করোনাভাইরাস: সচেতন হোক মানুষ, সাবধান হোক ভুল তথ্য থেকে

Author Topic: করোনাভাইরাস: সচেতন হোক মানুষ, সাবধান হোক ভুল তথ্য থেকে  (Read 2026 times)

Offline deanoffice-fahs

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 155
  • Test
    • View Profile
নভেল করোনাভাইরাস এবং এই ভাইরাসের কারণে হওয়া রোগ COVID -19 (COrona VIrus Disease - 2019)  নিয়ে উৎকণ্ঠিত সারা পৃথিবীর মানুষ। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে বিশ্বব্যাপি মহামারী বা Pandemic ঘোষণা করেছে।  আমার অফিস থেকে জানিয়ে দিয়েছে খুব জরুরি প্রয়োজন না হলে অফিসের সীমানাতে এসো না, ঘরে বসে কাজ করো। সেটাই করছি। আমি থাকি আমেরিকার লস এঞ্জেলস এর কাছে সান্টা ক্লারিটা শহরে, এখানে সব স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। একসাথে কোথাও ৫০ জনের বেশি একত্রিত হওয়া নিষেধ। বিয়ে বা জন্মদিনের দাওয়াত, কনসার্ট, রাজনৈতিক কিংবা  ধর্মীয় সমাবেশ (গির্জার সম্মিলন, মসজিদের জামাত) সবকিছু বন্ধ।
দুয়েকজন সহকর্মী শুরুতে একটু আধটু গাইগুঁই করছিলেন- একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে নাকি। এখন আমরা সবাই জানি, এটা মোটেই বাড়াবাড়ি নয়, বরং খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং খুবই খুবই জরুরি।

গণিতের ভাষায় বললে এই ভাইরাস ছড়ায় ‘সূচকীয়’ হারে। এর গ্রাফটা খুব ইন্টারেস্টিং। যখন মান কম, বৃদ্ধির হারও কম। শুরুতে খুব ধীরে বাড়ে, তারপর যখন মান বেড়ে যায় বৃদ্ধির হারও বেড়ে যায়। ইতালিতে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে আক্রান্ত ছিল ২০ জন, এরপর একমাসও যায়নি- আজ পাই দিবসে (১৪ মার্চ) সংখ্যাটা ২১ হাজার ১৫৭ (উৎস)। শুরুর সময় দেখে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, একটা দুইটা কেস দেখে কেউ বোঝে না যে কী আসতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যত আগে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা শুরু করা যায় তত ভালো। 

ভয় হয় বাংলাদেশ নিয়ে। সাধারণ মানুষ এবং সরকার দুইপক্ষকেই সচেতন হওয়া খুব জরুরি। তার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু উদ্ভট তথ্য আর লেখা দেখে বিরক্ত লাগে। এগুলো মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করবে। আমি চেষ্টা করছি যেসব তথ্য এখানে দেবো সবকিছুর নির্ভরযোগ্য সূত্র লিখে দিতে যেন মানুষ যাচাই করে নিতে পারে। কোনো কথাই তথ্য-প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করার দরকার নাই, আমার এই লেখাও না।
ছড়িয়ে পড়া কিছু ভুল তথ্য- ভুল ভাবনা
দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ভুলভাল তথ্যগুলো মানুষকে বিভ্রান্ত করে, আরও বিপদে ঠেলে দেয়। এখানে আমার চোখে পড়া কিছু ভুল তথ্য/চিন্তা খণ্ডন করছি।

১) ইউনিসেফ নাকি বলেছে ভাইরাসটা বড়, মাটিতে পড়ে যায়... - উঁহু, বলে নাই

ইউনিসেফের বরাত দিয়ে খুবই অদ্ভুত কিছু কথা বেশ কিছুদিন ফেসবুকে ঘুরেছে যার অধিকাংশই ভুল। সেগুলোর ভেতরে আছে এমন কিছু কথা- ভাইরাসটা আকারে বড়- মাটিতে পড়ে যায়, আইসক্রিম না খেয়ে গরম পানি খেলে ভাইরাস পেটে চলে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।  প্রথম কথা হচ্ছে ইউনিসেফ কোথাও এই জাতীয় কথা বলেনি।  এমন কিছু দেখলেই সতর্ক হোন। আপনার কোনো বন্ধু শেয়ার করলে তাকে জানিয়ে দিন ওটা ভুল, তাকে স্পষ্টভাবে মানা করুন- এটা যেন আর না ছড়ায়। এরকম ভুলভাল কথা যে ইউনিসেফের নাম দিয়ে ছড়ানো হচ্ছে এই খবর তাদের কাছেও পৌঁছে গেছে, সেই ব্যাপারে তাদের বক্তব্য পাবেন এখানে । ইউনিসেফ কাজ করে সারা পৃথিবীর শিশুদের নিয়ে। করোনাভাইরাস নিয়ে অবশ্যই তারাও সতর্ক এবং তাদের মূল বক্তব্য পাওয়া যাবে এখানে।

২) গরমের দেশে নাকি ছড়ায় না... -ভুল, সব জায়গায় ছড়াতে পারে

ফেসবুকে একটা পোস্ট চোখে পড়েছে যেখানে তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে কেউ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে গরমের দেশে এই ভাইরাস বেশি ছড়ায় না- এটা খুবই বিপজ্জনক ভুল তথ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা ওয়েবপাতা আছে ‘Myth Busters’ বলে। সেখানে  প্রথমেই বলা আছে ‘COVID-19 virus can be transmitted in areas with hot and humid climates’।  এখন পর্যন্ত পাওয়া সমস্ত তথ্য বলছে গরম এবং আর্দ্র এলাকাতেও COVID-19 রোগ ছড়াতে পারে। বাংলাদেশ গরম দেশ, তাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কিছু নাই। ১৪ মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত সৌদি আরব, মিশরে, ভারত, ইরাক - সব জায়গায় ১০০ এর উপরে আক্রান্ত (সূত্র)। এগুলো কোনোটাই ঠাণ্ডার দেশ না।

৩) শিশুরা নাকি আক্রান্ত হয় না ... -ভুল, সব বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লিঙ্কে গেলে এটাও পাওয়া যাবে। সব বয়সের মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে। যতদূর জানা গেছে বৃদ্ধ কিংবা বয়স্করা যদি আক্রান্ত হয় তাদের ক্ষেত্রে রোগের জটিলতা বেশি হবার সম্ভাবনা আছে, শিশুদের ক্ষেত্রে রোগটা মারাত্মক আকার ধারণ করে না (ইউনিসেফের তথ্য)। তাই বলে শিশুদের কিছু হবে না ভেবে অবহেলা করার মানে নেই। তাদের জন্য রোগের ভয়াবহতা হয়তো বেশি হবে না, কিন্তু তারা বাহক হিসেবে এই রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে অসুস্থ কিংবা ঝুকিপূর্ণ মানুষের কাছে।  বয়স্ক যারা এবং যাদের দেহে আগে থেকেই কোনো একটা অসুস্থতা আছে  (যেমন অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ) তাদের ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

৪) সবাইকে কি মাস্ক পরতে হবে? -না, যারা নিজেরা অসুস্থ, যারা স্বাস্থ্যকর্মী এবং যারা রোগীর দেখাশোনা করছে তাদেরকে মাস্ক পরতে হবে

বাংলাদেশে মাস্কের আকাল পড়ে গেছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা চড়া দামে মাস্ক বিক্রি করছেন এমন খবর চোখে পড়ছে হরহামেশাই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে আপনি যদি সুস্থ হন, বিনা কারণে মাস্ক পরার দরকার নেই (লিঙ্ক এখানে)। একই কথা বলেছে Center for Disease Control - CDC (লিঙ্ক এখানে- Respirators অনুচ্ছেদে দেখুন) আপনি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিংবা সন্দেহভাজন কোনো রোগীর দেখাশোনা করেন, তাহলে নিজেকে সুরক্ষার জন্য মাস্ক পরুন। যদি আপনি নিজে হাঁচি বা কাশিতে আক্রান্ত হন, তাহলে মাস্ক পরুন, যেন আপনার থেকে জীবাণু আর না ছড়াতে পারে। তারা এটাও বলছে যে শুধু মাস্ক পরে নিজেকে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত রাখা যাবে না। সাথে সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোঁয়া, হাঁচি-কাশি এলে কনুই বা টিস্যু দিয়ে ঢাকা- এগুলোর চর্চাও লাগবে।
যদি মাস্ক ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে সেটা ব্যবহারের সঠিক নিয়মটাও জেনে রাখতে হবে। কী করে পরতে হয়, কী করে খুলতে হয়, কোথায় কীভাবে ফেলতে হয়- এগুলোও জানাটা জরুরি। নিচের ভিডিওতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন কর্মী জানাচ্ছেন মাস্ক ব্যবহারের নিয়মাবলি। 


৫) রসুন খেলে, গরম পানি খেলে, ‘অমুক বলেছে তমুক খেলে’, অ্যান্টিবায়োটিক খেলে এই রোগ কি সেরে যাবে? -উঁহু, না, এই রোগের কোনো ভ্যাকসিন বা ঔষধ এখনও নাই (সূত্র)

অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়ার জন্য, ভাইরাসের জন্য নয়। Covid-19 রোগ ভাইরাসঘটিত। প্রতিরোধক কিংবা প্রতিষেধক কোনো হিসেবেই অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। যদি কোভিডে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হয়, এবং তার ব্যাকটেরিয়াঘটিত অন্য কোনো রোগ থাকে, তাহলে সেই অন্য রোগের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারেরা অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে Covid-19 রোগের কোনো ঔষধ এখনও নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে ২০ টির বেশি ভ্যাকসিনের কাজ চলছে, কিন্তু নানা ট্রায়াল পার হয়ে মানুষের গণহারে মানুষের ব্যবহার উপযোগী হতে বছরখানেক লেগে যেতে পারে বলে অনুমান করেছে সিএনএন । এই রোগের ঔষধ নিয়েও গবেষণা চলছে। কিন্তু সেখানেও একই ব্যাপার। নানান পরীক্ষাতে প্রমাণ করতে হবে যে ঔষধটা আসলেই কার্যকর এবং মানুষের ব্যবহারের উপযোগী।
শতকরা আশি ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ  মৃদু থেকে মাঝারি (mild to moderate)। জ্বর, শুকনো কাশির, ক্লান্তি, কফ - এগুলোই বেশি দেখা যায়  (সূত্র-১ , সূত্র-২)। এমনিতে আপনার শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাই এই জীবাণুগুলোকে একসময় হটিয়ে দেবে।
এটার আরেকটা মানে আছে। আপনি আক্রান্ত কাউকে একটা ঘাসের মধ্যে বিড়বিড় করে গালিগালাজ করে একটা ফু দিয়ে ধরিয়ে দিন, হোমিওপ্যাথির নামে চিনির দলা দিয়ে দিন, বড় সম্ভাবনা আছে সে কিছুদিন ভুগে সুস্থ হয়ে যাবে (আক্রান্ত হলে বাঁচার সম্ভাব্যতা ৯৬.৬ ভাগ) । সে ভাববে আপনি মনে হয় বিরাট কামেল, আসলে সে বুঝতেও পারবে না যে Placebo Effect ছাড়া ওইসবের আর কোনো মূল্য নাই, সুস্থ তিনি এমনিতেও হতেন।

৬) মানুষ কি শুধু শুধুই করোনাভাইরাস নিয়ে লাফালাফি করছে?... না, সতর্কতার দরকার আছে (প্যানিকের নয়)

একেবারে পাত্তা না দেওয়া এবং ভয়ে উল্টোপালটা কাজ করা- কোনোটাই কাজের কিছু না। অতি-আতঙ্কিত হয়ে নিজের কথা ভেবে অতিরিক্ত কেনাকাটা করে গুদামজাত করে ফেললে সেটা ভালো কিছু নয়, যাদের প্রয়োজন তারা পাবে না।
পাশাপাশি আপনাকে জানতে হবে- এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মোটেই অবহেলার নয়। কিছু কিছু সময় থাকে যখন ভয় না পাওয়ার থেকে কিছুটা পাওয়া ভালো। এটা তেমন একটা সময়। একেবারে যারা গা করছেন না, তারাই বরং নিজের ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক।

সারা চীন, ইতালি, স্পেন লকডাউন অবস্থায়। আমেরিকায় বড় বড় শহরে জনসমাগম নিষেধ। বড় বড় পুঁজিবাদী কোম্পানিগুলো লোকসান গুনে হলেও অফিসে যেতে মানা করছে কর্মীদের। আপনার কি মনে হয় এটা শুধু-শুধুই? যদি তা মনে হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে দোষ দেবো না। গুণোত্তর ধারা কিংবা সূচকীয় ফাংশন অনেকেই অনুভব করতে পারে না।

দাবার আবিষ্কার নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। দাবার আবিষ্কারে খুশি হয়ে রাজা পণ্ডিতকে উপহার দিতে চাইলেন। পণ্ডিত বললেন- বেশি কিছু চাই না- প্রথম ঘরে একটা গমের দানা। দ্বিতীয় ঘরে দুইটা, তিননম্বরে চারটা, এরপর ষোলোটা। এভাবে দ্বিগুণ করে করে সব ঘরে দেবেন। রাজা বললেন, এ আর এমন কী! কিন্তু ব্যাপারটা আসলে মোটেই সামান্য না। একটু হিসেব করলেই দেখবেন এমন করে গম দিতে গেলে মোট দানার সংখ্যা হবে 2⁶⁴-1=18446744073709551615। প্রতি দানা ৬৫ মিলিগ্রাম হলে মোট ওজন হবে 1.2×10¹⁵ কেজি। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর উৎপন্ন হয় প্রায় 7*10^11 কেজি। অর্থাৎ পণ্ডিত যা চেয়েছেন ঐ পরিমাণ গম উৎপাদন করতে পৃথিবীর 1700 বছর লাগবে! এটা এতটাই বড়ো একটা সংখ্যা।

আপনিও ঐ রাজার জায়গায় আছেন। আপনি একটা, দুইটা গম দেখে ভাবছেন এ তো কিছুই না।
না, মহামারী ঠিক এমনও আবার না। একটা সময়ে গিয়ে যারা সুস্থ হয়ে উঠবে, তারা আর নতুন করে আক্রান্ত হবে না, নতুন করে ছড়াবে না। ফলে সংখ্যাটা কমতে থাকবে। কিন্তু যদি অবহেলা করা হয়, তার আগে আক্রান্ত হবে বহু বহু মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার ৩.৪% (সূত্র)। সংখ্যাটা কম না। ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হলে ৩৪ হাজার মানুষ মারা যাবে।

কিন্তু মানুষ কি শুধু ভয়ের কারণে মাতামাতি করছে? না! এই মাতামাতির ভেতরে একটা আশার কথা আছে। আমরা এটার বিস্তৃতিকে প্রতিহত করতে পারি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা কার্যকর করতে পারলে এর বিস্তৃতি রোধ করা যাবে অনেকাংশে।
কীভাবে ছড়ায়

এই রোগ পরিস্থিতি মোকেবেলায় কী করা উচিৎ বুঝতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে রোগটা ছড়ায় কীভাবে।

    এই ভাইরাস মূলত মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি আর কাশি দিয়ে বের হয় জীবাণু। সেই  জীবাণুওয়ালা হাঁচি-কাশির ফোঁটা যদি সুস্থ মানুষের নাকে, মুখে বা চোখে পড়ে- জীবাণু ঢুকে যেতে পারে শরীরে। আপনি আক্রান্ত ব্যক্তির ৬ ফুটের ভেতরে থাকলে বাতাসে থাকা সেই ভাইরাস আপনার শ্বাসের সঙ্গেও ফুসফুসে ঢুকে পড়তে পারে। এটাই এই ভাইরাস ছড়ানোর প্রধান উপায়- মানুষের কাছাকাছি সংস্পর্শ (সূত্র)।

    CDC একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে। যাদের মধ্যে রোগের লক্ষণ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে (জ্বর, কাশি, হাঁচি ইত্যাদি), যারা সবচেয়ে বেশি অসুস্থ তারাই রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সংক্রামক। যাদের শরীরে জীবাণু রয়েছে কিন্তু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তারাও রোগ ছড়াতে পারে, তবে সেটার সম্ভাবনা কম, সেটা মূল উপায় নয় (সূত্র)।
    দ্বিতীয় উপায় হলো হাত দিয়ে জীবাণুওয়ালা কোনো তল স্পর্শ করার পর সেই হাত নাকে-মুখে-চোখে স্পর্শ করলে। হয়তো আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি-কাশির সময় হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছে, সেই হাত আর পরিষ্কার করেনি। এরপর সেই হাত দিয়ে সিঁড়ির রেলিং, দরজার হাতল, বেসিনের কল ধরেছে। জীবাণু লেগে গেছে সেখানে। আপনি সেগুলো ধরেছেন, আপনার হাতেও লেগে গেছে জীবাণু। তারপর আপনিও আর হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করেননি। এরপর নিজের নাকে, মুখে, চোখে ধরেছেন। জীবাণু ঢুকে যাবে আপনার শরীরেও (সূত্র)। তবে এই দ্বিতীয় উপায়টা রোগ ছড়ানোর মূল উপায় নয়, মূল উপায় কাছাকাছি মানুষের সংস্পর্শ।

করোনায় করণীয়
কীভাবে রোগ ছড়ায় জানলে আপনি বুঝবেন কী করলে এই ছড়ানোটা ঠেকানো যায়। নিচের দুটো পয়েন্ট লেখা হয়েছে WHO এর advice for public এবং CDC এর  How to protect yourself অবলম্বনে। লিঙ্কগুলোতে গিয়ে মূল লেখাগুলোও পড়ে আসার অনুরোধ রইল।

    ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা: সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুতে হবে বারবার (বিশেষ করে হাঁচিকাশির পর এবং পাব্লিক প্লেস থেকে ঘরে ফেরার পর)। সাধারণ সাবানই সবচেয়ে দারুণ কার্যকর- সাবানের অণুগুলো ভাইরাসের শরীরের চর্বির দেয়াল ভঙ্গে ফেলে ভাইরাসকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। সাবান না থাকলে হ্যান্ড- স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে যেখান অ্যালকোহলের পরিমাণ ৬০% এর বেশি। হাত পানিতে ভিজিয়ে এরপর সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধুতে হবে (দুইবার হ্যাপি বার্থডে টু ইউ গান গাইলে প্রায় ২০ সেকেন্ডের একটু বেশি হয়)। নখের নিচে আঙুলের ভাঁজে, হাতের উল্টো পৃষ্ঠে ভালো করে ধুতে হবে।

    হাঁচি-কাশি এলে হাতের তালু দিয়ে না ঢেকে কনুই দিয়ে ঢাকতে হবে। অথবা হাঁচি-কাশি টিস্যু পেপার দিয়ে ঢাকতে হবে, এরপর সাথে সাথে টিস্যু পেপারটা ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। 

    যেখানে সেখানে কফ, থুতু ফেলবেন না।

    নাকে মুখে চোখে হাত দেওয়া থেকে থেকে বিরত থাকতে হবে।

    সামাজিক দূরত্বায়ন (Social Distancing): হাঁচি- কাশি হচ্ছে এমন কারও ৬ ফুটের ভেতর আসবেন না। আমাদের অফিসে বলে দিয়েছে পারলে কারও ৬ ফুটের ভেতরেই আসার দরকার নাই। হ্যান্ডশেক বাদ দিন। অপ্রয়োজনে  বা স্বল্প প্রয়োজনে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন। জনসমাবেশে যাওয়ার দরকার নেই। যদি আপনি নিজে হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত হন, নিজেকে বাসায় আটকে ফেলুন, কোথাও বের হবেন না। বাসা থেকেই হটলাইনে ফোন দিন।  রাষ্ট্র নিজেও এটাকে কার্যকর করতে পারে। প্রয়োজনে সারা দেশ লক ডাউন করে দিতে পারে। আক্রান্ত এলাকার সঙ্গে সড়ক, নৌ- কিংবা আকাশপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে। অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ সব বন্ধ করে দিতে পারে। এমন হলে সেই নির্দেশনাকে মেনে চলবেন।

    মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোটাই যে রোগের বিস্তৃতির মূল উপায় তাকে বড় আকারে প্রতিহত করতে গেলে এই দূরত্বায়নের বিকল্প নেই।

    সামাজিক দূরত্বায়ন যে কাজ করে সেটার প্রমাণ ইতিহাসে বহুবার পাওয়া গেছে। চীনের উহানে সব লকডাউন করে ফেলার পর নতুন আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আছে সামাজিক দূরত্বায়ন কার্যকর করার মাধ্যমে। ইতালি দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে- সারা দেশ এখন লকডাউনে। কেউ ঘরে থেকে বেরোবে না খুব খুব জরুরি দরকার নাহলে।

    দূরত্বায়নের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ‘Flattening the curve’। একই সময়ে বহু মানুষ আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। সামাজিক দূরত্বায়ন কার্যকর করলে এটার ব্যবস্থাপনা কিছুটা সম্ভব হয়। সামাজিক দূরত্বায়ন কতটা কার্যকরী, তার একটা চমৎকার এনিমেশন প্রকাশিত হয়েছে Washington Post এ, সেটার লিঙ্কটা পাওয়া যাবে এখানে।


শেষ কথা:
এই ভাইরাস নভেল বা নতুন। ডিসেম্বর ২০১৯ এর আগে এমন ভাইরাস মানবজাতির ইতিহাসে কখনও কোথাও দেখা যায়নি। এর জন্য আমাদের শরীর প্রস্তুত নয়, প্রস্তুত নয় আমাদের অবকাঠামো। নেই ভ্যাকসিন, নেই ঔষধ। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে পরিচ্ছন্নতা, সামাজিক দূরত্বায়ন আর রাষ্ট্রীয়ভাবে ভ্রমণ, জনসমাবেশ নিষিদ্ধ, এমনকি প্রয়োজনে অফিস-আদালত, স্কুল কলেজ বন্ধ করার মতো আগ্রাসী কিন্তু কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এই ভাইরাসের ভয়াবহতাকে লাঘব করা সম্ভব।
সারা পৃথিবীর মানুষ সুস্থ থাকুক, রোগমুক্ত জীবন কাটাক এটাই প্রার্থনা।
পুনশ্চ:
মূল নোট লেখার পরে কিছু প্রশ্ন এসেছে। এখানে সেগুলোর উত্তর রেফারেন্সসহ লিখে রাখি।

১. আপনি লিখেছেন - ‘একটা সময়ে গিয়ে যারা সুস্থ হয়ে উঠবে, তারা আর নতুন করে আক্রান্ত হবে না, নতুন করে ছড়াবে না। ফলে সংখ্যাটা কমতে থাকবে।’ কিন্তু শোনা যাচ্ছে একবার আক্রান্ত হওয়ার পর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
উত্তর: এটার সম্ভাবনা খুবই  খুবই কম। কিছু ক্ষেত্রে হাস্পাতাল থেকে ছাড় দেওয়ার পর আবার ভর্তি  করতে  হয়েছে। একবার আক্রান্ত হওয়ার পর আবার করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে- এমন খবর আমিও  পড়েছি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- সেটার মূল কারণ হতে পারে যে আগের ইনফেকশন  পুরোপুরি সারেনি। ডায়গোনস্টিক রিপোর্ট ভুল।

২. আপনি লিখেছেন করোনাভাইরাস নতুন ভাইরাস। কিন্তু এর আগেও তো ২০০৩ এ চীনে SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome), ২০১২ তে মধ্যপ্রাচ্যে MERS (Middle Eastern Respiratory Syndrome) রোগ হয়েছিল করোনাভাইরাস থেকে।

উত্তর: ভাইরাসের একটা ধরনের নাম হলো করোনাভাইরাস, সেসব ভাইরাসের দেহে রাজমুকুটের (ল্যাটিন ভাষায় Corona মানে মুকুট) মতো প্রোটিন বের হয়ে থাকে। অনেক প্রজাতির করোনাভাইরাস রয়েছে, তার মধ্যে মানুষের শরীরে রোগ তৈরি করতে পারে এমন ছয় রকমের করোনাভাইরাস আগে জানা  ছিল। SARS ভাইরাস, MERS ভাইরাস এগুলো সেই ছয় রকমের মধ্যে দুটো। গত  ডিসেম্বরে উহানে যেটি পাওয়া গেল, সেটাও করোনাভাইরাস কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন  প্রজাতির, এটার নাম দেওয়া হয়েছে SARS-CoV-2। এই দিয়ে মোট সাত রকমের Human Coronavirus হলো। এটা একেবারে নতুন বলে  এটাকে Novel Coronavirus বলা হচ্ছে।

৩. আপনি লিখেছেন- সবাইকে গণহারে মাস্ক পরার দরকার নেই। মাস্ক কি কোনোই কাজ করে না?

উত্তর: মাস্ক অবশ্যই কিছুটা সুরক্ষা দেয়, কিন্তু সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে। Covid-19 রোগ ছড়ায় হাঁচি-কাশির ফোঁটা নাকে,  মুখে, চোখে গেলে। মাস্ক ঐ ফোঁটাগুলো আটকাতে পারবে। কিন্তু ভাইরাস যদি বাতাসে থাকে, সেটার আকার এতই ছোট (ব্যাস 125 nm) সাধারণ ফেস-মাস্ক বা Surgical Mask এর ভেতর দিয়ে অনায়াসে ঢুকে যাবে। এটা ঠেকাতে দরকার বিশেষ N95 respirator, যেটা খুবই শক্তভাবে লেগে থাকে। ওটা দিয়ে শ্বাস নেওয়াই কষ্ট। CDC এটাকে গণহারে ব্যবহার করতে মানা করেছে।

আরও কয়েকটা ব্যাপার জরুরি, মাস্ক ব্যবহার করতে হলে নিয়ম মেনে ব্যবহার করতে হবে।  এর সামনের দিকটা জীবাণুতে পূর্ণ থাকে। ওখানে কখনোই হাত দেওয়া যাবে না। পরা কিংবা খোলার সময় রাবার ধরে পড়তে হবে, খুলতে হবে। পরা বা খোলার পর হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। যেখানে সেখানে মাস্ক ফেলে দেওয়া যাবে না। এক মাস্ক বহুক্ষণ পরে থাকা যাবে না। এমনসব নিয়ম না মানতে পারলে লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা বেশি।  এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনের সুরক্ষা উপকরণে স্বল্পতা সারা পৃথিবী জুড়েই। সাধারণ মানুষ গণহারে ব্যবহার করলে এই স্বল্পতা আরো বাড়বে। গার্ডিয়ান পত্রিকা একটা কথা লিখেছে, সেটা মার ভালো লেগেছে মাস্ক মানুষকে একটা ভুল তৃপ্তি বা স্বান্ত্বনা দেয় যে  সে সুরক্ষিত। কিন্তু মাস্ক পরার সাথে সাথে যদি বারবার হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশি কনুই দিয়ে আটকানো, আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে ৬ ফুট দূরে থাকা - এসব নিয়ম না মানা হয়, তাহলে শুধু মাস্ক তাকে সুরক্ষা দেবে না।

আমার ধারণা এসব কারণে WHO এবং CDC দুটো প্রতিষ্ঠানই সুস্থ মানুষের জন্য বিনাপ্রয়োজনে মাস্ক পরাকে নিরুৎসাহিত করেছে। আপনি যদি নিজে অসুস্থ হন তাহলে পরুন, স্বাস্থ্যকর্মী হলে পরুন, অসুস্থ ব্যক্তির দেখাশোনা করেন তাহলে পরুন।

https://www.facebook.com/notes/chamok-hasan/%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%B8%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%A8-%E0%A6%B9%E0%A7%8B%E0%A6%95-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B7-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%B9%E0%A7%8B%E0%A6%95-%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%A4%E0%A6%A5%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87/10222152066891057/
........................................
Al Mozammel
Administrative officer
Office of the Dean
Faculty of Allied Health Sciences
Daffodil International University