বাংলার বিকৃত ব্যবহার বন্ধ করুন

Author Topic: বাংলার বিকৃত ব্যবহার বন্ধ করুন  (Read 807 times)

Offline Raja Tariqul Hasan Tusher

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 114
  • Test
    • View Profile
সম্প্রতি দেশে ফোন করেছিলাম বন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাব বলে। অল্প সময়ের কথা বলা। ভালো করে খেয়াল করলাম, দুই মিনিটের কথায় সে দুবার বলল, ‘আরে ইয়ার, কল দিবার টাইম পাও না?’ সবশেষে বলল, ‘ঠিক হ্যায়, থ্যাংকস-বাই!’

ইতিহাস বলে বাঙালি বাংলা ভাষা লিখে আসছে প্রায় হাজার বছর ধরে। সংস্কৃত ব্যাকরণ রীতি পাঠ করেই বাংলা লিখিত ভাষার চর্চা শুরু হয়েছিল। উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষার যে সর্বসম্মত ব্যাকরণ লিখেছিলেন, তা মূলত সাধু ভাষার ব্যাকরণ। কিন্তু কথ্য বাংলা ভাষার কোনো নির্দিষ্ট একটি চেহারা নেই। হতেও পারে না।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার কথার ধরন বৈচিত্র্যময়। তেমনি তার বিবিধ উচ্চারণ রীতি। বাক্য গঠনের বিভিন্নতা ও শব্দে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের খুব বেশি প্রভাব দেখা যায়। এটা নতুন কিছু নয়।

ধর্ম-জাতি-জীবনাচারণের সুক্ষ্ম প্রভাব নিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলা ভাষার শরীর গঠন হয়েছে। ভাষা এমন এক বিষয়, যা রাজনৈতিক মানচিত্রের সীমারেখা মেনে চলে না। ভাষা আঞ্চলিক কথন-কাঠামোয় গড়ে ওঠার প্রভাব প্রবহমান ধারায় বয়ে যাওয়া একটি আদি ঐতিহ্য। তাই আদি কাল থেকেই অভিব্যক্ত বাংলাদেশ সব অঞ্চলের ভাষার বিচিত্র তারতম্য মিলেমিশে তৈরি করেছে বাংলা ভাষার অবয়ব। এভাবেই বাংলা ভাষার বহমানতা, সমৃদ্ধি, ব্যাপ্তি ও বিকাশ।

ভাষাকে যদি নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে মূল নদীটিকে বাদ দিয়ে তার জলরাশি তার শাখা-প্রশাখা নানা নদীর সঙ্গে মিলেমিশে বইতে থাকে। বাংলা ভাষার এই গতিশীলতাকে মাঝেমধ্যে প্রবল হয়ে উঠতে দেখেই সমাজে আশঙ্কার মেঘ জমে ওঠে। এ কথা তো সত্য, প্রচলিত মূলধারার বাংলা ভাষায় ইংরেজি ছাঁচ অনেক দিনের আমদানি। সেই সঙ্গে ভাষার অস্তিত্বসংকটে প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। এ নিয়ে ‘গেল’ ‘গেল’ রব উঠেছে। তার কিছু নমুনা এখানে দিতে চাই।

আমেরিকায় জন্ম নেওয়া বা বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের বাংলা শুনলে মনে হবে কোথাও বোমা ফাটছে। যেমন,

তুমি কি গোসল করেছ?
আমি গোসলড ইয়েসটারডে।
তুমি কি স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ করেছ?
আমি করিইং তো,
তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।
আই উইল শেষ ইট
চলো আজ মসজিদে ইফতার করব।
মা আমরা আল্লাহ পার্টি যাব?
এটা তুমি করেছ?
আমি যাইছি না। বা করছি না।

এসব তো গেল বাংলিশে কথোপকথন। বাংলা শেখানোর জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু বাংলা স্কুল চালু হয়েছে। এরপর আছে এ দেশে যিনি যে এলাকা থেকে এসেছেন, তাঁর ছেলেমেয়েরা ইংরেজির সঙ্গে সেই এলাকার ভাষায় কথা বলে। সাম্প্রতিক কালের কিছু নিত্য ব্যবহার্য বাংলা ভাষা সবার মুখে মুখে যেমন—স্ট্যাটাস, ট্যাগানো, আপলোড, ছবি পোস্ট করা, ডিলিট, রিমুভ, কল মি, সরি, লাভ ইউ, হ্যাপি বার্থডে, হ্যাপি অ্যানিভার্সারি, শিট হোলি শিট, ইয়ার (বন্ধু), টিগ হ্যয়, মাস্তি, দোস্ত জিনিসটা সেরাম জোশ, চুপ যা না ইয়ার—এ রকমই অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, যা কিনা হিন্দি ইংরেজি বাংলিশ হয়ে আমাদের ভাষায় মিশে গেছে।

এসব শব্দ টেবিল-চেয়ারের মতোই হিন্দি সিরিয়াল দেখে তাদের ভাষা অনায়াসে এখন বাংলা শব্দ ভান্ডারে ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশের সব টিভি সিরিয়ালে আঞ্চলিক ভাষার নামে সম্পূর্ণ মনগড়া বিকৃত বাংলার ব্যবহার বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক চলনের যে ইঙ্গিত দেয়, তাতে সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন আসল বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে। গত দুদশকে লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে নতুন প্রজন্মের বড় অংশের কথ্য বাংলায়, যে জগাখিচুড়ি ভাষা শুনলে বুঝে ওঠা যায় না, আসলে কোন ভাষায় কথোপকথন চলছে।

ভাষা গেল গেল রব আছে ঠিকই, তার জন্য যথেষ্ট দরদ আছে এমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। যুগে যুগে সমাজ পরিবর্তনের ছাপ ভাষা ধারণ করবে, সেটিই স্বাভাবিক। তাই কবির ভাষায় বলতেই হয়, ‘তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি’।