Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - Al Mahmud Rumman

Pages: 1 [2] 3
16
Creative Writing / লকডাউন ২০২০ (কবিতা)
« on: November 16, 2020, 01:18:39 PM »
পাশে থেকো, পাশাপাশি নয়,
স্পর্শে ছড়ায় যেন দুঃসময়।

একা থাকো, তবে একলা না,
অবহেলায় মৃত্যু ডেকো না।

খবর নিও, বেঁচে থাকে যে,
মনে মনে মরে আছে নাকি।
করোনা মেরেছে কিছু আর-
বাকিরা দেয় হিসাবকে ফাঁকি।

লাশের গায়ে থাকে না লেখা,
কি দল করতো, মরলো কি করে।
লাশের মিছিল পৃথিবী জুড়ে,
সন্ত্রস্ত মন বারবার যায় মরে।



(লকডাউন ২০২০ – রুম্মান মাহমুদ)

17
Creative Writing / কবিতা
« on: November 16, 2020, 01:17:55 PM »
তোমাকে ঘিরে ধরে মহামারি
অনুজীব-ত্রাসে করো হাহাকার
মানুষ, তুমি তো মরেছো ঢের
নিজের গেলানো বিষে বারবার

তবু কেন এত ভয় অযথা?
গান লেখো, সাধ করো বাঁচবার
হাতে হাত রাখতেও কাঁপছো
নিঃশ্বাসে বিষভয় একাকার।

ফিরে দেখো, যা কিছু হলো আজ-
তোমারই দায়ভার ষোলআনা
বাবার লাশ আজ কাঁধে নাও
আসে তোমারও মৃত্যু পরোয়ানা।



(করোনা – রুম্মান মাহমুদ)

18
Creative Writing / পাপেট (কবিতা)
« on: November 16, 2020, 01:17:14 PM »
তুমি ভালো আছো জানি
মগজ বিক্রির টাকায় লেখালেখি চলে
একদা পড়তাম তোমাকে
তখনো যাও নি চলে নষ্টের দখলে।
এখন অনেক টাকা তোমার
যখন যা বলায় অবিকল তা-ই বলে যাও।
দিনকে রাত করো হামেশা
কলমের কালিতে কত সত্য বানাও!
তুমি জিতে গেছো ভাবো
ভাবো এভাবেই চলে যাবে চিরকাল
মানুষ তো দু'টাকার পাপেট
সয়ে যাবে
  মেনে নিবে
    নুয়ে মাথা
      নেচে যাবে
        যেমনি নাচাও
          যেমনি নাচো
             সকাল বিকাল।

(পাপেট -  রুম্মান মাহমুদ)

19
Creative Writing / সে (কবিতা)
« on: November 16, 2020, 01:16:35 PM »
একটা পাথর নিয়েই বাঁচতে পারে বহুকাল।
পাথর ঘষে সে দাউ দাউ তোলে আনন্দ ঝড়-
যত ঢেউ তুমি দু’হাতে কুড়াও অখিল শ্রাবণ
বিনিময়ে দাও অবহেলা অপমান অকাতর।

ঘৃণা দাও কিছু ভাবো জিতে গেছো খুব এই খেলা।
বোধের আড়ালে থাকুক নেভানো অপরাধবোধ
সে হাসবে খুব যেভাবে হেসেছে সারাটাজীবন,
তাকাবেনা ফিরে, নখে ঠোঁটে জ্বলবেনা প্রতিশোধ।

জীবন দিয়েছে তাকে যথেষ্ট, ফুরাবার নয়।
অপেক্ষা শুধু নিবিড় নিথর মৃত্যুদিনের
যেভাবে পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় স্বমেহনে
তুমি উড়ে যাও স্বাদ মাখো ঠোঁটে অন্য তৃণের।

(সে – রুম্মান মাহমুদ)

20
Creative Writing / ঝগড়া (কবিতা)
« on: November 16, 2020, 01:15:50 PM »
বিকালের ছায়াটা একদিকে কাত হয়ে এলেই মনে হয় তুমি এসে দাঁড়িয়ে আছো দরজার ওপাশে। রণক্ষেত্র হবে আজ।
কুরুক্ষেত্র হবে। পেঁপে গাছের ছায়াটাকে মনে হয় অবিকল ঝগড়াটে তুমি।
ভাবতে পারো, ঝগড়া আর তোমাকে আলাদা করলে আর কী থাকে?
ঝগড়া নাই মানেই কেঁপে কেঁপে উঠবে না সমুদ্র, তোমার হাত সরে যাবে কোমর থেকে, চুল ঢুকে যাবে খোঁপায়।
পাড়ার ঘাড়ে শ্বাস ফেলবে দমবন্ধ রাত। স্কুলবাড়ির ছেলেরা শিস বাজাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেলো বলে।
ঝগড়া নাই এর পৃথিবীতে তোমাকে ছোট জোনাকি পোকার মতো উড়ে যেতে দেখবো দাদার কবরের কাছে।
দাদা আমি আসার আগেই ফুটে গেছেন ওপারে। তবু শার্লকের বাচ্চাটা তোমাকে চিনতে পারবে ঠিকই।
চিৎকারের বদলে ওই নরম আলো কত ভয়ংকর বুঝে বলবেন শান্ত হও। আমার নিরুপায় আতংক
পাখির মতো উড়ে গিয়ে কাজ জুটিয়ে নিবে কোন উঁচু গাছের ডালে।
এরচেয়ে ভালো এসো ঝগড়া করি চুরমার, উঠানে দাঁড়াও চুল খুলে।
যুদ্ধের শঙ্খে ত্রস্ত হোক দিগ্বিদিক। আরেকটা বোতাম ছিঁড়ে যাক জীবনের।


(ঝগড়া – রুম্মান মাহমুদ)

21
আপনার কবিতারা আমার বোকা মায়ের মতো। নুন আনতে পানতা ফুরানো জীবন।
অনুযোগ চাপা পড়ে যায় সারাদিনের কাজে। ছিঁড়ে যাওয়া শাড়ির পাড়টা দিয়ে মশারি ঝুলছে দেয়ালে।
খসখসে হাত, তবু কি মায়া! পায়ে পানি জমছে, কিডনিতে পাথর। তবু খেটে খেটে নিঃশেষ।
আমি বলি অভ্যাসের জীবন তোমার। মা শুধু হাসে। কেবল কি অভ্যাস!
তবে তো তরকারিতে কখনো নুন কম হতো না। তুই রাগ করে উঠে যেতি না।
মা'র খুব শখ ছিল সমুদ্র দেখার। আপনার কবিতার হাহাকার সমুদ্রের শঙ্খের মতো বাজে।
আমার মা কবিতা বোঝেন না, বাবার বাজার ফেরত সাইকেলের ক্রিং ক্রিং তার জীবনের একমাত্র আনন্দ।
জানি না আপনি আপনার কবিতার মতো কিনা।
আমার খুব ইচ্ছা একদিন আপনি কোন এক কাজকর্মহীন দুপুরবেলা আমাদের বাড়িতে আসবেন।
মায়ের হাতের চালের গুড়োর রুটি খেতে খেতে আপনার সমুদ্র শঙ্খ বাজাবেন।
মা সমুদ্র টের না পেয়ে রাতে খেয়ে যেতে বলবে।
আপনার দীর্ঘশ্বাস সন্ধ্যার আকাশের মতো দূরের পাহাড়চূড়ায় মিলিয়ে যাবে ক্রমশ।

(অভ্যাস - রুম্মান মাহমুদ) 

22
ড্যাফোডিল প্রথম আলো স্থায়ী ক্যাম্পাস বন্ধুসভার কাজের তালিকা ২০১৯

 
জানুয়ারি ২০১৯
১। নতুন কমিটির প্রথম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১৬ ই জানুয়ারি
২। ২য় সাপ্তাহিক বৈঠক - ২৩ জানুয়ারি
৩। প্রথম পাঠচক্র - ২৬ জানুয়ারি
৪। ৩য় সাপ্তাহিক বৈঠক - ৩০ জানুয়ারি
৫। চড়ুইভাতি ও ফানুস উৎসব - ৩১ জানুয়ারি
 
ফেব্রুয়ারি ২০১৯
১।  ৪র্থ সাপ্তাহিক বৈঠক - ৬ ফেব্রুয়ারি
২। “নারী ও শিশু নির্যাতন রুখব আমরাই” অংশগ্রহন - ৮ ফেব্রুয়ারি
৩। ২য় পাঠচক্র - ৯ ফেব্রুয়ারি
৪। বসন্ত বরণ - ১৩ ফেব্রুয়ারি
৫। ৫ম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২০ ফেব্রুয়ারি
৬। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উৎযাপন - ২১ শে ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহর
৭। ৩য় পাঠচক্র - ২৩ ফেব্রুয়ারি
৮। বই মেলা ভ্রমণ - ২৬ ফেব্রুয়ারি
৯। ৬ষ্ঠ সাপ্তাহিক বৈঠক - ২৭ ফেব্রুয়ারি
১০। ক্লাব বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন - ২৮ ফেব্রুয়ারি (সেমিফাইনালিস্ট)
 
মার্চ ২০১৯
১। ৭ম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১৩ মার্চ
২। ৪র্থ পাঠচক্র - ১৯ মার্চ
৩। ৮ম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২০ মার্চ
৪। পুষ্টি প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক উৎসব, ধানমন্ডি অঞ্চল সহযোগী - ২৩ মার্চ
৫। ৫ম পাঠচক্র - ২৫ মার্চ
৬। স্বাধীনতা দিবস আলোচনা - ২৭ মার্চ
৭। পুষ্টি প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক উৎসব, মিরপুর অঞ্চল সহযোগী - ২৯ মার্চ
৮। ৯ম সাপ্তাহিক বৈঠক - ৩১ মার্চ
 
 
এপ্রিল ২০১৯
১। ১০ম সাপ্তাহিক বৈঠক - ৩ এপ্রিল
২। ৬ষ্ঠ পাঠচক্র - ৭ এপ্রিল
৩। পুষ্টি প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক উৎসব, জাতীয় পর্ব সহযোগী - ১২ এপ্রিল
৪। ১১ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১৩ এপ্রিল
৫। নববর্ষ উৎযাপন - ১৪ ই এপ্রিল
৬। শুদ্ধ বাংলা চর্চা প্রতিযোগিতা “আমি বাংলায় কথা কই” - ১৪ ই এপ্রিল
৭। তারুণ্যের জয়োৎসব অংশগ্রহন - ২৪ এপ্রিল
 
 
মে ২০১৯
১। প্রযুক্তির হাতেখড়ি, গফরগাঁও পর্ব - ২রা মে
২। ১২ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১৩ মে
৩। ৭ম পাঠচক্র - ১৮ মে
৪। ১৩ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২০ মে
৫। ইফতার মাহফিল - ২৩ মে
৬। ১৪ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২৭ মে
৭। একটি করে রঙিন জামা - ৩০ মে
 
জুন ২০১৯
১। ১৫ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১১ জুন
২। ৮ম পাঠচক্র - ১৩ জুন
৩। ১৬ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১৮ জুন
৪। স্বরচিত সাহিত্য আড্ডা - ২৪ জুন
৫। ১৬ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২৫ জুন
৬। ৯ম পাঠচক্র - ২৯ জুন
 
জুলাই ২০১৯
১। ১৭ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২ জুলাই
২। ১০ম পাঠচক্র - ৬ জুলাই
৩। ১৮ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১০ জুলাই
৪। ১৯ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১৭ জুলাই
৫। প্রথম আলো পত্রিকা পঠনে উৎসাহ প্রদান - ২০ জুলাই
৬। ২০ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২৪ জুলাই
৭। একজন বন্ধু, দুইটি গাছ - ২৭ জুলাই
৮। ১১ তম পাঠচক্র - ৩০ জুলাই
 
 
আগস্ট ২০১৯
১। “আমাদের দায়িত্ববোধ, ডেঙ্গু করি প্রতিরোধ” কর্মসুচি - ৩ আগস্ট
২। ২১ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ৫ আগস্ট
৩। ২২ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১৮ আগস্ট
৪। বন্ধুদের ইদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান - ২২ আগস্ট
৫। ১২ তম পাঠচক্র - ২৪ আগস্ট
৬। ২৩ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২৭ আগস্ট
 
 
সেপ্টেম্বর ২০১৯
১। ২৪ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ৪ সেপ্টেম্বর
২। ১৩ তম পাঠচক্র - ৮ সেপ্টেম্বর
৩। ২৫ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১১ সেপ্টেম্বর
৪। ২৬ তম সাপ্তাহিক বৈঠক -  ১৮ সেপ্টেম্বর
৫। ড্যাফোডিল স্থায়ী ক্যাম্পাস বন্ধুসভার জন্মদিন উৎযাপন - ২২ সেপ্টেম্বর
৬। ২৭ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২৫ সেপ্টেম্বর
৭। বিজ্ঞান উৎসবঃ জাতীয় পর্ব সহযোগী - ২৭ সেপ্টেম্বর
 
অক্টোবর ২০১৯
১। ২৮ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২ অক্টোবর
২। অবহেলিত বাচ্চাদের কম্পিউটার শেখার ১ম ক্লাস - ৩ অক্টোবর
৩। ২৯ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ৯ অক্টোবর
৪। অবহেলিত বাচ্চাদের কম্পিউটার শেখার ২য় ক্লাস - ১০ অক্টোবর
৫। আন্ত ক্লাব ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন ও অংশগ্রহন - ১১ থেকে ২৯ অক্টোবর
৬। ৩০ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ১৬ অক্টোবর
৭। অবহেলিত বাচ্চাদের কম্পিউটার শেখার ৩য় ক্লাস - ১৭ অক্টোবর
৮। ৩১ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ২৩ অক্টোবর
৯। অবহেলিত বাচ্চাদের কম্পিউটার শেখার ৪র্থ ক্লাস - ২৪ অক্টোবর
১০। ৩২ তম সাপ্তাহিক বৈঠক - ৩০ অক্টোবর
১১। অবহেলিত বাচ্চাদের কম্পিউটার শেখার ৫ম ক্লাস - ৩১ অক্টোবর
 
নভেম্বর ২০১৯
১। আজ তোমাদের ছুটিঃ শ্রমজীবী মানুষদের হয়ে কাজ করা - ৩ নভেম্বর
২। ৩৩ তম সাপ্তাহিক বৈঠক -  ৬ নভেম্বর
৩। অবহেলিত বাচ্চাদের কম্পিউটার শেখার ষষ্ঠ ক্লাস - ৭ নভেম্বর
৪। নতুন কমিটি মেম্বার হবার আবেদন পত্র সংগ্রহ - ১৯ থেকে ২৩ নভেম্বর


23
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে কবি আল মাহমুদ, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ুন আজাদের সাথে তার অম্লমধুর সম্পর্ক, রোহিঙ্গা ইত্যাদি প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিনের যে-ফোনালাপ হয় তারই শ্রুতিলিপি এই সাক্ষাৎকার। শ্রুতিলিপি তৈরি করেছেন তরুণ গল্পকার সাব্বির জাদিদ।


রাজু আলাউদ্দিন: কেমন আছেন, গুণদা?
নির্মলেন্দু গুণ: এই তো আছি মোটামুটি।
রাজু আলাউদ্দিন: গুণদা, একটা ব্যাপার নিয়ে আলাপ করা দরকার আপনার সাথে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি আল মাহমুদের কবিতা আছে, ফলে ঐতিহাসিকভাবে আপনার ওই বক্তব্যটা একটু দুর্বল হয়ে পড়বে। সেটা নিয়ে আমার মনে হয় আপনার একটু ইয়ে করা উচিত।
নির্মলেন্দু গুণ: ওটা কোথায় আছে, কবে প্রকাশিত হয়েছে এটা জানা দরকার।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি একটা তথ্য পেয়েছি। তথ্যটা হইল, বেবী মওদুদ আপা, উনি একটা বই করেছিলেন, ‘বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান’, ওখানে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত যে কবিতাগুলো ছিল সেখানে আল মাহমুদের ‘নিশিডাক’ কবিতাটা আছে।
নির্মলেন্দু গুণ: এটা কোনো গ্রন্থে যায় নাই?
রাজু আলাউদ্দিন: আমার হাতে যেহেতু আল মাহমুদের বইগুলো নাই, এ জন্য আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। হয়ত বইয়ে নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো উনি বলতে পারবেন।

রাজু আলাউদ্দিন: উনি তো এখন আর ফোনে কথা বলতে পারেন না–এই রকম অবস্থা আর কি। তো যাই হোক, ওটা দেখেই জানতে হবে। যদি লিখে থাকেন তো ভালো। খারাপ না। আর কবিতাটাও তো বেশ ভালো। ভালো কবিতা। ওটাকে কবিতা করে তুলতে পেরেছেন। স্লোগানে পরিণত হয়নি। অনেকে তো শুধু প্রোপাগাণ্ডা করে ফেলে। কবিতার শিল্পরূপটা থাকে না। তো সেটা দেখলাম যে উনার এই কবিতাটায় আছে। এটা ভালো। খারাপ না।

নির্মলেন্দু গুণ: এই কবিতাটা আমার দেখা দরকার। তাহলে আমি বলতে পারব যে আমি দুঃখিত, আল মাহমুদ সম্পর্কে যে মন্তব্যটা করছিলাম ওটা ঠিক না। তার কবিতা পাওয়া গেছে। গ্রন্থভূক্ত হয়েছে কি না জানি না। কিন্তু এই সংকলনের মধ্যে পাওয়া গেছে। তাছাড়া এই ব্যাপারটা তার দৃষ্টিগোচর করা গেলে সে বলতে পারবে। নয়ত এটা খুঁজে পাওয়া কঠিন। আচ্ছা, আল মাহমুদের কি রচনা সমগ্র বের হয়েছে?

রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, রচনা সমগ্র বের হয়েছে। রচনা সমগ্র বা কাব্য সমগ্র এরকম নামে বের হয়েছে।
নির্মলেন্দু গুণ: কাব্য সমগ্র গদ্য সমগ্র তো আমারও বের হয়েছে। রচনা সমগ্র বা রচনাবলী বের হইছে কি না?

রাজু আলাউদ্দিন: রচনাবলী…. আমি ঠিক নিশ্চিত না এই মুহূর্তে গুণদা, বেরিয়েছে কি না। তবে জানা যাবে।
নির্মলেন্দু গুণ: আচ্ছা, জীবিত লেখকদের মধ্যে রচনাবলী প্রকাশের রেওয়াজটা সাম্প্রতিক ঘটনা। আগে তো এমন ছিল না।
রাজু আলাউদ্দিন: ছিল না।
নির্মলেন্দু গুণ: যেমন, আমি একবার ভোরের কাগজে দেখছি, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক যারা, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ– জীবদ্দশায় তারা তাদের রচনাবলী দেখে যেতে পারেননি।
রাজু আলাউদ্দিন: তবে একটা ব্যতিক্রম আছে। বুদ্ধদেব বসুর কিন্তু জীবিতাবস্থায় তার রচনাবলী বের হয়েছিল। কোন প্রকাশনী থেকে সেটা আমার মনে নেই। কিন্তু সবুজ রঙের মানে টিয়া রঙের কভার, এরকম প্রচ্ছদে।
নির্মলেন্দু গুণ: এটা চল্লিশের কবিদের পর থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি নামে সিগনেট থেকে বেরোনো শুরু হলো না?
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ।
নির্মলেন্দু গুণ: তখন এটা বেরোতে পারে। তার ব্যাপারে আমি মন্তব্য করি নাই। আমি চারজন যে বড় কবির কথা বললাম, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ– এদের কারো রচননাবলী কিন্তু জীবদ্দশায় বের হয়নি।
রাজু আলাউদ্দিন: না, এঁদের জীবদ্দশায় বের হয় নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: পরবর্তীকালে, মানে চল্লিশের পর থেকে এটা চালু হইছে। তার আগে এটা চালু ছিল না।
রাজু আলাউদ্দিন: তার আগে এটা চালু ছিল না। বরং বলা যায়, তিরিশের দশকের একমাত্র বুদ্ধদেব বসু দিয়ে শুরু হইছে আর কি। জীবিতাবস্থায় তার রচনাবলী বের হয়েছে।
নির্মলেন্দু গুণ: বুদ্ধদেব বসু এইসব ব্যাপারে খুব তৎপর ছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: ম্যাটিকুলাসও ছিলেন। তথ্য-তৎপর ছিলেন।
নির্মলেন্দু গুণ: আমাদের দেশে জীবদ্দশায় কার বেরিয়েছে?
রাজু আলাউদ্দিন: আমার মনে হয় না আমাদের দেশে জীবদ্দশায় কারো বের হইছে। না, বের হইছে বোধহয়। যেমন হাসান আজিজুল হকের বের হইছে। শামসুর রাহমানের কি বেরিয়েছিল?
নির্মলেন্দু গুণ: না।
রাজু আলাউদ্দিন: এখন ইদানীং বেরুচ্ছে একেবারে তরুণ কবিদেরও। লেখালেখি শেষ না হতেই এখন তারা রচনাবলী বের করার দিকে বেশি মনোযোগী।
নির্মলেন্দু গুণ: এরকম আছে কয়জন?
রাজু আলাউদ্দিন: বেশ কয়েকজনই আছে দেখলাম। তাদের হয়ত আস্থা নাই যে পরবর্তীতে তাদের রচনাবলী আদৌ বেরোবে কি না! সেই জন্য আগেভাগেই বের করে রাখতেছে।
নির্মলেন্দু গুণ: হা হা হা। রচনাবলীতে জীবিত লেখকদের ছবি থাকা উচিত নয়। শামসুর রাহমান তার শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে ছবি দিয়েছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: ছবি তো ভালোই লাগে। থাক না! অসুবিধা কী! জীবিত লেখকদের বই যদি ছবিসহ বেরোয়, এটা খারাপ না। ফ্ল্যাপে যখন দিতে পারে, ব্যাককভারে যখন দিতে পারে…. যেমন বিষ্ণু দের নাভানা থেকে যখন শ্রেষ্ঠ কবিতা বেরুলো, তখন তো বিষ্ণু দের সুন্দর একটা ছবি ছিল। অনেকের তো কৌতূহল থাকে, পাঠকের কৌতূহল থাকে– আচ্ছা, এই কবি দেখতে কেমন! সে জন্য ছবি দেয়া আমার মনে হয় খারাপ না। প্রত্যেক রচনাবলীতে ভিন্ন ভিন্ন ছবি যেতে পারে। অসুবিধা কী! আপনি আপনার রচনাবলীতে দেন।
নির্মলেন্দু গুণ: বইয়ে ছবি যোগ করা এটা তো আমি চালু করছি।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, প্রেমাংশুর রক্ত চাই বইতে ছিল ছবি।
নির্মলেন্দু গুণ: কভারে ছবি দিয়ে বই বেরুলো। তার আগে তো কলকাতাতেও এমন বেরোয় নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, আমি দেখিনি অন্তত। তারপরে মান্নান ভাইয়ের করতলে মহাদেশ যখন বেরোল, মানে আপনাদের সমসাময়িক লেখকদের কথা বলতেছি আর কি, মান্নান ভাইয়ের করতলে মহাদেশ বইয়ে একটা ছবি বেরোল না? বুকে হাত দিয়ে…
নির্মলেন্দু গুণ: আমি শুরু করেছিলাম এটা। সেভেনটিতে ওটা প্রথম বেরোল আর কি।
রাজু আলাউদ্দিন: তবে মান্নান ভাইয়েরটা ছিল ভিতরে। আর আপনারটা ছিল প্রচ্ছদে। প্রচ্ছদে বোধহয় আপনিই শুরু করলেন প্রথম।
নির্মলেন্দু গুণ: ভিতরে না যাওয়ারই পক্ষপাতী আমি। আমার ছবিই তো সবচে বেশি প্রচারিত। বইয়ের মধ্যে ছবির ব্যবহার সবচে বেশি করছি আমি। ফ্ল্যাপে, ব্যাক কভারে, ফ্রন্ট কভারে।
রাজু আলাউদ্দিন: তারপরে টেক্সট বইয়ে আপনার ছবি দেখলাম। ‘মিয়া এখন…’ কী যেন লেখা ছিল।
নির্মলেন্দু গুণ: ‘মিয়াভাই ছবি আঁকে।’
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: আমি তো মহাখুশি। পরে ছেলেরা বড় হয়ে দেখবে যে এই মিয়াভাই তো কবিতাও লেখে। হা হা।
রাজু আলাউদ্দিন: ওখানে আপনাকে একটু ধর্মান্তরিতও করে নিছে, তাই না?
নির্মলেন্দু গুণ: তাতে অসুবিধা কী? তাতে কোনো অসুবিধা নাই। তাতে আমি আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হব। আমারে অনেকে বলছে যে আপনাকে মিয়াভাই বলছে। আমি বলি, মিয়াভাই তো বলেই। আমাদের দেশে মিয়াভাই, ভাইজান, ভাইসাব, দাদা, দাদু এসব তো বলেই।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে ভারতে আবার মিয়া বলতেই মুসলমান বোঝায়।
নির্মলেন্দু গুণ: মিয়াভাই মানে তো বড়ভাই। রেসপেক্ট্যাবল বড় ভাই।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, রেসপেক্টেড বড়ভাই। তা ঠিক। আমাদের এখানে এটা ধর্মান্তরণের অর্থ বহন করবে না। কিন্তু আবার ভারতে হলে এটা করবে। মানে পশ্চিমবঙ্গে হলে ধর্মান্তরণের অর্থটা দাঁড়াবে।
নির্মলেন্দু গুণ: মুসলিমদের সাথে যোগাযোগ কম তো, এই জন্য আর কি। তবে অনেক অমুসলিম আছে, আল্লাহ বলে। মানে বিসস্ময়কর শব্দ হিসেবে আল্লাহ শব্দটা তারা বলে। আল্লাহ!!
রাজু আলাউদ্দিন: এটা হলো আসলে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি।
নির্মলেন্দু গুণ: বেশি মানুষের ব্যবহৃত উক্তি বা শব্দগুলো সবাই ব্যবহার করে আর কি। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষার মুসলমানদের মধ্যে যারা আছেন, সাহিত্য চর্চা করেন, তারা এগুলো করেন। আমাদের পুরনো কবিরা যখন তারা কলকাতায় ছিল, তারা এটা করত। তারা জলকে জল বলত। তাদের লেখার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। মুসলমানরা তো নজরুলের ‘মহাশ্মশান’(শব্দটা) বাদ দিয়ে ‘গোরস্তান’ করল। কিন্তু কায়কোবাদের মহাকাব্যের নাম যে মহাশ্মশান এটাকে আর চেঞ্জ করতে পারে নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: তোরা ছোট মহাশ্মশান কাটছস, দ্যাখ, কতবড় মহাশ্মশান!
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: একটা কাজ করেন। কায়কোবাদের কবরস্তান কিন্তু আজিমপুরে। গেটে ঢুকতেই হাতের ডানদিকে। ওই দিকটায় নতুন মেয়র কিছু স্থাপনা তৈরি করছে। বিরাট মসজিদ করছে ওই এলাকায়। তাতে আমার ধারণা, বহু কবর ওইটার নিচে চাপা পড়ে যেতে পারে। মহাকবি কায়কোবাদের কবরও চাপা পড়ার সম্ভাবনা আছে। তো আপনাদের সাংবাদিককে দিয়া তদন্ত করে তার কবর কোনো স্ট্রাকচারের আড়ালে ঢাকা পড়ছে কি না এটা দেখা দরকার। আমি কবরটা দেখেছি। এবং আমি কায়কোবাদের গ্রামের বাড়িও গেছিলাম। আমি আর হুমায়ুন আজাদ, আমরা দুজন গেছিলাম। জায়গাটার নাম হচ্ছে আলগা। এটা বিক্রমপুরের একটা জায়গা। আগে যখন গেছিলাম, অনেক দূর ঘুরে যাইতে হতো। এখন তো অনেক ব্রিজ ট্রিজ হয়ে গেছে। ধলেশ্বরী ইত্যাদি ব্রিজ হয়ে গেছে। এখন খুব সহজেই যাওয়া যায়।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার সাথে তো হুমায়ুন আজাদের সাপে নেউলে সম্পর্ক। আপনারা দুজন একসাথে গেলেন কিভাবে!
নির্মলেন্দু গুণ: ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল। তুমি তুমির সম্পর্ক ছিল। আমি তাকে তুমি বলতাম। সে আমাকে তুমি বলত।
রাজু আলাউদ্দিন: উনার সাথে আপনার সম্পর্ক নষ্ট হলো কখন থেকে বা কী সূত্রে?
নির্মলেন্দু গুণ: খুব যে একটা নষ্ট হইছে তা তো বলা যায় না। হা হা হা।
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: সে আমাকে কবি বলে মানত না। তারপরেও তার সংকলনে আমার পাঁচটা কবিতা নিছে। সে যখন পাঠ্য বোর্ডে ছিল, সে আমার কবিতা পাঠ্য বইয়ে নিছে। আমার প্রথম কবিতা যখন পাঠ্য হলো স্কুলে, ‘মামা ও সূর্য’ নামে, এটা সেই-ই পাঠ্য করছিল। মুখে যতই ইয়ে করুক আমাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমাকে কবি বলে মানত। তার সংকলনের ভেতর আমার পাঁচটা কবিতা রাখছে, শুধু তাই না, সে আমার কবিতা পাঠ্যও করছে, সে যখন বোর্ডের দায়িত্বে ছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা আমি জানতাম না।
নির্মলেন্দু গুণ: তার সাথে যেটা নিয়ে আমার বিরোধ হয়েছিল, সেটা হলো নজরুলকে নিয়ে। নজরুলের বিরুদ্ধে সে যে মন্তব্য করেছিল, কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম যে, নজরুল যদি এই ধরনের সঙ্গীতগুলি না লিখত তাহলে মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক কবির জন্ম হইত না।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি বলছিলেন যে, নজরুলের যদি জন্ম না হইত তাহলে হামদ নাত তোমাদের লিখতে হইত। হা হা হা। আপনার মনে আছে এইটা?
নির্মলেন্দু গুণ: সেই জন্যই তো বলছি, শামসুর রাহমান আধুনিক কবি হইতে পারতেন না, তুমি তো আরো পরের কথা। তুমি যে আজকে তাকে অস্বীকার করছ, সে না হইলে তুমি হইতে পারতা না। মুসলমান সমাজের যে সাংস্কৃতিক চাহিদা, একালচারাইজেশন যেটা, হিন্দুদের সেই পর্বটা কিন্তু অনেক আগে সম্পন্ন হয়ে গেছে। ফলে হিন্দুদের মধ্যে মধুসূদনই বিদ্রোহ কইরা মেঘনাদবধ লিখে ফেলছে। ধর্মের বিরুদ্ধে ওরকম বিদ্রোহ বিরাট ব্যাপার। রামপ্রসাদ কালীসঙ্গীত প্রচুর লিখছে। হিন্দুর্মের উপর ভক্তিমূলক অনেক গান তার আছে। মঙ্গলকাব্যের যুগটাই তো বলা যায় ‘মঙ্গল কাব্য’। সাম্প্রতিকালে মুসলমানদের মধ্যে মঙ্গল লিখল জাকির তালুকদার। মুসলমানদের মধ্যে তো মঙ্গলকাব্য হয় নাই। এই যুগটা তো মুসলমানরা অতিক্রম করে নাই। মঙ্গলকাব্য রচনার যুগটা হিন্দুরা অতিক্রম করে আসছে। তারা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন লিখছে, পদাবলী কীর্তন লিখছে, এগুলো তো ধর্মেরই প্রকাশ। আরেকটা পয়েন্ট নিয়ে তার সাথে বিতর্ক হয়েছিল, সেটা হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়েছিল আর কি। এই কথাটা সে একটা আর্টিকেলে লিখছে। তো আমি বলেছিলাম যে, গণতন্ত্রের সুবাতাস আমাদের দেশে এত কম বয়ে গেছে যে, এটাকে শনাক্ত করা যখন সম্ভবই হইল হুমায়ুন আজাদের মতো তীক্ষ্ণ মানুষের পক্ষে; তিনি যখন এটাকে স্বীকার করলেন, তখন এই সময়টাকে শনাক্ত করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে কৃতিত্ব দেয়ার স্কোপ এখানে ছিল। তাতে মানুষ এই সময়টাকে আরো বেশি চিনতে পারত। সময়টা গণতান্ত্রিক কিন্তু শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক নয়– এই কথাটা হুমায়ুন আজাদ টেবিল টকে বলে মনে হয় শেখ মুজিবের প্রাপ্য মর্যাদা দানে বা ওই সময়ের নেতৃত্ব কার ছিল, এটাকে মনে হয় তিনি এড়িয়ে গেলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: পরে উনি কী বললেন?
নির্মলেন্দু গুণ: পরে উনি আবার মঞ্চে উঠতে চাইছিলেন। আমার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে চাইছিলেন। তখন ফয়েজ ভাই সভাপতিত্ব করছিলেন। আমি ফয়েজ ভাইরে বললাম, হুমায়ুন আজাদ যদি বক্তব্য দেন তাহলে আমাকেও পরে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। ফয়েজ ভাই বলল, না না, আর কোনো বক্তব্য হবে না। হুমায়ুন আজাদ অনেক চেষ্টা করেও মঞ্চে উঠতে পারল না। এটা নিয়ে তার সাথে প্রকাশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েছিল আর কি। পরে সে গালাগাল করছিল বলে কবিতা পরিষদ থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। এইটার পর থেকে তার সাথে সম্পর্কটা…
রাজু আলাউদ্দিন: নজরুল সম্পর্কে তো উনি কবিতাও লিখছেন দেখলাম। নজরুলের একটা ছবি দেখে সেই ছবির প্রতিক্রিয়াতে উনি কবিতা লিখলেন। আবার নজরুলকে বড় কবি হিসাবে উনি মাপেনও না।
নির্মলেন্দু গুণ: নজরুল দ্বারা প্রভাবিত হয় নাই এরকম বাংলা কবি নজরুল পরবর্তীকালে কেউ কি আছে!
রাজু আলাউদ্দিন: আরেকটা জিনিস দেখা যায়, নজরুলকে অগ্রাহ্য করার একটা প্রবণতা আছে। এটা এখানে যেমন আছে, আবার ওপারেও আছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তো নজরুলবিরোধীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, অসির ঝনঝনানি থাকলে তা যে কবিতা হবে না সেটা কিন্তু ঠিক না। এই ঝনঝনানিসহও কবিতা হতে পারে। কিন্তু দেখা গেল অনেকেই সেটা আবার মানতে চাইলেন না।
নির্মলেন্দু গুণ: রবীন্দ্রনাথ যখন নজরুলকে উদ্দেশ্য করে বসন্ত নাটকটা তাকে উৎসর্গ করছিলেন, তখন তো অনেকেই রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করছে। রবীন্দ্রনাথ কেন তাকে বসন্ত উৎসর্গ করলেন! কারণ তিনিই ভারতে বসন্ত এনেছেন। ভারতে তিনি বসন্ত এনেছেন তার জন্য তাকে উৎসর্গ করেছেন। বসন্ত শুধু নাটকের নাম না, এর দ্বারা তিনি নজরুলকে মিন করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে একটা সংখ্যা বের হয়েছিল, কে যেন লিখছিল রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে। সেখানে এই তথ্যটা পাওয়া যাবে। শহীদুল্লাহ সাহেব তারে নিয়ে গিয়েছিল, এটা আমাদের সেদিনের আলোচনার মধ্যে আসছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: “নজরুলকে আমি বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে কবি বলে অভিহিত করেছি, জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ আর পড়ে থাকলেও রূপ ও রসের সন্ধান করোনি। অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।” এই কথা বলেছেন। জাতির জীবনে যিনি বসন্ত এনেছেন তাকে বসন্ত নাটক উৎসর্গ করলেন উনি। এটা খুবই অর্থপূর্ণ ছিল। মানে রবীন্দ্রনাথের উদারতার জায়গাগুলোও কিন্তু সাংঘাতিক। একই সাথে উদারতা এবং যথাযথ মর্যাদা দেয়া, প্রাপ্য মর্যাদা দেয়া; এই বিষয়ে তার সততা এবং অনড় অবস্থান–এটা সাংঘাতিক।
নির্মলেন্দু গুণ: তার জন্য মাইকেল বিষয়ে তার বিবেচনা পঁচাত্তর বছর বয়সে সেটা পরিবর্তন করলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ হ্যাঁ। এইটা হলো বড় কবির লক্ষণ।
নির্মলেন্দু গুণ: আমি পরে লেখলাম যে পঁচাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত আপনে যে অপেক্ষা করলেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য; আপনার পাঠকরা তো জেনে গেছে আপনার বিবেচনা। পঁচাত্তর বছর বয়সে এটা উন্মোচন করলে গবেষকদের কাজে লাগবে কিন্তু পাঠকদের কাজে লাগে না। তিনি মাইকেল সম্পর্কে বিরূপ ছিলেন, এটার কারণ আমি ব্যাখ্যা করছি আমার বইতে। সেখানে বলছি যে, মাইকেল যখন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করলেন, তখন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে মাইকেলের সঙ্গে দেখা করলেন। তাকে কিছু ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করার জন্য অনুরোধ করলেন। তখন তিনি বলছেন, আমি ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করার জন্য খৃস্টধর্ম গ্রহণ করিনি। (রাজু আলাউদ্দিনের অট্টহাসি) দেবেন্দ্রনাথ মনে করছিলেন এই সময় মাইকেলকে দিয়ে ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করাই। তিনি ব্রাহ্ম সঙ্গীত লিখতে রাজি হলেন না। বরং বিরূপ মন্তব্য করলেন “আমি ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করার জন্য হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করি নাই।” তার তো উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন, খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করার। তিনি ইংল্যান্ডে যাবেন। ইংল্যান্ডের রমনী বিবাহ করলেন। বাংলাভাষার কবি বলে নিজেকে মনেই করলেন না। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পোয়েট… রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সময় নোবেল কমিটি কিন্তু তাকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পোয়েট বলছেন। বাঙালি কথাটা কিন্তু নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: তখন তো বাঙালি জাতিসত্তার স্বতন্ত্র কোনো ভিত দাঁড়ায় নাই, সেজন্য বলে নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: আমরা যে বলি বাঙালি জাতির প্রথম নোবেলজয়ী কবি। কিন্তু খাতাকলমে বাংলার লেশ মাত্র নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: তখন তো আমরাও ভারতীয়।
নির্মলেন্দু গুণ: কিন্তু পরে আমি একটা ইয়েতে পাইছি, তিনি কর্নেল ইউনিভার্সিটি ভিজিট করতে গেছিলেন নিউইয়র্কে। সেইখানে যে ভিজিটার্স বুক আছে, ওইখানে তিনি ন্যাশনালিটির জাগায় বেঙ্গলি লিখছিলেন। এটা খুব বিস্ময়কর। রবীন্দ্রনাথ আসলে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে তার যে বাঙালি পরিচয়টা ঢাকা পড়ে গেল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পরিচয়ের আড়ালে..
রাজু আলাউদ্দিন: সেইটাকে উনি আবার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেন।
নির্মলেন্দু গুণ: পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেন একটা জায়গায়। সেটা হলো কর্নেল ইউনিভার্সিটির ভিজিটার্স বুকের মধ্যে তিনি লিখছেন, সেখানে একটা কলাম আছে ন্যাশনালিটি। সেই ন্যাশনালিটির জায়গায় তিনি ইন্ডিয়ান লেখেননি। তিনি বেঙ্গলি লিখছেন।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা খুব সচেতনভাবে করছেন বোঝাই যায়।
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ বোঝাই যায়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে এটা করছিলেন। সম্ভবত সতের আঠারো সালে। জাপান থেকে তিনি গেছিলেন আমেরিকায়, ওই সময়ে।
রাজু আলাউদ্দিন: আরেকটা জিনিস দেখেন, ওই সময় তো নজরুল রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথ তো আসলে জনপ্রিয় ছিলেন না। জনপ্রিয় ছিলেন নজরুল ইসলাম।
নির্মলেন্দু গুণ: রবীন্দ্রনাথ জনপ্রিয় হয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে। তার আগে এত ইয়ে ছিল না। এখন আমরা যেমন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ইত্যাদিতে যেরূপে দেখছি, আগে তো ওইরকম ছিল না।
রাজু আলাউদ্দিন: আগে ওইরকম ছিল না। নজরুল যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে গেছেন একেবারে সাধারণ মানুষের ভেতর, ওইটা কিন্তু রবীন্দনাথ ঠাকুরের ছিলেন না।
নির্মলেন্দু গুণ: মানুষ জেলে গেলেই তো জনপ্রিয় হয়। পুলিশ যখন কাউকে এরেস্ট করে তখন সে জনপ্রিয় হয়। নজরুল একাধিকবার জেলে গেছে। এবং তার কবিতার জন্য জেলে গেছেন। তিনি তো জনপ্রিয় হবেনই।
রাজু আলাউদ্দিন: তবে শুধু কি জেলে যাওয়াটাই জনপ্রিয় হওয়ার কারণ? সে তো আসলে ওই গণমুখী কবিতাও লিখছে, তাই না? রাজনৈতিক কবিতা লিখছে, গণমুখী কবিতা লিখছে। সেগুলো তাকে জনপ্রিয় করছে, তাই না? তারপরে তার গান ছিল। এইগুলো নিয়ে আমার মনে হয়…
নির্মলেন্দু গুণ: ব্রিটিশের গোলামি ছিন্ন করার জন্য তার কারার এই লৌহ কপাট ইত্যাদি কবিতা, সাম্যবাদী কবিতা সমাজের সাধারণ মানুষের চিন্তাকে, আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করেছে। সুভাষ বসু, তিনি যখন ভারতের মুক্তি আন্দোলন করছেন, তখন নজরুলকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হইছে, সেইটার মধ্যে তিনি বক্তৃতা রাখছেন। নজরুলের এত অল্প বয়স, সেখানে তিনি বলছেন, নজরুল আমাদের সেই কবি যার কবিতা পড়ে আমরা কারাগারে যাব এবং কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে আমরা বেরিয়ে আসব।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি সেদিন বললেন যে একজন কবি হয়ে উঠতে পারে একটি জাতির ইতিহাস, নজরুল ছিলেন ওই ধরনের কবি। যিনি একটি জাতির ইতিহাস হয়ে উঠছিলেন। সেকারণে সুভাষ বসুরা বুঝতে পারছিলেন।
নির্মলেন্দু গুণ: এত অল্প বয়সে তারা নজরুলকে নাগরিক সংবর্ধনা দিছেন..
রাজু আলাউদ্দিন: নাগরিক সংর্বধনা নাকি জনসংবর্ধনা?
নির্মলেন্দু গুণ: নাগরিক সংবর্ধনা বোধধহয়। এটা উদ্বোধন করছিল রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সংবর্ধনা পাইছেন নজরুল।
রাজু আলাউদ্দিন: রবীন্দ্রনাথের আরেকটা উক্তি আমার অসম্ভব রকমের ভালো লাগে। তিনি ওই অর্থে অত জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু নজরুল যে জনপ্রিয় হয়ে গেছেন এবং সেই সূত্রে উনি বলছেন যে, “জনপ্রিয়তা কাব্যবিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়। কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।”
নির্মলেন্দু গুণ: নজরুলভাষ্যে পাওয়া যায়, রবীন্দ্রভাষ্যে পাওয়া যায় না, রবীন্দ্রনাথ তাকে বললেন, হে উন্মাদ আমি তোর মধ্যে শেলি ও বাইরনের মতো ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি। তার জীবন নিয়ে তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করলেন। নজরুলের জীবনের উন্মাদনা দেখে।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, এটা আমার মনে আছে। মানে উন্মাদ হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল।
নির্মলেন্দু গুণ: ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, খোদার আসন আরশ ছেদিয়া.. তিনি যেমনভাবে স্রষ্টাকে প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন, এটা রবীন্দ্রনাথের দেখে মনে হইছে যে এ তো উন্মাদ।
রাজু আলাউদ্দিন: রবীন্দ্রনাথে সেই আশঙ্কাই পরে সত্য হলো আর কি।
নির্মলেন্দু গুণ: অনেকে বলবে, রবীন্দ্রনাথ তো জানেই তারে ওষুধ খাওয়ায়ে পাগল বানাবে, তাই আগেই এটা বলছে।

রাজু আলাউদ্দিন: আপনাকে একবার বলছিলাম না! সাধারণ মানুষের ভেতরে কত রকমের অদ্ভুত ধারণা এবং তাদের ফ্যান্টাসি করার যে শক্তি… আমিই তো ছোটবেলায় শুনছি যে, দ্যাখ, নজরুল এতবড় কবি হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথ এটা সহ্য করতে পারে নাই। তো এখন কী করবে? এই প্রতিদ্বন্দ্বী তো রাখা যায় না। পরে রবীন্দ্রনাথ তার এক আত্মীয়কে নজরুলের সঙ্গে বিয়ে করাইলেন। প্রমিলা দেবী। প্রমিলা দেবী নাকি রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়, হা হা হা। এবং সেই মহিলাকে দিয়ে নাকি নজরুলের মাথা নষ্টা করে দিছেন। এইসব মূর্খরা যদি জানত….
নির্মলেন্দু গুণ: তিনি ঘরে যে কালীর সাধনা করতেন, তার শ্বাশুড়ির পরামর্শে তিনি এই কালীসঙ্গীতগুলো রচনা করছেন। এরকম শোনা যায়। এটা হইতেও পারে। কারণ তিনি প্রমিলাকে ভালোবাসতেন। স্ত্রীর সাথে শ্বাশুড়িকেও যদি সন্তুষ্ট করা যায় মন্দ কী!
রাজু আলাউদ্দিন: আমার মনে হয়, শ্বাশুড়িকে উনি মায়ের মতো ভালোবাসতেন। কারণ, মায়ের প্রতি কিন্তু নজরুলের, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, মাকে নিয়ে তার কোনো আবেগ নাই। কবিতা নাই, কিচ্ছু নাই। এবং তার মা মারা গেছে, সে তো দেখতেও যায় নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: তার সাহিত্যে তো মা বাবার উল্লেখ নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা একটা অজানা কারণ। আমি এখনো জানি না। তার মায়ের প্রতি বিন্দুমাত্র টান ছিল না। আমার মনে হয়, ওই অভাবটা তার শ্বাশুড়ির মাধ্যমে পূরণ করছে। এটা একটা কারণ হতে পারে আর কি।
নির্মলেন্দু গুণ: তার শ্বাশুড়িও তো সুন্দরী ছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: সুন্দরী ছিলেন তার শ্বাশুড়ি?
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ সুন্দরী ছিল। তিনি নারী তো। আর সে তো কবি। তার কল্পনা তো বসে থাকে না। শ্বাশুড়ির সাথে তার যে সম্পর্কটা ছিল এটা আমার কাছে মনে হইছে রবীন্দ্রনাথে সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর যে সম্পর্ক ছিল, ওই রকম ছিল। তিনি তার কবিতাগুলো শুনাইতেন, কাদম্বরী দেবী খুশি হতেন। নজরুল গান লিখতেন। শ্বাশুড়িকে খুশি করার জন্য হয়ত লিখতেন। গান তো আর বানায়ে লেখা যায় না, ভেতর থেকে না আসলে। আর গানগুলোও তো উচ্চমানের।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, এটা হতে পারে। আপনি যে মিলটার কথা বললেন, কাদম্বরী রবীন্দ্রনাথের এবং নজরুলের সঙ্গে তার শ্বাশুড়ির।
নির্মলেন্দু গুণ: প্ররোচিত করা, উজ্জীবিত করা আর কি।
রাজু আলাউদ্দিন: অদ্ভুত ব্যাপার, যে মুসলমানরা এই মিথ বানাইছে, তারা যদি সত্যি সত্যি জানত যে নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের কী পরিমাণ ভালোবাসা ছিল.…
নির্মলেন্দু গুণ: এটার জন্য ওই বইটা ছাপার দরকার। এতে নজরুল রবীন্দ্রনাথের বিতর্কের অবসান হবে। রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে বাংলা একাডেমি থেকে একটা বিশেষ সংখ্যা বের হয়েছিল। কে লিখেছিল নামটা আমি ভুলে গেছি। সেখানে একটা তথ্য পাইছিলাম যে, শহীদুল্লাহ সাহেব নজরুলকে নিয়ে গেছিলেন। ট্রেনে তিনি গীতাঞ্জলির সমস্ত গানগুলি তিনি শহীদুল্লাহ সাহেবকে শোনাইছেন। এরপর তারা যখন রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলেন, তিনি বললেন যে, এই যে আপনার নজরুল। সে তো আসার সময় আপনার পুরো গীতাঞ্জলি শোনাল আমাকে। তখন রবীন্দ্রনাথ তাকে বুকে জড়ায়ে ধরে বললেন, এ তো পাগল! আমার লেখা আমারই তো মনে থাকে না। এটার একটা সুন্দর বর্ণনা আছে। এটা পড়লে লোকে বুঝতে পারবে যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্কের সূত্রটা কিভাবে তৈরি হয়েছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি একটা জিনিস নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, অদ্ভুত ব্যাপার, তখন অনেক বামপন্থী কবি ছিলেন, বামপন্থী লেখক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছেন– গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস ইউ। তারপরে চিঠি লিখতেছেন। নজরুলের পক্ষে ওকালতি করতেছেন মানে নজরুল যে কবি, নজরুলকে তোমরা মনোযোগ দিয়ে পড়ছ না, এইসব ওকালতি করতেছেন। কিন্তু বামপন্থী কবিরা দেখেন, তাদের কিন্তু লেখা টেখা নাই নজরুল সম্পর্কে। বিষ্ণু দের কোনো মন্তব্য নাই নজরুল ইসলাম সম্পর্কে। সুধীন দত্ত বামপন্থী ছিলেন না, কিন্তু তার কোনো মন্তব্য নাই। অমিয় চক্রবর্তীর কি আছে? আমার মনে হয়, নাই। অমিয় চক্রবর্তীর নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: এই যে আমি একটা জিনিস খুঁজে বের করলাম। নজরুলের বিবেচনা বোধহয় এরকম ছিল। আমি আমার বিবেচনা থেকে বলছি। আমি যখন ঢাকায় চলে আসলাম, আমার বাবা আমাকে টাকা দিলেন ইন্ডিয়াতে চলে যাওয়ার জন্য। আমার মনে হলো একটা পারিবারিক শোককে কেন্দ্র করে আমার মধ্যে জীবন নামক যে শিল্পবস্তুটির বিকাশ ঘটেছে তার সত্তার উপর আমারই একচ্ছত্র অধিকার। অন্যদের যাদের জীবনের সঙ্গে জন্মসূত্রে সংশ্লিষ্ট, তাদের প্রতি সময় পেলে সম্ভব হলে আমি আমার বিবেচনা মতো কর্তব্য পালন করব। কিন্তু তা আমার জন্য বাধ্যতামূলক হতে পারে না। নশ্বর জীবনের গায়ে কিছুটা হলেও অনশ্বরতার ছোঁয়া লাগানোর সাধনাই হবে আমার সাধনা। আমার পরিবার যদি সে পথের অন্তরায় হয়, আমি পরিবারকে ত্যাগও করতে পারি। সেই অধিকার আমার আছে। আমার মনে হলো পরিবার একটা ছোট জিনিস। ডিমের খোসা থেকে বেরিয়ে আসা পক্ষী শাবকের মতো মানুষকেও এক পর্যায়ে পরিবারের খোলস থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়। পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার ধারণাটি খুবই আপেক্ষিক এবং শর্তসাপেক্ষ বলেই আমার মনে হয়। ভালোবাসা, স্নেহ, মায়ামমতার ছদ্মবেশে এটি তৃতীয় বিশ্বের মানুষের মধ্যে চালু একটি অতিশয় দরিদ্র ধারণা। এই ধারণা পাল্টাতে হবে। এইসব দীন ধারণার হাত থেকে প্রাচ্যের মানুষের মনকে মুক্ত করতে হবে। পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে এই ধারণার অবসান ঘটেছে বলে তারা বড় কিছু করতে পারছে। আমারও তেমনটি করার চেষ্টা করা উচিত। এইভাবে নিজেকে বুঝিয়ে পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘনের পক্ষে নিজের মনে আরো যুক্তি সংগ্রহ করে আমি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। পিতৃআজ্ঞা পালনের জন্য রাম বনে গিয়েছিলেন। আর আমি পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘন করে চললাম ঢাকার পথে। এখানেই বাল্মিকীর রামের সাথে আমার রামের পার্থক্য।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা কার কথা?
নির্মলেন্দু গুণ: এটা আমার কথা।
রাজু আলাউদ্দিন: ও, আপনার কথা! আচ্ছা আচ্ছা। বাহ! সুন্দর।
নির্মলেন্দু গুণ: নজরুল বোধহয় এরকম ভেবেছিলেন। পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখাটা হয়ে ওঠেনি তার। এ জন্য তিনি ময়মনসিং চলে আসলেন। আমার বাবা যেমন আমার সন্ধান না পাইয়া বিভিন্ন পত্রিকায় চিঠি লিখত, নজরুলের বাপ ছেলের জন্য চিঠি লিখবে সেরকম সুযোগ তো ছিল না। তিনি আসানসোলের দোকান থেকে চলে আসলেন ময়মনসিং-এ। পরিবারের সাথে তার কোনো যোগই নাই। তিনি তার পরিবারের কাছে, চুরুলিয়ায় ফিরে গেছেন এরকম তথ্যও পাওয়া যায় না। তার মানে তিনি তার পরিবারের সাথে সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভূর মতো আচরণ করেছেন। অচ্ছা এরপরে আরো একটু লেখা আছে: “ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। ঢাকা ক্রমশই বড় হচ্ছে। এখন ঢাকাকে কেন্দ্র করে কলকাতার বিকল্প একটা নতুন সাহিত্য পরিমণ্ডল গড়ে উঠতে শুরু করেছে। পাকিস্তানবাদী সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের ধারাটি এখন আর ঢাকাকেন্দ্রীক সাহিত্য আন্দোলনের মূল ধারা নয়। ওই ধারাটি এখন গৌণ ধারায় পরিণত হয়েছে। ক্রমে সেক্যুলার সাহিত্যের ধারাটি এখানে প্রবল হয়ে উঠবে তার লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। সুতরাং কলকাতা নয়, ঢাকাই হোক আমার কর্মক্ষেত্র।” আমি এইভাবে লিখছি আমার পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতি, ঢাকায় আসার আগে আমার ছোট চিন্তায়।
রাজু আলাউদ্দিন: বাহ! ভালো তো। এত বছর আগেই আপনি এই জিনিসগুলি সঠিকভাবে দেখতে পারছেন। এটা ফ্যান্টাসটিক। খুব ভাল্লাগল।

নির্মলেন্দু গুণ: তখন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ কণ্ঠস্বরের মতো কাগজ বের করছে। সেখানে তরুণদের বিদ্রোহ, হাঙরি জেনারেশন– পাকিস্তানবাদিতা মানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আধুনিকমনষ্ক কবি সাহিত্যিকদের জন্ম হচ্ছে এখানে। তাই আমার মনে হয়েছিল, এখানে আমার আত্মপ্রকাশের পথে কোনো বাধা থাকবে না। যদিও আমার শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি বাধাগ্রস্ত হইছি, কিন্তু এর বিপরীতে আমার সাহিত্যের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে না এটা বুঝেছিলাম।
রাজু আলাউদ্দিন: তো এখন কি মনে হচ্ছে না যে একটা ভবিষ্যদ্বাণী তার সাফল্য হারাচ্ছে? মানে আপনি যে বলছিলেন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে উঠবে, সেটা গড়ে উঠছিল…
নির্মলেন্দু গুণ: গড়ে ওঠার পরে এটা যে আক্রমণের মুখে পড়েছে, তারপরেও কিন্তু এইটেই সাহিত্যের মূলধারা।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা সাহিত্যের মূলধারা– এ নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু জনগণমন জগতে সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা কি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে না?
নির্মলেন্দু গুণ: ক্ষয় হচ্ছে। সেটা আমি বলছি। যেমন আল মাহমুদের ক্ষেত্রে যেটা ঘটল, গত আলোচনায় আমরা এটা বলছিলাম যেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে গেল, তখন কারো কাছে মনে হলো একটা দুর্বল মুসলিম রাষ্ট্র তৈরি হলো। একটা দুর্বল মুসলমান রাষ্ট্র, তার চারদিকে.. এই যেমন মায়ানমার। সো হোস্টাইল মায়ানমার। আমাদের ভাবনায় তো ছিল মায়ানমার এত হোস্টাইল হতে পারে না। সেদিন টেলিভিশনে এক আলোচনায় দেখলাম আসামে অনেক বাংলাদেশি মুসলমান বাস করে। আসামের মধ্যে যারা নন আসামি বাঙালি, আসামে কিন্তু বাঙালি খেদাও আন্দোলনের একটা ধারাবাহিকতা কিন্তু আছে। সেই ধারাবাহিকতায় আসাম থেকে বাঙালি মুসলমানরা কিন্তু আগেও বিতাড়িত হইছে। রোহিঙ্গাদের মতো। এতটা অত্যাচারিত হয় নাই। বা হইছিল কিন্তু এখন আমরা তথ্যপ্রযুক্তির কারণে যতটা জানতে পারি, তখন হয়ত জানতে পারি নাই। আসাম থেকে বিতাড়িত মুসলমানরা আমাদের গ্রামে আসছে। আমার ছেলেবেলা বইতে আছে, তাদের সাথে আমার কথা হইছে। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নতুন সম্পর্ক। নতুন মসজিদ তৈরি হইল। নতুন করে আমাদের গ্রামে আজান হইল। মুরগির ডাক শোনা গেল। সেই সময় আমাদের বাড়িতে মহিলারা পানি নিতে আসছে। তারা সুন্দরী ছিল। আমি পানি ভরে দিতাম। তাদের সৌন্দর্য দেখার জন্য আমি পানি ভরে দিতাম। মা আমাকে বলত, তুই পানি ভরে দিস কেন! ওরা ভরতে পারে না! কিন্তু আমি মনে মনে ভাবতাম যে, মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুদের চেয়ে ভিন্ন সৌন্দর্য আছে। তারা নাকে নথ পরে। আমার আলাদা রকম একটা ভালোলাগা আছে। এসব তো আর মাকে বলতে পারি না। তো আমাদের গ্রামে নতুন মুসলমান যারা আসছিল, তারা সবাই আসছিল আসাম থেকে। এখন আমরা যে স্কুল করছি সেই স্কুলের যিনি হেডমাস্টার তিনি হচ্ছেন আসাম থেকে আসা রুস্তম মাস্টার, যার কাছে তখন ইংরেজি শিখেছিলাম, তার ছেলে। আমার ছেলেবেলা বইতে আছে। আসাম থেকে তারা বিতাড়িত হয়ে আসছে, এটা রোহিঙ্গাদের মতোই কিন্তু। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, আসামের মুসলমানদের সঙ্গেও কিন্তু বাংলাদেশের সম্পর্কটা একই রকম। রোহিঙ্গাদের আরাকানে যেমন একসময় রাজসভা ছিল, আসামে ওরকম কোনো রাজসভা ছিল না। আসামের দৌলত কাজী, আলাওলের সন্ধানও আমরা পাই না। কিন্তু আসাম যেহেতু বর্ডারিং, আসামে প্রচুর বাংলাভাষাভাষি মানুষ বাস করে। আসামের শিলচরে তো একটা ভাষা আন্দোলনই হইল। সেখানে বারোজন মারাও গেল। এরা সবাই কিন্তু হিন্দু। সিলেটি হিন্দু। তারা সিলেটের ভাষায় কথা বলে। সিলেটিরা শিলচর, আগরতলা, ত্রিপুরা এগুলো দখল করছে আর কি। তাদের বিতাড়িত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু আসামি মুসলমানদের বিরুদ্ধে, তাদের উপর আসামিদের একটা ক্ষোভ আছে– বাঙ্গালি খেদাও। তারা মুসলমান খেদাও বলে না। তারা বলে বাঙ্গালি খেদাও। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও মুসলমান খেদাও এটা কিন্তু বলে না। রোহিঙ্গা খেদাও। তারা বলে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক। তো এই সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় নাই যে আসাম থেকে এক ধরনের আন্দোলন হইতে পারে। বা মায়ানমারকে যদি শাস্তি দেয়া না যায় তাহলে আসামিরা উৎসাহিত হবে, মায়ানমার যখন রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলমান উৎখাতে সাকসেস হলো, তাহলে আমরা কেন মুসলমানমুক্ত আসাম গড়ে তুলি না!
রাজু আলাউদ্দিন: তবে আসামের বাঙালি খেদাও-এর সাথে রোহিঙ্গাদের ছোট্ট একটা পার্থক্য আছে। সেট হলো, ওরা কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনি বা মিয়ানমারের লোকদের মতো এত নিষ্ঠুর আচরণ করেনি। নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ এগুলো করেনি। সেই কারণে আমরা বোধহয় এটা জানি কম।
নির্মলেন্দু গুণ: রাখাইনের ব্যাপারও কিন্তু আমরা আগে এতটা জানতাম না। আগে যে ঘটনাগুলো ঘটছে এগুলো আমাদের সকলের জানাও নাই। সেভেনটি এইটে যে আসছিল তারা, হাসিনা যে টিভিতে বলল যে, এই রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করেছে জিয়াউর রহমান। এই সমস্যা কখন তৈরি হয়েছিল এটা সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নাই। কারণ, তারা আগে কখন আসছিল এটা আমাদের মধ্যে বড় নিউজ আকারে আসে নাই। উদ্বেগ আকারে আসে নাই। সামান্য সংখ্যায় আসছিল আর কি। ইন্টারেস্টিং হইল, ছফা ভাই কিন্তু হুদা ভাইকে রোহিঙ্গা বলত। কবি নূরুল হুদা।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ হ্যাঁ। এইটা আমার মনে আছে।
নির্মলেন্দু গুণ: আর মহিউদ্দীন সাহেব আমাকে বলছিল, কী এমন চিটাগাং আসলেন যে বার্মায় যাবেন না! এটা একটা কথা হইল! চলেন বার্মা থেকে ঘুরে আসি। আমাদের সবারই তো ওখানে বউ আছে। রোহিঙ্গা যায় সাম্পানের মধ্যে, ভাত রান্না হয়, আরাকানে যাইতে চারপাঁচ দিন লাগে। সাম্পান নিয়ে একটা গান আছে। চিটাগাঙের বউ গান গাইতেছে স্বামীর উদ্দেশে। চিটাগাঙের অধিকাংশের দুইটা সংসার আছে। একটা হইল আরাকানে। আরেকটা হইল চিটাগাঙে। একজনের সংসার সম্পর্কে আরেকজনের কোনো ধারণা নাই। এখন যারা আসছে, অনেকেরই আত্মীয় আছে বাংলাদেশে। অনেকে বলতেছে তো, আমরা খবর দিছি যে তোমরা আইসা পড়।
……………………………
নির্মলেন্দু গুণ: কাফকার উপর সেদিন জাহিদুল হক খুব জোর দিল টেলিভিশনে শিল্পবাড়ি একটা প্রোগ্রামে। কাফকা ফুটবল প্লেয়ার ছিল না?
রাজু আলাউদ্দিন: না মনে হয়। আমি তো এমন কিছু পাইনি। আপনি বোধহয় আলবেয়ার কামুর কথা বলতেছেন।
নির্মলেন্দু গুণ: ও আলবেয়ার কামু। কাফকা তো জার্মান, না?
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ জার্মান।
নির্মলেন্দু গুণ: আর আলবেয়ার হলো আলজেরিয়ান।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, আলজেরিয়ান। যদিও পরে ফ্রান্সে .
নির্মলেন্দু গুণ: হি ওয়াজ এ ফুটবলার।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, হি ওয়াজ এ ফুটবলার। ঠিকই আছে এটা।
নির্মলেন্দু গুণ: কাফকার তো ম্যাটামরফসিস।
রাজু আলাউদ্দিন: ম্যাটামরফসিস, দ্য ক্যাসেল, দ্য আমেরিকা, ট্রায়াল..।
নির্মলেন্দু গুণ: কাফকার ডায়রি পড়ছি। তার একটা ডায়রি বের হইছিল মৃত্যুর পরে। তবে আমার পড়া মানে চোখ বুলানো।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার চোখ বুলানো তো পড়ার অধিক। হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: চোখ বুলায়ে যদি কাজ না হয় তাহলে পড়েও কাজ হয় না। হা হা হা।
রাজু আলাউদ্দিন: খুবই সত্যি। আপনার কি মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে এতগুলো বই, ধরা যাক আনা কারেনিনাবা ওয়ার এন্ড পিস-এর মতো বই পুরাটা পড়ছে? পড়ে নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: রবীন্দ্রনাথ যা পড়াশোনা করছেন, তার শৈশবকালে।
রাজু আলাউদ্দিন: না, আমি বৃদ্ধ বয়সের কথা বলছি। বৃদ্ধ বয়সে মোটা মোটা বই, আমার মনে হয় না উনি সবটুকু পড়তেন। আমার মনে হয় ওই রকম বড় লেখক, তাদের পুরাটা পড়ার দরকার হয় না।
নির্মলেন্দু গুণ: যারা বেশি পড়ে, তারা তো শেষে অধ্যাপক অথবা সমালোচক হয়ে যায়। তাদের পক্ষে আর ক্রিয়েটিভ থাকা সম্ভব হয় না। তারা গ্রামের ডাক্তার, যারা মেডিকেল সম্পর্কে জানার পরেও অপারেশন করতে পারে না, তারা ওই রকম হয়ে যায়।
রাজু আলাউদ্দিন: ব্যতিক্রমও কিন্তু আছে গুণদা। যেমন ধরেন, বোর্হেসের মতো লেখক অসম্ভব পড়ুয়া ছিলেন। সে তো সাংঘাতিক ক্রিয়েটিভ।
নির্মলেন্দু গুণ: আচ্ছা, আপনার তো ম্যাক্সিকান পোয়েট্রি, কিছু কবিতা দেয়ার কথা ছিল। আমি তো ইটালি থেকে একটা ছেলের মাধ্যমে অরিজিনাল ইটালিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ, তারপরে ট্রান্সট্রোমারের কবিতা ইন অরিজিনাল সুইডিশ এগুলো কালেক্ট করতেছি। অরিজিনাল ভাষার বই থাকা উচিত। জাপান থেকে একজন আসতেছে, জাপানি ভাষার বই নিয়ে আসতেছে। বিদেশ থেকে কেউ ফোন করলেই আমি তাকে প্রথম দায়িত্ব দিই, তোমার টাকা পয়সা দিতে হবে না, তুমি আমারে বই দাও। কারণ, আমার টাকা আছে কিন্তু বই নাই। গিভ মি সাম মেক্সিকান পোয়েট্রি।

রাজু আলাউদ্দিন: আমি দেব। দেব। মেক্সিকান পোয়েট্রি না হইলেও আমি আপনাকে স্প্যানিশ বই দেব।
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, ইসলামি বই দিলেও হবে। ইসলামি বই বলতে পারস্য, ইসলামের গৌরবের জায়গা তো পারস্যেই।
রাজু আলাউদ্দিন: না না। আমি বলছি ‘স্প্যানিশ’। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা বই দেব।
নির্মলেন্দদু গুণ: ও স্প্যানিশ! আমি বলছি, আরবি ভাষা নয় কিন্তু ইসলামের গৌরব মূল্যায়নে সাহিত্য-শিল্প বিচারে সেখানে বিশ্বমানের যে কয়জান লেখক আছে সবই তো ফার্সি।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, সবই ফার্সি।
নির্মলেন্দু গুণ: খলিল জিবরান বোধহয় একমাত্র ভালো লেখক, আরবি ভাষায় লিখছে।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ লেবাননের। লেবানিজ।
নির্মলেন্দু গুণ: আরবরা তো কেউ..
রাজু আলাউদ্দিন: না। সৌদি আরবের কোনো বড় লেখক নাই। একমাত্র ইমরুল কায়েস আর প্রাচীন যুগের কয়েকজন কবি আছে। ইমরুল কায়েসের কবিতা তো মনে হয় আপনি পড়ছেন, তাই না?
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ হ্যাঁ।
রাজু আলাউদ্দিন: ওই কবিতা পড়লে মনে হয় আপনি যেন তারই পুনর্জন্ম… এমন কবিতা আছে তার। “অনেক রমনী আছে মুরগির ডিমের মতোন দেহের সৌষ্ঠব”, বুঝছেন! আরো বলতেছেন, এমনকি শত্রুর ভয় উপেক্ষা করে আমি মিলিত হয়েছি তাবুতে, শত্রুর তাবুতে গিয়ে রমনীর সাথে। এই রকম অদ্ভুত সব কবিতা।
নির্মলেন্দু গুণ: যেমন কৃষাণ বধুর সঙ্গে নেরুদা মিলিত হইছিল, তাই না?
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ হ্যাঁ। গমক্ষেতে প্রেম। আপনার মনে আছে দেখছি।
নির্মলেন্দু গুণ: আমার নিজেরই তো এই অভিজ্ঞতা আছে। আমরা গ্রামের মানুষ তো। গমক্ষেত বা যে কোনো আড়াল দরকার হতো। যা বিশ্বস্ত আড়াল তৈরি করে। এবং পাটক্ষেত। পাটক্ষেত অনেক উঁচু হয় ডিপেন্ডলি ইউজড বেড, ইন্টেলিজেন্ট পিপল অব দ্য ভিলেজ অব দ্য ফারমার ফোকস। তারা এইগুলি করে আর কি।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ হ্যাঁ।



Source: https://arts.bdnews24.com/?p=15833

24


বহুল পঠিত উপন্যাস ‘মেমসাসেহব’-এর আলোচিত মেমসাহেব চরিত্রটি একেবারেই কাল্পনিক বলে জানালেন বইটির লেখক নিমাই ভট্টাচার্য। তার মতে, ‘রিপোর্টার’ যেমন একটি বই, ‘মেমসাহেব’ও তেমনি একটি। পাঠক পড়ে যেটা ভাববে সেটাই আসল কথা।

বিখ্যাত এ লেখক-সাংবাদিক সম্প্রতি কলকাতার টালিগঞ্জের মোর এভিনিউতে নিজ বাসায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।


‘মেমসাহেব’ ছাড়াও ‘রিপোর্টার’, ‘ডিপ্লোম্যাট’, ‘বংশধর’, ‘পিকাডেলি সার্কাস’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘কয়েদী’সহ অসংখ্য বই লিখেছেন নিমাই ভট্টাচার্য। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দেড়শ’র অধিক। তিনি তার লেখক ও সাংবাদিকতা জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন সাক্ষাৎকারে।

এপার এবং ওপার বাংলা মিলিয়ে তার সবচেয়ে বেশি পঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেমসাহেব’ নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি এ বছর প্রকাশের ৫০ বছর হয়েছে।

নিমাই ভট্টাচার্য জানান, ‘‘আমার ৩৫ বছর বয়সে বইটি লিখেছি। তখন আমি রিপোর্টার। এটি অসম্ভব জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বিক্রিত বই। এবারে এটি প্রকাশের ৫০ বছর হয়েছে। আমার লেখা বইয়ের মধ্যে এটি এখনও পর্যন্ত সমানভাবে জনপ্রিয় বই।’’

‘মেমসাহেব’ প্রকাশের ৫০ বছরে এসে অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘খুবই খুশি। ৫০ বছর ধরে একটা বই সমানভাবে জনপ্রিয় তা খুব একটা দেখা যায় না।’’

মেমসাহেব বইটিতে নিজের জীবনের ছায়া পড়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি সরাসারি জবাব না দিয়ে বলেন, ‘‘রিপোর্টার যেমন বই, মেমসাহেবও তেমনি। এটি পাঠক সমাজ ভেবে নিক। তবে মেমসাহেব চরিত্রটি একেবারেই কাল্পনিক ।’’

ঠিক কিভাবে উপন্যাসটি লিখেছেন জানতে চাইলে নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, তখন আমি দিল্লিতে। রিপোটিংয়ের কাজে কখনো দিল্লি, কখনো ব্যাঙ্গালোর, কখনো নেপাল বা অন্য কোথাও যেতে হতো। রিপোর্ট লিখে পাঠানোর তাড়া থাকতো। যেখানে বসে রিপোর্ট লিখতাম, এর ফাঁকে ফাঁকেই লিখেছি উপন্যাসটি।

১৯৩১ সালে জন্ম নেয়া নিমাই ভট্টাচার্য-এর পড়ালেখা ও সাংবাদিকতা জীবনের শুরু কলকাতাতেই। ১৯৫০ সালে ‘লোকসেবক’ পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। পরবর্তীতে দিল্লিতে গিয়ে বেশ কয়েকটি কাগজের পার্লামেন্ট, ডিপ্লোম্যাটিক ও পলিটিক্যাল করেসপন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন।

১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের বড় অংশই কাটিয়েছেন দিল্লিতেই। আর এসময়ের মধ্যে কাজ করেছেন পাঁচটি কাগজে। যার অধিকাংশই কলকাতার বাইরের। আর রিপোর্ট লিখতে গিয়েই লেখালেখি শুরু বলে জানান নিমাই ভট্টাচার্য।

দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে জওহরলাল নেহেরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, ভি কে কৃঞ্চমেনন, মোরারজী দেশাই, ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। নির্জোট শীর্ষ সম্মেলন, কমনওয়েলথ সম্মেলনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীসহ বিখ্যাত নেতৃবৃন্দের সঙ্গী হয়ে প্রতিবেদন করেছেন। তাদের জীবনাচরণও দেখেছেন একেবারে কাছ থেকে।

একজন পুরোদস্তুর রিপোর্টারের পাশাাপাশি লেখক হয়ে ওঠা এবং রিপোর্টের বাইরে এত কিভাবে লিখেছেন জানতে চাওয়া হয়।

নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ রিপোর্ট যা লিখি তা লিখেই গেলাম, প্রায় একবারেই লেখা শেষ হয়ে যায়। সে অভ্যাসটি থাকায় উপন্যাস লিখতে গেলেও প্রায় একই রকম। উপন্যাস বা অন্য লেখাও একবারেই লিখেছি। বারবার ড্রাফট দেখা, করেকশন করার কম দরকার হতো। দেড়শর মতো বই বেরিয়েছে, যার অধিকাংশই উপন্যাস।’’

‘‘রিপোর্টারের লেখা কেমন সেটা পাঠকরাই বিবেচনা করবেন। রির্পোটিং ও লেখালেখির জীবন দুটো আলাদা জিনিস। দিল্লিতে নেহেরু-ইন্দিরাসহ বড় মানুষদের সাহচর্যে থেকে রিপোর্ট করার মধ্যে অন্যরকম উত্তেজনা ছিল। কিন্তু সাহিত্যের কাজে স্থায়ী ছাপ পড়ে, খবরের কাগজের রির্পোটিংয়ে তা কম। খবরের কাগজের রিপোর্টিং পড়ে কয়জনই বা আর দেখা করতে আসে। বই পড়েই তো আপনারা দেখা করতে এসেছেন।’’

জনপ্রিয় লেখক হলেও নিমাই ভট্টাচার্য ছিলেন একজন বড় রিপোর্টার। ১৯৫০ সাল থেকেই রিপোর্টিং জীবনের শুরু। ১৯৮০ সালে কলকাতা ফেরার পর রিপোর্টিং একেবারেই ছেড়ে দেন। আর কোন কাগজের সাথে যুক্ত ছিলেন না। পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে।

তরুণ সাংবাদিকদের নিয়ে বলতে বললে নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, তাদের ভালো রিপোর্টার হতে হবে।

‘‘আর ভালো রিপোর্টার হতে হলে দুটো জিনিস দরকার। এক. গোপন কথা বের করতে হবে সরকার ও সমাজের। আমি জানি ভদ্রলোক, কিন্তু এর পেছনে কি আছে তা বের করতে হবে। সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতে হবে। অন্যায় অবিচার প্রকাশ করতে হবে।’’

‘‘দুই. নিজের প্রচণ্ড আগ্রহ ও সততা থাকতে হবে। কেউ খাইয়ে দিল আমি ভুলে গেলাম তা হওয়া যাবে না।’’

বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতা বিষয়ে নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এখন অনেক ধরণের সাংবাদিকতা হচ্ছে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাগজে লিখছে। সে অনুযায়ী নিজেদের তৈরি করতে হবে।’’

বাংলাদেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর দিল্লিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা হবার কথা স্মরণ করেন নিমাই ভট্টচার্য। তিনি সেসময় বঙ্গবন্ধুকে ডিপ্লোম্যাটসহ চারটি বই উপহার দিয়েছিলেন। ‘‘সেসময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিকদের অবদান বিরাট।’’

বাংলাদেশে মৌলবাদীদের আস্ফালন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘মৌলবাদ বরাবরই ছিল। বাংলাদেশ হবার আগেও ছিল, পরেও ছিল। একসময় উর্দু রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা হয়েছিল। উর্দুতে বাংলা লেখার চেষ্টাও হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনেও মৌলবাদীরা ছিল।’’

‘‘মুক্তমনের প্রগতিশীল সমাজ তৈরি করতে গেলে সে ধরণের শিক্ষা-দীক্ষা দরকার। সেজন্য আন্দোলনও দরকার।’’

তিন বছর আগে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে শরীরের একাংশ অবশ হয়ে যাওয়ার পর থেকে লেখালেখি একেবারেই বন্ধ নিমাই ভট্টাচার্যের। লিখতে না পারার আফসোস রয়েছে তার। তিনি বলেন, লিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারছি না।

লেখালেখি জীবন নিয়ে তৃপ্ত কি না জানতে চাইলে নিমাই ভট্টচার্য বলেন, কিছু লিখে তৃপ্ত হলেও আরও অনেক লেখা উচিত ছিল বলে এখন এসে মনে হয়।

‘মেমসাহেব’ এর বাইরে তার লেখাগুলোর মধ্যে প্রিয় বইয়ের কথা জানতে চাইলে তিনি ‘রিপোর্টার’, ‘ডিপ্লোম্যাট’ ও ‘নাচনী’র কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি বই তার প্রিয় বলে জানান।

বাংলাদেশে তার পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিমাই ভট্টচার্য বলেন, ‘‘বাংলাদেশের ভক্তরা ভালো থাক। তারা আমার বই পড়েন এজন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’’


Source: https://arts.bdnews24.com/?p=19220

25
Written By: Mridul Mahbub

অরুন্ধতী রায়ের The Ministry of Utmost Happiness প্রকাশিত হবার পর দেশ, বিদেশ ও ভারতের খ্যাত, অখ্যাত পত্র-পত্রিকায় যে আলোচনা এসেছে তাতে এই বইয়ের প্রতি আমার আগ্রহী হবার তেমন কোনো কারণ ছিল না। সেই আলোচনায় অরুন্ধতী গ্লামারাস নায়িকা। তিনি ১৯৯৭ সালে তার প্রথম ফিকশন The God of Small Things-এর জন্য বুকার পেয়েছেন। সেই বইয়ের বিক্রি প্রায় আট মিলিয়ন। আর তারপর বিশ বছর পর দ্বিতীয় উপন্যাস। এই সমস্ত আলোচনায় তার বিগত বিশ বছরের জার্নিটা কেমন যেন লুকানো! কোথাও নেই। অরুন্ধতীর মতো টাইগ্রেসকে ইন্ডিয়ান মিডিয়া বিশ বছর পর একখানা উপন্যাস লেখিকা হওয়ার বিরল সম্মান ছাড়া আর কিছুই দেয় নি। এমন উপন্যাস একটা দেশে কখন, কেন লিখিত হয় সেই সমস্ত বিষয় তারা আড়াল করেছে সুনিপুণভাবে। এই উপন্যাস লিখতে পারার জন্য তিনি অনেকগুলো নন-ফিকশন লিখেছেন। এই নন-ফিকশনগুলো এই উপন্যাস লেখার প্রস্তুতি মূলত। কিন্তু সমস্ত জায়গা প্রচারিত হয়েছে, একমাত্র ফিকশন লেখাই যেন অরুন্ধতি রায়ের জীবন, তার জীবন উদ্দেশ্য, লক্ষ্য। নায়িকারা যেমন একটা হিট ছবি করার পর, অনেকগুলো বক্স-ফ্লপ সিনেমার পর আবার একটা হিট ও হট ফিল্ম নিয়ে ফিরে আসে, তেমনই অরুন্ধতীকে ফিরিয়েছে ইন্ডিয়ান মিডিয়া। এই বিশ বছরে ৭/৮ খানা ননফিকশন লিখেছেন তিনি যার সকলই প্রায় মেড বাই ইন্ডিয়া স্বপ্নের বিপরীতে লিখিত। সেই সমস্ত লেখা-পত্র নিয়ে যেন এই উদ্‌যাপন। একজন ঔপন্যাসিকের কাছে কি আমরা শুধু ফিকশন আশা করব? এই প্রশ্ন মনে জাগে। বিষয় তেমনই। বিশ বছর পর খ্যাতনামা নায়িকা পুনরায় ফিরে এলে যেমন হয়, তেমনভাবেই যেন অরুন্ধ‌তী তার নতুন উপন্যাস নিয়ে ফিরেছেন। তার পরমানন্দের মন্ত্রণালয়-এ কী আছে, কারা আছে, কেন আ‌ছে এ সমস্ত গুরুতর আলোচনা সমগ্র ভারতে উপে‌ক্ষিত। ‘বিশ বছর পর লি‌খিত একটা উপন্যাস’ ট্যাগ দিয়ে ভারতীয় মি‌ডিয়া তৃ‌প্তির ঢেঁকুর তুলে বেশ আরামে আছে। বি‌ক্রি বাড়বে, কিন্তু তা শেষ কথা না। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, উপন্যাসটি আমরা কি উপলব্ধি করতে পারলাম এই ‘‌বিশ বছর পর’ ট্যাগ লাইনের বাইরে এসে? এই উপন্যাসের বিস্তার ও চিন্তা ব্যাপক বিজেপি-শা‌সিত ভারতে। তাকে আড়াল করার একটা চেষ্টা আছে ভারতীয় মি‌ডিয়ার।

The Ministry of Utmost Happiness হয়তো অরুন্ধতীর বিগত ২০ বছরের কর্ম ও ভাবনার কম্পাইলেশন, কনসেনট্রেশন। ২০ বছর পর একটা উপন্যাস, এইটাই মুখ্য! উপন্যাসটিকে এমন ট্রিটমেন্ট দেওয়ার কারণ বুঝতে পারি না আমি। পড়ার পর অবশ্য সামান্য বুঝেছি কেন মিডিয়া এমনভাবে এটার প্রচার চালাচ্ছে। লেখক হিসেবে তার যে দায় তিনি তা ভালোই সামলেছেন বিগত বছরগুলোতে। বিশ বছরের অবান্তর আলোচনা আমাকে কিছুতেই টানে নি। মনে হয় এই উপন্যাসের পরমানন্দটাকেই ছেঁটে দিয়েছেন মিডিয়া রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে। প্রকৃত কথা, সব মিডিয়া মিলে বলতে থাকলে তো মিডিয়ার এই পুঁজিবাদী ফর্মটাই থাকে না। ফলে, কালচার উৎপাদকরা নিজেদের সেভ করবে সেটাই স্বাভাবিক। হয়তো শিল্পসাহিত্য নিয়ে যারা মিডিয়াগিরি করে তাদের মূল লক্ষ্যই থাকে সেই সমস্ত বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যা বেচা-বিক্রি বাড়ায়। ২০ বছর ব্যাপারটা তার বইয়ের বিক্রি যে বাড়িয়েছে তাতে সন্দেহ নাই। এটাই মিডিয়ার অর্জন। হু হু করে সেল বাড়িয়ে দেয়। আমরা কিনতে থাকি, মিডিয়ার মতো করে দেখতে থাকি বিষয়গুলো। দুনিয়ার বেশির ভাগ লোকের আইকিউ ও ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স মিডিয়ার লোকদের থেকে কম। ফলে, তারা যা বলবেন, বেশির ভাগ লোকের সে হিসাবে ‘আ-তে আমটি আমায় খাওয়াও পেড়ে’ বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না। ফলে, অরুন্ধতী রায়ের The Ministry of Utmost Happiness-কে ভারতবর্ষের দলিত, মুসলিম, গেরিলা, বিদ্রোহী, দরিদ্রের করুণ ইতিহাস বলার থেকে ‘বিশ বছর পর লেখিকার একটি উপন্যাস’ বলতে পারার মাধ্যমে কোরটাকে আড়াল করার সক্ষমতা মিডিয়ার সোবারনেস, ইনক্লাইন্ডনেস টু স্টেট। চলতে থাকুক যুদ্ধ মানুষের বিরুদ্ধে। ‘যুদ্ধের জন্য শান্তি, আর শান্তির জন্য যুদ্ধ’ চলতে থাকুক জনগণের বিরুদ্ধে।

মানুষ হত্যার মাধ্যমে কোন মানুষকে বাঁচানোর গল্প শোনাচ্ছে রাষ্ট্র আমাদের?
জাতীয়তাবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনা, কাশ্মির, বিজেপি, গোহত্যা, মেড বাই ইন্ডিয়া, বিচার, অবিচার, সাম্রাজ্যবাদ, উদারনৈতিক গণতন্ত্র, উন্নয়ন, আন্দোলন, শান্তি, সরকারি বাহিনী, পাওয়ার, পার্টি, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি কোনো নতুন বিষয় না এই বিশ্বব্যবস্থায়। এই সমস্ত আন্তর্জাতিক সমস্যাসঙ্কুল অবস্থার সাথে আমাদের পরিচয় বহু দিনের। বিশেষত কোনো উপন্যাসে, তাও যদি তা অরুন্ধতী রায়ের উপন্যাসে ফিরে ফিরে আসে তবে তা আর কতটুকুই-বা নতুন হয়ে উঠতে পারে। এ তো অরুন্ধতীর লেখার সাধারণ বিষয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ নিয়ে অরুন্ধতীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সচেতন পাঠক কম-বেশি জানেন। সেই হিসাবে ৪৪৫ পৃষ্ঠার উপন্যাস কেন পড়ব আলোচকদের তথাকথিত আলোচনা পড়ে, তাই বুঝছিলাম না। জীবনে কোয়ালিটি রিডিংয়ের সময় খুবই কম। কী পড়ব, তার থেকে বেশি কী পড়বেন না সেই বিষয়ে সচেতন থাকা কর্তব্য এখন। তার ননফিকশনের শিক্ষা, তার এই উপন্যাস থেকে আমি নিতে প্রস্তুত ছিলাম না। গল্প-উপন্যাস শুধু, অতি শিক্ষামূলক হলে তা ঝামেলাপূর্ণ বিষয় মনে হয় আমার কাছে। উপন্যাসের কাজ সমাজ-সভ্যতার টুইস্ট আর তার কন্ট্রোভার্সিগুলো উন্মোচন করা। সেই হিশাবে কিছু নির্দেশনা থাকতে পারে উপন্যাসে, এনজিও থিসিস পেপারের সমাধান উপন্যাসের কাছে প্রত্যাশিত না। গল্প-উপন্যাস যদি উন্নয়নমূলক কাজের মতো কিছু একটা হয়, তবে উপন্যাস লেখা থেকে এনজিও খোলা ভালো আমার হিশাবে। ড. মুহাম্মদ ইউনুস ‘গ্রামীণ’-এর মাধ্যমে যা করতে চান তা তিনি উপন্যাস লিখে করতে পারবেন না। অপরের উপকার করতে পারার মধ্যে কতটুকু প্রকৃত অর্থে অপরের উন্নয়ন থাকে তা নিয়ে আমি খুবই সন্দিহান। মানুষ যখন তার অর্জিত বা দৈব জ্ঞান দ্বারা উপকার করতে চায় সেটা সব সময় উপকার হয় না। কলোনি পরবর্তী ভারত যদি প্রিকলোনিয়াল (রামরাজ্যে) অবস্থায় ফিরতে চায় তবে তার হাহাকার কেমন হতে পারে, তার একটা মেটাফরিক ডার্টি জোকস আছে স্লাভো জিজেকের যিশু খ্রিস্টকে নিয়ে।

খ্রিস্ট গ্রেফতার ও ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে তার শিষ্যরা ভাবল, ‘আহা বেচারা, ভার্জিন থেকে গেল! রক্তমাংসের উষ্ণতার স্বাদ পেল না! এরার আগে তাকে একটু আনন্দ কি দেওয়া যায় না।’ যেই কথা সেই কাজ। তারা মেরি ম্যাগডলিনিকে বিশ্রামরত যিশুর খাস-কামরায় যেতে বলল তাকে প্রলুব্ধ ও জাগ্রত করার জন্য। সে খুব খুশি মনেই তার মনোরঞ্জনে সম্মত হলো। সে ঢুকে গেল যিশুর তাঁবুতে। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরেই সে দৌড়ে বেরিয়ে এল, ভীত, ত্রস্ত, তীব্র হারানোর হাহাকার চোখে মুখে। সবাই তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সর্বস্বান্ত হওয়ার মতো কী হয়েছে? তোমাকে কি তিনি অভিশাপ দিয়েছেন?’ ম্যাগডলিনি বলল, ‘আমি তার ঘরে ঢুকে ধীরে ধীরে কোমর দোলাতে দোলাতে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিলাম তার সমানে, আমার পা দুটো ছড়িয়ে দিলাম যেন দেখা যায় আমার নারীচিহ্নের পিচ্ছিল প্রস্তুতি।’ তিনি এটা দেখে আঁতকে উঠলেন। যিশু বললেন, ‘কী গভীর ক্ষত। এই ক্ষতের আরোগ্য করা দরকার।’ তিনি খুব ধীরে সুস্থে তার করতলে ঢেকে দিলেন আমার গভীর ক্ষত।’

জিজেক এই নোংরা কৌতুকের নিচে লিখেছেন, অপর কেউ যখন আপনার অসুখ সারাতে চায় তখন একটু সাবধানী হোন। কেউ যদি তার অসুস্থতাই উপভোগ করে তবে সমস্যা কী! একইভাবে, কলোনিয়াল দেশগুলো প্রিকলোনিয়াল অবস্থায় ফিরতে গেলে মেরি ম্যাগডলিনির দুঃস্বপ্নের মতোই অবস্থা হবে। ইন্ডিয়া কলোনিয়াল প্রতিক্রিয়া ও দীর্ঘদিনের রূপান্তরকে বাদ দিয়ে রামরাজত্বে ফিরতে চাইলে চিৎকার এর থেকে কম হবে না।

কে চাইবেন যিশুর এই উপকার। মানবশরীরের আনন্দ-অঙ্গকে ক্ষত হিশাবে সারিয়ে তুলতে চাইবেন কে? এই কথা সাহিত্যের মাধ্যমে অপরের উপকার করার ক্ষেত্রেও খাটে। কী উপকার তা নির্ধারণ করতে হবে উপকারগ্রহীতার দশা ও অবস্থার ভিত্তিতে। যিনি উপকারের বাহানা করছেন সেই জায়গা থেকে দেখার সুযোগ নাই। ফলে, উপকার- ও উন্নয়ন-মানসিকতার সাহিত্য সৃষ্টিকারীরা যিশু। সাহিত্যগ্রহীতারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে যায় সাহিত্যের কাছে, সেখান থেকে একটা হাহাকার নিয়ে ফেরে যদি তাঁবুর মধ্যে যিশু বাদে অন্য কোনো প্লেবয় বসে না থাকে।

নানা রকম আলোচকরা যা যা বলছেন The Ministry of Utmost Happiness নিয়ে, সেই হিশাবে আমি এইটা পড়ার তেমন আগ্রহ বোধ করি নি।

কিন্তু আমার সন্দেহ হয়। যে ভারতে গরুর মাংস ফ্রিজে থাকার সন্দেহে মব লিঞ্চিং হয়, সেই ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এমন একটা বই নিয়ে তো আগুন জ্বলার কথা। সেই অর্থে বড় কোনো গুঞ্জন নাই। অথবা ভিন্নমুখী আলোচনার মাধ্যমে এটার গুরুত্ব তৈরি করতে চায় নাই সচেতনভাবেই। যেদেশে রাজনৈতিকভাবে নির্বিষ তসলিমা নাসরীন নিয়ে হাওয়া গরম হয় সেখানে প্রবল ভারত-উন্নয়নকে মিথ্যেবাদ আখ্যা দেওয়া অরুন্ধতীর নতুন উপন্যাস নিয়ে তেমন কোনো ঝড় নাই, আওয়াজ নাই। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো মুসলিম বা দলিত বা কাশ্মির বা অন্ধ্র প্রদেশের আতঙ্কবাদীরা। হিন্দুবাদী ভারতের সংখ্যালঘুরাই এর ক্যারেকটার। কিন্তু, সমগ্র ভারত কেন নিশ্চুপ? যারা জাতীয়তাবাদ আর ধর্মের নামে রাজনীতি করে এবং যারা উদারনৈতিক সর্বধর্মময় ভারতের নামে রাজনীতি করে, উভয় পক্ষই নীরব। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে আমার কাছে। ১৩৫ কোটির দেশে সে কি অপঠিত? নাকি তাদের উদার গণতন্ত্রের মুখোশ এইটা। ১৯৯৭ সালে যখন The God of small things প্রকাশিত হয় তখন অরুন্ধতী নিয়ে ব্যাপক সাড়াশব্দ ছিল। সেই তুলনায় এই ওপেন মিডিয়ার, সোস্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের যুগে The Ministry of Utmost Happiness নিয়ে কথা একটু কমই। আমার মনে সন্দেহ জাগে। বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হয়। ফলে আমার মনে হয়, এই আনন্দপুস্তক আমার পড়ে দেখা দরকার। কারণটা খুঁজে পাওয়া দরকার। বইটা পড়ে ফেলি আমি।

এটা পড়ার পরই আমার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়ের আনন্দমঠ-এর কথা মনে পড়েছে। কেন, কিভাবে, পরে বলি। আগে অন্য কথায় যাই।

নৃবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান দুই জায়গাতে গসিপ বা ফিকশন থিয়োরি নামে একটা বিষয় আছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভাল্যুশনারি সাইকোলজির অধ্যাপক রবিন ডুনবারের মনে করেন, মানুষের সাথে মানুষের যে বিশ্বাস ও আস্থার সস্পর্ক গড়ে উঠে তা গসিপের ভিত্তিতেই হয়। গসিপ হলো কে কার নামে কী বলছে। ধরেন অফিসের ক্যাফেটরিয়ায় বসে লাঞ্চ আওয়ারে আপনার পাশের টেবিলের কলিগের নামে দূরের টেবিলের আরেক কলিগের কাছে আপনি কিছু একটা বলছেন তার অগোচরে। আপনি কাকে বলছেন? কার বিরুদ্ধে বলছেন? যাকে বলছেন তিনিও আপনার সামনে অন্তত ঐ ব্যক্তির বিরোধী ধরেই কথা বলছেন। এই বলার মধ্যে দুইজন মানুষের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে ওঠে, বিশ্বাস স্থাপন হয়। তারা একইভাবে ভাবার যোগ্যতা অর্জন করে। এছাড়া এর মধ্যে আরও দুই রকম বিষয় আছে লক্ষ করার মতো। এক, বিষয়টা নিয়ে আপনি দূরের টেবিলের কলিগের কাছে যা যা বলছেন তা হয়তো সত্য। যার সম্পর্কে বলছেন তিনি বিষয়টা লুকিয়েছেন সবার কাছ থেকে, কিন্তু আপনি কোনো না কোনোভাবে জেনেছেন। ফলে এইটা গোপনে আরেক জনের কাছে প্রকাশ করে দেওয়ার মাধ্যমে এমন আনন্দ লাভ করছেন আপনি। সত্য জানালে ক্ষতি কার! এটা হলো রিয়েল রিয়েলিটি। আবার এমনও হতে পারে, আপনি যা বলছেন তার বেশির ভাগ ব্যাপারই আপনার মনগড়া। হয়তো কোনো একটা ঘটনায় আপনার মনে একটা পূর্বানুমান তৈরি হয়েছে, সেই অনুমানকে নানা জল্পনা-কল্পনা দিয়ে আপনি ভ্যালিড করছেন। কল্পনার এই ভ্যালিডিটি হলো সন্দেহ। সেই সন্দেহের কথাটাই আপনারা খুব নিচু স্বরে পরস্পরের সাথে শেয়ার করলেন। এটা হলো ইমাজেনারি রিয়ালিটি। হয়তো ঘটনা এমন না, আপনি যেমন ভাবছেন। রিয়েল রিয়েলিটি বা ইমাজেনারি রিয়েলিটি যাই বলেন না কেন, আপনার শ্রোতা আপনার উপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখবে, কেননা আপনারা পরস্পরকে মানসিকভাবে কো-অপারেট করছেন এইখানে। এই পরস্পরকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সাপোর্ট দিতে পারার ক্ষমতাই মানুষ ও সভ্যতা তৈরির নিয়ামক। এই গসিপ আর নানা গল্প নিয়েই মানুষে মানুষে আস্থার সম্পর্ক আগায়। গসিপ, রিউমারকে খারাপ কিছু হিশাবে ধরতে হলে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা শেষ করে নিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গসিপ হলো মানব অগ্রগতির টুলস। এই গসিপের জন্যই আমরা মানুষ। যারা গসিপ করছে তাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে। এই ইমাজেনারি বাস্তবতা, ফিকশনাল রিয়েলিটি, গল্প সমাজ-সভ্যতার জন্য বিরাট গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ একমাত্র জীব যারা এই কল্পিত বাস্তবতাকে মানে ও সে অনুযায়ী চলে। অন্য প্রাণীর মধ্যে এমন নজির নাই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গল্পে কত ভাগ বাস্তব সত্য, আর কত ভাগ কল্পিত সত্য আছে তা নিয়ে হিশেব করে দেখতে পারেন আপনি। সত্য মিথ্যা মুখ্য না। গল্পটাই ব্যাপার। সভ্যতার সামনের দিকে আগানোর জন্য গসিপ অবধারিত। আপনি যদি বানরকে বলেন মৃত্যুর পর তোমাকে ২৪টা কলা দেওয়া হবে, যদি আর কলা না খাও। বানর দুইটা কলা বেশি খাবে এক্ষেত্রে, মনে মনে আপনাকে বানর গালিও দিতে পারে যদি তার সে সুযোগ থাকে। আর মানুষ নানা রকম কল্পিত গল্প থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়, পরস্পর মিলে লক্ষ নির্ধারণ করে। সভ্যতা আজ এখানে এল, আপনারা নিজেদেরকে সভ্য হিশাবে দাবি করছেন, সুন্দর সুন্দর পোশাক পরেছেন, নানা বিষয় নিয়ে ভাবেন, বিমূর্ততার মজা নিচ্ছেন—এইগুলোর পেছনে বাস্তবতার চেয়ে কল্পিত বিশ্বাসের ভূমিকাই বেশি। মানুষ আশলে গল্প বিশ্বাস করতে চায়। জীবনের নানারকম গল্পই নিয়ন্ত্রণ করে তাকে। গুহাজীবী একজন মানুষ তার বাচ্চাকে সাবধান করছে, গুহার বাইরে রাতের বেলায় বাঘ থাকে। হয়তো সত্য বাঘ নাই গুহার বাইরে। মনের বাঘ মেনে নিয়ে বাচ্চারা বাইরে গেল না। এতে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। আধুনিক মানুষের টেলিভিশন খুলুন। দেখবেন হরলিক্স না খেলে আপনার সন্তান টলার, শার্পার, স্ট্রংগার হতে পারবে না। এমন কত কল্পিত গল্প মানুষ শোনে আর বিশ্বাস করে আর বাঁচতে থাকে যুগের পর যুগ। মানুষ ঝাড়ফুঁক বিশ্বাস করত রোগমুক্তির জন্য এক সময়। তাদের বিশ্বাস ছিল বিশেষ মানুষ মানুষকে সাহায্য করতে পারে রোগশোকের সময়। ফলে আজকের এই হাসপাতাল ব্যবস্থা। লিমিটেড কোম্পানি হলো ইমমর্টাল ব্যক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। রাষ্ট্রও লিমিটেড কোম্পানিই। আমেরিকায় লিমিটেড কোম্পানিকে কর্পোরেশন বলে। কর্পোরেশন এসেছে ল্যাতিন কর্পাস থেকে। যার অর্থ বডি বা দেহ। লিমিটেড কোম্পানি একটি অতীব আধুনিক ধারণা ও বিশ্বাস। মানুষ আর কর্পোরেশনের মধ্যে সবই এক। মানুষের বিচার হয়, ছেলে মেয়ে হয়, জরিমানা হয়। কোম্পানি মন্দ কাজ করলে তার বিচার হয়, তার সিস্টার কান্সার্ন তৈরি হয়, ফাইন হয়। সুশীল মানুষের মতো তারও সমাজের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য থাকে। রাষ্ট্র তাকে নানা দিক-নির্দেশনা দিতে পারে। এইটা তো একটা ধারণা, গল্প। কল্পিত ব্যক্তিত্ব আরোপ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের উপর। কর্পোরেশন হলো কল্পিত বাস্তবতার চূড়ান্ত রূপ। আমাদের প্রতিটি আচরণ অর্ধেক ননফিকশন আর অর্ধেক ফিকশন। ফিকশনের ব্যাপক ভূমিকা আছে মানুষের জীবনে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গল্প লাগে, মিথ লাগে। সেই গল্প আর মিথ তারা তৈরি করে দেয়? রাষ্ট্র তো জাতীয়তাবাদী গল্প। তা টিকিয়ে রাখার জন্য জাতীয় সংগীত লাগে, পতাকা লাগে, দেশ-বন্দনার কবিতা, গান লাগে, শহিদ হওয়া লাগে, বীরত্বের গল্প লাগে, ঐক্য লাগে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা লাগে, কল্পিত শত্রু তৈরি করা লাগে। এই শত্রু তৈরির কাজ রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের করতে পারে, আবার নিজ রাষ্ট্রের একটা সংখ্যালঘু অংশকেও রাষ্ট্রশত্রু হিশাবে দাঁড় করাতে পারে। আমাদের নিরপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করার মতো সংখ্যালঘু রাজনৈতিক দল, চরমপন্থি আদমবোমাদের গল্প আমরাই তৈরি করেছি। মুসলিম মানেই সন্ত্রাসী, এন্টি-স্টেট এই যে হীন আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির ফিকশন-উৎপাদী মেশিন ৯/১১ পর থেকে যে দুনিয়ায় শুরু হয়েছে তা আর থামছেই না। রাষ্ট্রের ভেতর জন্ম দিচ্ছি আমরা নতুন নতুন শত্রু, সমগ্র দুনিয়ার দেশ বাঁচানো, মানুষ বাঁচানোর স্লোগান দিয়ে। মানুষ হত্যার মাধ্যমে কোন মানুষকে বাঁচানোর গল্প শোনাচ্ছে রাষ্ট্র আমাদের?

অরুন্ধতী রায়ের The Ministry of Utmost Happiness পড়েই আমার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়ের আনন্দমঠ-এর কথা মনে পড়েছে আগেই বলেছি। সে কথায় যাওয়া যাক।

The Ministry of Utmost Happiness হলো সেই নতুন গল্প যা আমাদেরকে আনন্দমঠ উৎসারিত উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা দেয়।
যেকোনো বিষয়ে জনমনে বিশ্বাস জন্মানোর জন্য গল্প লাগে। বঙ্কিম আনন্দমঠ-এ সেই উগ্র জাতীয়তাবাদের গল্প তৈরি করেছেন। তার ফিকশন ভারতকে হিন্দুবাদে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সেই বিশ্বাস ভারতীয় ঐতিহ্যের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল সেটা আলোচনা করা জরুরি আজ এই অঞ্চলের জাতীয়তাবাদ ও দেশভাগ বোঝার জন্য। জাতীয়তাবাদ একটা গল্পনির্ভর বিষয়। জাতীয়তাবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য, ইন্সপায়ার্ড করার জন্য জাতীয় সংগীত, পতাকা, যুদ্ধ, কিছু বীর, নানা দিবস ইত্যাদি থাকা লাগে। মানুষকে এক কল্পিত লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়। ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’-মূলক জাতীয়তাবাদের গল্প, দেশ নামক দশভুজা দেবী, দেশপ্রেম মানে মায়ের সেবা এইসব একটা প্রজন্ম প্রবলভাবে বিশ্বাস করতে থাকে। কারণ জাতীয়তাবাদ কায়েমের সাথে সাথে এই সকল গল্প সত্য হয়ে যায়। ফলে উন্নয়ন আর শান্তির নামে মানুষ থেকে দেশ বড় হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদী মাতৃস্বরূপা, দেবীর মতো দেশ—মানুষের বিরুদ্ধে এই সমস্ত গল্পের জোরে দাঁড়িয়ে থাকে। জাতীয়তাবাদী দেশ মানেই তা মানুষকে নিপীড়নের মাধ্যমে টিক থাকে। এখন মানুষকে জাতীয়তাবাদের নেশা থেকে বের করতে হলে তার সামনে নতুন গল্প হাজির করতে হবে। নতুন গল্প ছাড়া প্রতিষ্ঠিত গল্পের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায় না। অরুন্ধতীর The Ministry of Utmost Happiness হলো সেই নতুন গল্প যা আমাদেরকে আনন্দমঠ-উৎসারিত উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা দেয়।

যে গল্প তিনি লিখেছেন এই বইয়ে তা আমরা কম-বেশি জানি সকলেই। সরকার কর্তৃক গুম, হত্যা, ধর্ষণ, অর্থ-জালিয়াতি, সেনা-নির্যাতন, জাতপাত, জঙ্গিবাদ—এ তো আমাদের জানা কথা। পত্রিকায় রোজ এই সংবাদ আসে। মানুষের রাষ্ট্রের বাইরে বসবাসের সুযোগ থাকলে আপনারা কী করতেন, আমি জানি না! যেখানে রাষ্ট্র নামক উৎপাদনক্ষম মেশিন আছে, সেখানেই তো এই অনাচার। সংবাদপত্রে লেখা এই সমস্ত শোকের, নির্যাতনের গল্প আমরা গুনতে শুনতে সহ্য-ক্ষমতা অর্জন করেছি। জাতীয়তাবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক খুন, জখম, জেলকে আমরা মেনে নিয়েছি। ফলে, পত্রিকায় বা টিভিতে যে সত্য গল্প আসে তাতে যেন প্রাণ নেই। বিদ্রোহের কোনো অনুপ্রেরণা নাই এই গল্পে। আমরা সকালে শুনি রাষ্ট্রবাহিনীর সাথে গেরিলাদের যুদ্ধে ত্রিশজন হতাহত, কিন্তু রাতে ভুলে যাই। রোজ রোজ নতুন গল্প উৎপাদন হতেই থাকে। অথচ অরুন্ধতী যে গল্প আমাদের বলেন তাতে প্রাণ আছে। আগেই বলেছি দুই রকম বাস্তবতা আছে দুনিয়ায়। এক সত্য বাস্তবতা আর দুই কল্পিত বাস্তবতা। কল্পিত বাস্তবতার শক্তি অনেক। মিডিয়ার গল্পে শুধু বাস্তবতার বাস্তবতা থাকে। অরুন্ধতীর তৈরি গল্পে আছে রিয়েল রিয়েলিটি আর ইমাজেনারি রিয়েলিটি। মানুষ গল্প থেকেও বেশি বিশ্বাস করে এই ফিকশন। এর জন্যই চেনা গল্প হয়েও The Ministry of Utmost Happiness শুধুমাত্র গল্প না হয়ে ফিকশন হয়ে ওঠে, চিন্তা আর বিশ্বাসের নতুন বেজ লাইন হয়ে ওঠে।

The Ministry of Utmost Happiness-কে বাংলায় পড়া যায় পরমানন্দের মন্ত্রণালয়। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ আর অরুন্ধতীর পরমানন্দের মন্ত্রণালয়—কোথায় যেন একটা মিল আছে! ইতিহাসের পায়ে পায়ে আগাতে হবে আমাদের।

আনন্দমঠ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয় ১৮৮০ সালে। ১৮৮২ সালে তা বই আকারে মুদ্রিত হয়। আনন্দমঠ যারা পড়েছেন তারা জানেন এটা ছিয়াত্তরের (বাংলা ১১৭৬, ইংরেজি ১৭৭০) মন্বন্তরের পটভূমিতে সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে লেখা। উপন্যাস হিশাবে বেশ বাজে। চরিত্রগুলোর যত না রক্তমাংস দেখা যায় তার থেকে বেশি মাংসের নিচে হাড় দেখা যায়। উপন্যাসের কঙ্কাল। রাজনৈতিক মতাদর্শ, হিন্দুজাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম—এই নিয়েই গড়ে উঠেছে আনন্দমঠ। এটা যত না উপন্যাস তার থেকে বেশি হিন্দুজাতীয়তাবাদী দীক্ষাগ্রন্থ, ম্যানুয়াল। সমাজতন্ত্র বোঝার জন্য কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো যেমন, ভারতের জাতীয়তাবাদ উপলব্ধি করার জন্য বঙ্কিমের আনন্দমঠ। ‘বন্দে মাতরম’ গানটি এই বইয়েরই অন্তর্ভুক্ত। আনন্দমঠ বইয়ে এই গানের সুর হিশাবে পাদটিকায় লেখা ছিল মল্লার, কাওয়ালি তাল। সুর করেছিলেন যদুভট্ট। ১৮৮৫ সালে তরুণ রবীন্দ্রনাথ এই গানের সুর করলেন ‘দেশ’ রাগে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি মুসলিম জাতীয়তাবাদও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল এর বিপরীতে। ক্রিয়ার বিপরীত সমান প্রতিক্রিয়া। ‘বাহুতে তুমি মা শক্তি/ হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি/ তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।’ জিন্না ও মুসলিম লীগের আপত্তি ছিল বৈকি! জিন্নাহ কতটা মুসলিম সেই প্রশ্নে না যাই। তিনি মুসলিম কম্যুনিটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মুসলিম কম্যুনিটির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যারা বলবেন জিন্নার জন্য নামাজ-রোজা করা প্রাথমিক শর্ত, তারা কেমন সেক্যুলার? নামাজ-রোজা পালন করার ভেতর দিয়ে পুঁজিবাদের সেবক হতে পারবেন না? র‌্যাডিক্যালিস্ট হওয়ার মাধ্যমে আপনি আমেরিকার স্বার্থ হাসিলে সাহায্য পাচ্ছেন, কিন্তু অমুসলিম জীবন যাপন করে মুসলিম কম্যুনিটির প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না! দুর্বলের পক্ষে দাঁড়ানোটাই আশল রাজনীতি। কিন্তু আমাদের বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ কাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে? শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুর কল্যাণ যে ব্যবস্থা দেখতে চায় তা কতটা কাজের। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শেই এই গান কেটে-ছেঁটে জাতীয় সংগীত হিসাবেই রাখার পরামর্শ দেওয়া হলো। ৭৬ বছর বয়স্ক রবীন্দ্রনাথ প্রবল আপত্তির মুখে পড়েন সেই সময়। প্রবল হিন্দুত্ববাদ আর জিন্নার মুসলিম জাতীয়তাবাদ একই তো বিষয়। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ‘বন্দে মাতরম’ মানে ‘করি মাতার বন্দনা’। এই মাতার যে বর্ণনা এই গানের মধ্যে আছে তা দশভুজা মা দুর্গা। এইখান থেকেই দেশ আমাদের কাছে মাতৃমূর্তি। দেশকে মূর্তি হিসাবে দেখার যতই বিরোধিতা জিন্নারা করুক না কেন, সেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বাইরে কিন্তু তারা কোনো নতুন বিকল্প হাজির করতে পারেন নি। হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে মুসলমানিত্ব। দেশ এক মিথিক্যাল মূর্তি আমাদের কাছে। ভক্তি- ও ভয়-মিশ্রিত। এখানে ব্যক্তি থেকে দল বড়, দল থেকে দেশকে বড় হিশাবে দেখানোর প্রবণতা। দেশ থেকে মানুষই বড় হওয়া দরকার। দেশমাতা নামক বিমূর্ত ধারণার পাশে মানুষ ধারণাটি পরাজিত হলো। দেশ নামক দেবতার কাছে মানুষ এক নগণ্য অস্তিত্ব। উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে জনগণ থেকে দেশ শব্দটা বেশি উচ্চারিত হয় তার ঐতিহাসিক কারণ হয়তো এখানেই।

বহুজাতীয়তাবাদী ভারত রাষ্ট্রকে দুর্গার প্রতিরূপ হিশাবে দেখার যে দেশাত্মবোধক চিন্তা তাতে তরুণ রবীন্দ্রনাথের সায় ছিল। ১৮৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে এই গান নিজে গান। শ্রীঅরবিন্দ এই গানকে বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত হিশাবে উল্লেখ করেন। শ্রীঅরবিন্দ কংগ্রেসের চরমপন্থি দলের নেতা ছিলেন, তা আমরা জানি। ইতিহাস বলে, মুসলিম সংগঠনগুলো জাতীয় সংগীত হিশাবে পৌত্তলিকতার দায়ে এই গানের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে। বিষবৃক্ষের বীজ দেখতে কেমন? বহুজাতি-মিশ্রিত নৃতত্ত্ব-নির্ভর ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করে মিথলজি-নির্ভর রাষ্ট্রচিন্তার ফল কেমন হতে পারে তা ভারত ঠিকই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে এখন। কাকে বলে ইতিহাস আর কাকে বলে পুরাণ, মিথ তা রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের জানা দরকার। না হলে মাটির বুকে কান পেতে শুধু রক্তপাতের শব্দ শোনা যাবে। মানুষ থেকে দেশ বড় হয়ে গেলে, রাষ্ট্র তার জনগোষ্ঠীকে নিজের বাহিনী দ্বারা উন্নয়ন আর শান্তির নামে নির্যাতন করতে পারে। রাষ্ট্র এক ধর্মীয় মিথিক্যাল চরিত্র, যার সেবা লাগে মানুষের রক্তে ভেজা রক্তজবায়। সেই মানুষ থেকে বড় রাষ্ট্রনামক বিষবৃক্ষের বীজ এইখানেই প্রোথিত। পরাধীন ব্রিটিশ-ভারত খণ্ডে যে দেশপ্রেমমূলক জাতীয়তাবাদ নামক ধর্মের জন্ম হয়েছিল তার ফলাফল দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটা দেশ মোটামুটি ভোগ করছে এখনও। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মায়ানমার কেউই বাদ নাই। উপমহাদেশে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের সূচনা উদাহরণ হিশাবে কাজ ক’রে সকল রাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধ করেছে ধর্মীয় রাজনীতিতে। মানুষ থেকে দেশ দেব-দেবীর মতো মহৎ পরিশুদ্ধ সবদেশেই। ফলে, রাষ্ট্র নামক ধারণা আর গল্পের নাম নিয়ে যেকোনো অনাচারই বৈধ।

এই বিষয়গুলো একটু মাথায় নেওয়া দরকার The Ministry of Utmost Happiness নিয়ে সামাস্য দুএকটা কথা বলার আগে। সুবিধা হয় একথা বোঝাতে, যে ভুল জাতীয়তাবাদের উপর নির্ভর করে ভারত তথা উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছে সেই রাষ্ট্রের দৃশ্যমান সমস্যা ও সমাধানের কিছু প্রবল নির্দেশনা হলো অরুন্ধতীর পরমানন্দের মন্ত্রণালয়। বঙ্কিমের আনন্দমঠ যেভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে ভূমিকা রেখেছে ঠিক একইভাবে এই বই ভবিষ্যৎ জনমুখী ভারত তথা পৃথিবীর সকল কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ে ওঠার বীজ রেখে যাচ্ছে। এই হলো আনন্দমঠ আর পরামানন্দের মন্ত্রণালয়ের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরস্পর থেকে। দুটো বইই রাজনীতিকে ডিল করছে। উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূলটা তৈরিতে আনন্দমঠ যেভাবে কাজ করেছিলে, একইভাবে এই রাজনীতির পরিবর্তনের স্বপ্ন পরমানন্দের মন্ত্রণালয়-এ আছে।

রাষ্ট্রকে নির্দেশনরা দেবার ক্ল্যাসিকাল গ্রন্থ পৃথিবীতে তিনটা : কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, সান’জুর আর্ট অব ওয়ার আর ম্যাকিয়াভেলির প্রিন্স। আর এই উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদ, দেশ, দেশপ্রেম ধারণার জন্য আনন্দমঠ অবশ্যপাঠ্য। এবং রাষ্ট্রের অসুখটা কোথায় তা দেখার জন্য এবং তার চিকিৎসার অনুপ্রেরণা পেতে The Ministry of Utmost Happiness বইটি। অরুন্ধতীর অতীতের রাষ্ট্রচিন্তকদের চিন্তার প্রতিফলনে যে নিষ্পেষণের রাষ্ট্রব্যবস্থা এখানে গড়ে উঠেছে তার স্বরূপ, সীমাবদ্ধতা বোঝা যায় এখানে। এই উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদের সূচনা হিন্দু-মিথলজি দিয়ে। এই অঞ্চলের অংশ বিশেষের ঐতিহ্য, কালচার, বিশ্বাসকে পুঁজি করে শুধুমাত্র হিন্দু-মিথের উপর নির্ভর করে জন্ম দেওয়া হয়েছে জাতীয়তাবাদের বিষবৃক্ষ। এইকালে তার যে ফল পাওয়া গেল, সমগ্র জনগণের জন্য তার স্বাদ বড় কটু, জাতি-বিদ্বেষপূর্ণ, রাষ্ট্র কর্তৃক উন্নয়ন ও শান্তির নামে দমন-পীড়নময়।

হিন্দু জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন নিয়ে ব‌ঙ্কিমের আনন্দমঠ র‌চিত হয়েছে ১৮৮২ সালে। ভারত ঐ‌তিহা‌সিক ও নৃতা‌ত্ত্বিকভাবে বহুজা‌তি-মিশ্রিত সংঘ-রাষ্ট্র। সেই ই‌তিহাস ও বহুজাতি-নির্ভর ভারতের প্রত্যাশায় লিখিত The Ministry of Utmost Happiness উপন্যাস‌টি। ব‌ঙ্কিমের পর ভারতকে ১৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হলো এর জন্য। এই অপেক্ষা বড় দীর্ঘ।

দুনিয়াটাকে গোরস্থান বানিয়ে ফেলেছি আমরা এটা যেন আমরা ভুলে না যাই। এই ভুলে না যাওয়া থেকেই জন্ম নিবে গোরস্থানে জান্নাত।
আনন্দমঠীয় বঙ্কিম-রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বিপরীতে অরুন্ধতীর ‘পরামানন্দ’ গড়ে উঠতে ১৩৫ বছর বড় বেশি সময়। বহু রক্ত ঝরে গেছে এর মধ্যে। বহু বহু প্রাণের ক্ষয় হয়ে গেছে। উপত্যকা ভরা লাশের মিছিলে The Ministry of Utmost Happiness হলো সুউচ্চ স্মৃতিসৌধ। ১৮৯৬ ‘জাতীয় কংগ্রেস’-এ ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়ার মাধ্যমে ভারত জাতীয়তাবাদের যে বিসমিল্লায় গলদ দিয়ে শুরু করেছিল ঠিক সেইভাবে ২০১৭ সালে The Ministry of Utmost Happiness-এর মাধ্যমে ভারত নিজেকে শুধরে নিতে পারে। নতুন সূচনা হতে পারে। অতীতকে পাল্টানোর কোনো উপায় নাই। শুধু একে ক্রিটিক্যালি দেখে নতুনভাবে শুরু করা যেতে পারে। পরমানন্দের দরজা দিয়ে সম্মিলিত ভারত তৈরি হতে পারে। এই বই একটা ইন্সপাইরেশন সমগ্র উপমহাদেশের জন্য। উপন্যাসের মধ্যে একটু ঢোকা যাক। অন্যান্য কথাই বেশি হয়ে গিয়েছে। তবে বইটার কোর পলিটিক্সটা খোলাশা করার জন্য এত কথার দরকার ছিল বলে মনে হয়।

থ্রু ট্র্যাডিশনাল ফর্মে লেখা একটা উপন্যাস। ছিন্ন ভিন্ন অনেক গল্প একে অন্যের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে। প্রতিদিন সকালে আপনি যা পড়েন পত্রিকায়, রাতে দেখেন নিউজ চ্যানেলে তাই নিয়েই এই উপন্যাসে গল্প। এই সংবাদপত্র-ধর্মী গল্পকে উপন্যাস হিসাবে তৈরি করে তোলাটাই হলো বড় এক চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জটা ভালোভাবেই সামলেছেন তিনি।

উপন্যাসের গল্পটা সংক্ষেপে বলি। উপন্যাসের ঘটনা বর্ণণা এই লেখার উদ্দেশ্যও না। এটা আশলে মাল্টিস্টোরিড এগারো তলা একটা বিল্ডিং। একটার মাথার উপর আরেকটা গল্প, একটা তলা যেভাবে আরেকটা তলা ধরে রাখে তেমন। ১২ তলায় ছাদ। প্রতি ফ্লোরের সজ্জা ও উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন। মাল্টি লেয়ারড, পরস্পর ছিন্নভিন্ন। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে এক ও অদ্বিতীয় পুরা ১২তলার এক বিশাল বিল্ডিং। সবকিছু জড়িয়ে পড়ে এক জায়গায়। অমৃত আর বিষের শরবত হয়ে ওঠে। মুলাকাত আলী ও জাহনারা বেগমের হিজড়া ছেলে আফতাব। সে লিঙ্গ পরিবর্তন করে আঞ্জুম হয়ে যায়। এই আঞ্জুমের কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে জয়নাব, দলিত সাদ্দাম হোসেন যার বাবা—নিহত রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর হাতে, যার জীবনের লক্ষ্যই এই পুলিশ অফিসারকে হত্যার মাধ্যমে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়া; ডক্টর আজাদ ভারতীয়, যিনি দিল্লির যন্ত্রর-মন্ত্ররে ১০ বছর ধরে অনশন করছেন, তিলো, তিলোত্তমা যার প্রেমিক মুসা, তারই স্বামী নাগারাজ হারিয়ানা। মুসা কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিপ্লবী, নাগা কাশ্মির বিট করা বিখ্যাত সাংবাদিক, টক শো ম্যান; বিপ্লব দাশগুপ্ত শ্রীনগরের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর হেড। এরা আবার পরস্পরের বন্ধু ছাত্রজীবনে। কিন্তু জীবন তাদের কোথায় ভাসিয়ে নিল। একই জীবন যাপন করা চারটা মানুষ কর্মক্ষেত্রে কী বিচিত্রভাবে ভিন্ন। সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমনের নামে গুলিতে নিহত মুসার বউ বেগম আরিফা ও মেয়ে জেবিন। সেনা অফিসার আমরিক কাশ্মিরের কসাই। নির্বিচারে হত্যায় পারদর্শী। অন্ধ্র প্রদেশের বিপ্লবী কমরেড রিভাথি, আহলাম বাজি, ওস্তাদ হামিদ খান, ইমাম জিয়াউদ্দীন, কুলসুম বাঈ, জাকির মিয়া, বেগম জিনাত, বেগম রেনেটা, রোশান লাল, ঠিকাদার ডি ডি গুপ্ত, এসিপি পিংকি, বলবীর সিং, জেবিন দ্বিতীয়। বহু চরিত্রের সমাবেশ এই বারো তলা বাড়িতে।

খোয়াবগাঁ-নামী পুরানা দিল্লির এক হিজড়াপট্টি থেকে আঞ্জুম নিঃসঙ্গ এক কবরখানায় আশ্রয় নেওয়ার মাধ্যমে উপন্যাসের শুরু। জন্মসূত্রে সে উভলিঙ্গ। কিন্তু পরিবার তাকে ছেলে অফতাব হিসাবে বড় করে তুলতে চেয়েছিল। সে পরিবার ছেড়ে খোয়াবগাঁয়ে চলে আসে স্বেচ্ছায়। বয়ঃসন্ধির সময় নিজ সিদ্ধান্তে জেন্ডার রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে মেয়ে হয়ে যায়। ছেলে অফতাব মেয়ে আঞ্জুমে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ভারতের নাগরিক হয়ে ওঠাটা আফতাবের সেলফ সিলেকশন না। ভারত রাষ্ট্র ত‌াকে আফতাব করে তুলতে চায়। সে আঞ্জুম হয়ে উঠতে চায়, এটা তার চয়েস। কিন্তু রাষ্ট্র আর আদর্শ জ্বলে ওঠে আপন শক্তিতে। আঞ্জুম হয়ে ওঠার ক্ষণে, উপন্যাসের মধ্যে ঢুকে পরে আহমেদাবাদের দাঙ্গা। ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যর পর কত শিখদের জীবন্ত পোড়ানো হয়েছে তা কেউ হিসাব দিতে পারবে না। রাষ্ট্র মানুষের মৃত্যুর হিশাবের পবিবর্তে ভিন্নমতাবলম্বীদের লাশ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। হিশাব করবেই না কেন? পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হলে ভারতকে আরো বেশি হিন্দুরাষ্ট্র হতে হয়। ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হলে পাকিস্তানকে আরো বেশি মুসলিম রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হয়। আঞ্জুম একজন মুসলিম হয়েও হিন্দুর বেশ নিয়েই তাকে বেঁচে ফিরতে হয় দিল্লিতে, আহমেদাবাদের দাঙ্গা থেকে। মানুষকে নিজের পরিচয় লুকিয়ে বাঁচতে হয়। এরপর এই দাঙ্গা থেকে ফেরার পর আঞ্জুমের ভেতর এক পরিবর্তন আসে। সে খোয়াবগাঁ ছেড়ে গোরস্থানে আশ্রয় নেয়। সেখানে একটা রেস্ট হাউস খোলে সে। নাম দেয় ‘জান্নাত’। স্বপ্ন থেকে স্বর্গের দিকে যাত্রা। এই কবরখানাই আজকের হিন্দুস্থান, জান্নাত হলো ভবিষ্যৎ ভারতের স্বপ্ন। এই কবরস্থানের জান্নাতেই জাতি, ধর্ম, দলিত, বিপ্লবী সবার নির্বিশেষে শারীরিক বা প্রতীকী স্থান হয়। এই দুনিয়ায় মানুষের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন হলো আমাদের সিলেকশন। যখন দিল্লিতে দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন চলছে তখন আঞ্জুম সেখানে গিয়ে দেখে এই আন্দোলন সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণির আন্দোলন। হিজড়াদের স্থান নাই। এমন আরো অনেকের স্থান এখানে নেই। দেখা যায় ভূপালে রাসায়নিক হাওয়ায় যারা পুড়িয়ে ফেলেছে ফুসফুস, তাদেরও তেমন একটা প্রয়োজন নেই এই আন্দোলনে। মিডিয়া আন্দোলনের যে খণ্ডচিত্র বেচতে চায় সেভাবেই আন্দোলন নিজেকে সাজিয়ে নেয়। সেই আন্দোলন-মুখরিত দিনে মানমন্দিরের পাশে একটা শিশু পাওয়া যায়। পরে যে মিস জেবিন দ্য সেকেন্ড হিসাবে কবরস্থানে গড়ে ওঠা ‘জান্নাতে’ স্থান পায়। এই শিশুটা আসলে কমরেড, বিপ্লবী রিভাথির। সে রাষ্ট্রের ছয়জন পুলিশ দ্বারা ধর্ষিত হয়ে এই শিশুটিকে গর্ভে ধারণ করে। একজন শিশুর ছয়জন রাষ্ট্রীয় পিতা। এই হলো বাস্তবতা। এই হলো রাষ্ট্রের নিপীড়ন নিজ জনগণের প্রতি। সে শিশুটিকে ফেলে চলে যায় দিল্লিতে। এই শিশুটির সাথে গল্পে প্রবেশ করে তিলো, তিলোত্তমা। যার প্রেমিক কাশ্মির-বিচ্ছিন্নতাবাদী বিপ্লবী মুসা। যে মুসা ছাত্রজীবনে নামাজহীন, তাকেই বিপ্লবীর বেশে নামাজ পড়তে দেখা গেছে। মুসা হলো স্বাধীন কাশ্মিরের পক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহী। একদিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলারত অবস্থায় গুলিতে মুসার বউয়ের আর শিশুকন্যা জেবিনের মৃত্যু হয়। অসহায় বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে তিলো কাশ্মিরে চলে আসে মুসার কাছে। মুসাকে পুলিশ বহুদিন হলো খুঁজছে। সেনা অফিসার আমরিক সিংয়ের হাতে তিলো ধরা পড়ে। মুসা পালিয়ে যায়। তিলোকে সেনা নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করে ইউনিভার্সিটির বন্ধু বিপ্লব দাশগুপ্ত। ছাত্রজীবনে বিপ্লব তিলোর প্রতি দুর্বল ছিল। মুসাকে হারিয়ে তিলোর একটা অবলম্বন দরকার ছিল। এই স্ট্র্যাটেজিকেল অবলম্বন হলো সাংবাদিক নাগা। সে নাগাকে বিয়ে করে। বাঁচার জন্য মানুষকে ইচ্ছার বাইরেও যেতে হয়। সে মূলত নাগাকে অবলম্বন করে মুসার জন্য অপেক্ষা করে। নাগার সাথে সম্পর্ক শেষ হয় তিলোর। ডিভোর্স দিয়ে সে চলে আসে দিল্লি। আমরিক সিংয়ের একের পর এক হত্যা চলতেই থাকে। যুদ্ধ আর ব্যবসা এক, একাকার কাশ্মিরে। শান্তির জন্য যুদ্ধ, নাকি যুদ্ধের জন্য শান্তি। আমরিককেও পালাতে হয়। ব্যক্তিই রাষ্ট্রকে রক্ষা করে। কিন্তু এই রক্ষাকর্তা ব্যক্তিকেও রাষ্ট্র ছুড়ে ফেলে দিতে পারে। আমরিক সিংকেও জীবনের কোনো এক মুহূর্তে আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়। ভারত রাষ্ট্র তার নিজের প্রয়োজনে তাকে বাদ দেয় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাঝ থেকে। মুসাও আমেরিকায় যায়। যে তার কন্যা ও স্ত্রীকে হত্যা করেছে, পক্ষ-বিপক্ষের বহু লোক হত্যা করেছে—তাকে তো একজন বিপ্লবীর সাহায্যে তার কাছে পৌঁছানো দরকার। তার মগজের ভেতর পিতলের বীজ বুনে দেয়ার কথা। মুসার তো তাকে হত্যা করতে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তাই না? সে আমরিক সিংকে খুঁজে বের করে। তাকে বলে তার কোনো ক্ষতি সে করতে চায় না। শুধু তাকে মনে করিয়ে দিতে চায় সে কী করেছে তার এক জীবনে, সভ্যতার বিরুদ্ধে। সে যেন শুধু ভুলে না যায় এই হত্যার ইতিহাস। এটাই আমরিককে সেলফ-ডেস্ট্রাকটিভ করে তোলে। আমরিক আত্মহত্যা করেছিল এরপর। মুসার ভাষায় আরও বলেছে ‘one day Kashmir will make India self destructive in the same way’, রাষ্ট্র যেন ভুলে না যায় সে কী করেছিল নিজ দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে। ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার জ্ঞান তার যেন থাকে। বিপ্লবী মানেই লাল খুন না শুধু; বিপ্লব মানে বিশ্বাস, সহযোগিতা আর প্রভাবিত করা সময়কে। মুসা সেই বিপ্লবী যার অস্ত্র শুধু বন্দুক না। অতীতকে মুছে ফেলা কিছুতেই সম্ভব নয়, অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। শুধু যেন আমরা সেই ইতিহাসটা ভুলে না যাই। বিল্পবী এই ইতিহাসের শিক্ষা নিয়েই আগায়, নির্মাণ করে নতুন দেশের স্বপ্ন। মুসা মূলত আমরিককে সেলফ-ডিস্ট্রাকশনে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাকে অন্তত উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছে আসলে সে কী করেছে। আর তিলো কমরেড রিভাথির কুড়িয়ে পাওয়া সন্তানের যোগসূত্রে স্থান পায় আঞ্জুমের জান্নাতে। সেই সূত্রে মুসাকেও দেখা যায় আঞ্জুমের কবরখানার জান্নাতে। সমগ্র ভারতের নিপীড়িত জনগণের জন্য কবরখানায় গড়ে ওঠা জান্নাত। এমন ছোট ছোট আরো অনেক গল্প আছে। শুধু ভারতের গল্প মনে হয় না, মনে হয় পৃথিবীর নিপীড়ক সকল রাষ্ট্রের ছবি যেন দেখতে বসেছি এখানে। পড়তে পড়তে নিজের মানচিত্রটাও ঢুকে যেতে পারে। রাষ্ট্র, মতাদর্শ, দেশপ্রেম, উন্নয়ন, শান্তি, বিচারের নামে মানুষের চেয়ে রাষ্ট্র বড় হয়ে ওঠে। দুনিয়াটাকে গোরস্থান বানিয়ে ফেলেছি আমরা, এটা যেন আমরা ভুলে না যাই। এই ভুলে না যাওয়া থেকেই জন্ম নিবে গোরস্থানে জান্নাত। গল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেবে বারবার, সভ্যতার নামে কোন কবরস্থান বানিয়ে রেখেছি এই দুনিয়া।

জাতীয়তাবাদী ইস্যুতে শুধু ভারতের নাম নিলে তা একপেশে বিচার হয়ে যাবে। বিষয়টা শুধু ভারতের না। ভারত হলো এই উপন্যাসের একটা দেশ যা সকল দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর যেখানেই ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যার উপর রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে সেখানেই আপনি দেখতে পাবেন ডিভাইড অ্যান্ড রুলিং, রাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্রের নাগরিককে গণঅত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ। সরকারি সকল নথি থেকে খুব পরিকল্পিতভাবে আস্তে আস্তে তার নাগরিকদেরকে মুছে ফেলা হয়। চীনের উইঘুর বা তিব্বত, পাকিস্তানের বেলুচ, ভারতের কাশ্মির, মায়ানমারের আরাকান, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, বিরোধীদল দমন, শ্রীলঙ্কায় উকুনের মতো মানুষ হত্যার ইতিহাস—এ সমস্ত অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই অঞ্চলে জাতিগত ঘৃণার ফলাফল কত ভয়াবহ তার উদাহরণ ১৯৪৭, ১৯৭১। ভারত বনাম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান বনাম পশ্চিম পাকিস্তান। ইতিহাসের এই শিক্ষার পরও কোন আশায় রাষ্ট্রগুলো হত্যার পর হত্যা করে যাচ্ছে আমাদের।

মানবসভ্যতা যদি বিলীন হয়ে যায় এবং এরপর একদল এলিয়েন যদি এই দুনিয়ায় আসে আর যদি বুঝতে চায় মানবজাতি কেমন ছিল তবে তাদের হাতে গ্যেটের ফাউস্ট দেওয়া যেতে পারে। ভিনগ্রহের এলিয়েন এই পুস্তক থেকে মানবচরিত্র ডিকোড করতে পারবে। আর অরুন্ধতীর The Ministry of Utmost Happiness পড়ে যে কেউ ডিকোড করতে পারবে ভারত নামক রাষ্ট্রটি কী ও কেমন। ফাউস্ট পড়ে মানবসভ্যতা বিলীন হবার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু পরমানন্দের মন্ত্রাণলায় পড়ে জানা যাবে কেন ভারত বিলীন হয়ে যেতে পারে, কাঁচের বাসনের মতো ঝনঝন শব্দে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে পারে এদিক সেদিক। শুধু ভারত না, যেকোনো রাষ্ট্র বোঝার জন্য এই বই সংরক্ষণ করা যেতে পারে। পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের রাষ্ট্রচিন্তকদের হাঁ-মুখের মধ্যে কতগুলো হাঙ্গরের দাঁত আছে তা গুনে দেখতে পারে এই বইয়ের মাধ্যমে।

এই উপন্যাস দক্ষিণ এশিয়ার ভারত বাদে অন্য কোনো দেশে প্রকাশিত হলে তা ব্যান হতো। ধরুন এই বইয়ের লেখক কোনো চাইনিজ বা বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি বা সিঙ্গাপুরি। ভাবা যায় কী-ই না হতে পারত রাষ্ট্রের তরফ থেকে তার বিরুদ্ধে! ভাবা যায় দিল্লির মসনদে ভারমিলিয়ন রেড পাগড়ি পরা লাল্লা মোদী জি ও তার খোলা তারোয়াল, যোগাসন! তিনি ও তার অনুসারীরা যখন ভাবছেন মোঘল আমলের পর এই প্রথম ভারত স্বাধীন হলো। যে হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন ও চিন্তা বঙ্কিম আনন্দমঠ-এ করেছেন, সেই স্বপ্নের স্বরাজ কায়েম হলো। ভারত মানেই হলো হিন্দুত্ববাদ। এমন একটা সময়ে এই বই প্রকাশিত হলো! ভাবা যায়! কতটা উদারচেতা এই ভারত, ভারতের গণতন্ত্রের ওপেননেস। ভারতের লোহার বাসরঘরের ফুঁটো হলো এই উদারতা। এই উদারতার হাত ধরেই বিজেপি দিল্লির অধিপতি আজ। মানব-রক্ষার থেকে গরু-রক্ষার গুরুত্ব বোঝার মতো উদারতা কয়টা রাষ্ট্রপ্রধানের থাকে, বলুন! উদারতাই ভারত গণতন্ত্রের বেহুলার বাসর। এই উদারতার নাম করেই কাশ্মির আজও জ্বলছে। রাষ্ট্রের নাম নিয়ে চালানো হচ্ছে এ যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধু অপর রাষ্ট্রের বিপক্ষে না, নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধেও। এই উদারতার নাম ধরেই কর্পোরেটের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে একরের পর একর জমি, এর নাম উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি। এই উদারতার নাম করেই মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই উদারতার নাম করেই আমি যেহেতু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেহেতু মুসলিম/দলিত-নিধনের কিছু অধিকার রাখি। এই উদারতার নাম করেই ভারত হজম করে The Ministry of Utmost Happiness। তেমন সমস্যা হয় না। এই উদারতার নাম করেই রাষ্ট্র যা ছিল এবং যা আছে, ঠিক সেইভাবেই চালানো যায় বছরের পর বছর। এমনভাবে ভারতের রাজনীতির সংকট ও তার উত্তরণ নিয়ে অরুন্ধতী রায়ের মতো ১৩৫ বছরে আর কেউ সামগ্রিকভাবে উপন্যাস লেখে নি। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধির ব্যাপক প্রভাব আছে ভারতীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায়। আনন্দমঠের পর এটিই দ্বিতীয় ভারতীয় জীবন্ত রাজনৈতিক উপন্যাস যা ভারতের সংবিধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রকাঠামোকে পরিবর্তনের অনেক সূচক দিতে পারে। এমন উপন্যাস পৃথিবীতে কয়টা আছে, বলুন?

The Ministry of Utmost Happiness প্রকাশের ভেতর দিয়ে জাতীয়তাবাদের মৃত্যু ঘোষিত হয়েছে।
শুধু ভারত না, উদার গণতান্ত্রিক যেকোনো দেশের স্বরূপ, সমস্যা ও সমাধান এই বই। ভারত হলো এই বইয়ের অনুসঙ্গ। জাতীয়তাবাদী চরম দেশপ্রেমী ধারণার উপর জন্ম নেওয়া সমস্ত দেশেরই চরিত্র একই। ঈশ্বরের নামে যেমন পশু বলি দেওয়া যায় তেমনি রাষ্ট্র নামক দেবীর নামে ক্রসফায়ার, গুম, খুন, ধর্ষণ, নিপীড়নকে আইন সন্মত হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়।এইটাই আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সমস্যা। উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর জাতীয়তাবাদী চিন্তার মূল হলো ভক্তিমূলক দেশপ্রেম নামক দেবী-চেতনা। এই অতিদেশ চেতনাই সমস্যাগুলোর কারণ এবং যা ঘটছে তা হলো এর ফলাফল। এবং এ থেকে উত্তরণের জন্য আমারা যা করতে পারি তার নির্দেশনাই পরমানন্দের মন্ত্রণালয়।

আনন্দমঠ উগ্র, হৃদয়হীন জাতীয়তাবাদের গল্প। এই গল্পে এক বিপুল জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ছিল। এই অলীক গল্পের বিশ্বাস তিনটা দেশের জন্ম দিয়েছে, যা ছিল অবধারিত। এই তৈরিকৃত ফিকশনের কারণে মানুষ মরেছে কত-শত। মানুষের রক্তে ধুয়ে গিয়েছে ইতিহাসের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। ফলে, রাজনৈতিক শোষকরা মানুষকে ঘৃণা শিখিয়েছে। শত্রুতা আর অবিশ্বাস দিয়েই শুরু হয়েছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ। এই ঘৃণার বীজ কোথায়? শুধু খুঁজে পেলেই হবে না। এই ঘৃণাকে নতুন ভালোবাসার গল্প দিয়ে রিপ্লেস করতে হবে। মানুষ গল্প পছন্দ করে। জাতি-ঘৃৃণার ঊর্ধ্বে উঠে নতুন গল্প বলতে হবে। ভারতের জাতীয় সংগীতে ভাগ্যবিধাতা আছে। সেই বিধাতা মানুষ না, বিমূর্ত অলীক কিছু। ‘আমার সোনার বাংলা’য় মায়ের মলিন মুখ আছে। এই মা কে? এই মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের জাতীয়তাবাদী মাতৃস্বরূপা দেশ নামক ধারণা দিয়ে রাষ্ট্রের নামে হত্যা, গুম, ধর্ষণ আইন-সম্মতভাবে চলছে। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের চরিত্রই এই। দেশ থেকে মানুষ বড়, প্রকৃতি বড়, সমস্ত প্রাণ ও জড় বড়। প্রাণ ও জড়কে সংরক্ষণ করতে হবে আমাদের। কিন্তু এই দেশের মাতৃরূপ, দেবীরূপ থেকে বের হবার গল্পটা ছিল না আমাদের এতদিন। অরুন্ধতীর The Ministry of Utmost Happiness হলো সেই ফিকশন যা আমাদেরকে আনন্দমঠ উৎসারিত উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নতুন গল্প দেয়। ১৩৫ বছর খুব বড় সময়। এখনো রক্ত ঝরছে ইতিহাস-গল্পগ্রন্থের পাতা থেকে।

উপন্যাসের শুরুতে আঞ্জুম যে গোরস্থানে আশ্রয় নিয়েছিল তার ফ্রি উইল, উইট চয়েজ। এই কবরখানা হলো বর্তমানের এই জাতীয়তাবাদী প্রতীকী রাষ্ট্র। সেই কবরখানাতেই সে তৈরি করল জান্নাত গেস্ট হাউস। পথের উদ্বাস্তু পশু থেকে মানুষ ও তার মত যেন স্থান পেল এখানে। পরমানন্দের মন্ত্রণালয় জন্ম নিল কবরখানার, মানুষের তৈরিকৃত জান্নাতে। এই গল্প থেকেই শুরু হতে পারে নতুন প্রাণ ও জড়ের দেশের ধারণা।

নিৎসে যেদিন পাগলা-গারদে গেল সেইদিন উত্তরাধুনিকতার জন্ম হলো। বিষয় হলো তারপরও আধুনিকতা চলছেই। তেমনি ২০১৭ সালে The Ministry of Utmost Happiness প্রকাশের ভেতর দিয়ে জাতীয়তাবাদের মৃত্যু ঘোষিত হয়েছে। এর মানে এই না, এখনই বিরাষ্ট্রীয় মানুষ-প্রধান রাষ্ট্র গড়ে উঠবে দেশে দেশে। আনন্দমঠ-এর পর পরমানন্দের মন্ত্রণালয় লিখিত হতে ভারতমাতাকে ১৩৫ বছর ধরে অরুন্ধতী রায়কে জরায়ুতে ধারণ করতে হয়েছে। বঙ্কিমের মতোই গুরুত্বপূর্ণ অথর তিনি। বঙ্কিম যেমন ভারতকে রাষ্ট্রচিন্তার প্রথম অস্ত্রটি দিয়েছেন, অরুন্ধতীও ভারত তথা সমগ্র দুনিয়াকে মানুষের পৃথিবী গড়ার গল্পটা মাত্র দিলেন। এই স্টেট ম্যানুয়ালের ব্যবহারিক বিধির প্রয়োগের কাজটা আমাদের।


Profile of the Author:
 
মৃদুল মাহবুব
জন্ম ৯ অ‌ক্টোবর ১৯৮৪। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করেন একটি বহুজা‌তিক কোম্পা‌নিতে।

প্রকাশিত বই :
কবিতা—
জল‌প্রিজমের গান [কবিয়াল, কলকাতা ২০১০]
কা‌ছিমের গ্রাম [চৈতন্য, ঢাকা ২০১৫]
উনমানুষের ভাষা [চৈতন্য, ঢাকা ২০১৭]

26
একান্ত আলাপে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন তরুণ লেখক কে এম রাকিব।



কে এম রাকিব
আপনি নিজেও একজন কবি। আপনাদের সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত বাংলা কবিতার ক্রমপরিবর্তনকে কিভাবে দেখেন?

সলিমুল্লাহ খান
এখনকার কবিতার সাথে আমার বেশি পরিচয় নাই। কাজেই প্রথমে এই দোষটা স্বীকার করা ভালো। কিন্তু মাঝেমধ্যে যা দেখি—যেমন [সোহেল হাসান] গালিবের কবিতা আমি দেখি—তাতে মনে হয় এখনকার কবিদের মধ্যেও অনেক নতুন প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব হয়েছে। দুঃখের মধ্যে তাঁদের সাথে আমার পরিচয় নাই। তাই এখনকার কবিদের সম্পর্কে কিছু কথার মতো কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি যখন অনিয়মিতভাবেই দেখি, [কিছু অনিয়মিত কথা হয়তো বলা যায়]।
আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম সত্তরের দশকে। আমাদের সময়ে বা একটু আগে যাঁরা কবিতায় নামধাম করেছেন তাঁদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন [অন্যান্যের মধ্যে] নির্মলেন্দু গুণ আর আবুল হাসান। মানে এঁদের তখন ভরাযৌবন। আমরা তখন মাত্র ছাত্র।

কে এম রাকিব
শামসুর রাহমান কি ততদিনে কবিখ্যাতি পেয়েছিলেন?

সলিমুল্লাহ খান
শামসুর রাহমান তো আরও আগের দিনের মানুষ। তাঁর প্রথম কবিতা উনিশশো পঞ্চাশের দশকে—হতে পারে আরো আগেই—বেরিয়েছিল। শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৯ সনে। তার মানে ভাষা-আন্দোলনের সময় তাঁর বয়স ২২-২৩ বছর। আর শামসুর রাহমান তখনই কবিতা প্রকাশ করা শুরু করেছেন।

কে এম রাকিব
আল মাহমুদ কি আরও পরে করেছেন নাকি সমসাময়িক?

সলিমুল্লাহ খান
যতটুকু খবর রাখি, বয়সে আল মাহমুদ শামসুর রাহমানের চেয়ে খানিক ছোটই হবেন। ধরেন, আল মাহমুদের জন্ম—আমি যদি ভুল না করে থাকি—ইংরেজি ১৯৩৬ সাল। সৈয়দ শামসুল হকের জন্মসালও তাই হবে হয়তো। কথাটাকে বাংলায় এইভাবে বললে আরো ভালো হয়, ইংরেজি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর, ঢাকায় নতুন কবিতার আন্দোলন—তাকে সমাবেশও বলতে পারেন—শুরু হয়।
ঢাকা তখন একটা মফস্বল শহর। তার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, আপনি জানেন, ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন। ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৫৩ সালে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামের একটা সংকলন বের করেন হাসান হাফিজুর রহমান। তিনিও তখন বয়সে বেশ তরুণ। ওখানে ছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আলাউদ্দিন আল আজাদ ওখানে ছিলেন কিনা মনে করতে পারছি না। থাকার কথা। তবে ঐ সংকলনে যাঁদের কবিতা তখন ছাপা হয়েছিল তাঁদের বয়স তখন ১৮ থেকে ২১ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ওঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ ছিলেন। শামসুর রাহমানও ছিলেন আশপাশেই। অর্থাৎ ওঁদের আমরা ‘পঞ্চাশের দশকের’ কবি বলে থাকি, বলতে পারি।
ষাটের দশকে ভিন্ন একদল কবি বেরিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ ইতি আদি। মানে কবিতার প্রথম প্রকাশের দিক থেকে বলছি। নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছিল ১৯৭০ সালের শেষে। ঐ যে বিখ্যাত বই…

কে এম রাকিব
প্রেমাংশুর রক্ত চাই।

আমার নিজের প্রথম কবিতার বই—এক আকাশের স্বপ্ন—বের হয় ১৯৮১ সালে ।
সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ। সেটা ১৯৭০ সালের শেষদিকে বেরিয়েছিল। ১৯৭১ সালের পর যে নতুন কবির দল বেরিয়েছেন তাঁদের মধ্যে নাম করেছিলেন [দাউদ হায়দার ইত্যাদি]। নাম মনে আছে এমন কবিদের মধ্যে আছেন আবুল হাসান। আরও অনেক কবি এসেছেন, সবার নাম বলার হয়তো প্রয়োজন নাই। আমরা এসেছি ১৯৭৫ সালের পরে, ঢাকায়। আমাদের সাথে উল্লেখযোগ্য কবি যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে মোহন রায়হান, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কথা মনে পড়ে। এঁদের বই ১৯৭৯ সালে বের হয়। এজন্যে এঁদের ‘সত্তর দশকের’ কবি বলি। আমার নিজের প্রথম কবিতার বই—এক আকাশের স্বপ্ন—বের হয় ১৯৮১ সালে।

কে এম রাকিব
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের বক্তৃতার উপরে আপনার বইটা বের হয় কখন? কবিতার বইটা প্রকাশের আগে না পরে?

সলিমুল্লাহ খান
না, না। কবিতার বইটা ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলায় বের হয়। তখন বইমেলা ছোট আকারে হতো, বাংলা একাডেমিতে। আর রাজ্জাক সাহেব বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন ১৯৮১ সালের মে মাসে। মানে আরও চার মাস পরে। তো সেই বক্তৃতার আমি রিভিউ লিখেছি। সেটি বের হয়েছে ১৯৮৩ সালে।

কে এম রাকিব
এই বইটাই সম্ভবত লেখক হিসেবে আপনাকে পরিচিতি দেয় প্রথম…

সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ, কথাটা অসত্য নয়, আমার কবিতার বইটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই। এটাতে আমার কোনো লজ্জা নাই।

কে এম রাকিব
স্বাভাবিক…

সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ, স্বাভাবিক। লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই, কিন্তু প্রত্যেক মানুষ নিজের সাধ্য অনুসারেই করে। তো, আমি গদ্যপদ্য দুটোই লেখা শুরু করেছি ঢাকায় এসে, বই প্রকাশের আগে আমার বহু গদ্যপদ্য, আলাদা পদ্য, আলাদা প্রবন্ধ বেরিয়েছে। রাজ্জাক সাহেবের বক্তৃতার পর আমি যে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি—আমাদের দেশে দীর্ঘ প্রবন্ধের চল তেমন নাই—সেটা আমাকে বই আকারেই প্রকাশ করতে হয়েছে। প্রথম প্রকাশের সময় পাতার সংখ্যা ছিল ১০৪ অর্থাৎ আজকালকার যা ঢিলাঢালা ছাপা তাতে দেড়শ পৃষ্ঠার মতো হবে। সেই বইটি, হ্যাঁ, দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। করার দুটো কারণ। [একটা কারণ সম্ভবত এই যে] তখন রাজনৈতিক প্রবন্ধের বিশেষ চল ছিল না। দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক কিছুই লিখতেন না সাধারণত, ঐটাই তাঁর প্রথম বই। সেটার সমালোচনা অন্যরা—বুদ্ধিমানরা—না করলেও আমি বোকা ছিলাম বলে করেছিলাম। সমালোচনার মধ্যে দুইটা ভাগ ছিল…।

কে এম রাকিব
এইটা কেন বলছেন? বুদ্ধিমানরা না করলেও…

সলিমুল্লাহ খান
আবদুর রাজ্জাকের মতো মহান জ্ঞানীর সমালোচনা করার মতো বিদ্যা তখন আমার ছিল না। কাজেই পাগলেরা অনেক সময় যেটা করে, শিশুরাও তেমনই করে। সে রকম আর কি। অর্থাৎ তাঁর সাথে আমার তুলনার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেটা সঠিক ছিল..। আমি ঐ ঘটনার পরে—আরও ৪০ বছরের মাথায় বলছি, সত্য বলতে ৩৫ বছর পরে আর কি—বলছি যে কোনো রকমের পাল্টা সমালোচনা কেউ বের করেনি, করতে পারেনি। তাঁর ভক্তের সংখ্যা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিই ছিল, নিতান্ত কম ছিল না। সেই সময় আমাকে পছন্দ করেন নাই অনেকেই…।

কে এম রাকিব
আপনার সেই লেখার আর্গুমেন্টকে কেউ রিফিউট করেছিল তখন?

সলিমুল্লাহ খান
না। কিন্তু মৌখিকভাবে অনেকেই রিফিউট করেছিল, যেমন সরদার ফজলুল করিম।

কে এম রাকিব
তার রিফিউটেশনের জায়গাটা কী ছিল?

সলিমুল্লাহ খান
সবাই। যেমন আহমদ ছফা এই জায়গা থেকে পছন্দ করেন নাই, তিনি বলেছিলেন, তুমি একজন প্রবীণ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে লিখে নিজেকে অজনপ্রিয় করে তুললা।

কে এম রাকিব
এখানে তো নবীন-প্রবীণ কম্পিটিশনের ব্যাপার হওয়ার কথা না, আলাপটা…

সলিমুল্লাহ খান
হওয়ার কথা না, আমার যতটুকু মনে আছে [তার কথাই] বলছি আর কি। যা হোক। আমার দুই-একজন সমবয়সী বন্ধু পত্রিকায় সদয় রিভিউ-টিভিউ লিখে থাকতে পারে, সেগুলি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই। এইটাই আর কি।

কে এম রাকিব
আমরা মনে হয় কবিতা নিয়া আলাপ থেকে দূরে সরে গেছি।

সলিমুল্লাহ খান
আমি বলছিলাম আমার প্রথম বই কবিতার বই… এটা বলার জন্যই। যা হোক, সেটা আমার প্রবন্ধের যে বই তার দুবছর আগে বের হয়। মাঝে মাঝে কবিতা লিখেছি বটে কিন্তু পরে কবিতার বই প্রকাশের আর অবকাশ হয় নাই। অনেক পরে ১৯৯৮ সালে আরেকটা বই বের করেছিলাম।

যাঁর বই আমি অনুবাদ করেছি তিনি জার্মানির কবি হলেও জার্মান কবিরা তাঁকে অত বেশি চিনতেন না।
কে এম রাকিব
সেটা তো অনূদিত কবিতার বই।

সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ, সেটা আবার মূল বই না। অনুবাদের বই।

কে এম রাকিব
আল্লার বাদশাহি?

সলিমুল্লাহ খান
হ্যা, নাম রেখেছিলাম ‘আল্লাহর বাদশাহি’। এবং যাঁর বই আমি অনুবাদ করেছি তিনি জার্মানির কবি হলেও জার্মান কবিরা তাঁকে অত বেশি চিনতেন না। কারণ, জার্মানদেশে আমরা যাকে বলি ‘মেইনস্ট্রিম’, তার বাইরে ছিলেন তিনি। তবে তিনি খুব উচ্চশিক্ষিতা মহিলা। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল [ধর্মতত্ত্ব, তবে] তিনি ছিলেন একটু, যাকে বলা হয় ‘বামঘেঁষা’…। জার্মানিতে তখন ডানপন্থা খুব প্রবল ছিল, পশ্চিম জার্মানিতেই তিনি [কায়েম-মোকাম ছিলেন]। বসবাস করতেন হামবুর্গে। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ভিয়েতনাম-যুদ্ধ-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। খ্রিস্টধর্মের নিরিখে ল্যাতিন আমেরিকার পরিপ্রেক্ষিত থেকে বলছি—যাকে বলা হয় ‘লিবারেশন থিয়োলজি’, ঐ গ্রুপের লোক তিনি। ধার্মিক হলেও তিনি ছিলেন প্রগতিশীল এবং সমাজতান্ত্রিক [ভাবধারার পক্ষপাতী]।

কে এম রাকিব
ভাসানী বা এইরকম সমাজতান্ত্রিক ধারার কাছাকাছি বলতে পারি?

সলিমুল্লাহ খান
না, ভাসানী ছিলেন রাজনীতিবিদ। উনি ছিলেন কবি।

কে এম রাকিব
আদর্শের জায়গাটা বামপন্থা।

সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ। মেইনস্ট্রিম [কোনো প্রকাশনা সংস্থা] থেকে তিনি তাঁর কবিতা বের করেন নাই। বই করেছেন কতগুলো অপ্রধান জায়গা থেকে। তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয় মার্কিনদেশে থাকার সময়। তারপরে, এই পরিচয়সূত্রে, ১৯৯৫ সনের দিকে আমি তাঁর কবিতার সাথে পরিচিত হই। তাঁর বই অনুবাদ করতে আমার দুই-তিন বছর লেগেছে। তাঁর অনুমতি নিয়েই আমি ওই বইটা প্রকাশের ব্যবস্থা করি। তাঁর একটা ইন্টারভিউ আমি নিয়েছিলাম, সেটি এখানকার একটি পত্রিকায় বেরও হয়েছিল। [পত্রিকাটার নাম খুব সম্ভব “মানব জমিন”। ঐ পত্রিকায় রাজু আলাউদ্দিন তখন চাকরি করতেন। মনে হয় তিনিই ওই ইন্টারভিউটা ছেপেছিলেন। ইন্টারভিউটি হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে আমার খুব একটা ভালো লাগছে না। বইটায় বেশ ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। দেখা গেল রাজু আলাউদ্দিন, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, এবং আরও কয়েকজন—ঢাকার ৪-৫ জন কবি—সমালোচনা বা (আমি বলব) বেশ প্রশংসাই করেছিলেন। তখন বোঝা গেল কবি হিসাবে [আমি হয়তো পুরাপুরি] মারা যাই নাই। এই আর কি! তারপরে ঐ বইটার ২য় সংস্করণ বের হয়েছিল অনেক দিন পরে, ‘আল্লাহর বাদশাহি: ডরোথি জুল্লের নির্বাচিত কবিতা’ নামে।

কে এম রাকিব
প্রথমেও কি ‘আল্লার বাদশাহি’ নামে ছাপা হয়েছিল?

সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ। আমি নাম বদল করিনি। ২য় সংস্করণটা প্রকাশনার দিক দিয়ে অনেক বেশি শোভন হয়েছিল। এইটাই আমার মনের মতো একটা বই হয়েছে। কবিতার সাথে সম্পর্ক আমার আপাতত এই দুই বইয়েই সীমাবদ্ধ। আরেকটা সম্পর্ক আছে কবিতার সাথে আমার। প্রত্যেকটা বইয়ের উৎসর্গপত্রে আমি কবিতা লিখেছি। সে রকম লিখতে লিখতে আমার অনেক কবিতা জমেছে। সেগুলো দিয়ে কোন কবিতার বই করি নাই। ভবিষ্যতে হয়তো কখনও করব। এই হচ্ছে কবিতার সাথে আমার সম্পর্ক। আমার প্রধান পেশা [বা ব্যবসায়] কবিতা নয়। তাই বলে কবিতা আমি ত্যাগ করেছি এমনও নয়।

কে এম রাকিব
এই সময়ে যারা কবিতা লিখছেন তাদের কবিতার সাথে কি যোগাযোগ…

সলিমুল্লাহ খান
পড়ি। অনেকের কবিতা পড়েছি। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত পড়তাম। [সুব্রত অগাস্টিন] গোমেজের কবিতার প্রশংসা করেছি। আমি যাঁদের পছন্দ করি তারা একটু ভিন্ন ঘরানার কবি। আর পছন্দ করি শুধু কবিতার কারণে নয়, আরও কারণে, অন্য কারণেও পছন্দ করি। আমার বিচারে [কবিতাকে তো] প্রথমত কবিতা হতে হবে, তারপরে অন্য বিষয় আসবে। যেমন, [মতিন বৈরাগী] আমার চেয়ে বয়সে হয়তো গোটা দশ বছরের বড় হবেন, কবি হিসেবে তিনি খুব ভালো নন, কিন্তু কবিতার সাথে পঞ্চাশ বছর লেগে আছেন, এটা একটা শ্রদ্ধেয় বিষয়। অন্তত একটি কবিতা ভালো লিখেছেন তিনি। আমি মনে করি জীবনে অন্তত একটি কবিতা যে ভালো লিখেছে সেও কবি। এমনকি নবি-পয়গম্বররাও চব্বিশ ঘণ্টা ওহি লাভ করেন না। মাঝে মাঝে তারা ওহি পান। যারা সাধারণত খারাপ কবিতা লেখেন, তাঁরাও মাঝেমধ্যে দুই-একটা ভালো কবিতা লেখেন। মতিন বৈরাগীর কবিতা—সত্যি বলতে কি—আমি প্রথমে পছন্দ করতাম না। কিন্তু [অনেকদিন পর] হঠাৎ ‘সক্রেটিস’ বলে তাঁর একটা কবিতা পড়লাম । এইটা আমার ভালো লাগল।

কে এম রাকিব
সক্রেটিস?

সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ। এইটা আমার ভালো লাগল। আমি লিখেছিও। অনেক লম্বা কবিতাটা, প্রায় আট পৃষ্ঠা।

কে এম রাকিব
তাহলে তো দীর্ঘকবিতা।

সলিমুল্লাহ খান
এইটা নিয়ে আমি লিখেছি । যদি আপনি সত্যি কৌতূহলী হন তাহলে এটা পাবেন [আমার পরের বইয়ে], [অদূর ভবিষ্যতে] আমার একটা বই বেরোচ্ছে, আমি এখন ওটার সম্পাদনাকর্ম করছি। [বইটা শিগগির]—ধরেন এই বছর—বের হবে আশা করছি।

কে এম রাকিব
নামটা ঠিক হয়েছে?

সলিমুল্লাহ খান
এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। [নাম মাসে মাসে] বদলে যায় কিনা! নাম তো সবসময়ই একটা প্রজেক্ট আকারে থাকে। এইটার নাম দিয়েছি ‘সাহেব বিবি গোলাম’। এটা হলো এখনকার কবি এবং লেখকদের যে সকল কাব্য বা গদ্য-বইয়ের সমালোচনা আমি করেছি সেগুলির একটা সংগ্রহ। প্রায় পঞ্চাশটির মতো লেখা নিয়ে [এই সংগ্রহশালা]।

কে এম রাকিব
বইটা করছে কারা?

সলিমুল্লাহ খান
প্রকাশক ঠিক হয় নাই। কিন্তু আমি আগে তো সম্পাদনা করে দেব। এখন পর্যন্ত সাতচল্লিশটা লেখা আছে। আরও লেখা নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমি কারও বইয়ের প্রশংসাপত্র লিখে দিয়েছি, কারও ভূমিকা বা রিভিউ করেছি। সেগুলিই একত্রিত করলেও এরকম একটা বই হয়। তরুণ কবিসহ অনেকের সম্পর্কেই আমি লিখেছি। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ সম্পর্কেও চারটা লেখা লিখেছি। বলে রাখা ভালো তারেক মাসুদও একসময় কবিতা বা ছড়া লিখতেন।

কে এম রাকিব
লেখাটা কি কবি তারেক মাসুদের উপরে না ফিল্মনির্মাতা তারেক মাসুদের উপরে?

সলিমুল্লাহ খান
চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদকে নিয়েই মূলত, একটু স্মৃতিকথার ধরনে। তারেক মাসুদ ঢাকায় এসে প্রথম ছড়া লিখতেন। আমার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ছিলেন মোহন রায়হান আর, তারেক মাসুদ। আমার অন্যান্য বন্ধু যারা ছিলেন, [যেমন আওলাদ হোসেন তালুকদার, ইনি এখন ময়মনসিংহে আছেন], যেমন কামাল চৌধুরী [উঁচুদরের সরকারি চাকুরে, সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন]… এঁদের সাথে এখন আর আমার যোগাযোগ নেই। মতামতের দিক থেকে আমরা অনেক ভিন্নমতের লোক, কিন্তু বড় মারামারি হয় নাই (হাসি)।

ঘটনাচক্রে দুনিয়াতে যাঁরা আমার চোখে ভালো কবি অথচ ভালো বলে সাধুসমাজে খুব বেশি পরিচিত নন তাঁদের ভালো বলতে আমার সংকোচ হয় না।
কে এম রাকিব
আজফার হোসেন, নুরুল কবির এরাও কি আপনার বন্ধুস্থানীয়?

সলিমুল্লাহ খান
আজফার হোসেন, নূরুল কবীর এঁরা বয়সে আমার চেয়ে সামান্য ছোট হবেন। আমারও তো বয়েস হয়ে গেছে—বৃদ্ধ হয়ে গেছি। হায়, আমার বয়স এখন ষাট। এঁরা ষাট ছুঁই ছুঁই। যা হোক, এই হচ্ছে কবিতার সাথে আমার সম্পর্ক। আমি এখনো কবিতা পড়ি। আমি অনেক বিদেশি কবিতার অনুবাদ করেছি, যেগুলো প্রকাশিত হয় নাই। যেমন ফিনল্যান্ডের একজন কবি, পেন্টি সারিকোস্কি [Pentti Saarikoski] তাঁর নাম। আমি ১৯৯১ সালে তাঁর কিছু কবিতার অনুবাদ করেছিলাম। এখনও একটা পাণ্ডুলিপি কোথাও আছে, হয়তো কোনোদিন বেরোবে।
আমি আরও একজন কবির কবিতা পছন্দ করি। তাঁর নাম কাদিয়া মলোদোভস্কি। ইনি পূর্ব ইয়োরোপের কবি। তারঁ মাতৃভাষা ইদ্দিশ, জার্মানির তথা পূর্ব এয়ুরোপের (আশকেনাজি) এয়াহুদি জাতির ভাষা। ওইসব ভাষা খুব একটা জানি না বিধায় ইংরেজি তর্জমা থেকে তর্জমা করি। তাই প্রকাশনার ক্ষেত্রে একধরনের সংকোচ কাজ করে আমার।
আমি সচরাচর মূল ভাষা দেখে তর্জমা সংশোধন করারও চেষ্টা করি। ওই যে ফিনিশ ভাষা জানতাম না, এইজন্যে ফিনিশ ভাষাও শেখার চেষ্টা করেছি কিছুদিন। খুব সফল হইনি। সম্প্রতি ইদ্দিশ শেখার চেষ্টা করছি। ইদ্দিশ জার্মান ভাষার একটা উপভাষা। লেখা হয় হিব্রু হরফে। তো আমি সম্প্রতি হিব্রু হরফ পড়াটা অল্প অল্প শিখছি। হিব্রু এখন ইসরাইলের ভাষা। কিন্তু হিব্রু যে হরফে লেখা হয় সে হরফে লেখা হলেও ইদ্দিশের ব্যাকরণটা কিন্তু জার্মান ভাষার ব্যাকরণের মতো। স্পোকেন জার্মানের মতো—এইটা বললেই বরং ভালো হয়।
যা হোক, আমি যে কবিকে চিনি কাদিয়া মলোদোভস্কি, ওঁর সাথে আমার কদাচ দেখা হয় নাই। ইনি মারা গেছেন ১৯৭৫ সালে। তাঁর কবিতার ইংরেজি তর্জমা আমি প্রথম পড়ি ১৯৯৮ সালে। ঘটনাচক্রে দুনিয়াতে যাঁরা আমার চোখে ভালো কবি অথচ ভালো বলে সাধুসমাজে খুব বেশি পরিচিত নন তাঁদের ভালো বলতে আমার সংকোচ হয় না। আমি যদি দেখি পড়ে আমার ভালো লাগছে, আমি সাহস করি অনুবাদ করার। এই আর কি। কবিতা সম্পর্কে আমার অতি অল্পই জানাশোনা।

কে এম রাকিব
একটা বহু পুরানো বিতর্ক আছে। শিল্পসাহিত্যে দুইটা ডমিন্যান্ট ধারা, যদিও সবসময় বিভাজনটা স্পষ্ট না, সেটা হচ্ছে একদল ‘আর্ট ফর আর্টস সেইক’-পন্থি, কথাটা সম্ভবত অস্কার ওয়াইল্ডের, যাকে সুধীন দত্ত বলেছেন ‘কলাকৈবল্যবাদ'[সেই ধারার]। আরেকটা ধারা আবার শিল্পকে সরাসরি রাজনীতির হাতিয়ার বানাতে চায়। অনেকের তো মনে হয় প্রপাগান্ডার মাধ্যম। এই দুই এক্সট্রিমের মাঝামাঝিও আছে। আপনার অবস্থান বা এই বস্তাপচা বিতর্কের বিষয়ে কিছু বলার আছে কিনা…।

সলিমুল্লাহ খান
আমাদের ছোটবেলা থেকেও এটা চালু ছিল। এইটাকে দুর্ভাগ্যজনক বলতে হয়। আমি বলছি। যেমন ধরেন চিকিৎসাশাস্ত্রকে চিকিৎসাশাস্ত্রই হতে হবে। অথচ অনেক ডাক্তার দেখা যায় যাঁরা পেশায় চিকিৎসা-ব্যবসায়ী, কোম্পানির ওষুধপত্র প্রমোট করেন, যাঁদের  কাছে পয়সা কামানোটাই বড় কর্তব্য মনে হয়। এরকম কবিদের মধ্যেও কেউ কেউ, দেখা যায়, বিজ্ঞাপন লেখেন। এই যে আপনারা চোখে দেখেন না—প্রপাগান্ডার কথা যে বলছেন—এই যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে যাঁদের আপনারা বড় কবি মনে করেন এঁরা সকলেই—বিজ্ঞাপন সংস্থায় একসময় না আরেক সময় কাজ করেছেন। এমনকি বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় বহুদিন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করতেন। প্রচারণার কাজে সকলেই অংশগ্রহণ করে, কিন্তু সেই প্রচারণা যদি আপনার পছন্দ হয়, আপনি সেইটাকে প্রচারণা মনে করেন না, শিল্পটিল্পই মনে করেন। আর যাঁর প্রচারণা আপনার পছন্দ হয় না, তাঁর সম্পর্কে আপনি নানা কথা বলেন।

কে এম রাকিব
জর্জ অরওয়েলের একটা কথা আছে সম্ভবত, অল আর্ট ইজ প্রপাগান্ডা।

সলিমুল্লাহ খান
আর্ট তো প্রপাগান্ডা বটেই। তারপরও কথা হচ্ছে কি, আমি যে আর্ট পড়ি সেখানকার প্রপাগান্ডায় চোখ দেব না। এখন লোকে বোরডম কাটানোর জন্যে শিল্পে ধর্ষণ ব্যবহার করে, সেক্স ব্যবহার করে। এটা আপনার জানার কথা। কবিতার ক্ষেত্রে আমি বলছি কবিতাকে প্রথমে কবিতা হতে হবে। তো কবিতা হবে কিনা এটা বুঝবেন কি করে? আমি মনে করি কবিতা মানে কবিতার ইতিহাস। অনেকে বলেন কবিতার ইতিহাস নাই। আমি বলি আছে। কারণ কবিতা ‘শেষ পর্যন্ত’ মানুষ ভাষা দিয়েই লেখে, ‘শেষ পর্যন্ত’ কথাটা আমি জোর দিয়ে বললাম। কারণ নানা সময়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন হয় ভাষার ভিতর দিয়ে।
অ্যারিস্টটল বলেছিলেন মানুষ তার ‘আত্মা’ দিয়ে চিন্তা করে। এটা ভুয়া কথা। আপনি লিখতে পারেন। মানুষের ‘আত্মা’ বলে কিছু নাই। ‘আত্মা’ একটা মিথ,এই ধরেন অধুনা পরিত্যক্ত  ‘ইথার’ নামক কথাটার মতো। মানুষ কিন্তু চিন্তা করে ‘ভাষা’ দিয়ে। ভাষা বলতে বিজ্ঞাপনের যে ভাষা, আমি ঐ ভাষার কথা বলছি না। মানুষ যখন চিন্তা করে তখন সে নানাভাবে প্রকাশ করে। ভাষা ছাড়া কোনো ভাব প্রকাশ করা সম্ভবই নয়। তাই হয়তো বলা যায়, ভাষাই চিন্তার কারণ, ইচ্ছা হয় আাপনি বলতে পারেন ‘অপর কারণ’ ।
‘চিন্তা’ কথাটাকে আমি দুভাবে বলব, মানুষ ‘অঙ্ক’ কষে—এটাও তার চিন্তার একধরনের প্রকাশ। আবার মানুষ যখন ইংরেজিতে যাকে ‘প্যাশন’ বলে তার প্রকাশ ঘটায় তাও চিন্তা বৈকি! সে চিন্তার প্রকাশভঙ্গি অন্যরকম। কবিতার মধ্যেও একধরনের চিন্তার প্রকাশ হয়। কিন্তু এই চিন্তার প্রকাশভঙ্গি অন্যরকম। এর মধ্যে রূপক, লক্ষণা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা এইসমস্ত জিনিশ থাকে। যদি বলেন আপনার চিন্তা পূর্ণ তো আপনার প্রকাশও পূর্ণ হবে। আমরা এখন কি করে বুঝব আপনি এখন কি চিন্তা করছেন? আপনি যা প্রকাশ করেন তা দেখেই তো বুঝব। এই যে বললাম সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কবিতা ভালো, কারণ ভাষার উপর তার প্রচণ্ড দখল। বাংলা ভাষার ইতিহাসের সাথে তার পরিচয় অনেক বেশি গাঢ়। তাঁর ভাষা দেখেই বুঝি তাঁর চিন্তার ক্ষমতা আছে। সত্য ধরা পড়ে।
আরেকটা কথা হলো কি, প্রতিভা বলে একটা কথা তো আছেই। শেষ কথা এইটাই—প্রতিভা। একজনের প্রতিভা আরজন নকল করতে পারে না। ওতে তাঁর আপন মুদ্রাই অঙ্কিত হয়। যেমন আপনার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ আমার হাতের ছাপের সঙ্গে মিলবে না। গোমেজের যেহেতু ভাষার উপর দখল আছে, আমি উদাহরণ দিয়েই বলছি, সেই কারণে তাঁর কবিতার মধ্যে যে ছন্দের স্ফূর্তি পরিস্ফুট হয়, শব্দের সাথে শব্দের সংঘর্ষে যে দ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটে সেটা আপনা-আপনি আপনার হৃদয়ে আঘাত হানে। তাঁর সব কবিতার অর্থ যে আমি বুঝি তা নয়। কবিতা আমরা অর্থের জন্যে পড়ি না। সেটা বাংলায় যাকে বলে দোলা দিয়ে যায়।

কে এম রাকিব
কবির সিগনেচার থাকে…

সলিমুল্লাহ খান
ওটা কেউ কেউ অর্জন করে। কবিতা পড়লে আমরা সহজেই বুঝতে পারি কোনটা মাইকেলের, কোনটা রবীন্দ্রনাথের, কোনটা জীবনানন্দের বা নজরুলের। তরুণ কবিদের ঐ মুদ্রাটা অর্জন করতে কিছু সময় লাগে। আমি যাঁদের কথাই বলছি যেমন এই গোমেজেরই লেখা গদ্য যখন পড়ি, আমার মনে হয় যেন একটা শিশু লিখছে। যেমন ‘বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ’ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর কিছু কিছু শিশুসুলভ ধারণা আছে।

কে এম রাকিব
যেমন? এটা কেন মনে হলো আপনার?

সলিমুল্লাহ খান
আমাদের এক বন্ধু ছিলেন আলম খোরশেদ নামে। তার একটা বইয়ের রিভিউ উনি ‘প্রথম আলো’ নামক এক পত্রিকায় লিখেছিলেন। সেটা পড়েই আমি বলছি। তাঁর কতগুলি অদ্ভুত ধারণা আছে, যেমন তিনি নিজে প্রচণ্ড শক্তির সঙ্গে আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেন কিন্তু আপনি যদি গোটা এক গণ্ডা আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেন তিনি বলবেন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ করছেন। এগুলো হচ্ছে শিশুসুলভ কথা। অর্থাৎ ফার্সি শব্দ ব্যবহার করলে মুসলিম সাম্প্রদায়িক হয়, এইধরনের যে শিশুসুলভ চিন্তাটা ওঁর আছে। বাঙ্গালি বলতে, [ওঁর ধারণা যাঁরা মুসলমান নন, যদিও কথাটা মুখ ফুটে বলার সাহস তাঁর নাই, কিন্তু তাঁর আবহ-ইঙ্গিত দেখে তা পরিষ্কার ধরতে পারবেন]। ওঁর মধ্যেও একটা ইনফিরিয়রিটির বোধ কাজ করে, কারণ কি জানি না, হতে পারে তিনি জাতে বাঙ্গালি অথচ তালে দেশি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানে ধর্মবিচারে সংখ্যালঘু গোছের মনে করেন নিজেকে। এই জটিলতার আলামত আছে তাঁর গদ্যে। উদাহরণ যেহেতু আপনি চাইছেন তাই বলি। তার পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে এক সভায় আমাকে ডেকে নিয়ে যান অনিকেত শামীম। এই শাহবাগেই জাতীয় জাদুঘরের ভিতরের কোনো এক ছোটঘরের অনুষ্ঠানে ।

কে এম রাকিব
কবে এটা?

সলিমুল্লাহ খান
এই দুবছর আগে। আমার সালজ্ঞান তালজ্ঞান ঠিক নাই।  আমি বললাম গোমেজ হচ্ছেন—ওঁ যে রসিকতা বুঝতে পারেন না সেটাই বলছি আর কি এবং নির্দোষ রসিকতার মধ্যেও দোষের আক্রোশ দেখেন তার উদাহরণ দিচ্ছি মাত্র—বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ খ্রিস্টান কবি। সে যে খ্রিস্টান এটা অনেকেই জানে, অনেকেই জানেও না। আমিও রসিকতা করার জন্যে যখন বললাম মাইকেল মধুসূদনের পরে তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি খ্রিস্টান কবি—দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি কবি বললে কোন দোষই হতো না—তিনি প্রমাদ গুনলেন। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ নজরুল প্রভৃতি বড় কবি মাঝখানে… এরকম আরো আছেন তাই আমি একটু রসিকতা করে বললাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত হলেন শ্রেষ্ঠ বাঙ্গলি খ্রিস্টান কবি, এক নম্বর কবি। আর সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ হলেন দুই নম্বর বড় কবি। আসলে আমার মনে কি ছিল কে জানে। হয়তো বলতে চেয়েছিলাম, এদেশে আরও খ্রিস্টান কবি নাই কেন, থাকা তো উচিত। সুখের মধ্যে, এতদিন পর যাক বাঁচা গেল, একটা  প্রতিভাবান খ্রিস্টান কবি পাওয়া গেল! তখন কিছুদিন পর শুনলাম তিনি আমাকে গালি দিলেন ‘মুসলমান সমালোচক’ বলে। অর্থাৎ রসিকতাটা মাঠে মারা গেল, [বলতে পারতাম বজ্রপাতে ‘শহিদ’ হলো]। আমি যে মুসলমান তা আমার অস্বীকার করার কোনো ইচ্ছা না থাকায় আর কথা বাড়াইনি।

যেমন ধরেন মাসুদ খান একদা ভালো কবিতা লিখতেন। কিন্তু দেখবেন কি, তাঁর চিন্তাভাবনাও অত্যন্ত নিম্নমানের। সামাজিক চিন্তার কথা বলছি, আর কিছু নয়।
কে এম রাকিব
আরেকটা ব্যাপারও হতে পারে, দুই নম্বর শব্দটার মধ্যে একটু নেগেটিভ কনোটেশন আছে, ওইটাতে হার্ট করছে কিনা?

সলিমুল্লাহ খান
কবি যেমন রসিকতা করবেন, গদ্যকারও কি তেমন রসিকতা করবেন না! আমাকে যে তিনি মুসলমান বলে সাথে সাথেই [শুনলাম ভিডিয়োযোগে] গালি দিলেন, তাতেই হার মানলাম। বোঝা গেল রসিকতাটা তিনি নিতেই পারেন নাই।

কে এম রাকিব
এখন যদি তিনি বলেন যে, আমিও আসলে ‘খ্রিস্টান কবি’ বলার মতো ‘মুসলমান সমালোচক’ বলেছি রসিকতা করে?

সলিমুল্লাহ খান
আমি তো আলোচ্যসূচিতে না। আমি তাঁর আলোচক। আমার উপর যখন তিনি আলোচনা করবেন তখন [ধরা যাক দুমাস বা] দুবছর পর তিনি তা বললে কোনো সমস্যা ছিল না। নগদ যে তিনি বলে পাঠালেন অস্ট্রেলিয়া থেকে… ওই ইয়াতে… তার বন্ধুদের সাথে ফোনালাপে [কি ভিডিয়ো-আলাপে], এইটা আমি রিপোর্টযোগে শুনেছি। যা হোক, এটাই হচ্ছে ঘটনার ঘনঘটা। আমি তাঁর লেখাতেও দেখেছি, মাত্র একটা উদাহরণ দিয়েছি আপনাকে। কবি পরিচয়ে প্রথম শ্রেণির হয়েও চিন্তাবিদ প্রণয়ে উনি চতুর্থ শ্রেণির হতে পারেন। এইটা উদাহরণ দিয়ে বললাম। বললাম দুঃখের কথাই। আরও অনেক আছেন। যেমন ধরেন মাসুদ খান একদা ভালো কবিতা লিখতেন। কিন্তু দেখবেন কি, তাঁর চিন্তাভাবনাও অত্যন্ত নিম্নমানের। সামাজিক চিন্তার কথা বলছি, আর কিছু নয়।

কে এম রাকিব
তার গদ্যও কি… তার গদ্যের সাথে আপনি পরিচিত?

সলিমুল্লাহ খান
সব কথা আজ এক সাথে বলা যাবে না। তিনি যে চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন, তার আলোকে বলছি, ওসব আমার কাছে মনে হয় অতি নিম্নশ্রেণির, অপরিপাটি। কবি হিসাবে তিনি বেশ ভালো ছিলেন, কিন্তু গদ্য লেখাটা কোনোদিন ঠিক শেখেননি। গদ্য লেখা বলতে বলছি চিন্তা করা, প্রকাশ করাটা শেখেননি।

কে এম রাকিব
এই কথাগুলো কি আমরা রাখব ইন্টারভিউতে? বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু।

সলিমুল্লাহ খান
কেন রাখবেন না ! অফকোর্স! তা তো বটেই। বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্যেই তো আপনি [সাক্ষাৎকার নিতে] আসছেন।

কে এম রাকিব
আচ্ছা।

সলিমুল্লাহ খান
আমি উদাহরণ দিয়ে বলছি। যাদেরকে আমি কবি হিসাবে ভালো মনে করি তাদের অনেকেই ভালো গদ্য লেখেন না। বাংলাদেশে সমালোচনা সাহিত্য বড় বিকশিত হয় নাই। কেন, আমি এই কথাটাই বলছি। পিঠ-চুলকানো চিন্তাভাবনাই এই দেশের প্রায় সমস্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । বাংলাদেশে সাহিত্য পত্রিকার নামে যতগুলি কাগজ বেরোচ্ছে অধিকাংশই এই টাইপের। অর্থাৎ আপনি যে প্রকাশনার তরফে এসেছেন সেই ‘পরস্পর’ অনলাইন পত্রিকার কথাই ধরুন না কেন, এই প্রকাশনাও ব্যতিক্রম নয়, হয়তো পরস্পর পত্রিকাও পরস্পর-গোষ্ঠীর লোকদেরই তোষামোদ করেন। এইরকম আর কি। তাঁরা যে প্রশংসাটা করেন, তা আবার এমন একটা ধোঁয়াশা ভাষায় করেন, কেন যে প্রশংসাটা করছেন আদৌ বোঝা যায় না।

কে এম রাকিব
আমি প্রচুর কবিতা পড়ি না, ভুলও হতে পারে, কিন্তু মনে হয় ওভার-অল বাংলা কবিতার চাইতে বাংলা কবিতার সমালোচনা পড়ে বোঝা কঠিন। ‘মহাকাল’, ‘গভীর জীবনবোধ’ ইত্যাদির ভিড়ে সমালোচনা সান্ধ্যভাষার মতো লাগে।

সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ। [এই জাতীয় সান্ধ্যভাষার লেখার মধ্যে] সবচেয়ে ভালো হচ্ছে গালিবের লেখা। মজার কথা, গালিবের লেখা আমি কিছুই বুঝি না। গালিব আমার ভালো বন্ধু। আপনে কথাগুলি ছাপতেও পারেন। তিনি যে কোন কবিতা ভালো মনে করেন, ‘পরস্পর’ যখন বের করেন দেখি যে অনেক [কবির কবিতা ছাপেন, কারও তিরিশটি কবিতা ছাপেন, কারও বত্রিশপাটি দাঁতও দেখান], কিন্তু ঘুরেফিরে আমরা যে তিমিরে ডোবা সেই তিমিরেই ডুবে থাকি। অর্থাৎ গালিবের সবই আছে। চিন্তা করার ক্ষমতাটাই খালি আল্লা দেয় নাই। বুঝতে পেরেছেন? আমি কেন কবিদের সংসর্গ ত্যাগ করেছি তা বুঝানোর জন্যে আপনাকে এই ঘরের উদাহরণটা দিলাম। এঁরা সকলেই ভালো কবি বটেন। গোমেজ সম্ভবত আমাদের সময়ের সবচাইতে ভালো কবি। তাঁর সাথে আছেন সাখাওয়াত টিপু, খুব ভালো কবি। কিন্তু গোমেজ আর সাখাওয়াত টিপু হয়তো পরস্পর কথা বলেন না। শামসেত তাবরেজী আরেকজন ভালো কবি। আমি যতদূর পড়েছি, [হিজল জোবায়ের আরেকজন শক্তিমান কবি।] এঁদের [কবিতার] সাথে কি আপনি পরিচিত?

কে এম রাকিব
এঁদের কবিতা পড়েছি। কমবেশি সবারই।

সলিমুল্লাহ খান
আগেই বলেছি মাসুদ খান ভালো কবি। এমনকি সাজ্জাদ শরিফও খারাপ কবি নন। ব্রাত্য রাইসুও ভালো কবি। আমার কোনো বিরোধ নাই এঁদের, এই কবিদের সাথে। কিন্তু এঁরা যখন, ধরুন ব্রাত্য রাইসু যখন গদ্য লেখেন তখন মনে হয় যেন কোনো লেখাপড়া জানেন না। এখন বলে রাখি, লেখাপড়া জানা কবির জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। তিনি যে লেখাপড়া জানেন না একথা তো সত্য, অস্বীকার করা যায় না। এটা ভালো কি মন্দ আমি জানি না। যখন তিনি বলেন কিনা ‘আমার লেখাপড়া জানার দরকারই নাই, আর লেখাপড়া জানলে কবিতা হয় না’, তখন আপনে কি করবেন, বলেন দেখি (হাসি)! অনেকে লেখাপড়া জানাটাকেই কবিতার শত্রু মনে করেন। এটা একধরনের কবিসুলভ অভিমান।

কে এম রাকিব
আবার কবিতার ক্ষেত্রে বা যে কোনো শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেই অনেক সময় দেখা যায় পণ্ডিতি-দেখানো, জ্ঞান বা উদ্ধৃতি-ভারাক্রান্ত [রচনা] ইত্যাদি আছে, কিন্তু মানের দিক দিয়ে তা নিম্নমানের। এমনও আবার প্রচুর আছে কিন্তু।

সলিমুল্লাহ খান
আসলে না জানলে তো আর কিচ্ছু করার নাই। কথা হচ্ছে কি, কার্ল মার্কস সাহেবের জন্মের দুই শত বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর। তাঁর নাম স্মরণ করা অন্যায় হবে না কবিতার ক্ষেত্রেও। তিনিও অল্প বয়সে অল্পসল্প কবিতাপত্র লিখেছেন।

কে এম রাকিব
প্লেটোও লিখেছেন কবিতা, যিনি তাঁর আদর্শ স্টেটে কবিদের জায়গা দিতে চান নাই।

সলিমুল্লাহ খান
ওই যে মার্কস সাহেব এক জায়গায় বলেছিলেন, অজ্ঞানতা কাউকে সাহায্য করে না, কথাটা ফেলনা নয়। জ্ঞান লাভ করে আপনি কাজে লাগাতে পারেন, নাও লাগাতে পারেন। কিন্তু অজ্ঞানতা আজ পর্যন্ত কাউকে তো কোনো সাহায্য করেনি, ভাই। তো, আমাদের ব্রাত্য রাইসু এ সত্যের একটা করুণ উদাহরণ। আমি তাঁকে খুব পছন্দ করি, রীতিমতো স্নেহই করি বলতে পারেন। আমার ‘আল্লাহর বাদশাহি’ নামক (অনুবাদ) কবিতার বইটা প্রকাশে তাঁর অনেক সাহায্য ছিল। সে কথা ভোলার মতো নয়। আমার অনুপস্থিতিতে বইটা উনিই (আর বলা প্রয়োজন সাজ্জাদ শরিফ) প্রকাশক যোগাড় করে বের করেছিলেন। আমি যাঁদের কাছে যেখানে যে ঋণ করেছি তা স্বীকার করতে হবেই। আর করলে দোষটাই-বা কি? কিন্তু দুঃখের কথা, তিনি নিজে লেখাপড়া করেন না। মনে হয় এই না করাটাকেই তিনি একটা ধর্মে উন্নীত করতে চান। আমি বলি, আপনি লেখাপড়া করতে ইচ্ছা না করে তো করবেন না। কিন্তু যাঁরা লেখাপড়া করতে চায়, তাঁদের দোষ দিচ্ছেন কেন?

কে এম রাকিব
যারা লেখাপড়া করেন তারাও অনেকে আবার লেখাপড়া করাটাকে ধর্মে উন্নীত করতে চান, এই জায়গার বিরোধিতা থেকেও হয়তো হতে পারে। আমি জানি না, তার পজিশন বা বক্তব্য কী এ ব্যাপারে।

সলিমুল্লাহ খান
আমি ধর্মের বিরোধিতা করতে চাই না। আমি মনে করছি যে ধর্মচর্চা হিসাবে আমরা একমত যে ‘লাকুম দিনুকুম ওয়াল ইয়াদিন’ নীতিটা মাননীয়। তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার। এইটাই হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি।

কে এম রাকিব
এইটাকেই এডওয়ার্ড সায়িদ সম্ভবত সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ হিসাবে দেখেছেন।

সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ, হ্যাঁ। যাই হোক, আমার কথা হচ্ছে কিনা কবিতা আমাদের দরকার। কিন্তু কবিতার বাইরেও যারা শিল্পের অন্যান্য ফর্ম চর্চা করেন তাদের দিকেও তো একটু মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের দেশে কবিতা যত বিকশিত হয়েছে সাহিত্য সমালোচনা যেটা বলা হয় সেটা অত বিকশিত হয়নি। কারণ কি? ছোটবেলা থেকেই আমার সঙ্গীসাথিদের মধ্যে কবিরা আছেন। যাঁদের কথা বললাম এঁরা সকলেই একসময় আমার বন্ধু ছিলেন, এখনও আছেন বলেই আমি মনে করি।। আমি এখনও কাউকে শত্রু মনে করি না। কবিদের আমি পছন্দ করি, সকল দোষের পরেও দোষ সত্ত্বেও কবিরা নমস্য। তো আমার কথা হচ্ছে ওদের কাছ থেকে একটু দূরে দূরে থাকি। যেমন [সোহেল হাসান] গালিবকে আমি পছন্দ করি। কিন্তু সামনা-সামনি হলে বলি, গালিব আপনারা এগুলো কি করেন? না, তাতে তিনি তো আমার শত্রু হন না। তিনি বলেন যে আপনার কাজটা আপনি করেন, আমার কাজটা আমি করি। আমি গালিবকে ভাইয়ের মতোই মনে করি। কিন্তু গালিবের কবিতা আমি মাথার উপর নেব এমন তো নাও হতে পারে। আমি বলি আপনার কবিতা আমি বুঝি না। মানে আপনার পদ্য আমার প্রাণে আবেদন জাগায় না। কিন্তু জসীমউদ্‌দীনের কবিতা? জাগায়, আমি আনন্দ পাই। এই যে আমি ‘প্রাচীনপন্থি’ হয়ে গেলাম!

কে এম রাকিব
হা হা হা…

রাইসু হচ্ছেন বনসাঁই। তাঁর নাম রাইসু বদলে কেউ যদি বনসাঁই দেন তাহলে চমৎকার একটা কাজ হয়। হি ডিড নট সিমপ্লি গ্রো।
সলিমুল্লাহ খান
আচ্ছা, আপনি আহমদ ছফার কবিতা পড়েছেন?

কে এম রাকিব
পড়েছি। তবে খুব বেশি না। প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা আর কিছু বিচ্ছিন্ন কবিতা। ‘কবি ও সম্রাট’…

সলিমুল্লাহ খান
প্রবীণ বটের কাছে তো অনেক আগের লেখা। শেষ বয়সে তিনি ‘কবি ও সম্রাট’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন। লেনিন ঘুমাবে এবার বইতে। এইটা একটু পড়েন আপনি। আমি ওটাকে একটা ভালো কবিতা মনে করি। মানে আমাকে বোঝার জন্যে আমি ভালো কবিতার একটা উদাহরণযোগে সংজ্ঞাই দিচ্ছি। আমি রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো কবিতাও পছন্দ করি। আমি একটু প্রাচীনপন্থি, এটা বলতে লজ্জা বোধ করি না।

কে এম রাকিব
আহমদ ছফা সঞ্জীবনী-তে ছফার কবিতা নিয়ে কিছু লিখেছেন।

সলিমুল্লাহ খান
সব কিছু লিখি নাই। ঐটা তো লিখেছিলাম ৭৭-৭৮ সালে। প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা বের হবার পরপরই একটা রিভিউ লিখেছিলাম। আহমদ ছফার কবিতা নিয়ে আমি আর কোনো কিছু লিখি নাই। ভবিষ্যতে আল্লা চাহে তো লিখব। যা হোক, আমি প্রাচীন এবং আধুনিক কালের মধ্যে কোনো বিরোধ কল্পনা করি না। ইংরেজিতে বলে হিস্ট্রি ইজ এ কন্টিনিউয়াম। আমার ভেতরে অতীতও আছে, বর্তমানও আছে।

কে এম রাকিব
সমাজব্যবস্থা, সময়, প্রযুক্তি, মূল্যবোধ—এইগুলার তো পরিবর্তন হয়। সেই বদলের অভিঘাত শিল্পে-সাহিত্যেও লাগার কথা না?

সলিমুল্লাহ খান
আছে তো। পরিবর্তনের মধ্যে কিছু কিছু আমি প্রার্থনা করি, কিছু কিছু পরিবর্তনে আমি সহায়তা করি। কিছু কিছু পরিবর্তনের আমি বিরোধিতাও করি। একসময় ফাসিবাদ আসছিল। এইটাও তো পরিবর্তনই। ওটা আমি পছন্দ করি না। কমিউনিজম পছন্দ করি, এটা তো আমি লুকাই না কখনো।

কে এম রাকিব
এই যে এনালজিটা, কবিতার পরিবর্তন, ফ্যাসিবাদের সাথে মিলিয়ে এইটা…

সলিমুল্লাহ খান
কবিতার ক্ষেত্রেও সমস্ত ইনোভেশন আমার ভালো লাগবে এমন কোনো কথা নাই। আমার এইখানে পছন্দ-অপছন্দ আছে। যেটা আমি বুঝতে পারি না সেইটা আমি ভালো বলব কেন? এখন কেউ যদি বলে আপনি এখানে ‘রাজার নতুন জামা’ পরে বেরিয়েছেন, আপনি তো কিছু জানেন না এইটাই প্রমাণিত হলো। তথাস্তু। আমি যেটা জানি সেটার কথাই বলছি। যেটা জানি সেটা বলি, কবিতার মধ্যে আমি বোদলেয়ার পড়েছি, তাঁর উপর দুটা সেমিনারও করেছি। ফরাসিতেও কিছু কিছু পড়েছি। গদ্যকবিতাগুলোও পড়েছি। আমার পৃথিবীতে প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন এই বোদলেয়ার। অন্য কবিদেরও আমি পছন্দ করি। সুতরাং আমার কবিতার রুচি সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা আছে। যাদের কবিতার কথা বলছি, যেমন ব্রাত্য রাইসুর মধ্যে একটা ক্ষমতা ছিল। সেটা হচ্ছে তাঁর চমকপ্রদ কথা বলার ক্ষমতা, তিনি বলতে পারতেন চমৎকার। কিন্তু ওই যে চমক দেওয়ার মোহ… মৃদুল দাশগুপ্ত তাঁর সম্পর্কে মনে হয় সঠিক কথাই বলেছেন: এই চমক দিয়ে সারাজীবন চলা যায় না। উনি কিন্তু গত বিশ বছরে এক ইঞ্চিও বড় হননি। বনসাঁই বলে একটা কথা আছে না? রাইসু হচ্ছেন বনসাঁই। তাঁর নাম রাইসু বদলে কেউ যদি বনসাঁই দেন তাহলে চমৎকার একটা কাজ হয়। হি ডিড নট সিমপ্লি গ্রো।

কে এম রাকিব
বাংলা কবিতার মধ্যে আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি একটা…

সলিমুল্লাহ খান
ওইটাই তো। ভালো কবিতার বই। এরপরে কিন্তু আর কিছু লিখতে পারে নাই। হালিকের দিন ওটাও আমি পড়েছি। আমাকে তাঁর বইয়ের রিভিউ লিখতে তিনি বলেছিলেন। দুঃখের মধ্যে, আমি রিভিউ লেখার কিছু খুঁজে পাই নাই। কারণ তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন। আমি যে সমস্ত শব্দ বা বাগ্বিধি পছন্দ করি না, সে যে সমস্ত ‘চ’ শব্দ ব্যবহার করেন, আমি ওটা রুচিবহির্ভূত বলেই মনে করি। আশা করি আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি রবীন্দ্রনাথ নই, আমি মোটেও রুচিবাগীশ নই। কিন্তু এখন একজন লোক, কোনো আধুনিক কবি যদি তাঁর আম্মাজানকেই বিয়ে করতে চান, তিনি করতে পারেন, আমি এটা অনুমোদন করব না।

কে এম রাকিব
এইরকম মাকে বিয়ে করা বা ইনসেস্ট—এরকম ব্যাপার কি আসলে তাঁর কবিতায় আছে?

সলিমুল্লাহ খান
ওঁর কবিতা সেরকমই। যখন বাংলা ভাষায় কেউ চ-শব্দ ব্যবহার করেন, তখন বুঝতে হবে তিনি তাই করছেন। অর্থাৎ তাঁর পাপটা হচ্ছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সংস্কৃতির একটা আয়না আছে। প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে প্রমোশন পাওয়া যায়। তিনি সেটার বিরোধিতা করছেন।

কে এম রাকিব
এভাবেও তো কেউ বলতে পারে যে, এই যে শব্দের ভালোমন্দ, মার্জিত-অমার্জিত হওয়ার ব্যাপার—এগুলাও আসলে একধরনের শ্রেণিরুচির ব্যাপার, ডমিন্যান্ট বা ডমিনেটেড শ্রেণির মূল্যবোধগত ব্যাপার। অ্যাবসলিউট কিছু না।

সলিমুল্লাহ খান
আমার বক্তব্যটা আমি বলছি। আমি ওটাকে মনে করি সংস্কৃতির বিরোধিতা। আমি যেটিকে সংস্কৃতি মনে করি, এখন আমার এটাকে আপনারা সমালোচনা করেন, আমার তো আপত্তি নাই। আমি আমার কথাই বলছি। আমি অন্যের কথার দায়িত্ব নেব না। রাইসুর কবিতাতে যে সমস্ত ‘চ’ জাতীয় শব্দ আছে, আরও অনেক কবিরই আছে, আরও উদাহরণ আছে, রাইসু অপেক্ষাকৃত ভালো কবি বলেই তাঁর নামে আলোচনাটা হচ্ছে। এগুলোকে আমি আমার রুচির যে [ছোটমতো] গণ্ডি, তার বহির্ভূতই মনে করি। অর্থাৎ আমার যে কাব্যের আসর, তাতে তার স্থান হবে না। তাঁর আসরে তো আমি জায়গা খুঁজতেছি না, তাই না?

কে এম রাকিব
কবিতা নিয়ে তো আলাপ হলো। কবিতার বাইরে গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি এইসময়ের লেখকদের পড়া হয়?

সলিমুল্লাহ খান
পড়া হবে না কেন! আমি সাহিত্যের ব্যবসায় করি। ছোট ব্যবসায়ী যদিও (হাসি)। আমি লিখতে পারি না, এটা অবশ্য সত্য।

কে এম রাকিব
আপনার প্রকাশিত প্রায় সব লেখাই আমি পড়েছি যেহেতু, আপনার বেশির লেখাই শিল্পসাহিত্য নিয়ে, যদিও তাত্ত্বিক, চিন্তক বা বুদ্ধিজীবী হিসাবেই আপনি বেশি পরিচিত।

সলিমুল্লাহ খান
মানুষ তাত্ত্বিক হিসাবে, বুদ্ধিজীবী হিসাবে, জন্মগ্রহণ করে না। সে ঘটনাচক্রে এটা-ওটা হয়ে ওঠে। আমরা তো ঘটনাবলির, পরিবেশ-পরিস্থিতির সন্তান। যাঁরা খুব বীরপুরুষ তাঁরা পরিবেশ-পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেন। আমরা যাঁরা ছোটপুরুষ কিংবা পুরুষই নই, নেহায়েতই জীব, কৃষ্ণের জীব, আমরা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হই। অসুবিধা নাই, আমাকে গালি দিলেও আমি মাইন্ড করব না। আপনি গালি দিতে পারেন। আমার বক্তব্য হলো, আমি গল্প-কবিতা কিছুটা পড়েছি। সব পড়ি নাই। সবকিছু পড়া সম্ভব নয়।… আনন্দ না পেলে আমি পড়ি না। অনেক সময় চাকরি হিসেবে পড়ি যে, এইটা পড়ে আপনাকে একটা মত দিতে হবে। সেটা অন্য জিনিশ।  যেমন, ছোট বয়সে, সত্তরের দশকে আমি হাসান আজিজুল হকের গল্পের উপরে লিখেছি। নামহীন গোত্রহীন নামক তাঁর চতুর্থ বইটা যখন বের হয় স্বাধীনতার পরে—ঐটাতে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি আছে—ওইটা আমি পড়েছিলাম। এখন আমি জানাই, ওই বইটা তাঁর যে লেখার স্বাভাবিক ক্ষমতা, ঐটা আছে বলে তিনি লিখতে পেরেছেন এবং আমাকে আকৃষ্ট করেছিল তাঁর গদ্যের ধারালো ভাবটা…

কে এম রাকিব
একটা নিরাবেগ নির্মোহ ভঙ্গি…

সলিমুল্লাহ খান
কাটা কাটা গদ্য আর কি। সেটা আমিও পছন্দ করি। করতাম তখন বেশি, এখনও করি। হাসান আজিজুল হকের লেখা এখনও পড়া যায়। অর্থাৎ আপনি ক্লান্ত বোধ করবেন না। এই যে গুণ তাঁর মধ্যে… উইট আছে, হিউমার আছে গদ্যে। কিন্তু জীবন ঘষে আগুন যখন বের হয় তখন আমি ওটা মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছি, খুবই কঠিন ছিল। তারপরেও আমি বেশ কয়েক বার পড়ার চেষ্টা করেছি।

কে এম রাকিব
আগুনপাখি লিখলেন পরে, উপন্যাস।

সলিমুল্লাহ খান
ঐগুলি আমি আর পড়ি নাই। সোজা কথা, আমি প্রথম দুটো বই পড়েছি। আত্মজা ও একটি করবী গাছ, আরেকটা কি যেন নাম ভুলে গেছি, আর তৃতীয় জীবন ঘষে আগুন ইত্যাদি। হাসান আজিজুল হকের গল্প যে কোনো সংকলনে পাওয়া যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কিছুদিন চাকরি করেছিলাম। এখনো হাসান আজিজুল হকের সাথে আমার যোগাযোগ আছে, পরিচয় আছে। উদাহরণ দিয়ে বলছি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প একটু পরে পড়েছি আমি। অন্যঘরে অন্যস্বর, দুধেভাতে উৎপাত এগুলো পরে পড়েছি। অন্যঘরে অন্যস্বর-টাই একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলাম। মনে হলো উনি তো তাঁর গল্পে একজন যেমন “এই  মনোরম, মনোটোনাস শহরে…” [তিনিও অনেকটা তেমনই]।

জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে একটা ফাতরা বই লিখেছেন তিনি। বইয়ের নাম ‘একজন কমলালেবু’।
কে এম রাকিব
‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। ওটা তো একদম প্রথম দিকের ইলিয়াসের লেখা।

সলিমুল্লাহ খান
তিনি আসলে কবিই—‘বুর্জোয়া কবি’। কিন্তু মজা হলো কি…

কে এম রাকিব
কিন্তু নিরুদ্দেশ যাত্রার যে ইলিয়াস, ওখান থেকে ইলিয়াস কিন্তু পরবর্তীতে অনেক সরে গেছেন।

সলিমুল্লাহ খান
হ্যাঁ, ইলিয়াস অনেক পরিবর্তিত হয়েছেন। তার গদ্য আমি মোটামুটি পড়েছি। অনেক পরে শওকত আলীর গদ্যও পড়েছি। কারো সাথে কারো পুরোপুরি মেলে না, কিন্তু তারা সবাই এক যুগের। এমনকি আল মাহমুদও অনেক গল্প লিখেছেন। আমি বলছি, আমরা হলাম ওই যুগের লোক। আমি নির্মলেন্দু গুণের গদ্যও পড়েছি। আপন দলের মানুষ নামের একটা গল্পের বই ছিল তার। আহমদ ছফা, বশীর আল হেলাল এঁদের গল্পও আমি কিছুদিন পড়েছি। অন্তত একসময় পড়তাম। আমি এঁদের সবাইকে একযুগের লোকই মনে করি। অন্যদের কথা, বলা বাহুল্য, কায়েস আহমেদ পড়েছি, হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক পড়েছি …

কে এম রাকিব
হুমায়ূন আহমেদ কেমন লেগেছে?

সলিমুল্লাহ খান
ভালো, খুব ভালো। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দুটো বই—নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার—একসময় পড়েছি। এর পরেও দুই-একটা একটু-আধেকটু পড়ে পড়ে দেখেছি।

কে এম রাকিব
আর টানে নাই?

সলিমুল্লাহ খান
নাহ্‌, আর টানেনি। ওই দুটি পড়ে বেশ ভালো লেগেছিল। তখন আমারও বয়স কম ছিল, ওনারও বয়স কম ছিল। পরবর্তীকালে উনি অনেক বড় হয়েছেন, আমি আর বড় হইতে পারি নাই। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখাও দুই-একটা পড়েছি। কারণ তাঁদের সাথে আমার পরিচয় ছিল [আহমদ ছফার মধ্যস্থতায়]। হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার পরিচয়, বলা যায় একপ্রকার বন্ধুত্বই ছিল। এঁরা সকলেই ভালো লেখক।
কিন্তু আমি যাঁকে বড় লেখক মনে করি তার উদাহরণ একমাত্র আহমদ ছফা। রবীন্দ্রনাথের পরে সর্বশেষ বড় লেখক আহমদ ছফা। শুধু এই স্বাধীন বাংলায় না, ওই ভারতাধীন বাংলায় না, সব বাংলাতেই—গদ্যে, পদ্যে, গল্পে, কবিতায়, চিন্তায় সবচেয়ে বড় লেখক আহমদ ছফা। কবি হিসেবেও ছফা অনন্য। গালিবদের আমার পছন্দ হয় না কি জন্য জানেন? তাঁরা আহমদ ছফার কবিত্ব বোঝেন না। তাঁরা তো ইম্ম্যাচিউর, [ওঁরা পাকেন নাই]। আহমদ ছফার কবিতা বুঝতে যে বয়সের দরকার তা ওঁদের হয় নাই। গালিবের হয়নি, রাইসুর হয়নি, সাজ্জাদের হয়নি, গোমেজের হয়নি। তাহলে এদের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাড়া আমি আর কি বলতে পারি? লিটমাস টেস্ট বলে একটা বাক্য আছে…  আপনি এইটার পরীক্ষা দিবেন তো রঙটা বদলায় কিনা দেখতে পারবেন…।
আহমদ ছফার কবিতা যাদের ভালো লাগে না তাঁদের ভালো কবি বলার কোনো কারণ আমি দেখি না। আহমদ ছফা ফাউস্ট অনুবাদ করেছেন। এটাকে তাঁরা ভালো বলছেন গ্যেটের কারণে। যে লোক গ্যেটেকে এমন অনুবাদ করেন…[তিনি কি আর খারাপ কবি হতে পারেন! আমাদের এই ভদ্রমহোদয়দের ভাবখানা এইরকমই।] আমি বলি আহমদ ছফা গ্যেটেকে বিকৃতই করেছেন। বিকৃত করে শেষতক যা দাঁড়িয়ে গেছে তার নামই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক দিয়েছিলেন ‘গ্যেটে প্লাস আহমদ ছফা’। আমার বিশ্বাস এই দেওয়াটা ঠিকই হয়েছে। এখানে শুধু এইটুকু বলি, বিকৃত করার জন্যও তো কবিত্বশক্তি লাগবে!

কে এম রাকিব
কবিতার অনুবাদ ভালো হতে গেলে তো মিনিমাম কবিত্ব থাকতে হয় অনুবাদকের।

সলিমুল্লাহ খান
যে লোক এত ক্ষমতার অধিকারী আমি তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখক বলি না, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন বলি, তাতে অসুবিধাটা কোথায়! বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর সেরা লেখক আহমদ ছফা। একদিকে এত চিন্তাশীল আরদিকে এত সৃষ্টিশীল… দুইটা এক জায়গায় করলে, যুক্ত করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছেন আহমদ ছফা, আহমদ ছফা ছাড়া আজ বাংলামুলুকে [বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র আর ভারতের অধিভুক্ত বাংলাপ্রদেশ জুড়ে] এমন কেউ আর নাই।

কে এম রাকিব
গদ্যের ক্ষেত্রে আপনি মনে করছেন আহমদ ছফাই… শীর্ষে।

সলিমুল্লাহ খান
শুধু গদ্যে না, পদ্যেও। আমি জানি আপনাদের জন্যে এ কথাটা গ্রহণ করা এবং ছাপানো—দুটাই চ্যালেঞ্জিং হবে। এটা মেনে নিতে কষ্ট হবে। তবে আমি সবিনয়ে এ সত্যই নিবেদন করি।

কে এম রাকিব
এই সময়ে যাঁরা লিখছেন তাঁদের মধ্যে কারও লেখা ভালো মনে হয়?

সলিমুল্লাহ খান
কারা লিখছেন, আপনি বলেন। আপনি তরুণ, আপনাদের কাছ থেকে শিখি…।

কে এম রাকিব
কত লেখকই তো লিখছেন। শাহাদুজ্জামান, মামুন হোসাইন, কাজল শাহনেওয়াজ, ওয়াসি আহমেদ, শাহীন আখতার, জাকির তালুকদার—কত নামই তো শোনা যায়।

সলিমুল্লাহ খান
এঁরা ভালো লেখক। এঁদের বিষয়ে আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। যেমন শাহাদুজ্জামান, বয়সে আমার ছোট। [মানে ওঁকে আমি অনেকদিন থেকেই চিনি। আমি ওঁকে খুব পছন্দও করি। ওঁর বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে আমার কষ্ট হয়। আমার সম্পাদিত পত্রিকায় একদা (১৯৮৩-৮৪ সালে) ওঁর লেখা আদর করে যত্ন করে ছেপেছি।] এতদিনেও দেখছি উনি গদ্য লিখতেই শেখেননি। গদ্যে আর পদ্যে যে একটা তফাত আছে এটা ওঁকে এতদিনে কে শেখাবে! জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে একটা ফাতরা বই লিখেছেন তিনি। বইয়ের নাম ‘একজন কমলালেবু’। যাঁর ন্যূনতম আত্মসম্মান আছে তাঁর তো এ রকম বই লেখা উচিতই নয়। জীবনানন্দের উপর একটা মশকরার বই লিখেছেন তিনি। প্রথমে দর্শনে, ভুলের প্রকোপে, একবার পড়েছিলাম ‘একডজন কমলালেবু’। পরে দেখি, না, বইয়ের নাম ‘একজন কমলালেবু’।
পরীক্ষা করার জন্য ‘আট বছর আগের একদিন’ নামের কবিতাটা নিয়ে যে চ্যাপ্টারটা তিনি লিখেছেন, সেটা পড়ে দেখলাম, পড়ে যারপরনাই হতাশ হলাম। দেখি কি কবিতাটার ভিতরটাই তিনি বুঝতে পারেন নাই। [প্রসঙ্গক্রমে বলি, বুঝতে পারলাম আরও এক কারণে । আমি নিজেও ঐ কবিতা নিয়ে সম্প্রতি বাংলায় একটা সহজ প্রবন্ধ লিখেছি। বলা বাহুল্য নয় বাংলা লেখাটা আমার প্রায় দশ বছর আগের একপ্রস্ত ইংরেজি কঠিন প্রবন্ধের তর্জমা নয়।] দেখলাম ওইটা আমার তাহলে আর পড়ার দরকার নাই।

কে এম রাকিব
বইয়ের বেশিরভাগ লেখার যে বিষয়, তা আবদুল মান্নান সৈয়দের শুদ্ধতম কবি-তেই আছে। এর বাইরে বেশি কিছু নাই।

সলিমুল্লাহ খান
আবদুল মান্নান সৈয়দের কথা আমার বলা উচিত ছিল। তাঁর কবিতাও আমি পড়েছি। আবদুল মান্নান সৈয়দ কখনও প্রাপ্তবয়স্ক হন নাই। ঠগ বাছতে গেলে ভাই গা উজাড় হবে। সবার নাম নিয়ে বলা তো মুশকিল। আসাদ চৌধুরীকে আমি চিনতাম। আমি বলব না তিনি একজন মহাকবি। সবার তো মহাকবি হতে হবে না। তিনি একজন সৎ মানুষ। রফিক আজাদের কবিতা আমি অনেকটা পছন্দ করতাম। তাঁর কবিতায় একধরনের গদ্যপ্রবণতা আছে, কবিতাকে উনি ‘পদ্যপ্রবন্ধ’ই বলতেন। নির্মলেন্দু গুণ আর আবুল হাসানকেও আমার এখনও ভালো লাগে। আবুল হাসানকে নিয়েও আমি একটা নিবন্ধ লিখেছি।

কে এম রাকিব
‘আবুল হাসানের অজ্ঞান’।

সলিমুল্লাহ খান
আমি অতি সামান্য লেখক। নিজের সম্পর্কে বেশি কথা বলা ঠিক নয়। আমি আপনাকে মাত্র দেখাচ্ছি বাংলা কবিতার সাথে আমার কি রকম [অতি সামান্য] পরিচয় আছে।

কে এম রাকিব
তাও তো বাংলাদেশের পরিচিত কবিসাহিত্যিকদের অনেককে নিয়েই লিখেছেন।

সলিমুল্লাহ খান
ফরহাদ মজহারের এবাদতনামা-র সমালোচনা কেউ করার আগে আমি লিখেছিলাম। বইটি প্রকাশ পাবার পরপর—১৯৯০-৯১ সালের কথা—তার খারাপ সমালোচনা করেছিলেন দুজন প্রথিতযশা লেখক—একজন রফিক আজাদ, অন্যজনের নাম পূরবী বসু, ইনি একজন গল্পকার। আমি তাঁদের দুজনের সমালোচনার জবাব দিয়েছিলাম। ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় আমার সেই সমালোচনার একটা সমালোচনা লিখেছিলেন অধ্যাপক আজফার হোসেন। আমি সেটার কোনো উত্তর দেই নাই। কারণ আক্ষরিক অর্থেই তাঁর যুক্তি ছিল অকাট্য, মানে কাটলে রোগী মারাই যাবেন। আমার লেখার সমালোচনা আপনিও করতে পারবেন। আর সবকিছুর জবাব আমাকেই দিতে হবে বা দিতেই হবে এমন কথা তো নাই। পাঠকসমাজ এটা বিচার করবেন। ভালো সমালোচকদের আমি আমার খাঁটি শিক্ষক মনে করি।

Link: https://www.porospor.com/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A7%8E%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%9A%E0%A6%95%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BF-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0/


27
মোহাম্মদ রফিক এবং সেলিম আল দীন—এক ভূখণ্ডে, একই জগতের দুই দিকপাল। মোহাম্মদ রফিকের সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ মৎস্যগন্ধা [১৯৯৯] পাঠ এবং মঞ্চে ঢাকা থিয়েটারের সাম্প্রতিক প্রযোজনা সেলিম আল দীনের বনপাংশুল প্রত্যক্ষ করলে বিগত দুই যুগব্যাপী গড়ে ওঠা এই ধারণা স্পষ্টতর হয় যে, দুই শিল্পীই বাংলা ভাষার প্রধানত ইংরেজি সাহিত্যের আধিপত্যে গড়ে ওঠা অবক্ষয়ক্লিষ্ট এবং পর-অনুকারী শিল্পের বিপরীতে দেশীয় জীবনযাপন, সংস্কৃতি, পুরাণের ছায়ার একটি প্রাতিস্বিক শক্ত ভিত্তিভূমি গড়ে তুলতে তৎপর। এক অর্থে দুজনই কবি—স্রষ্টা। দুজনের শিল্পচিন্তার মধ্যে ঐক্য যেমন আছে তেমনি আছে বৈপরীত্যও। এই ঐক্য ও বৈপরীত্য বিষয়ে তাদের মধ্যে একটা কথোপকথন হয়েছিল সম্প্রতি। এতে ইন্ধন জুগিয়েছেন কথাশিল্পী মঈনুল আহসান সাবের। কবিতা নাটক ও উপন্যাস ছোটগল্প মহাকাব্য, শিল্পবোধ জনরুচি ইত্যাকার বিষয়ে তারা কথা বলেছেন। ইতঃপূর্বে সেলিম আল দীন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন যে, ‘বিশ্বসাহিত্যে একবিংশ শতাব্দী শিল্প বিষয়ে এক আঙ্গিক ও পদ্ধতিগত সঙ্কটে নিপতিত হবে।’ এই আশঙ্কা পুনর্ব্যক্ত করে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন তিনি। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির হিমু, তরুণ কবি নাট্যকর্মী শামীম রেজা, নাট্যকর্মী হারুন রশীদ ও কবিতাকর্মী জাফর আহমদ রাশেদ। ধারণকৃত কথোপকথনের শ্রুতি উদ্ধার করেছেন জাফর আহমদ রাশেদ।

আ ড্ডা
❑❑
সেলিম আল দীন
২০০০ সালের পর, ২০০১ সাল থেকে কালের একটা দায় পড়ছে মানবজাতির ওপর। মানুষ সব সময় তার উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে আসছে নিজের মতো করে। আমার ধারণা জন্মেছে যে, বিশ্বে বর্তমানে পোয়েট্রি, ছোটগল্প, নাটক—এই লেখ্য শিল্পমাধ্যমগুলো, নাটকের লিখিত আকারের কথা বলছি, এগুলোর ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী এবং এগুলো আলটিমেটলি, বোর্হেস যে রকম বলেছে যে, কোনো কোনো নদী মরে যায়, এবং কোনো কোনো নদী আবার পুনরুজ্জীবিত হয়, শিল্পের নতুন নতুন শাখা-প্রশাখা সব সময় জন্মাচ্ছে, কোনো কিছু মারা যায় আবার নতুন কোনো কিছু গ্রো করে। তাহলে ২০০১ সাল থেকে, এখন যে ফর্মগুলোতে আমরা লিখছি, এগুলো কি ফুলফিল করবে আগামী শতাব্দীর দায় বা আবেগ বা রুচি বা পছন্দ—ছোটগল্পের ব্যাপারে বলতে হয়, এটি শিল্পের ক্ষেত্রে অনিবার্য ছিল না, এটা পছন্দের ব্যাপার ছিল। আলটিমেটলি ‘শর্ট স্টোরি’ বলে কোনো শব্দ হতে পারে কি না? কবিতা বলতে আমরা নির্বিশেষে একটা বিশাল ব্যাপার বুঝি, কিন্তু শর্ট স্টোরি? হোয়াট ইজ দিস? লেংথ দিয়ে কোনো শিল্প মাধ্যমকে তো মাপাই যায় না। এটা তো একেবারে এস্থেটিকালি ভুল। তারপরও আমরা দেখতে পাচ্ছি ছোটগল্প লেখা হয়েছে, এক সময় হোর্সেস—আমি একটু কম পছন্দ করি, মার্কেস বেশি পছন্দ করি, এরা এখনো ছোটগল্প লিখছেন, কিন্তু ছোটগল্প ওই মাত্রই। পোয়েট্রির ক্ষেত্রে আমরা দেখি, ক্লাসিক পিরিয়ড থেকে ভাগ হয়ে বা রিচুয়াল পোয়েট্রি থেকে ভাগ হয়ে রোমান্টিক পিরিয়ডে যে আত্ম-উন্মোচনটা ঘটল, তারপর থেকে গীতলতার বিরুদ্ধে স্টিফেন স্পেন্ডারদের আমলে একটা নতুন ধারা তৈরি হলো যে, কবিতাকে দূরবর্তী রাখা চলবে না। কবিতাকে একেবারে দৈনন্দিন জীবনের কাছাকাছি আনতে হবে, যদিও আমার ব্যক্তিগতভাবে মানতে কষ্ট হয় যে, কবিতার পদাবলী বিষয় একেবারে দৈনন্দিন হবে, আমি টি এস এলিয়টদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত নই। তারপরও দেখা যাচ্ছে যে, কবিতা একটা মোড় নিয়েছে, বিশ্বব্যাপী ওই ধারাটাই প্রচুর সকল কবি, বিশাল বিশাল কবির আবির্ভাব ঘটেছে। কবিতার ক্ষেত্রে গেল এটা : এখনো কবিতার ধারা অব্যাহত রয়েছে। আমরা অবশ্য এ হিসাব করে বলতে পারব না, এ মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি কে? ২০ বছর আগে হলে পারতাম, নেরুদা যখন জীবিত ছিলেন, তখন আমরা বলতে পারতাম তিনি শ্রেষ্ঠ কবি। এখন একটা ক্রান্তিলগ্ন উপস্থিত হচ্ছে। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে আমরা জানি যে, এ রকম না যে আমি হাল কোনো ধারণা নিচ্ছি, যে ওই সময় এ রকম হয়েছিল বলে আর এ রকম হবে না। কিন্তু আমরা দেখছি মহাকাব্য মৃত, আর কেউ লেখে না, ছোটগল্পও মৃত একটা শাখা বলে মনে করি। ছোটগল্প আর আগের ফর্মে থাকছে না, ছোটগল্পকে বাঁচাতে হলে অন্য কোনো ফর্মে যেতে হবে। উপন্যাস দাঁড়াচ্ছে, যদি ল্যাটিন আমেরিকা বা আফ্রিকান উপন্যাস, আচিবির উপন্যাসের কথা ধরি, আমার মনে হয়েছে ইট ইজ মোর টেল দেন এ নোবেল, দেন এ ফিকশন, টেলের ধারায় চলে গেছে। টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে উপন্যাস লিখেছেন, সে অর্থে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর কোথাও সে লক্ষণ নেই। খুব ক্লিশে উপন্যাসগুলোর লক্ষণ সেগুলো— বাস্তবতাবাদ, এই সেই।

নাটকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নাট্যকার ক্রমেই দূরবর্তী, ডিরেক্টর একটা বড় জায়গায় চলে আসছেন। পিটার ব্রুককে দেখলেই আমরা তা বুঝতে পারি। নাট্যকারের স্থান খুবই সঙ্কীর্ণ এখন, মঞ্চে। তার মানে ডেডলি জায়গায় এসে সবকিছু ঠেকে গেছে বলে আমার মনে হচ্ছে। কাজেই একুশ শতকে টোটাল পৃথিবীর অবস্থাটা কিভাবে দাঁড়াবে এবং ততোদিন আমরা বেঁচে থাকি বা না থাকি, তাহলেও আমাদের ওপর দায় বর্তায় যে, উত্তরকালে শিল্পের গতি-প্রকৃতি কী হবে? রবীন্দ্রনাথকেও পার্টিসিপেট করতে হয়েছিল একসময়, আধুনিকতা নিয়ে। পাউন্ডকেও হতে হয়েছিল ইয়েটসদের মুখোমুখি। যেজন্য ইয়েটস আর্তনাদ করে বলেছিলেন, ‘উই আর দ্য লাস্ট মেরান্টিকস’। তিনি টেরও পেয়েছিলেন যে, রোমান্টিসিজমের দিন শেষ। কাজেই এটা আমাদের বিচার্য, একুশ শতকে শিল্পভাবনা কোনদিকে মোড় নেবে। রফিক ভাই, আপনি বলুন।

মোহাম্মদ রফিক
আসলে সেলিম তুমি এতক্ষণ যা বললে, এসবের ঠিক কথার পিঠে কথা বলে একটা উত্তর সাজানো খুব কঠিন। সেজন্য, আমার কথা যে ঠিক তোমার কথার পিঠে কথা হবে, তা হয়তো নয়। আর আমরা হয়তো প্রত্যেকেই বিয়ষটা নিজের মতো করে ভাবছি। শিল্পের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করা কঠিন, আসলেই শিল্পের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করা যায় না। শিল্প তার নিজের নিয়মেই চলে এবং সেখানে দেখতে গেলে একজন লেখক নিমিত্তমাত্র।

পৃথিবীতে সমালোচনা বা লেখকের কথা শুনে সৃষ্টিশীলতা কখনো চলে না। সৃষ্টিশীলতা তার নিজের নিয়মে, নিজের পরিবেশে চলে, নিজের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে চলে এবং আগামী শতাব্দীর শিল্পও মোটামুটি বলা যায় যে, সেই নিয়মই মানবে; তার মতো করেই সে তার অবস্থান গড়ে তুলবে। তবে সঙ্কট কিছু আসছে, সঙ্কট সব সময় থাকে। এক সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল, বিশেষত ফ্রান্সের লোকেরা বলেই ফেলেছিলেন যে, উপন্যাস আর হবে না। কিন্তু দেখা গেল, ফরাসি দেশে না হলেও উপন্যাস কিন্তু হলো, ল্যাটিন আমেরিকায় আবার উপন্যাসের একটা সময় এল, নিজস্ব আঙ্গিকে তারা উপন্যাস লিখলেন। হয়তো এক সময় এই ঘাটটা মরে আসবে। কবিতাকে একইভাবে বিভিন্ন সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের একটা মুশকিল হচ্ছে, আমরা যারা ষাটে শুরু করেছি, আমরাও কবিতা সম্পর্কে মূল শিক্ষাটা পেয়েছি ইংরেজদের কাছ থেকে। ইংরেজরা কথাগুলো আমাদের যেভাবে বলেছে, আমরা সেভাবে শুনেছি এবং বিশ্বাস করেছি। যেমন রোমান্টিসিজমের প্রথম আঘাতটা কিন্তু ইংল্যান্ড থেকে আসে নি, এসেছে ফরাসি দেশ থেকে এবং রোমান্টিকতা থেকে বের করে কবিতাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে লোকটিকে আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, তিনি হলেন অ্যাপোলিনেয়র, গিয়ম অ্যাপোলিনেয়র ও লাফার্গ এবং এলিয়ট ও পাউন্ড—এদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছি, আমি ধার করেছি কথাটা ব্যবহার করব না। তবে যে কথাটাতে আমি আসছি এবং তোমার কথাতেও সেটা বেরিয়ে এসেছে, আমরা যখন লিখতে বসি কোনো একটা মিডিয়ামে, আমাদের একটা ধারণা থাকে, যেমন, আজকে ছোটগল্পের কথা উঠল যখন, যিনি বাংলাদেশে আজ ছোটগল্প লিখছেন, তার বাংলা ছোটগল্প সম্পর্কে একটা ধারণা আছে, তিনি এক বিশেষ কাঠামোর মধ্যে বসে তার ছোটগল্পটা লিখতে চেষ্টা করেন। আমি যখন একটা কবিতা লিখি, আমারও একটা ধারণা আছে যে, কবিতাটার চেহারা হবে এই, কবিতাটি এই এই জিনিস মানবে, এই এই জিনিস মানবে না এবং আমাদের সাহিত্যে কবিতাবোধ বলে একটা ধারণা আছে—আমরা মনে করি এটা কবিতা আর এটা কবিতা নয়। আবার ঠিক একইভাবে যিনি নাটক লিখছেন, যিনি উপন্যাস লিখছেন তাদেরও তাদের মাধ্যম সম্পর্কে একটা ধারণা আছে। আমি মনে করি এই ধারণাগুলো এক সময় এসে একটা বাতাবরণ সৃষ্টি করে। কবিতাবোধের যে কথাটা বলছিলাম, সেটা পরিবর্তিত হয়েছে। যারা শেলি-কিটস পড়ে কবিতার ধারণা তৈরি করেছে, তাদের পক্ষে হোমারকে এতবড় কবি ভাবতেই কষ্ট হয় এবং ধারণা করতেও কষ্ট হয়।

আমাদের দেশে যারা খণ্ডিত আধুনিকতার চর্চা করতে এসেছে, তারা রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা বোঝে নি।
সেলিম আল দীন
তারা হোমারকে কাহিনিকার মনে করে।

মোহাম্মদ রফিক
হ্যাঁ, তার কাব্যিকতাটা কোথায় বুঝতে চেষ্টা করে না। দ্বিতীয়ত, ত্রিশের দশকে আমাদের এখানে এক ধরনের সমালোচনা তৈরি হয়েছিল যার পুরোধা বলা যায় বুদ্ধদেব বসুকে। এরা কবিতা বলতে কিছু জিনিস বুঝিয়েছে, হাহাকার, অপ্রাপ্তির জন্য বেদনা বুঝিয়েছেন, যেজন্য এর বাইরে যে কবিতা রচনা করা যায় এ জিনিসটা আমরা মানতে চাই না। আমরা মানলেও আমাদের হৃদয় মানতে চায় না, আমাদের হৃদয় মানলেও আমাদের শিক্ষা মানতে চায় না, এভাবে বিভিন্ন রকমের বিরোধ তৈরি হয়। এজন্য দেখবি, মূল সঙ্কটটা হলো—যেখানে আমরা আসতে চাইছি, আমরা লিখতে বসে কিছু অনুশাসন মানছি। আমাদের লেখাগুলো লেখার মতো হয়ে উঠছে না। সেখানে বিভিন্ন ধরনের আরোপ আসছে, এক. আমি কবিতা লিখতে চাইছি, দুই. আমি ছোটগল্প লিখতে চাইছি। আমি বলতে চাই যে, এইসব বাদ দিয়ে লেখাটাকে যদি আমরা ছেড়ে দিই, আমরা যদি ধরে নিই যে, লেখাটা লেখা হয়ে উঠবে, তা ছোটগল্প হোক, উপন্যাস হোক বা কবিতা হোক—আমার লেখাটা লেখা হয়ে উঠলেই হলো। এই জায়গাটার মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে। কারণ, এটা শুধু আমাদের সঙ্কট নয়, আগামীতে আরো অনেক সঙ্কট আসছে। যেমন মিডিয়ার সঙ্কট, আমরা বলি যে, মানুষ কবিতা পড়ে না। এক্ষেত্রে পাঠকের দোষ দিয়ে তো লাভ নেই, অন্য জিনিসে যদি তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়, কবিতা সে কেন পড়বে? সে নাটক কেন দেখবে, সে উপন্যাস কেন পড়বে? কবিতায় টিকে থাকতে হলে আমাকে আমার মতো করে আমার জিনিস তৈরি করে যেতে হবে। সুতরাং আমাকে লিখতে হবে। আজকে একজন লোক কবিতা না বুঝতে পারে, কিন্তু যেটা সে বুঝল না, সেটা যে কবিতা নয়—একথা কে বলেছে? অ্যাপোলিনিয়ের সম্পর্কে তো খুব ভালো ধারণা ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছে যে, অ্যাপোলিনিয়রকে মানুষ গ্রহণ করেছে। সারা পৃথিবীতে পরবর্তীকালে যে কবিতা লেখা হয়েছে বলা যায়, তার চেহারা অনেকটা ওই লোকটিই ঠিক করে দিয়ে গেছেন।

সেলিম আল দীন
এলিয়টের ভূমিকা?

মোহাম্মদ রফিক
এলিয়টরা তার বিষয়টাকেই আরো সম্প্রসারিত করেছেন। আমরা কী করি? একটি বিষয়কে প্রসারিত করি। সুতরাং আমার মনে হয়, প্রথম যা হওয়া উচিত, লেখাকে লেখার মতো হতে দিতে হবে। তাকে কোনো ধারণা দিয়ে বেঁধে রাখলে চলবে না।

মঈনুল আহসান সাবের
রফিক ভাই, আমার যেটা মনে হয়, লেখাটা যে লেখা হয়ে উঠবে বা লেখাটা যে লেখা হয়ে উঠল, এটা বুঝবে কে?

মোহাম্মদ রফিক
এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। এটা সবাই মিলে বুঝবে, এজন্য আমার বারবার মনে হয়েছে যে, সমষ্টির একটা ভূমিকা এসে যাচ্ছে। আমি লেখায় যে কথাটা বারবার বলছি, তা হলো সামষ্টিক দ্বন্দ্ব—রোমান্টিসিজম থেকে যে ধারাটা এসেছিল, একক মানুষের ধারণা, একক সৃষ্টিশীলতার ধারণা—এই ধারণাটা মনে হয় নিঃশেষিত। এখন সবার অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি আসার, একটা চিন্তায় আসার সময় এসেছে।

মঈনুল আহসান সাবের
লেখকের ব্যক্তিক চিন্তার বদলে সমগ্রের চিন্তায় যাওয়া—সামগ্রিক হওয়া?

মোহাম্মদ রফিক
হ্যাঁ তাকে সমষ্টির কাছে যেতে হবে, এটা এক ধরনের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া, এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া সেলিমও নিশ্চিত টের পায়। সে যে চরিত্রগুলো তৈরি করে, সে চরিত্রগুলো যেমন তার ওপর অভিঘাত তৈরি করে, সেও তেমন চরিত্রগুলোকে তৈরি করেছে।

সেলিম আল দীন
ইন্টারেকশন—

মোহাম্মদ রফিক
হ্যাঁ, ইন্টারেকশন। এই প্রক্রিয়াটা থাকতে হবে। কবিতার ক্ষেত্রে, ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও। আমার মনে হয় যে, এই যে আমি একা তৈরি করলাম—একার জন্য এই ধারণার দিন শেষ। ওটা করতে গেলে আর কিছুই হবে না এবং এই সম্প্রসারিত রূপটাকে আমাদের এগিয়ে নিতেই হবে; একটা মুক্তির, একটা স্বাধীনতার বিষয় ভিতর থেকে আসতে হবে। এই স্বাধীনতার বিশ্বাস ছাড়া আগামীর সাহিত্যচিন্তা চলবে না।

সেলিম আল দীন
আপনি কি স্বাধীনতাবাদী বলতে বোঝাচ্ছেন যে কবিতা যেভাবে লেখা হচ্ছে, এই ধারণাটার পূর্বকৃত না করে আমি আমার স্বাধীনতায়…

মোহাম্মদ রফিক
আমি বলছি কবিতার স্বাধীনতায় কবিতাকে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। আমি সেখানে একটা অনুঘটক মাত্র।

সেলিম আল দীন
এটা একটা চমৎকার ধারণা কিন্তু—

মোহাম্মদ রফিক
একটা অনুশাসন মেনে তো আমরা লেখা শুরু করছি। কিন্তু লেখাকে অনুশাসনের ভিতরে বেঁধে না রেখে, লেখাকে লেখার স্বাধীনতা দিয়ে দিতে হবে।

মঈনুল আহসান সাবের
তাহলে কি পাঠকের সঙ্গে আরো দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে?

মোহাম্মদ রফিক
আমার তো মনে হয় আশঙ্কা কমে। নেরুদার কবিতায় দেখি, নেরুদার কিন্তু অনেক ত্রুটি আছে। তা সত্ত্বেও অনেকে বলেছেন, নেরুদা হচ্ছেন সেই মহৎ লেখকের উদাহরণ যিনি অনেক মহৎ কাজের জিনিসও তৈরি করেছেন। আমি বলতে চাই, ওই যে মহৎ কাজের জিনিস তৈরি করেছেন তার কারণ তার কবিতা, কবিতার ভিতর থেকে এসেছে, তার কবিতায় যেটা বিচলিত করে আমাকে। তার কবিতা পড়লে মনে হবে না যে তিনি কোনো চিন্তাভাবনা করে লিখতে বসেছেন। ভিতর থেকে তার কবিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসারিত হয়েছে। আর আমরা আধুনিকতার নামে স্বতঃস্ফূর্ততাকে হারিয়ে ফেলি, সেটা হবে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের ব্যাপার।

সেলিম আল দীন
এখানে একটা এলার্মিং পয়েন্ট আছে শিল্পের ক্ষেত্রে। এলার্মিং পয়েন্টটা হলো যে, আমি নাম ভুলে গেছি, একজন এসথেটিসিয়ান, তিনি বলেছেন, শিল্পের ক্ষেত্রে ভাঙচুরের ব্যাপারটি এমন এক পর্যায়ে চলে এসেছে, যেটা শেষ পর্যন্ত শিল্পের জন্য আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াচ্ছে, দাঁড়াবে। আমি তখন খুব ক্ল্যাসিক্যালি—ক্ল্যাসিক্যাল চিন্তাগুলোকে আমি প্রাগ্রসর চিন্তায় রূপান্তরের চেষ্টা করছি। ’৭৭/৭৮ সালে। আমি খুব সাবধান হয়ে গেলাম এবং আমার মনে হলো যে, আমি একটা অদৃশ্যলোক থেকে আহ্বান পেলাম যে, লেখকের স্বাধীনতা এবং লেখার স্বাধীনতা, রফিক ভাই যেমনটি বলেছেন, কথাটি অসাধারণ। লেখার ভিতর থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা আর লেখকের স্বাধীনভাবে লেখা—দুটোর ভিতর কিছু হলেও পার্থক্য আছে। আমার প্রশ্ন হলা যে, আপনি যে কবিতার স্বাধীনতার কথা বলছেন, সেটি কি পূর্বের কোনো ধারায় অবগাহন না করেই একেবারে সম্পূর্ণ সার্বভৌম হয়ে উঠবে? না পূর্বের ধারাগুলোকে আত্মস্থ করে সে এগোবে? যদি আত্মস্থ করে, তাহলে জন ময়্যার আর জোসেফ রাম্বেলের ধারার, মিথের যে এক্সপ্লেনেশন, সে অনুযায়ী আমাকে বলতেই হবে, কোথাও না কোথাও কবিতায় বা শিল্পের শেষ পর্যন্ত রিচুয়াল থাকেই এবং আমি এক জায়গায় লিখেছি, শিল্পে ‘হবে’ কেউ নির্ণয় করতে পারে না, কিন্তু এটা হবে। কেন আমি জন্ডিস হলে হলুদ পাখির পালক ঝোলাব গলায়, তার কারণ কেউ বলতে পারে না।

মোহাম্মদ রফিক
একটি কথা তুই ঠিক বলেছিস, তুই যখন লিখছিস, তখন তো তুই অনুশাসন দিয়ে বাঁধা থাকছিস, তুই তো একটা জগতের ভিতরে থেকে লিখছিস। আমি যখন একটা কবিতা লিখছি, আমার তো মাথার ভিতর কবিতার একটা ধারণা আছে। ওটাকে বাদ দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, তুই যে কথা বলেছিস, আমাদের দেশে ইদানীং দেখছি কেউ কেউ সার্বভৌমত্বের কথা বলছে। শিল্প সাহিত্যে এইসব শব্দের কোনো জায়গা নেই। শিল্পসাহিত্য হচ্ছে একটা নদীর স্রোত। এ স্রোত চলে। কেউ এসে তাকে এগিয়ে নেয়; সম্প্রসারিত করে।

সেলিম আল দীন
যোগ করে।

মোহাম্মদ রফিক
যোগ করে সুতরাং যখন আমি লিখছি, তখন অনেক কিছু মেনে নিয়ে লিখছি। অনেক কিছু মেনে নিয়ে তার ভিতর থেকে আমি শুরু করেছি। এই যে মেনে নিয়ে আমি শুরু করছি, শুরু করার পর যে জিনিসটা গড়ে উঠছে, তাকে তার নিয়মে গড়ে উঠতে দেওয়া হোক। তাকে যেন আমি সব সময় অনুশাসনে বেঁধে না রাখি, আমি সব সময় কবিতাকে কবিতাই করার চেষ্টা না করি। হোক না, দেখা যাক না, সে কী হয়।

সেলিম আল দীন
এই কথাটি পাশ্চাত্যে আমার মনে হয়, এখনো সুবিদিত নয়। আমরা এখান থেকে বাংলা ভাষায়, যদিও আমাদের ভাষাগোষ্ঠী আকারে বিশাল, কিন্তু প্রচার খুবই সীমিত, আমার মনে হয় যে, রফিক ভাই আমাদের কালকে শেয়ার করছেন—এ কথা বলে যে, আমি কি লিখছি এটাকে বড় না ভেবে, কোন মাধ্যমে লিখছি, এটা না ভেবে, ভাবতে হবে যে আমি লিখছি। এক্ষেত্রে রফিক ভাইকে উত্তর অবশ্যই দিতে হবে যে, আমি কি বিশেষীকৃত, না নির্বিশেষীকৃত রূপটিকে পাব?

মোহাম্মদ রফিক
বিশেষ কথাটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

সেলিম আল দীন
অর্থাৎ আমি কোনো একটা বিশেষ ফর্মে আবদ্ধ না থেকে, ফর্মটাকে আমি ওপেন করে দিলাম।

মোহাম্মদ রফিক
আমি এটাই বলতে চাইছি যে, আমাদের একটা ধারণা আছে, যখন লিখতে বসি, কবিতাটা এইভাবে, এরকম করে লিখতে হবে। আমি ওটাতে রাজি না।

সেলিম আল দীন
আমি তো বরং বলতে চাইছি যে, কবিতা লেখার সময় মোহাম্মদ রফিক যেন মনেই না রাখেন যে, তিনি কবিতাই লিখছেন।

মোহাম্মদ রফিক
আমি মুক্ত করে দিতে চাই। আমি মুক্ত করে দিতে চাই, আমি এই পর্যন্ত হয়েছি। ব্যস, আমার অার করার কিছুই নেই। আমি এখানে জোর করে একটি পঙ্‌ক্তি ঢুকিয়ে মুখে আমি একটা ছিপি লাগিয়ে দিতে চাই না। আমরা যেটা করি যে, একটা অর্থ করতে হবে, একটা চেহারা করতে হবে, এটা একটা ছিপি আর কি, আমি এই ছিপি আঁটার পক্ষপাতী না। আমি ছিপিগুলো সব খুলে দিতে চাই।

সেলিম আল দীন
তাতে, বিশেষীকৃত মাধ্যম, এই মাধ্যমেই দায় থেকে কিন্তু আপনি মুক্ত হচ্ছেন না। আপনি কিন্তু শুরুতে বলেছেন যে, আমি লিখছি, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি কী লিখছি, কিংবা কোন মাধ্যমে লিখছি, ছোটগল্পের আকারে, উপন্যাসের আকারে না কবিতার আকারে লিখছি এটার চেয়ে বড় কথা হলো যে, আমি লিখছি। আমার আইডিয়াটা যে ওয়েতেই প্রকাশ পাবে, আমি ভাবছি, সেই ওয়েতেই আমি লিখছি। লোকে বলছে এটা কবিতা, আমার কাছে এটা কবিতা না, আমার কাছে এটা আট লাইনের একটা উপন্যাস মনে হচ্ছে, আমার কাছে এটা আট লাইনের একটা ছোটগল্প মনে হচ্ছে, আট লাইনের একটা নাটক মনে হচ্ছে, আট লাইনের একটা পেইন্টিং মনে হচ্ছে। আমি বলতে চাইছি যে, আঙ্গিকের নির্বিশৈষীকৃত প্রথম ধারণা আপনি দিয়ে পরে এর বিরোধিতা করছেন।

মোহাম্মদ রফিক
না, আমি কিন্তু প্রথম ধারণাটাকে সম্প্রসারিত করছি। একটি ধারণা তো আছেই। শুরুর সময় এ ধারণা কিন্তু সবার মধ্যেই থাকে যে, কবিতা এ রকম, এই তার ফর্ম, এই তার ছন্দ—কিন্তু আমি বলতে চাইছি, আমি এখন মনে করি যে, কবিতাকে তার নিয়মে গড়ে উঠতে দিতে হবে, অনুশাসনের নিয়মে নয় এবং সে হয়ে উঠতে গিয়ে আরো অনেক কিছুর দ্বারস্থ সে হতে পারে, সে উপন্যাসের দ্বারস্থ হতে পারে। সে নাটকের কাছে যেতে পারে—বহুকিছুর কাছে যেতে পারে। বাংলা কবিতা তো অনেকের কাছেই যায় নি।

সেলিম আল দীন
রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। এটা এক আশ্চর্য বিষয়।

মোহাম্মদ রফিক
হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। যেমন ধর, আমাদের দেশে ভাটিয়ালি গানের একটা ফর্ম আছে, ভাওয়াইয়ার একটা চেহারা আছে। আমাদের কবিতা কিন্তু কখনো ওই চেহারার কাছে যায় নি। আমাদের কবিরা ভাবেই নি এটাকে আত্মস্থ করার, এটাকে আত্তীকরণ করার একটা প্রয়োজন আছে। মনে রাখতে হবে, শিল্প, চারদিকে তার যে পরিবেশ থাকে—এটাকে ভূমি-সাংস্কৃতিক পরিবেশ বলো, জীবনযাপনের পরিবেশ বলো, তাকে দাঁড়াতে হলে সমস্ত পরিবেশটা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। রবীন্দ্রনাথ এ সমস্ত পরিবেশ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সমস্ত পরিবেশের আধুনিকতা তিনি নির্মাণ করেছেন। সে জন্য পরবর্তীকালে আমাদের দেশে যারা খণ্ডিত আধুনিকতার চর্চা করতে এসেছে, তারা রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা বোঝে নি।

বাংলা কবিতা শুধু বাংলা ভাষার কবিতা নয়, বাঙালির কবিতা, বাংলা কবিতা সেই মাত্রায়, যে মাত্রায় বিশ্ব পটভূমিতে দাঁড়াতে পারে।
সেলিম আল দীন
আমি রফিক ভাইয়ের সঙ্গে যোগ করছি—চিত্রা পর্বে নয়, সোনার তরী পর্বে, ‘সুখ’ কবিতাটার কথা—পাশ্চাত্য হার মানবে ওই সময় নাইনটিন সেঞ্চুরির শেষের দিকে, পদ্মাপারে লেখা, যে পদ্মার পাশে ভেসে যায় তরী প্রশান্ত পদ্মার স্থির বক্ষের উপরি, তারপরে তরল অর্ধমগ্ন বালুচর রোদ পোহাচ্ছে, একটা ন্যাংটো ছেলে ঝাঁপ দিচ্ছে। আমি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত একটা কবিতার উদাহরণ টেনে বলব যে, রবীন্দ্রনাথ এ কালের কি না! সেখানে উলঙ্গ বালক এই পদ্মার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বারংবার, কলহাস্যে ধৈর্যময়ী মাতার মতন, মনে হয় সুখ অতি সহজ-সরল। সুখ জিনিসটাকে তিনি কোন লেবেলে নামিয়ে এনেছেন; কত দৈনন্দিনতার কাছে এনেছেন। রফিক ভাই মৎস্যগন্ধা’য় দূর বলে একটা শব্দ ব্যবহার করেছেন। বিশ্বসাহিত্যে দূর কথাটা নানাভাবে নানা মাত্রায়, ঈনিড থেকে শুরু করে ভার্জিল, হোমার থেকে শুরু করে ঈনিড হয়ে ফেরদৌসী থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ হয়ে মোহাম্মদ রফিক পর্যন্ত সর্বত্র। কিন্তু সেই দূরটাকেই এত সংলগ্ন অথচ এত দূরত্বে সমকালীন কোনো কবিকে আমি করতে দেখি নি। মৎস্যগন্ধার প্রথম কবিতাটি। আমার কথা হলো যে, রবীন্দ্রনাথ যে জায়গায় একটা বালকের সামান্য লাফিয়ে পড়ার ভিতরে সুখ সহজ-সরল বলছেন, আধুনিককালে এবং ওইকালে সুখের সংজ্ঞা ছিল বিশাল চিত্তটিত্ত ইত্যাদি বিশাল আয়োজন। সেখানে এর ভিতর একজন কবি যে সুখ পাচ্ছেন, এটাকে, রফিক ভায়েরটাকে আধুনিকতা বলব না বুদ্ধদেব (বসু) বাবুদের ওইসব কবিতাকে আমি আধুনিক মনন বলব? জানালার পাশে একটা হাত দেখলাম, এই হাত আমি কোনোদিন দেখব না, এই হাত কত সেবা করে যাবে, রোমান্টিকতার একেবারে চূড়ান্ত।

মোহাম্মদ রফিক
শেষ আর কি।

জাফর আহমদ রাশেদ
রফিক ভাই বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ সমূহ পরিবেশ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, বলেছেন পরবর্তীকালে খণ্ডিত আধুনিকতার চর্চা যারা করেছেন তারা রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা বোঝেন নি। তাহলে, আপনি কি বলতে চাইছেন যে, রবীন্দ্রনাথের পর আর বাংলা কবিতা দাঁড়ায় নি?

মোহাম্মদ রফিক
দাঁড়িয়েছে—প্রশ্নটির উত্তর অন্যভাবে দিতে হবে। আমি দাঁড়ানো কথাটা শুধুমাত্র পায়ে পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলি নি। আমি কবিতার বিস্তারের কথা বলছি। আমি মনে করি যে, বাংলা কবিতা শুধু বাংলা ভাষার কবিতা নয়, বাঙালির কবিতা, বাংলা কবিতা সেই মাত্রায়, যে মাত্রায় বিশ্বপটভূমিতে দাঁড়াতে পারে। আমি সেরকম দাঁড়ানোর কথা বলছি। এখানে আমার বা সেলিমের—এরকম একক প্রচেষ্টার কথা বলছি না; সবার মিলিত প্রচেষ্টার কথা বলছি। কবিতার চর্চা হতেই থাকবে, অনেকে কবিতা লিখবে, লোকে বলবে, বাহ্!

জাফর আহমদ রাশেদ
এ পর্যন্ত আপনাদের বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারো নাম উচ্চারণ করা যায় নি। মাঝখানে সেলিম ভাই বুদ্ধদেব বসুর এক প্রস্থ সমালোচনাই করে ফেললেন। রফিক ভাই বলেছেন, ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়ার প্রসঙ্গ তুলে যে, আমরা দেশীয় পরিবশেগুলোর কাছে যাই-ই নি—

সেলিম আল দীন
বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে অনেক ছেলেমানুষি ছিল।

জাফর আহমদ রাশেদ
তাহলে বলতে চাইছেন রবীন্দ্রনাথের পর ওইভাবে বাংলা কবিতায় দাঁড়াবার চেষ্টায় হয় নি।

মোহাম্মদ রফিক
না, হয় নি। তবে এটা ঠিক, একক প্রতিভার প্রচুর ভালো কবিতা লিখেছেন কেউ কেউ, দাঁড়িয়েছেন। তার মধ্যে জীবনানন্দ দাশ আছেন। রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক জায়গাটা বুঝতে হবে। বাঙালি মধ্যবিত্ত যাকে আমরা বলি, এসব ভাষা ব্যবহারের আমি বিপক্ষে, যাদের উত্থান শুরু হলো মাইকেল থেকে বা বিদ্যাসাগর থেকে বা বঙ্কিম থেকে, সেই বাঙালি তার মননে-মানসে-সংস্কৃতিতে যে শীর্ষে পৌঁছেছিল, তার প্রতিভূ হলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন যে বাঙালি, সে কিন্তু সমস্ত পৃথিবী জুড়ে বাঙালি। তারপর থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালির এক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। এই পতনেরও মহত্তম মানবিক রূপ জীবনানন্দ দাশ। সুতরাং এটাকে নিয়ে কচলালে আরো চলবে। ব্যাপারটা ওখানেই শেষ। এরপর থেকে নতুন দিগন্তের যে বিস্তৃতি, তার মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা, যে দৌড়, সেই দৌড় বা সেই আকাঙ্ক্ষা বাংলা কবিতায় কোথায়? সে তো কচলাচ্ছে।

সেলিম আল দীন
এখানে একটা কথা বলা দরকার, যেটা রফিক ভাই আরো বিস্তারিত বলতে পারতেন—রবীন্দ্রনাথ বৈশ্বিক হয়ে উঠেছেন, বাঙালি হয়ে। কিন্তু পরবর্তীকালে তাকে ডিঙিয়ে তার থেকে আলাদা হওয়ার বাসনায়, কালের তাগিদে যারা ভাবলেন যে, তারা কবিতা লিখবেন, উপন্যাস লিখবেন, শিল্পচর্চা করবেন—তাদের মধ্যে কিন্তু পরানুকরনের মাধ্যমে বৈশ্বিক হওয়ার চেষ্টা ছিল। আর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকে আত্মস্থ করে, মধুসূদন বিশ্বকে আত্মস্থ করে বৈশ্বিক। এরা কিন্তু আত্মস্থ করেন নি, অনুকরণ করেছেন, এক জীবনানন্দ দাশকে বাদ দিয়ে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বেশকিছু অংশ বাদ দিয়ে, বিষ্ণু দের কিছু অংশ বাদ দিয়ে আমি বলব যে, ওরা বৈশ্বিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন অনুকরণ করে। সেই জায়গাটাতেই তাদের এস্থেটিক, নান্দনিক ভ্রান্তি।

মোহাম্মদ রফিক
এখানেও সেলিম একটা গোলযোগ, সেটা হলো, তারা অনুকরণ করেছেন বিশ্বকে নয়, ওরা অনুকরণ করতে চেয়েছেন ইউরোপকে, বিশ্ব আরো অনেক বড় ব্যাপার। বিশ্বে তো তখন বহু কিছু হচ্ছিল, সেগুলো নিয়ে তারা মাথা ঘামান নি, তাদের মাথায় ছিল কেবল ইউরোপ।

মঈনুল আহসান সাবের
আলোচনাটা মূলত কবিতায়ই থেকে যাচ্ছে, কিন্তু বিষয়গুলো যদি আমরা গদ্যের ক্ষেত্রে দেখি, নাটকের ক্ষেত্রে দেখি—

সেলিম আল দীন
আমার প্রশ্নটাতে আমি আবার ফিরে আসছি। আমার প্রশ্নটা কিন্তু কোনো বিশেষ শিল্পমাধ্যমের রূপ-রস-রীতি কী হবে তা নয়, আমার মূল অন্বেষণ হলো—একবিংশ শতাব্দীতে, আমি বলছি যে, ছোটগল্পের যেমন একটা উদ্ভাবন ঘটেছে আকস্মিকভাবে শিল্পবিপ্লবের পর, মানুষের নিজস্ব প্রয়োজনে, কোনো অমর্ত্য লোকের ধারণা থেকে এটা তৈরি হয় নি, মহাকাব্যের ক্ষেত্রে যেমন দাবি করা হতো, ছোটগল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে সে দাবি নেই। ধরে নিচ্ছি, কালের প্রবাহে মহাকাব্যের স্থান দখল করেছে উপন্যাস। কিন্তু মহাকাব্য তো একই সঙ্গে কবিতার দাবিও মিটিয়েছে। উপন্যাস তো তা পারে না, যদি না সেটা রবীন্দ্রনাথ-টলস্টয়-দস্তয়েভস্কি-মার্কেজদের মতো নভেল হয়। পৃথিবীর বহু শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আছে, যেগুলো কবিতার ভাবনা ঘিরেই সৃষ্ট। সে জায়গায় আমার মনে হয় যে, রিপ্লেসমেন্ট ওই অর্থে হয় নি, একটা পূর্ব ধারা মরে গিয়ে নতুন একটা ধারার জন্ম হয়েছে, খানিকটা ওটাকে কাভার করে। কারণ মানুষ উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করতে চাইলেও পারে না। চরম বৈজ্ঞানিকভাবে ফুটবল খেলার নিয়মকানুন বেঁধে দেওয়ার পরও টাইব্রেকার হয়। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই, সেটা বোঝা যায় যে, লাক, যার ভাগ্য ভালো সে জিতবে—শেষ পর্যন্ত ওই প্রাচীন জায়গায় ঘুরে আসতে হয়। আমার কথা হলো যে এর আঙ্গিকগুলোর ভিতর কোনো কোনোটি, শুরুতে আমি বলেছি যে, আমি আপনার দরবারে উপস্থাপন করছি যে, আঙ্গিকগুলো সঙ্কটাপন্ন। আপনি এটা মনে করেন কিনা জানি না, আমি মনে করি এবং আমার সঙ্গে সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশও মনে করে যে, আঙ্গিকের ক্ষেত্রে একটা দৈন্যদশা, একটা হ্যাজার্ড ফেস করতে যাচ্ছি। আমরা যারা ৩০ বছর ধরে লিখছি, আমার ক্ষেত্রে নাটক, নাটক মারা যাচ্ছে—এটা আমি টের পাচ্ছি। কিন্তু এটা স্বীকার করতে আমার খারাাপ লাগছে যে, নাটকের আর প্রয়োজন নেই। যিনি বড় কবি, তিনি নিশ্চিয় টের পাচ্ছেন যে, কোথাও স্নায়ুতন্ত্রী ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোমা চলছে, যিনি ঔপন্যাসিক তিনি চেষ্টা করছেন, কিছু গল্প, উপাখ্যান, আকস্মিকতা দিয়ে কোনো মতে কিছু একটা টিকিয়ে রাখতে। আমরা যারা একালে লিখছি, একুশ শতক শুরু হওয়ার মাত্র আর এক বছর নাকি, একালে আমরা যারা বিষয়টি ফিল করে ফেললাম, যদিও সমাধান আমাদের হাতে নেই, কারণ—রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণ দিয়ে বললে, ‘তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার’, আমরা কি একটা ইমাজিনারি শিল্পরীতির কথা, হতে পারে একটু কল্পিত, যাতে প্লেটো-প্লেটো একটা ভাব আসবে—এ ধরনের শিল্প হবে, এ ধরনের কাজ হবে, এটা ডিটারমিন করতে যদিও আমরা পারি না, কিন্তু উই ক্যান সাজেস্ট ফিউচার অথবা হিন্স করতে পারি কি না, আসলে ডেস্ট্রয়েশনটা এই পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং তা থেকে এ ধরনের শিল্পযাত্রা নতুন করে পৃথিবী শুরু করতে পারে। অথবা এগুলোরও অবলেশগুলো ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এক সময় শিল্প নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। দুটোর ভিতর কোনো বিকল্প নেই আমি বিশ্বাস করি, স্ট্রংলি এটা আমি বিশ্বাস করি। এ ধারায় শিল্প মারা যাবে, আর এ থেকে বাঁচতে হলে নতুন পথের অন্বেষণ করতে হবে। আপনি কোনটাকে অনিবার্য মনে করছেন টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরির জন্য?

মোহাম্মদ রফিক
সেলিমের বিশ্বাসের জোর আছ, কিন্তু আমার পক্ষে এটা মানা খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে যে, এই শিল্প মাধ্যমগুলো শেষ হয়ে যাবে। আমার মনে হয় যে, শেষ হয়ে যাবে না, এক ধরনের নতুন জন্ম হবে। আমি প্রথম বলেছি যে, লিল্প তার নিজস্ব প্রয়োজনে নিজে পথ তৈরি করে নেয়। ধরা যাক উপন্যাস। উপন্যাস বারবার সে নিজের চেহারা পাল্টেছে। ভুল করে এগুলোকে এক সময় বলতাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আসলে তা নয়। একজন লেখক শুধু তাই লেখেন যা না লিখে তার কোনো উপায় নেই। সুতরাং ওটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলা উচিত না। আসলে উপন্যাস তার প্রয়োজনে জয়েসের হাতে এক রূপ নিয়েছে, টলস্টয়ের হাতে এক রূপ নিয়েছে। আবার আধুনিককালে মার্কেজ, ফুয়েন্তেস—এদের হাতে একটা রূপ নিয়েছে। কবিতাও বিভিন্ন লেখকের হাতে এক একটি রূপ নিয়েছে। একজন কবি এ ধরনের কবিতা লিখেছেন,এ কথা না বলে, আমি মনে করি, বলা উচিত, কবিতা তাকে বাধ্য করে ওই রূপ তৈরি করিয়ে নিয়েছে। প্রকৃত লেখার মধ্যে এমন কিছু থাকে যে, ওটা না করে লেখকের উপায় থাকে না। তুমি দেখবে, কবিতা লিখতে গিয়ে যে লাইনটি আমি পরে ইচ্ছা করে বসাচ্ছি, ওটাই বাজে লাগে। সুতরাং কবিতা কবির মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করিয়ে নেয়। সেলিম যে সঙ্কট ও বিপদের কথা বলছে, সেটা তো অবশ্যই আছে। আমরা প্রত্যেকে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখানে সাবের আছে, তোমরা আছ, সঙ্গে সঙ্গে আমরা কি এটাও টের পাচ্ছি না, সেলিমও কি টের পাচ্ছে না—সেলিমের নাটক দেখলে অবশ্য বোঝা যায়, সেও টের পাচ্ছে যে, তার নাটকই তাকে দিয়ে এমন সব কাণ্ডকারখানা করিয়ে নিচ্ছে যা সেলিম ১০ বছর আগেও চিন্তা করত না। আমার কবিতাও আমাকে দিয়ে এমন সব কাণ্ড করিয়ে নিচ্ছে, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এ কি সম্ভব ছিল? এই সম্ভাবনা ছিল না তা আমি বলছি না। আমি স্বাধীনতার ওপর জোর দিচ্ছি। সম্ভাবনার দরজা কোনোদিন বন্ধ করে দেওয়া চলবে না। বললে চলবে না যে, এটাই কবিতা, এটাই উপন্যাস, এটাই নাটক—আর কিছু নয়। সেলিম আজ বনপাংশুল লিখতে বসেছে কেন? সে মনে করে নি যে, হাতহদাই তো ভোলোই লিখেছি, লোকে প্রশংসাও করেছে, সুতরাং আমাকে এখানেই থাকতে হবে, এটাই করব। সেলিমের শক্তি তাকে দিয়ে বনপাংশুল লিখিয়ে নিয়েছে। অথবা বনপাংশুলের ব্যাপারটাই তাকে দিয়ে সৃষ্টি করিয়ে নিয়েছে। এখন কারো মনে হতে পারে, বনপাংশুলের এই জায়গাটা হাতহদাইয়ের চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু এই যে, নিজেকে শিল্পের তাগিদে বারবার নির্মাণ করে নেওয়া এবং শিল্প যে আমাকে এ জায়গায় দাঁড় করাচ্ছে, এ জায়গাটার কথা সব সময় মনে রাখতে হবে। দেখা যাবে, আজকে সেলিম যেমন বনপাংশুল লিখছে, হয়তো আগামী শতাব্দীতেও আর একটা কিছু অদ্ভুত কিছু তৈরি করছে, যা আগে জানা ছিল না, হয়তো আমিও এমন কিছু লিখব, আমার পাঠকরা বা আমি ভাবব যে, এটা তো আমাদের চিন্তার মধ্যে ছিল না! হয়তো সাবেরের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। সেলিমের কথার একটা দিক—শিল্পের কখনো মৃত্যু হবে না, কারণ মানুষের মৃত্যু হবে না অতএব শিল্পেরও হবে না। যেমন অনেকে ভাবছে যে, সমাজতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে, আসলে মানুষের এ ধরনের মৌলিক আকাঙ্ক্ষা, সব মানুষ ভালো থাকবে—এটা মানুষের মৌলিক আকাঙ্ক্ষা, এ আকাঙ্ক্ষার কোনোদিন মৃত্যু হতে পারে না। একটা সরকারের, একটা অবস্থার মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা থেকে যাবে। শিল্পে মানুষের আর একটা মূর্তি দেখার আকাঙ্ক্ষা আছে এটা কোনোদিন যাবে না। এই আকাঙ্ক্ষাই তরুণদের দিয়ে আরো নতুন কিছু করিয়ে নেবে।

একটা কথা মনে পড়ছে, একই ধরনের একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল পাবলো নেরুদাকে। ১০০ বছর পর লোকেরা কি কবিতা পড়বে? নেরুদা বলেছিলেন : আমি তো আর কারো সম্পর্কে বলতে পারব না, আমার লেখা সম্পর্কে বলতে পারি যে, ১০০ বছর পর আমার লেখা পাঠের প্রয়োজনীয়তা কেউ বোধ করবে না, তবে একজনকে তারা পড়বে, তিনি হলেন হোমার। আমরাও হয়তো বলতে পারব ১০০ বছর পর আমাদের কেউ পড়বে না। কিন্তু আমরা কি বলতে পারব যে, ব্যাসদেব পড়বে। বা, রবীন্দ্রনাথ পড়বে না? আরেকটা ব্যাপার আছে শিল্পে, মানুষের একটা মৌলিক রুচির ব্যাপার থাকে শিল্পে, লেখা একটা রুচির জায়গা তৈরি করেন। এই রুচি কখনো মরার নয়। সুতরাং এই রুচি নিশ্চয় বারবার ঘুরে ফিরে, বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আঙ্গকে সে একটা পরিবেশ তৈরি করিয়ে নেবে। তাতে করে অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়ে যাবে, আজকের এই শিল্পের চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যাবে, কবিতার চেহারা, নাটকের চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এমন হতে পারে যে, নাটকের জন্য আর মঞ্চের প্রয়োজন হবে না।

কোটি কোটি বছরের যে বিবর্তনের ধারা আমরা বহন করে আসছি এই ধারার মধ্যেই শিল্পসৃষ্টির তাগিদটা রয়ে গেছে। কাজেই এটি নষ্ট হবে না।
সেলিম আল দীন
এখনই তাই শুরু হয়ে গেছে।

মোহাম্মদ রফিক
দেখা যাবে যে, মঞ্চে অন্য জিনিস হচ্ছে। কবিতার মতো নাটকও হয়তো পড়ার জিনিস হয়ে যাবে। সুতরাং সম্ভাবনার দ্বারগুলো উন্মুক্ত রাখতে হবে সব সময়।

মঈনুল আহসান সাবের
লেখার হয়ে ওঠার ব্যাপরটা বলছিলেন রফিক ভাই। সেলিম ভাইকে বলছি, বনপাংশুল কি আপনা আপনিই বনপাংশুল হয়ে উঠেছে? না একেবারে তীব্রভাবে নির্ধারণ করেছেন বিষয়টি।

সেলিম আল দীন
না, আমি নির্ধারণ করি নি, প্রথমত, অমি ৮০ পাতার মতো লিখলাম। লিখে দেখলাম যে, কিছুই হয় নি। হয় আগের মতো হচ্ছে অথবা কিছুই হচ্ছে না। আগের মতো হওয়াটাও কিছু না হওয়ার সমান। আমি ছিঁড়ে ফেললাম এবং হাত গুটিয়ে বসে রইলাম। আমি দেখলাম যে, গল্পটিতে মানুষগুলো যে যেভাবে আসে এসে যাক, কেউ যদি গানে গানে কথা বলতে চায় বলুক, কেউ যদি নেচে নেচে কথা বলতে চায় বলুক, তারপর যা চেহারা দাঁড়াবে—দাঁড়াবে। মাঝামাঝি জায়গায় হঠাৎ আমার মনে হলো, কি রে, এ রকম ফর্ম তো পূর্বপুরুষরা করে গেছেন, সুতরাং আমার সামনে আর কোনো দ্বিধা রইল না। আমি দেখলাম যে, আমি যেমন করেছিলাম পঞ্চ উপাদানের সমষ্টিতে, হ্যাঁ, নানা ধরনের সবগুলো যদি অন্বিত হয়ে থাকে, এক জাযগাতে, তাহলে যা দাঁড়ায় আমার লেখা তাই। এটাকে নাটক হিসেবে ‘শৈলী’ ছাপতে চাইল না, নাম দিয়ে দিল উপাখ্যান। আমি বললাম, তাতে কিছু আসে যায় না। নাম তুলে দিলেও ক্ষতি নেই। কাজেই রফিক ভাইয়ের কথাটা ঠিক। তবে শিল্পের মৃত্যুর কথাটা আমি বলি নি। আমি বলেছি যে, শিল্পমাধ্যমের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, কবিতার যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, নাটকের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, অনবরতই আমরা কবিতা-নাটক লিখতে থাকি, আস্তে আস্তে লোকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু শিল্প কখনো মরবে না, একজন মানুষ জীবিত থাকলেও। কারণ মানুষের যে নিউরোবায়োলজিক্যাল বা স্নায়ুজৈবিক পরিবর্তন তার ভিতরে প্রপার এবং হকিংস, ইকলিস—এরা প্রমাণ করে ছেড়েছেন যে, স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যেই মানুষের কিন্তু রূপ সৃষ্টির স্পৃহা এবং প্রপারেরা থ্রি ওয়ার্ল্ড থিয়োরি দিয়েছেন সোসাইটির বিবর্তনের ক্ষেত্রে। থ্রি ওয়ার্ল্ড থিয়োরিতে সেকেন্ড ওয়ার্ল্ডে শিল্প নির্মাণ, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে সারভাইব, থার্ড ওয়ার্ল্ডে গিয়ে বিজ্ঞান, কোয়েশ্চেন, তর্ক ইত্যাদি। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ডটাই হচ্ছে শিল্পসৃষ্টি। অর্থাৎ কোনো কুঠার তৈরি করতে গেলেও নিউলিথিক যুগের বা পেলিউলিথিক যুগের সেই কুঠারের একটা শেভড তাকে দিতে হতো এবং দিতে গিয়ে সে, স্নায়ুজৈবিক কারণেই সৌন্দর্য বের করত। কাজেই যারা ভাবছে যে, শিল্প একটি মানবজাতির বানানো লেখা—তা একেবারেই নয়। এই আঙুল এই শরীর যতদিন আছে এবং কোটি কোটি বছরের যে বিবর্তনের ধারা আমরা বহন করে আসছি এই ধারার মধ্যেই শিল্পসৃষ্টির তাগিদটা রয়ে গেছে। কাজেই এটি নষ্ট হবে না।

মঈনুল আহসান সাবের
আমি একটু পিছনে ফিরতে চাই। সেলিম ভাই বলেছেন যে, বনপাংশুল কিছু পৃষ্ঠা লিখে আপনি ছিঁড়ে ফেলেছেন, কিছু হচ্ছে না। কিছু হচ্ছে না মানে কী? আপনি যে বিষয়টা বেছে নিয়েছিলেন। সে বিষয়গত কারণে কি আপনার মনে হলো যে, বিষয়টা যেভাবে উপস্থাপন করা দরকার, সেভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন না? নাটক—এই মিডিয়াটার সঙ্গে দর্শকের দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে।

সেলিম আল দীন
শকুন্তলার পর আমি আর কখনোই মঞ্চ নিয়ে চিন্তা করি নি। আমার নাটকটি মঞ্চস্থ হোক বা না হোক তাতে আমার কিছু আসে যায় না। এক অর্থে আমি মোটেই নাট্যকার নই, আর এক অর্থে আমি হয়তো নাটক লিখি কিংবা দৃঢ়ভাবে সবাই বলাতে আমি বিশ্বাস করি যে, আমি নাটকই লিখি। আসল কথা, কিভাবে আমি লিখব বিষয়টা, আমার আইডিয়াটা কিভাবে আমি উপস্থাপন করব। একটা গোত্রের একটা মেয়ে মদের শুদ্ধতাটাকে নাটকের শেষ পর্যন্ত, বহু সামাজিক-রাজনৈতিক আবর্তের সংঘাতের মধ্য দিয়ে বহন করে নিয়ে যাবে। বিষয়টি কোনভাবে আমি বলব। এই বলার ক্ষেত্রে দেখা গেল যে, আমি—এ রকমই আমার সেই অস্থিরতার কালটা কিভাবে লিখবে, আমি কাউকে কাউকে বাচ্চাদের মতো কোয়েশ্চেন করতে শুরু করলাম—পাঁচবার আমাকে ওই এলাকায় যেতে হয়েছে।

মোহাম্মদ রফিক
সাবের যে প্রশ্নটা করেছে, সে প্রসঙ্গে আমি একটু বলি! এটা আসলে একটা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় চলে, লেখক যেমন তার চারদিকের মানুষগুলোকেই তৈরি করে, ওরাও লেখককে তৈরি করে দেয়, যতক্ষণ পর্যন্ত এই তৈরির প্রক্রিয়াটা চলে, ততক্ষণ এই অস্থিরতাটা থাকে। সেলিম বলছে যে, আমি অমুককে জিগ্যেস করেছি, কীটসের একটা বিখ্যাত পঙ্‌ক্তি শোনা যায় যে, তার পাশে যে কাজ করত, কবিতার সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই, সে বলছে যে, তোমার শেষ পঙ্‌ক্তিটি ভালো হয় নি। তুমি এটা পাল্টে কি করা যায় করো। দেখা যায়, একজন লোক, সাহিত্যের সঙ্গে যার কোনো যোগাযোগই নেই, সে তোমাকে লেখার ব্যাপারে অনেক বেশি সাহায্য করছে, একজন পণ্ডিতের চেয়ে।

মঈনুল আহসান সাবের
একটা কথা আমার মনে হচ্ছে যে, বিষয়টা তিনি কিভাবে উপস্থাপন করবেন সেটা নিয়ে তীব্রভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন, ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাহলে প্রথম থেকে যে কথা বলা হচ্ছে যে, একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে এত কি অস্থির হওয়ার কোনো কারণ আছে? বিষয়ই তো ঠিক কের দেবে উপস্থাপন ভঙ্গি আঙ্গিক কী হবে।

মোহাম্মদ রফিক
অস্থিরতার নিশ্চয় কারণ আছে। কারণ প্রশ্ন হচ্ছে। প্রশ্ন তো থাকবেই। আমি তো বলতে চাইছি যে, আমি সেলিমের মতো এভাবে ভাবি নি। কিন্তু প্রশ্নের ওপর উত্তরটা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। আমরা যদি সচেতন থাকি এবং শিল্পের মূল ব্যাপারটা বুঝে নিই যে, শিল্পের মূল ব্যাপারটা কী—এটা কোনো বাঁধাধরা বিষয় নয়, শিল্পের মূল বিষয়টি হচ্ছে শিল্পের ভিতরে থেকেই শিল্পের এবং মানুষের দুজনেরই মুক্তি থাকতে হবে। দুজনেরই স্বাধীনতা থাকতে হবে। যেখানে রোমান্টিকরা মানুষকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষকে বাদ দিয়ে আমার কোনো কবিতা হয় না, সেলিমের কোনো নাটক লেখা হয় না। সুতরাং সবটাই একটা প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত হবে। আমাদের লেখার ভিতর দিয়ে সেটা আঙ্গিক যেটাকে আমরা বাংলায় বলেছি পরগ্রহণ করবে, অবশ্য বাংলাটা আমার কাছে অশ্লীল মনে হয়—এভাবে একটা বিষয় এসে দাঁড়াবে।

সেলিম আল দীন
আপনি খুব বেশি মাত্রায় সময়ের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন না?

মোহাম্মদ রফিক
তা ছেড়ে দিচ্ছি না। আমরা ছেড়ে দিচ্ছি বিবর্তন ধারার ওপর এবং এটার ওপর সবকিচু ছেড়ে দিতে হবে।

সেলিম আল দীন
তাহলে কার্ল মার্কসের সেই ইতিহাসকে পরিবর্তন করতে হবে। এই প্রশ্নটি আসছে কেন?

মোহাম্মদ রফিক
পরিবর্তন তো করবেই, কিন্তু—

সেলিম আল দীন
আমরা করেছি সেটা। কালে কালে ইউরোপ তার চাহিদা অনুযায়ী কাপড়ের ফ্যাশনও বদলেছে, কবিতার ফ্যাশনও বদলেছে।

মঈনুল আহসান সাবের
এটা কি একেবারে বুঝেশুনে ধরেবেঁধে বদলেছে?

সেলিম আল দীন
হ্যাঁ, ধরেবেঁধে বদলেছে। লিরিক্যাল ব্যালাডে তো তাই ঘোষণা দেখতে পাচ্ছি।

মোহাম্মদ রফিক
বদলাতে গিয়ে বিভ্রাটও হয়েছে। আমাদের সময়ের বিভ্রাট হবে। বিভ্রাট এড়েয়ে কখনো শিল্প হয় না। সৃষ্টি হয় না।

সেলিম আল দীন
কিন্তু তাজমহলের মতো সৃষ্টির কথা যখন ভাববেন তাজমহল নির্মাণে ভুল হলে তো চলে না।

মোহাম্মদ রফিক
তোর কথাটা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়, কারণ এটা আমাদের প্রত্যেককে প্রস্তুত করে নেবে। এজন্য তোকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। কিন্তু প্রস্তুত হতে গিয়ে তড়িঘড়ি যদি বেশি করে ফেলি তাহলে একটা বিভ্রাট—কালকে গিয়েই যদি ভাবতে শুরু করি যে, কথাটা তো ঠিক, সুতরাং পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে যাবে, এটা শিল্প হবে না।

সেলিম আল দীন
আমার ভিতরে এ প্রশ্নটার জন্ম হয়েছে নাইনটি থ্রি-ফোরে। আমার মনে হচ্ছে যে, আমি ঠিক নাটক লিখতে পারছি না কেন বা এ রকম কেন, নাটকে বাম পাশে নাম থাকবে, ডান পাশে সংলাপ—এরকম থাকতে হবে, লিখতে হবে এর কি মানে আছে?

[কয়েক মিনিট বিরতি]

সেলিম আল দীন
টিএস এলিয়টের সিলেক্টড প্রোজে আছে, মৌলিক স্রষ্টা যারা, শেষ পর্যন্ত প্রবন্ধ লেখে তাদের নিজের লেখাকে বাঁচার জন্য। আপনি সাহিত্যের অধ্যাপক, আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন, রফিক ভাই যে কলামগুলো এখন কাগজে লিখছেন ওগুলো টু সাপোর্ট হিজ মেইন ওয়ার্কস তার মূল কাগজগুলোকে বাঁচানোর জন্য।

মঈনুল আহসান সাবের
আপনি নিজে প্রয়োজন বোধ করছেন?

সেলিম আল দীন
না এটা হচ্ছে আমার স্থাপনার চারপাশে একটা বাউন্ডারি ওয়াল তৈরি করা। যাতে তিরন্দাজের, সমালোচকদের তিরগুলো এসে আটকে যায়।

মোহাম্মদ রফিক
আমি এক সময় ভেবেছিলাম, আমি গদ্য লিখব না। আমার একটা ধারণা ছিল যে, যা কিছু কবিতায় লেখা যায় না তা লেখার দরকার নেই। তারপরও গদ্য লিখেছি একেবারেই যে লিখি নি তা নয়। কিন্তু কখনো বইটই করব ভাবি নি।

সেলিম আল দীন
রফিক ভাইয়ের গদ্য, ইনফরমেশন এবং এনালাইসিস একসঙ্গে পাওয়া যায়, যা আমি বলব যে প্রায় দুর্লভ। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিশ্লেষণ।

মোহাম্মদ রফিক
আমাকে যখন প্রথম লিখতে বলা হলো, আমি প্রথম এটাকে খেলা হিসেবেই নিয়েছি। আমার এখনো ধারণা, আমার কবিতা লেখার ব্যাপারটা আর গদ্য লেখার ব্যাপারটা একটু আলাদা।

সেলিম আল দীন
না, না আপনার সংবাদের যে কলামটা সেটা পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, কবির মন নিয়ে আপনি শিল্পবোধের তাড়নায় এক ধরনের প্রতিবাদী গদ্য লিখেছেন। কিছু লেখা আছে রফিক ভাই, মঈনুল আহসান সাবেরও জানে, জাফরও জানে যে, যেগুলো ফরমায়েশি লেখা সেগুলোর ভিতর এক ধরনের বার্ডেন ফিল আপনি করবেন। এগুলোতে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে না। যেমন আমি ভোরের কাগজে গিয়ে বলেছি যে, আমি ঘন ঘন দেখা করছি, আমার কিন্তু লেখা দেওয়ার জন্য কোনো বাসনা নেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। সাবের বেশ লজ্জাও পেয়েছিল।

মোহাম্মদ রফিক
গদ্য লিখতে গিয়ে এখন কিন্তু বেশ মজাই লাগছে। মাঝেমধ্যে গদ্য লিখতে বেশ ভালোই লাগে এবং ও যে কথা বলেছে এটা কিন্তু ঠিক যে, কবিতায় অনেক কথাই বলা যায় কিন্তু সব কথা বলা যায় না। সব কথা বলার জন্য একটা আলাদা জায়গা।

সেলিম আল দীন
একটা ফর্ম তো আছেই। পাঁচালি। ইভেন ইউ ক্যান পুট পেইন্টিং। ইফ ইউ অ্যাট অল বিলিভ, শাহ মুহম্মদ সগীরের জোলেখা গবেষণার কাজে পড়তে গিয়ে হঠাৎ করে মাঝরাতে দেখলাম যে, পাঁচালি কাজের মধ্যে দেখা যাচ্ছে দৃশ্য এক, দৃশ্য দুই, দৃশ্য তিন। এটা তো নাটক না, তাহলে এটা কী? পরে আমি গবেষণা করে বের করলাম যে, ওটি পটচিত্র। অর্থাৎ পাঁচালি পেইন্টিংকে অ্যালাউ করছে। এটা আমাদের মূল আঙ্গিক। পেইন্টিংকে পর্যন্ত আত্মীকৃত করেছে পাঁচালি। জনগণের শিল্প তো! জনগণ যেমন যেটা পছন্দ করেছে গায়েন সেভাবে জুড়ে দিয়েছেন। এভাবে বাঙালি একটা ক্লাসিক ফর্ম জনগণের থেকে উঠিয়ে এনে দিয়েছেন, যেটা আলাওলের মাধ্যমে রাজদরবার পর্যন্ত বিস্তৃত। আলাওলের ভাষা এবং মধুসূদনের ভাষার তফাত নির্ণয় খুবই কঠিন।

জাফর আহমদ রাশেদ
আজকের আলোচনায় আঙ্গিকের বিষয়টা একটু বেশি আসছে।

সেলিম আল দীন
আসছে, কারণ আমাদের নির্ধারণ করতে হবে এই স্রোতটা কোনদিকে কোন আধারে যাবে।

মোহাম্মদ রফিক
আঙ্গিক নিয়ে চিন্তাটা এজন্য প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, এভাবেই কি সব থাকবে? না সবকিছু মিলেমিছে যাবে?

মঈনুল আহসান সাবের
আর একটু সীমিত পরিসরে আসি না কেন? বাংলাদেশের কবিতার আঙ্গিকগত সমস্যা বা সম্ভাবনা।

সেলিম আল দীন
আমি আর একটু বলি, তারপর অন্যদিকে যাওয়া যেতে পারে। ছোটগল্পের কাতারে ওয়ান অফ ওয়ে বলে এক ধরনের লেখা শুরু হয়েছিল। স্টকহোমে দ্রামাস্তিকা ইনস্টিটিউটের আমার একটা বক্তৃতা ছিল, এমএ ক্লাসের নাট্যরচনা বিষয়ক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। আমি বললাম, যদি দুই অঙ্ক না থাকে তবে এক অঙ্ক বলো কী করে? উপন্যাস ছোটগল্প একাঙ্ক (অস্পষ্ট) এই কাতার থেকে একাঙ্ক কি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় নি? একজন বড় লেখক আছেন যিনি একটি একাঙ্ক লিখেছেন গত ৩০ বছরে? উপন্যাস ছোটগল্প কবিতা একই রণক্ষেত্রে সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। একজন সহযোদ্ধা পড়ে যাওয়ার পরই বোঝা উচিত যে, যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান শিল্পের মাধ্যমগুলোতে। অতএব বাকিদের সতর্ক হতে হবে আত্মরক্ষার জন্য অথবা ওই পরিণতি বরণ করবে। ছোটগল্পও মৃত—আমি বলতে পারি।

মঈনুল আহসান সাবের
মৃত মানে কী? মূলত কি আঙ্গিকগত কারণে?

সেলিম আল দীন
যা-ই হোক অ্যাজ এ ফর্ম এটা আর টিকছে না। রবীন্দ্রনাথর ‘সমাপ্তি’কে আমি কবিতার আকারে সাজাতে পারি।

মোহাম্মদ রফিক
এমনও হতে পারে, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আবার হয়তো কোনো লেখকের হাতে এটি প্রয়োজনীয়তা ফিরে পাবে।

সেলিম আল দীন
আপনি নিশ্চয় দাবি করতে পারেন না যে, হোমারের স্টাইলে আর কেউ পৃথিবীতে মহাকাব্য লিখবে। আপনি জানেন যে, এরিস্টটলের কালেও বেশ কয়েকটি মহাকাব্য রচনার চেষ্টা করা হয়েছে, এগুলো এক্কেবারে যাচ্ছেতাই মহাকাব্য।

মঈনুল আহসানে সাবের
আপনি কি কবিতার মধ্যে যথেষ্ট উচ্ছ্বাস বা তীব্রতা পাচ্ছেন?

সেলিম আল দীন
কবিতা যখন ভালো হচ্ছে, পাচ্ছি। কিন্তু আলটিমেটলি, যূথবদ্ধভাবে যখন কবিতাকে দেখছি সারা পৃথিবীর মানচিত্রে তখন মনে হচ্ছে যে, একটা থ্রেটিং কন্ডিশন আছে। নট দ্যাট দি ইটশ এ টাইম মিডিয়ান, আমি এটা বলছি না। থ্রেট ভেরি এক্সিজেনসি থ্রেট।

মঈনুল আহসান সাবের
এটা আমরা বিচার করব কিভাবে? পাঠক দিয়ে বিচার করব না নিজের উপলব্ধি দিয়ে?

সেলিম আল দীন
দুভাবেই আমরা করতে পারি।

মঈনুল আহসান সাবের
পাঠক দিয়ে বিচার করলে, কবিতার অবস্থা সারা পৃথিবীতে আরো খারাপ। তারপর হয়তো গল্পের অবস্থা খারাপ। এদিকটা তো আমাদের তাহলে একটু বিশ্লেষণ করতে হবে।

গ্রিকরা তাদের অঙ্কশাস্ত্র, দর্শন নিয়েছে সুমেরীয়দের কাছ থেকে, একইভাবে তারা নাটকের ঐতিহ্য নিয়েছে আফ্রিকানদের কাছ থেকে।
সেলিম আল দীন
আমার ধারণা, গল্পের চেয়ে কবিতার অবস্থা পৃথিবীতে এখনো ভালো।

মোহাম্মদ রফিক
কবিতার আর একটা বিচার আছে। সেটা হচ্ছে যে, কবিতা আদি শিল্প। কবিতা নিজের কারণে নিজের মধ্যে আরো কতগুলো জিনিস আত্মীকরণ করে নিয়েছে। কবিতার ভিতরে সংগীতের ব্যাপর আছে, চিত্রকলার ব্যাপার আছে সুতরাং কবিতাকে যতই মনে হয় যে, একা একা, কবিতা কিন্তু আসলে একা নয়। ছোটগল্প অনেক পরে পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকে এসেছে। যদিও আগে যে ছোটগল্প ছিল না তা নয়।  ঊনবিংশ শতকে ছোটগল্প তার নিজের চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে। পৃথিবীতে ছোটগল্প থাকবে না, এটা কিন্তু আমি বলব না, কারণ এর জন্য আমার অনেক বেদনাবোধও আছে। আমার সব সময় মনে পড়ে যে, ছোটগল্প মানে হচ্ছে মোপাসা, শেখভ—এরা আমার প্রিয় লেখক। এটা যে থাকবে না—এবং এই বিষয়টি অন্যভাবে আসতে পারে। সেটা কারো হাতে এলে আমি বুঝব। আমার ধারণা, ছোটগল্প নিজেকে তৈরি করে নেবে। ছোটগল্প আগামী সংকটের জন্য নিজের চেহারাটা পরিবর্তন করে নেবে। হয়তো সেও কবিতাকে নেবে, তার চেহারাও দেখা যাচ্ছে। যেমন আমাদের দেশেও দেখা যাচ্ছে।

আমরা তিন হাজার বছরের ব্যবধানে হোমারের দিকে তাকাচ্ছি। ফলে আমরা বলতে পারছি হোমার এই আর বাদবাকিরা এই। আজ থেকে তিন হাজার বছর পরে যখন এদিকে তাকানো হবে তখন আজকের সাহিত্যের কোন রূপটা ধরা দেবে এটা বলা কিন্তু মুশকিল। আমেরিকায় একটি আলোচনায় আমি অংশ নিয়েছিলাম। হঠাৎ শেক্সপিয়রের প্রসঙ্গ এল। আমরা দু শ বছর ধরে জেনেছি শেক্সপিয়র মহানাট্যকার। কথায় কথায় একজন আমেরিকান ঔপন্যাসিক আমার কাছ জানতে চাইল যে, শেক্সপিয়র যে মহানাট্যকার তুমি কি করে জেনেছ? আমি বললাম, আমার পড়ে মনে হয়েছে। সে বলল, না, তোমার পড়ে মনে হয় নি। আমি বললাম : আমাদের পড়ানো হয়েছে। সে বলল, আচ্ছা, ইংরেজরা তোমাদের দেশ দু শ বছর শাসন করেছে যদি তোমরা ইংরেজদের দু শ  বছর শাসন করতে তাহলে ওদের কাছে শ্রেষ্ঠ লেখক কে হতো?

হয় বিদ্যাপতি, নয় চণ্ডীদাস। সে বলল, তোমরা যে মুহূর্তে শেক্সপিয়রকে বড় নাট্যকার বলছ, সে সঙ্গে আরো কিছু অনুশাসন মেনে নিচ্ছ। একটা চেহারা, একটা আঙ্গিক কতগুলো বোধ মেনে নিচ্ছ। যেমন, সে বলল, আমি লাৎভিয়ায় গিয়েছি, সেখানে তাদের একজন মহাকবির নামের একটি মন্দির আছে। মন্দিরের মধ্যে ওই কবির মহাকাব্য রাখা হয়েছে। এই দেশের সব লোক মনে করে, এখানে একজন কবি রয়েছেন, তিনি হোমারের চেয়ে বড়। আমরা লাৎভিয়ার কথা জানি না। এস্তানিয়ার কথা জানি না। আমাদের বিচার করারও নেই ওই কবি হোমারের চেয়ে বড় কি না? লাৎভিয়ানদের কাছে সে কিন্তু বড়।

সেলিম আল দীন
আমাদেরও মেনে নিতে হবে। কারণ স্থানিক বিচারে মহাকাব্য হয়। ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি-রুচি-ধর্মকে আত্মস্থ করে মহাকাব্য হয়। যখন ওই জাতি স্বীকৃতি দিচ্ছে, অতএব তিনি বড় মহাকবি।

মোহাম্মদ রফিক
দ্বিতীয়ত ওই লোকটি যখন অনূদিত হবে, তখন কিন্তু এই লোকটি আর ওই লোক থাকবে না। হোমারের একটা রূপ আমরা অনুবাদ করি। আজকের পৃথিবী ভীষণ বদলে যাচ্ছে। কে জানে, জুলু ভাষায় আর একজন হোমার আছেন কি না? কে বলে দেবে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ভাষায় একজন হোমার নেই? এখন নতুন নতুন জিনিস আমাদের সামনে আসবে। আগামী ২০ বছরে বহু ধারণা পাল্টে যাবে। এজন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

সেলিম আল দীন
এজন্য আমরা প্রস্তুত আচ্ছি বলেই এখানে একত্র হয়েছি, নিজেরা প্রস্তুতি হচ্ছি।

মঈনুল আহসান সাবের
জুলু ভাষায় হোমারের মতো একজন মহাকবি আছে কি না এটা জানার কি কোনো উপায় আছে? এখনকার মিডিয়া—যে সিস্টেমে আমরা চলে গেছি…

মোহাম্মদ রফিক
মিডিয়ার ঠিক নিচেই হচ্ছে অন্ধকার। মিডিয়া কি রেড ইন্ডিয়ানদের ইতিহাস থেকে তুলে দিতে পেরেছে? আধুনিক আমেরিকায় বরং তাদের এক কবিতার ধারা তৈরি হচ্ছে। সুতরাং মিডিয়া পৃথিবী শাসন করবে। কিন্তু সব শাসন করবে না। মিডিয়ার নিচে ফাঁকফোকর আছে, আর মানুষের ওই ফাঁকফোকরের জন্য যে আকাঙ্ক্ষা—এটা রয়ে যাবে। এবং ওটা গলে ঠিকই বেরিয়ে আসবে। আমরা প্রথম যে-কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, আঙ্গিকের সমস্যা এই আঙ্গিক থাকবে? না, প্রত্যেকে নিজে নতুনভাবে প্রস্তুত হবে? আমার মনে হয়, নতুন জিনিস পাওয়ার পর এখানেও আমরা বহু কিছু নতুন জিনিস দেখতে পাব। দেখা যাবে। আজকে যে চিন্তা আমরা এখানে করছি, মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে সে-চিন্তাটা করে আসছে। সেও বিভিন্নভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছে।

সেলিম আল দীন
এটা তো গ্যয়ে বলেই গেছেন, আমরা যা কিছু চিন্তা করছি তা পূর্বেই চিন্তা করা হয়ে গেছে। গ্যয়ে না গ্যেটে? আমাদের কাজ হচ্ছে সেগুলো ব্যাখ্যা করা।

মোহাম্মদ রফিক
আর একটা মজা যেটা আমি বলেছিলাম—আমাদের ক্লাসগুলোতে পড়ানো হয় নাটক শুরু করেছেন ইস্কিলিস। এমন ভাব, নাটক মানে ইস্কিলিস হচ্ছেন ধর্মগুরু। তিনি না থাকলে নাটক হতো না। এটা তো ডাহা মিথ্যা। গ্রিকরা তাদের অঙ্কশাস্ত্র, দর্শন নিয়েছে সুমেরীয়দের কাছ থেকে, একইভাবে তারা নাটকের ঐতিহ্য নিয়েছে আফ্রিকানদের কাছ থেকে। ইজিপ্ট থেকে। ওই সময় তারা ওটা একেবারে গায়েব করে রেখেছে।

সেলিম আল দীন
ইজিপ্টুজ তো ক্যারেক্টারই আছে!

মোহাম্মদ রফিক
হয়তো আফ্রিকায় একটা মহাসমৃদ্ধিশালী নাট্যযুগ ছিল—

সেলিম আল দীন
ইরাকে ছিল, মিসরে ছিল।

মোহাম্মদ রফিক
আফ্রিকার রিচুয়ালই কিন্তু তাই বলে।

সেলিম আল দীন
হোগার মাউন্টেন, আমি জানি না, উচ্চারণটা হোজার হবে কিনা, হোগার মাউন্টেন-এ দেখা যাচ্ছে, নগ্ন উড়ন্ত নারীমূর্তি। কৃষ্ণাঙ্গ। তার শাড়ির লক্ষণ যেটা সেটাকে ভরতকৃতনাট্যশাস্ত্রের সঙ্গে, সেটা ছিল, খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে, তাহলে যে ভঙ্গিতে পরেছে লীলাচপল কোনো নারী দেখানো অর্থই দাঁড়াচ্ছে, সে কোনো পারফরমেন্স করছে, এই শাড়ির লক্ষণগুলো মিউরো-বাইয়োলজিক্যাল ডেভেলপমেন্টে থিয়েটারে আসে কি না, এর ওপর বোধ হয় দেশি-বিদেশি ভাষায় আমারই লেখা একমাত্র দাবি করছি না, পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে, নিউরো-বায়োলজিক্যাল ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক আছে কি না—এটা আমি বের করেছি। আমার মনে হয়েছে ভেরি মাচ, থিয়েটারের চেয়ে বেশি। তারপর বারকামূর্তি যেটা, এটা পাওয়া গেছে মেসোপটেমিয়াতে। বারকামূর্তিরও সাজসজ্জা সব দেখে মনে হচ্ছে যে, কোনো বিশেষ নারী নয়, ভাস্কর্যের প্রেরণায় এটি গড়া। তার চোখ, চুল, ভ্রু সব মিলিয়ে। কাজেই রফিক ভাইয়ের কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না মোটেই, যে শুরুটা বা সমৃদ্ধশালী কোনো শিল্পমাধ্যম হয়তো তখনো ছিল। কিন্তু রফিক ভাই, একটি কথা, রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতার ভূমিকায় আছে একজন কবির কবিতার ইতিহাস বলে তখন যখন সেটা প্রকৃত কবিতা হয়ে ওঠে। তখন থেকে ইতিহাসটা শুরু। সেক্ষেত্রে আমরা মানতে বাধ্য হচ্ছি যে, ইস্কিলিসের আমলেই প্রথম ওই অর্থে নাটকের শুরু। মহৎ নাটক যাকে আমরা বলছি। আপনি নিজেই একবার ভাবুন যে…

মোহাম্মদ রফিক
এটা ভাবা যায়, আমি পৃথিবীতে কোনো সম্ভাবনাকেই বাদ দিতে রাজি নই। আমি মনে করি যে, তার আগেও যদি পৃথিবীতে কোনো ভালো জিনিস দেখা যায় তবে আমাদের কোনো অসুবিধে নেই।

মঈনুল আহসান সাবের
একটু অন্য জায়গায় বলি, পাঁচালিটা কোন সময় প্রচলিত ছিল এই অঞ্চলে।

সেলিম আল দীন
রামাই পণ্ডিতের শূন্য পুরাণ টুয়েলভ সেঞ্চুরি—আট শ বছর আগে।

মঈনুল আহসান সাবের
এখন আমরা যে বাংলা ভাষাটা ব্যবহার করছি, আপনি পাঁচালিতে যে ভাষাটা ব্যবহার করেছেন। এটা তো এখনকারই ভাষা, ইংরেজদের আসার ফলে বাংলাভাষার যে মূল প্রবাহটা ছিল বা যেভাবে বিকশিত হওয়া উচিত ছিল, ইংরেজদের হাতে আমাদের বাংলা ভাষাটা নিশ্চয়…

সেলিম আল দীন
বিস্তর বিশিষ্ট ভাষা তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের ভাষাটা কিন্ত স্রোত-প্রাণ প্রবাহ। একেবারে অক্ষুণ্ন বারবার ছিল। এবং এই একটি ভাষা পৃথিবীতে, রাজভাষা না-হয়েও এই খেটে খাওয়া নেংটি পরা মানুষগুলো ভাষাটাকে, আজকে যে ভাষায় মোহাম্মদ রফিক কবিতা লেখেন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, খেটে খাওয়া মানুষগুলোই এই ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রাজদরবারে কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া। তারা পায় নি কোনো কালিদাস, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছে। পায় নি কোনো ভাস কিংবা বিষাদ দত্ত, জয়দেব, কিন্তু পেয়েছে তো রবীন্দ্রনাথকে : মধুসূদনকে। আমি বলছি যে, এদের আসার ফলে আঙ্গিকগত মধ্যখণ্ডই শুধু হয় নি, ক’টি ভাষাও তৈরি হলো। শিল্পিত ভাষা। প্রয়োজন ছিল। আমি মনে করি না, ইতিহাসে কোনো ভুল আছে। ইতিহাসে যা অনিবার্য তাই হবে। মীর জাফরের হাতে সিরাজ নিহত হবেন—যতই অমনঃপূত হোক—ইতিহাসে এটা নির্ধারিত হয়ে ছিল।

মঈনুল আহসান সাবের
ইতিহাস তার মতো করেই তার ভূমিকা পালন করে যাবে। আর কিছু ভাববে না। কিন্তু আমাদের আর ওটা ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই? ইংরেজরা না এলে আমাদের বাংলা ভাষা অন্য কোনোভাবে বিকশিত হতো কি না?

মোহাম্মদ রফিক
অনেক আগেই এ বিতর্ক শেষ হয়েছে। শশীভূষণ দাশগুপ্ত তার এক গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ইংরেজরা না এলেও ভারতচন্দ্র এবং সব মিলিয়ে বাংলা ভাষায় যে কিভাবে আধুনিক কবিতা শুরু হয়ে গেছে, ইংরেজরা আসাতে এটা একটু ত্বরিত গতিতে হয়েছে, খানিকটা দিক পরিবর্তিত হয়েছে—এটাও অনিবার্য ছিল। আমি এটা অস্বীকার করছি না। আজকে আমি যে চিত্রকল্পটা তৈরি করছি কে জানে যে, ওটা আমি ব্লেকস ওয়ান থেকে ধার করি নি? কে জানে যে, ওটা আমি অ্যালেন পোর স্বল্পসংখ্যক কবিতা থেকে লোন করি নি? আমি কেন করব না? আবার আমি কেন তাকে পুরোটা অনুকরণ করব? কাজেই পাঁচালির ক্ষেত্রে প্রশ্ন দুটা থাকতে পারে। সেটা হলো যে, ভাষাটা বদলে গেল ধীরে ধীরে হাজার বছরে, অথচ আপনি ফর্মটা সে আমলের কেন নিচ্ছেন? কিন্তু না, সেটা হলো যে, সেভেনটিন সেঞ্চুরি পর্যন্ত পাঁচালি রাজদরবারে, আরাকানের রাজদরবারের ভাষা। আলাওলের ভাষা পড়লে বোঝা যায় যে, এ ভাষায় মধুসূদনের জন্মানোটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।

মঈনুল আহসান সাবের
আমার প্রশ্ন আসলে এইটেই ছিল—

সেলিম আল দীন
যে কারণে গোপাল হালদার বলেন যে, আলাওল একালে জন্মালে তিনি রবীন্দ্রনাথ হতেন। কোনো আবেগ তো আর গোপাল হালদারের ইতিহাস রচনায় নেই।…

মোহাম্মদ রফিক
বাংলা ভাষার একটা চেহারা নিজে থেকে দাঁড়াতোই। বরং বাংলাভাষার গৌরবটা সেখানেই ইংরেজরা অন্য যেসব এলাকায় গেছে মূলত প্রতিটি জায়গায় বিশেষ করে আফ্রিকায়, তাদের ভাষা ভুলিয়ে দিয়েছে। বাংলা ভাষা ভোলাবার তো প্রশ্ন আসে না, বরং বাংলা ভাষার পরিধি কি বিরাট তার প্রমাণ হলো, বাংলা ভাষা তার মুখোমুখি নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করেছে। নিজের তাগিদে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। ফলে এখানে অন্যান্য এলাকার মতো আমাদের যে ইংরেজি ভাষায় কথা বলাবার ব্যাপার ছিল, ইংরেজরা সেটা পারে নি।

মঈনুল আহসান সাবের
এখানে অর্থনীতি কি একটা বড় বিষয়? যেমন আফ্রিকার বহু দেশে আমরা দেখি, ফরাসিরা, ডাচরা যেখানে গেছে ওখানকার ভাষা শেষ হয়ে গেছে; সেইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীটি অর্থনৈতিকভাবে খুব দুর্বল ছিল আর বাংলা অর্থনীতি কি সচল ছিল যে, যা বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়ক হয়েছে।

মোহাম্মদ রফিক
বাংলার অর্থনীতি সবল ছিল, সেটা মূল ব্যাপার না। কিন্তু এটাও তো মিথ্যা কথা যেটা ইংরেজরা বলে যে, আফ্রিকানরা অসভ্য ছিল, আমরা তাদের সভ্য করেছি।

মঈনুল আহসান সাবের
আফ্রিকায় তাদের মতো সভ্যতা ছিল।

মোহাম্মদ রফিক
আমি জানি না, বাংলাভাষার ক্ষেত্রে অর্থনীতি একটা প্রধান কারণ কি না, কিন্তু তারপরেও এটা ঘটেছে। তবে এটা আমি মানতে রাজি না যে, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণেই ঘটনাটা ঘটেছিল। আসলে আমি মনে করি যে, বাংলা ভাষার ভিতরেই এমন একটা অন্তর্গত শক্তি ছিল, যার ফলে পরিস্থিতির মুখোমুখি সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে পেরেছে। এজন্য দেখা যায় যে, আমরা ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করি নি। এজন্য বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম—এদের কাছে আমাদের চিরকালই কৃতজ্ঞ থাকতে হবে।

[বিরতি…]

সেলিম আল দীন
এখানে রফিক ভাই একবার মিডিয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, মিডিয়ার প্রভাবে পাঠক কমে যেতে পারে, বলা হয়েছে, বিষয়টা জটিল এবং আধুনিক পৃথিবীতে এটা নিয়ে ম্যাক লোহানের মতো লোকরা সিক্সটিজে ঘোষণা করেছিলেন যে, আলটিমেটলি অক্ষর বা লেখ্য সিস্টেমটাই ওঠে যাবে। এটা পরে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে।

সাহিত্যের প্রধান নগরী নিশ্চিত ঢাকা, এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
মঈনুল আহসান সাবের
আমরা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে দেখছি, শ্যামল মাঝখানে গল্পের মধ্যে কিছু ছবি এঁকেছেন।

সেলিম আল দীন
এই যে ভূমিকম্পের সতর্কীকরণ করলাম না আমরা এখানে বসে এটা তার লক্ষণ। কিংবা গিন্সবার্গের কবিতাটা যে এ রকম করে সাজানো, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা এ রকম করে সাজানো, ওইসব মানে হচ্ছে এক ধরনের অতৃপ্তিতে ভোগা এবং এলার্মিংও এই মাধ্যমের জন্য। রফিক ভাই আপনি কি মনে করেন যে, মানুষ লেখার যে আনন্দটা, লেখার মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশটাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মিডিয়ার চিত্র দর্শনের মাধ্যমে পৃথিবীর সমস্ত সমাধান হয়ে যাবে।

মোহাম্মদ রফিক
আমি এটা মনে করিই না। এটা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। যারা মিডিয়া দেখে আনন্দিত হবে, তারা হবে। যারা লেখা পড়ে হবে, তারা হবে। হয়তো মিডিয়ার দিকে লোক বেশি যাবে এবং মিডিয়া কিছু সঙ্কটও তৈরি করবে।

সেলিম আল দীন
করেছে।

মোহাম্মদ রফিক
হ্যাঁ, করেছে।

সেলিম আল দীন
নরওয়েজিয়ান থেকে দুজন ছাত্রী এসেছিল আমার কাছে পড়তে বার্গান ইউনিভার্সিটির। তারা এক মাস ছিল। তারা বলল যে, স্যার আমাদের দেশে আমরা উই আর ট্রায়িং বেস্ট যাতে স্ক্রিন থেকে বইয়ের দিকে মানুষ মুখ ফেরায়।

মোহাম্মদ রফিক
এটা উন্নত বিশ্বের ধারণা। আমার যে অনুবাদিকা, তার বাড়িতে কোনো টেলিভিশন নেই। আমার বাসায় টেলিভিশন ছিল, আমি হঠাৎ ক’দিন সেটটা প্যাক করে আমার ছেলেমেয়েদের বললাম, দিজ ওয়ান এ আন ওয়েলকাম গেস্ট ফর এ লং টাইম, … এটা বেশি হয়ে গেছে।অতএব আমি এখন এটাকে বিদায় করতে চাই। আমি ওটাকে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসলাম। আমেরিকায় এমন প্রচুর পরিবার আছে, যারা বাড়িতে টেলিভিশন রাখে না। এটা হবে। কিন্তু এটা ঘটবার আগেও মিডিয়ার প্রতি একটা মোহ মানুষের মধ্যে থাকবে। কিন্তু মিডিয়া পৃথিবীতে সব কিছু ওলটপালট করে দেবে, লেখালেখি শিল্প-সাহিত্য বন্ধ করে দেবে—এটা সম্ভব না।

মঈনুল আহসান সাবের
রফিক ভাই, ১০ বছর আগে আপনার বই কেমন বিক্রি হতো?

মোহাম্মদ রফিক
আজো যা হয় তাই।

সেলিম আল দীন
মানুষের কল্পনা শক্তির অপচয় একটা সীমা প্রায় অতিক্রম করে গেছে। সত্যজিৎ রায় বা কুরোসোয়ার ছবি বাদ দিয়ে বলছি, চিত্রকলা বা ওই সমস্ত শিল্প মাধ্যমের কথা আমি বলছি না, আমি বলছি যে রিচুয়াল মিডিয়া মানুষের কল্পনা শক্তিকে এমন একটা সীমাবদ্ধ জায়গায় নিয়ে গেছে, অপরিণত বালকদের হাতে পড়ে, মানুষ এখন আর কিছু ভাবতে চাচ্ছে না। কামু বলেছিলেন না যে, একটা সময় আসবে যে আমরা নির্বিকার চিত্তে ধর্ষণের খবর, গণহত্যার খবর পড়ে সিদ্ধ ডিম খাব সকালবেলা।

মঈনুল আহসান সাবের
আমরা তো এসবের সঙ্গে মিলেমিশেই আছি।

সেলিম আল দীন
তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, লেখার যে আবেগটা, এটা নিউরোবায়োলজিক্যাল ডেভেলপমেন্টের ফল, এটা নষ্ট হবে না। এটি পাশ্চাত্যের লোকেরা কেন বলছে না, কেন প্রচার করছে না, আমি বুঝতে পারছি না। আমরা থার্ড ওয়ার্ল্ডে যারা নিজেদের আলো থেকে এত বঞ্চিত বলে মনে করছি, আমরা ঠিকই টের পেয়ে যাচ্ছি যে, নিউরোবায়োলজিক্যাল ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে লেখ্যরীতির একটা সম্পর্ক আছে। সুতরাং মানুষ কখনো লেখা এবং পড়া বাদ দেবে না। এককালে যেটা সাইন ছিল, কিছু সঙ্কেতের জন্য কোনো গোত্র কিছু অক্ষর তৈরি করেছিল, সেটা ক্রমে ক্রমে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সেটাকে একটা পরিশীলিত রূপে এনে, একেবারে তার বিস্তার সর্বশ্রেষ্ঠ আধাস্বরূপে পরিগণিত করেছে। আগামী ১০ হাজার বছরে হোমারের ইলিয়াসের মতো কোনো লেখ্যরীতির কাব্য আমরা পাব না। এমন কোনো দৃশ্য তৈরি হবে না, যেটা হোমারের ইলিয়াডকে অতিক্রম করে। মিডিয়া কোন জায়গায় ফেল করছে? আমি মোহাম্মদ রফিকের কবিতা পড়ছি, এটাকে চিত্রায়ণ সম্ভব, এমনকি চিত্রকলা করাও সম্ভব। কিন্তু পঙ্‌ক্তির ফাঁকে ফাঁকে আমার যে ভুবনটা তৈরি করছে সেটি করার অবকাশ দিচ্ছে না। আমি যখন শটও ওপেন করছি, তখন আমি সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছি, যে এই দেখ, এটাই কারেক্ট—সুতরাং লেখ্যরীতির সঙ্গে দৃশ্যরীতির এই সংঘাতটা থাকবেই। যেজন্য রিয়ালিস্টক ছবির বদলে বিমূর্তকরণে আন্দোলনটা শুরু হলো পৃথিবীতে। তারা চাচ্ছে যে ছবিটা ভাবাক। যদি এতই সোজা হতো, তাহলে সবাই ক্যামেরা ধরে বসে থাকত।

মোহাম্মদ রফিক
বিমূর্ততার যে ব্যাপারটা এটা তো আমাকে কোনোদিন এই মিডিয়া দেবে না এবং বিমূর্ততা ছাড়া তো কোনো জায়গা দাঁড়ায় না।

সেলিম আল দীন
মানুষকে তো কল্পনার সুযোগ দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ তো এজন্যই বলেন, ইউরোপে দৃশ্যপটের নামে যে উৎপাতটা শুরু হয়েছে, এটা তার কাছে একেবারে অনাবশ্যক মনে হয়েছে। দর্শক কি কল্পনার চাবি বন্ধক রেখে নাটক দেখতে যায়?

মঈনুল আহসান সাবের
এটাই তো মিডিয়ার ইতিহাস। মিডিয়া তো এরকম আচরণই করবে, এটাই নির্ধারিত।

সেলিম আল দীন
আরো প্রকট রূপ ধারণ করবে থার্ড ওয়ার্ল্ডে।

মোহাম্মদ রফিক
তাতে কিছু এসে যায় না।

জাফর আহমদ রাশেদ
আমি একটা বিষয়কে আলোচনায় আনতে চাচ্ছি। আপনারা দুজনেই বলেছেন, তিরিশের কাল থেকে বাংলা সাহিত্যে একটা অবক্ষয় সূচিত হয়েছে। গত ১৫/২০ বছর ধরে বাংলাদেশের কবিতা, নাটক যে দেশীয় জীবনযাপন, মিথ, লোকগাথা ইত্যাদিকে অবলম্বন করে দাঁড়াতে চাইছে, তার মধ্যে আপনারা দুজনের শিল্পচর্চারও ঘনিষ্ঠভাবে অঙ্গীভূত। রফিক ভাই মৎস্যগন্ধায় মহাভারতের চরিত্রকে আজকের পটভূমিতে সাজাচ্ছেন, সেলিম ভাই বনপাংশুল-এ একটি ছোট নৃ-গোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামকে দেখাচ্ছেন। এগুলো কিন্তু তরুণরা গভীরভাবে লক্ষ করছেন এবং এসবকে আত্মীকৃত করতে চাইছেন সচেতনভাবে।

সেলিম আল দীন
মোহাম্মদ রফিক দ্বারা আমি এককালে অনুপ্রাণিত হয়েছি। মোহাম্মদ রফিক যখন লোককথা-রূপকথা নিয়ে ভাবছেন তখনই কিন্তু আমার কীত্তনখোলা লেখা। আমি কিন্তু খুব সচেতন এবং রফিক ভাই জানেন না যে, আমি তার থেকে কী গ্রহণ করেছি। আমি কিন্তু আমার ওয়েতে গ্রহণ করেছি।

মোহাম্মদ রফিক
এটাকে আমি দেখছি এভাবে মানুষের বেড়ে ওঠার দুটো স্তর। প্রথম হচ্ছে নিজেকে চেনা, তারপরে নিজেকে পৃথিবীর লোক হিসেবে দেখা। তরুণ নিজেকে চেনার স্তরটা পার হচ্ছে। স্বাধীন মানুষ প্রথমে নিজেকেই চিনবে। তার ভাষার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে চিনবে, তার মিথের ভিতর দিয়ে নিজেকে চিনবে, এই চেনায় যেন আবার ভুল না হয়। আমরা যেন গণ্ডিবদ্ধ না হয়ে যাই। চেনাটাকে যেন আমরা সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি। নিজেদের যেন পৃথিবীর মানুষ হিসেবে চিনতে পারি।

জাফর আহমদ রাশেদ
আপনি নিজেকে চেনার জন্যই কি নিজের ঐতিহ্যগুলোকে চিনিয়ে দিচ্ছেন না?

মোহাম্মদ রফিক
বটেই।

জাফর আহমেদ রাশেদ
তরুণরা যে নিজেকে চেনার এবং চেনানোর চেষ্টা করছে সেটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ রফিক
এটা তো খুবই আনন্দের ব্যাপার।

জাফর আহমদ রাশেদ
রবীন্দ্রোত্তরকালে জীবনানন্দকে এবং অংশত সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে বাদ দিয়ে এই যে অবক্ষয়ের কাল বলছেন তার এতদিন পরে এসে নিজস্ব জায়গায় দাঁড়ানোর প্রসঙ্গটি, সেলিম ভাই এর আগে বনপাংশুল-এর আলোচনা প্রসঙ্গে ‘ভোরের কাগজ’কে যেটা বলেছিলেন এই চেষ্টাটার মাধ্যমে আমরা আর একবার কি নিজের হয়ে বৈশ্বিক হওয়ার চেষ্টা করছি?

সেলিম আল দীন
হ্যাঁ, অবশ্যই। রবীন্দ্রনাথের পথেই আমরা চলেছি। এটার গুরুত্ব সম্পর্কে রফিক ভাই অলরেডি বলেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ একমাত্র, যিনি বঙ্কিমদের ধারাকে আত্মসাৎ করে স্বকাল-স্বদেশের হয়ে বৈশ্বিক হয়েছেন। তারপর থেকে আমি বলেছি, পরকে অনুকরণ করার ত্রুটিটা রবীন্দ্রোত্তরকালের কবিদের প্রধান ত্রুটি। পরকে অনুকরণ করে বৈশ্বিক হওয়ার চেষ্টা, এখন আবার সেই পালাটা চলছে যখন দেশটি স্বাধীন, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং সাহিত্যের প্রধান নগরী নিশ্চিত ঢাকা, এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আবেগের কথা নয়, এটা একটি রাজনৈতিক অপরিহার্যতা, ভৌগলিক সত্য। প্রাণাবেগের দিক থেকেও এটাকে দেখা যায়, আমাদের কবিতার শক্তি, আমাদের গল্পের শক্তি, উপন্যাসের শক্তি, তবে উপন্যাস হয়তো ততোটা ওভাবে দাঁড়াতে পারে নি।

মোহাম্মদ রফিক
হ্যাঁ, তবে, একটা কথা যেটা বলছিলাম কেন্দ্র বা আমরা হয়েছি তা ভাগ্যক্রমে। বাঙালি বলতে এখন বাংলাদেশকেই লোকে চিনবে। সঙ্গে সঙ্গে একটা দায়িত্বও আমাদের ওপর বর্তেছে, আমাদের ক্ষুদ্র হলে চলবে না। মনকে বড় করতে হবে। বলতে হবে, আমি বাঙালি, আমি পৃথিবীর লোক। আমাকে বাঙালি হয়ে হিমালয়ের ওপর দাঁড়াতে হবে। যাই হোক, বাংলাদেশে যে একটা জিনিস শুরু হলো এটাই আনন্দের।

সেলিম আল দীন
এবং সাবের সাহিত্য সম্পাদক হওয়ার পরে এক ধরনের কোয়্যারি এই সম্পাদকের মধ্যে কাজ করছে আমি দীর্ঘদিন থেকে লক্ষ করছি, যদিও কোনো লেখা দিয়ে তাকে আমি সম্মানিত করতে পারি নি। আমি এত বাজে লেখায় ব্যস্ত, আমি তার অফিসে গিয়ে প্রথমে সাবধান করে দিয়েছি, আমি আসছি বলে লেখা-টেখা দেবো, তা নয়, জাস্ট আপনি হয়েছেন লেখার পরিবেশ এই পত্রিকায় কাজ করবে।

মোহাম্মদ রফিক
শোনো, তোমাদের তরুণদের একটা জরুরি কথা বলি। তোমরা একটা সাহিত্য পত্রিকা কর। বাংলাদেশে একটা ভালো সাহিত্য পত্রিকা নেই। দৈনিক পত্রিকায় কবিতা-গল্প লেখা যায়। কিন্তু প্রবন্ধ লেখা যায় না। আমি সংবাদে লিখতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝছি। তোমরা একটা জিনিস পারো, তোমরা একটা সিরিয়াস পত্রিকা করার চেষ্টা করো। সাহিত্য পত্রিকা। সেলিম বা আমি যে প্রবন্ধ লিখি দৈনিক পত্রিকায় ওগুলো পাঠক কেউ পড়ে না। অবশ্য দুএকজন তরুণ খুঁজে পড়ে।

হুমায়ুন কবির হিমু
আমার মনে হয়, কম্পিউটার যুগের যতই বিকাশ হোক মানুষের পাঠ কিন্তু কমবে না। তাকে পড়তেই হবে। কম্পিউটারে কিছু করতে হলে, দেখতে হলে পড়তেই হয়। স্ক্রিনে পড়তে হচ্ছে।

মঈনুল আহসান সাবের
কাগজকে তো আপনি উঠিয়ে দিতে পারছেন না, সম্ভব না উঠিয়ে দেওয়া। ইম্পুট-আউটপুট সবই তো কাগজ দিয়ে।

সেলিম আল দীন
চমৎকার বলেছ।

জাফর আহমদ রাশেদ
আচ্ছা, অবক্ষয়ের কথা বলতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশকে একটি আলাদা জায়গা দেওয়া হয়েছে আজকের আলোচনায়, তার কবিতা সম্পর্কে…

সেলিম আল দীন
আজকের একসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর [ইউনিভার্সিটি] থেকে আসার সময় রফিক ভাই আমাকে বলেছেন, জীবনানন্দ দাশের ভিতরের যে ফ্লো-টা তার যে আর্তনাদ, এষণা, যে দৃষ্টি, যে দ্বান্দ্বিকতা এদিকে না গিয়ে শব্দের এমন কারুকাজ কবিরা প্রথমে গিয়ে সেই ফাঁদে ধরা দেয় এবং তারা মিস-লেড, সিম্পলি। তারা ওই বিবর্ণ, ধূসর, আকন্দ-ধুন্দুল এগুলোর মধ্যে দিয়ে—রফিক ভাইয়ের সঙ্গে আমি একমত।

মোহাম্মদ রফিক
আমি জীবনানন্দের ওপর একটা বই লিখছি তো, আমি তো প্রমাণ করছি যে, জীবনানন্দ একেবারে রবীন্দ্রনাথ থেকে বেরিয়ে এসেছেন, রবীন্দ্রনাথের সন্তান, আমি কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি, কোন কবিতা থেকে কোন কবিতা জন্ম নিয়েছে। জীবনানন্দের বিকশী প্রভাব—লোকেরা যা আজেবাজে কথা বলে না! জীবনানন্দের মধ্যে এক ধরনের প্রচণ্ড ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা আছে, সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস, দর্শন, মানুষ, সভ্যতা বিভিন্ন অনুষঙ্গ তাকে জড়িয়ে আছে।

সেলিম আল দীন
প্রকৃতি?

মোহাম্মদ রফিক
প্রকৃতি তো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার মধ্যে আছে, আমরা তার ইতিহাস, দর্শন, মনের সভ্যতা অর্থাৎ তার সিরিয়াসগুলোকে বাদ দিয়েছি, আমাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা।

সেলিম আল দীন
আর শব্দ, আমি এককালে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম, দেখি কি, হুট করে জীবনানন্দ দাশ এসে পড়ে। বিষয়টা কি, তারপর ছেড়েই দিলাম।

মোহাম্মদ রফিক
আর জীবনানন্দ সম্ভব হয়েছে কেন? তখন যদি বাংলা ভাগ না হতো, জীবনানন্দকে যদি বরিশাল ছেড়ে যেতে না হতো তবে জীবনানন্দের একটা অন্য বিবর্তন দেখতে। কলকাতা গিয়ে তিনি খুব একা হয়ে গেছেন, যে বিবর্তনটা কেবল শুরু হয়েছিল রূপসী বাংলা’য়, যেটার আর পরিণতি হলো না। বাঙালির ইতিহাসের মতোই। বাঙালির ইতিহাসের কোনো পরিণতি নেই কিন্তু—

সেলিম আল দীন
আমি বলছিলাম যে, সঠিক ধারায় বাঙালি যায় নি।

মোহাম্মদ রফিক
যায় নি।

সেলিম আল দীন
মকসুদে মঞ্জিল যাকে বলে, সেখানে বাঙালি পৌঁছুতে পারে নি। গ্রিকরা পেরেছে, ইউরোপিয়ানরা পারে, আমেরিকানরা পারে, আফ্রিকার কোনো কোনো দেশও পারে, আমরা পারি নি। তারপর উত্তরাধিকারী হিসেবে বলতে হয়, আমাদের চেয়ে সৌভাগ্যবান জাতি বোধহয় এশিয়ায় নেই। যেখানে রবীন্দ্রনাথ আছেন, যেখানে বিজ্ঞানী আছেন, অর্থনীতিবিদ, পৃথিবীর সেরা মানের লোকগুলো যে ভাষাতে জন্মগ্রহণ করছেন, যেখানে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় যুদ্ধ করে, সাম্প্রদায়িকতার মতো নোংরা জিনিস দিয়ে নয় দেশ স্বাধীন করা।

জাফর আহমদ রাশেদ
আমরা মনে হয়, উপসংহারের দিকে চলে এসেছি। সেলিম ভাইয়ের একটি কথার সূত্র ধরে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি বলেছিলেন, সাহিত্যের মাধ্যমগুলো সাহিত্যে নন্দন একটি ক্রাইসিসের দিকে যাচ্ছে।

সেলিম আল দীন
আমি না আমি না, কাল—

জাফর আহমদ রাশেদ
হ্যাঁ, ওই সময় বলতে গিয়ে আপনি বলেছেন, নাটকের ডিরেক্টর একটা জড় জায়গায় চলে আসছে, কথাটা একটু ব্যাখ্যা করুন।

সেলিম আল দীন
হ্যাঁ, এখন তো পিটার ব্রুক যা চালু করেছেন, তাতে ডিরেক্টর নাট্যকারের জায়গায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। এমনকি নাটক লিখিত না হলেও চলে। কোনো একটি নাটক, যেমন শেক্সপিয়রের মিড সামার নাইট ড্রিম—এটিকে অবলম্বন করে নতুন করে ভাঙচুর করে সুন্দরভাবে তিনি গড়েছেন।

মোহাম্মদ রফিক
কিন্তু সেটা তো তারপরেও শেক্সপিয়রের নাটক তার মহাভারত তারপরেও মহাভারত।

সেলিম আল দীন
পিটার ব্রুক এমন একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিচ্ছেন, যাতে আর মনে হয় না নাট্যকারের প্রয়োজন আছে। অন্তত চেখভের সময় ভাবাই যেত না, চেখভের নাটকটি একেবারে ধ্রুব ছিল। কিন্তু এখন নাট্যকার বলে আলাদা আর কিছু থাকছে না।

ফেরদৌসীর মহাকাব্য যে না পড়েছে সে শিশু।
মোহাম্মদ রফিক
এটি যদি হয়ে থাকে, তাহলে এটা খুবই চিন্তার কথা। নাট্যকারের সমস্ত কথাবার্তা বাদ দিয়ে।

সেলিম আল দীন
এটা ভাঙনের মুখে আপনি কি বলবেন? আপনার ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে, নদীর স্রোত এত বড়, কোনো ঔচিত্যবোধ দিয়ে রফিক ভাই ঠেকাতে পারবেন না।

জাফর আহমদ রাশেদ
আলোচনাটা আবার সূচনা বিন্দুতে চলে এসেছে।

সেলিম আল দীন
নিশ্চয়।

মোহাম্মদ রফিক
তার মানে এই নয় যে, আলোচনার মধ্যে জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর নেই। মনে হয় যে আমরা ফিরে এলাম, কিন্তু যেখানে ফিরে আসি, সেটা আগের জায়গা নয়। অনেকদূর এগিয়ে আমরা ফিরে আসি। তবে হ্যাঁ, ফিরে একবার আসতেই হয়। নিজেদের চেনার-জানার জন্য।

জাফর আহমদ রাশেদ
আপনি কি এজন্যই বলেছিলেন, আমি কি বলতে পারি যে, আর কেউ কখনো ব্যাসদেব পড়বে না?

মোহাম্মদ রফিক
ব্যাস-বাল্মীকি তো পড়তেই হবে। আমি মৎস্যগন্ধা লেখার পরে, আমি তো এখন ‘মহাভারত’ ছাড়া কিছু পড়ি না। আর তো কিছু পড়ার দরকার নেই এই মুহূর্তে, আমার জন্য।

সেলিম আল দীন
হাজার হাজার বছরের যে রুচি, টেইলস, ফোক, ডিফারেন্ট হিউম্যান ফিগার, প্রোটোটাইপ, বাচনভঙ্গি, জীবনের পরিণাম সব একত্রে, একটি গাথায় আর পাচ্ছ না কোথাও, মহাকাব্যগুলো ছাড়া। ফেরদৌসীর শাহনামার মতো মহাকাব্য কোনো জাতিতে আছে না-কি? আদি মহাকাব্যগুলো বাদ দিয়ে, সিয়োডো এপিক থাকে আমরা বলি। সিয়োডা এপিক হলো একেবারে স্ব-উদ্ভাবিত মহাকাব্য, যেমন মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য।

মোহাম্মদ রফিক
কারেক্ট, ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, সেকেন্ডারি এপিক।

সেলিম আল দীন
ইরানে প্রচলিত একটি গল্প দাকাকির কাছ থেকে শুনে ফেরদৌসী ইলাবরেট করে শাহনামা লেখেন।

জাফর আহমদ রাশেদ
মহাভারতের গল্পগুলোও তো প্রচলিত।

মোহাম্মদ রফিক
হ্যাঁ, মহাভারতও তাই, প্রচলিত গল্পগুলোকে একত্রিত করা হয়েছে।

সেলিম আল দীন
ফেরদৌসীও সেভাবে করেছেন। ফেরদৌসীর মহাকাব্য যে না পড়েছে সে শিশু।

মোহাম্মদ রফিক
সব মহাকাব্য যে না পড়েছে সে শিশু। আমি এখন পর্যন্ত একটি বই প্রতিদিন শোয়ার আগে পড়ি—হোমারের ইলিয়ড। সারাদিন পড়ি মহাভারত, রাতে হোমার আর দান্তে। সেলিমও দান্তে খুব ভালোবাসে। ওর ওপর দান্তের প্রভাব আছে।

মঈনুল আহসান সাবের
আমরা এবার শেষ করতে চাই। যে সমস্যা সঙ্কটের কথা এসেছে—

মোহাম্মদ রফিক
হ্যাঁ, আমরা একা তো কেউ সমস্যার সমাধান করতে পারব না, আমরা সবাই মিলে একটি জিনিস তৈরি করব। সেলিম যদি চায় যে, আমিই তৈরি করব, হবে না। আমি যদি চিন্তা করি যে, আমি করব, হবে না।

সেলিম আল দীন
রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনায় শরৎচন্দ্র লিখেছেন, বাণীর দেউল আজ গগণ স্পর্শ করিয়াছে, বঙ্গের কত না কবি কত কারিগর এই দেউলে, তুমি তার চূড়ান্ত রূপটি দিলে—এই ধরনের।

সামনের কাজ অসংখ্য কবি-কারিগরের।


Link: https://www.porospor.com/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A7%8E%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0/%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%A6-%E0%A6%B0%E0%A6%AB%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%93/

28
English / কবিতা
« on: November 12, 2018, 05:15:23 PM »
জুয়া

রুম্মান মাহমুদ


লোকটা যেদিন জুয়া খেলে অনেক টাকা জেতে, সেদিন ফেরার পথে ছেলের জন্য কেনে ছানার সন্দেশ
মেয়েটার জন্য লাল চুড়ি। বাড়ি ফিরে বুড়ো বাপের পা টিপে দিতে দিতে তলিয়ে যায় অঘোর ঘুমে
গেল বছর বিষ খেয়ে মরে যাওয়া স্ত্রী স্বপ্নে এসে তার মাথায় হাত বোলায়, গুনগুন গান শোনায়।

লোকটা যেদিন জুয়ায় সব হারায়, সেদিন ধার করে মদ কেনে
টালমাটাল হয়ে ফেরার পথের প্রতিটা গাছ জড়িয়ে ধরে কান্না করে
অশ্রাব্য অভিসম্পাত করে এখনো বিষ খেয়ে মরে না যাওয়া বাপকে
মৃত বউয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে কাঁদতে কাঁদতে সে আকাশে ঢলে পড়ে।
সারারাত দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করে বুড়ো বাপ
লোকটা হেরে গেলে উঠানে খুব জ্যোৎস্না হয়।

29
English / Death (A short story)
« on: September 19, 2018, 12:15:41 PM »
মৃত্যু
রুম্মান মাহমুদ



      একটা প্রায়-অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছে ওরা। জানলা নেই, একটা ঘুলঘুলিতে মাঝে মাঝে চড়ুইরা আসা-যাওয়া করে। মাকড়সার জাল চাদরের মতো ছড়িয়ে আছে সারা ছাদ জুড়ে। আটকে পড়া পোকামাকড় আছে বহু। আমরাও ছাব্বিশ জন আছি। গত শনিবারও বত্রিশ জন ছিলাম। প্রতি পাঁচ দিন পরপর অস্ত্র হাতে ওরা আসে। দুইজনকে বেছে নেয় ইচ্ছামতো। তিনটা ধরণের মৃত্যু আছে অপশনে, যেকোন এক উপায়ে মরতে হবে। গিলেটিনে, অথবা ফাঁসির দড়িতে সাধারণত কেউ মরতে চায় না। তৃতীয় পন্থা, অর্থাৎ ছুটে পালাতে গিয়ে এক থেকে দশ অব্দি গোনার পর বুলেটের মৃত্যুটাই বেছে নেয় সবাই। এখন পর্যন্ত কেউ বাঁচেনি এই নিয়মে। তবু দৌড়ানোর চান্স সবাই নিতে চায়। আমরা যারা রুমের ভেতর থাকি, প্রতিবার গুলির শব্দে কিছুটা নিশ্চিন্ত হই। যাক, জীবনের মেয়াদ আরও কিছুদিন বাড়লো। আগে কেউ কেউ কাঁদতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
 
        আজকেও দু'জন বেছে নিলো ওরা। বললো নতুন চালানে আরও বিশজন আসছে। আমরা সহজে কমছি না। আর লটারিতে মানুষের অপশন বাড়লে বেঁচে থাকার মেয়াদ বাড়ারও সুযোগ থাকে। আমার পাশেই গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা ছেলেটাকে বেছে নিলো ওরা। অল্প বয়স, হাঁপানির টান আছে খুব, কপালের এক পাশে সেলাইয়ের দাগ আছে একটা। গরুর তাড়া খেয়ে ছোটবেলায় পুকুর ঘাটে পড়ে গিয়েছিল সে। সিরাজগঞ্জে মামার পানের আড়তে সে বসতো। সেখান থেকেই এক রাতে তাকে তুলে আনে ওরা। গত দশজনের মধ্যে একমাত্র ও-ই কাঁদলো হাউমাউ করে। ওরা আমোদ পেলো খুব। অপশনে বেছে নিলো দড়ি। জানে দৌড়ে পারবে না তার দুর্বল ফুসফুস। এই প্রথম, কোনোরকম গুলির শব্দ ছাড়াই মরে গেলো কেউ। আরেকজনের বেছে নেওয়া গুলির শব্দে অভ্যাসবশত কেঁপে উঠলাম আমি। তিন নাম্বার গুলিতে মরেছে। আজ রাতে ওদের কথা ভাববো।

       এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা মানেই মৃত্যুকে এগিয়ে আনা। দুইজন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল মুহুর্তের মধ্যে। একজন ঘুলঘুলিতে উঁকি দিতে গিয়ে চোখেই গুলি খেয়েছিল। তাই চেষ্টা করিনি কখনো। স্বাধীন থাকার দিনগুলার কথা মনে পড়ে না তেমন। প্রস্রাবের তীব্র গন্ধে আনন্দের সমস্ত স্মৃতি ভেসে গেছে। নোংরা প্লেটে লাল আটার রুটি আর মোটা চালের ভাত নিয়ে কেউ অভিযোগ করে না। প্রতিটা মৃত্যুর রাতে একত্রে বসে গান করি আমরা জীবিতরা। যারা মরে গেছে তাদের কথা বলি। তাদের হাসি কান্নার শব্দ ঘরটাতে ফিরে আসে বারবার। মতিন নামের একটা ছেলে আছে। ভালো গান গায়। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে হেসে উঠলো শব্দ করে। সেদিন সারারাত আর ঘুম এলো না আমার। হত্যাকারিদের অবয়ব ভেসে উঠলো চোখে। ওদের মুখ ঢাকা থাকে কালো কাপড়ে, আমাদের সাথে কথাবার্তা বলে কেবল একজনই। অল্পবয়সী কন্ঠ, নিখুঁত উচ্চারণ। একমাত্র তার হাতেই কোন অস্ত্র থাকে না। মনে হয় এই মৃত্যু খেলায় অন্তত একজন আছে, নাম লিখেছে অনিচ্ছায়।

         আগে মৃত্যু নিয়ে ফ্যান্টাসি ছিল। এখন প্রতিবার অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া পর বেঁচে থাকাটাই ফ্যান্টাসি মনে হয়। আম্মা বেঁচে আছেন কিনা জানি না। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমিই ছিলাম অন্ধের লাঠি। প্রথম প্রথম চাকরি নিয়ে শহর ছাড়ার পর প্রতিদিন অন্তত একশবার ফোন দিতাম আম্মাকে। কিভাবে রান্না করতে হয়, কাপড় কাঁচতে হয়, মাছ চিনতে হয় -এইসব জিজ্ঞাসা করতাম। কৌতুহল মেটানোর তো একটাই মানুষ পৃথিবীতে। প্রেমটেম, ভাইবোন কিছু নেই আমার। আম্মাই ফোন দিতেন ঔষুধের কথা মনে করাতে, রাতের ভাতটা ঠিক সময়ে খেতে। বিরক্ত লাগত এইসব ফোন পেয়ে। আম্মাকে বুঝতে দিতাম না। ভেবেছিলাম শহরে এনে আমার কাছেই রাখবো। মামাদের ঘ্যানঘ্যান থামবে। এখন, এই আবছা অন্ধকারে প্রায়ই আম্মাকে চিঠি লিখব ভাবি। তেমন কিছু না, স্রেফ জিজ্ঞাসা করবো, কিভাবে মরলে আমার জন্য ভালো হয়।

30
English / Two Poems
« on: September 11, 2018, 05:39:24 PM »
দু’টি কবিতা
রুম্মান মাহমুদ


১.

একটা পাথর নিয়েই বাঁচতে পারে বহুকাল।
পাথর ঘষে সে দাউ দাউ তোলে আনন্দ ঝড়-
যত ঢেউ তুমি দু’হাতে কুড়াও অখিল শ্রাবণ
বিনিময়ে দাও অবহেলা অপমান অকাতর।

ঘৃণা দাও কিছু ভাবো জিতে গেছো খুব এই খেলা।
বোধের আড়ালে থাকুক নেভানো অপরাধবোধ।
সে হাসবে খুব যেভাবে হেসেছে সারাটাজীবন,
তাকাবেনা ফিরে, নখে ঠোঁটে জ্বলবেনা প্রতিশোধ।

জীবন দিয়েছে তাকে যথেষ্ট, ফুরাবার নয়।
অপেক্ষা শুধু নিবিড় নিথর মৃত্যুদিনের
যেভাবে পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় স্বমেহনে
তুমি উড়ে যাও স্বাদ মাখো ঠোঁটে অন্য তৃণের।


২.

তুমি ছোটো আকাশকুসুম, পকেটে নিয়ে ঘোরো মহাকাল
পারো যদি এসো একবার, কথা বলি কোন অলস বিকাল।

আমার তো হলো না কিছুই, হবার যে নয় একথা খুব মানি
অহেতুক তোমাকে বলা, হলো কেবল অস্বস্তি হয়রানি।

ট্র‍্যাক কখনো ছিল না এক, বুঝি, আমি অন্য রেসের ঘোড়া,
প্রবোধ দিয়েছি নিজেকে, শেষকালে আজ হতে হলো খোঁড়া।

থাকুক এসব বাজে কথা, আমি ক্লাসে তোমার গল্প বলি,
ওদের চোখ টলমল বিষ্ময়, তারা খসে পড়া ঝলমল গলি,

আমি করিডোরে হাঁটি, ছায়াপথে মিশে যাই ক্রমশ
কত পেপার চেক করা বাকি, কত মেঘে ভারী হয় আকাশও।

Pages: 1 [2] 3