অর্থনীতিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতি নেই
মুনমুন শবনম বিপাশা
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশগ্রহণ করে। শুধু ১৯৭১ সাল নয়, সব সময়েই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাংলার নারীরা সোচ্চার ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও নারীদের অবদান, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান_ সব সময়েই নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া তারা পরোক্ষভাবেও সহায়তা করেছে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মায়েরা তাদের সন্তান-স্বামীকে যুদ্ধে পাঠাতে পিছপা হয়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নারীদের অত্যচার কখনোই ভোলার নয়। আমাদের দেশের নারীরা হচ্ছে দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মহান নিদর্শন। এ দেশের জন্মই হয়েছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এসব নারীকে পেছনে রাখলে কখনোই দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই উন্নয়ন মানে শুধু মাথাপিছুু গড় আয় বৃদ্ধি করা নয়। এই উন্নয়ন হলো 'মানব উন্নয়ন'। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার প্রকৃত ক্ষমতায়ন না হলে সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।
১৯৭১-এর পর আমাদের বড় প্রাপ্তি হলো সংবিধানে বর্ণিত অঙ্গীকার_ নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা অবদান রেখে চলেছে। তবে এখন পর্যন্ত অবদানের স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন তারা যথার্থভাবে পায়নি । এ দেশের প্রায় ৩ কোটি ২৫ লাখ নারী দেশের অর্থনীতিতে শ্রম দিচ্ছে। গ্রামে ও শহরে বাংলাদেশের মেয়েরা অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং এর প্রভাব পড়ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষা উন্নয়নের ক্ষেত্রে। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই, নারীরা দুই পা এগোলোও শুধু পারিপাশর্ি্বকতার কারণে পাঁচ পা পিছিয়ে পড়ছে। এখনও নারীরা স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ কথা সত্যি যে, অর্থনৈতিক দিক থেকে বর্তমানে নারীরা অনেক স্বাবলম্বী। যদিও কিছু মৌলবাদী সংগঠন এই অগ্রগতি থামাতে চাচ্ছে।
কয়েক বছর ধরে মুদ্রাস্টম্ফীতি যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। ফলে মানুষ আগের চেয়েও গরিব হচ্ছে। ১৫ কোটি জনগণের মধ্যে কমপক্ষে ১২ কোটি ৪৩ লাখ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৮৩% দরিদ্র। আর এই জনগণের প্রায় অর্ধেক '৬ কোটি ২০ লাখ' দরিদ্র নারী। আর বাকি জনসংখ্যার মধ্যে ৫৬ লাখ ধনী ও ৭২ লাখ মধ্যবিত্ত নারী। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন টক শো, সেমিনার হয় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য। বেশির ভাগের মূলকথা হলো নারীর ক্ষমতায়নে উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ পদের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা সাধারণত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ দেখা যায়, নারীর ক্ষমতায়নে এই ৫৬ লাখ (যারা মোট নারীর ৭ দশমিক ৭%) নারীর ওপর গুরুত্ব দেওয়া যায়। বাদ বাকি ৬ কোটি ২০ লাখ (মোট নারীর ৮০%) দরিদ্র নারীর ওপর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে আমার মতে, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে নারীর প্রকৃত উন্নয়ন করতে গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই সব দরিদ্র্য ও নিম্নবিত্ত ৬ কোটি ২০ লাখের কথা আগে বিবেচনা করা উচিত।
জাতীয় অর্থনীতি ও মোট দেশজ উৎপাদনে নারীর প্রকৃত অবদান কখনোই পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের জিডিপিতে নারীর আবদান মাত্র ২০ শতাংশ দেখানো হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে ১০ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী নারীরা গৃহস্থালি কাজে বছরে ব্যয় করে ১৬ হাজার ৬৪১ শ্রমঘণ্টা। তারা শিশু ও প্রবীণদের যত্ন করে। অথচ এ সব কাজের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। এক গ্রাম্য নারী ধান শুকানো, ধান ভাঙা, বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজই করে থাকে। কিন্তু জিডিপি হিসাব করার সময় এ সব কাজ স্বীকৃতি পায় না। ঢাকা ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাতের এক লেখায় বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের নারীর এসব কাজের বার্ষিক অর্থমূল্য হবে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে গ্রামের নারীদের অবদান ৭৯ শতাংশ এবং শহরের নারীর অবদান ২১ শতাংশ। তিনি লিখেছেন, ২০০৭-এ মোট জিডিপির বাজারমূল্য ছিল ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে নারীর প্রকৃত অবদান যোগ করলে হতো ৭ লাখ ১৭ হাজার ১১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০০৭-এর জিডিপির ৪৮ ভাগ হতো নারীর অবদান। এ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, অর্থনীতিতে নারীর প্রকৃত অবদানকে অবমূল্যায়ন করে নারীর প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো হচ্ছে না। ব্যাপারটা এমন, 'নারীরা তো এসব কাজ করবেই।' অথচ পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ও পুরুষ শাসিত এই সমাজ নারীদের এসব কাজের সম্মান ও মূল্যায়ন করতে সব সময়ই দ্বিধান্বিত। নারীরা যুগ যুগ ধরে শোষিত ও অবহেলিত হয়ে আসছে। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সমাজিক কুসংস্কারের দোহাই দিয়ে গৃহস্থালি কাজে নারীর ব্যয় করা শ্রম ও মেধাকে কখনোই মূল্যায়ন করা হয়নি।