বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান (দৈনিক যুগান্তর, ২১ জুলাই, ২০১৯; পৃ. ৫)

Author Topic: বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান (দৈনিক যুগান্তর, ২১ জুলাই, ২০১৯; পৃ. ৫)  (Read 991 times)

Offline kekbabu

  • Jr. Member
  • **
  • Posts: 78
  • Test
    • View Profile
    • https://daffodilvarsity.edu.bd/
বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
(দৈনিক যুগান্তর, ২১ জুলাই, ২০১৯; পৃ. ৫)

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- ‘Prevention is better than cure’, অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। আমাদের দেশের জনগণকে প্রতিবছরই ‘ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদস্বরূপ’ যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত হতে হয়, বন্যা সেসবের অন্যতম। বিগত বছরগুলোর মতো চলতি বছরেও নাটোর, বগুড়া, নওগাঁ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবারের বন্যা ব্যাপক রূপ নিয়েছে।

পানির ঢল, নদীভাঙন আর প্রবল বন্যায় গৃহহীন, সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন ওইসব এলাকার লাখ লাখ মানুষ। বন্যার কারণে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে রাস্তায়, স্কুল-কলেজে নির্ঘুম রাত পার করছেন অসহায় মানুষ। প্রতিমুহূর্তে তারা ভোগ করছেন অবর্ণনীয় কষ্ট। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় শত শত গ্রাম ও নিুাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ।

এসব এলাকার কাঁচা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, রোপা আমন ধানের বীজতলা, সবজি ক্ষেত, মৎস্য খামার ও পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ভুক্তভোগীরা। পাশাপাশি অনেক এলাকার স্কুল-কলেজ, হাটবাজার, রাস্তাঘাট বিনষ্ট হয়েছে, রেলপথসহ অনেক সড়কপথের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে অনেক স্কুল-কলেজ। আমাদের সবারই উচিত, এসব বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান অবশ্য বলেছেন, সরকারের ত্রাণভাণ্ডারে যথেষ্ট পরিমাণের ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে, কোনো বন্যার্ত মানুষ সরকারি ত্রাণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না, পর্যায়ক্রমে বন্যাকবলিত এলাকার সব মানুষই ত্রাণ পাবে। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রয়োজনীয় ত্রাণ, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি সঠিকভাবে দেয়া হচ্ছে কি না, তা সরকারের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বন্যার্ত মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হচ্ছে বটে; কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় সামান্য। বন্যাকবলিত জেলাগুলোর যেসব শহর ও উপজেলা পর্যায়ে যাতায়াত করা সহজ সেসব এলাকায় কিছু ত্রাণ তৎপরতা থাকলেও অনেক স্থানে, বিশেষ করে যেসব জায়গায় দুর্গম চরাঞ্চল রয়েছে, সেখানে ত্রাণ নিয়ে তেমন কেউ যাচ্ছে না বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে এমন অনেক চর রয়েছে, যেখানকার লোকজন স্বাভাবিক শুষ্ক মৌসুমেই অভাব-অনটনের মধ্য থাকে। তারা এখন কতটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বন্যাকবলিত বিভিন্ন জেলার অনেক মানুষ এখন ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত। এবারের ভয়াবহ বন্যায় জনজীবন যেভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, যত টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটেনি বলে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে। যেমন- এবারের বন্যায় রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৯০ হাজার মাছের পুকুর ও খামার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শুধু মৎস্য খাতেই ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে।

পানিতে তলিয়ে গেছে অনেক ফসলি জমি, রাস্তাঘাট। স্কুল-কলেজসহ ওইসব এলাকার অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যাক্রান্ত জনগণকে সড়কে, নৌকায় ত্রাণের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে, যা চরম মানবিক বিপর্যয়েরই চিত্র বটে। বন্যার প্রভাবে কিছু কিছু এলাকার চিত্র এমন দাঁড়িয়েছে যে, কিছুদিন আগেও যেখানে লোকালয় ছিল, আজ সেখানে লোকালয় বলে কিছু নেই।

বন্যায় বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার কারণে অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধ বা উঁচু স্থানে। আবার অনেকেই বাধ্য হয়ে মাচা আর নৌকায় পেতেছেন সংসার। রাতে অনেকেই ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে ঠিকমতো ঘুমানো সম্ভবও নয়। পানিবন্দি এসব মানুষের দিন কাটছে অনেকটাই অর্ধাহারে-অনাহারে। খাবার না থাকায় অনেকে গবাদি পশু বিক্রি করে দিয়েছেন। বন্যার কারণে গরু-ছাগলসহ অনেক গবাদি পশুর অবর্ণনীয় দুর্গতি, অনেক গবাদি পশুর করুণ মৃত্যুর পর পানির স্রোতে ভেসে যাওয়ার দৃশ্যগুলোও আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। তবে দুঃখের বিষয়, বন্যার্তরা ত্রাণ বা সহায়তা খুব একটা পাননি বলে এসব মানুষকে গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে অভিযোগ করতে দেখা গেছে।

এবারের বন্যাকবলিত জেলাগুলোর অধিকাংশ স্থানের নলকূপ ডুবে যাওয়ায় খাবার পানিরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত নানা রোগব্যাধি। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের রোগবালাই দেখা দেয়াই স্বাভাবিক। এর মধ্যে পানিবাহিত রোগের প্রভাবই বেশি দেখা যায়। বন্যার সময় ময়লা-আবর্জনা, মানুষ ও পশু-পাখির মলমূত্র এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা একত্রিত হয়ে এসব উৎস থেকে জীবাণু বন্যার পানিতে মিশে যায় এবং তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে বন্যায় সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার ঘটে।

বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে মানুষের ক্ষেত্রে জ্বর-সর্দি, ডায়রিয়া, কলেরা, রক্ত আমাশয়, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, ভাইরাল হেপাটাইটিস, পেটের পীড়া, কৃমির সংক্রমণ, চর্মরোগ, চোখের অসুখ ইত্যাদি সমস্যা মহামারী আকার ধারণ করে। বন্যাক্রান্ত মানুষ যেন পানিবাহিত রোগ থেকে সহজেই রক্ষা পেতে পারেন সে জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা জরুরি। আর এসব মানুষ যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজেই নিরাপদ পানি ব্যবহার করে, তা তাদের জানানো দরকার।

এর পাশাপাশি এটাও জানাতে হবে যে, বন্যার্তরা যেন বন্যার পানি বা বন্যায় তলিয়ে যাওয়া নলকূপ, কুয়া বা অন্য কোনো উৎসের পানি দিয়ে হাত-মুখ ধোয়া, কুলি করা ও পান করা থেকে বিরত থাকে। বন্যার পানিতে গোসল করা, কাপড় ধোয়া, থালাবাসন পরিষ্কার করা ইত্যাদি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। বন্যার পানি ফুটিয়ে পান করার ব্যাপারে বন্যাক্রান্তদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। পানি ফোটানোর জন্য জ্বালানির সংকট থাকলে বা ফোটানো সম্ভব না হলে ক্লোরিনের মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিবছর দেশে বন্যা হলেও বন্যা মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি থাকে কতটুকু? যতটুকু প্রস্তুতি থাকে, তা কি বন্যা মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট? কেন বন্যা প্রতিরোধে উপযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না? এ ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়? সরকারের পক্ষ থেকে যদিও প্রতিবছরই বন্যার সময় বলা হয়, পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে; বন্যাক্রান্ত এলাকায় ত্রাণের অভাব নেই ইত্যাদি; তবে এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর যে সংখ্যক মানুষ বন্যার শিকার হন তাদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে নেই।

ফলে অনেক বন্যার্ত মানুষ এক ধরনের বাধ্য হয়েই খোলা আকাশের নিচে বা মাচা পেতে দিনাতিপাত করেন। এসব মানুষকে শুধু খাদ্য দেয়াই যথেষ্ট নয়, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি, শিশুখাদ্য, ওরস্যালাইনসহ জরুরি ওষুধপথ্য দেয়ারও প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি সরকারি ত্রাণসামগ্রী সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করাও জরুরি। বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর যে সংস্কৃতি দেশে বিদ্যমান, তা আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা প্রয়োজন। বন্যাদুর্গত মানুষের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া সবার নৈতিক দায়িত্ব। কারণ ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে আগাম কিছু ব্যবস্থা নিয়ে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ কমিয়ে আনা সম্ভব। আগামী দিনগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে বন্যাক্রান্ত স্থানগুলো চিহ্নিত করে সঠিক উপায়ে বাঁধ ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোয় জিওটিউব (বালির বড় বড় বস্তা) ফেলার ব্যবস্থা, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির ব্যবস্থাসহ এমন সব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন যেন সহজেই বন্যা মোকাবেলা করা যায়। এ সবকিছু সঠিকভাবে সম্পাদন করা হলে জনগণকে আর বন্যার কারণে চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে না।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি, ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com
Dr. Kudrat-E-Khuda (Babu).
Associate Professor (Dept. of Law), Daffodil International University;
International Member of Amnesty International;
Climate Activist of Greenpeace International; Column Writer;
Mobile Phone: +8801716472306
E-mail: kekbabu.law@diu.edu.bd