ষার্থী দর্শকদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ এসব ভুল বানান ও ভাষা দেখে নিজেদের অজান্তেই তারা এসব শিখে ফেলছে, যার ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হতে বাধ্য। স্ক্রলে সংবাদ ও বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে সেগুলো যথাযথভাবে সম্পাদনার কোনো ব্যবস্থাই কি টিভি চ্যানেলগুলো করতে পারে না? বিজ্ঞাপনের ভাষা ও বানানের ব্যাপারে তারা হয়তো বলবেন যে, এটি বিজ্ঞাপনদাতাদের দায়িত্ব। কিন্তু নিজেদের পর্দায় প্রচারের আগে এগুলোর ভাষা ও বানান সম্পাদনার নৈতিক দায়িত্ব টিভি চ্যানেলগুলো কিছুতেই এড়াতে পারে না।
আমরা জানি যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত অধিকাংশ অনুষ্ঠানই এখন প্যাকেজভিত্তিতে বাইরে থেকে কিনে নেওয়া। বিজ্ঞাপনগুলোও অন্যদের তৈরি। ফলে টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বলতেই পারেন যে, সেখানকার ভাষা ও বানানে যদি ত্রæটি থাকে, তাহলে চ্যানেলগুলো তা সংশোধন করবে কেমন করে? এটি করা মোটেও কোনো কঠিন বিষয় নয়। প্যাকেজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তির শর্তেই থাকতে পারে যে, ভুল ভাষা ও বানান সম্বলিত প্যাকেজ অনুষ্ঠান কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না (এখানে নাটক, চলচ্চিত্র বা এ জাতীয় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পাত্রপাত্রীদের মুখের ভাষার কথা বুঝানো হচ্ছে না)।
টিভি চ্যানেলগুলোতে এখন টকশোর ছড়াছড়ি। আর বাজারে একসাথে এতগুলো চ্যানেল থাকার কারণে এসব টকশো’তে বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মানসম্পন্ন প্রাজ্ঞ লোকজন খুঁজে পাওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈকি! এ অবস্থায় বহুক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও মানহীন লোকজন দিয়েই অধিকাংশ চ্যানেল কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে দায়সারাভাবে কাজ সম্পন্ন করছে (অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথাযথ লোক খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টায়ও ঘাটতি রয়েছে)। ফলে দেখা যাচ্ছে, এসব টকশো’তে অংশগ্রহণকারী লোকজনের মধ্যকার একটি বড় অংশেরই ন্যূনতম মানসম্পন্ন ভাষায় কথাবার্তা বলার যোগ্যতা থাকছে না। এঁরা শুদ্ধ বাক্য ও উচ্চারণে যেমন কথা বলতে পারছেন না, তেমনি পারছেন না বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণ ব্যতীত কথা বলতেও। ফলে এসব মানহীন লোকের কথা শুনে শুনে সাধারণ দর্শক যেমন বিরক্ত হচ্ছেন, তেমনি আমাদের সামাজিক-সংস্কৃতির একটি স্তর নির্মাণেও তা নিম্মমুখী মান ও প্রবণতা তৈরি করছে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই হতাশাব্যঞ্জক।
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন খুবই দ্রুতহারে এগুচ্ছে, যা আমাদের সকলের জন্যই অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের এবং তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে যে, সে অগ্রগতি দেশের জনগণকে আরো ভালোভাবে খেয়েপড়ে বাঁচতে সাহায্য করছে। কিন্তু দায়িত্ববোধসম্পন্ন সচেতন মানুষ কি শুধু খাওয়ার জন্যই বাঁচে? তার চিন্তা ও মনন, সংস্কৃতি ও সমাজবোধের স্তরটিও সেখানে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয় কি? যদি তাই হয়, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের কর্ম ও আচরণের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি সাধন ও সবক্ষেত্রে ন্যূনতম একটি মান রক্ষার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে বৈকি! আর সেটি টিভি চ্যানেলগুলোর ভাষা ও বানানের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের ক্ষেত্রে আরো অধিক প্রযোজ্য।
অবশ্যই মনে রাখছি যে, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতিটিই এক-একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে গৃহীত অনুমোদন কোনোভাবেই শর্তমুক্ত নয়। এবং সে শর্ত অনুযায়ী এ বাণিজ্য কোনোভাবেই এমন ধারায় করার কথা নয়, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণকর। অতএব বাণিজ্যের দোহাই দিয়ে এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত ভাষাগত মানদণ্ড এড়িয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আর তর্কেও খাতিরে সে কথা যদি বাদও দিই, তাহলেও আশা করবো যে, নিজেদের পেশাগত সুনাম, মান ও ভাবমূর্তির স্বার্থে হলেও টিভি চ্যানেলগুলো তাদের পর্দায় প্রচারিত অনুষ্ঠানের ভাষা ও বানানের মানের ব্যাপারে আরো সচেতন হবে। বস্তুতঃ টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু সে প্রত্যাশাকে পুঁজি করে তারা যদি ভাষা ও বানানের মান রক্ষার দায়টি এড়িয়ে যান, তাহলে একটি জাতিগোষ্ঠীর বিকাশ ও গঠনের প্রক্রিয়ায় সেটিকে মানহীনতার দিকে ঠেলে দেবার দায়ও কিন্তু তাদের উপর অনেকখানিই বর্তাবে বৈকি! আশা করি, সে হীন দায়ভার থেকে তারা অবশ্যই মুক্ত থাকতে চাইবেন।
লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com
Source:
http://www.ekalerkantho.com/home/page/2019-06-19/15