‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি অন্তরসমূহকে হেদায়াত দিয়েছেন। ঈমানের মাধ্যমে অন্তরসমূহের উন্নতি ঘটে। তিনি আমাদের চাহিদামতো নেয়ামতসমূহ দিয়েছেন।’
আমি আমাকে ও আপনাদেরকে তাকওয়া অবলম্বন তথা আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি। ‘হে যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’
আল্লাহ এ বিশ্ব প্রকৃতিকে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। মানুষের মনে ঢেলে দিয়েছেন সীমাহীন আশা-আকাক্সক্ষা। এ আশা-আকাক্সক্ষার পরিমাণ কারো মধ্যে কম, আর কারো মধ্যে বেশি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আদম সন্তান যদি একটি উপত্যকা পরিমাণ খেজুর গাছের মালিক হয়, সে অনুরূপ আরেকটি উপত্যকার মালিক হতে চায়। অতঃপর আরেকটির, এভাবে সে অনেক উপত্যকার মালিক হতে চায়। আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে পূর্ণ হওয়ার মতো নয়।’
সব ভালো চাওয়াই প্রশংসনীয়। মন্দ বিষয় চাওয়া, অসম্ভব কিছু চাওয়া নিন্দনীয়। ভালো চাওয়া প্রমাণ করে মানুষের উচ্চাকাক্সক্ষার। ভালো চাওয়ার আকাক্সক্ষা মানুষকে সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছায়। বিপরীত দিকে কোনো কোনো চাওয়া মানুষকে অসম্মান ও অমর্যাদার গভীর গর্তে নিপতিত করে। উমর রা: একদিন তাঁর সাথীদের সাথে বসা ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি বললেন, তোমাদের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করো। একজন বললেন, এই ঘরটি যদি স্বর্ণে ভরা থাকত, তাহলে তা আমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতাম। তিনি আবার বললেন, আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটাও। একজন বললেন, এ ঘরটি যদি মুক্তা বা হীরায় ভরা থাকত তাহলে আমি তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতাম ও সাদকাহ করে দিতাম। তিনি আবার বললেন, তোমরা তোমাদের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করো। তারা বললেন, আপনি আসলে কী চান? তিনি বললেন, আমি চাই এ ঘরটি যদি আবু উবাইদাহ বিন আল-জাররাহ, মু‘আজ বিন জাবাল, সালিম ও হুজাইফার মতো লোকদের দিয়ে ভরা থাকত। একবার একটি কক্ষে মুসআব বিন জুবাইর, উরওয়াহ বিন জুবাইর, আবদুল্লাহ বিন জুবাইর এবং আবদুল্লাহ বিন উমার রাদিআল্লাহু আনহুমা একসাথে বসা ছিলেন। এমন সময় কেউ বলল, তোমরা তোমাদের মনের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করো। আবদুল্লাহ বিন জুবাইর রাদিআল্লাহু আনহুমা বললেন, আমি খলিফা হতে চাই।
উরওয়াহ রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, আমি চাই লোকজন আমার কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করবে। মুসআব রা: বললেন, আমি ইরাকের শাসক হতে চাই। আবদুল্লাহ বিন উমার রাদিআল্লাহু আনহুমা বললেন, আমি আল্লাহর ক্ষমা লাভ করতে চাই।
উমার বিন আবদুল আজিজ রাহি: বলেন, আমার মনে ছিল বিভিন্ন আকাক্সক্ষা। আকাক্সক্ষা ছিল ফাতিমা বিনতে আবদুল মালিককে বিয়ে করার, আমি তাকে বিয়ে করেছি। আকাক্সক্ষা ছিল গভর্নর হওয়ার, হয়েছি। আকাক্সক্ষা ছিল খলিফা হওয়ার, হয়েছি। আমার চূড়ান্ত আকাক্সক্ষা জান্নাতের। আশা করি জান্নাতও লাভ করব ইনশা আল্লাহ।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! ভালো আশায় রয়েছে বড় ধরনের সওয়াব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার ধরনের লোকের উল্লেখ করে বলেছেন, একজনকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, শিক্ষাও দিয়েছেন, সে তার শিক্ষা অনুযায়ী আমল তথা কাজ করে। সম্পদ সঠিক ক্ষেত্রে খরচ করে।
আরেকজনকে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন, সম্পদ দেননি। সে বলে, আল্লাহ যদি আমাকে তার মতো সম্পদ দিতেন, আমিও তার মতো সম্পদকে কাজে লাগাতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারা দু’জনই সমান প্রতিদান পাবে।
অন্য একজনকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, শিক্ষা ও বিদ্যা দেননি। সে সঠিকভাবে সম্পদ খরচ করে না।
অপরজনকে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কিন্তু সম্পদ দেননি। সে বলে, আমার যদি সম্পদ থাকত তাহলে আমি তার মতো করে সম্পদ খরচ করতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারা দু’জনই একই ধরনের পাপের অধিকারী হবে।
নিছক আশা-আকাক্সক্ষার কোনো মূল্য নেই। আশা-আকাক্সক্ষার সাথে খাঁটি নিয়ত ও তার সাথে উত্তম আমলের প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমার দিকে অগ্রসর হও।’
ভালো আশা-আকাক্সক্ষা এক ধরনের দোয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন আশা-আকাক্সক্ষা করে, সে যেন তা করে বেশি করে। কেননা এর মাধ্যমে সে মূলত তার রবের কাছে প্রার্থনা করে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কিছু আশা করে সে যেন ভাবে সে কী আশা করছে।’
ইসলাম নেতিবাচক কোনো কামনা ও আকাক্সক্ষাকে সমর্থন করে না। তাই মন্দ ও অন্যায় কোনো বিষয় কামনা করা যাবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন বিপদগ্রস্ত হলে মৃত্যু কামনা না করে। যদি বলতেই হয়, তাহলে বলবে, ‘হে আল্লাহ! জীবন যদি আমার জন্য কল্যাণকর হয় তাহলে আমাকে জীবিত রাখো। আর যদি মৃত্যু আমার জন্য কল্যাণকর হয়, তাহলে আমাকে মৃত্যু দাও।’
আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা ভালো আশা-আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার বান্দার কাছে তার ধারণা অনুযায়ী।’ এর তাৎপর্য হলো বান্দাহ আমার ব্যাপারে যে ধরনের ধারণা পোষণ করে আমি তা করতে সক্ষম। আল্লাহর ব্যাপারে যখন বান্দার সুধারণা থাকে তখন আশা-আকাক্সক্ষা হয় অতি মর্যাদাসম্পন্ন। সে তখন আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত ও অনুগ্রহের অনুভূতি নিয়ে তার আশা-আকাক্সক্ষাকে সাজায়। সে কারো প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে না। অন্যের কাছে যা আছে তা পেতে চায় না।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের কারো কারো ওপর যে অনুগ্রহ দিয়েছেন, তোমরা তোমাদের জন্য তা কামনা করবে না।’ একজন প্রকৃত মুসলিম এ বাস্তব সত্য উপলব্ধি করবে যে, আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে শুধু আল্লাহর ইচ্ছায়। অতএব, সে অস্থির হবে না। দুশ্চিন্তা করবে না। আল্লাহ যা করেন তার মধ্যেই প্রকৃত কল্যাণ। সে সব অবস্থায় আল্লাহর শোকর আদায় করবে।
আল্লাহ বলেন, ‘এমন বিষয় রয়েছে যা তুমি অপছন্দ করো অথচ সেটিই তোমার জন্য কল্যাণকর, আবার এমন বিষয় রয়েছে যা তুমি পছন্দ করো অথচ সেটি তোমার জন্য মন্দ ও অশুভ। প্রকৃত বিষয় তো আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’
ইবলিস হলো সব মন্দ আশা-আকাক্সক্ষার উৎস। সে অঙ্গীকারবদ্ধ যে, আল্লাহর বান্দাদেরকে মিথ্যা ও অলীক আশা-আকাক্সক্ষার সাগরে ডুবিয়ে রাখবে। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে শয়তানকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে সে সুস্পষ্টভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে তো তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় আর আশা-আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে। শয়তানের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা বৈ কিছু নয়।’
মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা যদি আখিরাতমুক্ত হয়ে শুধু পার্থিব বিষয় নির্ভর হয়, তাহলে সে নিশ্চিতভাবে পথভ্রষ্ট হবে। সঠিক পথ থেকে তার পদস্খলন ঘটবে।
আল্লাহ বলেন, ‘যে দ্রুত বিষয় তথা দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ পেতে চায়, আমি তাকে এখানে তার জন্য যতটুকু দিতে চাই সত্বর দিয়ে দেই। পরিশেষে তার জন্য জাহান্নামই নির্ধারণ করে রাখি, যেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত, অপমানিত ও বিতাড়িত অবস্থায়। অপর দিকে যারা আখিরাত চায় এবং তা পাওয়ার জন্য যে পরিমাণ চেষ্টা করা উচিত, তেমনভাবেই চেষ্টা করে, আর সে হয় মুমিন, তারাই হচ্ছে এমন লোক যাদের চেষ্টা-সাধনা আল্লাহর দরবারে স্বীকৃত হয়।’
কর্মবিহীন আশা-আকাক্সক্ষা হলো স্বপ্নের ঘোর। এ ধরনের আশা-আকাক্সক্ষার কোনো ফলাফল নেই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তো সে-ই যে নিজের নফ্সকে অনুগত করে রাখে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে। আর ব্যর্থ তো সে, যে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে আর আল্লাহর কাছ থেকে আশা করে। যে আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য অবৈধ পথ ও পন্থা অনুসরণ করে, সে মূলত নিজের ওপরই অবিচার করে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে গণক বা জাদুকরের কাছে আসে এবং সে যা বলে তা বিশ্বাস করে, সে প্রকারান্তরে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করে।
মৃত্যু-পরবর্তী জীবন শুরু হয় কবরের মাধ্যমে। কবরের জীবনেও আশা-আকাক্সক্ষা চলতে থাকে। কবরে মুমিনের আকাক্সক্ষা হলো যেন কিয়ামত সংঘটিত হয়, তাহলে তার জন্য প্রতিশ্রুত সুখ ও নিয়ামত উপভোগ করতে পারবে। আর কাফিরের কামনা হলো যেন কিয়ামত সংঘটিত না হয়। কেননা কিয়ামাত সংঘটিত হলেই তাকে পীড়াদায়ক শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
মৃত ব্যক্তি কামনা করবে পৃথিবীর জীবনে ফিরে গিয়ে করতে না পারা ভালো কাজগুলো করতে; সম্ভব হলে দু’রাকাত সালাত আদায় করতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কবরটি কার? লোকজন বলল, এটি অমুকের কবর। তিনি বললেন, তোমাদের গোটা পৃথিবীর তুলনায় তার কাছে দু’রাকাত সালাত উত্তম।
মৃত ব্যক্তি চাইবে পৃথিবীতে ফিরে এসে সাদকাহ করতে, আল্লাহর জিকর করতে, অন্তত একবার সুবহানাল্লাহ অথবা একবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে খরচ করো তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগে। কেননা সে তখন বলবে, ‘হে আমার রব! যদি তুমি আমার মৃত্যুটা পিছিয়ে দিতে তাহলে আমি সাদকাহ করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’
সবচেয়ে পীড়াদায়ক আকাক্সক্ষা হবে কিয়ামতের দিন শাস্তির সম্মুখীন হয়ে আল্লাহর অবাধ্য কাফিররা মাটিতে পরিণত হতে চাইবে।
আল্লাহ বলেন, ‘এই দিন সত্য। কেউ ইচ্ছা করলে নিজের মালিকের কাছে নিজের জন্য একটা আশ্রয় খুঁজে নিতে পারে। আমি আসন্ন আজাব সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করেছিলাম। সে দিন মানুষ দেখতে পাবে তার হাত দুটি এ দিনের জন্য কী কী জিনিস পাঠিয়েছে। অস্বীকারকারী ব্যক্তি তখন বলে উঠবে, হায়! কত ভালো হতো যদি আমি আজ মাটি হয়ে যেতাম।’
আমি আমাকে ও আপনাদেরকে আল্লাহকে ভয় করে চলার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। ভালো আশা-আকাক্সক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা হলো জান্নাতবাসীর জান্নাতপ্রাপ্তি। আল্লাহ তাদেরকে সেখানে তাদের মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেবেন।
সর্বশেষ যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাকে বলা হবে তোমার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করো। সে তার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করবে। তাকে বলা হবে, তুমি যা আকাক্সক্ষা করেছ, তা দেয়া হলো। শুধু তাই নয়, বরং তার চেয়ে দশগুণ বেশি দেয়া হলো।
Source :dailynayadiganta.com/detail/news/270959