থ্রি জি বনাম ফোর জি: কিছু প্রাথমিক পার্থক্য
বেশ কিছুদিন হল দেশের টেলিযোগাযোগ প্রেক্ষাপটে যে হাওয়াটি বারে বারে সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে তা হচ্ছে থ্রি-জি এবং ফোর-জি। একবার আমরা শুনছি থ্রি-জি আসছে, আবার শুনছি না, থ্রি-জি না, ফোর-জি আসছে। কর্তাব্যাক্তিদের কথার দুলুনিতে দুলছি আমরা যারা সাধারন জনগণ। একটু হাই-স্পীড ইন্টারনেটের জন্য সারা দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আর সেটা নিয়ে তিন বছর পার হয়ে গেলেও, আমরা ঠিক করতে পারছি না - থ্রি জি, নাকি ফোর জি! থ্রি-জি নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে করতে, ভাবতে ভাবতে সেই প্রযুক্তিটি পুরনো হয়ে এখন ফোর-জি'র পথে পৃথিবী পা বাড়িয়েছে। দেশের এতো বড় ক্ষতির জন্য কাকে জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে ?
সাধারণ একজন মানুষের কাছে থ্রি-জি এবং ফোর-জি মোবাইল প্রযুক্তি রহস্যময় দুটি শব্দ। তবে তারা হয়তো একটি বিষয় চিন্তা করতে পারেন, তাহলো থ্রি আর ফোর-এর ভেতর মাত্র পার্থক্য এক। তাহলে আর এতো ঝামেলা কেন!
তবে সাধারণ মানুষদেরকেও এর থেকে একটু বুঝতে হবে। কারণ বর্তমান সময়ে বাজারে থ্রি-জি এবং ফোর-জি স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটে ভরে যাচ্ছে। আপনার যদি এগুলো সম্পর্কে কিছুটা ধারনা না থাকে, তাহলে এগুলো কিনতে গিয়ে শুধু শুধু টাকা নষ্ট হতে পারে। আবার বিদেশ থেকে কেউ দেশে ফিরছেন। তাকে বললেন একটা আধুনিক স্মার্টফোন নিয়ে আসতে। তিনি আপনার জন্য নিয়ে এলেন দেখতে দারুন একটি ফোর-জি স্মার্টফোন। তাহলে লাভটি কী হলো। তবে একটি বিষয় মনে রাখবেন, নাম্বার বেশি হলেই সব সময় যে ভালো ফল পাওয়া যাবে তা কিন্তু নয়।
থ্রিজি বনাম ফোরজি: কী তারা ?
প্রথমের হিসাব প্রথমে, জি এর মানে কি? 'জি' মানে জেনারেশন বা প্রজন্ম। মোবাইল প্রযুক্তির প্রজন্ম, যা মোবাইল ফোন এবং এর নেটওয়ার্কে ইনস্টল করা হয়ে থাকে। প্রতিটি নতুন 'জি'-এর জন্য আপনাকে নতুন একটি ফোন কিনতে হবে আর নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে ব্যয়বহুল আপগ্রেডের। প্রথম দুটির একটি ছিল অ্যানালগ সেল ফোন (ওয়ান জি বা প্রথম প্রজন্ম) এবং অপরটি ডিজিটাল ফোন (টু-জি বা দ্বিতীয় প্রজন্ম) এর জন্য। বাংলাদেশের মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কগুলো এখনও টু-জি, এবং সরকার চিন্তা ভাবনা করছে এক সাথেই থ্রি-জি এবং ফোর-জি'র লাইসেন্স দিয়ে দেবে। কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে টু-জি পর্যন্ত বিষয়গুলো সাদামাটাই ছিল। এর পরে এসেই বিষয়টা একটু জটিলাকার ধারণ করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক, অথবা থ্রিজি চালু হয় ২০০৩ সালে। সে সময় এর সুসংগত সর্বনিম্ন ইন্টারনেটের গতি ছিল ১৪৪ কিলো-বিট/সেকেন্ড। সে সময় ধারণা করা হয়েছিল এর মধ্যে দিয়েই "মোবাইল ব্রডব্যান্ড" চালু হবে। কিন্তু বর্তমানে নানা ধরনের থ্রি-জি চালু রয়েছে। এবং এই "থ্রি-জি" সংযোগ মানে ইন্টারনেট গতি ৪০০ কেবিপিএস থেকে এর চাইতে দশ গুণ বেশিও পেতে পারেন।
সাধারণত নতুন প্রজন্ম নিয়ে আসে নতুন বেজ প্রযুক্তি, প্রতি ব্যবহারকারী হিসেবে নেটওয়ার্কের আরো বেশি তথ্য ধারণক্ষমতা এবং আরো ভালো ভয়েস পাঠানোর সুবিধা।
সে হিসেবে ফোর-জি মানে আরো দ্রুত গতি সম্পন্ন বলে অনুমান করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ব্যাপারটা সবসময় এরকম নয়। ফোর-জি নামধারী প্রযুক্তির শুধু যে অভাব নেই তা নয়, নানাভাবে এই প্রযুক্তিটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আর তাই ফোরজি টার্মটি হয়ে পড়েছে প্রায় অর্থহীন।
মান নির্ধারণের সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন, ফোর-জি নামকরণের একটা নির্দিষ্ট মাপকাঠি তৈরি করে দেয়ার প্রচেষ্টা করেছে, কিন্তু এর ক্যারিয়াররা বার বার তা উপেক্ষা করায় শেষ পর্যন্ত আইটিইউ পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তি বলতে আসলে একক কোনও প্রযুক্তি নেই - তিনটি উপায়ে এই ফোর-জি বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলো হলো এইচএসপিএ+ ২১/৪২, ওয়াইম্যাক্স এবং এলটিই। যদিও কিছু মানুষ এলটিইকেই শুধু চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তি বলে মনে করে থাকেন। আবার কেউ কেউ বলে এদের কেউ চতুর্থ প্রজন্মের যে গতি থাকার কথা তা দিতে সক্ষম নয়।
তবে একটা নিয়ম সকলেই মানতে চেষ্টা করে সেটি হচ্ছে, নতুন প্রজন্মটিকে অবশ্যই আগের প্রজন্মের গতি অপেক্ষা দ্রুত হতে হবে। অবশ্য এই নিয়ম শুধুমাত্র মোবাইল পরিচালকদের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। উদাহরণ দিলে ব্যপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে, ধরুণ, আমরা সকলেই জানি সিটিসেল দেয় সিডিএমএ সুবিধা। এরা যদি ওয়াইম্যাক্স ফোর-জি চালু করে তাহলে তা অবশ্যই তাদের সিডিএমএ থ্রি-জির চাইতে বেশি গতি সম্পন্ন হবে। কিন্তু, গ্রামীণ ফোনের থ্রি-জি এইচএসপিএ সংযোগ বাংলালিঙ্ক বা রবির (যদি থাকতো) ফোর-জি এলটিই এর চাইতে দ্রুত গতির হতে পারে। অর্থাৎ আপনার মোবাইল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানটি যদি তার তরঙ্গ পরিবর্তন করে তাহলে সে আগের চেয়ে গতিশীল হলেও প্রতিদ্বন্দ্বীর চাইতে গতিশীল হবে তা কিন্তু বলা যাবে না। খুব অবাক লাগছে, তাই না?
তাই যারা ভাবছেন, ফোর-জি এলেই আমরা ব্রডব্যান্ডের গতিতে ভেসে যাবো, তারা একটু ব্রেক নিতে পারেন। এটা পুরোটাই নির্ভর করবে, সেই অপারেটর কিভাবে তার নেটওয়ার্ক বসাচ্ছে, এবং কতটুকু সেবা তারা আসলেই দিতে চায়। এর সাথে খরচের বিষয়টিও জড়িত। সেটা এই আলোচনায় আর আনা হলো না।
চতুর্থ প্রজন্মের সংযোগ কি আপনার প্রয়োজন ?
বাংলাদেশে বাংলা লায়ন এবং কিউবী নামের দুটি কোম্পানী ওয়াইম্যাক্স পদ্ধতিতে ফোর-জি সেবা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু তাদের সেই সেবা এবং দামে কি আপনি সন্তুষ্ট? তাহলে কেন মনে হচ্ছে যে, এলটিই ফোর-জি এলেই আমরা বিশাল কিছু পেয়ে যাবো? তবে হ্যাঁ, কিছু পরিবর্তন তো হবেই, তার মূল কারণ হলো এলটিই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার। পৃথিবীতে যেই প্রযুক্তি বেশি মানুষ ব্যবহার করবে, তার দাম ততই কমে যাবে। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই পৃথিবীর সবচে বড় ওয়াইম্যাক্স ক্যারিয়ার স্প্রিন্ট তাদের ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তিকে পরিত্যাগ করে এলটিই-তে কনভার্ট করে ফেলার কাজে হাত দিয়েছে। সেই হিসাবে, বাংলালায়ন এবং কিউবী যেকোনও সময় ধাপ্পাস করে মাটিতে পড়ে যাবে। কিন্তু গ্রাহক হিসেবে আপনার সমস্যা কোথায়? আপনাকে আরেকটি থ্রি-জি কিংবা ফোর-জি মডেম কিনতে হবে, এই যা!
তাই বলে কি আপনাকে ফোর-জি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে হবে? ধরুন, এই বছরই দুটো কোম্পানী এলো - একটি থ্রি-জি নিয়ে অপরিট ফোর-জি নিয়ে। তখুনি কি আপনি ফোর-জি'র জন্য পাগল হয়ে যাবেন?
আপনি যদি নিয়মিত ভিডিও স্ট্রিমিং করতে পছন্দ করেন তাহলে ফোরজি আপনার জন্য স্বর্গ। ল্যাপটপের সাথে যদি মোবাইল সংযোগ করে আপনি ব্যবহার করে থাকেন তাহলে ফোর-জি আপনার জীবনে নিয়ে আসতে পারে স্বস্তি। মোদ্দা কথায় বিশালাকারে তথ্য আদান-প্রদান করতে হলেই আপনার প্রয়োজন হবে ফোর-জি'র। তবে, মনে রাখতে হবে - ফোর-জি নেটওয়ার্কে আপনি সহসাই অনেক বেশি ডাটা ডাউনলোড করে ফেলতে পারেন। ফলে আপনার যে কোটা থাকবে সেটা সহসাই শেষ হয়ে যেতে পারে। বিশাল একটা ফাইল মুহুর্তেই ডাইনলোড হয়ে আপনার মাসিক খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে!
থ্রি-জি নাকি ফোর-জি স্মার্টফোন কিনবো?
দেশে যদি চতুর্থ প্রজন্মের সংযোগ না আসে তাহলে এ জাতীয় মোবাইল কেনা উচিত হবে না। তাই বিদেশে অনেক ফোর-জি মোবাইল ফোন পাওয়া গেলেও সেটা বাংলাদেশে এনে চালানো যাবে না। তাই সেটা নিয়ে শুধু আত্মতৃপ্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনও লাভই নেই। আবার আরেকটি বিষয় মনে রাখবেন - ফোর-জি নেটওয়ার্কে আপনার মোবাইল ডিভাইসটি বেশি ব্যাটারী নষ্ট করবে। তাই আপনার কাছে যদি ইন্টারনেট গতির চাইতে ব্যাটারির স্থায়িত্বকাল অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে থ্রি-জি কেনাই ভালো হবে।
source : Zakaria Swapan