করোনা থেকে সুরক্ষায় স্বার্থপরতা নয়

Author Topic: করোনা থেকে সুরক্ষায় স্বার্থপরতা নয়  (Read 586 times)

Offline Sultan Mahmud Sujon

  • Administrator
  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 2669
  • Sultan Mahmud Sujon, Sr. Admin Officer
    • View Profile
    • Helping You Office Operation & Automation Management
মাস্ক, জীবাণুনাশক (হ্যান্ড স্যানিটাইজার), তরল সাবান কিংবা টিস্যুর জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন এবং ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো এগুলোর দাম বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগে ফেসবুক সয়লাব। অনেকেই এটি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সুবিধাবাদী চরিত্র বলে অভিহিত করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পুঁজিবাদের মুনাফাসন্ধানী চরিত্র বিশ্বজুড়ে একই। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের সুবিধা নিয়ে মুনাফা করা মুক্তবাজার ব্যবস্থায় কোনো অপরাধ নয়। অর্থনীতির চাহিদা ও সরবরাহের সূত্র দিয়ে তার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা আমাদের সবারই জানা। চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি হতে পারে, এই আশঙ্কায় ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশেই এগুলোর সংকট দেখা গেছে।

এসব দেশে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, তরল সাবান, টয়লেট পেপার, পাস্তা ও টিনজাত খাদ্য নিয়ে বড় বড় দোকানগুলোতেও টানাটানির দৃশ্য গণমাধ্যমে খবর হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় টয়লেট পেপার সরবরাহে সংকট দেখা দেওয়ায় রসবোধের জন্য পরিচিত এন.টি. নিউজ নামের একটি পত্রিকা পাঠকদের জন্য এক দিন আট পৃষ্ঠা খালি রেখেছিল, যাতে তা টয়লেটে ব্যবহার করা যায়। অবশ্য নিউজপ্রিন্টে টয়লেটের পাইপ বন্ধ হয়ে গেলে তার সমাধান পত্রিকাটি কিছু দিয়েছে, এমন কোনো তথ্য কোথাও পাইনি।

মাস্ক নিয়ে যে সংকট, তা বাংলাদেশে নতুন হলেও এর বৈশ্বিক ঘাটতি শুরু হয়েছে প্রায় এক মাস আগে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস আধানম ঘেব্রেইসুস জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে সার্জিকাল মাস্ক এবং অন্যান্য সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের বৈশ্বিক চাহিদা নজিরবিহীন মাত্রায় পৌঁছেছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে যাদের এগুলো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের জন্য সরবরাহ-সংকট বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। হুজুগ কাটাতে তখন তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন যে অসুস্থ ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের জন্য এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। তখন পর্যন্ত সংক্রমণ ঘটেছিল ২৪টি দেশে। কিন্তু সেদিনই তিনি জানিয়েছিলেন যে চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় শত গুণে বেড়েছে। সংস্থার সর্বসাম্প্রতিক হিসাব বলছে, মাস্কের দাম এখন বেড়েছে গড়ে প্রায় ছয় গুণ। রোগী পরিচর্যার বাইরে অযথা এবং ব্যাপকভাবে পারসোনাল প্রটেকশন ইকুয়িপমেন্ট (পিপিই) ব্যবহারের কারণে সংকট বেড়েছে। ডাক্তার-নার্সদের অস্ত্রোপচারের মুখোশ পাওয়া নিশ্চিত করার চেষ্টায় তিনি তখন থেকেই পিপিই প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। সরকারগুলোর প্রতি তিনি এগুলোর উৎপাদন অন্তত ৪০ শতাংশ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু হুজুগ কমেনি। এবং চাহিদা বেড়েই চলেছে। এই হুজুগের কারণে কোনো হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যদি জীবন রক্ষাকারী কোনো অস্ত্রোপচার করতে না পারেন, তাহলে তার দায় কিন্তু আমাদের ওপরই বর্তায়।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি ও দাম বাড়ানোর চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশগুলোতে এসব বিষয়ে সরকারের খোলাখুলিভাবেই হস্তক্ষেপ করার কথা। ব্রিটেনে বাজার তদারককারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকার ইতিমধ্যেই অযৌক্তিকভাবে কোনো জিনিসের দাম না বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। মন্ত্রীরা বড় বড় সুপারমার্কেটের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত করেছেন যে সরবরাহে কোনো ঘাটতির আশঙ্কা নেই। সম্ভাব্য সংক্রমণের সন্দেহে সংক্রমিত ব্যক্তি বা পরিবার নিজের বাড়িতে স্বেচ্ছাবন্দী বা সেলফ-আইসোলেশনে থাকলে অথবা কোনো এলাকাকে অবরুদ্ধ এলাকা ঘোষণা করা হলে সরকার সেখানে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছে। আমাদের মন্ত্রীরা কি এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন?

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চীনে শুরু হলেও তা যে কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানা মানে না, সেটা এখন সুস্পষ্ট। একইভাবে এই সামাজিক সংক্রমণ কোনো শ্রেণিবৈষম্যও মানবে না। ভাইরাসটি এমন নয় যে তা ধনী-গরিব বা সামর্থ্যবান-সামর্থ্যহীনদের মধ্যে ভেদাভেদ রেখে সংক্রমিত হবে। সুতরাং একটি পরিবার তিন থেকে ছয় মাসের মাস্ক-গ্লাভস-স্যানিটাইজার মজুত করলেই নিজ পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, এমন নয়। স্বাস্থ্যসম্মত শুচিতা ও সতর্কতা সবারই প্রয়োজন। বিশেষ করে এত উচ্চ জনঘনত্বের দেশে একজন আরেকজনের থেকে খুব বেশি দূরত্বে কি যেতে পারবেন?

সব দেশেই এখন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে জনসমাগম ও গণপরিবহন এড়িয়ে চলতে। রেস্তোরাঁগুলোতে ভোক্তাদের এক মিটার দূরত্বে বসানোর কথা বলা হয়েছে। সেলফ আইসোলেশনের ক্ষেত্রে পরিবারের অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কতটুকু প্রস্তুত আমরা? ঢাকার সোয়া কোটি বাসিন্দার মধ্যে যাঁরা বস্তিগুলোতে থাকেন, তাঁদের সুরক্ষার কথা কেউ কি ভাবছেন? নিম্নবিত্ত কর্মজীবীদের কথা, বিশেষ করে যাঁরা দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন, তাঁদের কারও প্রয়োজন হলে সেলফ আইসোলেশন কীভাবে সম্ভব হবে? রোজগার হারালে না খেয়ে থাকার ভয়ে অসুস্থ হলেও যাঁর কাজে আসার সম্ভাবনা আছে, তাঁকে নিরস্ত করবেন কীভাবে? অথচ এভাবে সংক্রমণ দ্রুত বিস্তারের ঝুঁকি অনেক বেশি। পশ্চিমা দেশগুলোতে এ ধরনের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য সরকারগুলো জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে। অসুস্থতার পুরো সময়টিতে যাতে নিয়োগদাতা কোম্পানি চিকিৎসাকালীন ভাতা দিতে বাধ্য হয়, সে জন্যে জরুরি ভিত্তিতে আইন হচ্ছে। যাঁরা কোনো চাকরিতে নেই, তাঁদের জন্য সরকারিভাবে কিছু বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ রকম ব্যবস্থার কথা আমাদেরও ভাবতে হবে।

অন্যান্য মহাদেশ এবং আশপাশের দেশগুলোতে করোনার সংক্রমণের খবর পাওয়া গেলেও ৮ মার্চের আগপর্যন্ত হয়তো অনেকেই আশা করেছিলেন যে বাংলাদেশ বোধ হয় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাবে। এর আগে বৈশ্বিক মন্দার হাত থেকেও তো আমরা পার পেয়েছি। অন্যান্য সংক্রমণ, যেমন এইডস, সোয়াইন ফ্লু কিংবা বার্ড ফ্লুর ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে আমাদের তেমন বড় কোনো সংকটের মধ্যে পড়তে হয়নি। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে গতবারের ডেঙ্গুর প্রকোপ, যেটি ছিল আমাদের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য দুর্যোগ। ডেঙ্গুর মতো ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আশার কথা, মশা করোনাভাইরাসের বাহক নয়। কিন্তু, করোনাভাইরাসের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের যে লম্বা সময় আমরা পেয়েছি, তা যে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেছে, সে কথা কেউই বলতে পারেন না।

বিমানবন্দরে যাত্রীদের তাপমাত্রা মাপার স্ক্যানারে সম্ভাব্য রোগী শনাক্ত করার ব্যবস্থা নিয়েই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। ইতালিফেরত দুজন প্রবাসীর করোনা ধরা পড়ার কারণেই নতুন করে প্রশ্নটি উঠেছে। চীনের উহানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার সময়েও অনেকে এ ধরনের স্বার্থপরতার পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, তাঁরা সুস্থ না হলে ফিরিয়ে আনা ঠিক হবে না। প্রথমত, নৈতিকভাবে কোনো রাষ্ট্রের সরকারই তার কোনো নাগরিককে এভাবে বিপন্ন অবস্থায় পরিত্যাগ করতে পারে না। আর দ্বিতীয়ত, করোনাভাইরাস সংক্রমিত হলেই যে তা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়বে বা লক্ষণগুলো প্রকাশ পাবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বলা হচ্ছে, এর লক্ষণ ধরা পড়তে ১৪ দিন পর্যন্ত লাগে। এ কারণে, সন্দেহ হলেই সম্ভাব্য রোগীকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে। আর না হলে সেলফ আইসোলেশনে। যেসব দেশে প্রকোপ মহামারির রূপ নিয়েছে, সেই সব দেশ থেকে ফিরে এলে অবশ্যই ১৪ দিনের সেলফ আইসোলেশন। আর সে রকম কোনো বিদেশভ্রমণ ছাড়াও যদি কারও জ্বর, সর্দি-কাশি দেখা দেয়, তাহলে তার ঘর থেকে না বেরোনো হচ্ছে সর্বসাম্প্রতিক পরামর্শ।

এ ধরনের ঝুঁকিতে থাকা সবাইকে হাসপাতালে জায়গা দেওয়ার সামর্থ্য স্বাভাবিকভাবেই সব দেশের থাকার কথা নয়। কেবল সে কারণেই সেলফ আইসোলেশনের নীতি। উন্নত ও নির্ভরযোগ্য জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য সুখ্যাত হলেও ব্রিটেনে ইতিমধ্যেই সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় জীবনরক্ষার জন্য আবশ্যক হিসাবে বিবেচিত না হলে অন্য সব ধরনের অস্ত্রোপচার পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ সংক্রমণ এখনো তিন শর ঘরে। ব্রিটিশ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই সংখ্যা অল্পসময়ের মধ্যে অনেক বেশি পরিমাণে বাড়বে। তাই পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে কী দাঁড়াবে, সেই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে চলছে তাঁদের প্রস্তুতি।

চীনের মতো সাত দিনে একটি পুরো হাসপাতাল তৈরি করে ফেলার সক্ষমতা দ্বিতীয় কোনো দেশের আছে বলে জানা যায় না। সংক্রমণ মোকাবিলায় চীন যে ধরনের কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, তেমনটি কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রায় অকল্পনীয়। ইতালি ও ইরান সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে শুরুর দিকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে না পারায় তার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। এখন পুরো ইতালি কোয়ারান্টাইন হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের গবেষণাগার হচ্ছে ইতালি। বিশ্বায়নের এই যুগে ইতালি কীভাবে নিজেদের স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতা কার্যকর করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বৈশ্বিক এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ যতটা পাওয়া গেছে, তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারাই এখন বড় কথা। বিশেষজ্ঞরা এই ভাইরাসের সংক্রমণ যতটা সম্ভব বিলম্বিত করার চেষ্টা করছেন এই আশায় যে গ্রীষ্মের গরমে এই ভাইরাস দীর্ঘক্ষণ টিকতে পারবে না এবং ইত্যবসরে এর চিকিৎসাও হয়তো আবিষ্কার হবে। বাংলাদেশ উষ্ণমণ্ডলীয় দেশ হওয়ায় এই সুবিধা নেওয়ার সুযোগও রয়েছে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সংক্রমণ যতটা সম্ভব সীমিত রাখা। জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকে উপেক্ষা করে সেটি অর্জন সম্ভব নয়। কেননা, করোনা সীমান্ত মানেনি, ধনী-গরিবের ফারাকও মানে না।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক


Source: https://www.prothomalo.com/opinion/article/1644053/%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A7%9F