Daffodil International University

Entertainment & Discussions => Story, Article & Poetry => Topic started by: Al Mahmud Rumman on March 31, 2019, 11:55:15 AM

Title: সাক্ষাৎকারে নির্মলেন্দু গুণ: মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুদের চেয়ে ভিন্ন সৌন্দর্য আছে
Post by: Al Mahmud Rumman on March 31, 2019, 11:55:15 AM
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে কবি আল মাহমুদ, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ুন আজাদের সাথে তার অম্লমধুর সম্পর্ক, রোহিঙ্গা ইত্যাদি প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিনের যে-ফোনালাপ হয় তারই শ্রুতিলিপি এই সাক্ষাৎকার। শ্রুতিলিপি তৈরি করেছেন তরুণ গল্পকার সাব্বির জাদিদ।


রাজু আলাউদ্দিন: কেমন আছেন, গুণদা?
নির্মলেন্দু গুণ: এই তো আছি মোটামুটি।
রাজু আলাউদ্দিন: গুণদা, একটা ব্যাপার নিয়ে আলাপ করা দরকার আপনার সাথে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি আল মাহমুদের কবিতা আছে, ফলে ঐতিহাসিকভাবে আপনার ওই বক্তব্যটা একটু দুর্বল হয়ে পড়বে। সেটা নিয়ে আমার মনে হয় আপনার একটু ইয়ে করা উচিত।
নির্মলেন্দু গুণ: ওটা কোথায় আছে, কবে প্রকাশিত হয়েছে এটা জানা দরকার।
রাজু আলাউদ্দিন: আমি একটা তথ্য পেয়েছি। তথ্যটা হইল, বেবী মওদুদ আপা, উনি একটা বই করেছিলেন, ‘বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান’, ওখানে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত যে কবিতাগুলো ছিল সেখানে আল মাহমুদের ‘নিশিডাক’ কবিতাটা আছে।
নির্মলেন্দু গুণ: এটা কোনো গ্রন্থে যায় নাই?
রাজু আলাউদ্দিন: আমার হাতে যেহেতু আল মাহমুদের বইগুলো নাই, এ জন্য আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। হয়ত বইয়ে নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো উনি বলতে পারবেন।

রাজু আলাউদ্দিন: উনি তো এখন আর ফোনে কথা বলতে পারেন না–এই রকম অবস্থা আর কি। তো যাই হোক, ওটা দেখেই জানতে হবে। যদি লিখে থাকেন তো ভালো। খারাপ না। আর কবিতাটাও তো বেশ ভালো। ভালো কবিতা। ওটাকে কবিতা করে তুলতে পেরেছেন। স্লোগানে পরিণত হয়নি। অনেকে তো শুধু প্রোপাগাণ্ডা করে ফেলে। কবিতার শিল্পরূপটা থাকে না। তো সেটা দেখলাম যে উনার এই কবিতাটায় আছে। এটা ভালো। খারাপ না।

নির্মলেন্দু গুণ: এই কবিতাটা আমার দেখা দরকার। তাহলে আমি বলতে পারব যে আমি দুঃখিত, আল মাহমুদ সম্পর্কে যে মন্তব্যটা করছিলাম ওটা ঠিক না। তার কবিতা পাওয়া গেছে। গ্রন্থভূক্ত হয়েছে কি না জানি না। কিন্তু এই সংকলনের মধ্যে পাওয়া গেছে। তাছাড়া এই ব্যাপারটা তার দৃষ্টিগোচর করা গেলে সে বলতে পারবে। নয়ত এটা খুঁজে পাওয়া কঠিন। আচ্ছা, আল মাহমুদের কি রচনা সমগ্র বের হয়েছে?

রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, রচনা সমগ্র বের হয়েছে। রচনা সমগ্র বা কাব্য সমগ্র এরকম নামে বের হয়েছে।
নির্মলেন্দু গুণ: কাব্য সমগ্র গদ্য সমগ্র তো আমারও বের হয়েছে। রচনা সমগ্র বা রচনাবলী বের হইছে কি না?

রাজু আলাউদ্দিন: রচনাবলী…. আমি ঠিক নিশ্চিত না এই মুহূর্তে গুণদা, বেরিয়েছে কি না। তবে জানা যাবে।
নির্মলেন্দু গুণ: আচ্ছা, জীবিত লেখকদের মধ্যে রচনাবলী প্রকাশের রেওয়াজটা সাম্প্রতিক ঘটনা। আগে তো এমন ছিল না।
রাজু আলাউদ্দিন: ছিল না।
নির্মলেন্দু গুণ: যেমন, আমি একবার ভোরের কাগজে দেখছি, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক যারা, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ– জীবদ্দশায় তারা তাদের রচনাবলী দেখে যেতে পারেননি।
রাজু আলাউদ্দিন: তবে একটা ব্যতিক্রম আছে। বুদ্ধদেব বসুর কিন্তু জীবিতাবস্থায় তার রচনাবলী বের হয়েছিল। কোন প্রকাশনী থেকে সেটা আমার মনে নেই। কিন্তু সবুজ রঙের মানে টিয়া রঙের কভার, এরকম প্রচ্ছদে।
নির্মলেন্দু গুণ: এটা চল্লিশের কবিদের পর থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি নামে সিগনেট থেকে বেরোনো শুরু হলো না?
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ।
নির্মলেন্দু গুণ: তখন এটা বেরোতে পারে। তার ব্যাপারে আমি মন্তব্য করি নাই। আমি চারজন যে বড় কবির কথা বললাম, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ– এদের কারো রচননাবলী কিন্তু জীবদ্দশায় বের হয়নি।
রাজু আলাউদ্দিন: না, এঁদের জীবদ্দশায় বের হয় নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: পরবর্তীকালে, মানে চল্লিশের পর থেকে এটা চালু হইছে। তার আগে এটা চালু ছিল না।
রাজু আলাউদ্দিন: তার আগে এটা চালু ছিল না। বরং বলা যায়, তিরিশের দশকের একমাত্র বুদ্ধদেব বসু দিয়ে শুরু হইছে আর কি। জীবিতাবস্থায় তার রচনাবলী বের হয়েছে।
নির্মলেন্দু গুণ: বুদ্ধদেব বসু এইসব ব্যাপারে খুব তৎপর ছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: ম্যাটিকুলাসও ছিলেন। তথ্য-তৎপর ছিলেন।
নির্মলেন্দু গুণ: আমাদের দেশে জীবদ্দশায় কার বেরিয়েছে?
রাজু আলাউদ্দিন: আমার মনে হয় না আমাদের দেশে জীবদ্দশায় কারো বের হইছে। না, বের হইছে বোধহয়। যেমন হাসান আজিজুল হকের বের হইছে। শামসুর রাহমানের কি বেরিয়েছিল?
নির্মলেন্দু গুণ: না।
রাজু আলাউদ্দিন: এখন ইদানীং বেরুচ্ছে একেবারে তরুণ কবিদেরও। লেখালেখি শেষ না হতেই এখন তারা রচনাবলী বের করার দিকে বেশি মনোযোগী।
নির্মলেন্দু গুণ: এরকম আছে কয়জন?
রাজু আলাউদ্দিন: বেশ কয়েকজনই আছে দেখলাম। তাদের হয়ত আস্থা নাই যে পরবর্তীতে তাদের রচনাবলী আদৌ বেরোবে কি না! সেই জন্য আগেভাগেই বের করে রাখতেছে।
নির্মলেন্দু গুণ: হা হা হা। রচনাবলীতে জীবিত লেখকদের ছবি থাকা উচিত নয়। শামসুর রাহমান তার শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে ছবি দিয়েছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: ছবি তো ভালোই লাগে। থাক না! অসুবিধা কী! জীবিত লেখকদের বই যদি ছবিসহ বেরোয়, এটা খারাপ না। ফ্ল্যাপে যখন দিতে পারে, ব্যাককভারে যখন দিতে পারে…. যেমন বিষ্ণু দের নাভানা থেকে যখন শ্রেষ্ঠ কবিতা বেরুলো, তখন তো বিষ্ণু দের সুন্দর একটা ছবি ছিল। অনেকের তো কৌতূহল থাকে, পাঠকের কৌতূহল থাকে– আচ্ছা, এই কবি দেখতে কেমন! সে জন্য ছবি দেয়া আমার মনে হয় খারাপ না। প্রত্যেক রচনাবলীতে ভিন্ন ভিন্ন ছবি যেতে পারে। অসুবিধা কী! আপনি আপনার রচনাবলীতে দেন।
নির্মলেন্দু গুণ: বইয়ে ছবি যোগ করা এটা তো আমি চালু করছি।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, প্রেমাংশুর রক্ত চাই বইতে ছিল ছবি।
নির্মলেন্দু গুণ: কভারে ছবি দিয়ে বই বেরুলো। তার আগে তো কলকাতাতেও এমন বেরোয় নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, আমি দেখিনি অন্তত। তারপরে মান্নান ভাইয়ের করতলে মহাদেশ যখন বেরোল, মানে আপনাদের সমসাময়িক লেখকদের কথা বলতেছি আর কি, মান্নান ভাইয়ের করতলে মহাদেশ বইয়ে একটা ছবি বেরোল না? বুকে হাত দিয়ে…
নির্মলেন্দু গুণ: আমি শুরু করেছিলাম এটা। সেভেনটিতে ওটা প্রথম বেরোল আর কি।
রাজু আলাউদ্দিন: তবে মান্নান ভাইয়েরটা ছিল ভিতরে। আর আপনারটা ছিল প্রচ্ছদে। প্রচ্ছদে বোধহয় আপনিই শুরু করলেন প্রথম।
নির্মলেন্দু গুণ: ভিতরে না যাওয়ারই পক্ষপাতী আমি। আমার ছবিই তো সবচে বেশি প্রচারিত। বইয়ের মধ্যে ছবির ব্যবহার সবচে বেশি করছি আমি। ফ্ল্যাপে, ব্যাক কভারে, ফ্রন্ট কভারে।
রাজু আলাউদ্দিন: তারপরে টেক্সট বইয়ে আপনার ছবি দেখলাম। ‘মিয়া এখন…’ কী যেন লেখা ছিল।
নির্মলেন্দু গুণ: ‘মিয়াভাই ছবি আঁকে।’
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: আমি তো মহাখুশি। পরে ছেলেরা বড় হয়ে দেখবে যে এই মিয়াভাই তো কবিতাও লেখে। হা হা।
রাজু আলাউদ্দিন: ওখানে আপনাকে একটু ধর্মান্তরিতও করে নিছে, তাই না?
নির্মলেন্দু গুণ: তাতে অসুবিধা কী? তাতে কোনো অসুবিধা নাই। তাতে আমি আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হব। আমারে অনেকে বলছে যে আপনাকে মিয়াভাই বলছে। আমি বলি, মিয়াভাই তো বলেই। আমাদের দেশে মিয়াভাই, ভাইজান, ভাইসাব, দাদা, দাদু এসব তো বলেই।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে ভারতে আবার মিয়া বলতেই মুসলমান বোঝায়।
নির্মলেন্দু গুণ: মিয়াভাই মানে তো বড়ভাই। রেসপেক্ট্যাবল বড় ভাই।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, রেসপেক্টেড বড়ভাই। তা ঠিক। আমাদের এখানে এটা ধর্মান্তরণের অর্থ বহন করবে না। কিন্তু আবার ভারতে হলে এটা করবে। মানে পশ্চিমবঙ্গে হলে ধর্মান্তরণের অর্থটা দাঁড়াবে।
নির্মলেন্দু গুণ: মুসলিমদের সাথে যোগাযোগ কম তো, এই জন্য আর কি। তবে অনেক অমুসলিম আছে, আল্লাহ বলে। মানে বিসস্ময়কর শব্দ হিসেবে আল্লাহ শব্দটা তারা বলে। আল্লাহ!!
রাজু আলাউদ্দিন: এটা হলো আসলে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি।
নির্মলেন্দু গুণ: বেশি মানুষের ব্যবহৃত উক্তি বা শব্দগুলো সবাই ব্যবহার করে আর কি। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষার মুসলমানদের মধ্যে যারা আছেন, সাহিত্য চর্চা করেন, তারা এগুলো করেন। আমাদের পুরনো কবিরা যখন তারা কলকাতায় ছিল, তারা এটা করত। তারা জলকে জল বলত। তাদের লেখার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। মুসলমানরা তো নজরুলের ‘মহাশ্মশান’(শব্দটা) বাদ দিয়ে ‘গোরস্তান’ করল। কিন্তু কায়কোবাদের মহাকাব্যের নাম যে মহাশ্মশান এটাকে আর চেঞ্জ করতে পারে নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: তোরা ছোট মহাশ্মশান কাটছস, দ্যাখ, কতবড় মহাশ্মশান!
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: একটা কাজ করেন। কায়কোবাদের কবরস্তান কিন্তু আজিমপুরে। গেটে ঢুকতেই হাতের ডানদিকে। ওই দিকটায় নতুন মেয়র কিছু স্থাপনা তৈরি করছে। বিরাট মসজিদ করছে ওই এলাকায়। তাতে আমার ধারণা, বহু কবর ওইটার নিচে চাপা পড়ে যেতে পারে। মহাকবি কায়কোবাদের কবরও চাপা পড়ার সম্ভাবনা আছে। তো আপনাদের সাংবাদিককে দিয়া তদন্ত করে তার কবর কোনো স্ট্রাকচারের আড়ালে ঢাকা পড়ছে কি না এটা দেখা দরকার। আমি কবরটা দেখেছি। এবং আমি কায়কোবাদের গ্রামের বাড়িও গেছিলাম। আমি আর হুমায়ুন আজাদ, আমরা দুজন গেছিলাম। জায়গাটার নাম হচ্ছে আলগা। এটা বিক্রমপুরের একটা জায়গা। আগে যখন গেছিলাম, অনেক দূর ঘুরে যাইতে হতো। এখন তো অনেক ব্রিজ ট্রিজ হয়ে গেছে। ধলেশ্বরী ইত্যাদি ব্রিজ হয়ে গেছে। এখন খুব সহজেই যাওয়া যায়।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার সাথে তো হুমায়ুন আজাদের সাপে নেউলে সম্পর্ক। আপনারা দুজন একসাথে গেলেন কিভাবে!
নির্মলেন্দু গুণ: ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল। তুমি তুমির সম্পর্ক ছিল। আমি তাকে তুমি বলতাম। সে আমাকে তুমি বলত।
রাজু আলাউদ্দিন: উনার সাথে আপনার সম্পর্ক নষ্ট হলো কখন থেকে বা কী সূত্রে?
নির্মলেন্দু গুণ: খুব যে একটা নষ্ট হইছে তা তো বলা যায় না। হা হা হা।
রাজু আলাউদ্দিন: হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: সে আমাকে কবি বলে মানত না। তারপরেও তার সংকলনে আমার পাঁচটা কবিতা নিছে। সে যখন পাঠ্য বোর্ডে ছিল, সে আমার কবিতা পাঠ্য বইয়ে নিছে। আমার প্রথম কবিতা যখন পাঠ্য হলো স্কুলে, ‘মামা ও সূর্য’ নামে, এটা সেই-ই পাঠ্য করছিল। মুখে যতই ইয়ে করুক আমাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমাকে কবি বলে মানত। তার সংকলনের ভেতর আমার পাঁচটা কবিতা রাখছে, শুধু তাই না, সে আমার কবিতা পাঠ্যও করছে, সে যখন বোর্ডের দায়িত্বে ছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা আমি জানতাম না।
নির্মলেন্দু গুণ: তার সাথে যেটা নিয়ে আমার বিরোধ হয়েছিল, সেটা হলো নজরুলকে নিয়ে। নজরুলের বিরুদ্ধে সে যে মন্তব্য করেছিল, কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম যে, নজরুল যদি এই ধরনের সঙ্গীতগুলি না লিখত তাহলে মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক কবির জন্ম হইত না।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি বলছিলেন যে, নজরুলের যদি জন্ম না হইত তাহলে হামদ নাত তোমাদের লিখতে হইত। হা হা হা। আপনার মনে আছে এইটা?
নির্মলেন্দু গুণ: সেই জন্যই তো বলছি, শামসুর রাহমান আধুনিক কবি হইতে পারতেন না, তুমি তো আরো পরের কথা। তুমি যে আজকে তাকে অস্বীকার করছ, সে না হইলে তুমি হইতে পারতা না। মুসলমান সমাজের যে সাংস্কৃতিক চাহিদা, একালচারাইজেশন যেটা, হিন্দুদের সেই পর্বটা কিন্তু অনেক আগে সম্পন্ন হয়ে গেছে। ফলে হিন্দুদের মধ্যে মধুসূদনই বিদ্রোহ কইরা মেঘনাদবধ লিখে ফেলছে। ধর্মের বিরুদ্ধে ওরকম বিদ্রোহ বিরাট ব্যাপার। রামপ্রসাদ কালীসঙ্গীত প্রচুর লিখছে। হিন্দুর্মের উপর ভক্তিমূলক অনেক গান তার আছে। মঙ্গলকাব্যের যুগটাই তো বলা যায় ‘মঙ্গল কাব্য’। সাম্প্রতিকালে মুসলমানদের মধ্যে মঙ্গল লিখল জাকির তালুকদার। মুসলমানদের মধ্যে তো মঙ্গলকাব্য হয় নাই। এই যুগটা তো মুসলমানরা অতিক্রম করে নাই। মঙ্গলকাব্য রচনার যুগটা হিন্দুরা অতিক্রম করে আসছে। তারা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন লিখছে, পদাবলী কীর্তন লিখছে, এগুলো তো ধর্মেরই প্রকাশ। আরেকটা পয়েন্ট নিয়ে তার সাথে বিতর্ক হয়েছিল, সেটা হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়েছিল আর কি। এই কথাটা সে একটা আর্টিকেলে লিখছে। তো আমি বলেছিলাম যে, গণতন্ত্রের সুবাতাস আমাদের দেশে এত কম বয়ে গেছে যে, এটাকে শনাক্ত করা যখন সম্ভবই হইল হুমায়ুন আজাদের মতো তীক্ষ্ণ মানুষের পক্ষে; তিনি যখন এটাকে স্বীকার করলেন, তখন এই সময়টাকে শনাক্ত করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে কৃতিত্ব দেয়ার স্কোপ এখানে ছিল। তাতে মানুষ এই সময়টাকে আরো বেশি চিনতে পারত। সময়টা গণতান্ত্রিক কিন্তু শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক নয়– এই কথাটা হুমায়ুন আজাদ টেবিল টকে বলে মনে হয় শেখ মুজিবের প্রাপ্য মর্যাদা দানে বা ওই সময়ের নেতৃত্ব কার ছিল, এটাকে মনে হয় তিনি এড়িয়ে গেলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: পরে উনি কী বললেন?
নির্মলেন্দু গুণ: পরে উনি আবার মঞ্চে উঠতে চাইছিলেন। আমার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে চাইছিলেন। তখন ফয়েজ ভাই সভাপতিত্ব করছিলেন। আমি ফয়েজ ভাইরে বললাম, হুমায়ুন আজাদ যদি বক্তব্য দেন তাহলে আমাকেও পরে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। ফয়েজ ভাই বলল, না না, আর কোনো বক্তব্য হবে না। হুমায়ুন আজাদ অনেক চেষ্টা করেও মঞ্চে উঠতে পারল না। এটা নিয়ে তার সাথে প্রকাশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েছিল আর কি। পরে সে গালাগাল করছিল বলে কবিতা পরিষদ থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। এইটার পর থেকে তার সাথে সম্পর্কটা…
রাজু আলাউদ্দিন: নজরুল সম্পর্কে তো উনি কবিতাও লিখছেন দেখলাম। নজরুলের একটা ছবি দেখে সেই ছবির প্রতিক্রিয়াতে উনি কবিতা লিখলেন। আবার নজরুলকে বড় কবি হিসাবে উনি মাপেনও না।
নির্মলেন্দু গুণ: নজরুল দ্বারা প্রভাবিত হয় নাই এরকম বাংলা কবি নজরুল পরবর্তীকালে কেউ কি আছে!
রাজু আলাউদ্দিন: আরেকটা জিনিস দেখা যায়, নজরুলকে অগ্রাহ্য করার একটা প্রবণতা আছে। এটা এখানে যেমন আছে, আবার ওপারেও আছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তো নজরুলবিরোধীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, অসির ঝনঝনানি থাকলে তা যে কবিতা হবে না সেটা কিন্তু ঠিক না। এই ঝনঝনানিসহও কবিতা হতে পারে। কিন্তু দেখা গেল অনেকেই সেটা আবার মানতে চাইলেন না।
নির্মলেন্দু গুণ: রবীন্দ্রনাথ যখন নজরুলকে উদ্দেশ্য করে বসন্ত নাটকটা তাকে উৎসর্গ করছিলেন, তখন তো অনেকেই রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করছে। রবীন্দ্রনাথ কেন তাকে বসন্ত উৎসর্গ করলেন! কারণ তিনিই ভারতে বসন্ত এনেছেন। ভারতে তিনি বসন্ত এনেছেন তার জন্য তাকে উৎসর্গ করেছেন। বসন্ত শুধু নাটকের নাম না, এর দ্বারা তিনি নজরুলকে মিন করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে একটা সংখ্যা বের হয়েছিল, কে যেন লিখছিল রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে। সেখানে এই তথ্যটা পাওয়া যাবে। শহীদুল্লাহ সাহেব তারে নিয়ে গিয়েছিল, এটা আমাদের সেদিনের আলোচনার মধ্যে আসছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: “নজরুলকে আমি বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে কবি বলে অভিহিত করেছি, জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ আর পড়ে থাকলেও রূপ ও রসের সন্ধান করোনি। অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।” এই কথা বলেছেন। জাতির জীবনে যিনি বসন্ত এনেছেন তাকে বসন্ত নাটক উৎসর্গ করলেন উনি। এটা খুবই অর্থপূর্ণ ছিল। মানে রবীন্দ্রনাথের উদারতার জায়গাগুলোও কিন্তু সাংঘাতিক। একই সাথে উদারতা এবং যথাযথ মর্যাদা দেয়া, প্রাপ্য মর্যাদা দেয়া; এই বিষয়ে তার সততা এবং অনড় অবস্থান–এটা সাংঘাতিক।
নির্মলেন্দু গুণ: তার জন্য মাইকেল বিষয়ে তার বিবেচনা পঁচাত্তর বছর বয়সে সেটা পরিবর্তন করলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ হ্যাঁ। এইটা হলো বড় কবির লক্ষণ।
নির্মলেন্দু গুণ: আমি পরে লেখলাম যে পঁচাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত আপনে যে অপেক্ষা করলেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য; আপনার পাঠকরা তো জেনে গেছে আপনার বিবেচনা। পঁচাত্তর বছর বয়সে এটা উন্মোচন করলে গবেষকদের কাজে লাগবে কিন্তু পাঠকদের কাজে লাগে না। তিনি মাইকেল সম্পর্কে বিরূপ ছিলেন, এটার কারণ আমি ব্যাখ্যা করছি আমার বইতে। সেখানে বলছি যে, মাইকেল যখন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করলেন, তখন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে মাইকেলের সঙ্গে দেখা করলেন। তাকে কিছু ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করার জন্য অনুরোধ করলেন। তখন তিনি বলছেন, আমি ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করার জন্য খৃস্টধর্ম গ্রহণ করিনি। (রাজু আলাউদ্দিনের অট্টহাসি) দেবেন্দ্রনাথ মনে করছিলেন এই সময় মাইকেলকে দিয়ে ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করাই। তিনি ব্রাহ্ম সঙ্গীত লিখতে রাজি হলেন না। বরং বিরূপ মন্তব্য করলেন “আমি ব্রাহ্ম সঙ্গীত রচনা করার জন্য হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করি নাই।” তার তো উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন, খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করার। তিনি ইংল্যান্ডে যাবেন। ইংল্যান্ডের রমনী বিবাহ করলেন। বাংলাভাষার কবি বলে নিজেকে মনেই করলেন না। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পোয়েট… রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সময় নোবেল কমিটি কিন্তু তাকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পোয়েট বলছেন। বাঙালি কথাটা কিন্তু নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: তখন তো বাঙালি জাতিসত্তার স্বতন্ত্র কোনো ভিত দাঁড়ায় নাই, সেজন্য বলে নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: আমরা যে বলি বাঙালি জাতির প্রথম নোবেলজয়ী কবি। কিন্তু খাতাকলমে বাংলার লেশ মাত্র নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: তখন তো আমরাও ভারতীয়।
নির্মলেন্দু গুণ: কিন্তু পরে আমি একটা ইয়েতে পাইছি, তিনি কর্নেল ইউনিভার্সিটি ভিজিট করতে গেছিলেন নিউইয়র্কে। সেইখানে যে ভিজিটার্স বুক আছে, ওইখানে তিনি ন্যাশনালিটির জাগায় বেঙ্গলি লিখছিলেন। এটা খুব বিস্ময়কর। রবীন্দ্রনাথ আসলে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে তার যে বাঙালি পরিচয়টা ঢাকা পড়ে গেল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পরিচয়ের আড়ালে..
রাজু আলাউদ্দিন: সেইটাকে উনি আবার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেন।
নির্মলেন্দু গুণ: পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেন একটা জায়গায়। সেটা হলো কর্নেল ইউনিভার্সিটির ভিজিটার্স বুকের মধ্যে তিনি লিখছেন, সেখানে একটা কলাম আছে ন্যাশনালিটি। সেই ন্যাশনালিটির জায়গায় তিনি ইন্ডিয়ান লেখেননি। তিনি বেঙ্গলি লিখছেন।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা খুব সচেতনভাবে করছেন বোঝাই যায়।
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ বোঝাই যায়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে এটা করছিলেন। সম্ভবত সতের আঠারো সালে। জাপান থেকে তিনি গেছিলেন আমেরিকায়, ওই সময়ে।
রাজু আলাউদ্দিন: আরেকটা জিনিস দেখেন, ওই সময় তো নজরুল রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথ তো আসলে জনপ্রিয় ছিলেন না। জনপ্রিয় ছিলেন নজরুল ইসলাম।
নির্মলেন্দু গুণ: রবীন্দ্রনাথ জনপ্রিয় হয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে। তার আগে এত ইয়ে ছিল না। এখন আমরা যেমন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ইত্যাদিতে যেরূপে দেখছি, আগে তো ওইরকম ছিল না।
রাজু আলাউদ্দিন: আগে ওইরকম ছিল না। নজরুল যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে গেছেন একেবারে সাধারণ মানুষের ভেতর, ওইটা কিন্তু রবীন্দনাথ ঠাকুরের ছিলেন না।
নির্মলেন্দু গুণ: মানুষ জেলে গেলেই তো জনপ্রিয় হয়। পুলিশ যখন কাউকে এরেস্ট করে তখন সে জনপ্রিয় হয়। নজরুল একাধিকবার জেলে গেছে। এবং তার কবিতার জন্য জেলে গেছেন। তিনি তো জনপ্রিয় হবেনই।
রাজু আলাউদ্দিন: তবে শুধু কি জেলে যাওয়াটাই জনপ্রিয় হওয়ার কারণ? সে তো আসলে ওই গণমুখী কবিতাও লিখছে, তাই না? রাজনৈতিক কবিতা লিখছে, গণমুখী কবিতা লিখছে। সেগুলো তাকে জনপ্রিয় করছে, তাই না? তারপরে তার গান ছিল। এইগুলো নিয়ে আমার মনে হয়…
নির্মলেন্দু গুণ: ব্রিটিশের গোলামি ছিন্ন করার জন্য তার কারার এই লৌহ কপাট ইত্যাদি কবিতা, সাম্যবাদী কবিতা সমাজের সাধারণ মানুষের চিন্তাকে, আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করেছে। সুভাষ বসু, তিনি যখন ভারতের মুক্তি আন্দোলন করছেন, তখন নজরুলকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হইছে, সেইটার মধ্যে তিনি বক্তৃতা রাখছেন। নজরুলের এত অল্প বয়স, সেখানে তিনি বলছেন, নজরুল আমাদের সেই কবি যার কবিতা পড়ে আমরা কারাগারে যাব এবং কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে আমরা বেরিয়ে আসব।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি সেদিন বললেন যে একজন কবি হয়ে উঠতে পারে একটি জাতির ইতিহাস, নজরুল ছিলেন ওই ধরনের কবি। যিনি একটি জাতির ইতিহাস হয়ে উঠছিলেন। সেকারণে সুভাষ বসুরা বুঝতে পারছিলেন।
নির্মলেন্দু গুণ: এত অল্প বয়সে তারা নজরুলকে নাগরিক সংবর্ধনা দিছেন..
রাজু আলাউদ্দিন: নাগরিক সংর্বধনা নাকি জনসংবর্ধনা?
নির্মলেন্দু গুণ: নাগরিক সংবর্ধনা বোধধহয়। এটা উদ্বোধন করছিল রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সংবর্ধনা পাইছেন নজরুল।
রাজু আলাউদ্দিন: রবীন্দ্রনাথের আরেকটা উক্তি আমার অসম্ভব রকমের ভালো লাগে। তিনি ওই অর্থে অত জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু নজরুল যে জনপ্রিয় হয়ে গেছেন এবং সেই সূত্রে উনি বলছেন যে, “জনপ্রিয়তা কাব্যবিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়। কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।”
নির্মলেন্দু গুণ: নজরুলভাষ্যে পাওয়া যায়, রবীন্দ্রভাষ্যে পাওয়া যায় না, রবীন্দ্রনাথ তাকে বললেন, হে উন্মাদ আমি তোর মধ্যে শেলি ও বাইরনের মতো ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি। তার জীবন নিয়ে তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করলেন। নজরুলের জীবনের উন্মাদনা দেখে।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, এটা আমার মনে আছে। মানে উন্মাদ হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল।
নির্মলেন্দু গুণ: ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, খোদার আসন আরশ ছেদিয়া.. তিনি যেমনভাবে স্রষ্টাকে প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন, এটা রবীন্দ্রনাথের দেখে মনে হইছে যে এ তো উন্মাদ।
রাজু আলাউদ্দিন: রবীন্দ্রনাথে সেই আশঙ্কাই পরে সত্য হলো আর কি।
নির্মলেন্দু গুণ: অনেকে বলবে, রবীন্দ্রনাথ তো জানেই তারে ওষুধ খাওয়ায়ে পাগল বানাবে, তাই আগেই এটা বলছে।

রাজু আলাউদ্দিন: আপনাকে একবার বলছিলাম না! সাধারণ মানুষের ভেতরে কত রকমের অদ্ভুত ধারণা এবং তাদের ফ্যান্টাসি করার যে শক্তি… আমিই তো ছোটবেলায় শুনছি যে, দ্যাখ, নজরুল এতবড় কবি হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথ এটা সহ্য করতে পারে নাই। তো এখন কী করবে? এই প্রতিদ্বন্দ্বী তো রাখা যায় না। পরে রবীন্দ্রনাথ তার এক আত্মীয়কে নজরুলের সঙ্গে বিয়ে করাইলেন। প্রমিলা দেবী। প্রমিলা দেবী নাকি রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়, হা হা হা। এবং সেই মহিলাকে দিয়ে নাকি নজরুলের মাথা নষ্টা করে দিছেন। এইসব মূর্খরা যদি জানত….
নির্মলেন্দু গুণ: তিনি ঘরে যে কালীর সাধনা করতেন, তার শ্বাশুড়ির পরামর্শে তিনি এই কালীসঙ্গীতগুলো রচনা করছেন। এরকম শোনা যায়। এটা হইতেও পারে। কারণ তিনি প্রমিলাকে ভালোবাসতেন। স্ত্রীর সাথে শ্বাশুড়িকেও যদি সন্তুষ্ট করা যায় মন্দ কী!
রাজু আলাউদ্দিন: আমার মনে হয়, শ্বাশুড়িকে উনি মায়ের মতো ভালোবাসতেন। কারণ, মায়ের প্রতি কিন্তু নজরুলের, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, মাকে নিয়ে তার কোনো আবেগ নাই। কবিতা নাই, কিচ্ছু নাই। এবং তার মা মারা গেছে, সে তো দেখতেও যায় নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: তার সাহিত্যে তো মা বাবার উল্লেখ নাই।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা একটা অজানা কারণ। আমি এখনো জানি না। তার মায়ের প্রতি বিন্দুমাত্র টান ছিল না। আমার মনে হয়, ওই অভাবটা তার শ্বাশুড়ির মাধ্যমে পূরণ করছে। এটা একটা কারণ হতে পারে আর কি।
নির্মলেন্দু গুণ: তার শ্বাশুড়িও তো সুন্দরী ছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন: সুন্দরী ছিলেন তার শ্বাশুড়ি?
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ সুন্দরী ছিল। তিনি নারী তো। আর সে তো কবি। তার কল্পনা তো বসে থাকে না। শ্বাশুড়ির সাথে তার যে সম্পর্কটা ছিল এটা আমার কাছে মনে হইছে রবীন্দ্রনাথে সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর যে সম্পর্ক ছিল, ওই রকম ছিল। তিনি তার কবিতাগুলো শুনাইতেন, কাদম্বরী দেবী খুশি হতেন। নজরুল গান লিখতেন। শ্বাশুড়িকে খুশি করার জন্য হয়ত লিখতেন। গান তো আর বানায়ে লেখা যায় না, ভেতর থেকে না আসলে। আর গানগুলোও তো উচ্চমানের।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, এটা হতে পারে। আপনি যে মিলটার কথা বললেন, কাদম্বরী রবীন্দ্রনাথের এবং নজরুলের সঙ্গে তার শ্বাশুড়ির।
নির্মলেন্দু গুণ: প্ররোচিত করা, উজ্জীবিত করা আর কি।
রাজু আলাউদ্দিন: অদ্ভুত ব্যাপার, যে মুসলমানরা এই মিথ বানাইছে, তারা যদি সত্যি সত্যি জানত যে নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের কী পরিমাণ ভালোবাসা ছিল.…
নির্মলেন্দু গুণ: এটার জন্য ওই বইটা ছাপার দরকার। এতে নজরুল রবীন্দ্রনাথের বিতর্কের অবসান হবে। রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে বাংলা একাডেমি থেকে একটা বিশেষ সংখ্যা বের হয়েছিল। কে লিখেছিল নামটা আমি ভুলে গেছি। সেখানে একটা তথ্য পাইছিলাম যে, শহীদুল্লাহ সাহেব নজরুলকে নিয়ে গেছিলেন। ট্রেনে তিনি গীতাঞ্জলির সমস্ত গানগুলি তিনি শহীদুল্লাহ সাহেবকে শোনাইছেন। এরপর তারা যখন রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলেন, তিনি বললেন যে, এই যে আপনার নজরুল। সে তো আসার সময় আপনার পুরো গীতাঞ্জলি শোনাল আমাকে। তখন রবীন্দ্রনাথ তাকে বুকে জড়ায়ে ধরে বললেন, এ তো পাগল! আমার লেখা আমারই তো মনে থাকে না। এটার একটা সুন্দর বর্ণনা আছে। এটা পড়লে লোকে বুঝতে পারবে যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্কের সূত্রটা কিভাবে তৈরি হয়েছিল।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি একটা জিনিস নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, অদ্ভুত ব্যাপার, তখন অনেক বামপন্থী কবি ছিলেন, বামপন্থী লেখক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছেন– গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস ইউ। তারপরে চিঠি লিখতেছেন। নজরুলের পক্ষে ওকালতি করতেছেন মানে নজরুল যে কবি, নজরুলকে তোমরা মনোযোগ দিয়ে পড়ছ না, এইসব ওকালতি করতেছেন। কিন্তু বামপন্থী কবিরা দেখেন, তাদের কিন্তু লেখা টেখা নাই নজরুল সম্পর্কে। বিষ্ণু দের কোনো মন্তব্য নাই নজরুল ইসলাম সম্পর্কে। সুধীন দত্ত বামপন্থী ছিলেন না, কিন্তু তার কোনো মন্তব্য নাই। অমিয় চক্রবর্তীর কি আছে? আমার মনে হয়, নাই। অমিয় চক্রবর্তীর নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: এই যে আমি একটা জিনিস খুঁজে বের করলাম। নজরুলের বিবেচনা বোধহয় এরকম ছিল। আমি আমার বিবেচনা থেকে বলছি। আমি যখন ঢাকায় চলে আসলাম, আমার বাবা আমাকে টাকা দিলেন ইন্ডিয়াতে চলে যাওয়ার জন্য। আমার মনে হলো একটা পারিবারিক শোককে কেন্দ্র করে আমার মধ্যে জীবন নামক যে শিল্পবস্তুটির বিকাশ ঘটেছে তার সত্তার উপর আমারই একচ্ছত্র অধিকার। অন্যদের যাদের জীবনের সঙ্গে জন্মসূত্রে সংশ্লিষ্ট, তাদের প্রতি সময় পেলে সম্ভব হলে আমি আমার বিবেচনা মতো কর্তব্য পালন করব। কিন্তু তা আমার জন্য বাধ্যতামূলক হতে পারে না। নশ্বর জীবনের গায়ে কিছুটা হলেও অনশ্বরতার ছোঁয়া লাগানোর সাধনাই হবে আমার সাধনা। আমার পরিবার যদি সে পথের অন্তরায় হয়, আমি পরিবারকে ত্যাগও করতে পারি। সেই অধিকার আমার আছে। আমার মনে হলো পরিবার একটা ছোট জিনিস। ডিমের খোসা থেকে বেরিয়ে আসা পক্ষী শাবকের মতো মানুষকেও এক পর্যায়ে পরিবারের খোলস থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়। পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার ধারণাটি খুবই আপেক্ষিক এবং শর্তসাপেক্ষ বলেই আমার মনে হয়। ভালোবাসা, স্নেহ, মায়ামমতার ছদ্মবেশে এটি তৃতীয় বিশ্বের মানুষের মধ্যে চালু একটি অতিশয় দরিদ্র ধারণা। এই ধারণা পাল্টাতে হবে। এইসব দীন ধারণার হাত থেকে প্রাচ্যের মানুষের মনকে মুক্ত করতে হবে। পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে এই ধারণার অবসান ঘটেছে বলে তারা বড় কিছু করতে পারছে। আমারও তেমনটি করার চেষ্টা করা উচিত। এইভাবে নিজেকে বুঝিয়ে পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘনের পক্ষে নিজের মনে আরো যুক্তি সংগ্রহ করে আমি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। পিতৃআজ্ঞা পালনের জন্য রাম বনে গিয়েছিলেন। আর আমি পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘন করে চললাম ঢাকার পথে। এখানেই বাল্মিকীর রামের সাথে আমার রামের পার্থক্য।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা কার কথা?
নির্মলেন্দু গুণ: এটা আমার কথা।
রাজু আলাউদ্দিন: ও, আপনার কথা! আচ্ছা আচ্ছা। বাহ! সুন্দর।
নির্মলেন্দু গুণ: নজরুল বোধহয় এরকম ভেবেছিলেন। পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখাটা হয়ে ওঠেনি তার। এ জন্য তিনি ময়মনসিং চলে আসলেন। আমার বাবা যেমন আমার সন্ধান না পাইয়া বিভিন্ন পত্রিকায় চিঠি লিখত, নজরুলের বাপ ছেলের জন্য চিঠি লিখবে সেরকম সুযোগ তো ছিল না। তিনি আসানসোলের দোকান থেকে চলে আসলেন ময়মনসিং-এ। পরিবারের সাথে তার কোনো যোগই নাই। তিনি তার পরিবারের কাছে, চুরুলিয়ায় ফিরে গেছেন এরকম তথ্যও পাওয়া যায় না। তার মানে তিনি তার পরিবারের সাথে সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভূর মতো আচরণ করেছেন। অচ্ছা এরপরে আরো একটু লেখা আছে: “ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। ঢাকা ক্রমশই বড় হচ্ছে। এখন ঢাকাকে কেন্দ্র করে কলকাতার বিকল্প একটা নতুন সাহিত্য পরিমণ্ডল গড়ে উঠতে শুরু করেছে। পাকিস্তানবাদী সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের ধারাটি এখন আর ঢাকাকেন্দ্রীক সাহিত্য আন্দোলনের মূল ধারা নয়। ওই ধারাটি এখন গৌণ ধারায় পরিণত হয়েছে। ক্রমে সেক্যুলার সাহিত্যের ধারাটি এখানে প্রবল হয়ে উঠবে তার লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। সুতরাং কলকাতা নয়, ঢাকাই হোক আমার কর্মক্ষেত্র।” আমি এইভাবে লিখছি আমার পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতি, ঢাকায় আসার আগে আমার ছোট চিন্তায়।
রাজু আলাউদ্দিন: বাহ! ভালো তো। এত বছর আগেই আপনি এই জিনিসগুলি সঠিকভাবে দেখতে পারছেন। এটা ফ্যান্টাসটিক। খুব ভাল্লাগল।

নির্মলেন্দু গুণ: তখন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ কণ্ঠস্বরের মতো কাগজ বের করছে। সেখানে তরুণদের বিদ্রোহ, হাঙরি জেনারেশন– পাকিস্তানবাদিতা মানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আধুনিকমনষ্ক কবি সাহিত্যিকদের জন্ম হচ্ছে এখানে। তাই আমার মনে হয়েছিল, এখানে আমার আত্মপ্রকাশের পথে কোনো বাধা থাকবে না। যদিও আমার শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি বাধাগ্রস্ত হইছি, কিন্তু এর বিপরীতে আমার সাহিত্যের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে না এটা বুঝেছিলাম।
রাজু আলাউদ্দিন: তো এখন কি মনে হচ্ছে না যে একটা ভবিষ্যদ্বাণী তার সাফল্য হারাচ্ছে? মানে আপনি যে বলছিলেন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে উঠবে, সেটা গড়ে উঠছিল…
নির্মলেন্দু গুণ: গড়ে ওঠার পরে এটা যে আক্রমণের মুখে পড়েছে, তারপরেও কিন্তু এইটেই সাহিত্যের মূলধারা।
রাজু আলাউদ্দিন: এটা সাহিত্যের মূলধারা– এ নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু জনগণমন জগতে সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা কি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে না?
নির্মলেন্দু গুণ: ক্ষয় হচ্ছে। সেটা আমি বলছি। যেমন আল মাহমুদের ক্ষেত্রে যেটা ঘটল, গত আলোচনায় আমরা এটা বলছিলাম যেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে গেল, তখন কারো কাছে মনে হলো একটা দুর্বল মুসলিম রাষ্ট্র তৈরি হলো। একটা দুর্বল মুসলমান রাষ্ট্র, তার চারদিকে.. এই যেমন মায়ানমার। সো হোস্টাইল মায়ানমার। আমাদের ভাবনায় তো ছিল মায়ানমার এত হোস্টাইল হতে পারে না। সেদিন টেলিভিশনে এক আলোচনায় দেখলাম আসামে অনেক বাংলাদেশি মুসলমান বাস করে। আসামের মধ্যে যারা নন আসামি বাঙালি, আসামে কিন্তু বাঙালি খেদাও আন্দোলনের একটা ধারাবাহিকতা কিন্তু আছে। সেই ধারাবাহিকতায় আসাম থেকে বাঙালি মুসলমানরা কিন্তু আগেও বিতাড়িত হইছে। রোহিঙ্গাদের মতো। এতটা অত্যাচারিত হয় নাই। বা হইছিল কিন্তু এখন আমরা তথ্যপ্রযুক্তির কারণে যতটা জানতে পারি, তখন হয়ত জানতে পারি নাই। আসাম থেকে বিতাড়িত মুসলমানরা আমাদের গ্রামে আসছে। আমার ছেলেবেলা বইতে আছে, তাদের সাথে আমার কথা হইছে। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নতুন সম্পর্ক। নতুন মসজিদ তৈরি হইল। নতুন করে আমাদের গ্রামে আজান হইল। মুরগির ডাক শোনা গেল। সেই সময় আমাদের বাড়িতে মহিলারা পানি নিতে আসছে। তারা সুন্দরী ছিল। আমি পানি ভরে দিতাম। তাদের সৌন্দর্য দেখার জন্য আমি পানি ভরে দিতাম। মা আমাকে বলত, তুই পানি ভরে দিস কেন! ওরা ভরতে পারে না! কিন্তু আমি মনে মনে ভাবতাম যে, মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুদের চেয়ে ভিন্ন সৌন্দর্য আছে। তারা নাকে নথ পরে। আমার আলাদা রকম একটা ভালোলাগা আছে। এসব তো আর মাকে বলতে পারি না। তো আমাদের গ্রামে নতুন মুসলমান যারা আসছিল, তারা সবাই আসছিল আসাম থেকে। এখন আমরা যে স্কুল করছি সেই স্কুলের যিনি হেডমাস্টার তিনি হচ্ছেন আসাম থেকে আসা রুস্তম মাস্টার, যার কাছে তখন ইংরেজি শিখেছিলাম, তার ছেলে। আমার ছেলেবেলা বইতে আছে। আসাম থেকে তারা বিতাড়িত হয়ে আসছে, এটা রোহিঙ্গাদের মতোই কিন্তু। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, আসামের মুসলমানদের সঙ্গেও কিন্তু বাংলাদেশের সম্পর্কটা একই রকম। রোহিঙ্গাদের আরাকানে যেমন একসময় রাজসভা ছিল, আসামে ওরকম কোনো রাজসভা ছিল না। আসামের দৌলত কাজী, আলাওলের সন্ধানও আমরা পাই না। কিন্তু আসাম যেহেতু বর্ডারিং, আসামে প্রচুর বাংলাভাষাভাষি মানুষ বাস করে। আসামের শিলচরে তো একটা ভাষা আন্দোলনই হইল। সেখানে বারোজন মারাও গেল। এরা সবাই কিন্তু হিন্দু। সিলেটি হিন্দু। তারা সিলেটের ভাষায় কথা বলে। সিলেটিরা শিলচর, আগরতলা, ত্রিপুরা এগুলো দখল করছে আর কি। তাদের বিতাড়িত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু আসামি মুসলমানদের বিরুদ্ধে, তাদের উপর আসামিদের একটা ক্ষোভ আছে– বাঙ্গালি খেদাও। তারা মুসলমান খেদাও বলে না। তারা বলে বাঙ্গালি খেদাও। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও মুসলমান খেদাও এটা কিন্তু বলে না। রোহিঙ্গা খেদাও। তারা বলে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক। তো এই সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় নাই যে আসাম থেকে এক ধরনের আন্দোলন হইতে পারে। বা মায়ানমারকে যদি শাস্তি দেয়া না যায় তাহলে আসামিরা উৎসাহিত হবে, মায়ানমার যখন রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলমান উৎখাতে সাকসেস হলো, তাহলে আমরা কেন মুসলমানমুক্ত আসাম গড়ে তুলি না!
রাজু আলাউদ্দিন: তবে আসামের বাঙালি খেদাও-এর সাথে রোহিঙ্গাদের ছোট্ট একটা পার্থক্য আছে। সেট হলো, ওরা কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনি বা মিয়ানমারের লোকদের মতো এত নিষ্ঠুর আচরণ করেনি। নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ এগুলো করেনি। সেই কারণে আমরা বোধহয় এটা জানি কম।
নির্মলেন্দু গুণ: রাখাইনের ব্যাপারও কিন্তু আমরা আগে এতটা জানতাম না। আগে যে ঘটনাগুলো ঘটছে এগুলো আমাদের সকলের জানাও নাই। সেভেনটি এইটে যে আসছিল তারা, হাসিনা যে টিভিতে বলল যে, এই রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করেছে জিয়াউর রহমান। এই সমস্যা কখন তৈরি হয়েছিল এটা সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নাই। কারণ, তারা আগে কখন আসছিল এটা আমাদের মধ্যে বড় নিউজ আকারে আসে নাই। উদ্বেগ আকারে আসে নাই। সামান্য সংখ্যায় আসছিল আর কি। ইন্টারেস্টিং হইল, ছফা ভাই কিন্তু হুদা ভাইকে রোহিঙ্গা বলত। কবি নূরুল হুদা।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ হ্যাঁ। এইটা আমার মনে আছে।
নির্মলেন্দু গুণ: আর মহিউদ্দীন সাহেব আমাকে বলছিল, কী এমন চিটাগাং আসলেন যে বার্মায় যাবেন না! এটা একটা কথা হইল! চলেন বার্মা থেকে ঘুরে আসি। আমাদের সবারই তো ওখানে বউ আছে। রোহিঙ্গা যায় সাম্পানের মধ্যে, ভাত রান্না হয়, আরাকানে যাইতে চারপাঁচ দিন লাগে। সাম্পান নিয়ে একটা গান আছে। চিটাগাঙের বউ গান গাইতেছে স্বামীর উদ্দেশে। চিটাগাঙের অধিকাংশের দুইটা সংসার আছে। একটা হইল আরাকানে। আরেকটা হইল চিটাগাঙে। একজনের সংসার সম্পর্কে আরেকজনের কোনো ধারণা নাই। এখন যারা আসছে, অনেকেরই আত্মীয় আছে বাংলাদেশে। অনেকে বলতেছে তো, আমরা খবর দিছি যে তোমরা আইসা পড়।
……………………………
নির্মলেন্দু গুণ: কাফকার উপর সেদিন জাহিদুল হক খুব জোর দিল টেলিভিশনে শিল্পবাড়ি একটা প্রোগ্রামে। কাফকা ফুটবল প্লেয়ার ছিল না?
রাজু আলাউদ্দিন: না মনে হয়। আমি তো এমন কিছু পাইনি। আপনি বোধহয় আলবেয়ার কামুর কথা বলতেছেন।
নির্মলেন্দু গুণ: ও আলবেয়ার কামু। কাফকা তো জার্মান, না?
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ জার্মান।
নির্মলেন্দু গুণ: আর আলবেয়ার হলো আলজেরিয়ান।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, আলজেরিয়ান। যদিও পরে ফ্রান্সে .
নির্মলেন্দু গুণ: হি ওয়াজ এ ফুটবলার।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, হি ওয়াজ এ ফুটবলার। ঠিকই আছে এটা।
নির্মলেন্দু গুণ: কাফকার তো ম্যাটামরফসিস।
রাজু আলাউদ্দিন: ম্যাটামরফসিস, দ্য ক্যাসেল, দ্য আমেরিকা, ট্রায়াল..।
নির্মলেন্দু গুণ: কাফকার ডায়রি পড়ছি। তার একটা ডায়রি বের হইছিল মৃত্যুর পরে। তবে আমার পড়া মানে চোখ বুলানো।
রাজু আলাউদ্দিন: আপনার চোখ বুলানো তো পড়ার অধিক। হা হা হা।
নির্মলেন্দু গুণ: চোখ বুলায়ে যদি কাজ না হয় তাহলে পড়েও কাজ হয় না। হা হা হা।
রাজু আলাউদ্দিন: খুবই সত্যি। আপনার কি মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে এতগুলো বই, ধরা যাক আনা কারেনিনাবা ওয়ার এন্ড পিস-এর মতো বই পুরাটা পড়ছে? পড়ে নাই।
নির্মলেন্দু গুণ: রবীন্দ্রনাথ যা পড়াশোনা করছেন, তার শৈশবকালে।
রাজু আলাউদ্দিন: না, আমি বৃদ্ধ বয়সের কথা বলছি। বৃদ্ধ বয়সে মোটা মোটা বই, আমার মনে হয় না উনি সবটুকু পড়তেন। আমার মনে হয় ওই রকম বড় লেখক, তাদের পুরাটা পড়ার দরকার হয় না।
নির্মলেন্দু গুণ: যারা বেশি পড়ে, তারা তো শেষে অধ্যাপক অথবা সমালোচক হয়ে যায়। তাদের পক্ষে আর ক্রিয়েটিভ থাকা সম্ভব হয় না। তারা গ্রামের ডাক্তার, যারা মেডিকেল সম্পর্কে জানার পরেও অপারেশন করতে পারে না, তারা ওই রকম হয়ে যায়।
রাজু আলাউদ্দিন: ব্যতিক্রমও কিন্তু আছে গুণদা। যেমন ধরেন, বোর্হেসের মতো লেখক অসম্ভব পড়ুয়া ছিলেন। সে তো সাংঘাতিক ক্রিয়েটিভ।
নির্মলেন্দু গুণ: আচ্ছা, আপনার তো ম্যাক্সিকান পোয়েট্রি, কিছু কবিতা দেয়ার কথা ছিল। আমি তো ইটালি থেকে একটা ছেলের মাধ্যমে অরিজিনাল ইটালিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ, তারপরে ট্রান্সট্রোমারের কবিতা ইন অরিজিনাল সুইডিশ এগুলো কালেক্ট করতেছি। অরিজিনাল ভাষার বই থাকা উচিত। জাপান থেকে একজন আসতেছে, জাপানি ভাষার বই নিয়ে আসতেছে। বিদেশ থেকে কেউ ফোন করলেই আমি তাকে প্রথম দায়িত্ব দিই, তোমার টাকা পয়সা দিতে হবে না, তুমি আমারে বই দাও। কারণ, আমার টাকা আছে কিন্তু বই নাই। গিভ মি সাম মেক্সিকান পোয়েট্রি।

রাজু আলাউদ্দিন: আমি দেব। দেব। মেক্সিকান পোয়েট্রি না হইলেও আমি আপনাকে স্প্যানিশ বই দেব।
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, ইসলামি বই দিলেও হবে। ইসলামি বই বলতে পারস্য, ইসলামের গৌরবের জায়গা তো পারস্যেই।
রাজু আলাউদ্দিন: না না। আমি বলছি ‘স্প্যানিশ’। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা বই দেব।
নির্মলেন্দদু গুণ: ও স্প্যানিশ! আমি বলছি, আরবি ভাষা নয় কিন্তু ইসলামের গৌরব মূল্যায়নে সাহিত্য-শিল্প বিচারে সেখানে বিশ্বমানের যে কয়জান লেখক আছে সবই তো ফার্সি।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, সবই ফার্সি।
নির্মলেন্দু গুণ: খলিল জিবরান বোধহয় একমাত্র ভালো লেখক, আরবি ভাষায় লিখছে।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ লেবাননের। লেবানিজ।
নির্মলেন্দু গুণ: আরবরা তো কেউ..
রাজু আলাউদ্দিন: না। সৌদি আরবের কোনো বড় লেখক নাই। একমাত্র ইমরুল কায়েস আর প্রাচীন যুগের কয়েকজন কবি আছে। ইমরুল কায়েসের কবিতা তো মনে হয় আপনি পড়ছেন, তাই না?
নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ হ্যাঁ।
রাজু আলাউদ্দিন: ওই কবিতা পড়লে মনে হয় আপনি যেন তারই পুনর্জন্ম… এমন কবিতা আছে তার। “অনেক রমনী আছে মুরগির ডিমের মতোন দেহের সৌষ্ঠব”, বুঝছেন! আরো বলতেছেন, এমনকি শত্রুর ভয় উপেক্ষা করে আমি মিলিত হয়েছি তাবুতে, শত্রুর তাবুতে গিয়ে রমনীর সাথে। এই রকম অদ্ভুত সব কবিতা।
নির্মলেন্দু গুণ: যেমন কৃষাণ বধুর সঙ্গে নেরুদা মিলিত হইছিল, তাই না?
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ হ্যাঁ। গমক্ষেতে প্রেম। আপনার মনে আছে দেখছি।
নির্মলেন্দু গুণ: আমার নিজেরই তো এই অভিজ্ঞতা আছে। আমরা গ্রামের মানুষ তো। গমক্ষেত বা যে কোনো আড়াল দরকার হতো। যা বিশ্বস্ত আড়াল তৈরি করে। এবং পাটক্ষেত। পাটক্ষেত অনেক উঁচু হয় ডিপেন্ডলি ইউজড বেড, ইন্টেলিজেন্ট পিপল অব দ্য ভিলেজ অব দ্য ফারমার ফোকস। তারা এইগুলি করে আর কি।
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ হ্যাঁ।



Source: https://arts.bdnews24.com/?p=15833