Daffodil International University

Career Development Centre (CDC) => Entrepreneurial Skills => Career Guidance => Be a Business man/woman => Topic started by: diljeb on December 13, 2014, 10:29:56 AM

Title: হাঁসের খামার (নদীতে খেয়ে খামারে ডিম)
Post by: diljeb on December 13, 2014, 10:29:56 AM
শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন

নদীতে খেয়ে খামারে ডিম

দিলীপ কুমার সাহা, নিকলী (কিশোরগঞ্জ) | আপডেট: ০২:২৬, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ / Like ৪
     

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহরকোনা গ্রামে সোয়াইজনি নদীর তীরে জিল্লু মিয়ার হাঁসের খামার। শামুক ভেঙে হাঁসগুলোকে খেতে দিচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলোকিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ধনু, সোয়াইজনি, ঘোড়াউত্রা ও নরসুন্দা নদীতে নৌকায় ঘুরলে দূর থেকে মনে হতে পারে, একটু পর পর বুঝি ঝাঁকে ঝাঁকে শীতের অতিথি পাখি। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এগুলো হাঁস। আর ছোট এক বা একাধিক নৌকায় বসে হাঁসের ঝাঁক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এঁরা হাঁসের খামারের লোক। হাওরবেষ্টিত এই উপজেলায় নদীগুলোকে কেন্দ্র করে প্রায় ৫০০ ছোট-বড় হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে।
প্রায় ২৭ বছর আগে নিকলীর নগর গ্রামের তিন বন্ধু ইসরাইল মিয়া, আলী হোসেন ও মঞ্জিলহাটির রহিম মিয়া মিলে নিজেদের বাড়িতে ৫০-৬০টি করে হাঁস পালন করতে শুরু করেন। দুই বছর পর হঠাৎ ডাকপ্লেগ রোগে হাঁসগুলো মারা গেলে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু ওই দুই বছরে তাঁদের হাঁস পালন ও ডিম বিক্রিতে লাভ দেখে মহরকোনা গ্রামের জিল্লু মিয়া তাঁর বাবা আবদুর রহমানের কাছে হাঁস পালনের বায়না ধরেন। ছেলের আবদার রাখতে ঘরে থাকা ৮৬ মণ ধান বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকা দেন হাঁস কেনার জন্য। জিল্লু মিয়া ২৫ হাজার টাকায় সিলেটের বানিয়াচং উপজেলা থেকে ৩০০ হাঁস কিনে আনেন। বাকি পাঁচ হাজার টাকা হাতে রাখেন খামার পরিচালনার জন্য। এক মাসের মাথায় ২৫০টি হাঁসই ডিম দিতে শুরু করে। ডিম বিক্রি থেকে প্রতিদিন তাঁর হাতে আসতে থাকে ৪০০ টাকা। এক বছর পর বাবাকে ৩০ হাজার টাকা ফেরত দেন জিল্লু। বছর দুয়েকের মধ্যে লাভের টাকা থেকে আরও এক হাজার হাঁস কেনেন তিনি। দ্রুত বড় হতে থাকে তাঁর খামার। এখন তাঁর খামারে চার হাজার হাঁস রয়েছে। খামারের প্রতিদিনের খরচ পাঁচ হাজার টাকা বাদ দিলেও গড়ে দৈনিক পাঁচ হাজার টাকা লাভ থাকছে তাঁর।
জিল্লু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা একসময় খুব গরিব ছিলাম। অন্যের জমি বর্গা করতাম। হাঁসের খামার করে দিন ফিরেছে।’ জিল্লু এখন দশ একর বোরো ধানের জমিসহ ২৫ লাখ টাকার মালিক। বললেন, ‘নিজে বেশি পড়াশোনা করতে পারিনি। দুই মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছি।’
এ গল্প শুধু জিল্লু মিয়ার নয়; হাঁস পালন করে এরই মধ্যে নিজের অবস্থা বদলেছেন নিকলীর কয়েক শ যুবক। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বর্তমানে ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক খামার গড়ে উঠেছে।
মহরকোনা গ্রামের হোসেন মিয়া (৪৫) পরিবার নিয়ে অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাতেন। এলাকায় কাজ না থাকলে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাতেন। বছর পাঁচেক আগে একবার ঢাকা থেকে বাড়িতে এসে অন্যদের হাঁসের খামার দেখে হাঁস পালনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। টাকা-পয়সা জোগাড় করে তিনি ২৫০টি হাঁস কিনে শুরু করেন খামার। বর্তমানে তাঁর খামারে হাঁসের সংখ্যা এক হাজার। হোসেন মিয়া বলেন, ‘এখন আমি হাঁসের খামার ছাড়াও দুই লাখ টাকার মালিক। সংসারে কোনো অভাব নেই। ভালো আছি।’
প্রায় একই ধরনের গল্প নিকলীর সদর ইউনিয়নের কালাচান মিয়া (৪৫), সুমন মিয়া (৪০), করম আলী (৪০), মালেক মিয়া (৩৮), কাঞ্চন মিয়া (৫০), আলম মিয়া (৪৩), কালাম মিয়া (৫৫), হোসেন মিয়া (৪৩), কাশেম মিয়া (৪০), লোকমান মিয়া (৪৭), সোনালী মিয়া (৫০), রুহুল মিয়া (৪৫), উসমান মিয়া (৩৬), সাইফুল ইসলাম (৫০), নাসু মাঝি (৪২), গিয়াস উদ্দিন (৬০) ও আলী ইসলামের। তাঁরা সবাই এখন সফল খামারি।
নিকলীর সদর ইউনিয়নে ঘোড়াউত্রা নদীর পাড়ে একটি হাঁসের খামার থেকে ডিম সংগ্রহ করছেন এক কর্মী l ছবি: প্রথম আলোকেন এত সাফল্য: হাঁস চাষ বা হাঁসের খামার দেশের অন্য অঞ্চলেও কম-বেশি আছে। কিন্তু এই এলাকার চাষিরা হাঁস চাষের ক্ষেত্রে বেছে নিয়েছেন একটা নতুন পদ্ধতি। এখানকার খামারগুলো প্রায় সব নদীকেন্দ্রিক। হাঁসগুলো সারা দিন নদীতেই থাকে। রাতে নেওয়া হয় নদীপাড়ের অস্থায়ী খামারে। দিনভর নদীতে ঘুরে ঘুরে প্রাকৃতিক খাবার খায়। বাড়তি খাবার তেমন একটা দেওয়াই লাগে না।
নদীতীরের একাধিক খামারে গিয়ে খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত বাড়ির আশপাশে খামার করে হাঁস পালন করলে মোট খরচের একটা বড় অংশ চলে যায় খাবারের পেছেন। এতে লাভ কমে যায়। কিন্তু নদীর পাড়ে খামার করলে এত খরচ হয় না। নদীতে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যায়, হাঁসগুলো সারা দিন ঘুরে সেই সব খবার খায়। আলাদা খাবার দিতে হয় সামান্যই। এ ছাড়া উন্মুক্ত পরিবেশে ও নদী থেকে প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ায় আগাম ডিম দেওয়াসহ ডিমের পরিমাণ বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে খরচ কম, লাভ বেশি বলে নদীর তীরে খামারের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে এ উপজেলায়।
খামারিরা জানান, এই খামারগুলো মূলত ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যেই গড়ে তোলা হয়। সাধারণত ৫০০ থেকে শুরু করে চার হাজার পর্যন্ত হাঁস থাকে একেকটি খামারে। প্রতিটি খামারে হাঁসগুলো দেখভাল করার জন্য দুই থেকে চারজন লোক থাকে। তবে নদীতে খাবারের সংকট দেখা দিলে খামারিরা প্রতিদিন এক হাজার হাঁসের খাবারের জন্য ৩০ খাঁচা শামুক কেনন। প্রতি খাঁচা শামুক ৩০ টাকা।
খামারিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ খামারের চেয়ে নদীর পাড়ে হাঁসের খামারে বিনিয়োগ অনেক কম। এখানে অবকাঠামোগত ব্যয় নেই বললেই চলে। হাঁস কেনা বাবদ যে পরিমাণ টাকা লাগে, সেটিই মূল বিনিয়োগ। যেমন এক হাজার হাঁসের একটি খামার করতে চাইলে হাঁস কেনার জন্য লাগে আড়াই লাখ টাকা (প্রতিটি হাঁস গড়ে ২৫০ টাকা হিসাবে)। আর শামুক কেনা ও হাঁসগুলো নদীতে চরানো ও দেখভাল করার জন্য লোক রাখাসহ অন্যান্য খাতে প্রতি মাসে আরও ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতিদিন ডিম পাওয়া যায় গড়ে ৯০০। বর্তমান বাজারদর হিসাবে ৯০০ ডিমের দাম প্রায় সাড়ে আট হাজার টাকা। মাসে গড়ে প্রায় আড়াই লাখ টাকার ডিম বিক্রি করা যায়। অর্থাৎ পরিচালন খরচ বাদ দিলে মাসে প্রায় দুই লাখ টাকা লাভ করার সুযোগ থাকে।
হাঁসের জাত: খামারগুলো ঘুরে মূলত দুই জাতের হাঁস দেখা গেছে। একটির নাম ‘নাগিনী’। এ জাতের হাঁস সারা দিন নদীতে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। আবার ডিমও দেয় তুলনামূলক বেশি দিন। অপর জাতটির নাম ‘খাগি’। এ জাতের হাঁসগুলো নদীতে ঘোরাফেরা করে কম। খামারিরা এ জাতের হাঁসগুলোকে শামুক, ধান ও গম দিলে বসে বসে খায়। আবার ডিমও দেয় কম দিন। তাই খামারিরা নাগিনী জাতের হাঁসই পালন করেন বেশি। একটি হাঁস টানা তিন বছর প্রায় নিয়মিত ডিম দেয়। এরপর পুরোনো হাঁস বিক্রি করে আবার নতুন হাঁস কিনে খামার সাজাতে হয়।
খামারিদের অভিযোগ, কর্মকর্তার বক্তব্য: এলাকার শুরুর দিককার খামারি জিল্লু মিয়া। তিনি অভিযোগ করেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে খামারিরা কোনো সহযোগিতা পান না। সরকারিভাবে হাঁসের যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, তা পেতে হলে টাকা দিতে হয়। খামারে ডাকপ্লেগ বা অন্য কোনো রোগ দেখা দিলে এদের কাছ থেকে কোনো চিকিৎসা বা পরামর্শ পাওয়া যায় না। এ কারণে অনেক সময় খামারে হাঁসের মড়ক দেখা দিলে অসহায় হয়ে বসে থাকতে হয়।
তবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এম এ জলিল বলেন, ‘ওষুধের সরবরাহ কম থাকায় অনেক সময় খামারিদের চাহিদামতো ওষুধ দেওয়া যায় না। আর জনবল কম থাকায় অনেক সময় খামারগুলোতে সঠিক সময়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।’ টাকা-পয়সা নেওয়ার অভিযোগ নজরে আনলে তিনি জোর দিয়েই বললেন, ‘আমি কোনো দিন টাকা নিয়ে কোনো খামারে চিকিৎসা করিনি। অফিসের অন্য কেউ করেন কি না, তা আমার জানা নেই।’ এই কর্মকর্তাও বললেন, নদীতে খাওয়ানো যায় বলে নিকলীতে হাঁস পালন ও খামারের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে।
খামারিরা জানান, কার্তিক থেকে জৈষ্ঠ পর্যন্ত আট মাস টানা ডিম দেয় হাঁস। তবে আষাঢ় থেকে আশ্বিন—চার মাস ডিম উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। তখন নদীতে খাবারের সংকট থাকে।
খামারি ও ডিম ব্যবসায়ীদের হিসাবে, নিকলীর এই খামারগুলোতে দিনে দুই লাখ ডিম উৎপাদন হয়। এখন প্রতিটি ডিম আট টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মূলত ঢাকার ঠাটারীবাজার ও কারওয়ান বাজারের পাইকারেরা এসব ডিম কিনে নিয়ে যান।