চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: বাংলাদেশ কতখানি প্রস্তুত
১৫ বছর আগের কথাই ভাবুন। মোড়ে মোড়ে ছিল দোকান থেকে মোবাইল ফোন করার ব্যবস্থা। সঙ্গে সাইবার ক্যাফে, ডিভিডি, মুভি রেন্ট, এমপিথ্রি-পেনড্রাইভের দোকান। এখন শহরে আর এসব দেখতে পাওয়া যায় না হরহামেশা।
আবার ভাবুন, আপনি নিয়মিত কোনো সুপারশপে যান। এর পরেরবার সেখানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আপনাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বলে দেওয়া হচ্ছে আপনি সাধারণত কত টাকার শপিং করেন এখান থেকে, আর নিয়মিত কোন কোন সামগ্রী কেনেন, আর সেসবে সেদিন বিশেষ ছাড় চলছে কি না! অথবা ডাক্তারের কাছে গেলে আপনাকে সব মেডিকেল হিস্ট্রি গড়গড় করে বলতে হচ্ছে না, আপনার পরিচয়পত্রের সঙ্গেই যুক্ত ডেটাবেইসে রাখা আছে সেসব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে এসব কিন্তু অসম্ভব কোনো কল্পনা নেই আর।
বাষ্প ইঞ্জিনের আবিষ্কারে শুরু হয়েছিল প্রথম শিল্পবিপ্লব, বিদ্যুতের উদ্ভাবনে হয়েছিল দ্বিতীয়টি আর কম্পিউটার-ইন্টারনেটের প্রচলনে চলছিল তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস, বায়োটেকনোলজির সঙ্গে অটোমেশন প্রযুক্তির মিশেলে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই বিপ্লব মোকাবিলায় বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যবস্থা কতটুকু প্রস্তুত?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আইবিএম ওয়াটসন যেখানে ডকুমেন্ট রিভিউ প্রসেস বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে ৮৫ ভাগ নিখুঁত আইনি সহায়তা দিচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে, সেখানে আমাদের আদালতে এখনো ভিডিও ফুটেজ প্রমাণ হিসেবে দেখানোর কারিগরি প্রযুক্তিটুকু নেই।
অতি অল্পেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ফেলার অভ্যাস আমাদের। দেশের সব প্রান্তে এখনো থ্রি-জি নেটওয়ার্কই পাওয়া যায় না, অথচ ফোর-জি নিয়েই তুমুল প্রচারণা চালানো হয়। সোফিয়ার মতো ‘চ্যাটবট’ রোবট দেখেই সরকারি মহলে সে কী উচ্ছ্বাস! অথচ এর চেয়ে ভালো রোবট আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ারাই বানান নিয়মিত। জেপি মর্গানের ‘কইন’ যেখানে ডকুমেন্ট প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে সার্ভিস অটোমাইজেশন করে ফেলছে, আমাদের ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে ‘ফেসবুক মেসেঞ্জার চ্যাটবট’ নিয়েই উল্লসিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল ডিজিটাল নিরাপত্তাব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রায় হাজার কোটি টাকার রিজার্ভ চুরির কলঙ্কের কথা তো বলাই বাহুল্য।
এখানে বলে রাখা ভালো, এই মেসেঞ্জার চ্যাটবট কেবল কিছু নির্ধারিত প্রশ্নের নির্ধারিত উত্তর দিতেই সক্ষম। আর অন্যদিকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে সফটওয়্যার প্রোগ্রাম তাকে জোগান দেওয়া বিপুল ডেটা আর অ্যালগরিদম অ্যানালাইসিস করে মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে আনকোরা সব প্রশ্ন বা সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব সিদ্ধান্ত দিতে পারে এখন।
তাই আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করে রাখা উচিত অবশ্যই। ইন্টারনেট ব্যবহার আর সফটওয়্যার অটোমেশন করে হওয়া ‘ডিজিটালাইজেশন’ কিন্তু তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের অংশ, যা নিয়ে এখন অনেক হইচই বাংলাদেশে। এর সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান নিয়ামক মেশিনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিভিন্ন সার্ভিস অটোমাইজেশনের মধ্যে কিন্তু বিস্তর ফারাক।
ওয়ালটনের কারখানায় ‘কম্প্রেসর অ্যাসেম্বলি’ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে বেশ কিছু রোবটিক প্রযুক্তি। স্মার্ট ফ্রিজ আর স্মার্ট টিভি বানানোর কাজও দেশেই করছে ওয়ালটন। এসিআই ‘রুপালি’ প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘প্যাটার্ন অ্যানালাইসিস’ আর ‘আইওটি’ ব্যবহার করে মৎস্যচাষিদের দিচ্ছে অটোমাইজড পরামর্শসেবা। ‘ফসলি’ নামেও ডিজিটাল কৃষিসেবা দিচ্ছে এসিআই। এপেক্স গ্রুপ বিনিয়োগ করছে ‘গ্রে ডেটা সায়েন্স’ কোম্পানিতে। আমাদের টেক্সটাইল কারখানায় লেজার কাটিং প্রযুক্তিতেও এখন চলে এসেছে অটোমাইজেশন।
‘বিকাশ’-এর মাধ্যমে অনেকখানি বদলে গেছে এ দেশের মোবাইল-ব্যাংকিং সিস্টেম। প্রান্তিক লোকজন কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা ছাড়াই সহজে অর্থ লেনদেন করতে পারছেন। বিকাশে প্রতিদিন এখন লেনদেন হচ্ছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। রকেট, নগদ, আইপে-ও কাজ করছে এখন এই সেক্টরে।
আইসিডিডিআরবিতে ‘কারা’ নামের টেলি-অফথালমোলজি প্রযুক্তি দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি শনাক্তের একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি চালু করা হয়েছে সম্প্রতি। ‘বন্ডস্টাইন’ টানা চার বছরের মতো সফলভাবে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর জন্য আইওটি ডিভাইসের মাধ্যমে স্মার্ট ট্র্যাকিং ব্যবহার করে আসছে। অলীক, ইন্টেলিজেন্ট মেশিনস, দেশ এআই, ব্রেইনস্টেশন ২৩ সহ আরও কিছু উদ্যোগ স্বল্প পরিসরে কাজ করছে আইওটি, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে।
তবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কিংবা আইওটি সেক্টরে বিনিয়োগবান্ধব মানসিকতা এখনো গড়ে ওঠেনি। দেশের নীতিনির্ধারকেরা সত্যি বলতে এখনো অনেকটা সেকেলে। সরকারি হস্তক্ষেপে মাঝেমধ্যেই ব্যাহত হয় গুগল-ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সেবা।
এর চেয়ে ভালো রোবট এখন আমাদের শিক্ষার্থীরাই বানাচ্ছে
এর চেয়ে ভালো রোবট এখন আমাদের শিক্ষার্থীরাই বানাচ্ছে
এ দেশের প্রাচীন আইন এখনো লিখে রেখেছে রীতিমতো চুক্তি করে ‘বর্গফুটের’ অফিস না নিলে ব্যবসা করা যাবে না। অথচ জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে অনলাইনে ব্যবসা নিবন্ধন আর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ঘরে বসেই ইন্টারনেট-সংযোগ দিয়ে তৈরি করা যায় বৈশ্বিক ব্যবসা। এসব আইনেও আনা দরকার পরিবর্তন।
শিল্পকারখানায় কী ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতা লাগবে, সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষাক্রমের তেমন সমন্বয় নেই। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় শিক্ষাব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। প্রাথমিক পাঠ্যক্রম থেকেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সারা দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি অফিসের ফাইল-নথিপত্র ডিজিটাল ডকুমেন্টে রূপান্তরিত করতে হবে। আর নতুন ডকুমেন্টও ডিজিটাল পদ্ধতিতে তৈরি করে সংরক্ষণ ও বিতরণ করতে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে দেশে প্রচুর সেমিনার আর গোলটেবিল বৈঠক হচ্ছে। সবারই একই মত, এই বিপ্লব মোকাবিলায় অনেক কাজ করতে হবে। এআই, আইওটি, বিগ ডেটা, ব্লকচেইনের মতো জনপ্রিয় শব্দ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে সেখানে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই। আর কেবল পরিকল্পনা করলেই তো হবে না, অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের মানবসম্পদকেও যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে হবে এই পরিবর্তনের জন্য। তবে আশার কথা, সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্ট্র্যাটেজি’ নিয়ে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
প্রযুক্তিগত এই পরিবর্তনের কারণে আগামী ১০ বছরে অনেক পেশা হারিয়ে যেতে পারে, সঙ্গে অবশ্য যোগ হবে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। পিডব্লিউসি জানাচ্ছে, স্বয়ংক্রিয়করণ প্রযুক্তির জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৮০ কোটি বর্তমান চাকরি হারিয়ে যাবে। স্বভাবতই আমাদের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো বিপদে পড়বে। তাই আমাদের এখন থেকেই জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, ব্লকচেইন এসব প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এখনো শিশু পর্যায়ে। এসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পণ্য সরবরাহ, চিকিৎসা, শিল্পকারখানা, ব্যাংকিং, কৃষি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে কাজ করার পরিধি এখনো তাই ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত।
সত্যিকার অর্থে যেহেতু তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সুফলই আমরা সবার কাছে পৌঁছাতে পারিনি, চতুর্থ বিপ্লব মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি ক্লাসের পিছিয়ে পড়া ছাত্রের মতোই।
১৭৮৪ সাল
শিল্পবিপ্লব ১.০
বাষ্পীয় ইঞ্জিন মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিল গতিকে। যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু আধুনিক শিল্পায়নের দিকে। বাড়ে কয়লার খনি ও ইস্পাতের ব্যবহার।
১৮৭০ সাল
শিল্পবিপ্লব ২.০
উৎপাদনে নতুন অধ্যায় শুরু। বৈদ্যুতিক বাতি মানুষকে দেয় এক নতুন আলোকিত বিশ্ব। উদ্ভব ঘটে প্রোডাকশন লাইন ধারণার। উৎপাদন বাড়ে বহুগুণ।
১৯৬৯ সাল
শিল্পবিপ্লব ৩.০
কম্পিউটারের ব্যবহার ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির শুরু। আবিষ্কৃত ইন্টারনেট জগৎকে এনে দেয় মানুষের হাতের মুঠোয়। উদ্ভব ঘটে প্রোগ্রামেবল লজিক কনট্রোলার (পিএলসি) ব্যবস্থার।
এখন
শিল্পবিপ্লব ৪.০
ডিজিটাল বিপ্লব। স্মার্টফোনের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংসহ নানা কিছু
সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্যাভিলিয়ন
Source:
https://www.prothomalo.com/economy/article/1620316/%E0%A6%9A%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%AC-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%95%E0%A6%A4%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A4