Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - provakar_2109

Pages: [1] 2
1
ভারতে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)-এর দ্বাদশ আসর। আইপিএল মানেই যে অর্থের ছড়াছড়ি, এমন বলাটা মোটেই অত্যুক্তি হবে না। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো যেন টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হয় নিলাম অনুষ্ঠানে। কোটি কোটি রুপিতে তারা দলে ভেড়ায় একেকজন তারকা ক্রিকেটারকে। এমনকি নিতান্তই অখ্যাত, অপরিচিত ক্রিকেটারকে দলে নেয়ার জন্যও অনেক সময় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা ব্যয় করে, তা দেখে রীতিমতো চোখ কপালে ওঠে সাধারণ ক্রিকেট সমর্থকদের। পাশাপাশি একটি প্রশ্নও কমবেশি সবার মনের কোণেই উঁকি দিয়ে যায়: ক্রিকেটারদের পেছনে এত অর্থ কীভাবে খরচ করে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো? এত এত অর্থ খরচের পর আদৌ কি তাদের হাতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে? কীসের আশায় তারা প্রতিবছর আইপিএলকে কেন্দ্র করে এতটা মেতে ওঠে?

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, সবকিছুতে লাভ-ক্ষতির হিসাব দেখার কী-ই বা প্রয়োজন! ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা ক্রিকেট খেলাটাকে ভালোবাসে, তাই তারা আইপিএলে দল কেনে, আর সব কাজ বাদ দিয়ে আইপিএল নিয়েই কয়েকটা মাস ব্যস্ত থাকে। কিন্তু না, প্রকৃত বাস্তবতা মোটেই সেরকম না। আইপিএলের প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকই বিশাল বড় ব্যবসায়ী। ক্রিকেট নয়, ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতিই তাদের কাছে মুখ্য বিষয়। আইপিএল থেকে লাভ না হলে, খামোখা তারা একে এত বেশি গুরুত্ব দিত না। আইপিএল তাদের জন্য দারুণ অর্থকরী ও লাভজনক বলেই, বছরের বড় একটা সময় তারা খুশিমনে আইপিএলের পেছনে ব্যয় করতে পারে। এমনকি কোনো কোনো দল মাঠের খেলায় একদমই সুবিধা করতে না পারলেও, সেসব ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক মোটেই হতাশ হয়ে পড়ে না, বরং পরের বছর ঠিকই আবার নতুন উদ্যমে দল গোছানো শুরু করে দেয়।

এখন চলুন পাঠক, জেনে নিই আইপিলে অংশগ্রহণকারী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর লাভের উৎস কী, কেনই বা আইপিএলকে কেন্দ্র করে তাদের এত মাতামাতি।

মিডিয়া স্বত্ত্ব

আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইগুলোর সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো সম্প্রচারকারী টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন স্ট্রিমারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ। প্রাথমিকভাবে এই অর্থ বিসিসিআই গ্রহণ করে, এবং তারপর তারা প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নির্দিষ্ট হারে তাদের ভাগের অর্থ বুঝিয়ে দেয়।

এক্ষেত্রে কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি কয়টি ম্যাচ খেলেছে, এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলেছে, অর্থাৎ কাদের ম্যাচে বেশি দর্শক হয়েছে, এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। সহজ কথায় বলতে গেলে, রাউন্ড রবিন লিগ থেকে বাদ পড়ে যাওয়া দলগুলো মিডিয়া সত্ত্ব বাবদ যে অর্থ পায়, তার তুলনায় প্লে অফ খেলা দলগুলো বেশি অর্থ পায়। আর সবচেয়ে বেশি অর্থ পায় ফাইনালে খেলা দুটি দল। এছাড়া সম্প্রচারকারী চ্যানেল যদি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি অথবা তাদের নির্দিষ্ট এক বা একাধিক খেলোয়াড়কে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান করতে চায়, সে বাবদও ওই ফ্র্যাঞ্চাইজি মোটা অংকের অর্থ পেয়ে থাকে।

মিডিয়া সত্ত্ব থেকেই প্রতিটি আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি ৬০-৭০ শতাংশ লাভ করে থাকে।

ব্র্যান্ড স্পন্সরশিপ

আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের উৎস হলো ব্র্যান্ড স্পন্সরশিপ। প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই কয়েকটি ব্র্যান্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়, এবং নিজেদের জার্সি ও টিম কিটে সেসব ব্র্যান্ডের লোগো প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের বিজ্ঞাপন করে থাকে। এমনকি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি তাদের হোম গ্রাউন্ডের বাউন্ডারির বাইরে কোনো ব্র্যান্ডের লোগোসমৃদ্ধ ব্যারিকেড লাগিয়েও অর্থ পেয়ে থাকে।

স্পন্সররা যত স্পষ্টভাবে তাদের বিজ্ঞাপন দেখাতে চায়, সে অনুযায়ী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তত বেশি আয় করে থাকে। প্রধানত মূল ম্যাচের জার্সির বুকের কাছটায়, এবং পেছনে খেলোয়াড়ের নামের নিচে প্রদর্শিত ব্র্যান্ড লোগো থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে।

এছাড়া ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে চুক্তি মোতাবেক, ব্র্যান্ডগুলো চাইলে সেই ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে কোনো বিশেষ ইভেন্টের আয়োজনও করতে পারে। এছাড়া অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড়রাই তাদের প্রধান স্পন্সর ব্র্যান্ডের টিভি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে থাকে। এগুলোর মাধ্যমেও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো প্রচুর অর্থ পেয়ে থাকে।

স্পন্সরশিপ থেকেই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো ২০-৩০ শতাংশ লাভ করে থাকে।

টিকিট বিক্রি

ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তাদের হোম ম্যাচের জন্য টিকিট বিক্রি থেকে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ পেয়ে থাকে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরাই মূলত হোম ম্যাচের টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। টিকিট বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের সামান্য অংশ স্পন্সর এবং বিসিসিআইকে দেয়া হয়, আর বাকি প্রায় ৮০ শতাংশের মতো অর্থই চলে যায় ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের পকেটে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা তাদের ইচ্ছামতো টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে বটে, তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হয়: তাদের হোম গ্রাউন্ডের দর্শক ধারণক্ষমতা, তাদের দলের জনপ্রিয়তা, ঐ শহরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি। এছাড়া টিকিটের দাম যেন এত বেশি হয়ে না যায় যে তা আগ্রহী দর্শকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, এ বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হয়।

আইপিএল কর্তৃপক্ষ চায়, যেকোনো ভাবেই হোক, গ্যালারির একটি আসনও যেন ফাঁকা না থাকে, এবং টিভিতে বসে খেলা দেখা দর্শকদের যেন মনে হয় এবারের আসর খুবই হিট হয়েছে। এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে, ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা অনেক সময় টিকিট বাবদ ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণেও বাধ্য হয়, যাতে খুব বেশি আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও দর্শক স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখে।

টিকিট বিক্রি থেকে আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মোট লাভের ১০ শতাংশের মতো উঠে আসে।

প্রাইজ মানি

প্রাইজ মানি বাবদও অংশগ্রহণকারী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো মোটা অংকের অর্থ পেয়ে থাকে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ আসরের চ্যাম্পিয়ন দল চেন্নাই সুপার কিংস প্রাইজ মানি হিসেবে পেয়েছিল মোট ২০ কোটি রুপি। এই অর্থকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। ১০ কোটি রুপি দলের পুরো স্কোয়াড ও কোচিং স্টাফদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল, আর ১০ কোটি রুপি পেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক। এছাড়া রানার্স-আপ দল সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ পেয়েছিল ১২.৫ কোটি রুপি। প্লে-অফ খেলা বাকি দুই দলও বেশ ভালো প্রাইজ মানি পেয়েছিল।

মার্চেন্ডাইজ বিক্রি

ক্লাব ফুটবলে মার্চেন্ডাইজ বিক্রয়ী একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের মোট লাভের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আসে মার্চেন্ডাইজ বিক্রি থেকে। সে তুলনায় আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো এখনো বেশ পিছিয়ে আছে। তাদের মোট লাভের মাত্র ৫ শতাংশ আসে মার্চেন্ডাইজ বিক্রি থেকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভুলে গেলে চলবে না, ক্লাব ফুটবল চলে প্রায় সারা বছর ধরে, সে তুলনায় আইপিএলের উন্মাদনা থাকে বছরে মাস দুয়েক। তাই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মার্চেন্ডাইজ বিক্রি বাবদ এর চেয়ে বেশি লাভ করা কঠিনই বটে। তারপরও, প্রতি বছরই মার্চেন্ডাইজ বাবদ লাভের পরিমাণ বাড়ছে। আইপিএল তো সবে ১২ বছরে পা দিল। আজ থেকে আরো পাঁচ বা দশ বছর পর হয়তো মার্চেন্ডাইজ বাবদ লাভের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই মার্চেন্ডাইজ হিসেবে তাদের মূল জার্সির রেপ্লিকা, টুপি, ঘড়ি ইত্যাদি বিক্রি করছে। এই খাতে অদূর ভবিষ্যতে আরো নতুন নতুন উদ্ভাবনের সম্ভাবনা রয়েছে।

বিসিসিআই সেন্ট্রাল পুল

বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো মিডিয়া সত্ত্ব বাবদ অর্থ তো পায়ই, এর পাশাপাশি তারা আইপিএলের অফিসিয়াল স্পন্সরশিপ ও পার্টনারশিপ বাবদও অর্থ পেয়ে থাকে। বিসিসিআইয়ের সেন্ট্রাল পুল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কী পরিমাণ অর্থ লাভ করবে, তা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তবে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হলো লিগ টেবিলে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর অবস্থান।

স্টল ভাড়া

প্রতিটি ম্যাচ চলাকালীনই দর্শকরা যাতে খাবার ও পানীয় কিনতে পারে, সেজন্য স্টেডিয়ামের ভেতর স্টল বসে। কিন্তু এসব স্টল ফ্র্যাঞ্চাইজিরা নিজেরা চালায় না। তারা কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে স্টল ভাড়া দেয়, এবং তার বিনিময়ে তারা অর্থ পায়। সাধারণত তৃতীয় পক্ষের সাথে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর চুক্তি প্রতি ম্যাচ করে বর্ধিত করা হয়, এবং এ খাতে প্রতিটি স্টল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ নিয়ে থাকে।

প্লেয়ার ট্রেডিং

প্রতি বছর আইপিএলের আগে একটি নিলাম অনুষ্ঠান হয়। তবে এর আগে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের মতো করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ট্রান্সফার উইন্ডোও খোলা হয়। এই সময়ের মধ্যে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নিজেদের মধ্যে খেলোয়াড় অদল-বদল করতে পারে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি একজন খুব বড় তারকা খেলোয়াড়ের বদলে নিজেদের দলে একজন সাধারণ বা গড়পড়তা মানের খেলোয়াড় নিচ্ছে, এবং সেই সাথে তারা মোটা অংকের অর্থ 'ক্ষতিপূরণ' হিসেবেও পেয়ে যাচ্ছে।

নিজেদের ব্র্যান্ডের প্রচারণা

স্পন্সরদের বিজ্ঞাপন প্রচার তো রয়েছেই, সেই সাথে আইপিএল কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর জন্য নিজেদের ব্র্যান্ডের প্রচারণা চালানোরও খুব বড় একটি প্ল্যাটফর্ম। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকই খুব বড় ব্যবসায়ী, ফলে তাদের অসংখ্য ছোট-বড় ব্র্যান্ড ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি কেনার মাধ্যমে তারা তাদের সেসব ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠানের মুফতে প্রচারণাও কিন্তু চালাতে পারছেন।

শেষ কথা

এতক্ষণ তো বলা হলো আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কীভাবে লাভ করে থাকে। কিন্তু আপনাদের আগ্রহ নিশ্চয়ই এখনো মেটেনি? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে, প্রতি বছর আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কী পরিমাণ লাভ করে থাকে। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ মৌসুমে আইপিএলের প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই কমপক্ষে ৭৫ কোটি রুপি করে লাভ করেছে। আর কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি নাকি ১০০ থেকে ১২৫ কোটি রুপি পর্যন্তও লাভ করেছে।

2
ভারতে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)-এর দ্বাদশ আসর। আইপিএল মানেই যে অর্থের ছড়াছড়ি, এমন বলাটা মোটেই অত্যুক্তি হবে না। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো যেন টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হয় নিলাম অনুষ্ঠানে। কোটি কোটি রুপিতে তারা দলে ভেড়ায় একেকজন তারকা ক্রিকেটারকে। এমনকি নিতান্তই অখ্যাত, অপরিচিত ক্রিকেটারকে দলে নেয়ার জন্যও অনেক সময় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা ব্যয় করে, তা দেখে রীতিমতো চোখ কপালে ওঠে সাধারণ ক্রিকেট সমর্থকদের। পাশাপাশি একটি প্রশ্নও কমবেশি সবার মনের কোণেই উঁকি দিয়ে যায়: ক্রিকেটারদের পেছনে এত অর্থ কীভাবে খরচ করে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো? এত এত অর্থ খরচের পর আদৌ কি তাদের হাতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে? কীসের আশায় তারা প্রতিবছর আইপিএলকে কেন্দ্র করে এতটা মেতে ওঠে?

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, সবকিছুতে লাভ-ক্ষতির হিসাব দেখার কী-ই বা প্রয়োজন! ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা ক্রিকেট খেলাটাকে ভালোবাসে, তাই তারা আইপিএলে দল কেনে, আর সব কাজ বাদ দিয়ে আইপিএল নিয়েই কয়েকটা মাস ব্যস্ত থাকে। কিন্তু না, প্রকৃত বাস্তবতা মোটেই সেরকম না। আইপিএলের প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকই বিশাল বড় ব্যবসায়ী। ক্রিকেট নয়, ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতিই তাদের কাছে মুখ্য বিষয়। আইপিএল থেকে লাভ না হলে, খামোখা তারা একে এত বেশি গুরুত্ব দিত না। আইপিএল তাদের জন্য দারুণ অর্থকরী ও লাভজনক বলেই, বছরের বড় একটা সময় তারা খুশিমনে আইপিএলের পেছনে ব্যয় করতে পারে। এমনকি কোনো কোনো দল মাঠের খেলায় একদমই সুবিধা করতে না পারলেও, সেসব ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক মোটেই হতাশ হয়ে পড়ে না, বরং পরের বছর ঠিকই আবার নতুন উদ্যমে দল গোছানো শুরু করে দেয়।

এখন চলুন পাঠক, জেনে নিই আইপিলে অংশগ্রহণকারী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর লাভের উৎস কী, কেনই বা আইপিএলকে কেন্দ্র করে তাদের এত মাতামাতি।

মিডিয়া স্বত্ত্ব

আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইগুলোর সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো সম্প্রচারকারী টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন স্ট্রিমারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ। প্রাথমিকভাবে এই অর্থ বিসিসিআই গ্রহণ করে, এবং তারপর তারা প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নির্দিষ্ট হারে তাদের ভাগের অর্থ বুঝিয়ে দেয়।

এক্ষেত্রে কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি কয়টি ম্যাচ খেলেছে, এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলেছে, অর্থাৎ কাদের ম্যাচে বেশি দর্শক হয়েছে, এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। সহজ কথায় বলতে গেলে, রাউন্ড রবিন লিগ থেকে বাদ পড়ে যাওয়া দলগুলো মিডিয়া সত্ত্ব বাবদ যে অর্থ পায়, তার তুলনায় প্লে অফ খেলা দলগুলো বেশি অর্থ পায়। আর সবচেয়ে বেশি অর্থ পায় ফাইনালে খেলা দুটি দল। এছাড়া সম্প্রচারকারী চ্যানেল যদি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি অথবা তাদের নির্দিষ্ট এক বা একাধিক খেলোয়াড়কে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান করতে চায়, সে বাবদও ওই ফ্র্যাঞ্চাইজি মোটা অংকের অর্থ পেয়ে থাকে।

মিডিয়া সত্ত্ব থেকেই প্রতিটি আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি ৬০-৭০ শতাংশ লাভ করে থাকে।

ব্র্যান্ড স্পন্সরশিপ

আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের উৎস হলো ব্র্যান্ড স্পন্সরশিপ। প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই কয়েকটি ব্র্যান্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়, এবং নিজেদের জার্সি ও টিম কিটে সেসব ব্র্যান্ডের লোগো প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের বিজ্ঞাপন করে থাকে। এমনকি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি তাদের হোম গ্রাউন্ডের বাউন্ডারির বাইরে কোনো ব্র্যান্ডের লোগোসমৃদ্ধ ব্যারিকেড লাগিয়েও অর্থ পেয়ে থাকে।

স্পন্সররা যত স্পষ্টভাবে তাদের বিজ্ঞাপন দেখাতে চায়, সে অনুযায়ী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তত বেশি আয় করে থাকে। প্রধানত মূল ম্যাচের জার্সির বুকের কাছটায়, এবং পেছনে খেলোয়াড়ের নামের নিচে প্রদর্শিত ব্র্যান্ড লোগো থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে।

এছাড়া ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে চুক্তি মোতাবেক, ব্র্যান্ডগুলো চাইলে সেই ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে কোনো বিশেষ ইভেন্টের আয়োজনও করতে পারে। এছাড়া অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড়রাই তাদের প্রধান স্পন্সর ব্র্যান্ডের টিভি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে থাকে। এগুলোর মাধ্যমেও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো প্রচুর অর্থ পেয়ে থাকে।

স্পন্সরশিপ থেকেই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো ২০-৩০ শতাংশ লাভ করে থাকে।

টিকিট বিক্রি

ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তাদের হোম ম্যাচের জন্য টিকিট বিক্রি থেকে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ পেয়ে থাকে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরাই মূলত হোম ম্যাচের টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। টিকিট বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের সামান্য অংশ স্পন্সর এবং বিসিসিআইকে দেয়া হয়, আর বাকি প্রায় ৮০ শতাংশের মতো অর্থই চলে যায় ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের পকেটে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা তাদের ইচ্ছামতো টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে বটে, তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হয়: তাদের হোম গ্রাউন্ডের দর্শক ধারণক্ষমতা, তাদের দলের জনপ্রিয়তা, ঐ শহরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি। এছাড়া টিকিটের দাম যেন এত বেশি হয়ে না যায় যে তা আগ্রহী দর্শকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, এ বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হয়।

আইপিএল কর্তৃপক্ষ চায়, যেকোনো ভাবেই হোক, গ্যালারির একটি আসনও যেন ফাঁকা না থাকে, এবং টিভিতে বসে খেলা দেখা দর্শকদের যেন মনে হয় এবারের আসর খুবই হিট হয়েছে। এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে, ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা অনেক সময় টিকিট বাবদ ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণেও বাধ্য হয়, যাতে খুব বেশি আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও দর্শক স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখে।

টিকিট বিক্রি থেকে আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মোট লাভের ১০ শতাংশের মতো উঠে আসে।

প্রাইজ মানি

প্রাইজ মানি বাবদও অংশগ্রহণকারী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো মোটা অংকের অর্থ পেয়ে থাকে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ আসরের চ্যাম্পিয়ন দল চেন্নাই সুপার কিংস প্রাইজ মানি হিসেবে পেয়েছিল মোট ২০ কোটি রুপি। এই অর্থকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। ১০ কোটি রুপি দলের পুরো স্কোয়াড ও কোচিং স্টাফদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল, আর ১০ কোটি রুপি পেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক। এছাড়া রানার্স-আপ দল সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ পেয়েছিল ১২.৫ কোটি রুপি। প্লে-অফ খেলা বাকি দুই দলও বেশ ভালো প্রাইজ মানি পেয়েছিল।

মার্চেন্ডাইজ বিক্রি

ক্লাব ফুটবলে মার্চেন্ডাইজ বিক্রয়ী একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের মোট লাভের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আসে মার্চেন্ডাইজ বিক্রি থেকে। সে তুলনায় আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো এখনো বেশ পিছিয়ে আছে। তাদের মোট লাভের মাত্র ৫ শতাংশ আসে মার্চেন্ডাইজ বিক্রি থেকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভুলে গেলে চলবে না, ক্লাব ফুটবল চলে প্রায় সারা বছর ধরে, সে তুলনায় আইপিএলের উন্মাদনা থাকে বছরে মাস দুয়েক। তাই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মার্চেন্ডাইজ বিক্রি বাবদ এর চেয়ে বেশি লাভ করা কঠিনই বটে। তারপরও, প্রতি বছরই মার্চেন্ডাইজ বাবদ লাভের পরিমাণ বাড়ছে। আইপিএল তো সবে ১২ বছরে পা দিল। আজ থেকে আরো পাঁচ বা দশ বছর পর হয়তো মার্চেন্ডাইজ বাবদ লাভের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই মার্চেন্ডাইজ হিসেবে তাদের মূল জার্সির রেপ্লিকা, টুপি, ঘড়ি ইত্যাদি বিক্রি করছে। এই খাতে অদূর ভবিষ্যতে আরো নতুন নতুন উদ্ভাবনের সম্ভাবনা রয়েছে।

বিসিসিআই সেন্ট্রাল পুল

বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো মিডিয়া সত্ত্ব বাবদ অর্থ তো পায়ই, এর পাশাপাশি তারা আইপিএলের অফিসিয়াল স্পন্সরশিপ ও পার্টনারশিপ বাবদও অর্থ পেয়ে থাকে। বিসিসিআইয়ের সেন্ট্রাল পুল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কী পরিমাণ অর্থ লাভ করবে, তা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তবে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হলো লিগ টেবিলে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর অবস্থান।

স্টল ভাড়া

প্রতিটি ম্যাচ চলাকালীনই দর্শকরা যাতে খাবার ও পানীয় কিনতে পারে, সেজন্য স্টেডিয়ামের ভেতর স্টল বসে। কিন্তু এসব স্টল ফ্র্যাঞ্চাইজিরা নিজেরা চালায় না। তারা কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে স্টল ভাড়া দেয়, এবং তার বিনিময়ে তারা অর্থ পায়। সাধারণত তৃতীয় পক্ষের সাথে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর চুক্তি প্রতি ম্যাচ করে বর্ধিত করা হয়, এবং এ খাতে প্রতিটি স্টল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ নিয়ে থাকে।

প্লেয়ার ট্রেডিং

প্রতি বছর আইপিএলের আগে একটি নিলাম অনুষ্ঠান হয়। তবে এর আগে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের মতো করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ট্রান্সফার উইন্ডোও খোলা হয়। এই সময়ের মধ্যে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নিজেদের মধ্যে খেলোয়াড় অদল-বদল করতে পারে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি একজন খুব বড় তারকা খেলোয়াড়ের বদলে নিজেদের দলে একজন সাধারণ বা গড়পড়তা মানের খেলোয়াড় নিচ্ছে, এবং সেই সাথে তারা মোটা অংকের অর্থ 'ক্ষতিপূরণ' হিসেবেও পেয়ে যাচ্ছে।

নিজেদের ব্র্যান্ডের প্রচারণা

স্পন্সরদের বিজ্ঞাপন প্রচার তো রয়েছেই, সেই সাথে আইপিএল কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর জন্য নিজেদের ব্র্যান্ডের প্রচারণা চালানোরও খুব বড় একটি প্ল্যাটফর্ম। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকই খুব বড় ব্যবসায়ী, ফলে তাদের অসংখ্য ছোট-বড় ব্র্যান্ড ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি কেনার মাধ্যমে তারা তাদের সেসব ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠানের মুফতে প্রচারণাও কিন্তু চালাতে পারছেন।

শেষ কথা

এতক্ষণ তো বলা হলো আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কীভাবে লাভ করে থাকে। কিন্তু আপনাদের আগ্রহ নিশ্চয়ই এখনো মেটেনি? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে, প্রতি বছর আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কী পরিমাণ লাভ করে থাকে। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ মৌসুমে আইপিএলের প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই কমপক্ষে ৭৫ কোটি রুপি করে লাভ করেছে। আর কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি নাকি ১০০ থেকে ১২৫ কোটি রুপি পর্যন্তও লাভ করেছে।

3
ভারতে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)-এর দ্বাদশ আসর। আইপিএল মানেই যে অর্থের ছড়াছড়ি, এমন বলাটা মোটেই অত্যুক্তি হবে না। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো যেন টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হয় নিলাম অনুষ্ঠানে। কোটি কোটি রুপিতে তারা দলে ভেড়ায় একেকজন তারকা ক্রিকেটারকে। এমনকি নিতান্তই অখ্যাত, অপরিচিত ক্রিকেটারকে দলে নেয়ার জন্যও অনেক সময় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা ব্যয় করে, তা দেখে রীতিমতো চোখ কপালে ওঠে সাধারণ ক্রিকেট সমর্থকদের। পাশাপাশি একটি প্রশ্নও কমবেশি সবার মনের কোণেই উঁকি দিয়ে যায়: ক্রিকেটারদের পেছনে এত অর্থ কীভাবে খরচ করে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো? এত এত অর্থ খরচের পর আদৌ কি তাদের হাতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে? কীসের আশায় তারা প্রতিবছর আইপিএলকে কেন্দ্র করে এতটা মেতে ওঠে?

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, সবকিছুতে লাভ-ক্ষতির হিসাব দেখার কী-ই বা প্রয়োজন! ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা ক্রিকেট খেলাটাকে ভালোবাসে, তাই তারা আইপিএলে দল কেনে, আর সব কাজ বাদ দিয়ে আইপিএল নিয়েই কয়েকটা মাস ব্যস্ত থাকে। কিন্তু না, প্রকৃত বাস্তবতা মোটেই সেরকম না। আইপিএলের প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকই বিশাল বড় ব্যবসায়ী। ক্রিকেট নয়, ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতিই তাদের কাছে মুখ্য বিষয়। আইপিএল থেকে লাভ না হলে, খামোখা তারা একে এত বেশি গুরুত্ব দিত না। আইপিএল তাদের জন্য দারুণ অর্থকরী ও লাভজনক বলেই, বছরের বড় একটা সময় তারা খুশিমনে আইপিএলের পেছনে ব্যয় করতে পারে। এমনকি কোনো কোনো দল মাঠের খেলায় একদমই সুবিধা করতে না পারলেও, সেসব ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক মোটেই হতাশ হয়ে পড়ে না, বরং পরের বছর ঠিকই আবার নতুন উদ্যমে দল গোছানো শুরু করে দেয়।

এখন চলুন পাঠক, জেনে নিই আইপিলে অংশগ্রহণকারী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর লাভের উৎস কী, কেনই বা আইপিএলকে কেন্দ্র করে তাদের এত মাতামাতি।

মিডিয়া স্বত্ত্ব

আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইগুলোর সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো সম্প্রচারকারী টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন স্ট্রিমারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ। প্রাথমিকভাবে এই অর্থ বিসিসিআই গ্রহণ করে, এবং তারপর তারা প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নির্দিষ্ট হারে তাদের ভাগের অর্থ বুঝিয়ে দেয়।

এক্ষেত্রে কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি কয়টি ম্যাচ খেলেছে, এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলেছে, অর্থাৎ কাদের ম্যাচে বেশি দর্শক হয়েছে, এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। সহজ কথায় বলতে গেলে, রাউন্ড রবিন লিগ থেকে বাদ পড়ে যাওয়া দলগুলো মিডিয়া সত্ত্ব বাবদ যে অর্থ পায়, তার তুলনায় প্লে অফ খেলা দলগুলো বেশি অর্থ পায়। আর সবচেয়ে বেশি অর্থ পায় ফাইনালে খেলা দুটি দল। এছাড়া সম্প্রচারকারী চ্যানেল যদি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি অথবা তাদের নির্দিষ্ট এক বা একাধিক খেলোয়াড়কে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান করতে চায়, সে বাবদও ওই ফ্র্যাঞ্চাইজি মোটা অংকের অর্থ পেয়ে থাকে।

মিডিয়া সত্ত্ব থেকেই প্রতিটি আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি ৬০-৭০ শতাংশ লাভ করে থাকে।

ব্র্যান্ড স্পন্সরশিপ

আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের উৎস হলো ব্র্যান্ড স্পন্সরশিপ। প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই কয়েকটি ব্র্যান্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়, এবং নিজেদের জার্সি ও টিম কিটে সেসব ব্র্যান্ডের লোগো প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের বিজ্ঞাপন করে থাকে। এমনকি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি তাদের হোম গ্রাউন্ডের বাউন্ডারির বাইরে কোনো ব্র্যান্ডের লোগোসমৃদ্ধ ব্যারিকেড লাগিয়েও অর্থ পেয়ে থাকে।

স্পন্সররা যত স্পষ্টভাবে তাদের বিজ্ঞাপন দেখাতে চায়, সে অনুযায়ী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তত বেশি আয় করে থাকে। প্রধানত মূল ম্যাচের জার্সির বুকের কাছটায়, এবং পেছনে খেলোয়াড়ের নামের নিচে প্রদর্শিত ব্র্যান্ড লোগো থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে।

এছাড়া ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে চুক্তি মোতাবেক, ব্র্যান্ডগুলো চাইলে সেই ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে কোনো বিশেষ ইভেন্টের আয়োজনও করতে পারে। এছাড়া অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড়রাই তাদের প্রধান স্পন্সর ব্র্যান্ডের টিভি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে থাকে। এগুলোর মাধ্যমেও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো প্রচুর অর্থ পেয়ে থাকে।

স্পন্সরশিপ থেকেই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো ২০-৩০ শতাংশ লাভ করে থাকে।

টিকিট বিক্রি

ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তাদের হোম ম্যাচের জন্য টিকিট বিক্রি থেকে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ পেয়ে থাকে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরাই মূলত হোম ম্যাচের টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। টিকিট বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের সামান্য অংশ স্পন্সর এবং বিসিসিআইকে দেয়া হয়, আর বাকি প্রায় ৮০ শতাংশের মতো অর্থই চলে যায় ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের পকেটে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা তাদের ইচ্ছামতো টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে বটে, তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হয়: তাদের হোম গ্রাউন্ডের দর্শক ধারণক্ষমতা, তাদের দলের জনপ্রিয়তা, ঐ শহরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি। এছাড়া টিকিটের দাম যেন এত বেশি হয়ে না যায় যে তা আগ্রহী দর্শকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, এ বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হয়।

আইপিএল কর্তৃপক্ষ চায়, যেকোনো ভাবেই হোক, গ্যালারির একটি আসনও যেন ফাঁকা না থাকে, এবং টিভিতে বসে খেলা দেখা দর্শকদের যেন মনে হয় এবারের আসর খুবই হিট হয়েছে। এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে, ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা অনেক সময় টিকিট বাবদ ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণেও বাধ্য হয়, যাতে খুব বেশি আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও দর্শক স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখে।

টিকিট বিক্রি থেকে আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মোট লাভের ১০ শতাংশের মতো উঠে আসে।

প্রাইজ মানি

প্রাইজ মানি বাবদও অংশগ্রহণকারী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো মোটা অংকের অর্থ পেয়ে থাকে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ আসরের চ্যাম্পিয়ন দল চেন্নাই সুপার কিংস প্রাইজ মানি হিসেবে পেয়েছিল মোট ২০ কোটি রুপি। এই অর্থকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। ১০ কোটি রুপি দলের পুরো স্কোয়াড ও কোচিং স্টাফদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল, আর ১০ কোটি রুপি পেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক। এছাড়া রানার্স-আপ দল সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ পেয়েছিল ১২.৫ কোটি রুপি। প্লে-অফ খেলা বাকি দুই দলও বেশ ভালো প্রাইজ মানি পেয়েছিল।

মার্চেন্ডাইজ বিক্রি

ক্লাব ফুটবলে মার্চেন্ডাইজ বিক্রয়ী একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের মোট লাভের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আসে মার্চেন্ডাইজ বিক্রি থেকে। সে তুলনায় আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো এখনো বেশ পিছিয়ে আছে। তাদের মোট লাভের মাত্র ৫ শতাংশ আসে মার্চেন্ডাইজ বিক্রি থেকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভুলে গেলে চলবে না, ক্লাব ফুটবল চলে প্রায় সারা বছর ধরে, সে তুলনায় আইপিএলের উন্মাদনা থাকে বছরে মাস দুয়েক। তাই আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মার্চেন্ডাইজ বিক্রি বাবদ এর চেয়ে বেশি লাভ করা কঠিনই বটে। তারপরও, প্রতি বছরই মার্চেন্ডাইজ বাবদ লাভের পরিমাণ বাড়ছে। আইপিএল তো সবে ১২ বছরে পা দিল। আজ থেকে আরো পাঁচ বা দশ বছর পর হয়তো মার্চেন্ডাইজ বাবদ লাভের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই মার্চেন্ডাইজ হিসেবে তাদের মূল জার্সির রেপ্লিকা, টুপি, ঘড়ি ইত্যাদি বিক্রি করছে। এই খাতে অদূর ভবিষ্যতে আরো নতুন নতুন উদ্ভাবনের সম্ভাবনা রয়েছে।

বিসিসিআই সেন্ট্রাল পুল

বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো মিডিয়া সত্ত্ব বাবদ অর্থ তো পায়ই, এর পাশাপাশি তারা আইপিএলের অফিসিয়াল স্পন্সরশিপ ও পার্টনারশিপ বাবদও অর্থ পেয়ে থাকে। বিসিসিআইয়ের সেন্ট্রাল পুল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কী পরিমাণ অর্থ লাভ করবে, তা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তবে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হলো লিগ টেবিলে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর অবস্থান।

স্টল ভাড়া

প্রতিটি ম্যাচ চলাকালীনই দর্শকরা যাতে খাবার ও পানীয় কিনতে পারে, সেজন্য স্টেডিয়ামের ভেতর স্টল বসে। কিন্তু এসব স্টল ফ্র্যাঞ্চাইজিরা নিজেরা চালায় না। তারা কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে স্টল ভাড়া দেয়, এবং তার বিনিময়ে তারা অর্থ পায়। সাধারণত তৃতীয় পক্ষের সাথে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর চুক্তি প্রতি ম্যাচ করে বর্ধিত করা হয়, এবং এ খাতে প্রতিটি স্টল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ নিয়ে থাকে।

প্লেয়ার ট্রেডিং

প্রতি বছর আইপিএলের আগে একটি নিলাম অনুষ্ঠান হয়। তবে এর আগে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের মতো করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ট্রান্সফার উইন্ডোও খোলা হয়। এই সময়ের মধ্যে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নিজেদের মধ্যে খেলোয়াড় অদল-বদল করতে পারে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি একজন খুব বড় তারকা খেলোয়াড়ের বদলে নিজেদের দলে একজন সাধারণ বা গড়পড়তা মানের খেলোয়াড় নিচ্ছে, এবং সেই সাথে তারা মোটা অংকের অর্থ 'ক্ষতিপূরণ' হিসেবেও পেয়ে যাচ্ছে।

নিজেদের ব্র্যান্ডের প্রচারণা

স্পন্সরদের বিজ্ঞাপন প্রচার তো রয়েছেই, সেই সাথে আইপিএল কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর জন্য নিজেদের ব্র্যান্ডের প্রচারণা চালানোরও খুব বড় একটি প্ল্যাটফর্ম। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকই খুব বড় ব্যবসায়ী, ফলে তাদের অসংখ্য ছোট-বড় ব্র্যান্ড ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি কেনার মাধ্যমে তারা তাদের সেসব ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠানের মুফতে প্রচারণাও কিন্তু চালাতে পারছেন।

শেষ কথা

এতক্ষণ তো বলা হলো আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কীভাবে লাভ করে থাকে। কিন্তু আপনাদের আগ্রহ নিশ্চয়ই এখনো মেটেনি? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে, প্রতি বছর আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কী পরিমাণ লাভ করে থাকে। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ মৌসুমে আইপিএলের প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই কমপক্ষে ৭৫ কোটি রুপি করে লাভ করেছে। আর কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি নাকি ১০০ থেকে ১২৫ কোটি রুপি পর্যন্তও লাভ করেছে।

4
১.

ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা সম্মিলিতভাবে ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন করে। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে শ্রীলঙ্কার মাটিতে গ্রুপপর্বে নিজেদের ম্যাচ খেলতে যায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়া। এই দু'টি ম্যাচেই শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার মাটিতে খেলতে না যাওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে তেমন সমস্যা হয়নি। তিন জয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে গ্রুপ ‘এ’ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে না খেলার পর কেনিয়ার বিপক্ষেও পরাজিত হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এতে করে তাদের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার সমীকরণ বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত বড় ধরণের অঘটন ঘটেনি। গ্রুপ ‘এ’ থেকে চতুর্থ অবস্থানে থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল তারা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসাবে পায় গ্রুপপর্বে পাঁচ ম্যাচের পাঁচটিতে জয় পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে। গ্রুপপর্বে দুর্দান্ত খেললেও কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রায়ান লারার অসাধারণ ব্যাটিংয়ের পর রজার হার্পারের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ১৯ রানে হেরে বিদায় নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

অস্ট্রেলিয়া তাদের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে প্রতিবেশী নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বড় রান তাড়া করে জয় পায়। যার ফলে শেষ চারে আবারও মুখোমুখি হয় গ্রুপ ‘এ’তে দুই দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়া। কেনিয়ার বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরাজিত হলেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের গ্রুপপর্বের জয় পেয়েছিল তারা।
২.

গ্রুপপর্বে ধুঁকতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেমিফাইনালের আগে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াকে গ্রুপপর্বের ম্যাচে পরাজিত করেছিল তারা। মোহালিতে '৯৬ সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মার্ক টেলর। মোহালির পেস সহায়ক উইকেটে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে উইন্ডিজ পেসারদের তোপের মুখে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা। মাত্র ১৫ রান তুলতেই সাজঘরে ফিরে যান মার্ক টেলর, দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মার্ক ওয়াহ, রিকি পন্টিং এবং স্টিভ ওয়াহ। এই চার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান মোট চার রান যোগ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে।

দলের বিপর্যয়ের মুখে বুক চিতিয়ে লড়াই করার ক্ষেত্রে মাইকেল বেভানের বিকল্প হয় না। সেমিফাইনালেও তিনি দলের বিপদে ব্যাট হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, সঙ্গী হিসাবে পেয়ে যান স্টুয়ার্ট ল'কে। এই দুইজন ব্যাটসম্যান ধীরগতিতে ব্যাটিং করে বড় জুটি গড়েন। নিজেদের ইনিংসের শুরুতে রান তোলার চেয়ে উইকেটে টিকে থাকাকেই বেশি প্রাধান্য দেন তারা। তাদের ১৩৮ রানের অসাধারণ জুটি ভাঙে স্টুয়ার্ট ল রান আউট হয়ে ফিরে গেলে। তিনি দলীয় ১৫৩ রানের মাথায় ১০৫ বলে পাঁচটি চারের মারে ৭২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তার বিদায়ের পর মাইকেল বেভানও দ্রুত ফিরে যান, তিনি ১১০ বলে চারটি চার এবং একটি ছয়ের মারে ৬৯ রান করেছিলেন।

এই দুইজনের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের পর উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান ইয়ান হিলি ২৮ বলে দ্রুত ৩১ রানের ইনিংস খেলে দলকে লড়াই করার মতো পুঁজি এনে দেন। শেষদিকে তার দ্রুত রান তোলার ফলে অস্ট্রেলিয়া নির্ধারিত ওভার শেষে আট উইকেটে ২০৭ রান সংগ্রহ করে। ম্যাচের প্রথমভাগের ব্যর্থতার পর ল, বেভান এবং হিলির ব্যাটে চড়ে বেশ ভালোভাবেই ম্যাচে ফিরেছিল অস্ট্রেলিয়া।
৩.

মোহালিতে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই পেসার কার্টলি অ্যামব্রোস এবং ইয়ান বিশপ আগুনঝড়ানো বোলিংয়ে মাত্র ১৫ রানেই চার উইকেট হারিয়ে বসেছিল অস্ট্রেলিয়া। মার্ক টেইলর এবং স্টিভ ওয়াহকে সরাসরি বোল্ড করেছিলেন বিশপ। মার্ক ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেছিলেন অ্যামব্রোস। অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা আরও শোচনীয় হতে পারতো, যদি বিশপ তার পা দাগের মধ্যে রাখতে পারতেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ ৭২ রান করা স্টুয়ার্ট ল তার বলে মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়েছিল, কিন্তু বিশপ সেই বলটি নো করে বসেন। এরপর থেকে ল এবং বেভান জুটি অস্ট্রেলিয়াকে লড়াকু সংগ্রহ এনে দিয়েছিলেন।

নিজের করা নো বল নিয়ে ইয়ান বিশপের আফসোস ইতি ছিল না। এই সম্পর্কে তিনি বলেন,

    'আমার নো বলে স্টুয়ার্ট ল ক্যাচ উঠিয়েছিল। আমার মনে হয়, সে মিড উইকেটে ফ্লিক করেছিল। সে সময় এটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রু হতে পারতো। এখনও এটা আমাকে পীড়া দেয় যে, আমি আমার পা দাগের ভেতরে রাখতে পারিনি।'

মাইকেল বেভান এবং স্টুয়ার্ট ল দুইজনেই বেশ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান ছিলেন। তবে স্টুয়ার্ট ল সেই তুলনায় অনভিজ্ঞ ছিলেন। ল'কে আউট করা বলটি যদি বিশপ নো বল না করতেন, তাহলে অস্ট্রেলিয়া বেশ চাপে পড়ে যেতো। শেষ পর্যন্ত ভাগ্য সহায় থাকার কারণে দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন তিনি।
৪.

অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২০৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শিবনারায়ণ চন্দরপলের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে জয়ের পথেই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অন্যদিকে, মোহালিতে শিশিরের কারণে অস্ট্রেলিয়ার দুই লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন এবং স্টুয়ার্ট ল'র বোলিং করতে সমস্যা হচ্ছিল। শিশির খুব বেশি ছিল না, কিন্তু যতটুকু ছিল তাতেই সমস্যায় পড়েছিলো স্পিনাররা। একের পর এক ফুলটস দিতে থাকেন তারা। এই সুযোগই ভালোভাবে কাজে লাগিয়ে দলের রানের চাকা এগিয়ে নিতে থাকেন লারা-চন্দরপলরা।

উদ্বোধনী উইকেট জুটি ২৫ রানে ভেঙে যাওয়ার পর জুটি বাঁধেন চন্দরপল এবং ব্রায়ান লারা। তারা দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৬৮ রান যোগ করেন। ৪৫ বলে ৪৫ রান করা লারা দলীয় ৯৩ রানে ফিরে গেলে এই জুটি ভাঙে। এরপর অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসন ব্যাট করতে নেমে চন্দরপলকে সাথে নিয়ে দলকে জয়ের পথে রাখেন।

এক পর্যায়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ ছিল দুই উইকেটে ১৬৫ রান। জয়ের জন্য আট উইকেট হাতে রেখে মাত্র ৪৩ রান প্রয়োজন ছিল তাদের। এমন পরিস্থিতিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে ১৯৮৩ সালের পর আবারও বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার হাতছানি দেয়।

শিবনারায়ণ চন্দরপল দলীয় ১৬৫ রানের মাথায় ৮০ রান করে সাজঘরে ফিরে গেলে রিচার্ডসন এবং তার মধ্যকার ৭২ রানে জুটি ভাঙে। এই জুটি ভাঙার পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভাবেনি, তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। জিমি অ্যাডামস এবং কীথ আর্থারটনকে ব্যাটিংয়ে না নামিয়ে রজার হার্পার এবং ওটিস গিবসনকে ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খামখেয়ালিপনার সুযোগ কাজে লাগায় অস্ট্রেলিয়া। শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং ফ্লেমিংয়ের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে দুই উইকেটে ১৬৫ রান থেকে ১৮৭ রান তুলতেই সাত উইকেট হারায় তারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ গ্রুপপর্বেও কেনিয়াকে 'সহজভাবে' নিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল।
৫.

দলের মিডল-অর্ডার এবং লোয়ার মিডল-অর্ডারে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানরা নিজেদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসলেও একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন রিচি রিচার্ডসন। দলীয় ১৯৪ রানের মাথায় ইয়ান বিশপ তিন রান করে শেন ওয়ার্নের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরে ফেরেন। দুর্দান্ত বোলিং করতে থাকা শেন ওয়ার্নের ম্যাচে এটি চতুর্থ উইকেট ছিল। শুরুতে শিশিরের জন্য বল করতে সমস্যা হলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩৬ রান দিয়ে চার উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের পথ দেখান তিনি।

বিশপ যখন ৮ম ব্যাটসম্যান হিসাবে সাজঘরে ফেরেন, তখনও জয়ের জন্য ১৪ রান প্রয়োজন ছিল উইন্ডিজের। তখনও এক প্রান্ত আগলে রেখে লড়াই করে যাচ্ছিলেন রিচি রিচার্ডসন। ডেমিয়েন ফ্লেমিং যখন ইনিংসের শেষ ওভারে বোলিং করতে আসেন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল দশ রানের। স্ট্রাইকে ছিলেন রিচার্ডসন, তিনি প্রথম বলেই চার হাঁকিয়ে উইন্ডিজকে ম্যাচে ফেরান। এরপর যে ভুলটি করলেন, তার জন্য হয়তো অনেকদিন ধরে তিনি আফসোস করেছেন। দলের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিলো পাঁচ বলে ছয় রান। তখনই দ্রুত সিঙ্গেল নিতে গিয়ে কার্টলি অ্যামব্রোস রান আউট হয়ে ফিরে যান। সেই সাথে রিচার্ডসনও স্ট্রাইক হারিয়ে ফেলেন।

শেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে খেলতে নামা কোর্টনি ওয়ালশ প্রথম বলে বোল্ড হয়ে গেলে পাঁচ রানে পরাজিত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফ্লেমিংয়ের বলে ওয়ালশ যখন বোল্ড হন, তখন অপর প্রান্তে থাকা রিচার্ডসন ৪৯ রানে অপরাজিত ছিলেন। শেষ ওভারে সিঙ্গেল নিতে যাওয়ার ভুলে এবং সতীর্থদের ব্যর্থতার দিনে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছাতে পারেননি তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ সাত ব্যাটসম্যান মিলে মাত্র দশ রান সংগ্রহ করলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পরাজিত হয়ে মাঠ ত্যাগ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর আগে তিনবার সেমিফাইনালেও উঠলেও কখনও পরাজিত হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

নব্বইয়ের দশকে উপমহাদেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলাটা বেশ কঠিন ছিল। এখনকার আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেওয়াটাও তাদের কাছে এক ধরনের পরীক্ষা ছিল। গ্রুপপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে পরাজয়ের পর সেমিফাইনালেও দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফাইনাল খেলে অজিরা। তাদের এই জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন শেন ওয়ার্ন। তিনি ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপেও এমন নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেমিফাইনালে দুর্দান্ত বোলিং করে অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে উঠানোর পর চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেছিলেন তিনি।

১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক জয়ে ফাইনালে ওঠার পর অস্ট্রেলিয়ার উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান মার্ক ওয়াহ তার বায়োগ্রাফিতে বলেন,

    'How the bloody hell did we win that?'

১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল খেলেছিল ভাগ্যগুণে এবং প্রশংসনীয় মনোবলে। তা না হলে এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হাল না ছেড়ে দুইবার ঘুরে দাঁড়িয়ে জয় পাওয়াটা কল্পনাতীত।

5
১.

ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা সম্মিলিতভাবে ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন করে। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে শ্রীলঙ্কার মাটিতে গ্রুপপর্বে নিজেদের ম্যাচ খেলতে যায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়া। এই দু'টি ম্যাচেই শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার মাটিতে খেলতে না যাওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে তেমন সমস্যা হয়নি। তিন জয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে গ্রুপ ‘এ’ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে না খেলার পর কেনিয়ার বিপক্ষেও পরাজিত হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এতে করে তাদের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার সমীকরণ বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত বড় ধরণের অঘটন ঘটেনি। গ্রুপ ‘এ’ থেকে চতুর্থ অবস্থানে থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল তারা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসাবে পায় গ্রুপপর্বে পাঁচ ম্যাচের পাঁচটিতে জয় পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে। গ্রুপপর্বে দুর্দান্ত খেললেও কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রায়ান লারার অসাধারণ ব্যাটিংয়ের পর রজার হার্পারের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ১৯ রানে হেরে বিদায় নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

অস্ট্রেলিয়া তাদের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে প্রতিবেশী নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বড় রান তাড়া করে জয় পায়। যার ফলে শেষ চারে আবারও মুখোমুখি হয় গ্রুপ ‘এ’তে দুই দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়া। কেনিয়ার বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরাজিত হলেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের গ্রুপপর্বের জয় পেয়েছিল তারা।
২.

গ্রুপপর্বে ধুঁকতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেমিফাইনালের আগে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াকে গ্রুপপর্বের ম্যাচে পরাজিত করেছিল তারা। মোহালিতে '৯৬ সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মার্ক টেলর। মোহালির পেস সহায়ক উইকেটে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে উইন্ডিজ পেসারদের তোপের মুখে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা। মাত্র ১৫ রান তুলতেই সাজঘরে ফিরে যান মার্ক টেলর, দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মার্ক ওয়াহ, রিকি পন্টিং এবং স্টিভ ওয়াহ। এই চার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান মোট চার রান যোগ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে।

দলের বিপর্যয়ের মুখে বুক চিতিয়ে লড়াই করার ক্ষেত্রে মাইকেল বেভানের বিকল্প হয় না। সেমিফাইনালেও তিনি দলের বিপদে ব্যাট হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, সঙ্গী হিসাবে পেয়ে যান স্টুয়ার্ট ল'কে। এই দুইজন ব্যাটসম্যান ধীরগতিতে ব্যাটিং করে বড় জুটি গড়েন। নিজেদের ইনিংসের শুরুতে রান তোলার চেয়ে উইকেটে টিকে থাকাকেই বেশি প্রাধান্য দেন তারা। তাদের ১৩৮ রানের অসাধারণ জুটি ভাঙে স্টুয়ার্ট ল রান আউট হয়ে ফিরে গেলে। তিনি দলীয় ১৫৩ রানের মাথায় ১০৫ বলে পাঁচটি চারের মারে ৭২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তার বিদায়ের পর মাইকেল বেভানও দ্রুত ফিরে যান, তিনি ১১০ বলে চারটি চার এবং একটি ছয়ের মারে ৬৯ রান করেছিলেন।

এই দুইজনের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের পর উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান ইয়ান হিলি ২৮ বলে দ্রুত ৩১ রানের ইনিংস খেলে দলকে লড়াই করার মতো পুঁজি এনে দেন। শেষদিকে তার দ্রুত রান তোলার ফলে অস্ট্রেলিয়া নির্ধারিত ওভার শেষে আট উইকেটে ২০৭ রান সংগ্রহ করে। ম্যাচের প্রথমভাগের ব্যর্থতার পর ল, বেভান এবং হিলির ব্যাটে চড়ে বেশ ভালোভাবেই ম্যাচে ফিরেছিল অস্ট্রেলিয়া।
৩.

মোহালিতে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই পেসার কার্টলি অ্যামব্রোস এবং ইয়ান বিশপ আগুনঝড়ানো বোলিংয়ে মাত্র ১৫ রানেই চার উইকেট হারিয়ে বসেছিল অস্ট্রেলিয়া। মার্ক টেইলর এবং স্টিভ ওয়াহকে সরাসরি বোল্ড করেছিলেন বিশপ। মার্ক ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেছিলেন অ্যামব্রোস। অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা আরও শোচনীয় হতে পারতো, যদি বিশপ তার পা দাগের মধ্যে রাখতে পারতেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ ৭২ রান করা স্টুয়ার্ট ল তার বলে মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়েছিল, কিন্তু বিশপ সেই বলটি নো করে বসেন। এরপর থেকে ল এবং বেভান জুটি অস্ট্রেলিয়াকে লড়াকু সংগ্রহ এনে দিয়েছিলেন।

নিজের করা নো বল নিয়ে ইয়ান বিশপের আফসোস ইতি ছিল না। এই সম্পর্কে তিনি বলেন,

    'আমার নো বলে স্টুয়ার্ট ল ক্যাচ উঠিয়েছিল। আমার মনে হয়, সে মিড উইকেটে ফ্লিক করেছিল। সে সময় এটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রু হতে পারতো। এখনও এটা আমাকে পীড়া দেয় যে, আমি আমার পা দাগের ভেতরে রাখতে পারিনি।'

মাইকেল বেভান এবং স্টুয়ার্ট ল দুইজনেই বেশ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান ছিলেন। তবে স্টুয়ার্ট ল সেই তুলনায় অনভিজ্ঞ ছিলেন। ল'কে আউট করা বলটি যদি বিশপ নো বল না করতেন, তাহলে অস্ট্রেলিয়া বেশ চাপে পড়ে যেতো। শেষ পর্যন্ত ভাগ্য সহায় থাকার কারণে দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন তিনি।
৪.

অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২০৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শিবনারায়ণ চন্দরপলের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে জয়ের পথেই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অন্যদিকে, মোহালিতে শিশিরের কারণে অস্ট্রেলিয়ার দুই লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন এবং স্টুয়ার্ট ল'র বোলিং করতে সমস্যা হচ্ছিল। শিশির খুব বেশি ছিল না, কিন্তু যতটুকু ছিল তাতেই সমস্যায় পড়েছিলো স্পিনাররা। একের পর এক ফুলটস দিতে থাকেন তারা। এই সুযোগই ভালোভাবে কাজে লাগিয়ে দলের রানের চাকা এগিয়ে নিতে থাকেন লারা-চন্দরপলরা।

উদ্বোধনী উইকেট জুটি ২৫ রানে ভেঙে যাওয়ার পর জুটি বাঁধেন চন্দরপল এবং ব্রায়ান লারা। তারা দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৬৮ রান যোগ করেন। ৪৫ বলে ৪৫ রান করা লারা দলীয় ৯৩ রানে ফিরে গেলে এই জুটি ভাঙে। এরপর অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসন ব্যাট করতে নেমে চন্দরপলকে সাথে নিয়ে দলকে জয়ের পথে রাখেন।

এক পর্যায়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ ছিল দুই উইকেটে ১৬৫ রান। জয়ের জন্য আট উইকেট হাতে রেখে মাত্র ৪৩ রান প্রয়োজন ছিল তাদের। এমন পরিস্থিতিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে ১৯৮৩ সালের পর আবারও বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার হাতছানি দেয়।

শিবনারায়ণ চন্দরপল দলীয় ১৬৫ রানের মাথায় ৮০ রান করে সাজঘরে ফিরে গেলে রিচার্ডসন এবং তার মধ্যকার ৭২ রানে জুটি ভাঙে। এই জুটি ভাঙার পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভাবেনি, তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। জিমি অ্যাডামস এবং কীথ আর্থারটনকে ব্যাটিংয়ে না নামিয়ে রজার হার্পার এবং ওটিস গিবসনকে ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খামখেয়ালিপনার সুযোগ কাজে লাগায় অস্ট্রেলিয়া। শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং ফ্লেমিংয়ের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে দুই উইকেটে ১৬৫ রান থেকে ১৮৭ রান তুলতেই সাত উইকেট হারায় তারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ গ্রুপপর্বেও কেনিয়াকে 'সহজভাবে' নিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল।
৫.

দলের মিডল-অর্ডার এবং লোয়ার মিডল-অর্ডারে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানরা নিজেদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসলেও একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন রিচি রিচার্ডসন। দলীয় ১৯৪ রানের মাথায় ইয়ান বিশপ তিন রান করে শেন ওয়ার্নের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরে ফেরেন। দুর্দান্ত বোলিং করতে থাকা শেন ওয়ার্নের ম্যাচে এটি চতুর্থ উইকেট ছিল। শুরুতে শিশিরের জন্য বল করতে সমস্যা হলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩৬ রান দিয়ে চার উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের পথ দেখান তিনি।

বিশপ যখন ৮ম ব্যাটসম্যান হিসাবে সাজঘরে ফেরেন, তখনও জয়ের জন্য ১৪ রান প্রয়োজন ছিল উইন্ডিজের। তখনও এক প্রান্ত আগলে রেখে লড়াই করে যাচ্ছিলেন রিচি রিচার্ডসন। ডেমিয়েন ফ্লেমিং যখন ইনিংসের শেষ ওভারে বোলিং করতে আসেন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল দশ রানের। স্ট্রাইকে ছিলেন রিচার্ডসন, তিনি প্রথম বলেই চার হাঁকিয়ে উইন্ডিজকে ম্যাচে ফেরান। এরপর যে ভুলটি করলেন, তার জন্য হয়তো অনেকদিন ধরে তিনি আফসোস করেছেন। দলের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিলো পাঁচ বলে ছয় রান। তখনই দ্রুত সিঙ্গেল নিতে গিয়ে কার্টলি অ্যামব্রোস রান আউট হয়ে ফিরে যান। সেই সাথে রিচার্ডসনও স্ট্রাইক হারিয়ে ফেলেন।

শেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে খেলতে নামা কোর্টনি ওয়ালশ প্রথম বলে বোল্ড হয়ে গেলে পাঁচ রানে পরাজিত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফ্লেমিংয়ের বলে ওয়ালশ যখন বোল্ড হন, তখন অপর প্রান্তে থাকা রিচার্ডসন ৪৯ রানে অপরাজিত ছিলেন। শেষ ওভারে সিঙ্গেল নিতে যাওয়ার ভুলে এবং সতীর্থদের ব্যর্থতার দিনে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছাতে পারেননি তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ সাত ব্যাটসম্যান মিলে মাত্র দশ রান সংগ্রহ করলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পরাজিত হয়ে মাঠ ত্যাগ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর আগে তিনবার সেমিফাইনালেও উঠলেও কখনও পরাজিত হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

নব্বইয়ের দশকে উপমহাদেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলাটা বেশ কঠিন ছিল। এখনকার আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেওয়াটাও তাদের কাছে এক ধরনের পরীক্ষা ছিল। গ্রুপপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে পরাজয়ের পর সেমিফাইনালেও দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফাইনাল খেলে অজিরা। তাদের এই জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন শেন ওয়ার্ন। তিনি ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপেও এমন নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেমিফাইনালে দুর্দান্ত বোলিং করে অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে উঠানোর পর চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেছিলেন তিনি।

১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক জয়ে ফাইনালে ওঠার পর অস্ট্রেলিয়ার উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান মার্ক ওয়াহ তার বায়োগ্রাফিতে বলেন,

    'How the bloody hell did we win that?'

১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল খেলেছিল ভাগ্যগুণে এবং প্রশংসনীয় মনোবলে। তা না হলে এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হাল না ছেড়ে দুইবার ঘুরে দাঁড়িয়ে জয় পাওয়াটা কল্পনাতীত।

6
গরীবের কুঁড়েঘর থেকে শুরু করে ধনীর বিশাল প্রাসাদ, রহস্য ছড়িয়ে থাকে সবখানেই। শাকের খালেলির জন্ম একটি ধনাঢ্য পরিবারে, তাতে জড়িয়ে ছিল গাঢ় রহস্য। ১৯৪৭ সালের ২২শে আগস্ট মাদ্রাজের একটি পার্সিয়ান মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন শাকের খালেলি। বাবা গোলাম হোসেইন নামাজী এবং মা গওহর তাজ বেগমের মেয়ে ছিলেন শাকের। গওহর তাজ বেগমের বাবা, অর্থাৎ, শাকের খালেলির নানা ছিলেন প্রথমে জয়পুর এবং পরবর্তীতে হায়দ্রাবাদে কর্মরত দেওয়ান। শাকেরের দাদা মোহাম্মদ নামাজীও খুব একটা কম কিছু ছিলেন না।

ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নামাজীর ব্যবসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ইরান, সিঙ্গাপুর আর আমেরিকাতেও। ভারতে বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তার। ভারত, ইরান এবং সিঙ্গাপুরে জনস্বার্থে নানারকম প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন শাকের খালেলির দাদা। তার ভেতরে নামাজী হাসপাতাল বেশ পরিচিত। জন্মের পর অনেকটা সময় সিঙ্গাপুরেই কাটিয়েছেন শাকের খালেলি। বাবা-মা সিঙ্গাপুরে থাকায় সেখানেই পড়াশোনা করেছেন তিনি।

১৯৬৫ সালে, ১৮ বছর বয়সে নিজের কাজিন আকবর মির্জা খালেলির সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হন শাকের। শাহ তাজ বেগম এবং গওহর তাজ বেগম ছিলেন দুই বোন। তাই শাকের আর আকবরের এই সম্পর্কে কোনরকম বাধা দেন নি তারা। একটা সময় বিয়ে হয়ে যায় আকবর খালেলি এবং শাকেরের। বিয়ের পর শাকের হয়ে ওঠেন শাকের খালেলি। খুব ভালো খেলোয়াড় এবং শিক্ষার্থী ছিলেন আকবর খালেলি। চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ভারতে বেশ ভালো কিছু করার ক্ষমতা রাখতেন। কিন্তু সবকিছু বাদ দিয়ে দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন তিনি। আইএফএস এবং আইএএস- দুটো পরীক্ষাতেই বসেন। ১৯৫৪ সালে আইএফএস এ যোগ দেন। নিজের কাজের তাগিদেই নানা স্থানে বদলি হতেন আকবর খালেলি। মোট চারটি মেয়ে জন্ম নেয় শাকের খালেলি এবং আকবর খালেলির ঘরে; জেবুন্দেহ খালেলি, সাবাহ, রেহানে এবং এসমাত খালেলি। বেশ কেটে যাচ্ছিলো দুজনের সংসার।

হঠাৎ করেই ইরানে বদলি হয়ে যান আকবর খালেলি। মেয়েদের নিয়ে ইরানে যেতে রাজি হননি শাকের খালেলি। মেয়েদের নিয়ে দেশেই থাকেন তিনি। স্থাপত্য নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল শাকেরের। সেটি নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ৩৭ বছর বয়সে নিজের বাড়ি নিজেই তৈরি করেন শাকের। এরপর মায়ের বাড়িতেও সাহায্য করেন। তারপর তার চোখ যায় অন্যান্য দিকে। বাবা-দাদার মতন দানশীল ছিলেন শাকের। তাই আশেপাশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভেতরে বেশ সুনাম কুড়িয়ে ফেলেন তিনি দ্রুত। কিন্তু তা খুব বেশিদিনের জন্যে নয়। মুরালি মনোহর মিশরা নামে একজনের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্ক বিয়েতে গিয়ে ঠেকে শাকেরের। দ্বিতীয় স্বামীর পরিবারে ভালোই ছিলেন শাকের। মেয়েদের সাথেও কথা হতো তাঁর। কিন্তু হুট করে উধাও হয়ে যান শাকের খালেলি।

১৯৯১ সালের কথা। শাকেরের সন্তান সাবাহ নিজের সাধ্যমতো খুঁজে বেড়ায় তার মাকে। সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজার চেষ্টা করে সে। কিন্তু কিছুতেই কোনো লাভ হয় না। নিজের সৎ বাবার কাছে জানতে চায় মা কোথায়। কিন্তু শাকেরের ২য় স্বামী মুরালি মনোহর মিশ্র স্পষ্টভাবে কোনো উত্তর দেন না। সন্দেহ হয় সাবাহ’র। ১৯৯২ সালে সেই সন্দেহ আর একটা আশঙ্কা গাঢ় হয়ে ওঠে মনের ভেতরে। সোজা বেঙ্গালুরুর কর্ণাটকের অশোক নগর পুলিশ স্টেশনে যায় সাবাহ। ‘হেবিস কোপাস’ কেস দাখিল করে সে। তবে তার আগে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয় সাবাহকে। টানা এক বছর চেষ্টার পর অবশেষে তার মায়ের উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে পুলিশ কেস করতে সক্ষম হয় সাবাহ।

এরপরের তিনটি বছর শাকের খালেলিকে খুঁজে বেড়ায় ব্যাঙ্গালোর পুলিশ। কিন্তু কোনো খোঁজ মেলে না তার। যেন বিশাল সম্পত্তির মালিক এই নারী কাউকে কিছু না জনিয়েই হুট করে উধাও হয়ে গিয়েছেন। সাবাহ’র সাথে শাকেরের পরিবারের বাকি সদস্যরাও এ সময় খুঁজে বেড়ায় শাকেরকে। কেস করার কিছুদিনের ভেতরেই পুলিশ শাকের খালেলির কেসকে আর সব কেসের মতন ফাইলবন্দী করে রেখে দেয়। ভুলে যায় হারিয়ে যাওয়া শাকের খালেলির কথা। তবে পুলিশকে খুব বেশিদিন চুপ থাকতে দেয়নি শাকের খালেলির পরিবার। শাকের খালেলির প্রথম স্বামী আকবর খালেলি ছিলেন একজন আই এফ এস অফিসার। তাদের পরিবার ছিল সম্ভ্রান্ত এবং প্রভাবশালী। আকবর খালেলি পুলিশকে চাপ দেন শাকেরের ব্যাপারে খোঁজ খবর চালু রাখতে। ফলে পুলিশ একটা সময় তৎপর হয়ে ওঠে সুন্দরী, রহস্যময় আর অগাধ সম্পত্তির মালিক শাকের খালেলির গুম হওয়ার রহস্য উদঘাটনে।

সাবাহ নিজের জবানবন্দীতে কিছু ভাবিয়ে তোলার মতো কথা বলেন। সাবাহ জানান, মুম্বাই থাকায় তখনই মায়ের কাছে যেতে পারছিল না সে। ফোন করে সে সৎ বাবাকে। মুরালি ওরফে শ্রদ্ধানন্দ ফোন এড়িয়ে গেলে মাকে খুঁজতে বেশ কয়েকবার সাবাহ শ্রদ্ধানন্দের কাছে যায়। কিন্তু শ্রদ্ধানন্দ কখনোই কোনো ব্যাপারে খোলাসা করে উত্তর দেননি সাবাহকে। বারবার জিজ্ঞেস করায় একটা সময় শ্রদ্ধানন্দ সাবাহকে জানান, শাকের আমেরিকায় গিয়েছেন।

এমনকি নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালের ঠিকানা দেন তিনি সাবাহকে। সাবাহ সেই হাসপাতালে খোঁজ করে। কিন্তু সেখানে শাকের খালেলি নামে কোনো ব্যক্তি ছিলো না। ফলে আবার শ্রদ্ধানন্দকে ফোন করে সাবাহ। তার কাছে খোঁজ নিতে যায়। তখন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রথমে ভাব ধরেন যেন তিনি ঠিক বলেছিলেন। কোনোভাবে শাকের তাকে ঠিক তথ্য দেয়নি। আর তার পরপরই আবার জানান যে, তিনি ভুল বলেছিলেন। শাকের ইংল্যান্ডের কোনো একটি হাসপাতালে গিয়েছেন। আর ভালো আছেন। সাবাহ স্বামী শ্রদ্ধানন্দের কাছে শাকেরের ঠিকানা, ফোন নম্বর বা যোগাযোগ করার মতন কিছু চায়। তিনি সরাসরি না করে দেন সাবাহকে। জানান, শাকের যাওয়ার সময় এমন কিছুই রেখে যায়নি যা দিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। সেবার মায়ের সম্পর্কে কথা বলতেই মুম্বাইয়ের একটি রেস্টুরেন্টে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের সাথে দেখা করে সাবাহ। সেখানে আবার তাকে জানান স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, শাকের খালেলি দেশের বাইরে আছে। কথাবার্তা বলতে বলতে একটা সময় স্বামী শ্রদ্ধানন্দ একটু পাশে যান। আর সেই সময়েই সাবাহ’র চোখ পড়ে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের সাথে আনা কিছু কাগজের উপর। কাগজগুলো টেবিলের উপরে রাখা ছিল। সেদিকে ভালো করে তাকাতেই একটি পাসপোর্ট দেখতে পায় সাবাহ। পাসপোর্টটি ছিল তার মা শাকের খালেলির। সন্দেহ তীব্র হয় সাবাহ’র। এখানে যদি শাকেরের পাসপোর্ট থাকে তাহলে শাকের কী করে বিদেশে গেল? তার মানে কি শ্রদ্ধানন্দ মিথ্যে কথা বলছেন?

পুলিশ সন্দেহ করে শ্রদ্ধানন্দকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কে এই শ্রদ্ধানন্দ মিশ্র? তদন্ত শুরু করে পুলিশ। মুরালি মনোহর মিশ্র বা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সম্পর্কে বেশ অন্যরকম কিছু তথ্য পায় তারা। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ রামপুর স্টেটের নবাবের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া তিনি উত্তর প্রদেশের রামপুর রয়্যাল ফ্যামিলির জমির দেখভাল করতেন। আকবর খালেলি ও শাকের খালেলির খুব ভালো সম্পর্ক ছিল রামপুর রয়্যাল ফ্যামিলির সাথে। প্রায় সময়েই সেখানে বেড়াতে আসতেন এই দম্পতি। দিল্লিতে শাকেরের সাথে দেখা হয় শ্রদ্ধানন্দের। যেহেতু জায়গা জমি নিয়ে বেশ ভালো বুঝতেন শ্রদ্ধানন্দ, ফলে নিজের জায়গা জমি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো তাকে বলেন শাকের। আর সেগুলোর সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এই সময় একে অন্যের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন শাকের এবং শ্রদ্ধানন্দ। সে সময় আকবর খালেলি ট্রান্সফার হয়ে শাকেরের কাছ থেকে একটু দূরে অবস্থান করছিলেন। চার মেয়েকে নিয়ে শাকের একাই থাকতেন। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় শ্রদ্ধানন্দ। এমনিতে ঘনিষ্ঠতা তো ছিলই। সেটাকে আরো একটু বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করে সে এই সময়। শাকের একসময় ধরা দেন শ্রদ্ধানন্দের কাছে।

শাকেরের মেয়েরা বারবার থানায় যেতে থাকে। পুলিশকে চাপ দিতে থাকে মায়ের খোঁজ পাওয়া জন্য। কারণ, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কিছু না কিছু খারাপ ঘটনা তাদের মায়ের সাথে ঘটেছে। কেবল সাবাহ না। এবার পুলিশের কাছে আসেন শাকেরের আরেক মেয়ে জেবান্দাহ। পুলিশের এমন অলস হয়ে বসে থাকা নিয়ে কথা তোলে সে। শ্রদ্ধানন্দই যে শাকেরকে গুম করেছে সেটা পুলিশকে জানায় জোবান্দাহ। পুলিশ কেন এখনো শ্রদ্ধানন্দকে আটক করছে না সেটা জানতে চায় সে। এর ভেতরে অবশ্য বেশ কয়েকবার শ্রদ্ধানন্দকে থানায় তলব করা হয়। এভাবে একটা সময় শাকের উধাও হওয়ার ২ বছর কেটে যায়। ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে কেসটি ব্যাঙ্গালোর ক্রাইম ব্রাঞ্চ পুলিশকে দেওয়া হয়। কারণ পুলিশের মনে তখন বেশ খটকা লাগে ব্যাপারটি নিয়ে। সেইসাথে খালেলি পরিবারের পক্ষ থেকে আসা প্রতিনিয়ত চাপ তো ছিলই। সেন্ট্রাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ নিজেদের সব ধরনের সোর্স কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। অপরাধীদের ডেরাগুলোতে খুঁজে ফেরে যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়। আর সেইসময় হঠাৎ একটা সূত্র চলে আসে পুলিশের হাতে। সেখানে ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ কনস্টেবল মহাদেব শুনতে পান দুই মাতালের আলাপচারিতা। শ্রদ্ধানন্দকে নিয়ে কথা বলছিল তারা। কিছুদিন আগে ৮১ রিচমন্ড রোডে কাজ পড়েছিল তাদের। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সেদিন একটা কফিন আনিয়েছিলেন তার ঐ বাড়িতে। এই একটি তথ্যই পুলিশদের কাছে পুরো কাজটাকে অনেক বেশি সহজ করে দেয়। অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল পুলিশের মনে। কেন ৮১ রিচমন্ড রোডে কোনো কফিনের দরকার পড়েছিলো? কেউ কি মারা গিয়েছিল ঐ বাড়িতে? যদি মারা গিয়ে থাকে তাহলে সে কে? আর এই সব প্রশ্নের উত্তর কেবল একজনই দিতে পারতেন। আর তিনি হলেন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। ইন্সপেক্টর তথ্যটি থানায় জানালে আটক করা হয় দুই মাতালকে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের। আর তারপর ঘটনার সত্যতা জেনে স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে জেরা করে পুলিশ। থানায় আনা হয় তাকে। পুলিশের প্রথম জিজ্ঞাসার সোজা না জানিয়ে দেন তিনি। জানিয়ে দেন যে, কোনো কফিন আনেন নি তিনি। পরে পুলিশ বাধ্য হয় শ্রদ্ধানন্দের সামনে কফিন সরবরাহকারী দুজনকে নিয়ে আসতে। তাদেরকে দেখার পরেই মুখ খুলতে রাজী হন তিনি।

পুলিশকে জানান, তিনি শাকের খালেলির সব রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে তারই বাড়িতে। পুলিশকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান শ্রদ্ধানন্দ। সেখানে বাড়ির একটা নির্দিষ্ট অংশে চারকোনা করে চক দিয়ে ঘর কাটেন তিনি। সেখানে পুলিশ কোদাল দিয়ে খুঁড়তে আরম্ভ করে। খুব বেশিক্ষণ খুঁড়তে হয় না। তার আগেই উঁকি মারে একটা আস্ত কফিন। কফিনের ভেতরে শুয়ে ছিল একটি কংকাল। কংকালের একদিকে চুড়ি ছিল। খানিকটা ছেঁড়া শাড়ি ছিল পাশে। সিসিবি আরো ভালো করে পরীক্ষার জন্য হায়দ্রাবাদ ল্যাবে ফটোগ্রাফ সুপার ইম্পোজিশন এবং ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট করান কংকালটির। আর ফলাফল? একদম যা ভাবা হয়েছিল তা-ই! কংকালটি ছিল হঠাৎ করে ৩ বছর ধরে উধাও হয়ে যাওয়া শাকের খালেলির। কে খুন করেছিল শাকের খালেলি? নিশ্চয়ই স্বামী শ্রদ্ধানন্দ! কিন্তু এটি সঠিকভাবে বলা এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে বিচারের মুখোমুখি করাটা সিসিবির পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এই হত্যার কোনো চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলো না। ঠিক কেন, কীভাবে হত্যা সম্পন্ন হয়েছে সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হচ্ছিলো না। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ জানান, তিনি শাকের খালেলিকে খুন করেননি। কারণ, শাকেরকে খুন করার মতন কোনো মোটিভ তার ছিলো না। কোনো কারণ ছাড়া কেন তিনি খুন করতে যাবেন নিজের স্ত্রীকে? তবে সিসিবি থেমে থাকেনি। নিজেদের তদন্ত চালিয়ে যেতে থাকে তারা। আর জানতে পারে যে, মৃত্যুর আগে শাকেরের সমস্ত সম্পত্তির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নিয়েছিলেন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। ফলে শাকের মারা গেলে তার সমস্ত সম্পত্তি তার কাছেই যায়। শ্রদ্ধানন্দের সাথে সংসার করার সময় বেশ হতাশ হয়ে পড়েন শাকের। অনেক বেশি ঝগড়া বাঁধতো তাদের মধ্যে। আর এর কারণ ছিল শ্রদ্ধানন্দের নেতিবাচক কার্যক্রম। পুলিশের কাছে নিজের স্বীকারোক্তিতে শ্রদ্ধানন্দ জানান, নিজের কিছু বাজে অভ্যাসের কারণে টাকা খরচ করছিলেন তিনি। এর ভেতরে ছিল মদ্যপান, পরনারীর প্রতি আসক্তি, জুয়াখেলা সহ আরো অনেক কিছু। এর সাথে চলে আসে আয়কর আর পারিবারিক কিছু সমস্যা। আর এই অতিরিক্ত টাকা পয়সা খরচ করার ব্যাপার থেকেই ঝামেলা শুরু হতো দুজনের মধ্যে।

শ্রদ্ধানন্দের মাথায় একটা সময় শাকেরের টাকাগুলোর লোভ জেঁকে বসে। তার ভেতরে আশংকা ছিল শাকের নিজের সমস্ত সম্পত্তি থেকে শ্রদ্ধানন্দকে বাদ দিয়ে দেবেন। আর তাই শাকেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। শাকেরকে অজ্ঞান করে জীবন্ত কবর দেন তিনি। শাকের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার সমস্ত সম্পত্তি একটু একটু করে ভাগ করতে শুরু করেন শ্রদ্ধানন্দ। তারপর সেই সম্পত্তি বেচতে থাকেন আর কিছুদিনের ভেতরেই কয়েক কোটি রুপির মালিক হয়ে যান। কফিন খুঁজে পাওয়ার পর এমন কিছু কাগজ আসে সিসিবির হাতে যেগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিলো যে, শাকেরের মৃত্যুর পর শাকেরের ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে অনেক কাগজ চালিয়েছেন শ্রদ্ধানন্দ। এসব কিছুকে আমলে নিয়ে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের উপরে শাকের খালেলি হত্যার অভিযোগ আনে সিসিবি।

২০০৫ সালের মে মাসে আদালত স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে ফাঁসির রায় শোনায়। পরবর্তীতে এই রায় নিয়ে আপিল করা হয়। তবে তাতে লাভ হয় না। সুপ্রিম কোর্টেও একসময় চলে যায় মামলাটি। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট স্বামী শ্রদ্ধানন্দের ফাঁসির রায়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বদলে দেন। বর্তমানে তিনি জেলে আছেন।

7
গরীবের কুঁড়েঘর থেকে শুরু করে ধনীর বিশাল প্রাসাদ, রহস্য ছড়িয়ে থাকে সবখানেই। শাকের খালেলির জন্ম একটি ধনাঢ্য পরিবারে, তাতে জড়িয়ে ছিল গাঢ় রহস্য। ১৯৪৭ সালের ২২শে আগস্ট মাদ্রাজের একটি পার্সিয়ান মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন শাকের খালেলি। বাবা গোলাম হোসেইন নামাজী এবং মা গওহর তাজ বেগমের মেয়ে ছিলেন শাকের। গওহর তাজ বেগমের বাবা, অর্থাৎ, শাকের খালেলির নানা ছিলেন প্রথমে জয়পুর এবং পরবর্তীতে হায়দ্রাবাদে কর্মরত দেওয়ান। শাকেরের দাদা মোহাম্মদ নামাজীও খুব একটা কম কিছু ছিলেন না।

ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নামাজীর ব্যবসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ইরান, সিঙ্গাপুর আর আমেরিকাতেও। ভারতে বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তার। ভারত, ইরান এবং সিঙ্গাপুরে জনস্বার্থে নানারকম প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন শাকের খালেলির দাদা। তার ভেতরে নামাজী হাসপাতাল বেশ পরিচিত। জন্মের পর অনেকটা সময় সিঙ্গাপুরেই কাটিয়েছেন শাকের খালেলি। বাবা-মা সিঙ্গাপুরে থাকায় সেখানেই পড়াশোনা করেছেন তিনি।

১৯৬৫ সালে, ১৮ বছর বয়সে নিজের কাজিন আকবর মির্জা খালেলির সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হন শাকের। শাহ তাজ বেগম এবং গওহর তাজ বেগম ছিলেন দুই বোন। তাই শাকের আর আকবরের এই সম্পর্কে কোনরকম বাধা দেন নি তারা। একটা সময় বিয়ে হয়ে যায় আকবর খালেলি এবং শাকেরের। বিয়ের পর শাকের হয়ে ওঠেন শাকের খালেলি। খুব ভালো খেলোয়াড় এবং শিক্ষার্থী ছিলেন আকবর খালেলি। চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ভারতে বেশ ভালো কিছু করার ক্ষমতা রাখতেন। কিন্তু সবকিছু বাদ দিয়ে দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন তিনি। আইএফএস এবং আইএএস- দুটো পরীক্ষাতেই বসেন। ১৯৫৪ সালে আইএফএস এ যোগ দেন। নিজের কাজের তাগিদেই নানা স্থানে বদলি হতেন আকবর খালেলি। মোট চারটি মেয়ে জন্ম নেয় শাকের খালেলি এবং আকবর খালেলির ঘরে; জেবুন্দেহ খালেলি, সাবাহ, রেহানে এবং এসমাত খালেলি। বেশ কেটে যাচ্ছিলো দুজনের সংসার।

হঠাৎ করেই ইরানে বদলি হয়ে যান আকবর খালেলি। মেয়েদের নিয়ে ইরানে যেতে রাজি হননি শাকের খালেলি। মেয়েদের নিয়ে দেশেই থাকেন তিনি। স্থাপত্য নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল শাকেরের। সেটি নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ৩৭ বছর বয়সে নিজের বাড়ি নিজেই তৈরি করেন শাকের। এরপর মায়ের বাড়িতেও সাহায্য করেন। তারপর তার চোখ যায় অন্যান্য দিকে। বাবা-দাদার মতন দানশীল ছিলেন শাকের। তাই আশেপাশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভেতরে বেশ সুনাম কুড়িয়ে ফেলেন তিনি দ্রুত। কিন্তু তা খুব বেশিদিনের জন্যে নয়। মুরালি মনোহর মিশরা নামে একজনের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্ক বিয়েতে গিয়ে ঠেকে শাকেরের। দ্বিতীয় স্বামীর পরিবারে ভালোই ছিলেন শাকের। মেয়েদের সাথেও কথা হতো তাঁর। কিন্তু হুট করে উধাও হয়ে যান শাকের খালেলি।

১৯৯১ সালের কথা। শাকেরের সন্তান সাবাহ নিজের সাধ্যমতো খুঁজে বেড়ায় তার মাকে। সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজার চেষ্টা করে সে। কিন্তু কিছুতেই কোনো লাভ হয় না। নিজের সৎ বাবার কাছে জানতে চায় মা কোথায়। কিন্তু শাকেরের ২য় স্বামী মুরালি মনোহর মিশ্র স্পষ্টভাবে কোনো উত্তর দেন না। সন্দেহ হয় সাবাহ’র। ১৯৯২ সালে সেই সন্দেহ আর একটা আশঙ্কা গাঢ় হয়ে ওঠে মনের ভেতরে। সোজা বেঙ্গালুরুর কর্ণাটকের অশোক নগর পুলিশ স্টেশনে যায় সাবাহ। ‘হেবিস কোপাস’ কেস দাখিল করে সে। তবে তার আগে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয় সাবাহকে। টানা এক বছর চেষ্টার পর অবশেষে তার মায়ের উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে পুলিশ কেস করতে সক্ষম হয় সাবাহ।

এরপরের তিনটি বছর শাকের খালেলিকে খুঁজে বেড়ায় ব্যাঙ্গালোর পুলিশ। কিন্তু কোনো খোঁজ মেলে না তার। যেন বিশাল সম্পত্তির মালিক এই নারী কাউকে কিছু না জনিয়েই হুট করে উধাও হয়ে গিয়েছেন। সাবাহ’র সাথে শাকেরের পরিবারের বাকি সদস্যরাও এ সময় খুঁজে বেড়ায় শাকেরকে। কেস করার কিছুদিনের ভেতরেই পুলিশ শাকের খালেলির কেসকে আর সব কেসের মতন ফাইলবন্দী করে রেখে দেয়। ভুলে যায় হারিয়ে যাওয়া শাকের খালেলির কথা। তবে পুলিশকে খুব বেশিদিন চুপ থাকতে দেয়নি শাকের খালেলির পরিবার। শাকের খালেলির প্রথম স্বামী আকবর খালেলি ছিলেন একজন আই এফ এস অফিসার। তাদের পরিবার ছিল সম্ভ্রান্ত এবং প্রভাবশালী। আকবর খালেলি পুলিশকে চাপ দেন শাকেরের ব্যাপারে খোঁজ খবর চালু রাখতে। ফলে পুলিশ একটা সময় তৎপর হয়ে ওঠে সুন্দরী, রহস্যময় আর অগাধ সম্পত্তির মালিক শাকের খালেলির গুম হওয়ার রহস্য উদঘাটনে।

সাবাহ নিজের জবানবন্দীতে কিছু ভাবিয়ে তোলার মতো কথা বলেন। সাবাহ জানান, মুম্বাই থাকায় তখনই মায়ের কাছে যেতে পারছিল না সে। ফোন করে সে সৎ বাবাকে। মুরালি ওরফে শ্রদ্ধানন্দ ফোন এড়িয়ে গেলে মাকে খুঁজতে বেশ কয়েকবার সাবাহ শ্রদ্ধানন্দের কাছে যায়। কিন্তু শ্রদ্ধানন্দ কখনোই কোনো ব্যাপারে খোলাসা করে উত্তর দেননি সাবাহকে। বারবার জিজ্ঞেস করায় একটা সময় শ্রদ্ধানন্দ সাবাহকে জানান, শাকের আমেরিকায় গিয়েছেন।

এমনকি নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালের ঠিকানা দেন তিনি সাবাহকে। সাবাহ সেই হাসপাতালে খোঁজ করে। কিন্তু সেখানে শাকের খালেলি নামে কোনো ব্যক্তি ছিলো না। ফলে আবার শ্রদ্ধানন্দকে ফোন করে সাবাহ। তার কাছে খোঁজ নিতে যায়। তখন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রথমে ভাব ধরেন যেন তিনি ঠিক বলেছিলেন। কোনোভাবে শাকের তাকে ঠিক তথ্য দেয়নি। আর তার পরপরই আবার জানান যে, তিনি ভুল বলেছিলেন। শাকের ইংল্যান্ডের কোনো একটি হাসপাতালে গিয়েছেন। আর ভালো আছেন। সাবাহ স্বামী শ্রদ্ধানন্দের কাছে শাকেরের ঠিকানা, ফোন নম্বর বা যোগাযোগ করার মতন কিছু চায়। তিনি সরাসরি না করে দেন সাবাহকে। জানান, শাকের যাওয়ার সময় এমন কিছুই রেখে যায়নি যা দিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। সেবার মায়ের সম্পর্কে কথা বলতেই মুম্বাইয়ের একটি রেস্টুরেন্টে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের সাথে দেখা করে সাবাহ। সেখানে আবার তাকে জানান স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, শাকের খালেলি দেশের বাইরে আছে। কথাবার্তা বলতে বলতে একটা সময় স্বামী শ্রদ্ধানন্দ একটু পাশে যান। আর সেই সময়েই সাবাহ’র চোখ পড়ে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের সাথে আনা কিছু কাগজের উপর। কাগজগুলো টেবিলের উপরে রাখা ছিল। সেদিকে ভালো করে তাকাতেই একটি পাসপোর্ট দেখতে পায় সাবাহ। পাসপোর্টটি ছিল তার মা শাকের খালেলির। সন্দেহ তীব্র হয় সাবাহ’র। এখানে যদি শাকেরের পাসপোর্ট থাকে তাহলে শাকের কী করে বিদেশে গেল? তার মানে কি শ্রদ্ধানন্দ মিথ্যে কথা বলছেন?

পুলিশ সন্দেহ করে শ্রদ্ধানন্দকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কে এই শ্রদ্ধানন্দ মিশ্র? তদন্ত শুরু করে পুলিশ। মুরালি মনোহর মিশ্র বা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সম্পর্কে বেশ অন্যরকম কিছু তথ্য পায় তারা। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ রামপুর স্টেটের নবাবের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া তিনি উত্তর প্রদেশের রামপুর রয়্যাল ফ্যামিলির জমির দেখভাল করতেন। আকবর খালেলি ও শাকের খালেলির খুব ভালো সম্পর্ক ছিল রামপুর রয়্যাল ফ্যামিলির সাথে। প্রায় সময়েই সেখানে বেড়াতে আসতেন এই দম্পতি। দিল্লিতে শাকেরের সাথে দেখা হয় শ্রদ্ধানন্দের। যেহেতু জায়গা জমি নিয়ে বেশ ভালো বুঝতেন শ্রদ্ধানন্দ, ফলে নিজের জায়গা জমি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো তাকে বলেন শাকের। আর সেগুলোর সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এই সময় একে অন্যের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন শাকের এবং শ্রদ্ধানন্দ। সে সময় আকবর খালেলি ট্রান্সফার হয়ে শাকেরের কাছ থেকে একটু দূরে অবস্থান করছিলেন। চার মেয়েকে নিয়ে শাকের একাই থাকতেন। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় শ্রদ্ধানন্দ। এমনিতে ঘনিষ্ঠতা তো ছিলই। সেটাকে আরো একটু বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করে সে এই সময়। শাকের একসময় ধরা দেন শ্রদ্ধানন্দের কাছে।

শাকেরের মেয়েরা বারবার থানায় যেতে থাকে। পুলিশকে চাপ দিতে থাকে মায়ের খোঁজ পাওয়া জন্য। কারণ, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কিছু না কিছু খারাপ ঘটনা তাদের মায়ের সাথে ঘটেছে। কেবল সাবাহ না। এবার পুলিশের কাছে আসেন শাকেরের আরেক মেয়ে জেবান্দাহ। পুলিশের এমন অলস হয়ে বসে থাকা নিয়ে কথা তোলে সে। শ্রদ্ধানন্দই যে শাকেরকে গুম করেছে সেটা পুলিশকে জানায় জোবান্দাহ। পুলিশ কেন এখনো শ্রদ্ধানন্দকে আটক করছে না সেটা জানতে চায় সে। এর ভেতরে অবশ্য বেশ কয়েকবার শ্রদ্ধানন্দকে থানায় তলব করা হয়। এভাবে একটা সময় শাকের উধাও হওয়ার ২ বছর কেটে যায়। ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে কেসটি ব্যাঙ্গালোর ক্রাইম ব্রাঞ্চ পুলিশকে দেওয়া হয়। কারণ পুলিশের মনে তখন বেশ খটকা লাগে ব্যাপারটি নিয়ে। সেইসাথে খালেলি পরিবারের পক্ষ থেকে আসা প্রতিনিয়ত চাপ তো ছিলই। সেন্ট্রাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ নিজেদের সব ধরনের সোর্স কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। অপরাধীদের ডেরাগুলোতে খুঁজে ফেরে যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়। আর সেইসময় হঠাৎ একটা সূত্র চলে আসে পুলিশের হাতে। সেখানে ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ কনস্টেবল মহাদেব শুনতে পান দুই মাতালের আলাপচারিতা। শ্রদ্ধানন্দকে নিয়ে কথা বলছিল তারা। কিছুদিন আগে ৮১ রিচমন্ড রোডে কাজ পড়েছিল তাদের। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ সেদিন একটা কফিন আনিয়েছিলেন তার ঐ বাড়িতে। এই একটি তথ্যই পুলিশদের কাছে পুরো কাজটাকে অনেক বেশি সহজ করে দেয়। অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল পুলিশের মনে। কেন ৮১ রিচমন্ড রোডে কোনো কফিনের দরকার পড়েছিলো? কেউ কি মারা গিয়েছিল ঐ বাড়িতে? যদি মারা গিয়ে থাকে তাহলে সে কে? আর এই সব প্রশ্নের উত্তর কেবল একজনই দিতে পারতেন। আর তিনি হলেন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। ইন্সপেক্টর তথ্যটি থানায় জানালে আটক করা হয় দুই মাতালকে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের। আর তারপর ঘটনার সত্যতা জেনে স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে জেরা করে পুলিশ। থানায় আনা হয় তাকে। পুলিশের প্রথম জিজ্ঞাসার সোজা না জানিয়ে দেন তিনি। জানিয়ে দেন যে, কোনো কফিন আনেন নি তিনি। পরে পুলিশ বাধ্য হয় শ্রদ্ধানন্দের সামনে কফিন সরবরাহকারী দুজনকে নিয়ে আসতে। তাদেরকে দেখার পরেই মুখ খুলতে রাজী হন তিনি।

পুলিশকে জানান, তিনি শাকের খালেলির সব রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে তারই বাড়িতে। পুলিশকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান শ্রদ্ধানন্দ। সেখানে বাড়ির একটা নির্দিষ্ট অংশে চারকোনা করে চক দিয়ে ঘর কাটেন তিনি। সেখানে পুলিশ কোদাল দিয়ে খুঁড়তে আরম্ভ করে। খুব বেশিক্ষণ খুঁড়তে হয় না। তার আগেই উঁকি মারে একটা আস্ত কফিন। কফিনের ভেতরে শুয়ে ছিল একটি কংকাল। কংকালের একদিকে চুড়ি ছিল। খানিকটা ছেঁড়া শাড়ি ছিল পাশে। সিসিবি আরো ভালো করে পরীক্ষার জন্য হায়দ্রাবাদ ল্যাবে ফটোগ্রাফ সুপার ইম্পোজিশন এবং ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট করান কংকালটির। আর ফলাফল? একদম যা ভাবা হয়েছিল তা-ই! কংকালটি ছিল হঠাৎ করে ৩ বছর ধরে উধাও হয়ে যাওয়া শাকের খালেলির। কে খুন করেছিল শাকের খালেলি? নিশ্চয়ই স্বামী শ্রদ্ধানন্দ! কিন্তু এটি সঠিকভাবে বলা এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে বিচারের মুখোমুখি করাটা সিসিবির পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এই হত্যার কোনো চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলো না। ঠিক কেন, কীভাবে হত্যা সম্পন্ন হয়েছে সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হচ্ছিলো না। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ জানান, তিনি শাকের খালেলিকে খুন করেননি। কারণ, শাকেরকে খুন করার মতন কোনো মোটিভ তার ছিলো না। কোনো কারণ ছাড়া কেন তিনি খুন করতে যাবেন নিজের স্ত্রীকে? তবে সিসিবি থেমে থাকেনি। নিজেদের তদন্ত চালিয়ে যেতে থাকে তারা। আর জানতে পারে যে, মৃত্যুর আগে শাকেরের সমস্ত সম্পত্তির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নিয়েছিলেন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। ফলে শাকের মারা গেলে তার সমস্ত সম্পত্তি তার কাছেই যায়। শ্রদ্ধানন্দের সাথে সংসার করার সময় বেশ হতাশ হয়ে পড়েন শাকের। অনেক বেশি ঝগড়া বাঁধতো তাদের মধ্যে। আর এর কারণ ছিল শ্রদ্ধানন্দের নেতিবাচক কার্যক্রম। পুলিশের কাছে নিজের স্বীকারোক্তিতে শ্রদ্ধানন্দ জানান, নিজের কিছু বাজে অভ্যাসের কারণে টাকা খরচ করছিলেন তিনি। এর ভেতরে ছিল মদ্যপান, পরনারীর প্রতি আসক্তি, জুয়াখেলা সহ আরো অনেক কিছু। এর সাথে চলে আসে আয়কর আর পারিবারিক কিছু সমস্যা। আর এই অতিরিক্ত টাকা পয়সা খরচ করার ব্যাপার থেকেই ঝামেলা শুরু হতো দুজনের মধ্যে।

শ্রদ্ধানন্দের মাথায় একটা সময় শাকেরের টাকাগুলোর লোভ জেঁকে বসে। তার ভেতরে আশংকা ছিল শাকের নিজের সমস্ত সম্পত্তি থেকে শ্রদ্ধানন্দকে বাদ দিয়ে দেবেন। আর তাই শাকেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। শাকেরকে অজ্ঞান করে জীবন্ত কবর দেন তিনি। শাকের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার সমস্ত সম্পত্তি একটু একটু করে ভাগ করতে শুরু করেন শ্রদ্ধানন্দ। তারপর সেই সম্পত্তি বেচতে থাকেন আর কিছুদিনের ভেতরেই কয়েক কোটি রুপির মালিক হয়ে যান। কফিন খুঁজে পাওয়ার পর এমন কিছু কাগজ আসে সিসিবির হাতে যেগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিলো যে, শাকেরের মৃত্যুর পর শাকেরের ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে অনেক কাগজ চালিয়েছেন শ্রদ্ধানন্দ। এসব কিছুকে আমলে নিয়ে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের উপরে শাকের খালেলি হত্যার অভিযোগ আনে সিসিবি।

২০০৫ সালের মে মাসে আদালত স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে ফাঁসির রায় শোনায়। পরবর্তীতে এই রায় নিয়ে আপিল করা হয়। তবে তাতে লাভ হয় না। সুপ্রিম কোর্টেও একসময় চলে যায় মামলাটি। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট স্বামী শ্রদ্ধানন্দের ফাঁসির রায়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বদলে দেন। বর্তমানে তিনি জেলে আছেন।

8
ভারতের ইতিহাসে একটি করুণ, অনাকাঙ্ক্ষিত ও মর্মবিদারক ঘটনা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গোড়া থেকেই সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া থেকে শুরু করে বিশ্বমহলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের সার্বিক প্রচেষ্টাসহ নব্য উত্থিত রাষ্ট্রটির জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক লড়াইয়ে সদর্পে অগ্রসর হয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’য় ভূষিত হন বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু।

স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহরলাল নেহরুর একমাত্র সন্তান ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহরু। ১৯৪২ সালে ইন্দিরা বিয়ে করেন ফিরোজ গান্ধীকে। ফিরোজ জাহাঙ্গীর গান্ধী ছিলেন পার্সী বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্যও ছিলেন।

তার নামের পদবী ছিল মূলত ‘Ghandy’। ১৯৩০ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ফিরোজ গান্ধী। মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা চরমভাবে অনুপ্রাণিত ফিরোজ তার নামের বানান ‘Ghandy’ থেকে ‘Gandhi’-তে পরিবর্তন করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত থাকার সুবাদেই নেহরু পরিবারের সাথে সখ্য বাড়ে ফিরোজের। ১৯৪২ সালের ২৬ মার্চ ফিরোজকে বিয়ের পর ইন্দিরা ‘নেহরু’ থেকে ‘ইন্দিরা গান্ধী’ হয়ে যান।

ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তিনি ৪ দফা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আশির দশকে ৪র্থ দফায় ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় ভারতের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়ে। বেশ কিছু রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্বাধীনতা দাবি করতে শুরু করে এ সময়। এর মধ্যে পাঞ্জাবও ছিল। সন্ত জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নেতৃত্বে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা স্বতন্ত্র ভূখন্ড ‘খালিস্তান’ এর দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে জার্নাইল সিং অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অবস্থান নেন এবং শিখদের ভেতরে বিদ্রোহ উস্কে দিতে থাকেন

১৯৮৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু-স্টার পরিচালনা করে। বিদ্রোহী দমনের এই অভিযানে ভিন্দ্রানওয়ালেসহ ভারতীয় সেনাদের হিসাবমতে প্রায় ৪৯৩ জন শিখ বিদ্রোহী নিহত হয়। কিন্তু অন্যান্য নথি অনুযায়ী বেসামরিক মানুষসহ মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। সেনাবাহিনীর ৪ অফিসারসহ ৮৩ জন নিহত হন। স্বর্ণমন্দিরের অনেক ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই অভিযানে।

অপারেশন ব্লু-স্টারের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল একটি বিশেষ দিন, ৬ জুন। এই দিনটি স্বর্ণমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অর্জন দেবের মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে প্রচুর শিখ তীর্থযাত্রীর আগমন ঘটে স্বর্ণমন্দিরে। অনেকেই মনে করেন, যত বেশি সম্ভব শিখ হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করাই ছিল এই দিনটি নির্ধারণের লক্ষ্য। তবে এই অভিযানে নেতৃত্বদানকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ব্রারের ভাষ্যমতে, ব্যাপারটি ছিল নিছক কাকতালীয়। ২০০৪ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,

    “আপনাকে বুঝতে হবে, সরকারের কাছে অপারেশন সম্পন্ন করার জন্য মাত্র ৩-৪ দিন সময় ছিল। আমাদের কাছে তথ্য ছিল খালিস্তান যেকোনো মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে। বুঝার চেষ্টা করুন। ধরুন, এক সুন্দর দিনে ভিন্দ্রানওয়ালে স্বাধীন খালিস্তান ঘোষণা করে খালিস্তানের পতাকা উড়িয়ে দিল...। খালিস্তানি মুদ্রা পর্যন্ত বন্টন করা হয়ে গিয়েছিল; পাকিস্তানও এদের পেছনে টাকা ঢালছিল। তারা চাচ্ছিলো যে পাঞ্জাব, ভারতের শক্তিশালী একটা অংশ, ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক।”

স্বর্ণমন্দিরে সেনা আক্রমণের আগে থেকেই পাঞ্জাবকে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। পাঞ্জাবের প্রধান শহরগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়। দেশি ও বিদেশি সংবাদকর্মীদের শহরের বাইরে রেখে আসা হয়। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান আর ব্লু-স্টার অভিযান নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু বিতর্কের চেয়ে বেশি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ছিল অভিযান পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতি।

পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের অবমাননা আর খালিস্তানের স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ করে দেবার প্রতিশোধস্বরুপ ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪, সাৎওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং নামে নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা ব্রিটিশ অভিনেতা ও পরিচালক পিটার আস্তিনভের আইরিশ টেলিভিশনের জন্য করা একটি ডকুমেন্টারির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে যাচ্ছিলেন। নয়া দিল্লির ১ নং সফদরজং রোডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে হেঁটে পার্শ্ববর্তী আকবর রোডের অফিসে যাচ্ছিলেন তিনি। স্বর্ণমন্দিরে অভিযানের পরের মাসে ‘র’ এর ডিরেক্টর মিসেস গান্ধীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যে থেকে শিখদের অপসারণ করতে। তিনি একবাক্যে না করে দিয়ে বলেন, “তাহলে কী করে আমরা নিজেদের সেক্যুলার বলবো?”

বেয়ান্ত সিংকে মিসেস গান্ধী দশ বছর ধরে চিনতেন। এই দশ বছরের পরিচিত বেয়ান্ত সিং মাত্র ৭ ফুট দূর থেকে তার পয়েন্ট থার্টি এইট রিভলভার দিয়ে মিসেস গান্ধীর তলপেটে তিনটি গুলি চালায়। তিনি মাটিতে পড়ে যেতেই সাৎওয়ান্ত সিং তার অটোমেটিক স্টেনগানের ত্রিশ রাউন্ড খালি করে দেয় তার উপর। অন্তত ৭টি গুলি মিসেস গান্ধীর পেটে লাগে, ৩টি তার বুকে আর ১টি হৃৎপিণ্ডে। প্রধানমন্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেই দুই ঘাতক দেহরক্ষী শান্তভাবে তাদের অস্ত্র ফেলে দেয়। অন্য নিরাপত্তাকর্মীরা তৎক্ষণাৎ তাদের ধরে ফেললে বেয়ান্ত সিং নির্লিপ্তভাবে বলে, “আমার যা করার দরকার ছিল আমি করেছি, এখন তোমরা যা করতে চাও কর।”

তাদের দুজনকে একটি গার্ডহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অকস্মাৎ বেয়ান্ত সিং লাফ দিয়ে এক নিরাপত্তারক্ষীর বন্দুক ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে। একইসাথে সাৎওয়ান্ত সিং তার পাগড়ির ভেতর থেকে একটি ছোরা বের করে। রক্ষীরা তৎক্ষণাৎ দুজনকেই গুলি করতে বাধ্য হয়। বেয়ান্ত সিং সাথে সাথেই মারা যায়। সাৎওয়ান্ত সিংকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে সে স্বীকারোক্তি দেয় যে, সে একটি বড়সড় ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। এই ষড়যন্ত্রে একজন উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারও জড়িত ছিল এবং তাদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল রাজীব গান্ধী।

মিসেস গান্ধীর নিথর দেহটি অল-ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস হসপিটালে নেয়া হয়। গাড়িতে তার মাথাটি কোলে করে বসে অঝোরে কেঁদে চলেছিলেন পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী। হাসপাতালে পৌঁছার পর তার দেহে জীবনের কোনো লক্ষণ না থাকলেও ১২ জন ডাক্তারের একটি দল অসম্ভবকে সম্ভব করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যান। ইন্দিরার দেহ থেকে ৭টি বুলেট বের করা হয়, একটি কৃত্রিম ফুসফুস সংস্থাপন করা হয়, ৮৮ বোতল ও-নেগেটিভ রক্ত দেয়া হয়। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে একটি ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রচার করে, ‘মিসেস গান্ধী মৃত।’

ইন্দিরা গান্ধী কখনো বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরতেন না। মৃত্যুর আগেরদিন রাতে ওড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে এক বিশাল জনসভায় তিনি বলেছিলেন,

    “আমার দীর্ঘ জীবনের আকাঙ্ক্ষা নেই। আমি এসব জিনিসে ভয় পাই না। এই জাতির সেবায় আমার জীবন চলে গেলেও আমি কিছু মনে করবো না। আজ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু এই জাতিতে শক্তি সঞ্চার করবে।”

ক্ষমতায় থাকাবস্থায় জওহরলাল নেহেরু থাকতেন তিন মূর্তি ভবনে। সেখানেই মিসেস গান্ধীর মৃতদেহ দু’দিন রাখা হয়। হাজারো ভারতবাসী তাদের সম্মান জানাতে আর প্রধানমন্ত্রীকে শেষ দেখা দেখতে আসেন সেখানে। দু’দিন পর ৭ মাইল দূরে যমুনার তীরে তার শবদাহ করা হয়। এখানেই দাহ করা হয়েছিল তার পিতা জওহরলাল নেহরুকে, ছেলে সঞ্জয় গান্ধীকে, আর ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মহাত্মা গান্ধীকে।

ইন্দিরার ব্লু-স্টার অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়তো সময়ের বিচারে খুব কঠিন একটি সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু একজন আদর্শ রাষ্ট্রপ্রধানের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, বিশেষ করে ভারতের মতো নানা জাতি আর সংস্কৃতিতে বিভক্ত জনগোষ্ঠীর ভূখন্ডে এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলা যায়। সেই সাথে এত অভিযানের ক্ষয়ক্ষতি, এত বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর দায়ভারও সরকারের উপরেই আসে। একটি খারাপ সময়ে শক্ত হাতে রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিষাদময় পরিণতি বরণ করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীকে। বাংলাদেশ তার আপদকালীন এই বন্ধুটির প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

9
ভারতের ইতিহাসে একটি করুণ, অনাকাঙ্ক্ষিত ও মর্মবিদারক ঘটনা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গোড়া থেকেই সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া থেকে শুরু করে বিশ্বমহলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের সার্বিক প্রচেষ্টাসহ নব্য উত্থিত রাষ্ট্রটির জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক লড়াইয়ে সদর্পে অগ্রসর হয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’য় ভূষিত হন বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু।

স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহরলাল নেহরুর একমাত্র সন্তান ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহরু। ১৯৪২ সালে ইন্দিরা বিয়ে করেন ফিরোজ গান্ধীকে। ফিরোজ জাহাঙ্গীর গান্ধী ছিলেন পার্সী বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্যও ছিলেন।

তার নামের পদবী ছিল মূলত ‘Ghandy’। ১৯৩০ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ফিরোজ গান্ধী। মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা চরমভাবে অনুপ্রাণিত ফিরোজ তার নামের বানান ‘Ghandy’ থেকে ‘Gandhi’-তে পরিবর্তন করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত থাকার সুবাদেই নেহরু পরিবারের সাথে সখ্য বাড়ে ফিরোজের। ১৯৪২ সালের ২৬ মার্চ ফিরোজকে বিয়ের পর ইন্দিরা ‘নেহরু’ থেকে ‘ইন্দিরা গান্ধী’ হয়ে যান।

ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তিনি ৪ দফা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আশির দশকে ৪র্থ দফায় ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় ভারতের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়ে। বেশ কিছু রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্বাধীনতা দাবি করতে শুরু করে এ সময়। এর মধ্যে পাঞ্জাবও ছিল। সন্ত জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নেতৃত্বে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা স্বতন্ত্র ভূখন্ড ‘খালিস্তান’ এর দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে জার্নাইল সিং অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অবস্থান নেন এবং শিখদের ভেতরে বিদ্রোহ উস্কে দিতে থাকেন

১৯৮৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু-স্টার পরিচালনা করে। বিদ্রোহী দমনের এই অভিযানে ভিন্দ্রানওয়ালেসহ ভারতীয় সেনাদের হিসাবমতে প্রায় ৪৯৩ জন শিখ বিদ্রোহী নিহত হয়। কিন্তু অন্যান্য নথি অনুযায়ী বেসামরিক মানুষসহ মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। সেনাবাহিনীর ৪ অফিসারসহ ৮৩ জন নিহত হন। স্বর্ণমন্দিরের অনেক ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই অভিযানে।

অপারেশন ব্লু-স্টারের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল একটি বিশেষ দিন, ৬ জুন। এই দিনটি স্বর্ণমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অর্জন দেবের মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে প্রচুর শিখ তীর্থযাত্রীর আগমন ঘটে স্বর্ণমন্দিরে। অনেকেই মনে করেন, যত বেশি সম্ভব শিখ হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করাই ছিল এই দিনটি নির্ধারণের লক্ষ্য। তবে এই অভিযানে নেতৃত্বদানকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ব্রারের ভাষ্যমতে, ব্যাপারটি ছিল নিছক কাকতালীয়। ২০০৪ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,

    “আপনাকে বুঝতে হবে, সরকারের কাছে অপারেশন সম্পন্ন করার জন্য মাত্র ৩-৪ দিন সময় ছিল। আমাদের কাছে তথ্য ছিল খালিস্তান যেকোনো মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে। বুঝার চেষ্টা করুন। ধরুন, এক সুন্দর দিনে ভিন্দ্রানওয়ালে স্বাধীন খালিস্তান ঘোষণা করে খালিস্তানের পতাকা উড়িয়ে দিল...। খালিস্তানি মুদ্রা পর্যন্ত বন্টন করা হয়ে গিয়েছিল; পাকিস্তানও এদের পেছনে টাকা ঢালছিল। তারা চাচ্ছিলো যে পাঞ্জাব, ভারতের শক্তিশালী একটা অংশ, ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক।”

স্বর্ণমন্দিরে সেনা আক্রমণের আগে থেকেই পাঞ্জাবকে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। পাঞ্জাবের প্রধান শহরগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়। দেশি ও বিদেশি সংবাদকর্মীদের শহরের বাইরে রেখে আসা হয়। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান আর ব্লু-স্টার অভিযান নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু বিতর্কের চেয়ে বেশি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ছিল অভিযান পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতি।

পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের অবমাননা আর খালিস্তানের স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ করে দেবার প্রতিশোধস্বরুপ ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪, সাৎওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং নামে নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা ব্রিটিশ অভিনেতা ও পরিচালক পিটার আস্তিনভের আইরিশ টেলিভিশনের জন্য করা একটি ডকুমেন্টারির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে যাচ্ছিলেন। নয়া দিল্লির ১ নং সফদরজং রোডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে হেঁটে পার্শ্ববর্তী আকবর রোডের অফিসে যাচ্ছিলেন তিনি। স্বর্ণমন্দিরে অভিযানের পরের মাসে ‘র’ এর ডিরেক্টর মিসেস গান্ধীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যে থেকে শিখদের অপসারণ করতে। তিনি একবাক্যে না করে দিয়ে বলেন, “তাহলে কী করে আমরা নিজেদের সেক্যুলার বলবো?”

বেয়ান্ত সিংকে মিসেস গান্ধী দশ বছর ধরে চিনতেন। এই দশ বছরের পরিচিত বেয়ান্ত সিং মাত্র ৭ ফুট দূর থেকে তার পয়েন্ট থার্টি এইট রিভলভার দিয়ে মিসেস গান্ধীর তলপেটে তিনটি গুলি চালায়। তিনি মাটিতে পড়ে যেতেই সাৎওয়ান্ত সিং তার অটোমেটিক স্টেনগানের ত্রিশ রাউন্ড খালি করে দেয় তার উপর। অন্তত ৭টি গুলি মিসেস গান্ধীর পেটে লাগে, ৩টি তার বুকে আর ১টি হৃৎপিণ্ডে। প্রধানমন্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেই দুই ঘাতক দেহরক্ষী শান্তভাবে তাদের অস্ত্র ফেলে দেয়। অন্য নিরাপত্তাকর্মীরা তৎক্ষণাৎ তাদের ধরে ফেললে বেয়ান্ত সিং নির্লিপ্তভাবে বলে, “আমার যা করার দরকার ছিল আমি করেছি, এখন তোমরা যা করতে চাও কর।”

তাদের দুজনকে একটি গার্ডহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অকস্মাৎ বেয়ান্ত সিং লাফ দিয়ে এক নিরাপত্তারক্ষীর বন্দুক ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে। একইসাথে সাৎওয়ান্ত সিং তার পাগড়ির ভেতর থেকে একটি ছোরা বের করে। রক্ষীরা তৎক্ষণাৎ দুজনকেই গুলি করতে বাধ্য হয়। বেয়ান্ত সিং সাথে সাথেই মারা যায়। সাৎওয়ান্ত সিংকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে সে স্বীকারোক্তি দেয় যে, সে একটি বড়সড় ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। এই ষড়যন্ত্রে একজন উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারও জড়িত ছিল এবং তাদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল রাজীব গান্ধী।

মিসেস গান্ধীর নিথর দেহটি অল-ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস হসপিটালে নেয়া হয়। গাড়িতে তার মাথাটি কোলে করে বসে অঝোরে কেঁদে চলেছিলেন পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী। হাসপাতালে পৌঁছার পর তার দেহে জীবনের কোনো লক্ষণ না থাকলেও ১২ জন ডাক্তারের একটি দল অসম্ভবকে সম্ভব করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যান। ইন্দিরার দেহ থেকে ৭টি বুলেট বের করা হয়, একটি কৃত্রিম ফুসফুস সংস্থাপন করা হয়, ৮৮ বোতল ও-নেগেটিভ রক্ত দেয়া হয়। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে একটি ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রচার করে, ‘মিসেস গান্ধী মৃত।’

ইন্দিরা গান্ধী কখনো বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরতেন না। মৃত্যুর আগেরদিন রাতে ওড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে এক বিশাল জনসভায় তিনি বলেছিলেন,

    “আমার দীর্ঘ জীবনের আকাঙ্ক্ষা নেই। আমি এসব জিনিসে ভয় পাই না। এই জাতির সেবায় আমার জীবন চলে গেলেও আমি কিছু মনে করবো না। আজ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু এই জাতিতে শক্তি সঞ্চার করবে।”

ক্ষমতায় থাকাবস্থায় জওহরলাল নেহেরু থাকতেন তিন মূর্তি ভবনে। সেখানেই মিসেস গান্ধীর মৃতদেহ দু’দিন রাখা হয়। হাজারো ভারতবাসী তাদের সম্মান জানাতে আর প্রধানমন্ত্রীকে শেষ দেখা দেখতে আসেন সেখানে। দু’দিন পর ৭ মাইল দূরে যমুনার তীরে তার শবদাহ করা হয়। এখানেই দাহ করা হয়েছিল তার পিতা জওহরলাল নেহরুকে, ছেলে সঞ্জয় গান্ধীকে, আর ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মহাত্মা গান্ধীকে।

ইন্দিরার ব্লু-স্টার অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়তো সময়ের বিচারে খুব কঠিন একটি সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু একজন আদর্শ রাষ্ট্রপ্রধানের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, বিশেষ করে ভারতের মতো নানা জাতি আর সংস্কৃতিতে বিভক্ত জনগোষ্ঠীর ভূখন্ডে এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলা যায়। সেই সাথে এত অভিযানের ক্ষয়ক্ষতি, এত বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর দায়ভারও সরকারের উপরেই আসে। একটি খারাপ সময়ে শক্ত হাতে রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিষাদময় পরিণতি বরণ করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীকে। বাংলাদেশ তার আপদকালীন এই বন্ধুটির প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

10
ব্যাখাটা অনেক সহজ। আসলে পুরো ব্যাপারটাই অর্থনৈতিক। ধনী ও গরীবের মাঝে পার্থক্য যত বাড়বে, অপরাধের পরিমাণও তত বাড়বে। সত্য বলতে কি, ধনীদের জন্য সমাজে অনেক অর্থ চলে এসেছে। কিন্তু তা গরীব পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই গরীবরা এই অর্থ জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ কারণে সমাজে নানা বিবাদের সৃষ্টি হয়। এটা আসলে খুবই স্বাভাবিক। সব জায়গায় এটা চলছে। তার উপর আমাদের এখানে তো অশিক্ষিত তরুণদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এদের তো যৌন বিষয়ক শিক্ষা নেই-ই, কিন্তু ইন্টারনেটে ঠিকই ফ্রি পর্ণোগ্রাফি দেখতে পায়। এগুলো এদের যৌবনসুলভ মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। এরা আসলে বুঝতেই পারে না কী করবে। নারীদের এরা কেবল ভোগের বস্তু হিসেবে ভাবতে থাকে। এরা চায় ধনীদের মতো এদের জীবনেও আমোদ ফুর্তি আসুক। কিন্তু এসব পায় না বলে জোর করে ভোগ করার চেষ্টা করে, ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা না ভেবে। তাছাড়া হারানোর জন্যও এদের তেমন কিছু নেই।

উক্তিটি সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত নেটফ্লিক্সের ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘দিল্লি ক্রাইম’ থেকে সরাসরি তুলে দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণের আসামীকে ধরতে যাওয়ার সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা এই বক্তব্য দেন। নিজের জুনিয়র একজন কর্মচারী তাকে ধর্ষকদের মন মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এই ব্যাখাটি দেন।

নেটফ্লিক্স ভারতে আসার পর থেকে দর্শকদের একের পর এক মানসম্মত টিভি সিরিজ উপহার দিয়ে আসছে। এই তালিকায় যুক্ত নতুন একটি টিভি সিরিজ হলো ‘দিল্লি ক্রাইম’। ২২ মার্চ এটি ‘নেটফ্লিক্স অরিজিনাল’ হিসেবে তাদের স্ট্রিমিং সার্ভিসে যুক্ত হয়।

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। ঘটনাস্থল ভারতের দিল্লি শহর। দক্ষিণ দিল্লির এক সিনেমাহল থেকে বেরিয়ে ঘরে ফিরছে দুই তরুণ তরুণী। সাদা রঙের একটি সিটি বাসে উঠলো দুজন। তারা দুজন ছাড়াও বাসে ড্রাইভারসহ আরো ৬ জন ছিল। বাসে চড়ার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর রাস্তার পাশে এক গর্তে এই দুই তরুণ তরুণীকে উলঙ্গ অবস্থায় আবিষ্কার করা হয়। দুজনেরই জ্ঞান আছে। কিন্তু তাদের শরীর নিথর। ছেলেটা নড়াচড়া করতে পারলেও মেয়েটিকে চুড়ান্ত মাত্রায় ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই পুলিশ দ্রুত তাদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে থাকে।

২০১২ সালে দিল্লিতে বাসে গণ ধর্ষণের একটি ঘটনা পুরো ভারতবাসীকে স্তম্ভিত করে ফেলেছিল। উপরে সেই কাহিনীর কথাই বলা হয়েছে। এক মেয়ের ছয় জন দ্বারা ধর্ষিত ও ধর্ষণের পর শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার এই ঘটনাটি পুরো ভারতবাসীর বিবেককে নাড়া দেয়। দিল্লি পুলিশের কেস ফাইলে এর আগে কখনো এমন বীভৎস ও অমানবিক ঘটনার নমুনা পাওয়া যায়নি। চরমভাবে আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করা সেই মেয়েটিকে সমগ্র ভারতবাসী ‘নির্ভয়া’ নাম দেয়। নির্ভয়ার ধর্ষকদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে সারা দেশ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে।

প্রায় সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া এই বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় ‘দিল্লি ক্রাইম’ টিভি সিরিজ। সাতটি এপিসোডের এই টিভি সিরিজের জনরা হলো ক্রাইম ড্রামা। আরো স্পষ্ট করে বললে পুলিশ প্রসিডিউরাল ক্রাইম ড্রামা। অর্থাৎ যে কাহিনীতে একটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নির্দিষ্ট কোনো কেস হাতে নেয় এবং ধাপে ধাপে সেই কেসের সমাধান বের করে। অবশেষে অপরাধীদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে।
কাহিনী সংক্ষেপ

বর্তিকা চতুর্বেদী দক্ষিণ দিল্লির সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডিসিপি)। এই চরিত্রকে কেন্দ্র করেই পুরো সিরিজের কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে। সিরিজের সূচনা হয় এই চরিত্রের মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমে।

    দিল্লি। ভারতের রাজধানী। যার জনসংখ্যা একটি ছোটখাটো দেশের সমান। প্রতি বছর এখানে প্রায় এগারো হাজার জঘন্য অপরাধের রিপোর্ট করা হয়। এসব অপরাধের প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। যেখানে পুলিশ বাহিনীর অর্ধেকই ট্রাফিক ডিউটি ও ভিআইপিদের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে আটকা পড়ে যায়।

মাঝরাতে পুলিশ স্টেশন থেকে ডিসিপি বর্তিকা চতুর্বেদীর কাছে একটি ফোনকল আসে। ফোনের অপর পাশ থেকে তিনি জানতে পারেন যে, একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে দিল্লির মহিলাপুরের রাস্তার পাশ হতে উলঙ্গ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। মেয়েটি মারাত্মকভাবে আহত। ফোনে এসব ঘটনা শোনার পরপরই তিনি বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। যে হাসপাতালে ছেলে ও মেয়েটিকে ভর্তি করানো হয়েছে সেখানে পৌঁছান।

হাসপাতালে পৌঁছে মেয়েটিকে দেখার পর তিনি একদম স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। মেয়েটি বাসে ছয় জনের দ্বারা গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। ধর্ষকরা কেবল মেয়েটির সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। মেয়েটিকে লোহার রড দিয়ে চরমভাবে আহত করে এবং বারবার তার গোপন অঙ্গে রড ঢুকিয়ে ও বের করে দেহের ভিতরের অংশ জখম করে ফেলে। ডাক্তারের কাছে ভয়ংকর এই বর্ণনা শোনার পর ডিসিপি নিজেকে সামলাতে পারেন না। একজন নারী হিসেবে তিনি অন্তরে এক তীব্র জ্বালা অনুভব করেন। তার চোখেমুখে তা ফুটে ওঠে।

নিজের চাকরির ইতিহাসে আগে কখনো ডিসিপি বর্তিকা চতুর্বেদী এমন জঘন্য কেসের সম্মুখীন হননি। তিনি কোনো বিলম্ব না করে সেই রাতেই তার ডিপার্টমেন্টের সকল দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের একত্র করতে থাকেন। যেভাবেই হোক, এই ছয়জন আসামিকে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে। আর তা করতে হবে সকল প্রোটোকল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালনের মাধ্যমে।
চরিত্র পরিচিতি ও অভিনয়

কাহিনীর মূল চরিত্রের নাম ডিসিপি বর্তিকা চতুর্বেদী। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী শেফালী শাহ। দক্ষিণ দিল্লির সহকারী পুলিশ কমিশনারের চরিত্রকে তিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। দায়িত্ববোধ, আবেগ, কঠোরতা বিভিন্ন দৃশ্যে যখন যেটার প্রয়োজন হয়েছে, তা তিনি সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। পুরো সিরিজ জুড়ে লাইম লাইট তার উপরই ছিল। চরিত্রের গভীরতা ও গুরুত্বকে মাথায় রেখে তিনি সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন।

অন্যান্য চরিত্রগুলোর মাঝে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভুপেন্দ্র সিং ও নিতি সিং চরিত্র দুটি। ভুপেন্দ্র সিং একজন দক্ষ পুলিশ অফিসার। তিনি যেমন কর্তব্যপরায়ণ ও আদর্শবাদী, তেমনি প্রয়োজনের সময় নিয়মের বাইরে গিয়ে কীভাবে কাজ আদায় করে নিতে হয় তাও ভালো জানেন। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা রাজেশ তাইলাং। এই অভিনেতাকে আমাজন প্রাইম স্ট্রিমিং সার্ভিসের অপর এক জনপ্রিয় ভারতীয় সিরিজ ‘মির্জাপুর’ এও একটি চরিত্রে দেখা গিয়েছে।

নিতি সিং একজন ট্রেইনি বা শিক্ষানবিশ পুলিশ অফিসার। চাকরিতে নতুন হলেও অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পুলিশ কর্মকর্তাদের থেকেও তিনি অনেক বিচক্ষণ ও কর্তব্যপরায়ণ। তার এই গুণ বর্তিকা চতুর্বেদীর চোখে পরে এবং শিক্ষানবিশ হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিতির উপর কেসের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়ভার তুলে দেন। নিতি সিং চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী রাসিকা দুগাল। এনাকেও ‘মির্জাপুর’ সিরিজটিতে গুরুত্বপূর্ণ এক পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়।

অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রগুলো দর্শকদের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজে তাদের ছোটখাটো কিছু চরিত্রে দেখা যায়। তবে এই সিরিজটিতে প্রত্যেক চরিত্র তাদের নিজস্ব দৃশ্যে ভালো অভিনয় করেছেন। কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেও পরিচালক তাদের প্রতি সুবিচার করেছেন। পুলিশদের জীবনের ভালো-খারাপ সব দিক এই চরিত্রগুলোর মাধ্যমে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ধর্ষকদের মাঝে যে বাস ড্রাইভার ছিল, তার কথা আলাদা করে বলতেই হবে। বিকৃত মস্তিষ্কের এই মানুষটা আসলেই মানুষ না জানোয়ার তা দর্শককে ভাবিয়ে তুলবে। এই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা মৃদুলকে অবশ্যই বাহবা দিতে হবে।
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা

ইন্দো-কানাডিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা রিচি মেহতা প্রায় ৫ বছর ধরে এই টিভি সিরিজ নিয়ে কাজ করছেন। নিজের টিমকে নিয়ে তিনি এই কেসের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করেছেন। যারা যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই ঘটনাটির সাথে যুক্ত ছিল তাদের সাথে কথা বলেছেন। যেহেতু পুলিশদের তদন্তের উপর ভিত্তি করে সিরিজের কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে। তাই তিনি সংশ্লিষ্ট সকল পুলিশ কর্মকর্তার সাথে ওঠাবসা করেছেন। তার মতে, একটি অপরাধের বিচারকার্য সাধারণ জনগণ কীভাবে দেখে এবং এর সাথে জড়িত আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কীভাবে দেখে, দুটি দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কেই জানা জরুরি ছিল।

    আমি যেই তাদের (সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের) সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম, তখন ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভেবে দেখতে শুরু করি। একজন মানুষের দ্বারা যতটুকু সম্ভব তার পুরোটাই তারা দিয়েছেন এই কেসের পেছনে। এটা শুধু এমন নয় যে, তারা তাদের কাজটাই ঠিকমতো করেছেন। এই সিরিজটি দেখলে আপনারা এটাও দেখবেন, এই কেসের সমাধান করার জন্য তাদের কত প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

বাস্তবে এই কেস নিয়ে পুলিশের উপর সাধারণ জনগণের অনেক ক্ষোভ ছিল। তবে নানা ঝামেলার সম্মুখীন হয়েও ৫ দিনের মাথায় ছয় জন আসামীকেই পুলিশ ধরতে সক্ষম হয়। দিল্লি পুলিশের পরিপ্রেক্ষিতে কাজটা আসলে কতটা কঠিন ছিল, তা পরিচালক সফলভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। চিত্রনাট্য এই সিরিজের অন্যতম শক্তিশালী দিক। ধীর গতি কিংবা খুব দ্রুত কাহিনী শেষ করে দেওয়ার কোনো প্রবণতা ছিল না। সাতটি এপিসোডই ছিল সমান গতিময়। দর্শক হাতে সময় নিয়ে দেখতে বসলে এক বসায় শেষ করতে পারবেন।

পুরো সিরিজের মেকিংয়ে যে জিনিসটির অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি ছিল তা হলো সংবাদমাধ্যম। যেকোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। তবে সংবাদমাধ্যকে এই সিরিজে একেবারেই অবহেলা করা হয়েছে। যেটুকু দেখানো হয়েছে, তা হলো কীভাবে জনগণকে সত্যিকারের খবর থেকে বঞ্চিত করা হয়। আর বেশি কভারেজের আশায় অর্ধসত্য ও মিথ্যা খবর ছড়ানো হয়। এই নেতিবাচক হলুদ সংবাদিকতার দৃশ্যায়নও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। শুধুমাত্র পুলিশদের কঠোর পরিশ্রম আর তাদের জীবনযাপনকে তুলে ধরা অনেকের কাছে একতরফা লাগতে পারে। ধর্ষণের শিকার মেয়ের পরিবার ও তাদের সংগ্রামকেও আরো বড় করে তুলে ধরা উচিত ছিল।

আরেকটি বিষয় হলো ভাষা। নেটফ্লিক্সে ইংরেজি ও হিন্দি দুই ভাষাতেই সিরিজটি দেখা যাবে। তবে হিন্দি ডাবিংয়েও বেশ কিছু জায়গায় লম্বা সময় ধরে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে বর্তিকা চতুর্বেদীর নিজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার কথোপকথন। এই দৃশ্যগুলোতে বেশিরভাগ জায়গায়ই সবাই ইংরেজিতে কথা বলে। ব্যাপারটা বেশ দৃষ্টিকটু ছিল।

যেখানে গল্প ও বাস্তবতা মিশে গিয়েছে

আমরা সাধারণত কোনো ঘটনাকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করে থাকি। একটি ঘটনার সকল দিক আমাদের চোখে পড়ে না। যেটুকু আমাদের চোখে পড়ে তা নিয়েই আমরা একটা মোটামুটি যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলি। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি মেয়ের সাথে চলন্ত বাসে যে অমানবিক ঘটনা ঘটেছিল, সেটিও অনেকটা এরকম। সাধারণ জনগণ ঘটনার বীভৎসতা মেনে নিতে পারেনি। কাউকে না কাউকে দোষারোপ করতেই হবে। মানুষ ভাবতে শুরু করে পুলিশ হয়তো চাইলে এই ঘটনাটা থামাতে পারতো। সংবাদমাধ্যমগুলোও জনগণের মনে এই ধারণা পোষণে সাহায্য করে।

আসামিদের গ্রেফতার ও ফাঁসির জন্য সারা ভারতের রাস্তায় মানুষ আন্দোলনে নেমেছিল। শান্তিপূর্ণভাবে মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। এসব শান্তিপূর্ণ মিছিলকে হরতালে রূপ দেওয়ার জন্য দরকার শুধু কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী। আবার রাজনৈতিক স্বার্থের ব্যাপারটা তো আছেই। একটি মেয়ের জীবনের সাথে এখানে কয়টি জীবন সংকটের মুখে পড়ে তা এই সিরিজ দেখলে দর্শক জানতে পারবেন। তাছাড়া এসব অপরাধের পেছনে যে আধুনিক তরুণসমাজেরও বড় ভূমিকা রয়েছে, সে দিকটিরও আলোকপাত এখানে করা হয়েছে।

আন্দোলনের প্রয়োজন আছে। এটি বিচারকার্য তরান্বিত করে। কিন্তু এই আন্দোলনই অনেক সময় সঠিক বিচারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। গ্রেফতারকৃত আসামিদের নিরাপদে আদালতে নেওয়া, ফরেনসিক টিমের ঘটনাস্থল নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদিতে আন্দোলন বড় রকমের বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আরেকটি বিষয়ের জন্য এই টিভি সিরিজের প্রশংসা করতেই হবে। তা হলো ধর্ষণের কোনো দৃশ্য না দেখানো। বাসে আসলে কী ঘটেছিল তা জানানোর জন্য কোনো দৃশ্য দেখানোর প্রয়োজন পড়েনি। নির্মাতা ঘটনার ব্যাখার মধ্যেই এর মারাত্মক বীভৎসতাকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। পরিবারকে সাথে নিয়ে দেখতে বসতে পারেন আইএমডিবিতে ৮.৯ রেটিং পাওয়া এই টিভি সিরিজটি।

11
ব্যাখাটা অনেক সহজ। আসলে পুরো ব্যাপারটাই অর্থনৈতিক। ধনী ও গরীবের মাঝে পার্থক্য যত বাড়বে, অপরাধের পরিমাণও তত বাড়বে। সত্য বলতে কি, ধনীদের জন্য সমাজে অনেক অর্থ চলে এসেছে। কিন্তু তা গরীব পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই গরীবরা এই অর্থ জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ কারণে সমাজে নানা বিবাদের সৃষ্টি হয়। এটা আসলে খুবই স্বাভাবিক। সব জায়গায় এটা চলছে। তার উপর আমাদের এখানে তো অশিক্ষিত তরুণদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এদের তো যৌন বিষয়ক শিক্ষা নেই-ই, কিন্তু ইন্টারনেটে ঠিকই ফ্রি পর্ণোগ্রাফি দেখতে পায়। এগুলো এদের যৌবনসুলভ মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। এরা আসলে বুঝতেই পারে না কী করবে। নারীদের এরা কেবল ভোগের বস্তু হিসেবে ভাবতে থাকে। এরা চায় ধনীদের মতো এদের জীবনেও আমোদ ফুর্তি আসুক। কিন্তু এসব পায় না বলে জোর করে ভোগ করার চেষ্টা করে, ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা না ভেবে। তাছাড়া হারানোর জন্যও এদের তেমন কিছু নেই।

উক্তিটি সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত নেটফ্লিক্সের ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘দিল্লি ক্রাইম’ থেকে সরাসরি তুলে দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণের আসামীকে ধরতে যাওয়ার সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা এই বক্তব্য দেন। নিজের জুনিয়র একজন কর্মচারী তাকে ধর্ষকদের মন মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এই ব্যাখাটি দেন।

নেটফ্লিক্স ভারতে আসার পর থেকে দর্শকদের একের পর এক মানসম্মত টিভি সিরিজ উপহার দিয়ে আসছে। এই তালিকায় যুক্ত নতুন একটি টিভি সিরিজ হলো ‘দিল্লি ক্রাইম’। ২২ মার্চ এটি ‘নেটফ্লিক্স অরিজিনাল’ হিসেবে তাদের স্ট্রিমিং সার্ভিসে যুক্ত হয়।

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। ঘটনাস্থল ভারতের দিল্লি শহর। দক্ষিণ দিল্লির এক সিনেমাহল থেকে বেরিয়ে ঘরে ফিরছে দুই তরুণ তরুণী। সাদা রঙের একটি সিটি বাসে উঠলো দুজন। তারা দুজন ছাড়াও বাসে ড্রাইভারসহ আরো ৬ জন ছিল। বাসে চড়ার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর রাস্তার পাশে এক গর্তে এই দুই তরুণ তরুণীকে উলঙ্গ অবস্থায় আবিষ্কার করা হয়। দুজনেরই জ্ঞান আছে। কিন্তু তাদের শরীর নিথর। ছেলেটা নড়াচড়া করতে পারলেও মেয়েটিকে চুড়ান্ত মাত্রায় ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই পুলিশ দ্রুত তাদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে থাকে।

২০১২ সালে দিল্লিতে বাসে গণ ধর্ষণের একটি ঘটনা পুরো ভারতবাসীকে স্তম্ভিত করে ফেলেছিল। উপরে সেই কাহিনীর কথাই বলা হয়েছে। এক মেয়ের ছয় জন দ্বারা ধর্ষিত ও ধর্ষণের পর শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার এই ঘটনাটি পুরো ভারতবাসীর বিবেককে নাড়া দেয়। দিল্লি পুলিশের কেস ফাইলে এর আগে কখনো এমন বীভৎস ও অমানবিক ঘটনার নমুনা পাওয়া যায়নি। চরমভাবে আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করা সেই মেয়েটিকে সমগ্র ভারতবাসী ‘নির্ভয়া’ নাম দেয়। নির্ভয়ার ধর্ষকদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে সারা দেশ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে।

প্রায় সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া এই বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় ‘দিল্লি ক্রাইম’ টিভি সিরিজ। সাতটি এপিসোডের এই টিভি সিরিজের জনরা হলো ক্রাইম ড্রামা। আরো স্পষ্ট করে বললে পুলিশ প্রসিডিউরাল ক্রাইম ড্রামা। অর্থাৎ যে কাহিনীতে একটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নির্দিষ্ট কোনো কেস হাতে নেয় এবং ধাপে ধাপে সেই কেসের সমাধান বের করে। অবশেষে অপরাধীদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে।
কাহিনী সংক্ষেপ

বর্তিকা চতুর্বেদী দক্ষিণ দিল্লির সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডিসিপি)। এই চরিত্রকে কেন্দ্র করেই পুরো সিরিজের কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে। সিরিজের সূচনা হয় এই চরিত্রের মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমে।

    দিল্লি। ভারতের রাজধানী। যার জনসংখ্যা একটি ছোটখাটো দেশের সমান। প্রতি বছর এখানে প্রায় এগারো হাজার জঘন্য অপরাধের রিপোর্ট করা হয়। এসব অপরাধের প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। যেখানে পুলিশ বাহিনীর অর্ধেকই ট্রাফিক ডিউটি ও ভিআইপিদের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে আটকা পড়ে যায়।

মাঝরাতে পুলিশ স্টেশন থেকে ডিসিপি বর্তিকা চতুর্বেদীর কাছে একটি ফোনকল আসে। ফোনের অপর পাশ থেকে তিনি জানতে পারেন যে, একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে দিল্লির মহিলাপুরের রাস্তার পাশ হতে উলঙ্গ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। মেয়েটি মারাত্মকভাবে আহত। ফোনে এসব ঘটনা শোনার পরপরই তিনি বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। যে হাসপাতালে ছেলে ও মেয়েটিকে ভর্তি করানো হয়েছে সেখানে পৌঁছান।

হাসপাতালে পৌঁছে মেয়েটিকে দেখার পর তিনি একদম স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। মেয়েটি বাসে ছয় জনের দ্বারা গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। ধর্ষকরা কেবল মেয়েটির সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। মেয়েটিকে লোহার রড দিয়ে চরমভাবে আহত করে এবং বারবার তার গোপন অঙ্গে রড ঢুকিয়ে ও বের করে দেহের ভিতরের অংশ জখম করে ফেলে। ডাক্তারের কাছে ভয়ংকর এই বর্ণনা শোনার পর ডিসিপি নিজেকে সামলাতে পারেন না। একজন নারী হিসেবে তিনি অন্তরে এক তীব্র জ্বালা অনুভব করেন। তার চোখেমুখে তা ফুটে ওঠে।

নিজের চাকরির ইতিহাসে আগে কখনো ডিসিপি বর্তিকা চতুর্বেদী এমন জঘন্য কেসের সম্মুখীন হননি। তিনি কোনো বিলম্ব না করে সেই রাতেই তার ডিপার্টমেন্টের সকল দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের একত্র করতে থাকেন। যেভাবেই হোক, এই ছয়জন আসামিকে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে। আর তা করতে হবে সকল প্রোটোকল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালনের মাধ্যমে।
চরিত্র পরিচিতি ও অভিনয়

কাহিনীর মূল চরিত্রের নাম ডিসিপি বর্তিকা চতুর্বেদী। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী শেফালী শাহ। দক্ষিণ দিল্লির সহকারী পুলিশ কমিশনারের চরিত্রকে তিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। দায়িত্ববোধ, আবেগ, কঠোরতা বিভিন্ন দৃশ্যে যখন যেটার প্রয়োজন হয়েছে, তা তিনি সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। পুরো সিরিজ জুড়ে লাইম লাইট তার উপরই ছিল। চরিত্রের গভীরতা ও গুরুত্বকে মাথায় রেখে তিনি সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন।

অন্যান্য চরিত্রগুলোর মাঝে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভুপেন্দ্র সিং ও নিতি সিং চরিত্র দুটি। ভুপেন্দ্র সিং একজন দক্ষ পুলিশ অফিসার। তিনি যেমন কর্তব্যপরায়ণ ও আদর্শবাদী, তেমনি প্রয়োজনের সময় নিয়মের বাইরে গিয়ে কীভাবে কাজ আদায় করে নিতে হয় তাও ভালো জানেন। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা রাজেশ তাইলাং। এই অভিনেতাকে আমাজন প্রাইম স্ট্রিমিং সার্ভিসের অপর এক জনপ্রিয় ভারতীয় সিরিজ ‘মির্জাপুর’ এও একটি চরিত্রে দেখা গিয়েছে।

নিতি সিং একজন ট্রেইনি বা শিক্ষানবিশ পুলিশ অফিসার। চাকরিতে নতুন হলেও অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পুলিশ কর্মকর্তাদের থেকেও তিনি অনেক বিচক্ষণ ও কর্তব্যপরায়ণ। তার এই গুণ বর্তিকা চতুর্বেদীর চোখে পরে এবং শিক্ষানবিশ হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিতির উপর কেসের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়ভার তুলে দেন। নিতি সিং চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী রাসিকা দুগাল। এনাকেও ‘মির্জাপুর’ সিরিজটিতে গুরুত্বপূর্ণ এক পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়।

অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রগুলো দর্শকদের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজে তাদের ছোটখাটো কিছু চরিত্রে দেখা যায়। তবে এই সিরিজটিতে প্রত্যেক চরিত্র তাদের নিজস্ব দৃশ্যে ভালো অভিনয় করেছেন। কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেও পরিচালক তাদের প্রতি সুবিচার করেছেন। পুলিশদের জীবনের ভালো-খারাপ সব দিক এই চরিত্রগুলোর মাধ্যমে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ধর্ষকদের মাঝে যে বাস ড্রাইভার ছিল, তার কথা আলাদা করে বলতেই হবে। বিকৃত মস্তিষ্কের এই মানুষটা আসলেই মানুষ না জানোয়ার তা দর্শককে ভাবিয়ে তুলবে। এই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা মৃদুলকে অবশ্যই বাহবা দিতে হবে।
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা

ইন্দো-কানাডিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা রিচি মেহতা প্রায় ৫ বছর ধরে এই টিভি সিরিজ নিয়ে কাজ করছেন। নিজের টিমকে নিয়ে তিনি এই কেসের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করেছেন। যারা যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই ঘটনাটির সাথে যুক্ত ছিল তাদের সাথে কথা বলেছেন। যেহেতু পুলিশদের তদন্তের উপর ভিত্তি করে সিরিজের কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে। তাই তিনি সংশ্লিষ্ট সকল পুলিশ কর্মকর্তার সাথে ওঠাবসা করেছেন। তার মতে, একটি অপরাধের বিচারকার্য সাধারণ জনগণ কীভাবে দেখে এবং এর সাথে জড়িত আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কীভাবে দেখে, দুটি দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কেই জানা জরুরি ছিল।

    আমি যেই তাদের (সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের) সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম, তখন ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভেবে দেখতে শুরু করি। একজন মানুষের দ্বারা যতটুকু সম্ভব তার পুরোটাই তারা দিয়েছেন এই কেসের পেছনে। এটা শুধু এমন নয় যে, তারা তাদের কাজটাই ঠিকমতো করেছেন। এই সিরিজটি দেখলে আপনারা এটাও দেখবেন, এই কেসের সমাধান করার জন্য তাদের কত প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

বাস্তবে এই কেস নিয়ে পুলিশের উপর সাধারণ জনগণের অনেক ক্ষোভ ছিল। তবে নানা ঝামেলার সম্মুখীন হয়েও ৫ দিনের মাথায় ছয় জন আসামীকেই পুলিশ ধরতে সক্ষম হয়। দিল্লি পুলিশের পরিপ্রেক্ষিতে কাজটা আসলে কতটা কঠিন ছিল, তা পরিচালক সফলভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। চিত্রনাট্য এই সিরিজের অন্যতম শক্তিশালী দিক। ধীর গতি কিংবা খুব দ্রুত কাহিনী শেষ করে দেওয়ার কোনো প্রবণতা ছিল না। সাতটি এপিসোডই ছিল সমান গতিময়। দর্শক হাতে সময় নিয়ে দেখতে বসলে এক বসায় শেষ করতে পারবেন।

পুরো সিরিজের মেকিংয়ে যে জিনিসটির অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি ছিল তা হলো সংবাদমাধ্যম। যেকোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। তবে সংবাদমাধ্যকে এই সিরিজে একেবারেই অবহেলা করা হয়েছে। যেটুকু দেখানো হয়েছে, তা হলো কীভাবে জনগণকে সত্যিকারের খবর থেকে বঞ্চিত করা হয়। আর বেশি কভারেজের আশায় অর্ধসত্য ও মিথ্যা খবর ছড়ানো হয়। এই নেতিবাচক হলুদ সংবাদিকতার দৃশ্যায়নও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। শুধুমাত্র পুলিশদের কঠোর পরিশ্রম আর তাদের জীবনযাপনকে তুলে ধরা অনেকের কাছে একতরফা লাগতে পারে। ধর্ষণের শিকার মেয়ের পরিবার ও তাদের সংগ্রামকেও আরো বড় করে তুলে ধরা উচিত ছিল।

আরেকটি বিষয় হলো ভাষা। নেটফ্লিক্সে ইংরেজি ও হিন্দি দুই ভাষাতেই সিরিজটি দেখা যাবে। তবে হিন্দি ডাবিংয়েও বেশ কিছু জায়গায় লম্বা সময় ধরে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে বর্তিকা চতুর্বেদীর নিজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার কথোপকথন। এই দৃশ্যগুলোতে বেশিরভাগ জায়গায়ই সবাই ইংরেজিতে কথা বলে। ব্যাপারটা বেশ দৃষ্টিকটু ছিল।

যেখানে গল্প ও বাস্তবতা মিশে গিয়েছে

আমরা সাধারণত কোনো ঘটনাকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করে থাকি। একটি ঘটনার সকল দিক আমাদের চোখে পড়ে না। যেটুকু আমাদের চোখে পড়ে তা নিয়েই আমরা একটা মোটামুটি যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলি। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি মেয়ের সাথে চলন্ত বাসে যে অমানবিক ঘটনা ঘটেছিল, সেটিও অনেকটা এরকম। সাধারণ জনগণ ঘটনার বীভৎসতা মেনে নিতে পারেনি। কাউকে না কাউকে দোষারোপ করতেই হবে। মানুষ ভাবতে শুরু করে পুলিশ হয়তো চাইলে এই ঘটনাটা থামাতে পারতো। সংবাদমাধ্যমগুলোও জনগণের মনে এই ধারণা পোষণে সাহায্য করে।

আসামিদের গ্রেফতার ও ফাঁসির জন্য সারা ভারতের রাস্তায় মানুষ আন্দোলনে নেমেছিল। শান্তিপূর্ণভাবে মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। এসব শান্তিপূর্ণ মিছিলকে হরতালে রূপ দেওয়ার জন্য দরকার শুধু কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী। আবার রাজনৈতিক স্বার্থের ব্যাপারটা তো আছেই। একটি মেয়ের জীবনের সাথে এখানে কয়টি জীবন সংকটের মুখে পড়ে তা এই সিরিজ দেখলে দর্শক জানতে পারবেন। তাছাড়া এসব অপরাধের পেছনে যে আধুনিক তরুণসমাজেরও বড় ভূমিকা রয়েছে, সে দিকটিরও আলোকপাত এখানে করা হয়েছে।

আন্দোলনের প্রয়োজন আছে। এটি বিচারকার্য তরান্বিত করে। কিন্তু এই আন্দোলনই অনেক সময় সঠিক বিচারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। গ্রেফতারকৃত আসামিদের নিরাপদে আদালতে নেওয়া, ফরেনসিক টিমের ঘটনাস্থল নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদিতে আন্দোলন বড় রকমের বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আরেকটি বিষয়ের জন্য এই টিভি সিরিজের প্রশংসা করতেই হবে। তা হলো ধর্ষণের কোনো দৃশ্য না দেখানো। বাসে আসলে কী ঘটেছিল তা জানানোর জন্য কোনো দৃশ্য দেখানোর প্রয়োজন পড়েনি। নির্মাতা ঘটনার ব্যাখার মধ্যেই এর মারাত্মক বীভৎসতাকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। পরিবারকে সাথে নিয়ে দেখতে বসতে পারেন আইএমডিবিতে ৮.৯ রেটিং পাওয়া এই টিভি সিরিজটি।

12
১৯৩৩ সালের ৮ ডিসেম্বর। তুরস্কে সহকর্মীদের সাথে শিকার করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত শটগানের একটি গুলি লাগে ২৭ বছর বয়সী এক আমেরিকান তরুণীর বাম পায়ে। তিনি তুরস্কের ইজমির শহরে আমেরিকান দূতাবাসের নিযুক্ত ক্লার্ক ছিলেন। সহকর্মীরা তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা আজকের মতো উন্নত ছিল না। ফলে তরুণীর বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ পুরোটাই কেটে ফেলে দিতে হয়। পায়ে কাঠের একটি নকল পা লাগানো হয়। তিনি এই নকল পায়ের নাম দেন ‘কাথবার্ট’। সাধারণ কোনো মানুষ হলে বাকি জীবন হয় পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতেন অথবা, নিরাপদ কোনো চাকরি নিয়ে কাটিয়ে দিতেন।

কিন্তু সেই তরুণী ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি সেই নকল পা দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর সময়টায় ফ্রান্সে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন মিত্রশক্তির পক্ষে। নাৎসিদের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ লিস্টে নাম হয় তাঁর। গেস্টাপো বাহিনী তাঁকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য দেয়ালে তাঁর ছবি ছাপায়। তাঁকে মিত্রশক্তির সবচেয়ে বিপদজনক স্পাই হিসেবে দেখে জার্মানরা। শত্রুপক্ষের কাছে তিনি ‘দ্য লিম্পিং লেডি’ নামে পরিচিতি পান। কিন্তু শত চেষ্টার পরও নাৎসি বাহিনী তাঁকে ধরতে পারেনি। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও থেমে থাকেননি। অবসর নেয়া সময় পর্যন্ত কাজ করেছেন সিআইএতে। তিনি ছিলেন বাল্টিমোরে জন্ম নেয়া ভার্জিনিয়া হল, যার ছিল একাধিক ছদ্মনাম। এক পা ছাড়াই কীভাবে নাৎসিদের যম হয়ে ওঠেছিলেন সেটা নিয়েই আজকের লেখা।

ভার্জিনিয়া হল ১৯০৬ সালের ৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় গ্রীষ্মের সময় কাটাতেন ভাইয়ের সাথে তাদের মেরিল্যান্ডের ১১০ একরের ফার্মে। ছুটিতে পরিবারের সাথে ইউরোপে ঘুরতে যেতেন। পড়াশোনা করেছেন বাল্টিমোরের রোল্যান্ড পার্ক কাউন্টি ডে স্কুলে। এরপর র‍্যাডক্লিফ ও বার্নার্ড কলেজে পড়েন। স্নাতক সম্পন্ন করেন ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে। ছোটবেলা থেকেই ফরাসি ভাষায় ভালো দক্ষতা অর্জন করেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিক্ষালাভ করতে গিয়ে ইতালিয়ান ও জার্মান ভাষাতেও দক্ষ হয়ে ওঠেন।

তিনি ছিলেন খুবই উচ্চাভিলাষী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হতে চেয়েছিলেন। এজন্য ১৯২৯ ও ১৯৩০ সালে দুবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরীক্ষা দেন। কিন্তু দুবারই তিনি অকৃতকার্য হন। তখন ১,৫০০ জন পররাষ্ট্র কর্মকর্তার মাঝে মাত্র ৬ জন ছিলেন নারী। তাই তিনি ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য পোল্যান্ডের ওয়ারশতে আমেরিকান দূতাবাসে ক্লার্কের কাজ করা শুরু করেন। সেখানে দুই বছর কাজ করার পর তুরস্কে বদলি হন। আর তুরস্কতেই পা হারান তিনি। এরপর পররাষ্ট্র কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায় তাঁর। কারণ ১৯৩৭ সালে আবারো পরীক্ষা দিতে চাইলে পা না থাকায় তাঁকে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু দমে যাননি তিনি। ক্লার্কের চাকরি ছেড়ে ফ্রান্সের প্যারিসে চলে যান। এ সময়ই তাঁর এমন সুযোগ আসে, যাতে তাঁর পা না থাকা কিংবা নারী হওয়া কোনোটাই বাধা ছিল না। ইউরোপ জুড়ে তখন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। ৩ সেপ্টেম্বর ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন থেকে ফ্রান্সের পরাজয়ের সময় পর্যন্ত ভার্জিনিয়া সেখানে অ্যাম্বুলেন্স চালকের কাজ করেন। এ সময় যুদ্ধের ময়দান থেকে আহত সৈনিকদের অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসতেন নিরাপদ জায়গায়। ফ্রান্সের পরাজয়ের পর তিনি ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান। এ সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ‘স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ’ বা এসওই গঠন করেন। ভার্জিনিয়ার সাথে এ সময় এসওই'র এক সদস্যের পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে ভার্জিনিয়া এসওই'র সাথে যোগাযোগ করেন।

কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় এসওই তাঁকে ফ্রান্সে পাঠায় গুপ্তচরবৃত্তির জন্য। পররাষ্ট্র বিভাগে যে কারণে তিনি সু্যোগ পাননি, সেটিই এখন তাঁর পক্ষে দারুণভাবে কাজ করল। তিনি ছিলেন নারী, একইসাথে একটি পা নেই। ব্রিটিশদের কাছে এটাই মোক্ষম অস্ত্র মনে হলো। কারণ, এতে তিনি নাৎসিদের সন্দেহের চোখ ফাঁকি দিতে পারবেন। সেখানে তাঁর কাজ ছিল জার্মানদের আক্রমণ সম্পর্কিত তথ্য জোগাড় করা। একইসাথে ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করা ও তাদের অস্ত্রের যোগান দেয়া।

এসময় তিনি গুপ্তচরের কৌশল, মোর্স কোড, হাতাহাতি লড়াই, মানচিত্র পড়া, ক্যানু চালানো, আক্রমণ পরিকল্পনা করা ইত্যাদি কাজ শেখেন। তাঁর ছদ্মনাম ছিল জারমেইন। তিনি ফ্রান্সে প্রবেশ করেন ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’ এর ফরাসি-আমেরিকান রিপোর্টার হিসেবে। এসওই সাধারণত তাদের এজেন্টদের ছয় মাসের বেশি সময় এক জায়গায় রাখতো না। কিন্তু ভার্জিনিয়া হল ১৫ মাস ফ্রান্সের লিওনে কাজ করেন। এ সময় ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীকে গোপনে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। মিত্রবাহিনীর বিমানচালকদের প্যারাস্যুট দিয়ে নামার নিরাপদ জায়গা জানিয়ে দিতেন। এছাড়া ফ্রান্সের অন্যান্য এলাকার এসওই সদস্যদের লিয়াজোঁ হিসেবেও কাজ করেন। শুধু তা-ই নয়, ফরাসি ও জার্মান কারাগার ও ক্যাম্প থেকে যুদ্ধবন্দীদের পালিয়ে যেতেও সাহায্য করেন।

ভার্জিনিয়া হল তাঁর প্রতিটি কাজই এত দক্ষভাবে  করেছিলেন যে, নাৎসিদের ক্ষতিগুলো তাদের চোখে পড়া শুরু করল। কিন্তু ভার্জিনিয়া ছদ্মবেশে এত নিখুঁত ছিলেন যে, কখনো ধরা পড়েননি। কিন্তু তারা ঠিকই খবর পেয়ে গেল, একজন খোঁড়া মহিলা গুপ্তচর এসবের মূল হোতা। সেসময় ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণে আসে গেস্টাপোর কুখ্যাত ক্লস বার্বি। তাকে ডাকা হতো ‘লিওনের কসাই’ নামে। সে ভার্জিনিয়ার ছবি পুরো ফ্রান্স জুড়ে ছাপায় এবং তাঁকে ধরিয়ে দেয়ার কথা জানায়। ভার্জিনিয়া তখন ফ্রান্স ছেড়ে স্পেনে পালান।

স্পেনে তাঁর পালানোর পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। তখন ছিল শীতের সময়। একদিকে তুষারপাত, অন্যদিকে তাঁর কাঠের পা। এত প্রতিকূলতা নিয়ে তাঁকে পাইরিনিজ পর্বত পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু স্পেনে গিয়েও তিনি নিরাপদ থাকতে পারেননি। তাঁকে অবৈধ অভিবাসনের অপরাধে স্পেনের একটি রেল স্টেশন থেকে আটক করা হয় এবং মিরান্ডা ডেল এব্রো কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তিনি বিশ দিন আটক ছিলেন। তারপর আমেরিকান দূতাবাসের মাধ্যমে ছাড়া পান। এরপর তিনি লন্ডনে চলে যান। তিনি আবারো ফ্রান্সে যেতে চাচ্ছিলেন কাজ করার জন্য। কিন্তু তখন তিনি গেস্টাপোর মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে থাকায় এসওই তাঁকে আর সেখানে পাঠানোর ঝুঁকি নিতে চায়নি। বরং তাঁকে স্পেনে পাঠানো হয় শিকাগো টাইমস পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে। কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন ফ্রান্সের মতো বড় কোনো কাজে যুক্ত হতে।

অবশেষে তাঁর হাতে সুযোগ আসে। ১৯৪৪ সালের ১০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ‘অফিস অভ স্ট্রাটেজিক সার্ভিস’ বা ওএসএস-এ যোগ দেন। এটি ছিল যুদ্ধকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থা, যা থেকে পরে সিআইএর জন্ম হয়। ওএসএসের মাধ্যমে ভার্জিনিয়া পুনরায় ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। তবে এবার এক খোঁড়া বৃদ্ধার ছদ্মবেশে যান। হাঁটার ভঙ্গি করেন বৃদ্ধাদের মতো, দাঁতগুলোও ফরাসিদের মতো করে পরিবর্তিত করেন। তিনি মধ্য ফ্রান্সের ক্রোজান্ট নামের একটি ছোট গ্রামের একটি ফার্মে যান। সেখানে তিনি গরু পরিচর্যা করতেন, পনির বানাতেন এবং ফার্মের মালিককে কাজে সাহায্য করতেন।

তাঁর মূল কাজ ছিল রেডিও অপারেটর হিসেবে তথ্য পাচার করা এবং জার্মানদের আক্রমণ করার জন্য একটি বাহিনী গড়ে তোলা। তিনি জার্মান সেনাদের চলাচল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেন। সকল তথ্য তিনি রেডিওর মাধ্যমে লন্ডনে প্রেরণ করতেন। ছদ্মবেশে থাকলেও তাঁকে বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের মধ্যে থাকতেন। এ সময় ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীকে মিত্রপক্ষের কাছ থেকে প্যারাস্যুটের মাধ্যমে পাওয়া অস্ত্রের যোগান দেন। তিনি ফরাসি বাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়নকে প্রশিক্ষণ দেন এবং একই সাথে জার্মানদের মধ্যে ভুল তথ্য পাচার করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেন।

তিনি তখন তাঁর বাহিনী নিয়ে চারটি সেতু ধ্বংস করেন, মালবাহী রেলগাড়িকে লাইনচ্যুত করেন, বিভিন্ন স্থানের রেললাইন মারাত্মকভাবে ধ্বংস করেন এবং টেলিফোন লাইনও বিচ্ছিন্ন করে দেন। তাঁর বাহিনী ১৫০ জন জার্মানকে হত্যা করে এবং ৫০০ জনেরও বেশি জার্মানকে আটক করে।

যুদ্ধ শেষ হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুমেন ওএসএস ভেঙে দেন। তখন তিনি নতুন গঠিত সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএতে যোগ দেন। দুই বছর ইউরোপে কাটিয়ে ১৯৫০ সালে বিয়ে করেন ওএসএস ও সিআইএর আরেক এজেন্ট পল গয়লটকে। এরপর তিনি সিআইএর বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৬ সালে বাধ্যতামূলক অবসরের পূর্ব পর্যন্ত সিআইএতেই কাজ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি মারা যান।

তিনি সবসময়ই ছিলেন প্রচারবিমুখী মানুষ। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুমেন তাঁকে সাহসিকতার জন্য জনসম্মুখে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক ডিএসসি প্রদান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভার্জিনিয়া হল ওএসএসের প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল উইলিয়াম জে ডনোভানকে অনুরোধ করেন, পদকটি যেন তাঁর কার্যালয়ে শুধুমাত্র ভার্জিনিয়ার মায়ের উপস্থিতিতে দেয়া হয়। কারণ তিনি চাইতেন, তাঁর পরিচয় জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়ে তাঁর কাজে যেন বিঘ্ন না ঘটায়। এমনকি পরিবারের সাথেও তাঁর কাজ নিয়ে খুব একটা কথা বলতেন না।

তিনি মারা যাওয়ার পরও খুব কমই আলোচনা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। তবে সম্প্রতি কিছুটা হলেও আলোচনায় আসছেন তিনি। ২০০৫ সালে লেখক জুডিথ এল পিয়ারসন ভার্জিনিয়া হলের জীবনী নিয়ে লেখেন ‘ওলভস এট দ্য ডোর’ বইটি। এ বছর তাঁকে নিয়ে আরেকটি বই আসছে। লেখক সোনিয়া পারনেলের লেখা বইটির নাম ‘এ ওমেন অভ নো ইম্পরট্যান্স’। প্যারামাউন্ট পিকচার্স ২০১৭ সালে এই বইটির সত্ব কিনে নেয়। বইটি থেকে বানানো মুভিতে ভার্জিনিয়া হলের চরিত্রে অভিনয় করবেন স্টার ওয়ার্স খ্যাত অভিনেত্রী ডেইজি রিডলি।

13
কাঁধে ব্যাগ, মুঠোফোনে ম্যাপ, তারপর টিকিট কেটে অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া- জগতটাকে এভাবে ঘুরে দেখার ইচ্ছা কার না আছে? ভ্রমণের গন্তব্যস্থল কল্পনা করতে বললে আপনার চোখের সামনে হয়তো ভেসে উঠবে নায়াগ্রা জলপ্রপাত, আইফেল টাওয়ার কিংবা মিশরের পিরামিড। দেশের ভেতরে হয়তো যাইতে চাইবেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কিংবা সাজেক ভ্যালি। শান্ত পাহাড়ের নিস্তব্ধতা থেকে সুবিশাল সমুদ্র, প্রাচীন নগরী থেকে প্রবাসের অলিগলি- পর্যটনের ক্ষেত্র সুবিস্তৃত। আনন্দ, জানার আগ্রহ ও ঘোরার শখ- এসব কিছু মিলিয়ে পর্যটন।

কিন্তু সেই পর্যটনের স্থান যদি হয় এমন কোনো স্থান, যার ইতিহাস কেবল দুঃখ এবং দুর্দশায় ভরা, তাহলে?

অথচ ট্যুরিজম বা পর্যটনের নানা প্রকারের মধ্যে রয়েছে এমনই একধরনের পর্যটনশিল্প, যা কি না ইতিহাসের শোক এবং কষ্টের অধ্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। নাম তার- ডার্ক ট্যুরিজম।

না, এটি কালো জাদু বা সে জাতীয় কোনো কিছুই নয়। এটি তার চেয়ে আরো বৃহৎ পরিসরের এবং আলাদা একটি বিষয়৷ 

১৯৯৬ সালে ডার্ক ট্যুরিজম (Dark tourism) এর ধারণা প্রবর্তন করেন গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটির দুই ফ্যাকাল্টি সদস্য জন লেনন এবং ম্যালকম ফোলি। তাদের সংজ্ঞানুসারে, দুর্যোগ এবং ট্র‍্যাজেডির সাথে সম্পর্কিত স্থানে ভ্রমণ করাকে ডার্ক ট্যুরিজম বলে। কোনো স্থান অতীতের ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে থাকলে তার প্রতি মানুষের কৌতূহল এবং তা দর্শন করা ডার্ক ট্যুরিজমের অন্তর্গত। 

এই ভয়াবহতা হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা মানবসৃষ্ট কোনো ঘটনা। গোটা বিশ্ব জুড়ে রয়েছে ডার্ক ট্যুরিজমের অজস্র স্থান।

এ স্থান হতে পারে সুনামি, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্পের আঘাতে বিধ্বস্ত কোনো এলাকা। যেমন- ২০১১ সালের সুনামিতে বিধ্বস্ত জাপান বা সাম্প্রতিক সময়ে জলোচ্ছ্বাস কবলিত ইন্দোনেশিয়ায়। অনেক ডার্ক ট্যুরিস্ট ত্রাণকার্যে সাহায্য করে থাকেন এ সময়ে।

ডার্ক ট্যুরিজম হতে পারে অতীতের বড় কোনো দুর্ঘটনাস্থলে, যেমন- চেরনোবিলের পারমানবিক বিপর্যয়ের নিদর্শন বা আবেরফানের বিপর্যয়।

কিন্তু ডার্ক ট্যুরিজম সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে মানুষের নিষ্ঠুরতার চিহ্ন যেখানে পাওয়া যায় সেখানে। যেখানে মানুষের উপর আরেক শ্রেণীর মানুষের চূড়ান্ত অমানবিকতার ইতিহাসের স্বাক্ষী পাওয়া যায়, সেখানেই ডার্ক ট্যুরিজমের প্রবল সম্ভাবনা।

নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের সাক্ষী পোল্যান্ডের অসউইৎজ ক্যাম্প, জাপানের আওকিগাহারা সুইসাইড ফরেস্ট, রুয়ান্ডার গণহত্যার মেমোরিয়াল, পারমাণবিক বোমায় হারিয়ে যাওয়া হিরোশিমা এবং নাগাসাকির ধ্বংসাবশেষ, ৯/১১ হামলার স্বাক্ষী গ্রাউন্ড জিরো- সবক'টি স্থানের একটি ক্ষেত্রে মিল আছে, প্রতিটি স্থান মানুষের বেদনার স্বাক্ষী।

ডার্ক ট্যুরিজম হতে পারে কোনো সিরিয়াল কিলার বা সন্ত্রাসীর একসময়ের আবাসস্থলে। মজার ব্যাপার হলো, ডার্ক ট্যুরিজমকে আকৃষ্ট করে নানা দেশে নানা ধরনের মিউজিয়াম বা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে। লস অ্যাঞ্জেলসের ‘মিউজিয়াম অফ ডেথ’ ডার্ক ট্যুরিস্টদের আকৃষ্ট করার জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের নানা অপরাধীর কুকীর্তির কথা জানতে বহু দর্শনার্থী ঘুরে আসেন এই জাদুঘর। ডার্ক ট্যুরিজমের প্রসারের স্বার্থে বহু সংঘ এবং অনলাইন ওয়েবসাইট রয়েছে।     

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডার্ক ট্যুরিজমের স্বার্থে নয়, বরং ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য যেসব জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোও ডার্ক ট্যুরিজমের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, সাধারণ ভ্রমণের সময় হয়তো কেউ কেউ ডার্ক ট্যুরিস্ট স্পটে ঢুঁ মেরে আসেন। যেমন- কেউ হয়তো জাপান বেড়াতে গিয়েছেন, সময় পাওয়াতে তিনি হিরোশিমা বা নাগাসাকি ঘুরে আসলেন!

ডার্ক ট্যুরিজমের স্পটের সময়সীমা নিয়ে বিতর্ক আছে। লেনন এবং ফোলির মতে, ডার্ক ট্যুরিস্ট সাইট কেবল সাম্প্রতিক ঘটনার মাঝে সীমাবদ্ধ। আর এ সময়সীমা তারা নির্ধারণ করেছেন ১৯০০ সাল থেকে। অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর আগের কোনো ঘটনা ডার্ক ট্যুরিজমের আওতায় পড়বে না। তবে অনেক তাত্ত্বিক এর বিরোধিতা করেছেন, কেননা এর আগে বহু ট্র‍্যাজেডি ঘটেছে, যার ফল আজও মানুষের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এর উদাহরণ হিসেবে তারা পম্পেই ট্র‍্যাজেডির কথা উল্লেখ করেছেন। ৭৯ সালে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে যায় ইতালির এ নগরী, মৃত্যু হয় হাজারো মানুষের।

লেনন-ফোলির সংজ্ঞানুসারে, পম্পেই ডার্ক ট্যুরিজমের আওতায় না পড়লেও ভয়াবহতার দিক দিয়ে এটি কোনো অংশে কম নয়। আবার ভিসুভিয়াসও এখনো মরে যায়নি, ঘুমন্ত এই আগ্নেয়গিরি যেকোনো সময়ে আবারও জেগে উঠতে পারে। তাই ডার্ক ট্যুরিজমে পম্পেইকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতেই পারে।

ডার্ক ট্যুরিজমকে কি খুব অদ্ভুত এবং অপরিচিত কোনো বিষয় মনে হচ্ছে? মজার ব্যাপার হলো, আমাদের বাংলাদেশেই ডার্ক ট্যুরিজমের বেশ কিছু স্পট রয়েছে।

সেগুনবাগিচায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে নির্মিত ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ কিন্তু একটি ডার্ক ট্যুরিজমের স্পট।

এছাড়া আছে রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মিরপুর বধ্যভূমি, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থান ইত্যাদি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সমাধি, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যে বাড়িতে তাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়- এই সবক'টি স্থানই ডার্ক ট্যুরিজমের অন্তর্গত।     

২০১৩ সালের মর্মান্তিক রানা প্লাজার ধ্বসের স্থানও ডার্ক ট্যুরিজমের স্থান।   

জেনে হোক না জেনে হোক, আমরা কম-বেশি সকলেই ডার্ক ট্যুরিজমে অংশ নিয়েছি।

তবে, নৈতিকতার প্রশ্নে নানা সময়েই ডার্ক ট্যুরিজম নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।

কারো কারো মতে, মানুষের কষ্টকে পুঁজি করে পর্যটন শিল্প প্রচার করাটা নৈতিকভাবে অনুচিত। তারা মনে করেন, ডার্ক ট্যুরিজম অনেকটা নিষিদ্ধ বস্তুর উপর আকর্ষণের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত।

আবার আরেক মহলের মতে, ডার্ক ট্যুরিজম কোনো দোষের কিছু নয়, বরং জানার স্বার্থে ডার্ক ট্যুরিজম অত্যন্ত জরুরি। এ দলের গবেষকদের মতে, মানুষ যদি তার ইতিহাস না জানে, তবে সে কোনোদিনই তার অতীতের ভুল শোধরাতে পারবে না। ডার্ক ট্যুরিজম, তাদের দৃষ্টিতে যে কেবল মৃত্যুর প্রতি কৌতূহল বা ফ্যাসিনেশন দ্বারা প্রভাবিত, তা নয়। বরং ট্র্যাজেডির স্থান বা ঘটনার পেছনের ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকেই ডার্ক ট্যুরিজম।

অনেকে হয়তো তারপরও মনে করতে পারেন, অপরের দুঃখ-দুর্দশার ইতিহাসকে নিজের শখের বিষয়ে পরিণত করাটা কতখানি যুক্তিযুক্ত?

যতই সময় অতিবাহিত হোক না কেন, বেদনার ইতিহাস তো বেদনার ইতিহাসই, তা-ই নয় কি?

কিন্তু মানুষ হিসেবে যে বৈশিষ্ট্য আমাদের অন্য সকল জীব থেকে আলাদা করে রেখেছে তা হলো আমাদের জানার আগ্রহ, কৌতূহল। আর শুধুমাত্র বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তো চলবে না, ভবিষ্যতের সঠিক পথ বোঝার জন্য আমাদের পেছন ফিরে তাকাতেই হবে। অতীতকে ভুলে কখনো ভবিষ্যতকে গড়া যাবে না। জাতি হিসেবেও আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের ইতিহাস না জানলে আমরা কখনো স্বাধীনতার মর্ম বুঝতে পারবো না। আর এ কেবল জানার জন্য জানা নয়, ভেতর থেকে অনুভব করার বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাজার হাজার মানুষ অসউইৎজ ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন- আজ ক্যাম্পের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে সাম্প্রদায়িকতা কত ভয়ংকর, কত বিষাক্ত।

আবার মুরাম্বি মেমোরিয়ালে দাঁড়িয়ে,  ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডায় তুতসিদের গণহত্যার জবানবন্দি দেখে মানুষ দেখবে ঘৃণা কী জঘন্য একটা বিষয় এবং কীভাবে কেবল তুতসি পরিচয়ের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলো তাদেরই হুতু প্রতিবেশী!

অতীতের ভুল, গ্লানি বা বেদনা থেকে শিক্ষা নেবার জন্য তাই অবশ্যই উচিত এ সকল স্থানে যাওয়া, জানা। তবে এসব স্থানে যাওয়া বলতে কেবলমাত্র নিজের চেকলিস্টে টিক দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পর্যটকের সংবেদনশীলতাটাও জরুরি।

ডার্ক ট্যুরিজমের স্পট অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটের চেয়ে আলাদা। এসব স্থান অতীতের বেদনাকে ধারণ করছে, তাই অবশ্যই পর্যটককে সেরকম মার্জিত আচরণ করতে হবে। যদি সারি সারি কবরের সামনে কেউ সেলফি স্টিক নিয়ে নিজের সবচেয়ে ভালো প্রোফাইল পিকচার তুলতে বসে- তাহলে তা অত্যন্ত অশোভন হবে।

সে কারণে এসব জায়গায় ভ্রমণের সময় নিজের আচরণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, আপনার আচরণ যেন কোনোভাবে স্থানীয় মানুষ বা যাদের ইতিহাস তাদেরকে আঘাত না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বিশ্বের নানা স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ বা সামর্থ্য অনেকেরই থাকে না, তাই যাদের তা আছে, তাদের উচিত ভ্রমণের সময় সহানুভূতিশীল হওয়া।

ডার্ক ট্যুরিজম বা যেকোনো ধরনের ভ্রমণের সময় ভ্রমণের স্থান, সেখানকার মানুষ এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানার সাথে সাথে পর্যটকের সাথে সেই স্থানের জনপদের মধ্যে একধরনের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পর্যটক সেই জনপদের স্থানে নিজেকে রেখে চিন্তা করার সুযোগ পায়, এভাবে অপরকে বোঝার মানসিকতা থেকে মানুষ বিদ্বেষমূলক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসে। মানুষ উদার হয়, সহমর্মী হয়।

দিনশেষে এসব স্থানে ভ্রমণের পেছনে আপনার উদ্দেশ্য কী সেটাই মুখ্য বিষয়। সেটা কি মৃত্যু ও বিষাদের প্রতি কৌতূহল? ইতিহাস জানার আগ্রহ? নাকি বন্ধুবান্ধবের মাঝে 'ব্যতিক্রম' হবার ইচ্ছা?

আপনি কি একজন ডার্ক ট্যুরিস্ট?

আপনার উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, ভ্রমণের সময় আপনার আচরণ যথাযথ সম্মান এবং সংবেদনশীলতার পরিচয় দিলে এ নিয়ে আর কোনো বিতর্ক হবার কারণ থাকবে না।

শুধুমাত্র ক্যামেরা দিয়ে নয়, বিষাদের ইতিহাসের স্বাক্ষী এসব স্থানকে নিজের অন্তর দিয়ে দেখুন। বাড়ি ফিরে আসার সময় শান্তি, সহানুভূতি এবং অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা নিয়ে আসুন, মনে ধারণ করুন। তাহলেই একটু একটু করে পৃথিবীটা আরো সুন্দর, আরো  সহনশীল হয়ে উঠবে।

তাই শুরুটা হোক নিজেকে দিয়ে।                       

সাম্প্রতিককালে নেটফ্লিক্স ডার্ক ট্যুরিজম সম্পর্কে 'ডার্ক ট্যুরিস্ট' নামের একটি ধারাবাহিক ডকুমেন্টারি সিরিজ নির্মাণ করেছে। সাংবাদিক ডেভিড ফ্যারিয়ারের উপস্থাপনায় প্রচারিত ধারাবাহিকটির ট্রেইলার নিচে দেখে নিতে পারেন।

14
মহাকাশ নিয়ে কম বেশি সবার মধ্যেই বিস্ময় আর জানার আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। আমরা ছোটবেলা থেকে বইপত্রে মহাকাশ সংক্রান্ত অসাধারণ তথ্যাবলী পড়েছি। আমাদের জ্ঞানের পরিসীমা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। মহাকাশযান পাঠিয়ে বিজ্ঞানীরাও নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে লাগলেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত আধুনিক হচ্ছে, মহাকাশ নিয়ে কৌতূহল কিংবা গবেষণার পরিমাণও ততো বাড়ছে। বাড়ছে মহাকাশযাত্রার সংখ্যা, পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে নভোযান উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অদৃশ্য প্রতিযোগিতা।

২০১৯ এর পুরো বছর জুড়ে থাকছে অসাধারণ সব ঘটনাপ্রবাহ যা মহাকাশপ্রেমীদের জন্য বেশ উত্তেজনাকর ব্যাপার বটেই। গত বছর, ২০১৮ সালও ছিল তেমনই উত্তেজনা আর আবিষ্কারের বছর। স্পেসএক্স গত বছর তাদের প্রথম ফ্যালকন হেভি রকেট মহাশূন্যে পাঠায়। পাশাপাশি একটি লাল টেসলা গাড়ি মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের দিকে পাঠানো হয়।

একটি গাড়ি মহাশূন্যে ভাসছে, ভাবতেই কেমন লাগে, তাই না? এদিকে নাসাও বসে থাকেনি। পৃথিবীর মতো বসবাসোপযোগী গ্রহ খুঁজে বের করতে নানা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তারাও। সূর্যকে ছুঁতে একটি প্রোব পাঠিয়েছে নাসা। তাদের ইনসাইট রোবট মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেছে এবং সেটি মঙ্গলের অসাধারণ সব ছবি পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। ২০১৯ এর পুরোটা সময় জুড়ে ব্যস্ত থাকবেন মহাকাশ নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সেই সাথে পৃথিবীর আকাশে দেখা যাবে একেকটি বিস্ময়কর মহাজাগতিক ঘটনা। কী কী ঘটবে ২০১৯ সালে?

আলটিমা থিউলি

এই বছরের প্রথম দিনে নাসার নিউ হরাইজন নামক মহাকাশযান একটি বিশাল মাইলফলকের জন্ম দিয়েছে। এটি আলটিমা থিউলি নামক একটি পাথর খন্ডের কাছে গিয়েছে যা পৃথিবী থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন মাইল দূরে এবং যাকে পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ধরা হচ্ছে। মহাকাশযানটি ২০১৫ সালে প্লুটোর কাছে গিয়ে থেমে থাকেনি বরং আরো দূরে যেতে থাকে। জানুয়ারির ১ তারিখে আলটিমা থিউলির কাছে পৌঁছায়। পাথর খন্ডটি প্রায় একটি শহরের সমান বড়।
কোয়াড্রানটিডস

জানুয়ারির নিকষ কালো আকাশে একধরনের উল্কা বৃষ্টির দেখা পাওয়া গিয়েছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে কোয়াড্রানটিডস। এই বছরের জানুয়ারির ৩-৪ তারিখ রাতের আকাশে এই উল্কা বৃষ্টি উপভোগ করছে হাজার হাজার মানুষ। ঘণ্টায় ৫০-১০০টি উল্কা দেখা গিয়েছে এ সময়।

আংশিক সূর্যগ্রহণ

৬ জানুয়ারিতে পৃথিবীর আকাশে আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছে। চাঁদ আংশিকভাবে সূর্যকে ঢেকে দেয়ায় এমনটা দেখা যায়। চীন, কোরিয়া, জাপান, রাশিয়া, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষজন এই আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখতে পেয়েছেন।

ক্রু ড্রাগন মহাকাশযান

এলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স জানুয়ারির ১৭ তারিখ একটি পরীক্ষামূলক নিক্ষেপের পরিকল্পনা করছে। প্রথমবারের মতো পৃথিবীর কক্ষপথে ফ্লোরিডার কেপ কেনেভ্রাল থেকে ক্রু ড্রাগন মহাকাশযান পাঠাবে স্পেসএক্স। তাদের লক্ষ্য নাসার মহাকাশ শাটল ফ্লিটের নির্দিষ্ট স্থান গ্রহণে সাহায্য করা ও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশচারীদের যাতায়াতে সহায়তা করা।
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ

আগামী জানুয়ারির ২০ তারিখে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আকাশে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে। পূর্ণিমার সময় পৃথিবী সূর্যকে ঢেকে ফেললে এই মহাকাশীয় ঘটনার দেখা মিলবে।
চন্দ্রযান-২

ভারতের আইএসআরও নামক মহাকাশ সংস্থা ২০০৮ সালে তাদের প্রথম মহাকাশযান চাঁদে পাঠায় যার নাম চন্দ্রযান-১। তারই ধারাবাহিকতায় এই বছরের জানুয়ারির ৩০ তারিখে তারা আবারও চন্দ্র অভিযানে পাঠাচ্ছে চন্দ্রযান-২। চাঁদের পৃষ্ঠ অন্বেষণ এই অভিযানের লক্ষ্য। তাই তারা একটি অক্ষীয় যান, একটি অবতরণকারী যান এবং ছয় চাকা বিশিষ্ট রোভার পাঠিয়েছে।

নাসার জুনো মহাকাশযান

২০১৬ সালে নাসার একটি মহাকাশযান বৃহস্পতি গ্রহে পৌঁছায়। গ্রহটির অসাধারণ কিছু ছবি পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই পাঠিয়েছে সেটি। নাসা এই অভিযানে বেশ কিছু বিস্ময়কর তথ্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। যার মধ্যে একটি হলো বৃহস্পতির সেই অদ্ভুত লাল অংশটি (Great Red Spot) কেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আরো তথ্য পাবার জন্য নাসা জুনোর ভ্রমণকাল আরো কয়েক বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। পুরো গ্রহের কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে মহাকাশযানটির সময় লাগে ৫৩.৫ দিন যাকে পেরিজোভে বলা হয়। ১৮তম পেরিজোভেটি হবে ১২ ফেব্রুয়ারিতে। এমন পেরিজোভ এইবছর আরো ৬ বার হবে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। 
ইসরায়েলের স্প্যারো চন্দ্রযান

ইসরায়েলের একটি অলাভজনক বেসরকারি মহাকাশযান ১৩ ফেব্রুয়ারি চাঁদের উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটে চড়ে রওনা হবে। রওনা দেওয়ার দুই মাস পর এটি চাঁদে অবতরণ করবে বলা ধারণা করা হচ্ছে। স্পেসআইএল নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এটি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং যানটি চাঁদে অবতরণ করার পর প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্পেসআইএল এর নাম ইতিহাসে স্থান পাবে। চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদে অবতরণের খেতাব পাবে ইসরায়েল। ইসরায়েলের একজন ব্যবসায়ী এই প্রতিষ্ঠানের পেছনে অর্থ ব্যয় করছেন বলে জানা যায়।

সিএসটি-১০০ স্টারলাইনার

স্পেসএক্স যেমন তাদের ক্রু ড্রাগন মহাকাশযানের মাধ্যমে নাসার মহাকাশ শাটলের স্থান নিতে চাইছে সেভাবেই বোয়িং একটি স্টারলাইনার মহাকাশযান নিক্ষেপের পরিকল্পনা করছে; যা মহাকাশচারী পরিবহনের কাজ করবে। বছরের মার্চের দিকে এই যানটি পাঠানো হবে কিন্তু এটিও হবে পরীক্ষামূলক। এটিতে আপাতত কোনো মানুষ চড়বে না।
ফ্যালকন হেভি রকেট

এই বছরের শুরুর দিকে স্পেসএক্স দুটি ফ্যালকন হেভি রকেট মহাকাশে প্রেরণ করছে। প্রথমটি হচ্ছে মহাকাশ পরীক্ষা প্রোগ্রাম-২। এটির লক্ষ্য হলো কিছু সামরিক স্যাটেলাইট ও নাসার গভীর মহাকাশীয় পারমাণবিক ঘড়ি (Atomic clock) কক্ষপথে প্রেরণ করা। এই পারমাণবিক ঘড়িটি যোগাযোগ ও দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আরবস্যাট- ৬ এ হচ্ছে একটি স্যাটেলাইট যা ফ্যালকন হেভি রকেটের দ্বিতীয় সংস্করণ।

পার্কার সোলার প্রোব (পিএসপি)

মানুষের তৈরি সবচেয়ে দ্রুতগামী বস্তু হচ্ছে নাসার পার্কার সোলার প্রোব। সূর্যের কাছে গিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করাই এর কাজ। এটি এতটাই দ্রুতগতি সম্পন্ন যে গত বছরের নভেম্বরের ৫ তারিখ এটি প্রতি সেকেন্ডে ১২০ মাইল গতিতে সূর্যের কাছ দিয়ে উড়ে গেছে। এই গতিতে নিউ ইয়র্ক থেকে টোকিওতে এক মিনিটেরও কম সময়ে যাওয়া সম্ভব। এ বছর এপ্রিলের ৪ তারিখ ও সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ মোট দুইবার সূর্যের কাছে দিয়ে উড়ে যাবে এই যানটি।
ক্রু ড্রাগন মহাকাশযান

জানুয়ারিতে হওয়া পরীক্ষামূলক যাত্রাটি যদি সফল হয় তাহলে স্পেসএক্স তাদের ক্রু ড্রাগন মহাকাশযানটি নাসার দুজন মহাকাশচারী সহ ১৭ জুন মহাশূন্যে প্রেরণ করবে। এটি হবে তাদের যাত্রীসহ প্রথম ভ্রমণ। সেই দুজন ভাগ্যবান ব্যক্তি হচ্ছেন ডাগ হারলি ও বব বেনকেন।
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ

এই বছরের মাঝামাঝি, জুলাইয়ের ২ তারিখে একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ যাবে। এটি দেখতে হলে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছাকাছি থাকতে হবে এবং সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হচ্ছে চিলি, আর্জেন্টিনা ও প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু জায়গা।
নিউ জেনারেশন মহাকাশযান

পৃথিবীর এত এত সংস্থা মহাকাশ নিয়ে কত পরিকল্পনা করছে, রকেট পাঠাচ্ছে, মহাকাশযান পাঠাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে অনেকদূর। এসবের মধ্যে চীনের মতো দেশ তো আর বসে থাকতে পারে না। তাই এই বছরের মাঝামাঝিতে একটি মহাকাশযানের পরীক্ষামূলক যাত্রা করবে। যার নাম দিয়েছে নিউ জেনারেশন ম্যানড মহাকাশযান। প্রথমেই তারা কোনো মানুষ পাঠাচ্ছে না। কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য হলো ৪-৫ জন চীনা নভোচারীকে কক্ষপথে পাঠানো।
আংশিক চন্দ্রগ্রহণ

আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়া থেকে জুলাইয়ের ১৬ তারিখে আংশিক চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে।
পারসিডস

বছরের অন্যতম আকর্ষণীয় উল্কা বৃষ্টি পারসিডস নামে পরিচিত যা এই বছরের ১২-১৩ আগস্ট পৃথিবীর আকাশে দেখা যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঐ সময় পূর্ণিমা থাকবে তাই হয়তো ভালোভাবে উপভোগ করা যাবে না।
চাংই'-৫

গবেষণার জন্য চাঁদের মাটির স্যাম্পল নেয়ার জন্য চীন একটি চন্দ্রাভিযানে চাংই'-৫ কে পাঠাবে ২০১৯ এর শেষের দিকে। এতে তারা যদি সফল হয় তাহলে এটি হবে চীনের প্রথম চন্দ্র মাটি সংগ্রহণ।

জেমিনিডস

বছরের শ্রেষ্ঠ উল্কা বৃষ্টি হচ্ছে জেমিনিডস। এটি এতটাই আকর্ষণীয় যে রাতের আকাশে মিনিটে একাধিক উল্কার দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু আবারো দুর্ভাগ্যবশত এই সময়টাতে পূর্ণিমা থাকবে। তবুও চাঁদের আলোর কারণে উজ্জ্বল উল্কার ঝলকানি দেখতে ব্যঘাত হবে না খুব বেশি। এ বছর ১৩-১৪ ডিসেম্বরে জেমিনিডস উল্কা বৃষ্টি দেখা যাবে।

বলয়াকার সূর্যগ্রহণ

চাঁদ সবসময় পৃথিবীর চারিদিকে সমানভাবে প্রদক্ষিণ করে না। ফলে মাঝে মাঝে চাঁদকে অনেক ছোট ও দূরে দেখায়। এরকম অবস্থায় যদি চাঁদ সূর্যকে ঢেকে ফেলে তাহলে সূর্যের বৃত্তাকার পরিসীমা বাদে শুধুমাত্র মাঝের অংশ ঢাকা পড়ে। যার ফলে অদ্ভুত সুন্দর বলয়াকার সূর্যগ্রহণের সৃষ্টি হয়। ২০১৯ এর ২৬ ডিসেম্বর এই ঘটনাটি ঘটবে বলে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন। ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকার কিছু জায়গা এবং পাশাপাশি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু কিছু জায়গা থেকে এই সূর্যগ্রহণটি দেখা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

15
আটশোরও বেশি দিন ধরে সামরিকভাবে অবরুদ্ধ এক শহর। খাদ্য নেই, তীব্র শীতে চারদিকে মারা পড়ছে মানুষ। জনবহুল সেই শহরের ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণের প্রদীপ ইতোমধ্যেই নিভে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের লেলিনগ্রাদ শহরকে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঠিক এভাবেই অচল করে দিয়েছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনী। ১৯৪১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর লেলিনগ্রাদকে সরাসরি আক্রমণ না করে চারদিক থেকে যতটা পারা যায় অবরোধের সিদ্ধান্ত নেয় হিটলার বাহিনী। তবে শহরের বাইরে চলতে থাকে খণ্ডযুদ্ধ।

১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ শহরের তেল আর কয়লা সরবরাহে টান পড়ে যায়। শীত যত সামনে এগুতে থাকে, বাসিন্দারা ততই সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে। শহরের কেন্দ্রীয় তাপ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। পানির পাইপে বরফ জমে সারা শহরে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থবির হয়ে যায় কয়েকদিনের মধ্যেই।

সামর্থ্যের শেষটুকু পর্যন্ত লড়ে গেছে লেলিনগ্রাদের মানুষ। কিন্তু ক্রমেই চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে অনাহার আর তীব্র শীতের সাথে যুদ্ধ করে নাৎসিদের কাছে পর্যদুস্ত হয়ে পড়ছিল তারা। গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সব ধরনের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় দিনের পর দিন ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল। প্রত্যকের রাষ্ট্রীয় খাবার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ দাঁড়ায় এক তৃতীয়াংশে।

১৯৪১ এর ভয়াবহ সেই শীতের দিনে খাবার হিসেবে শহর কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের সরবরাহ করতো ১২৫ গ্রামের একটি পাউরুটি। এই পাউরুটি বানানো হতো গাছের ছাল, বাকল, পাতা আর সামান্য ময়দা দিয়ে। ব্যাপারটি হয়তো আজকের দিনে চিন্তাও করা যাবে না, এই বিচ্ছিরি স্বাদের রুটির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো শহরের বাসিন্দারা।

অনাহারে আর অর্ধাহারে ১৯৪১ সালের নভেম্বর নাগাদ প্রায় এগারো হাজার মানুষের মৃত্যু রেকর্ড করে সোভিয়েত প্রশাসন। ডিসেম্বর নাগাদ সেই সংখ্যা দাঁড়ায় অর্ধলক্ষে। শিশু আর বৃদ্ধদের বেশিরভাগই মারা যাচ্ছিল খাবারের অভাবে। তীব্র ঠাণ্ডা, চারদিকে বরফের রাজ্য, রাস্তা, পার্ক কিংবা খোলা মাঠে ছড়িয়ে আছে মানুষের লাশ।

তীব্র শীতের সেই দিনগুলোতে মৃত লাশের মাংস খেয়েও বেঁচে ছিলেন কেউ কেউ।[1] সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশ NKVD ২১০৫ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষের মাংস খাওয়ার অপরাধে আটক করে।[1] কিন্তু আটক করে কী হবে? জেলখানাগুলোতে আর জায়গা নেই। কর্তৃপক্ষও খাবার দিতে পারছে না কয়েদিদের। জার্মান বাহিনীর গোলাবারুদের আক্রমণও বাড়ছে প্রতিদিন।

লেলিনগ্রাদের পতন ঠেকাতে অবরোধ ভেঙ্গে অস্ত্র গোলাবারুদ পাঠানো তখন একান্তই জরুরী হয়ে পড়ে। এর জন্য নাৎসি অবরোধ ডিঙ্গিয়ে নির্মাণ করতে হবে বিকল্প কোনো রাস্তা। কিন্তু তা শুধুমাত্র সম্ভব লেলিনগ্রাদকে ঘিরে থাকা লাদোগা হ্রদের উপর রাস্তা কিংবা রেলপথ নির্মাণ করতে পারলে। ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ এই হ্রদের ভঙ্গুর বরফের চাইয়ের উপর রেলপথ নির্মাণ অসম্ভব প্রায়। তাই নির্মাণ করতে হবে সড়কপথ। লেনিনগ্রাদের লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে এই রাস্তার বিকল্প নেই।

বরফের উপর রাস্তা নির্মাণে রাশিয়ানদের ধারেকাছে কোনো জাতি নেই। কিন্তু এবার চ্যালেঞ্জটা একটু বেশিই। বরফের নীচে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি, উপরে হিটলার বাহিনীর বিমান, যেকোনো সময় একটিমাত্র বোমা নস্যাৎ করে দেবে পুরো রাস্তা। তবে এই ভয়ে বসে থাকলে তো আর চলবে না।

১৯৪১ সালের তিন নভেম্বর, লেনিনগ্রাদ মিলিটারি কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যেকোনো মূল্যে লাদোগা হ্রদের উপর ২০ থেকে ত্রিশ মাইল দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করতে হবে। তীব্র শীতে হ্রদের পুরো বরফকে কাজে লাগিয়ে শহর থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নিতে হবে। এই সড়কের নাম দেওয়া হয় Military Road No. 101, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এই রাস্তা হয়ে উঠে জীবনের রাস্তা। লেনিনগ্রাদের মানুষ এই রাস্তার নাম দেয় 'রোড অব লাইফ'।

১৯৪১ সালের উনিশ নভেম্বর রোড অব লাইফ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা শুরু হয়। খাদ্য আর মিলিটারি সরঞ্জাম বোঝাই ভারী ভারী ট্রাক চলতে শুরু করে সে রাস্তায়।
কিন্তু ভঙ্গুর বরফ আর ক্ষণে ক্ষণে বিমান থেকে ধেয়ে আসা বোমা এই রাস্তাকে অকার্যকর করে দেয়। বারবার রাস্তা পরিবর্তন করতে হয়। বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যেতেও ব্যবহার করা হয় এই রাস্তা। ভারী ট্রাক আর সামরিক গাড়ির পাশাপাশি সাধারণ মানুষ তাদের ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়েন নিরাপদ গন্তব্যের খোঁজে।

ফলে এই রাস্তায় তৈরি হয় ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের দীর্ঘ লাইন। সাধারণ মানুষেরাই এই সড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নারীদের অনেকেই সেনাবাহিনীর পাশে এসে দাঁড়ায়। এমনকি নারী ট্রাক চালকও নিয়োগ দেওয়া হয় শহরের অভ্যন্তরে মালামাল পৌঁছে দেওয়ার জন্য।কিন্তু বরফের চাইয়ের উপর একসাথে অনেক গাড়ি কিংবা ঘোড়া উঠতে না পারায় গতি মন্থর হয়ে গিয়েছিল অনেক।

তাই লাদোগা হ্রদের বিকল্প আরো কয়েকটি রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী। তাই হ্রদের বিভিন্ন জায়গায় বরফের পুরুত্ব পরীক্ষা করে পরিসংখ্যান তৈরি করে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর আবহাওয়া অধিদপ্তর। যে জায়গাগুলোতে বরফ বেশি পুরো সেইদিক দিয়ে বিকল্প রাস্তা নির্মাণ শুরু করা হয়।লেনিনগ্রাদের মানুষের তখন দরকার খাদ্য, পানীয়, কেরোসিনসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রায় এক হাজার টনের সাপ্লাই।

রোড অব লাইফের নির্ঘুম সড়কে প্রতিনিয়ত ৬০০ থেকে ৭০০ টন সাপ্লাই আসতে থাকে। টানা গাড়ি চালিয়ে ড্রাইভাররা শিকার হতে থাকেন একের পর এক দুর্ঘটনার। ধু ধু বরফের রাজ্যে, একটি সাধারণ দুর্ঘটনাও হয়ে উঠে প্রাণঘাতী। এই রোড অব লাইফ শুধু সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার কাজেই ব্যবহার হচ্ছিল না, পাশাপাশি জার্মান বাহিনীকে পালটা আক্রমণেও এই রাস্তাকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। তাই সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে রাস্তার স্থলভাগে রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছিল।

৮৭২ দিনের জার্মান অবরোধে দশ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই চরম ঠাণ্ডায় খাদ্যের অভাবে মৃতুবরণ করেছিল। লাদোগা হ্রদের উপরে নির্মিত এই রোড অব লাইফ প্রাণ বাঁচিয়েছে প্রায় পনেরো লক্ষাধিক লোকের। ১৫ মিলিয়ন টন খাদ্য লেনিনগ্রাদবাসীর ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে এই রাস্তার কল্যাণে।

সোভিয়েত সেনাদেরকেও যুদ্ধে সামরিকভাবে সহায়তা করেছে এই রাস্তা। সময়ের কালোস্রোত পাড়ি দিয়ে এখনো এর অংশবিশেষ দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো দিনগুলোর স্মৃতি হিসেবে।

Pages: [1] 2