মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের অসহযোগ ও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তৎকালীন অন্য ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সামান্য নয়, এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরকে সেদিন রক্তে রঞ্জিত করেছিল পাকিস্তানি হায়েনারা, স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল শিক্ষাব্যবস্থাকে। ওই সময় এ দেশের লাখো কোটি জনতার পাশাপাশি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
৩০ লাখ শহীদের মধ্যে রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানা-অজানা অনেক ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ডায়েরিতে এদের মাঝে ১৮ জন শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। তারা হলেন_ মো. জামাল হোসেন মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, নাজিম আখতার কাশেম কৃষি প্রকৌশল অনুষদ, হাবিবুর রহমান কৃষি অনুষদ, আবদুল মতিন খন্দকার মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, আবুল কাশেম ডিভিএম, খুরশিদ আলম কৃষি অনুষদ, এম নাজমুল আহসান কৃষি অর্থনীতি ও সমাজকল্যাণ অনুষদ, শামসুল হক তালুকদার কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ, কাজী মজুর হোসেন ভেটেরিনারি অনুষদ, ইব্রাহিম মোস্তফা কামাল ভেটেরিনারি অনুষদ, মনিরুল ইসলাম আকন্দ মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ এবং কর্মচারীদের মধ্যে গিয়াস উদ্দিন, হাসান আলী, ওয়াহিদুজ্জামান, নুরুল হক, মধুসুদন, আক্কাস আলী, মো. তোহসিনুল ইসলাম প্রমুখ। উপরোক্ত শহীদদের মধ্যে তিনজন শহীদের স্মৃতিকে ধরে রাখার লক্ষ্যে তাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি হলের নামকরণ করা হয়েছে। এগুলো হলো_ শহীদ জামাল হোসেন হল, শহীদ শামসুল হক হল, শহীদ নাজমুল আহসান হল। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল হক, অধ্যাপক আতিয়ার রহমান মোল্লা, অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত হোসেন, অধ্যাপক ড. শেখ জিনাত আলী, অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি মো. নজিবর রহমানসহ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরিতে উল্লেখ রয়েছে।
প্রাপ্ততথ্য থেকে জানা যায়, ভারতের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বর্তমান ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল হক প্রশিক্ষক হিসেবে সফল দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ বৈঠক বাতিল ঘোষণা করলে সারা দেশে প্রতিবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র দেশের ন্যায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও লাগলো বিক্ষোভের ঢেউ। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঈশা খাঁ হলসংলগ্ন শহীদ মিনারে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, এলাকাবাসী সমবেত হয়ে সংগ্রামের শপথ নিলেন ।
৬ মার্চ ১৯৭১, ময়মনসিংহ টাউন হলে জমায়েত হলেন ময়মনসিংহের বীর জনতার পাশাপাশি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীরা। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন জননেতা রফিক উদ্দিন ভূইয়া। গঠিত হলো স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা নূর মোহাম্মদ তালুকদার। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে পালিত হলো প্রতিরোধ দিবস। প্রতিটি ভবনে উত্তোলিত হলো স্বাধীন বাংলার পতাকা। তৎকালীন ভিসি কাজী ফজলুর রহীম ঘোষণা করলেন, আজ থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় 'স্বাধীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়' নামে পরিচিত হবে। ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য থেকে বিপুলসংখ্যক যোগ দিলেন সংগ্রাম পরিষদে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এর কিছুদিন পর উপস্থিত হলেন তৎকালীন মেজর শফিউল্লাহ। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খোলা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। ২৩ এপ্রিল ১৯৭১, পাকবাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করল এবং বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরকে ঘোষণা করা হলো তাদের ক্যান্টনমেন্ট। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অতিথিশালায় স্থাপন করে আঞ্চলিক কমান্ড হেড কোয়ার্টার। সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক হলকে করা হয় সেনানিবাস। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরসংলগ্ন একটি বাড়িকে করা হয় নির্যাতন কক্ষ। নির্যাতন কক্ষের পাশেই লাশ পুঁতে রাখা হতো। জানা যায়, ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ থেকে রাজাকার বাহিনী কর্তৃক ধরে আনা অসংখ্য নারী-পুরুষকে হত্যার পর এ জায়গায় মাটিচাপা দেওয়া হতো। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জায়গাটিকে চিহ্নিত করে বধ্যভূমি ঘোষণা করেছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের শত শত মানুষের নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে নীরবে আজও সাক্ষী দিচ্ছে বধ্যভূমিটি। তৎকালীন আলোকচিত্রী নাইব উদ্দিন আহমেদ তার ক্যামেরায় বন্দী করেছিলেন নির্যাতনের অনেক বিভীষিকাময় চিত্র, যা আজও জাতীয় বিভিন্ন প্রদর্শনীতে দেখা যায় ।
ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ফার্মগুলোতে চালানো হয় লুটপাট। তৎকালীন উপাচার্য ড. কাজী ফজলুর রহীম, ডিন শামসুল ইসলাম, ড. শফিকুর রহমান, ড. মোস্তফা হামিদ হোসেনকে লাঞ্ছি করে পাকিস্তনি হানাদার বাহিনী। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত গফরগাঁও, ভালুকা, ত্রিশাল ও অন্যান্য থানার রাজাকার বাহিনী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করত। ১০ ডিসেম্বর রাতে পালিয়ে গেল হানাদার বাহিনী। যাওয়ার আগে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা মেরে বিধ্বস্ত করল, ভস্মীভূত করল কয়েকটি ছাত্রাবাসের লাখ লাখ টাকার বই ও আসবাবপত্র। ১২ ডিসেম্বরের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করতে থাকে বিজয়ের বেশে দলে দলে মুক্তিপাগল ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক- কর্মচারীরা। রক্তেভেজা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তোলন করা হলো স্বাধীন বাংলার পতাকা। এখনো সোহরাওয়ার্দী হল, ফজলুল হক হল ও জামাল হোসেন হল প্রাঙ্গণে 'শহীদের স্মৃতিস্তম্ভ' অতীতের সেই বিভীষিকাময় সময়গুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
লেখক :দীন মোহাম্মদ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা।
Source :
http://www.bd-pratidin.com/?view=details&type=gold&data=Cook&pub_no=588&cat_id=3&menu_id=51&news_type_id=1&index=5