Daffodil International University

Educational => Higher Education => Higher Education => Topic started by: Shahana Parvin on December 04, 2019, 05:25:46 PM

Title: যেখানে পড়েছি, সেখানেই পড়াই
Post by: Shahana Parvin on December 04, 2019, 05:25:46 PM
এক সময় যেই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী হয়ে থেকেছেন, সেখানেই শিক্ষক হিসেবে ফিরে আসার অনুভূতি কেমন? এই শিক্ষকেরা কি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিজেকেও খুঁজে পান? পড়ুন ৫ শিক্ষকের অভিজ্ঞতা।

শায়লা ইসরাত
প্রভাষক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি)
আইইউবিতে আমার রুমে যাওয়ার দুটি পথ আছে। আমি সব সময় ক্যানটিনের সামনের পথটা বেছে নিই, কারণ এই জায়গা সব সময় প্রাণোচ্ছল থাকে। ছেলেমেয়েদের এত হাসি, উদ্যম, উচ্ছলতা—দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। ক্যাম্পাসে ঢোকার সময় আর বের হওয়ার সময়, প্রতিদিন আমি ওদের দেখে শক্তি পাই। একটু দুঃখবোধও হয়। কারণ, এই তো কয়েক বছর আগে, আমিও তো ওদের একজনই ছিলাম। সেই ক্যানটিন, উচ্ছলতা, প্রাণ, রং—সবই আছে, নেই শুধু আমার বন্ধুরা। কেউ উচ্চশিক্ষা, কেউবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত।

আইইউবি থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশলে আমার স্নাতক সম্পন্ন হয় ২০১৩ সালে। সিজিপিএ ছিল ৩.৯২, যেটা আমার ব্যাচের সর্বোচ্চ। তবু ক্যারিয়ার নিয়ে তখনো অনিশ্চয়তায় ভুগছিলাম। প্রতিদিন পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতাম। এর মধ্যে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ডিন স্যার বললেন, ‘তুমি এখানে অ্যাপ্লাই করছ না কেন?’

 ২০১৪ সালে আমি আবার নতুন করে আইইউবিতে এলাম; শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষক হিসেবে। শুরু থেকেই ছেলেমেয়েরা আমাকে পছন্দ করেছিল। ওরা বলত, ওদের না–বলা কথা আমি বুঝতে পারি। সত্যিই তা–ই। ক্লাসে কখন বোরিং লাগে, কখন একটু হাসাহাসি করতে ইচ্ছা হয়, কখন পড়ার বাইরে অন্য বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগে, কখন ঘুম পায়—এসব আমি বুঝি। যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, মনে হতো, এত ক্লাস টেস্ট, কুইজ, মিডটার্ম কেন যে শিক্ষকেরা নেন! এখন জানি, পরীক্ষা না নিলে ছেলেমেয়েরা পড়তে বসে না।

আমার শিক্ষকেরা এখনো আমাকে ছাত্রীর মতোই দেখেন, এখনো আমি বকা খাই, এখনো কোনো সমস্যা হলে তাঁরা আমাকে বুঝিয়ে বলেন, কী যে ভালো লাগে! তবে সবচেয়ে ভালো লাগে তখন, যখন প্রথম বর্ষের কোনো শিক্ষার্থী বলে, ‘ম্যাম, আমি আসলে নিজের ইচ্ছায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসিনি। আপনার ক্লাস করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আগ্রহ পেতে শুরু করেছি।’
শিক্ষকদের পাশে পাওয়া বড় আশীর্বাদ

বায়েজীদ বাতেন
প্রভাষক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মিলনায়তনে তখন জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমি বসেছি একদম সামনের সারিতে, শিক্ষকদের সঙ্গে। এদিকে আমার মন পড়ে আছে পেছনে। কারণ, পেছনের সারিতে বসে চিৎকার করে গান গাওয়ার যে কী আনন্দ, সেটা আমি জানি। একসময় বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র ছিলাম। এখন সেখানেই আছি শিক্ষক হিসেবে। অথচ বুয়েটের শিক্ষক তো দূরের কথা, ছাত্র হওয়ার ভাবনাও আমার ছিল না।
মা-বাবা চেয়েছিলেন, আমি ডাক্তার হই। এ লেভেল শেষ করে মেডিকেলের কোচিংয়ে ভর্তিও হয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেডিকেলে নয়, যেহেতু পদার্থবিজ্ঞান খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম, চান্স পেয়ে গেলাম বুয়েটে। বুয়েটজীবনের শুরুতে ক্লাস, হাফওয়ালে বসে আড্ডা, ক্লাস শেষেই ক্যাফেটেরিয়ায় ছোটা...সে কী রোমাঞ্চ! নাচ, গান, প্রতিযোগিতা, যা-ই হোক, ক্যাম্পাসের সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম প্রায় কোনোটাই বাদ দিইনি। ভবিষ্যতে কী হব, কোথায় যাব, এসব নিয়ে অত ভাবতাম না। শুধু মনে হতো, বদ্ধ ঘরে বসে পড়ার মতো কোনো বিষয় প্রকৌশল নয়। এটা ঘুরে-ফিরে-দেখে-বুঝে, হাতেকলমে শেখার জিনিস।

তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর বন্ধুরা বলত, ‘কিরে, তোর তো রেজাল্ট ভালো। তুই তো টিচার হবি।’ এর আগে সত্যিই শিক্ষক হওয়ার কথা ভাবিনি। এখন যখন আমার শিক্ষকদের সঙ্গে বসে চা খাই, মনে হয় এটা জীবনের বড় আশীর্বাদ। শিক্ষকেরা তো আজীবনই শিক্ষক থাকেন।

আমি আমার শিক্ষার্থীদের বলি, শুধু বইয়ের মধ্যে ডুবে থেকো না। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যাও, সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নাও, ছাত্রজীবনটা উপভোগ করো। সেই স্কুলজীবন থেকে আমি কখনো শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে দ্বিধা করিনি। আমি চাই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমারও সেই সম্পর্কটা থাকুক। যদি কিছু বুঝতে সমস্যা হয়, হোক আমার ক্লাসের কিংবা অন্য ক্লাসের বিষয়, এমনকি ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা—কথা বলার জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা।
ছাত্রীদের হৃৎস্পন্দন আমার চেনা
সৈয়দা নাদিয়া আফরিন মোহনা
শিক্ষক, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আজিমপুর দিবা শাখা

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়েছি। আত্মবিশ্বাস ছিল, তবু ইন্টারভিউ দিতে গেলে একটু নার্ভাস তো লাগেই। কিন্তু সিভি হাতে নিয়ে আপা যখন বললেন, ‘ও! আমাদের মেয়ে।’ হঠাৎ করেই সব ভয় দূর হয়ে গেল।
প্রথম যেদিন নবম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান ক্লাস নিতে গেলাম, সেই দিনটার কথা আমার মনে আছে। একটা ক্লাসে প্রায় ৬০ জন ছাত্রী। এতগুলো মেয়েকে সামলে রাখা সহজ নয়। কিন্তু যখন বললাম, আমিও একদিন ভিকারুননিসার ছাত্রী ছিলাম, ওদের সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেল। টের পেলাম, উল্টো দিকে বসে থাকা মেয়েগুলোর হৃৎস্পন্দন আমার খুব চেনা!

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা দিবা শাখায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। উচ্চমাধ্যমিক পড়েছি বেইলি রোড শাখায়। আর এখন আজিমপুর শাখায় শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিই। মাঝেমধ্যে কোনো অনুষ্ঠান হলে সব শাখার শিক্ষকেরা এক হন। আমার পুরোনো শিক্ষকদের দেখে আমি যতটা খুশি হই, মনে হয় তাঁদের খুশি আমার চেয়েও বেশি।

ছাত্রীদের সঙ্গে আমার সম্পর্কট চমৎকার। ক্লাসভর্তি মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতে দারুণ লাগে। যখন ছাত্রী ছিলাম, শিক্ষকেরা বকা দেওয়ার সময় বলতেন, ‘আমাকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা কোরো না। তোমার জায়গায় একদিন আমিও ছিলাম।’ মনে হতো, সব শিক্ষক কেন একই কথা বলেন। আশ্চর্য, এখন সেই কথা আমিও বলি!

কখনো কখনো খুব স্মৃতিকাতর লাগে, বিশেষ করে বিদায়ী ছাত্রীদেরর‌্যাগ ডের সময়। মেয়েরা যখন ছোটাছুটি করে একজন আরেকজনের টি–শার্টে লেখে, একসঙ্গে ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’ গায়, পেছনে দাঁড়িয়ে আমারও কখন যেন চোখ ভিজে যায়। আমরা ভিকারুননিসার ছাত্রীরা বলি, ‘ওয়ানস আ ভিকি, অলওয়েজ আ ভিকি’। এই কথা আমার বেলায় একটু বেশিই সত্যি।
শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিতে চাই
দিলীপ চন্দ্র রায়
প্রভাষক, সরকাির মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, সিলেট।

মফস্বলের সন্তান হওয়ায় শহরের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ বড় কঠিন ছিল। সালটা ১৯৯৬। ইচ্ছা ছিল উচ্চমাধ্যমিক পড়ব প্রিয় ক্যাম্পাস মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেটে (এমসি কলেজ)। কিন্তু ভর্তি হতে না পারার বেদনা নিয়ে যখন বাড়িতে পৌঁছাই, তখন চারপাশে অবসন্ন অন্ধকার। মা আমার অসহায় চাহনি দেখে বারবার সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন এই বলে যে ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন।
১৯৯৬ সালের বেদনা ভুলিয়ে দিতে ১৯৯৮-৯৯ শিক্ষাবর্ষে এমসি কলেজে গণিত বিভাগে ভর্তি হই। বলতে দ্বিধা নেই যে প্রথম দিকে এমসি কলেজে অধ্যয়ন মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পড়ালেখা থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন সংগঠন করা, কবিতা আর গল্প লেখা, পত্রিকায় টুকিটাকি লেখালেখি করা, সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশ করা ইত্যাদি হয়ে উঠেছিল প্রধান উপজীব্য বিষয়। এরই মধ্যে গণিত বিভাগ একটু একটু করে কাছে টানতে শুরু করে। মাঝেমধ্যে ক্লাসে আসি, স্যারদের কথা শুনি। কোনো কোনো স্যার নিজের জীবনের গল্প, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প শোনান, শুনে আমার মতো অনেকের মনেই একটা স্বপ্ন দানা বাঁধতে শুরু করে।

তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে পড়ে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখা অনেকটাই বিলাসিতা ছিল। কিন্তু প্রেরণা পেতাম তাঁদের দেখে, যাঁরা এমসি কলেজে পড়ে সেখানেই শিক্ষকতা করছেন। আজ আমার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও একই বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি। প্রাত্যহিক শত সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষকতার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম। যখন শিক্ষার্থীদের সামনে কথা বলি এবং তারা সেই কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, তখন শিক্ষকতার বাইরে নিজেকে কল্পনা করতে পারি না। আমি যাঁদের ছাত্র ছিলাম, সেই শিক্ষাগুরুদের সহকর্মী হয়ে তাঁদের স্নেহাবেশে আবিষ্ট হয়ে একই কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে সব সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ একজন শিক্ষার্থীর জীবনকে ইতিবাচকভাবে আমূল পাল্টে দিতে পারে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আমার শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ প্রদানের ফেরিওয়ালা হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
আবেগ আগের মতোই আছে
নরদেব রায়
প্রভাষক, এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর

ডা. ইউসুফ আলী ছাত্রাবাসের রুম নম্বর ১০৮। আমি আর আমার এক বন্ধু রুমে ঢুকতেই ভেতরে বসে থাকা ছাত্ররা চট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। খুব অবাক হয়ে বলল, ‘স্যার আসেন, বসেন।’ ওদের শান্ত করে বলি, ‘তোমাদের এই রুমে একদিন আমি ছিলাম।’ এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজে (সাবেক দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ) শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার দু–এক দিন পর গিয়েছিলাম নিজের পুরোনো ঠিকানায়। মনের আঙিনায় উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল অজস্র স্মৃতি।
আমার বাবা বলতেন, ‘গতিই জীবন, স্থবিরতাই মৃত্যু।’ অথচ অল্প বয়সেই মাকে হারিয়ে আমাদের পাঁচ ভাইবোনেরই মনে হয়েছিল, জীবনটা বুঝি থমকে গেছে। জীবনের এই কঠিন বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আমার মনে প্রথম উঁকি দিয়েছিল। মা মেনকা রানী রায়ের মৃত্যুর পর বাবা মনোরঞ্জন রায় একই সঙ্গে মা ও বাবা, দুই ভূমিকাই পালন করেছেন। ভাইদের মধ্যে আমি ছিলাম সবার ছোট। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে বড় ভাই তপনদা সংসারের হাল ধরেছিলেন। বাবা ও ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করব বলেই ডাক্তার হওয়ার দৃঢ়সংকল্প আমার ছিল।

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সব সময় মনে একটা অভিপ্রায় ছিল, যদি কখনো শিক্ষক হই, তাহলে নিজের কলেজেই হব। স্বপ্ন পূরণ হবে, সেটা অবশ্য তখনো ভাবতে পারিনি। ৩৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু ওই যে মনে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল, সেটিই আমাকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে এল নিজের পুরোনো ক্যাম্পাসে।

কলেজের নাম বদলে গেছে, ভেতরেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আমার আবেগ এখনো আগের মতোই আছে। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে জীবনের এই অবস্থানে এসেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই সব সময় ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে চেষ্টা করি। গরিব মানুষের সেবা করার যে ব্রত নিয়ে আমি চিকিৎসাবিদ্যায় পড়তে এসেছিলাম, আমি চাই আমার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মনেও সব সময় থাকুক এই মহান ব্রত।


শিক্ষা সংবাদ> প্রথম আলো