Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - akazad600

Pages: [1] 2 3
1
আমার ছোটবেলার কথা বলছি। সে সময় আমাদের এলাকার কেউ প্রসব ব্যাথা বা অ্যপেন্ডিক্সের ব্যাথার ছটফট্ করছে কিংবা হঠাৎ কারো কোনো ভয়াবহ শারিরীক অসুস্থতা, অথচ বাইরে তুষার ঝড় হচ্ছে না এমন কখনো হয়েছে আমার মনে পড়ে না। রাস্তা বন্ধ, গাড়ী চলার প্রশ্নই ওঠে না। রুগী শহরের হাসপাতালে নেবার জন্য তখন ঘোড়াই ছিল একমাত্র ভরসা। ভাগ্যিস তখনও সহজেই ঘোড়া পাওয়া যেত আশেপাশে।

স্বাভাবিকভাবেই আমার পেটের একপাশে যখন ব্যাথা শুরু হল তখন রাত এগারটা এবং বাইরে চলছে তুষার ঝড়ের তান্ডব। আমরা কোন ঘোড়া পালতাম না, তাই প্রতিবেশীদের ডেকে তুলতে হল ঘোড়ায় করে আমাকে হাসপাতালে নেবার জন্য। রাস্তা মোটে দেড় মাইল কিন্তু সে রাস্তা পাড়ি দেয়া এক অভিযান যেন। হাসপাতালে ডাক্তার অপেক্ষা করছিল আগে থেকেই এবং সবাই যেমন ভেবেছিল তেমনই হল। তোড়জোড় শুরু হল আমার অ্যপেন্ডিক্স অপারেশনের।

মাঝে মাঝে ভাবি, সে সময় কি এরকম আরো অ্যপেন্ডিক্স অপারেশন হত? এখন যে প্রচুর হয় তা জানি, এমনকি একজনের কথা জানি যার অপারেশনটা ঠিক সময় না হওয়াতে তাকে বাঁচানোই যায়নি। তবে আমার যতধুর মনে পড়ে আমার বয়সের কারো কারো এই অপারেশনটা করাতে হত। সংখ্যায় খুব একটা বেশী ছিল না যদিও। আর মনে হয় খুব একটা অপ্রত্যাশিত বা দুঃখজনকও ছিল না কারণ অপারেশনটা হওয়া মানেই ছিল স্কুল থেকে ছুটি। আবার ব্যাপারটার সাথে এক ধরনের মর্যাদা যুক্ত ছিল– অন্যদের চেয়ে আলাদা একটা অবস্থান পাওয়া। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার স্বস্তি।

আর বাকী সবকিছু মিলিয়ে ব্যাপারটার একধরনের তৃপ্তি ছিল যেন।

অ্যপেন্ডিক্সবিহীন আমি বেশ কিছু দিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকলাম, আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম চিরহরিৎ গাছগুলোর মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া বিষণ্ন পথটা জুড়ে বরফ পড়ার দিকে। এই বিশেষ বিলাসিতার টাকাটা বাবা কোত্থেকে জোগাড় করবে সেটা চিন্তা বোধ হয় একবারও আমার মাথায় আসেনি। (আমার ধারণা বাবা দাদার খামার থেকে যে কাঠগুলো নিয়ে এসেছিল সেগুলো বিক্রি করে হাসপাতালের খরচটা মিটিয়েছিল। কাঠগুলো বাবা অনেকদিন রেখে দিয়েছিল। হয়ত ভেবেছিল ফাঁদ বানাবে। কাঠগুলোকে ঘিরে একটা নষ্টালজিয়া কাজ করত বাবার।)

এক সময় আমি আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, শরীর চর্চার ক্লাস থেকে ছুটি পেতে লাগলাম যতদিন প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশী দিন পর্যন্ত। সেরকমই এক শনিবারে রান্নাঘরে শুধু আমি আর মা ছিলাম। মা বলল, অ্যপেন্ডিক্স অপারেশনের সময় শুধু অ্যপেন্ডিক্সটাই নয়, আমার শরীর থেকে কেটে বাদ দেয়া হয়েছে আরও কিছু। অপারেশন করতে গিয়ে ডাক্তার নাকি অ্যপেন্ডিক্স নয়, চিন্তিত হয়ে পড়েছিল অন্য একটা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেকে। একটা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, মা বলেছিল, আকারে একটা টার্কীর ডিমের সমান।

তবে ভয়ের কিছু নেই, মা বলেছিল, এখন আর নেই ওটা।

একবারের জন্যও ক্যান্সারের চিন্তা আমার মাথায় আসেনি আর মাও কখনো ক্যান্সারের কথা উল্লেখ করেছে বলে মনে পড়ে না। মনে হয় না আজকাল আর ওরকম একটা কিছু খুঁজে পাবার পর সেটাকে না খুঁচিয়ে, সেটা ক্যান্সার নাকি ক্যান্সার নয়। সেটা না জেনে এরকম করে ছেড়ে দেয়া সম্ভব। ক্ষতিকর নাকি নিরীহ সেটা এক নিমেষেই জানতে চাই আমরা। আমার অপারেশনের পর আমরা যে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারিনি তার একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে সেদিনে ক্যান্সার শব্দটিকে ঘিরে থাকা ধোঁয়াশা, যেমন ধোঁয়াশা ছিল যৌনতা শব্দটিকে ঘিরে। আসলে তার চেয়েও খারাপ। যৌনতা নিয়ে আলাপ করাটা জঘন্য ছিল তবে এর কোথাও অন্য ধরনের মজা ছিল অবশ্যই ছিল, আমরা জানতাম, যদিও আমাদের মায়েরা ভাবত আমরা অতশত বুঝিনা– আর ক্যান্সার শব্দটাই এমন ঘিনঘিনে, পঁচা, দুর্গন্ধযুক্ত প্রানীর কথা মনে করিয়ে দিত সেটা হয়ত পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেবার সময়ও কেউ একবার তাকিয়ে দেখতে চাইবে না।
সুতরাং আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি এবং আমাকেও কিছু বলা হয়নি। তখন শুধু ধরে নিতে পারি জিনিসটা ক্ষতিকর প্রজাতির ছিল না অথবা সেটা খুব অভিজ্ঞ হাতে অপসারণ করা হয়েছিল আর সেজন্যই আজ এখানে দিব্যি আছি আমি। এই জিনিসটাকে সারা জীবনই অত্যন্ত কম গুরুত্ব দিয়েছি আমি। যতবারই আমার উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়েছে যে আমার কি কি অপারেশন হয়েছে, আমি শুধু অ্যপেন্ডিক্সের নামই বলেছি।

যতদূর মনে পড়ে, মা’র সাথে আমার এসব কথা হয়েছিল ইন্টারের ছুটিতে, খাড়িগুলো বইছে প্রবল বেগে। ঝকঝকে গ্রীষ্ম ধীর পায়ে প্রবেশ করছে। ওখানকার আবহাওয়া কালক্ষেপন করতে জানত না, জানত না কৃপা করতেও।
জুনের শুরুর উষ্ণ দিনগুলোতে আমি স্কুল থেকে ছুটি পেয়ে গেলাম, বরাবরই বেশ ভাল নম্বর পাওয়াতে আমাকে ফাইনাল পরীক্ষা থেকে অব্যহতি দেয়া হল। বেশ সুস্থ সবল ছিলাম, ঘরের কাজ করতাম, বই পড়তাম আগের মত, কেউ জানত না ভেতরে ভেতরে একটা সমস্যা চলছিল আমার।
এখানে আমাকে একটু বলে নিতে হবে আমরা কে কোথায় ঘুমাতাম। আমি আর আমার বোন একই ঘরে থাকতাম ছোট একটা ঘরে, দু’টো বিছানা পাশাপাপশি ফেলা সম্ভব নয় তাই একটা মই লাগানো দোতলা খাট দেয়া হল। যে উপরে ঘুমাবে সে মই দিয়ে উপরে উঠে যাবে। আমিই উপরে ঘুমাতাম। যখন আরও ছোট ছিলাম, অন্যদের জ্বালাতন করতে অনেক মজা লাগত, তখন তোষকের কোনা তুলে উপর থেকে থুথু ফেলব বলে ছোট বোনকে ভয় দেখাতাম। ও অসহায়ভাবে নিচের বিছানায় শুয়ে থাকত। অবশ্য আমার বোন– ওর নাম ক্যাথেরিন– মোটেও অসহায় ছিল না। ও লেপের ভেতর ঢুকে যেত। আমার মজাটা ছিল ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা, দম বন্ধ হয়ে আসলে কিংবা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সাড়া শব্দ না পেয়ে যেই ও মাথা বের করত অমনি থুথু মারা কিংবা থুথু মারার নিখুঁত অভিনয় করে ওকে রাগিয়ে দেয়া।

এসব ছেলেমানুষি করার বয়স অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। আমার বোন তখন নয় আর আমি চৌদ্দ। আমার সাথে আমার বোনের সম্পর্ক এক এক সময় এক এক রকম। আমি যখন ওকে জ্বালাতন করতাম না বা ওর পিছু লাগতাম না তখন আমি বনে বসতাম ভীষণ বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন এক উপদেষ্টা অথবা ভয়ংকর ভয়ংকর সব গল্প বলে ওর চুল খাড়া করে দেওয়ার দায়িত্ব নিতাম। মাঝে মাঝে ওকে মা’র পুরানো, বাতিল করে দেয়া কিছু কাপড় পরাতাম, বেশ জমকালো কিন্তু সেকেলে। মা’র পুরানো পাউডার আর রুজ দিয়ে ওকে সাজিয়ে বলতাম, ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে। ক্যাথেরিন সুন্দর ছিল, কোন সন্দেহ নেই। তবে আমার মেকাপে ওকে বিদেশী ভূতুড়ে পুতুলগুলোর মত দেখাত।

তার মানে এই নয় যে ওর ওপর সারাক্ষণ ছড়ি ঘুরাতাম আমি। এমনকি আমরা যে সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতাম তাও নয়। ওর নিজের বন্ধু বান্ধব ছিল, নিজের খেলাও। ওর খেলাগুলো বেশীর ভাগই ছিল ঘর গেরস্থালী সংক্রান্ত। পুতুলদের খেলনা গাড়ীতে চড়িয়ে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, মাঝে মাঝে পুতুল নয়, বেড়াল ছানাদের কাপড় চোপড় পরিয়ে বেড়াতে নিয়ে যেত। আবার অন্য একটা খেলাও খেলত ওরা। একজন মাস্টার সেজে অন্য একজনকে শাস্তি দিত অবাধ্যতার জন্য। যে শাস্তি পেত সে মিথ্যামিথ্যি কাঁদত।

জুন মাসে আমি স্কুল থেকে ছুটি পেয়েছিলাম, আগেই বলেছি। সে সময়টা আমি বেশ একা থাকার সুযোগ পেতাম, এমনটা আগে কখনও হয়নি। বাড়ির কিছু কাজ আমি করতাম তবে মা সম্ভবত তখনও বেশ সুস্থই ছিল, বেশীর ভাগ কাজ নিজেই করতে পারত। অথবা আমাদের যথেষ্ট টাকা পয়সা ছিল ফলে কাজ করার জন্য লোক ভাড়া করতে পারতাম আমরা। গ্রীষ্মের শেষ দিকে যখন আমি নিজেই বাড়িটা পরিপাটি রাখার চেষ্টা করত তখনও তেমন কোনো কাজ খুঁজে পেতাম না আমি। আমার জন্য কোনো কাজ কেউ ফেলে রাখত না। সেই রহস্যময় টার্কীর ডিমটা নিশ্চয় আমাকে একটা মেকি পদমর্যাদা দিয়েছিল, যার ফলে আমি বেশ কিছুটা সময় মেহমানের মত ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারতাম।

এর ফলে যে বিশাল কিছু করে ফেলেছিলাম আমি তা কিন্তু নয়। আমাদের পরিবারে সেরকম বিশাল কিছু করে ফেলার কোন নজিরই নেই। সবকিছুই ছিল খুব অন্তর্মুখী এমনই একটা অদ্ভুত আর অকেজো অনুভূতি হত আমার নিজের সম্পর্কে। সবসময়ই যে অকেজো মনে হত তাও অবশ্য না। আমার মনে আছে, গাজর ক্ষেতে বসে নুয়ে নুয়ে নতুন গজানো গাজর গাছ তুলে নিতাম আমি, যেমন প্রতি বসন্তেই করতে হয়, গাজড়গুলো যেন ভাল বাড়তে পারে। বেশ কাজে আসতাম আমি তখন, দিনে যে সময়টাতে আমার একদমই কিছু করার থাকত না তখনই শুধু আমার ওরকম মনে হত।

একারণেই সম্ভবত আমার ঘুমের সমস্যা শুরু হল। প্রথম প্রথম সমস্যাটা ছিল মাঝরাত পর্যন্ত জেগে শুয়ে থাকা আর ভাবা আমি কেমন তরতাজা হয়ে জেগে আছি আর বাড়ির বাকী সবাই কি ঘুমটাই না ঘুমাচ্ছে। আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়তাম, এক সময় ক্লান্ত হয়ে বাতি নিভিয়ে দিতাম। কেউ আমাকে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও বলত না। জীবনে এই প্রথম (এবং এটাও সম্ভবত টার্কীর ডিমের পদমর্যাদার কারনে) আমাকে নিজে নিজে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দেয়া হল।

দিনের আলোতে উজ্বল আর তারপর বেশ রাত পর্যন্ত বাতি জ্বলে থাকা বাড়ীটা বদলে যেতে বেশ খানিকটা সময় নিত। সারাদিনের এলোমেলো জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা, সব কাজ শেষ করা, কিছু কাজ অসমাপ্ত রাখা বাড়িটা একটা অদ্ভুত জায়গা হয়ে উঠত যেখানে তার উপর কর্তৃত্ব করা কোনো মানুষ বা কর্মযজ্ঞ থাকত না, তার কোন ব্যবহারও থাকত না যেন, আসবাবগুলোর অস্তিত্বও বোঝা যেত না ওদেরকে কারো প্রয়োজন হত না বলে।

তোমাদের মনে হতে পারে, এ তো মুক্তি! প্রথম প্রথম হয়ত তাই ছিল। স্বাধীনতা, বিস্ময়। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল আর আমার নিদ্রাহীন রাত লম্বা হতে হতে ভোর পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল, আমি ততই ব্যাপারটাতে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আমি, প্রথমত নিজেকে এবং আমার ইচ্ছেটাকেও ঘুম পাড়ানোর জন্য, প্রথমে ছড়া তারপর কবিতা বলতে শুরু করলাম। কিন্তু ব্যাপারটা যেন আমাকে ব্যাঙ্গ করতে শুরু করল। শব্দগুলো এতটাই এলোমেলো আর অর্থহীন ছিল যে আমার মনে হত আমি নিজেই নিজেকে ব্যাঙ্গ করছি।

আমি যেন ঠিক আমি ছিলাম না।
আমি সারা জীবন বিভিন্ন মানুষ সম্পর্কে একথা শুনে এসেছি, কখনোই ভেবে দেখিনি এর মানে কি হতে পারে।

তাহলে, তোমার কি মনে হয়, তুমি কি?
একথাও আমি শুনে আসছি, কখনো ভীতিকর মনে হয়নি, খুব আটপৌরে একটা বিদ্রুপই ধরে নিয়েছিলাম কথাটাকে।
এখন নতুন করে ভাবতে হবে।
ততদিনে আমি ঘুমের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমি বুঝে ফেলেছিলাম ঘুম আর সহজে আসবে না। হয়ত আমি ঘুমাতে চাইতামও না। কিছু একটা যেন আমার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছিল, সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম আমি। খুব যুদ্ধ করতাম ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে আসতে। তা করার মত জ্ঞান হয়ত সামান্যই ছিল আমার। জিনিসটা যাই হোক, সেটা আমাকে নানান কিছু করতে বলত কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছিল না বলার, শুধু করা সম্ভব কিনা সেটা যাচাই করাই ছিল উদ্দেশ্য। আমাকে সে জানিয়ে দিচ্ছিল উদ্দেশ্য সবসময় গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মেনে নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কি অদ্ভুত। কারো উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য নয়, কিংবা অন্য কোনো বিশেষ কারণেও নয়। শুধুমাত্র তুমি বিষয়টা ভেবেছিলে বলেই ভাবনাটার কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিৎ।

এবং বিষয়টা নিয়ে আমি ভাবতাম। যতই ভাবনাটা দূরে সরাতে চাইতাম ততই যেন সেটা ঘিরে ধরত আমাকে। কোনো প্রতিহিংসা বা ঘৃণা নয়– যেমনটা আগেই বলেছি, কোনো বিশেষ কারন নেই, শুধু একটা শীতল গভীর ভাবনা, সেটাকে ঠিক তাড়নাও বলা যায় না। একটা ধ্যানের মত ভাবনা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করত। ভাবনাটাকে আমার প্রশ্রয় না দেয়াই উচিৎ ছিল কিন্তু আমি ডুবে থাকতাম এই ভাবনায়।

ভাবনাটার অস্তিত্ব ছিল আমার চারপাশে, মনের মধ্যে সারাক্ষণ ঘুরত সে।

আমার মাথায় ঘুরত আমার ছোট বোনকে গলা টিপে মেরে ফেলার চিন্তা। আমার ছোট বোন যে দোতলা খাটে আমার নিচে শুয়ে ঘুমাতো আর এই পৃথিবীতে যাকে আমি ভালবাসতাম সবচেয়ে বেশী। আমি কোনো হিংসা, প্রতিহিংসা কিংবা রাগ থেকে এমন ভাবতাম না, এক ধরনের বিকার ছিল এটা, যেটা হয়ত আমার ঠিক পাশেই শুয়ে থাকত রাতের বেলা। বিকারটা স্বভাবে এমন কিছু হিংস্রও ছিল না, বরং বলা যায় খানিকটা বিদ্রুপ করত যেন ওটা। একটা আলসে, ঢিলেঢালা, বিদ্রুপভরা প্রস্তাব যেটা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে ছিল। যেন বলত, কেন নয়? সবচেয়ে খারাপ যেটা সেটা করে দেখই না কি হয়।

সবচেয়ে খারাপ। এ বাড়ীর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা আমাদের ঘরটা, যেখানে আমরা ঘুমিয়েছি সারা জীবন আর নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করেছি এখানে। আমি হয়ত একদম অকারণেই কাজটা করতাম, আমি বা অন্য যে কেউই সেটা বুঝত, শুধু বুঝত না যে আমি কোনো ভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।

আমি প্রথমে উঠে বসতাম, বিছানা থেকে নামতাম, তারপর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে একেবারে বাইরে চলে যেতাম, বিছানার ধাপগুলো বেয়ে নামার সময় আমি ভুলেও একবারের জন্যও আমার বোনের দিকে তাকাতাম না। এরপর নিঃশব্দ সিড়ি বেয়ে সোজা নিচে। সেখানে কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই, রান্নাঘরে ঢুকে যেতাম সোজা। রান্নাঘরটা আমার ভীষণ চেনা ছিল, কোনো আলো ছাড়াই রান্নাঘর পেরিয়ে যেতে পারতাম সহজেই্ রান্নাঘরের বাইরের দরজায় তালা দেয়া হত না, ওই দরঝার চাবিটা আমাদের কাছে ছিল কিনা সে ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে। একটা চেয়ার কাত করে দরজার হাতলের নিচে ঠেস দিয়ে রাখা হত যাতে বাইরে থেকে কেউ ঢোকার চেষ্টা করলেই চেয়ার পড়ে একটা বিকট শব্দ হয়। ধীরে, নিঃশব্দে চেয়ারটা সরিয়ে ফেলতে আমার কোনো সমস্যাই হত না।

প্রথম রাতের পর থেকে আমাকে একবারের জন্যও কোথাও থামতে হত না। তাই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যেতে আমার লাগত কয়েকটা নির্ঝঞ্জাট সেকেন্ড মাত্র।

এ অঞ্চলে রাস্তায় কোন বাতি ছিল না, শহর থেকে অনেক দূরে থাকতাম আমরা।
সবকিছুই কেমন বড় মনে হত অন্ধকারে। আমাদের বাড়ীর চারপাশে যে গাছগুলো ছিল তাদের সবাইকে তাদের নিজ নিজ নামে ডাকতাম আমরা– বীচ গাছ, এল্ম্ গাছ, ওক গাছ, শুধু মেপলের বেলায় ছিল গাছগুলো, কারণ ওরা সব গায়ে গা লাগিয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকত। ওদের সবাইকে সে সময় ভীষণ কালো দেখাত। সাদা লাইলাক (ফুল ছিল না যদিও) আর বেগুনী লাইলাকের গাছটাকেও ঝোপ না বলে লাইলাক গাছই বলতাম আমরা, আকারে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল বলে।
বাড়ীর পূর্ব পাশ আর পশ্চিম পাশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা দু’টো জগৎ দেখা যেত, অন্তত আমার চোখে তেমনই দেখাতো। পূর্ব দিকটা ছিল শহরের দিকে, যদিও শহরের কিছুই দেখা যেত না। দু’মাইল দূরে শহর–সারি বাঁধা বাড়ি, রাস্তায় বাতি আর কল খুললেই পানি, যদিও এবারের কিছুই দেখা যেত না, আগেই বলেছি। তবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে একটা মৃদু আলোর আভা দেখা যেত কিনা সেটা নিশ্চিত বলতে পারছি না।
পশ্চিমে নদীর দীর্ঘ বাঁকটা, মাঠ আর গাছ, সূর্যাস্তের দৃশ্যে ছেদ ফেলার মত কিছুই ছিল না। এপাশে শুধুই প্রকৃতি, মানুষের হাত পড়েনি, প্রাত্যহিক জীবনের কোলাহলের কোনো চিহ্নও ছিল না এদিকটায়।

আমি হাঁটতে থাকতাম প্রথমে বাড়ীর কাছে কাছে তারপর দৃষ্টি একটু পরিস্কার হয়ে আসলে যখন আত্মবিশ্বাস জন্মাতো যে পাম্পের হাতল কিংবা কাপড় শুকানোর রঙের সাথে ধাক্কা খাব না, তখন ঝুঁকি নিতাম এদিক সেদিক যাবার। এক সময় পাখীদের নড়াচড়া শুরু হত গাছে গাছে, কিছুক্ষণ পর কিচির মিচির। যে সময় পাখীরা জাগে বলে আমার ধারণা ছিল আসলে তার অনেক আগে ওদের সকাল হয়। তবে আকাশ কিন্তু খানিকটা ফর্সা হয়ে যায় প্রথম পাখীর ডাকের পরপরই। আর ঠিক সে সময় হঠাৎ করেই রাজ্যের ঘুম আসত আমার চোখ জুড়ে। আমি ঘরে ফিরে যেতাম, ভেতরটা হঠাৎ খুব অন্ধকার মনে হত, আর আমি খুব নিপুন হাতে, সাবধানে, নিঃশব্দে চেয়ারটা দরজার হাতলের নিচে কাত করে ঠেস দিয়ে রেখে দিতাম। তারপর দোতলায় উঠে যেতাম কোনো শব্দ না করে, দরজা আর সিড়িগুলো সতর্কভাবে ডিঙিয়ে যেতাম আমি যদিও দেখে মনে হত প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। আমি সোজা গিয়ে আমার বালিশের উপর পড়তাম আর বেশ দেরী করে ঘুম থেকে উঠতাম– দেরী বলতে আমাদের বাড়ীতে খুব জোর আটটা কি সাড়ে আটটা।
রাতের সব ঘটনা আমি স্পষ্ট মনে করতে পারতাম কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভীষণ অবাস্তব মনে হয়–ভয়ংকর ঐ চিন্তাটা সত্যিই এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে দিনের বেলা এর কোন প্রভাবই আমার উপর থাকত না। আমি ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আমার ভাই আর বোন স্কুলে চলে যেত কিন্তু টেবিলে তখনও ওদের নাস্তার প্লেটগুলো পড়ে থাকত, দু’একটা সিরিয়ালের টুকরো ভাসতে থাকত বাড়তি দুধটুকুর মধ্যে।
অবিশ্বাস্য। বোন স্কুল থেকে ফিরলে আমরা দুজন হ্যামকের দু’দিকে মাথা দিয়ে দোল খেতাম।

এই হ্যামকে দোল খেতেই আমার দিনের অনেকটা সময় কাটত, একারণেই হয়ত আমার রাতে ঘুম আসতে চাইত না। রাতে ঘুম না আসার বিষয়টা নিয়ে আমি কারো সাথে কথাও বলিনি, আর আমাকেও তাই কেউ বলেনি যে দিনে একটু কাজ কর্ম করলে রাতে ঘুমটা ভাল হয়।

আমার সমস্যাটা সঙ্গে করে নিয়ে রাত আসত। পিশাচগুলো আমাকে পেয়ে বসত আবার। খুব দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মত বোধটুকু থাকত আমার। আমি একবারের জন্যও ভাবার চেষ্টা করতাম না যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে কিংবা খুব চেষ্টা করলে আমি ঘুমিয়ে যেতে পারব। খুব সাবধানে আমি বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতাম। অন্ধকারে চলাফেরায় আরও পরাদর্শী হয়ে উঠেছিলাম আমি, ঘরের ভেতরটা আরও স্পষ্ট দেখতে পেতাম, আরও অচেনা, রান্না ঘরের পাল্লার কুকুরে চিবানো অংশটা–সব যেন আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম। একটা কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার একটা বালি দিয়ে খেলার জায়গা ছিল, উঠানে জায়গাটা এমনভাবে বানানো ছিল যাতে মা উত্তরের জানালা দিয়ে আমার উপর নজর রাখতে পারে কাজ করতে করতে, এখন একটা স্পাইরিয়ার ঝোপ অবাধ্যভাবে বেড়ে উঠে জায়গাটা একদম ঢেকে দিয়েছে।

রান্নাঘরের পূর্ব দিকের দেয়ালে কোনো জানালা ছিল না। একটা দরজা ছিল যেটা খুললেই এক সারি সিড়ি, ওখানে দাঁড়িয়ে আমরা বড় বড় ভেজা কাপড়গুলো শুকাতে দিতাম, আবার শুকিয়ে গেলে ওগুলো ধরে ঝুল খেতাম আর ধোয়া কাপড়ের টাটকা গন্ধ নিতাম– সে সাদা বিচানা চাদরই হোক বা কালো ওভারঅল।

রাতে হেঁটে বেড়ানোর সময় কখনো কখনো আমি সিড়িগুলোর কাছে একটু থামতাম। বসতাম না, শহরের দিকটা একটু ভালভাবে দেখতে পেতাম ওখান থেকে, হয়ত শহুরে সভ্যতার বাতাস একটু গায়ে মাখতে চাইতাম।

এক রাতে– ঠিক বলতে পারব না আমার রাত জেগে হেঁটে বেড়ানোর বিশতম রাত নাকি দ্বাদশ রাত নাকি অষ্টম বা নবম– আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম কোনের দিকে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, ততক্ষণে আমার গতি কমানোর আর সময় নেই। কে যেন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, সোজা হেঁটে যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলেও তখন ধরা পড়ে যেতাম। পালাতে গিয়ে ধরা পড়ার চেয়ে বরং মুখোমুখী হওয়াই ভাল।

কে দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে ? আমার বাবা। বাবাও সিড়ির উপর বসে শহরের দিকে আর প্রায় অদৃশ্য শহরে আলোর আভার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাবা দিনের পোশাকই পড়ে ছিল— গাঢ় রংয়ের প্যান্ট, শার্ট আর বুট। সিগারেট ফুকছিল বসে, নিজের হাতে বানানো সিগারেট। হয়ত সিগারেটের গন্ধই আমাকে অন্য কারো ……

তামাকের গন্ধ থাকত সব জায়গায়, ঘরের ভেতরে, বাইরেও। আলাদা করে সেটা টের পাবার সম্ভাবনা কমই ছিল।

বাবা বলল, সুপ্রভাত, যেটা বলাটা খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে তবে ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। আমাদের পরিবারে আমরা এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় একদমই অভ্যস্ত ছিলাম না। কোনো বৈরী সম্পর্কের কারণে নয়, বরং যেখানে সারাদিনই সবার সাথে সবার দেখা হচ্ছে সেখানে এরকম ঘটা করে সম্ভাষণ বিনিময়টা অপ্রয়োজনীয় মনে করা হত।

আমিও সুপ্রভাত জানালাম বাবাকে। সময়টা তখন নিশ্চয় সকালের খুব কাছাকাছি তা না হলে বাবা এরকম পোশাকে থাকত না। আকাশও ততক্ষণে নিশ্চয় ফর্সা হতে শুরু করেছিল কিন্তু ঘন গাছের সারির জন্য ভাল বোঝা যাচ্ছিল না। পাখিদের ডাকাডাকিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিনই আমি আগের দিনের চেয়ে বেশী সময় বাইরে কাটাচ্ছিলাম, প্রথম দিকে যেমন ভাল লাগত সেরকম কিন্তু আর লাগছিল না, যে সম্ভাবনাটা এক সময় শুধু শোবার ঘরেই বাস করত, শুধু দোতলা বিছানায়, সেটা ধীরে ধীরে ঘরের প্রতিটি কোনায় বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল।

এখন যখন সেদিনের কথা চিন্তা করি, আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কেন বাবা কাজের পোশাক পরে ছিল না সেদিন? পোশাক দেখে মনে হচ্ছিল বাবা কোনো প্রয়োজনে শহরে যাবে। সেদিন সকালের প্রথম কাজটাই ছিল শহরে যাওয়া।

আমি আর হেঁটে বেড়াতে পারলাম না, কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটল আমার ঘুরে বেড়ানোর আনন্দের।

“ঘুমের সমস্যা হচ্ছে ? বাবা বিজ্ঞেস করল।

আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, না। কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে হল রাতভর হেঁটে বেড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করাটা কতটা কঠিন হবে। তাই বললাম, হ্যাঁ।

বাবা বলল, “গ্রীষ্মের রাতে এরকম হতেই পারে। খুব ক্লান্ত হয়ে ঘুমাতে গেলে আর যেই না মনে করলে এক্ষুনি ঘুমিয়ে যাচ্ছ, অমনি ঘুমের আর দেখা নেই, তাই না?”

আমি বললাম, হ্যাঁ।

বুঝতে পরলাম আমার বাড়ী থেকে বের হওয়া আর রাতভর হেঁটে বেড়ানোটা যে বাবা আজই হঠাৎ দেখতে পেল তা নয়। যার বাড়ির সীমানার ভেতরেই তার সব গরু, ছাগল আর ভেড়া যেগুলো কিনা তার রোজগারের ভিত্তি এবং যে তার ড্রয়ারে একটা হ্যান্ডগান রাখে, সিড়িতে সামান্যতম আওয়াজ বা দরজার হাতল ঘুরানোর সুক্ষ্ন শব্দও তার সজাগ কানকে এড়িয়ে যেতে পারে না।

আমার না-ঘুমানো বিষয়ক আলোচনা এরপর কোনদিকে মোড় নেবে আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাবা একরকম ঘোষণাই করল যে রাতে না ঘুমাতে পারাটা একটা ভীষণ যন্ত্রণা। কিন্তু আলোচনা কি এখানেই শেষ ? আমার কোনমতেই তাকে এর চেয়ে বেশী কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না। বাবা যদি ঘুণাক্ষরেও আমাকে বুঝতে দিত যে এই ঘোষণাই আলোচনার শেষ না, যদি একটুও আভাস দিত যে পুরো বিষয়টা জানার জন্যই সে এসেছে, আমার মনে হয় না সে আমার মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারত। নীরবতা ভাঙলাম আমিই, নিজের ইচ্ছায়, বললাম আমি ঘুমাতে পারি না। আমি বাধ্য হয়ে বাইরে এসে হেঁটে বেড়াই।
কেন?
আমি জানি না।
খারাপ স্বপ্ন দেখ না তো ?
না।

“বোকার মত প্রশ্ন করলাম”, বাবা বলল “ভাল স্বপ্ন তো আর তোমাকে তাড়িয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসত না”।

বাবা আমাকে সময় নেবার সুুযোগ দিল। কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমি ওখান থেকে পালিয়ে আসতে চাইছিলাম কিন্তু যা না করে কেন যেন কথা বলতে শুরু করলাম। সত্যই বললাম সব, শুধু সামান্য একটু বদলে দিয়ে।

আমার ছোট বোনের কথা যখন বললাম, আমি বললাম, আমার ভয় হয় ওর কোনো ক্ষতি যদি করে ফেলি। আমার বিশ্বাস ছিল ওটুকু বলাই যথেষ্ট, কি ক্ষতি সেটা বাবা বুঝে নেবে।

“ওকে গলা টিপে মেরে ফেলি যদি”, আমি বলেই ফেললাম। কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছিলাম না আমি।

এ কথা ফিরিয়ে নেবার আর সুযোগ নেই, একটু আগ পর্যন্ত যে মানুষটা ছিলাম আর কখনোই সে মানুষটা হতে পারব না আমি।

বাবা কথাটা শুনল। শুনল যে আমি মনে করি কোনো কারণ ছাড়াই আমি ছোট্ট ক্যাথেরিনকে ঘুমের মধ্যে গলা টিপে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখি।

বাবা বলল, “আচ্ছা”।

এরপর বলল আমি যেন দুশ্চিন্তা না করি, বলল, “কখনও কখনও মানুষের মাথায় এরকম ভাবনা আসতেই পারে”।

কথাগুলো বাবা বলল খুব গম্ভীরভাবে, গুরুত্ব দিয়ে, কোনো শঙ্কা বা বিস্ময় দেখা গেল না তার ভেতর। মানুষের মাথায় এরকম ভাবনা আসতেই পারে কিংবা ভাবনা না বলে ভয় বলতে পার, কিন্তু এ নিয়ে ঘারড়াবার কিছু নেই, বলতে পার এটা একটা দুঃস্বপ্নের মত।

বাবা কিন্তু পরিস্কার করে বলল না যে আমার দ্বারা এরকম ভয়ংকর কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই। দেখে মনে হল বাবা বরং ধরে নিয়েছে এরকম কিছু ঘটতেই পারে না। এটা ইথারের জন্য হচ্ছে, বাবা বলল। তোমাকে হাসপাতালে ইথার দেয়া হয়েছিল। ধরে নাও এটা একটা স্বপ্ন, এর বেশী কিছু না। এরকম কিছুই কখনো ঘটবে না, যেমন কোনো উল্কা কখনোই আমাদের বাড়ির উপর এসে পড়বে না। (অবশ্যই পড়তে পারে কিন্তু এর সম্ভাবনা এতই কম যে সেটা ঘটতেই-পারে-না’র দলে পড়ে গেছে)।

এরকম চিন্তা করার জন্য বাবা আমাকে দোষারোপ করল না মোটেও। বিস্মিতও হল না একটুও।

বাবা অনেক কিছুই বলতে পারত। আমার বোনের ব্যাপারে আমার মনোভাব কেমন সেটা জানার জন্য প্রশ্ন করতে পারত অথবা আমার জীবনে কোনো সমস্যা চলছে কিনা সেটা জানতে চাইতে পারত। যদি আজ এ ঘটনা ঘটত তবে বাবা হয়ত কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করত। (প্রজন্ম আর আয়-রোজগারের দৌড়ে এক ধাপ এগিয়ে এই আমি মনে হয় সন্তানের জন্য তাই করতাম)।

বাবার কৌশলটাও কিন্তু কাজ করল। আমি আমার আগের অবস্থানে ফেরৎ গেলাম কারো বিদ্রুপের স্বীকার বা শঙ্কার কারণ না হয়েই।

এরকম কিছু কিছু ভাবনার জন্ম হয় মানুষের মনে যেটা খুব ক্ষণস্থায়ী, হারিয়ে যায় অল্প ক’দিনের মধ্যেই, এসব নিয়েই তো জীবন।

তুমি যদি এ যুগের বাবা মা হও আর দীর্ঘদিন বেঁচে থাক তাহলে তুমি তোমার এমন কিছু ভুল হঠাৎ আবিস্কার করবে যেগুলো তুমি একেবারেই জানতে চাও না। আবার একই সাথে খুব ভালভাবে জান। কখনো কখনো তুমি নিজের কাছেই আবার কখনো কখনো ভীষণ বিরক্ত নিজের ওপরে। আমার বাবার এসবের কোনো বালাই ছিল বলে আমার মনে হয় না। আমি নিশ্চিত জানি, আমি যদি বাবাকে কখনো জিজ্ঞেস করতাম সে আমাকে বেল্ট দিয়ে পেটাত কেন, সে বলত, তোমার ভালর জন্যই। সেই বেদম মারগুলো বাবার মনে, যদি আদৌ তার মনে থেকে থাকে, তার মুখরা সন্তানকে শাসন করার উপযুক্ত ব্যবস্থা হিসেবেই থেকে গেছে, যে মুখরা সন্তানের সুখ-কল্পনা ছিল মুরগীর খোঁয়াড়গুলোর শাসক বনে বসেছে সে।

“নিজেকে অনেক বেশী বুদ্ধিমান মনে করছ তুমি”, বাবা হয়ত শাস্তির কারণ হিসেবে বুদ্ধিমান হয়ে যাওয়াটাই উল্লেখ করত, আর সেসময়, সতিই, একথা প্রায়ই শোনা যেত বুদ্ধিমান বাচ্চাদের সম্পর্কে। ওদেরকে পিটিয়ে বুদ্ধির ভূত না ছাড়ালে নাকি ছেলেগুলোর বড় হয়ে নিজেদেরকে বুদ্ধিমান মনে করার সম্ভাবনা থেকে যেত, কিংবা বুদ্ধিমতী, যেমন আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল।

সে যাই হোক, সেদিন ভোরে আমার যা শোনার দরকার ছিল আমাকে ঠিক তাই বলেছিল বাবা আর খুব অল্প দিনের মধ্যে সবকিছু ভুলেও গিয়েছিলাম আমি।

আমি ভেবেছিলাম বাবা ভাল কাপড় চোপড় পরে আছে কারণ তাকে হয়ত সকাল সকাল ব্যাঙ্কে যেতে হবে, যেখানে তাকে শুনতে হবে, যদিও নতুন কিছু নয় সেটা যে ব্যাঙ্ক লোন আর বাড়ানো যাবে না। বাবা তার সাধ্যমত পরিশ্রম করেছে কিন্তু বাজারের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই সংসার চালানোর জন্য তাকে নতুন কোনো উপায় খুঁজতে হবে আর একই সাথে ব্যাঙ্কের টাকাটা পরিশোধেরও ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা বাবা হয়ত তখন জানতে পেরেছিল যে মায়ের ক্রমাগত শরীর কাঁপাটার একটা বিশেষ নাম আছে এবং সেটা আর কোনদিনই সারবে না অথবা বাবা অবিশ্বাস্য কোনো মহিলার প্রেমে পড়েছিল।

http://forum.daffodilvarsity.edu.bd/index.php?action=post;board=365.0

2


.হঠাৎ করে সাদাপোশাকধারী কিছু লোক এসে যদি আপনাকে বলে যে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। আপনাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। আপনি কিছু না বুঝে ওঠার আগেই তারা আপনাকে গ্রেপ্তার করে বসল। অথচ আপনি কোনো অপরাধই করেননি। কিংবা ঘটনাটি আপনার সঙ্গে না ঘটে কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে ঘটল। এ অবস্থায় কী করার আছে আপনার? আপনার কি কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়া সম্ভব কিংবা কীভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন?

এমন পরিস্থিতির শিকার হলে
প্রথমেই মনে রাখতে হবে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আপনার জানার অধিকার রয়েছে কেন, কী কারণে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাই প্রথমেই জানতে চাইতে হবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগটি কী? অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাদের পরিচয় জানতে চাইবেন এবং তাদের পরিচয়পত্র দেখতে চাইবেন। একা একা কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরিবার-পরিজনকে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিন। প্রয়োজনে আশপাশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের খবর দিন এবং যত পারা যায় লোকজন জড়ো করার চেষ্টা করুন। আপনার বিরুদ্ধে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কি না, তা দেখতে চাইবেন। যদি তারা আপনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে আপনি একা তাদের সঙ্গে যাবেন না বলে তাদের জানিয়ে দেন এবং পরিবারের দু-একজনকে সঙ্গে নেবেন বলে তাদের জানান। প্রয়োজনে নিকটস্থ থানায় ফোন করে আপনার গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানান। এবং থানা এ সম্পর্কে অবগত অছে কি না, তা জানার চেষ্টা করুন। আপনার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ দেখাতে না পারলে আপনাকে হয়তো ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের কথা বলতে পারে। ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার নিয়ে ২০১৬ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন এবং কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যা ১০ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে পূর্ণাঙ্গ রায় হিসেবে প্রকাশিত হয়।

আপিল বিভাগের নির্দেশনা
আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে বাধ্য থাকবে এবং পুলিশের পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেপ্তারের স্থান ও সময় ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ গ্রেপ্তারের পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি মেমোরেন্ডাম তৈরি করবেন। গ্রেপ্তারের সময় ও স্থান এবং আটক রাখার জায়গা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির আত্মীয়কে জানাতে হবে। আত্মীয়স্বজন না পেলে ব্যক্তির নির্দেশনা মেনে তাঁর বন্ধুকে জানাতে হবে। এ জন্য সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে। কোন যুক্তিতে, কার তথ্যে বা অভিযোগে ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ঠিকানাসহ তা কেস ডায়েরিতে লিখতে হবে, আটক ব্যক্তি কোন কর্মকর্তার তদারকিতে রয়েছেন, তাও উল্লেখ করতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা যাবে না। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাত থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে তা রেকর্ড করে চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছ থেকে সনদ নিতে হবে।

জামিনের জন্য চেষ্টা করতে হবে
গ্রেপ্তার হলে গ্রেপ্তারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চালান দেবেন। ২৪ ঘণ্টা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর কোনো অবস্থাতেই (ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া) পুলিশ আপনাকে আটক রাখতে পারবে না। এ সময় পুলিশ আপনাকে গুরুতর কোনো অভিযোগে রিমান্ডের আবেদন করতে পারে। আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী ডায়েরির অনুলিপি ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে আদালতে হাজির করে আটকাদেশ চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট, আদালত, ট্রাইব্যুনাল একটি বন্ড গ্রহণ করে তাঁকে মুক্তি দেবেন। আটক থাকা কোনো ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মামলায় যদি গ্রেপ্তার দেখাতে চায়, সে ক্ষেত্রে যদি ডায়েরির অনুলিপিসহ তাঁকে হাজির না করা হয়, তাহলে আদালত তা মঞ্জুর করবেন না। কোনো কারণে নিম্ন আদালতে জামিন না হলে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

http://www.prothom-alo.com/life-style/article/1199181/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A7%8B%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%B2%E0%A7%87

3


ঢাকা শহরের বহু মানুষ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এই দুই ধরনের জ্বরই এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। এ দুই রোগে জ্বর, গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, শরীরে ফুসকুড়ি বা র‌্যাশ হয়ে থাকে। খুব দুর্বল লাগে, মাথা ঘোরে, কারও কারও বমি হয়। রক্তচাপও কমে যেতে পারে। বলতে গেলে রোগী প্রায় কিছুই খেতে চায় না। বিশেষ করে, শিশু ও বয়স্ক মানুষকে নিয়ে সমস্যা বেশি হয়। খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার ফলে তারা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। এমন রোগীকে খাওয়ানোর ব্যাপারে কয়েকটি পরামর্শ:

* জ্বর হলে শরীরে ক্যালরির চাহিদা বাড়ে। কারণ, তখন বিপাক বেড়ে যায়, বেশি পুষ্টির দরকার হয়। তাই খাওয়া বন্ধ করে দিলে বিপদ বাড়বে। রুচি কমে গেলে এমন খাবার বেছে নিন, যা অল্প খেলেও বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়।

* ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া হলে প্রচুর তরল পান করতে হয়, দিনে কমপক্ষে আড়াই লিটার। পানির পাশাপাশি লবণ ও খনিজ উপাদানসমৃদ্ধ তরল (যেমন: ডাবের পানি, ওরস্যালাইন, লেবু-লবণের শরবত, ফলের রস) পান করা উচিত। এতে করে রক্তচাপ হ্রাসের ঝুঁকি কমবে। তবে অতিমিষ্টি পানীয় বমির উদ্রেক করতে পারে। বাজারের কোমল পানীয় বা আইসক্রিম সহজে পিপাসা মেটায় না।

* অরুচি বা বমি ভাবের মধ্যে তেল-মসলাযুক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। খাবারের তালিকায় পর্যাপ্ত শর্করা যেমন: ভাত, জাউভাত, ওটমিল ইত্যাদি রাখুন। রাখুন প্রোটিনও, যেমন: দুধ, দই, মাছ বা মুরগির মাংস ও স্যুপ।

* অনেক ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া রোগীর খেতে গেলেই বমি আসে। তারা হালকা শুকনো খাবার খেতে পারে। যেমন বিস্কুট, মুড়ি ইত্যাদি। এতে বমি ভাব কমবে। এ ছাড়া আদা-চা, গ্রিন টি বা শুকনো আদা বমি ভাব কমায়। এ সময় ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।

http://www.prothom-alo.com/life-style/article/1194976/%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%81-%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%80-%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A8

4
আপনি তাহলে লেখেন?’ ভদ্রলোক পুরু চশমা চোখে দিতে দিতে আমাকে জিজ্ঞেস করেন।

—জি লিখি...সফটওয়্যার। আমি ছোট করে উত্তর দিই।
—আপনার বন্ধু যে বলে গেল আপনি চমৎকার লেখেন? আরে ভাই লুকান কেন? ধর্মবিরোধী ব্লগ লেখেন নাকি?’
মনটাই খারাপ হয়ে গেল। থাকি অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরে। এবার সিডনি বেড়াতে এসে পরিচিত তেমন কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করিনি ইচ্ছা করে। পরিকল্পনা ছিল ‘কোথাও যাওয়ার নেই কিচ্ছু করার নেই জাতীয় একটা ছুটি কাটাব’। প্রথম দুই দিন সেভাবে কাটালামও। কিন্তু তৃতীয় দিন এসে মনে হলো দুই-চার জন খুব কাছের মানুষকে না জানালে খুব অন্যায় হয়ে যাবে। সেই হিসেবেই এক ছোট ভাইকে ফোন করলাম।
—বস আপনি সিডনিতে। কিছুই জানি না। কই আছেন? কবে আসবেন দেখা করতে? উচ্ছ্বসিত হয়ে ছোট ভাই এক নাগাড়ে বলে যায়।
—এইতো আসলাম। এইবার কোথাও যাব না, কিচ্ছু করব না। তাই কাউকে জানাইনি। তবে তোমার সঙ্গে একদিন আড্ডা দিতে যাব। কোনদিন ফ্রি আছ? আমি জিজ্ঞেস করি।
—বস পরশুদিন শনিবার আমার ছেলের জন্মদিন। গত তিন বছর করতে পারি নাই। এইবার একটু বড় করেই করছি। আপনাকে আসতেই হবে।
—এইবার মাফ করো ভাই। তোমার সঙ্গে অন্য আর একদিন দেখা করব তাহলে।
—নাহ আপনাকে আসতেই হবে। কথা দিলাম অনুষ্ঠানের পরে আপনার সঙ্গে ঠিকই আড্ডা দেব। ভাবি বাচ্চাদেরও নিয়ে আসবেন।
তাকে আরও কিছুক্ষণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে হার মানলাম।
অতপর ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে আসেনি। কারণ আমার না হয় দু-একজন পরিচিত থাকবে...থাকবে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিময় আড্ডা...কিন্তু তারা এখানে একেবারেই আগন্তুক। তাই...।
আমরা প্রথম প্রজন্ম প্রবাসী বাংলাদেশি দেশ থেকে আসার সময় পাসপোর্ট ভিসার সঙ্গে নিজের অজান্তেই নিজস্ব একটা বাংলাদেশ নিয়ে আসি। একজনের বাংলাদেশ হয়তো অন্যজনের বাংলাদেশের সঙ্গে মেলে না...কেমন যেন মিলতে চায় না। তারপরও সেটা বাংলাদেশই। এ রকম আড্ডা-দাওয়াতেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। আমার বেশ ভালো লাগে। ছোট ভাই একসময় ফেসবুকে নিয়মিত আমার লেখা পড়ত। ‘ফেসবুক একটা চূড়ান্ত ফাতরামির জায়গা’ ঘোষণা দিয়ে মাস তিনেক আগে সে তার অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভেট করেছে। অথচ এই ভরা মজলিশে আমার অন্য পরিচয় বাদ দিয়ে লেখার কথাটাই আগে বলল। বিরক্ত লাগলেও প্রকাশ করার আগেই সে অন্যত্র ব্যস্ত হয়ে যায়। আর আমি তখন সাত-আট জোড়া কৌতূহলী চোখের সামনে...।
—ভাই যার কথা বললেন তার সঙ্গে আমার ছোট ভাই, বড় ভাই সম্পর্ক। জানেনইতো এই সব সম্পর্কে একটু বাড়াবাড়ি থাকে। ও একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। আসলে তেমন কিছু না। বিরক্তি চেপে কোনোমতে ম্যানেজ করার চেষ্টা করি।
বয়স্ক ভদ্রলোক একটু চুপ থেকে আবার বলা শুরু করেন।
—আজকাল দেখি সবাই লেখক, সবাই কবি। আরে লিখতে হলেতো জানতে হবে, পড়তে হবে। এই যে আজকাল এত লেখক, তাদের কয়জন রবীন্দ্রনাথের চরিত্রহীন পড়েছে...।
এভাবেই খুব গম্ভীর স্বরে তিনি শরৎ চন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ, বিমল মিত্রকে বিমল কর বলে আলাপ শুরু করলেন। লেখকের নামের ভুল হতেই পারে কিন্তু আরও একটু আলাপ করাতেই বুঝলাম তিনি কয়েকটা বইয়ের নামই শুধু জানেন। আশপাশের বেশ কয়েকজন ভদ্রলোকের পাণ্ডিত্যে বেশ মুগ্ধ। হঠাৎ আমার পুরোনো এক ওস্তাদের কথা মনে হয়...।
ব্রুস লির ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ মধুমিতা সিনেমা হলে চলার পড়ে ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় মার্শাল আর্টের প্র্যাকটিস শুরু হয়ে যায়। আমাদের পাড়াও বাদ যায় না। মুসা ভাই ছিলেন আমাদের ওস্তাদ। ‘উচ-আচ’ প্র্যাকটিসের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে তিনি ‘জীবনটা হলো জ্বলন্ত সিগারেটের মতো’ টাইপের দার্শনিক কথাবার্তা বলতে পছন্দ করতেন। একদিন প্র্যাকটিসে হঠাৎ হারু আর জলিলের মাঝে মারামারি শুরু হয়ে গেল।
‘মারামারি করতাছস ক্যান?’ দুজনকে আলাদা করতে করতে ওস্তাদ জিজ্ঞেস করেন।
‘ও আমারে শুয়োর বলছে।’ হারু উত্তর দেয়।
‘আমাকে ও কুত্তা বলছে। জলিলও বলে।’
‘এই সব গালাগালি দিতাছোস কেন?’ ওস্তাদ আবার জিজ্ঞেস করেন।
‘ওকে আমার শুয়োর বইলাই মনে হয়।’ নির্বিকারভাবে বলে হারু।
জলিলও সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা উত্তর দেয়।
‘চুপ কর। বলত মানব সভ্যতার ভিত্তি বা পিলার কি?’ ওস্তাদ জিজ্ঞেস করেন।
আমরা কেউ কোনো উত্তর দিই না। জানি ওস্তাদ এখন কোনো দার্শনিক টাইপ কথা বলবেন।
প্রকৃতি। শিল্পী মাসুদা আহমেদপ্রকৃতি। শিল্পী মাসুদা আহমেদ
‘মানব সভ্যতার ভিত্তি হলো মনের ভাব ঢেকে রাখা। মানুষ লজ্জাস্থান ঢাকার অনেক আগেই মনের ভাব ঢেকে রাখতে শিখে গেছে। মনে কর এক রাজা আর এক রাজাকে কি মনে করে সেইটা যদি বলে ফেলত। তারপর ধর ছাত্র শিক্ষককে কি মনে করে, অফিসে কর্মচারী বসকে কি মনে করে কিংবা বিয়ের পরে আরেক নারীকে...থাক ওটা তোদের বুইঝা কাজ নাই। মনের ভাব ঢেকে না রাখলে কবে মারামারি কাটাকাটি কইরাই মানুষ শেষ হইয়া যাইত। বুঝছস...।’
—কি বলেন ভাই ঠিক বলছি না?
হঠাৎ ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করায় আমার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়। ওস্তাদের কথা ভুলে বাস্তবে ফিরে আসি।
—একদম ঠিক বলেছেন।
কিন্তু কয়জন এসব বোঝে। মানব সভ্যতায় ক্ষুদ্র অবদান রাখার জন্য মনের ভাব গোপন রেখে হাসিমুখে উত্তর দিই। কিন্তু খাবার নিয়ে ওই টেবিলে আর ফিরি না...ফিরতে ইচ্ছা হয় না। ফাঁকা দেখে আর একটা টেবিলে বসি। একটু পরেই দুই ভদ্রলোক স্ত্রীসহ ফাঁকা জায়গা পূর্ণ করেন।
—ভাই আপনাকেতো চিনলাম না।
এক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করেন। আমি সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দিই।
—ভাবি ব্যাগটাতো খুব সুন্দর।
—হ্যাঁ। মায়ার থেকে কিনছি। গুচি ব্রান্ড। সেলে না কিন্তু। তুমিতো জানোই আমি সেল থেকে কিছু কিনি না। সব পুরোনো রদ্দি মাল সেলে দেয়। আমি কিনি না।
দুই মহিলার আলাপ শুরু হয়। এই দীর্ঘ প্রবাস জীবনে এসব এখন দারুণভাবে সয়ে গেছে। তাই চুপচাপ খেতে থাকি।
—পাবলিক স্কুলে কোনো পড়াশোনা হয় নাকি? আমার দুইটা ছেলেমেয়েই প্রাইভেট স্কুলে পড়ে। বছরে ৩০ হাজার ডলার খরচ। কিন্তু কি করব। ছেলেমেয়ের জন্যইতো বিদেশ থাকা।
এক ভদ্রলোক আলাপ শুরু করেন। পরবর্তী দশ মিনিট ওনারা দুজন মিলে পাবলিক স্কুল যে কত খারাপ আর প্রাইভেট স্কুল যে কত ভালো তার বর্ণনা দিয়ে গেলেন।
—ভাই আপনার ছেলেমেয়ে কোথায় পড়ে?
হঠাৎ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেন।
—ভাই আমার ছেলে মেয়ে পাবলিক স্কুলে পড়ে। তবে আপনারা যা বলেছেন তা মনে হয় ঠিক। হাসিমুখে বলি। এভাবেই মানব সভ্যতার পিলার গড়তে গড়তে ক্লান্ত হয়ে যাই। ভাবি আজ অনেক হয়েছে। এক দঙ্গল মানুষের ভিড়ে ছোট ভাইকে খুঁজতে থাকি...বিদায় নেওয়ার জন্য। খুঁজতে খুঁজতেই এক সময় কিচেনের কাছে আসি। তিন-চারজন তরুণ ছেলে কাজ করছে।
—ছয় মাস হইয়া গেল এখনো তুই খালি যাই যাই করস। দেশে কি এমন মধু আছে। আরে এই সব কষ্টের কাম কি সারা জীবন করবি নাকি?
এক তরুণ আরেক তরুণকে বোঝাবার চেষ্টা করছে। যাকে বোঝানো হচ্ছে সে কোনো কথা বলছে না...চোখ তুলে তাকাচ্ছেও না। আমার কৌতূহল হয়। কোক নেওয়ার ছলে দাঁড়িয়ে থাকি।
—দেশের যা অবস্থা যাইয়া কি করবি? আর দুই-তিন বছর পরেই পিআর (পারমানেন্ট রেসিডেন্সি) পাবি। তখন? ওই তুহিন ওরে একটু বোঝা না।
—ওই যে আদিল ভাইরে দেখ।
তুহিনের কথা শুনতে পাই।
—আদিল ভাইয়ের এখন চারটা বাড়ি। নতুন বিএমডব্লিউ গাড়ি। তারে যাইয়া জিগা সে প্রথম জীবনে কি করছে। টয়লেট পরিষ্কার করার কাজ করছে। ধুর তুই আবার কানতাছোস। যা তরে কাম করতে হইব না। তুই বাইরে যা আমরা দেখতাছি।
তরুণ ধীর পায়ে বাইরে যায়। গ্লাস ভর্তি কোক নিয়ে আমি পেছনে যাই।
—কি বিশ্রী আবহাওয়া। এই দেশে কেমনে যে পইড়া আছি। আমি আলাপ শুরু করার চেষ্টা করি।
তরুণ চোখ তুলে তাকায়। তরুণের চোখে সত্যিই সদ্য মোছা জলের দাগ। কেমন মায়া হয়।
—কি নাম তোমার ছোট ভাই। আমি জিজ্ঞেস করি।
—রায়হান।
—কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়?
—সি কিউ। ভাই আমি খেয়াল করছি আপনি আমাদের কথা শুনেছেন।
—হ্যাঁ শুনেছি।
—বিশ্বাস করেন ভাই এই সব কাজের জন্য আমার মন খারাপ না। কাজতো কাজই। ছাত্র অবস্থায় সবাই এমন করে।
—দেশ থেকে আসলে প্রথমে সবার একটু মন খারাপ থাকে।
আমি বোঝাবার চেষ্টা করি।
—আসলে তাও না ভাই। কাউরেই আসলে ঠিক বোঝাইতে পারি না।
—বল না। দেখি বুঝতে পারি কিনা।
—ধরেন প্রতিদিন ঠিক সাতটার বাস ধরি। ঠিক সময়ে বাস আসে। সিটগুলা এত আরামের আমার বাসার সোফাও এত আরামের না। ক্লাসরুম কি ঝকঝকে পরিষ্কার। বন্ধুরা প্রায়ই ঘুরতে এখানে সেখানে নিয়ে যায়। কীযে সুন্দর সব জায়গা।
—তাহলে সমস্যা কোথায়।
—কেমনে বোঝাই। সুন্দর বিশাল সুপার মার্কেটে ঢুকলেই আমাদের বাসার সামনে ফরিদের ছোট্ট অগোছালো দোকানের কথা মনে হয়। হাইওয়েতে উঠলে বাসার সামনের গলির কথা মনে হয়। এই এত সুন্দর জায়গা, সবকিছু এত ভালো কিন্তু কিছুই যে আমার মনে হয় না। আর এ রকম বাঙালি পরিবেশে আসলে মা-বাবা-ভাইবোনের কথা এত মনে হয়। চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না...কাউকে ঠিকভাবে বোঝাতেও পারি না।
রায়হানের কথাগুলো শুনতে শুনতে কোথায় আমার কি যেন নড়ে গেল। পরবর্তী কিছুক্ষণ একনাগাড়ে অকপটে নিজের কথা বলে গেলাম।
—ভাইরে এই শূন্যতা...হাহাকার মনে হয় সব প্রবাসীরই আছে। কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য, অভ্যস্ততা, নিরাপত্তাবোধের পলি পড়ে পড়ে হয়তো শূন্যতা ঢেকে যায়...অন্তত চাপা পড়ে যায়। ধৈর্য ধর তোমারও যাবে। জানো মাঝে মাঝে মনে হয় এই সব স্বাচ্ছন্দ্য, অভ্যস্ততা আসলে একটা অসুখই। যে অসুখ অন্য সব কিছুকে ঢেকে দেয়।
উদাসভাবে মনের সত্যি কথাগুলোই বলি। রায়হানও মনোযোগ দিয়ে শোনে আমার কথা।
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীতপ্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
এই কাহিনি এখানেই শেষ হওয়ার কথা। পিআর, সিটিজেনশিপ, চাকরি, গাড়ি, বাড়ি, মর্টগেজ এসবের মাঝেই রায়হানের জীবন চলার কথা...সবার যেমন চলে...আমার যেমন চলছে। কিন্তু প্রায় দুই বছর পরে রায়হানের সঙ্গে আবার আমার দেখা হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারির রুটিন সফরে বাংলাদেশ গেছি। বসুন্ধরায় কিছু কেনাকাটা করে সিএনজি খুঁজছি বাসায় ফেরার জন্য। কোনো সিএনজি ওয়ালাই যেতে রাজি হচ্ছে না। বিরক্ত মনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা সিএনজি সামনে এসে থামল। লোহার শিকে ঘেরা পেছনের খুদে জেলখানা থেকে এক ঝকঝকে তরুণ নেমে এল।
—ভাই আমাকে চিনতে পারছেন।
—না মানে ঠিক। আমি ইতস্তত করতে থাকি।
—আমার নাম রায়হান। আপনার সঙ্গে একবার সিডনিতে দেখা হয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারি।
—কেমন আছ? নিশ্চয়ই ছুটিতে এসেছ। ফিরবে কবে?
আমি উচ্ছ্বসিতভাবে জিজ্ঞেস করি।
—ভাই কোথায় যাবেন?
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই রায়হান পাল্টা প্রশ্ন করে। আমি উত্তর দিই।
—ভাই সিএনজিতে মা বসে আছে। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। উল্টোদিকে। না হলে আপনাকে পৌঁছে দিতাম। আপনাকে ছাইড়া দিতেও মন চাচ্ছে না। জানেন না আপনি আমার কি উপকার করেছেন।
-মানে?
-ওই যে বলেছিলেন স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তাবোধ এই সব আসলে একটা অসুখ। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার এক বছর পরে পড়াশোনা শেষ হয়। দেখলাম আপনার কথাই ঠিক। ওই সব অসুখ সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তারপর হঠাৎ এক সপ্তাহের সিদ্ধান্তে দেশে ফিরলাম। আর যাই নাই। ব্যাংকে মোটামুটি ভালো চাকরি করি। কিছুদিন আগে বিয়ে করেছি। বউ আমাকে বোকা বলে।
সলজ্জভাবে শেষ কথাটা বলে রায়হান।
মামা আর দেরি কইরেন না। একটু পর অনেক জ্যাম হইয়া যাবে। সিএনজিওয়ালা রায়হানকে তাড়া দেয়।
-যাও রায়হান। তোমাকে দেখে বেশ ভালো লাগল। আরও ভালো লাগল তোমাকে সুখী দেখে।
-সুখী কিনা জানি না ভাই। বউয়ের কথামতো আমি হয়তো একটু বোকাই। তবে ভালো আছি। বেশ ভালো আছি। মন হু হু করে না। আর স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তাবোধ নিয়ে ভাবি না। ওইগুলিতো এক ধরনের আলগা পলিমাটি। আপনিই বলেছিলেন। দোয়া করবেন ভাই।
বলে সিএনজিতে উঠে বসে রায়হান।

5
আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে ?।
আমরা যা খুশি তাই করি,
তবু তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে ?।
রাজা সবারে দেন মান,
সে মান আপনি ফিরে পান,
মোদের খাটো ক'রে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে ?।
আমরা চলব আপন মতে,
শেষে মিলব তাঁরি পথে,
মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে ?।

Link: http://gitabitan.com/


6
কিডনি রোগের ঝুঁকি স্থূলতায় ।। অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ


কিডনি রোগের ঝুঁকি স্থূলতায়

বিশ্বব্যাপী মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ‘বিশ্ব কিডনি দিবস’ পালন করা হয়। সে অনুযায়ী এ বছর, বৃহস্পতিবার, (০৯ মার্চ) বিশ্বব্যাপী উদযাপন করা হচ্ছে ‘বিশ্ব কিডনি দিবস-২০১৭’।

বিশ্ব কিডনি দিবসের উদ্দেশ্য হলো এ রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা এবং কিডনি রোগ প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টি। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘স্থূলতা কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, সুস্থ কিডনির জন্য প্রয়োজন সুস্থ জীবনধারা’।

বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগ দিন দিন মহামারী আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটিরও বেশি মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি ঘণ্টায় অকাল মৃত্যুবরণ করছে পাঁচজন। সাধারণত ৭৫ শতাংশ কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে রোগীরা বুঝতেই পারেন না যে, সে ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিডনি যখন বিকল হয়ে যায় তখন বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় কিডনি সংযোজন অথবা ডায়ালাইসিস। অন্যদিকে কিডনি রোগের চিকিৎসা এতোই ব্যয়বহুল যে, এদেশের শতকরা ১০ শতাংশ লোকেরও সাধ্য নেই এই ব্যয়-বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ স্থূল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর যতো মৃত্যু হয় পুষ্টিহীনতার জন্য, তার চেয়ে বেশি মৃত্যু অতিভোজন ও অতি ওজনের কারণে। মানুষের মৃত্যুর জন্য প্রথম ১০ ঝুঁকির মধ্যে স্থ‍ূলতা একটি। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে মৃত্যুর জন্য দায়ী অসংক্রামক ব্যাধিগুলো। আর স্থূলতা জন্ম দেয় জীবন ঝুঁকিতে ফেলা এসব অসংখ্য ব্যাধির। এর মধ্যে প্রধান রোগগুলো হলো; উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাড়-জোড়ার ক্ষয় ও ব্যাথা, স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হওয়া ও নাক ডাকা, মেটাবোলিক সিন্ড্রম, মানসিক অবসাদ ও নিরানন্দভাব, কোলন ও ব্রেস্ট ক্যান্সার এর মতো মারাত্বক ব্যাধি।

স্থূলতার সঙ্গে কিডনি রোগের সম্পর্ক সরাসরি। বাড়তি ওজন সরাসরি কিডনির ছাকনি নষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে বাড়তি ওজন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের কারণ যা কিডনি বিকলের অন্যতম কারণ।

শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে পরিবেশগত কারণে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবে পল্লি অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, গর্ভবতী মায়েদের ২১ শতাংশ স্থূল, ৪০ শতাংশ মাত্রাতিরিক্ত ওজন, অন্যদিকে মাত্র ৩৩ শতাংশ মায়েদের ওজন স্বাভাবিক। অথচ অতিরিক্ত ওজনের জন্য মা ও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি।

স্থূলতা প্রতিরোধে করণীয়:
স্বাস্থ্যকর সুষম পরিমিত খাবার এবং সুস্থ জীবনধারার চর্চা সুস্থ থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একবার  মুটিয়ে গেলে, তা নিয়ন্ত্রণে আনা অনেক কঠিন। কিন্তু আমরা একটু সচেতন হলে, আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা যদি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পালন করতে পারি, তবে স্থূলতার ভয়াল থাবা থেকে আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারবো।

শিশুদের ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। কিশোর ও যুবকদের ক্ষেত্রে কম্পিউটার, দীর্ঘক্ষণ ভিডিও গেমস, ফেসবুক, চ্যাটিং ও টেলিভিশনের সামনে সময় কাটানোর পরিবর্তে খোলা মাঠে খেলাধুলা, ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করতে হবে। ধীরে ধীরে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। সুস্থ জীবনধারায় উৎসাহিত করতে বাবা-মাকে রোল মডেল হিসেবে কাজ করতে হবে।

বড়দের ক্ষেত্রে ওজন নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যসম্মত কম ক্যালরিযুক্ত সুসম খাদ্যের অভ্যাস ও নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম এবং ব্যায়াম ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে। প্রতিদিন নিজের ওজন লিখে রাখতে হবে। অফিসে চেয়ারে বসার কাজ থাকলেও উঠে গিয়ে হাঁটতে হবে। লিফট পরিহার করে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার অভ্যাস করতে হবে।

অতিরিক্ত চর্বি, চিনি বা ক্যালরিযুক্ত খাবার পরিহার করে পর্যাপ্ত পরিমাণে শাক-সবজি ও আঁশ যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। মিহি খাবারের পরিবর্তে গোটা শস্য; যেমন- লাল চাল, গমের রুটি খেতে হবে। ক্ষুধার্ত হলেই কেবল খাওয়া উচিত, অযথা বা অপ্রয়োজনীয় খাবার বর্জন করা উচিত। কাউকে খুশি করার জন্য বা ভালো কাজের পুরস্কার হিসেবে মজার খাবার না দিয়ে, ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। কোমল পানীর পরিবর্তে সাধারণ পানি পানে উৎসাহিত করতে হবে।
 
এটা স্পষ্ট যে, শহরে হাঁটার রাস্তাগুলো এমনিতেই সরু, তার ওপর এগুলো হকারদের দখলে। হাঁটার জায়গা কোথায়! বেশির ভাগ স্কুলে খেলার মাঠ নেই। নগর পরিকল্পনাবিদদের এদিকে নজর দিতে হবে।

সবশেষে বলা যায়, সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য সুস্থ জীবনধারা। নিজে চর্চা করুন এবং সন্তানদের উৎসাহিত করুন। এতে আপনি সুস্থ থাকবেন, জাতি পাবে কর্মঠ ও সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

লেখক
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ


http://forum.daffodilvarsity.edu.bd/index.php?action=post;board=295.0

7
অগ্নিশিখা, এসো এসো, আনো আনো আলো।
দুঃখে সুখে ঘরে ঘরে গৃহদীপ জ্বালো।।
আনো শক্তি, আনো দীপ্তি, আনো শান্তি, আনো তৃপ্তি,
আনো স্নিগ্ধ ভালোবাসা, আনো নিত্য ভালো।।
এসো পুণ্যপথ বেয়ে এসো হে কল্যাণী-
শুভ সুপ্তি, শুভ জাগরণ দেহো আনি।
দুঃখরাতে মাতৃবেশে জেগে থাকো নির্নিমেষে
আনন্দ-উৎসবে তব শুভ্র হাসি ঢালো।।

8
Story, Article & Poetry / বাংলা ভাষা
« on: March 12, 2017, 02:08:35 PM »


বাংলা ভাষা

আঁকার ভাষা লেখার ভাষা

চাওয়ার ভাষা পাওয়ার ভাষা

বাংলা ভাষা

আঁকার ভাষা লেখার ভাষা

চাওয়ার ভাষা পাওয়ার ভাষা

মনের ভেতর জাগায় আশা

বাংলা ভাষা- বাংলা ভাষা।

বলার ভাষা চলার ভাষা

লৌহকপাট ভাঙার ভাষা

রক্তে গড়া ভালোবাসা

বাংলা ভাষা- বাংলা ভাষা।

মিষ্টি মধুর সুরের ভাষা

আমার অনেক স্বপ্ন আশা

কান্না ভুলে কেবল হাসা

বাংলা ভাষা- বাংলা ভাষা।

9
কবিতা

৩২ নম্বর মেঘের ওপারে
আনিসুল হক

তার ওপরে মেঘ,
মেঘের মধ্যে বাড়ি—
৩২ নম্বর মেঘমহল।
৩২ নম্বরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি।
আপনার গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি,
চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা,
হাতে পাইপ।

ছাদের কিনারে সানসেটে উড়ছে কবুতরগুলো।
উঠানে সাইকেল-রিকশা চালাচ্ছে লাল সোয়েটার পরা রাসেল।
পানের ডিব্বা নিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশের গোল টেবিলটাতে সুপারি কাটায় ব্যস্ত আপনার রেণু।
জামাল মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের সময় পাওয়া ক্যাপটা পরে আয়নায় তাকাচ্ছেন।
ছাদের ঘরে বেহালা বাজাচ্ছেন কামাল। মেঘে মেঘে ছড়িয়ে পড়ছে বেহালার মূর্ছনা।

আকাশের ওপারে আকাশ, তার ওপরে মেঘ,
মেঘের মধ্যে বাড়ি—৩২ নম্বর মেঘমহল।
সেইখানে দোতলার ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে
পুরু লেন্সের ভেতর থেকে পূর্ণ চোখে তাকিয়ে আপনি দেখছেন...
.যেমন করে দেখেছিলেন
একাত্তরের মার্চে ওড়ানো সবুজের মধ্যে লাল সূর্য আর হলুদ মানচিত্রখচিত পতাকা;
যেমন করে তাকিয়ে দেখেছিলেন সত্তরে একাত্তরে রোজ আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়
৩২ নম্বর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা স্বাধীনতা-পাগল মানুষগুলোকে;
যেমন করে সাতই মার্চের মঞ্চে দাঁড়িয়ে লক্ষ-কোটি চোখে দেখতে পেয়েছিলেন
একটা জাতির জন্মের ফুল ফোটা;
যেন আপনি রিলকে, পৃথিবীর শেষতম কবি যিনি
শিল্পীর মগ্নতা নিয়ে নিরীক্ষণ করেন কী করে কলি থেকে পাপড়ি উন্মীলিত হয়, ফুটে ওঠে ফুল।
আকাশের ওপারে আকাশে
মেঘমহলের ৩২ নম্বরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি তাকিয়ে আছেন—
বারবার দেখেও আপনার আশ মিটছে না;
শিল্পী যেমন ছবি আঁকা শেষ করে ক্যানভাস থেকে দূরে গিয়ে পুরোটা ছবি বারবার করে দেখেন;
লেখা সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথ যেমন বারবার পড়তেন তাঁর কবিতা
আর পাণ্ডুলিপিটাকে বানিয়ে ফেলতেন একটা আস্ত শিল্পকর্ম;

তেমনি করে আপনি দেখছেন
আপনার আঁকা ছবিটাকে
দূর থেকে, কিন্তু পূর্ণ চোখে।
তেমনি করে আপনি পড়ছেন আপনার লেখা কবিতাটাকে।
অপার্থিব শিল্পসুষমায় অপরূপ দিব্যকান্তি
আপনি দেখছেন কী রকম জ্বলজ্বল করছে আপনার শিল্পকর্মখানি—
দেখছেন কী রকম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বাঙালিরা—
দেখছেন কী রকম মুক্ত কণ্ঠে তারা গাইছে আমার সোনার বাংলা—
স্বকণ্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনানোর
কবিজনোচিত উজ্জ্বলতা আর মগ্নতা অবয়বজুড়ে;
ভোরের সোনালি আলোয় কাঁচা-পাকা চুলে স্বর্গীয় দ্যুতি।

রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর জীবনানন্দ দাশের পাশে দাঁড়িয়ে আপনি বলছেন,
‘ওই দেখুন, ওই যে আমার কবিতা—
কবিগুরু, ওই যে আপনার সোনার বাংলা,
বিদ্রোহী কবি, ওই যে আপনার জয় বাংলা,
জীবনানন্দ বাবু, ওই যে আপনার রূপসী বাংলা,

ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ,
ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ,
ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ,
চির অপরূপ চির মধুর চির অপরাজেয় বাংলাদেশ।’

আপনি চশমা খুলে হাতে নিলেন,
আপনার উজ্জ্বল চোখ দুটি থেকে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা অশ্রু।

অনেক নিচে মর্ত্যের এক চার কোনা ঘরে লেখার টেবিলে বসে আছি—
আমার চোখ ভিজে গেল
আমি পাশ-টেবিলে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
কে বলেছে আপনি নাই, এই তো আপনি আছেন—এইখানে,
সবখানে, সমস্ত বাংলায়—
এইখানে বাংলার লাল ও সবুজে
আমাদের অশ্রু আর ভালোবাসায়,
আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার
আর এগিয়ে যাওয়ার অমোঘ মন্ত্রে—
‘মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না...’


10
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমসমূহে অতি তীব্র ভূমিকম্পের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে ঢাকা শহরকে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা সাধারণ জনগণকে কিছুটা বিভ্রান্ত ও কিছুটা আতঙ্কিত করেছে। একজন শিল্পপতি এই লেখককে বলেই বসলেন যে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কতটা যুক্তিসংগত হবে তা তিনি ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি জানালেন, কম্পিউটারে ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে তিনি জেনেছেন যে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প মানে সর্বাত্মক ধ্বংসলীলা। বাস্তবিকই তাই, ভূমিকম্প মাত্রার স্কেলে ৯ মাত্রার সংজ্ঞা সর্বাত্মক ধ্বংসই বটে।
ওপরে উল্লিখিত ভূমিকম্পের সংবাদটি দেশি-বিদেশি কয়েকজন ভূবিজ্ঞানী কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা রচনার সূত্রে পরিবেশন করা হয়। নেচার জিওসায়েন্স নামের পত্রিকাতে উপরিউক্ত গবেষক দল বেশ কয়েক বছর ধরে চালানো কাজের ওপর ভিত্তি করে প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন। ওই গবেষণাকাজে মাঠভিত্তিক উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হলেও উপাত্তসমূহের বিশ্লেষণ বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেনি। দেশের একাধিক ভূবিজ্ঞানী উপরিউক্ত গবেষকদের বিশ্লেষণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁদের মতে, উপাত্ত বিশ্লেষণের একাধিক পর্যায়ে গবেষক দলের মতসমূহ বহুলাংশে অনুমানভিত্তিক। আর এহেন অনুমানভিত্তিক বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করে একটি এলাকা বা শহরকে ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সম্ভাবনাময় বলা বা তা বাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করাটা নেহাত অযৌক্তিক। তবে এই লেখকের সঙ্গে উল্লেখিত গবেষণা প্রবন্ধের প্রধান লেখক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল স্টেকলারের যোগাযোগ হলে তিনি মত প্রকাশ করেন যে দেশের সংবাদমাধ্যমসমূহে বিষয়টি অতিরঞ্জিতভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা কখনো একচোখা হতে পারে না। একজন বিজ্ঞানী তখনই প্রজ্ঞার পরিচয় দেন যখন তিনি ভিন্নমতকে আস্থায় নিয়ে মতবিনিময় করে থাকেন। তাই আগামী দিনে এ বিষয়ে পক্ষ-বিপক্ষ বিজ্ঞানীদের মতবিনিময়ের অবকাশ রয়েছে। আর গবেষণালব্ধ জ্ঞানের পরিপক্বতা সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে। পৃথিবীর অনেক স্থানেই পরিপক্ব গবেষণা বৈজ্ঞানিক তথ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ ভূবিজ্ঞানীদের কাছে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্ড এনড্রেস ফল্টটি তীব্র ভূমিকম্পের উৎসের অন্যতম প্রধান স্থান হিসেবে খুবই সুপরিচিত। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি কেবল সময়ের ব্যাপার যে ক্যালিফোর্নিয়ায় বিরাট মাত্রার ভূমিকম্প হবে, যা নাকি একাধিক শহরকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ ফল্টটির ওপর এতটাই গবেষণা ও জরিপকাজ হয়েছে যে এটির অস্তিত্ব বা প্রকৃতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেন না। এই ফল্টটি ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান এবং দুটি প্লেটের সংযোগকারী রেখা হিসেবে তাদের বিপরীতমুখী গতিকে ধারণ করে। আর রাডারসংবলিত উপগ্রহ এবং জিপিএস প্রযুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ বছরের গবেষণা থেকে এই ফল্ট রেখার গতি, দিক বা নানা প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের জানা হয়েছে। এভাবেই তাঁরা বলেন যে ৮ মাত্রার বিরাট ভূমিকম্প কোনো না কোনো সময় হবেই। অথচ দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে রাখা এই ভবিষ্যদ্বাণীর পরও বিশ্বের অন্যতম প্রধান প্রযুক্তি কম্পিউটার শিল্পের স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত সিলিকন ভ্যালি গড়ে উঠেছে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের মাঝবরাবর।
একইভাবে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের পশ্চিমে সাগরের ভেতর দিয়ে অপর একটি ভয়ংকর প্লেট বাউন্ডারি বিদ্যমান এবং বিজ্ঞানীদের মতে, এটিও আমেরিকা মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ ভূমিকম্পের প্রমাণিত উৎস। এটিও ভূবিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের গবেষণা ও জরিপে ব্যাপকভাবে পরীক্ষিত। তাঁরা বলছেন, ভ্যাঙ্কুভার শহর ও আশপাশ অঞ্চল ভবিষ্যতে কোনো একসময় তীব্র আকারের ভূমিকম্পের শিকার হবে, যার মাত্রা ৮ বা ততোধিক হতে পারে। কবে হবে তার কোনো ঠিক নেই অর্থাৎ তা আগামীকাল থেকে ৫০০ বছরের মধ্যের যেকোনো সময়। কিন্তু তাতে কী এসে যায়, কানাডার সবচেয়ে সুন্দর ও বাসযোগ্য শহর হিসেবে ভ্যাঙ্কুভার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অনেক দিন। কয়েক বছর আগে শহরটি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও বাসযোগ্য শহরের তালিকায় এক নম্বর স্থান অধিকার করে। নেপালের ভূমিকম্পপ্রবণতা বহুলভাবে পরিচিত। গত বছর সেখানে ৭.৮ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছে, তা ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। হিমালয় পাহাড় বরাবর কতগুলো মেগা ফল্ট বহুদিন ধরে ভূবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রয়েছে এবং এই ফল্ট যেকোনো একসময় ভূমিকম্প দেবে, তা আগেই জানা ছিল।
বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলের কাছে অবস্থিত। তাই এটি তুলনামূলকভাবে সাধারণ কোনো স্থান থেকে অধিকতর ভূমিকম্পপ্রবণ। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি বা ভূমিকম্পবিজ্ঞান এখনো তুলনামূলকভাবে অপরিপক্ব। বাংলাদেশের ভূমিকম্প নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করার পূর্বশর্ত হিসেবে আরও অনেক জরিপ ও গবেষণার প্রয়োজন। ভূমিকম্প নিয়ে ওপরে উল্লেখিত গবেষণাকাজের বিশ্লেষণে বহু অনিশ্চয়তা রয়েছে। যেমন গবেষক দল তাদের প্রকাশিত প্রবন্ধে যে মেগা থ্রাস্ট ফল্ট দেখিয়েছেন তার অবস্থান অতিমাত্রায় জল্পনাভিত্তিক। কেনই বা সে ফল্টটি ঠিক ঢাকা শহরের নিচ দিয়ে যাবে, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। আবার সে ফল্টটির কোনো ভূতাত্ত্বিক চিহ্নও কেন নেই, তার ব্যাখ্যা নেই। তাই এখানে অতি তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ভূতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের অবস্থান নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। আবার ভূমিকম্প হওয়ার ফলে লিকুইফ্যাকশন হয়ে বাড়ি রাস্তা লোকজন সমূলে তলিয়ে যাওয়ার ঘোষণাটিও অতিরঞ্জিত। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, ঢাকা শহরের লাল মাটির এলাকাসমূহ যথেষ্ট সুদৃঢ় এবং তাতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে নিচু ভূমি ভরাট করে যেসব এলাকায় বাড়ি-ঘর তৈরি হয়েছে সেসব বড় ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে দেশি ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমসমূহে ঢাকা শহর অঞ্চলে ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে যে প্রচার হয়েছে, তা নেহাত অপরিপক্বতার সাক্ষ্য বহন করে। যে সূত্রমতে এই সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে সেই গবেষণা প্রবন্ধেই এ ধরনের এসটিমেটকে বহুলভাবে অনিশ্চিত উপাদানের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে বলে উল্লেখ আছে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এহেন তীব্র ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী প্রচারটি বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে বিশ্ববাজারে উপস্থাপন করার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখার প্রয়াস পান। তবে একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে তা সম্ভবত অমূলক। গবেষণা প্রবন্ধটির প্রধান লেখক অধ্যাপক মাইকেল স্টেকলার এই নিবন্ধকারকে জানান যে মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চালন করার কোনো উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা তাঁর নেই। তিনি কখনো বলেননি যে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের বিপদ আসন্ন। তাদের কাছে এমন কোনো উপাত্ত নেই যা দিয়ে এখানে ভূমিকম্প হওয়ার সময় নিয়ে মন্তব্য করা যায়। তবে তিনি আশা করেন সে সময়টি সুদূর, যাতে করে বাংলাদেশ ভঙ্গুর স্থাপনাসমূহ শক্ত করে তোলার যথেষ্ট সময় পায়।
ভূমিকম্পের তীব্রতা নিয়ে বিতর্কে না গিয়ে যে কথাটি দেশের সব ভূবিজ্ঞানী মনে করে থাকেন তা হলো বাংলাদেশের ভঙ্গুর প্রকৃতির অবকাঠামোসমূহকে অপেক্ষাকৃত সুদৃঢ় করার প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

11
ন্যূনতম মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলেও সবার আগে অর্থের প্রয়োজন পড়ে। বলা যায়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই অর্থের প্রয়োজন। এমনকি ইবাদাত-বন্দেগি, পূজা-অর্চনা—কোনো কিছুই অর্থ ছাড়া সম্ভব নয়। ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিধানও অর্থ ছাড়া পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

জাকাত ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। জাকাত একদিকে দরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি, অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।

জাকাত শব্দের আরবি অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে জাকাত বলতে ধনীদের ধন-মালে আল্লাহর নির্ধারিত অংশকে বোঝায়। জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে, বিত্তশালীদের পরিশুদ্ধ করে, দারিদ্র্য মোচন করে, উত্পাদন বৃদ্ধি করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে এবং সমাজে শান্তি আনে। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে জাকাত। ইমানের পর নামাজ ও তার পরই জাকাতের স্থান। কোরআন মজিদের ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে ২৮ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

জাকাত কে দেবে?

জাকাত স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক এমন মুসলিম নর-নারী আদায় করবে, যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে। তবে এর জন্য শর্ত হলো—এক. সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে। দুই. সম্পদ উত্পাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হতে হবে। তিন. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। চার. সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকলেই কেবল জাকাত ফরজ হবে। পাঁচ. জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা শর্ত। ছয়. কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলেই কেবল সে সম্পদের ওপর জাকাত দিতে হবে।

জাকাতের নিসাব

ক. সোনা ৭.৫ তোলা=৯৫.৭৪৮ গ্রাম প্রায়। খ. রুপা ৫২.৫ তোলা=৬৭০.২৪ গ্রাম প্রায়। (আহসানুল ফতোয়া ৪/৩৯৪, আল ফিকহুল ইসলামী ২/৬৬৯)

দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব নির্ধারণে সোনা-রুপা হলো পরিমাপক। এ ক্ষেত্রে ফকির-মিসকিনদের জন্য যেটি বেশি লাভজনক হবে, সেটিকে পরিমাপক হিসেবে গ্রহণ করাই শরিয়তের নির্দেশ। সুতরাং মুদ্রা ও পণ্যের বেলায় বর্তমানে রুপার নিসাবই পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে। তাই যার কাছে ৫২.৫ তোলা সমমূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রা বা ব্যবসায়িক পণ্য মজুদ থাকবে, তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে। যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের একভাগ (২.৫০%) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৭২; সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬২৩)

যেসব সম্পদে জাকাত ফরজ

সব ধরনের সম্পদে জাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকাপয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়।

সোনা-রুপার অলংকার সব সময় বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক সর্বাবস্থায় তার জাকাত দিতে হবে। (আবু দাউদ শরিফ : ১/২৫৫; নাসায়ি, হাদিস : ২২৫৮)

অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপরও জাকাত ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৬১)

মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকাপয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার জাকাত আদায় করা ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৯১)

ব্যাংক ব্যালেন্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকাপয়সার মতোই। এসবের ওপরও জাকাত ফরজ।

টাকাপয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে জাকাত ফরজ। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৭)

হজের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলেমেয়ের বিয়েশাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তাতেও জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩২৫)

দোকানপাটে যা কিছু বিক্রির উদ্দেশ্যে রাখা থাকে, তা বাণিজ্যিক পণ্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ : ১/২১৮)

ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন—জমিজমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি যেমন—মুদিসামগ্রী, কাপড়চোপড়, অলংকার, নির্মাণসামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়্যার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি, তা বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১০৩)

যদি সোনা-রুপা, টাকাপয়সা কিংবা বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সব সম্পদ হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৮১)

যেসব সম্পদে জাকাত ফরজ নয়

সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। তদ্রূপ হীরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসার পণ্য না হলে সেগুলোতেও জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৬/৪৪৭-৪৪৮)

নিজ ও অধীনস্থ পরিবারপরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা, হাদিস : ১০২০৭)

গৃহের আসবাবপত্র যেমন—খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদির জাকাত ফরজ নয়। অনুরূপ গার্হস্থ্য সামগ্রী যেমন হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৫৬০)

পরিধানের বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে, তবুও তাতে জাকাত ফরজ হয় না। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৫)

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসার পণ্য নয়, তার ওপর জাকাত ফরজ নয়।

ঘরবাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও (মূল দামের ওপর) জাকাত ফরজ নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ বছরে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হয়, তবে সেই ভাড়ার ওপর জাকাত ফরজ।

ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী—যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালাবাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও জাকাত ফরজ নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের ওপর জাকাত আসবে।

কারো ঋণ যদি এত হয়, যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ জাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে না, তাহলে তার ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুয়াত্তা মালেক : ১০৭; আদদুররুল মুখতার : ২/২৬৩)

কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে, ঋণ দুই ধরনের হয়ে থাকে। ক. প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়। খ. ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়।

প্রথম প্রকার ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে জাকাতের হিসাব করতে হবে। কিন্তু যেসব ঋণ উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয়, যেমন—কারখানা বানানো, ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বিল্ডিং বানানো অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিলে জাকাতের হিসাবের সময় সে ঋণ ধর্তব্য হবে না। এ ধরনের ঋণের কারণে জাকাত কম দেওয়া যাবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৮৭)

কেউ অন্যের কাছে টাকা পেলে পাওনা উসুল হওয়ার পর ওই টাকার জাকাত আদায় করা ফরজ। তার আগে আদায় করা জরুরি নয়, তবে আদায় করলে জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩৫৬)

তাই স্বামীর কাছে পাওনা মোহরানা নিসাব পরিমাণ হলেও তা স্ত্রীর হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতে জাকাত ফরজ হয় না।

যাদের জাকাত দেওয়া যাবে

জাকাত কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য আর যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য, তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান।

যে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য মাল আছে অথবা কিছুই নেই, এমনকি এক দিনের খাদ্যও নেই, এমন লোক শরিয়তের দৃষ্টিতে গরিব। তাকে জাকাত দেওয়া যাবে।

যার কাছে জাকাতযোগ্য সম্পদ আছে, সে শরিয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে জাকাত দেওয়া যাবে না।

অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির কাছে জাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত অন্য ধরনের সম্পদ আছে, যাতে জাকাত আসে না—যেমন ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতা, গার্হস্থ্য সামগ্রী ইত্যাদি নিসাব পরিমাণ আছে, তাকেও জাকাত দেওয়া যাবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১৫৬)

তবে এই ব্যক্তির ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।

জাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হলো, উপযুক্ত ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া। যাতে সে নিজের খুশিমতো তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এরূপ না করে যদি জাকাতদাতা নিজের খুশিমতো দরিদ্র লোকটির কোনো প্রয়োজনে টাকাটি খরচ করে যেমন—তার ঘর সংস্কার করে দিল, টয়লেট স্থাপন করে দিল কিংবা পানি বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করল, তাহলে জাকাত আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৭)

আত্মীয়স্বজন যদি জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়, তাহলে তাদের জাকাত দেওয়াই উত্তম। ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাগ্নে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা এবং অন্য আত্মীয়দের জাকাত দেওয়া যাবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১৬০)

তাদের জাকাতের কথা না বলে মনে মনে জাকাতের নিয়ত করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে এটাই উত্তম।

নিজ মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, পরদাদা প্রমুখ ব্যক্তি—যারা তার জন্মের উৎস তাদেরকে নিজের জাকাত দেওয়া জায়েজ নয়। এমনিভাবে নিজের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি এবং তাদের  অধস্তনকে নিজ সম্পদের জাকাত দেওয়া জায়েজ নয় । স্বামী ও স্ত্রী একে অন্যকে জাকাত দেওয়া জায়েজ নয় । (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৮)

জাকাত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা নেই। যার জন্য যেভাবে বছর গণনা করা সুবিধাজনক হয়, সে সেভাবেই জাকাত আদায় করবে। তার পরও রমজান মাসেই বিত্তবানরা দান-সদকা ও জাকাত প্রদানে উৎসাহী হন। কেননা রমজান মাসে যেকোনো ধরনের দান-সদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। স্মরণ রাখতে হবে, এ মাসেই জাকাত আদায়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/islamic-life/2016/06/24/373688#sthash.lGZSQBh3.dpuf

12
আর এইচডি ছবি-ভিডিওর যুগে স্মার্টফোনে একটা কমন সমস্যা হলো মেমরি। যদিও বাজারে অনেক ক্যাপাসিটির মেমরি পাওয়া যায় তবে সেটা তা ব্যায়সাপেক্ষ। আর কত বারই বা মেমরি কার্ড বদলাবেন? জানেন কি, মেমরি কার্ড না বদলেও বাড়িয়ে নিতে পারেন আপনার ফোনের মেমরি? চলুন দেখে নেওয়া যাক টিপসগুলো :

০১. ক্যামেরার রেজলিউশন: ফোনের মেমরির সর্বাধিক দখল করে থাকে ছবি এবং ভিডিও। ছবি এবং ভিডিওর সংখ্যা যদি একান্তই কমাতে না পারেন, তা হলে ফোনের রেজলিউশন কমিয়ে-বাড়িয়ে মেমরি স্পেস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।

০২. হোয়াটসঅ্যাপে অটো-ডাউনলোড: রোজ হোয়াটস্অ্যাপে সকলেরই একাধিক ভিডিও বা যে কোনও রকমের মিডিয়া ফাইল ঢুকে থাকে। যা অটো-ডাউনলোড হয়ে থাকে। আপনাকে হোয়াটস্অ্যাপে কে কী পাঠাচ্ছেন তার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। হোয়াটঅ্যাপে ফোন সেটিংসে গিয়ে ‘মিডিয়া অটো-ডাউনলোড’ অপশনটা নিষ্ক্রিয় করে দিন।

০৩. ম্যাজিক ক্লিনার অ্যাপ: অটো-ডাউনলোড অপশন নিষ্ক্রিয় করতে না চাইলে মেমরি স্পেস বাড়ানোর আরও একটা উপায় রয়েছে। অযাচিত হোয়াটস্অ্যাপ ফটো এবং ভিডিও বাছাই করে তা ফোন থেকে সহজেই মুছে ফেলতে সাহায্য করে।

০৪. ব্যাকআপ: অ্যানড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীরা তাঁদের সমস্ত ফটো, ভিডিও গুগল লাইব্রেরিতে জমা করতে পারেন। একই ভাবে, অ্যাপল ব্যবহারকারীরা এই সমস্ত কিছু আইক্লাউড অ্যাপ্লিকেশনে জমা করতে পারেন।  এর ফলে মোবাইল ফোনের মেমরি স্পেস অনেকটাই বাড়বে।

০৫. ই-মেইল সিনক্রোনাইজ: মোবাইল ফোনের ই-মেল অপশনে গিয়ে প্রয়োজন মতো সিনক্রোনাইজ-র দিন বাড়িয়ে বা কমিয়ে নিন।

০৬. অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ মুছে ফেলুন: এমন অনেক অ্যাপ্লিকেশন এবং গেম আমাদের ফোনে থেকে যায় যেগুলো এখন আর কাজেই লাগে না। কিন্তু মোবাইলের অনেকটা মেমরি স্পেস দখল করে থাকে তারা। যত দ্রুত সম্ভব এই অযাচিত অ্যাপ ফোন থেকে সরিয়ে ফেলুন।
-
 See more at: http://www.kalerkantho.com/online/info-tech/2016/06/29/375878#sthash.ezjG8cb5.zLCXxFCN.dpuf

13
মাস তিনেক আগে প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশের কোথাও হুট করেই বদলে গেল পরিবেশ। অক্টোপাস-তারামাছ-কাঁকড়া তো ছিলই, কোত্থেকে উদয় হলো ৩৮ হাজার পাউন্ড ওজনের পেটমোটা ক্যাপসুল আকৃতির এক কনটেইনার! আকারে ঢাউস হলেও সে বস্তু নড়েচড়ে না, টুঁ শব্দটাও করে না। জলজ প্রাণীগুলো মাথা চুলকে মরলেও মাইক্রোসফট কর্তৃপক্ষের ঠিকই জানা ছিল ওই বস্তুর নাড়িনক্ষত্র।
মাইক্রোসফট করপোরেশনের একদল গবেষক পুরো এক ডেটা সেন্টার এই ক্যাপসুলের মধ্যে ভরে ১০৫ দিন অথই জলরাশির নিচে ফেলে রেখেছিলেন। ‘প্রোজেক্ট ন্যাটিক’ ছদ্মনামের সফল এই পরীক্ষণের ফলে এখন সমুদ্রের তলদেশেও যে ডেটা সেন্টার নির্মাণ সম্ভব, তা জানা গেল। প্রশ্ন হলো, ধু ধু মরুপ্রান্তর আছে, আদিগন্ত সবুজ মাঠ আছে, সমুদ্রের নিচেই কেন?
কারণ, ডেটা সেন্টার আকারে খুব বড় হয়। কোনো কোনোটা তো পুরো এক ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়। তাতে সারি সারি সাজানো সার্ভার থেকেই আসে ইন্টারনেটে পাওয়া সব তথ্য। এই সার্ভারগুলো প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে। ঠান্ডা করার জন্য কুলিং সিস্টেমের পেছনে ঢালতে হয় কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। সমুদ্রের হিমশীতল পানির নিচে ডেটা সেন্টার করলে প্রাকৃতিক উপায়েই তা ঠান্ডা থাকবে। আলাদা করে ঠান্ডা করতে হবে না।
আরেকটি সুবিধা হলো, সমুদ্রের তীর ঘেঁষেই গড়ে ওঠে সভ্যতা। জনবসতিও এই এলাকাগুলোতেই বেশি। সমুদ্রের তলদেশে ডেটা সেন্টার স্থাপন করলে কাছের এলাকাগুলোয় দ্রুততর ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া ক্যাপসুলের সঙ্গে টারবাইন লাগানো সম্ভব হলে সমুদ্রস্রোত কাজে লাগিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। সব দিক থেকেই ধারণাটি লাভজনক।
সামনে একটাই চ্যালেঞ্জ—প্রবল পানির চাপ সহ্য করে দীর্ঘদিন ক্যাপসুলগুলো কর্মক্ষম থাকবে কি না!



* নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে

14
Story, Article & Poetry / Dream
« on: November 26, 2015, 03:32:51 PM »
You are not of this planet
Of this distant space
Where you drift along the shore
Where you get lost in you the mirror
You are from a distant time
A distant kiss
Longing to pull me back
Again to your flame.

You are me, and I… you
We are like two shells
Floating under the sea
For eternity too…

I dream,
And when I do
I see you,
You a distant road of black pitch torn apart by invisible lights
You a tree
I see
In the night when every man is apart,
From the day that he lived through.
Then again I see you

Millions of times I slept and woke
With a strange smell of an oak.

And then,

I dream about a blue sea,
Coming closer towards me…
 
source....http://arts.bdnews24.com/?p=127#more-127

15
অনুবাদ: দিলওয়ার হাসান

সেই বিকেলে মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “যে ভাবে তুমি নিজের সঙ্গে কথা বলো, তা কি পুরনো অভ্যাস?” টেবিলের ওপর থেকে চোখ তুলে সে এমনভাবে প্রশ্নটা করল যেন ওই ভাবনা তাকে এই মাত্র আঘাত করেছে। বলাই বাহুল্য আসলে তা করেনি।

রান্নাঘরের টেবিলে মুখোমুখি বসেছিল দুজন। পাশের রেলসড়ক দিয়ে কম্পিউটার ট্রেনের যাতায়াতের শব্দ ছাড়া ওই এলাকাটা বেশ নীরব। ট্রেনবিহীন রেলসড়কটা তাদের জন্য এক রহস্যময় নৈঃশব্দ তৈরি করে। কিচেনের পাতলা প্লাস্টিকের মেঝে ছেলেটার পা দুটোকে শীতল পরশ দান করে। মোজা খুলে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে সে। এপ্রিল মাসের বিকেল হলেও আজকের আবহাওয়ায় একটু বেশি গরমের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। মেয়েটা তার বিবর্ণ চেক সার্টের হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে রেখেছে। তার পলকা ফরসা আঙুলগুলো খেলছে কফি চামচের হাতলের সাথে। ছেলেটা তার আঙুলগুলোর দিকে তাকায়, আর তার মনের ক্রিয়া অদ্ভুতরকমের নীরস হয়ে পড়ে।

ছেলেটা কেবল কুড়িতে পড়েছে, মেয়েটা তার চেয়ে সাত বছরের বড়, বিবাহিত ও এক সন্তানের জননী। ছেলেটির জন্য মেয়েটি হচ্ছে চাঁদের দূরের অংশ।

তার স্বামী এমন একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ যারা বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে পারদর্শী। ফলে তাকে মাসের অধিকটা সময় দেশের বাইরের কোনো শহর যেমন লন্ডন, রোম কিংবা সিঙ্গাপুরে থাকতে হয়। অপেরা ওই ভদ্রলোকের খুব প্রিয়। তার শেলভে তাই জায়গা করে আছে ভার্দি, পুসিনি, দোনিজেত্তি বা রিচার্ড স্ট্রাউসের রেকর্ড। যখন ফুরিয়ে যায় কিংবা করবার কিছু থাকে না ছেলেটা রেকর্ডের শেলভের এ পাশ থেকে ও পাশে চোখ বুলায় আর মনে-মনে অ্যালবামগুলোর নাম পড়ে — লা বোহ…মি, টোসকা, টুরানডট, নরমা, ফাইডেলিও… সে কখনো এসব মিউজিক শোনেনি বা শোনার সুযোগ তার হয়নি। তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতদের কেউই অপেরার ভক্ত নয়। শুধু জানে অপেরা-সঙ্গীতের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে আছে, কিছু লোক তা শোনে; তবে মেয়েটির স্বামীর এই রেকর্ডগুলো দেখে সে ওই জগৎ সম্পর্কে প্রথম জ্ঞান লাভ করেছে।

মেয়েটিও অবশ্য অপেরার ভক্ত নয়। “তবে ওগুলো আমি ঘেন্না টেন্না করি না। ওগুলোর একটাই দোষ, বড় দীর্ঘ।” বলে সে।

রেকর্ডেও শেলভের পাশেই চমৎকার একটা স্টিরিও সেট। এটার উপস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রমধর্মী। তবে বাজানোর সময় ওটা সে দেখেনি কখনো। মেয়েটিও জানে না ওটার পাওয়ার সুইচ কোথায় আর ছেলেটি ওটি স্পর্শ করার কথাও ভাবেনি কখনো।

মেয়েটি ওকে বলেছে “ঘরে কোনো সমস্যা নেই আমার। স্বামী আমার কাছে খুবই ভাল। মেয়েকে আমি স্নেহ করি খুব। আমি মনে করি আমি সুখী।” তাকে বেশ শান্তশিষ্টই মনে হয়। তার কথা থেকে আঁচ করা যায় না যে, সে তার জীবনের ব্যাপারে অজুহাত দাঁড় করাচ্ছে। নিষ্ঠার সঙ্গে সে তার বিয়ের কথা বলে, যেন সে ট্রাফিক আইন কিংবা আন্তর্জাতিক ডেটলাইন নিয়ে আলোচনা করছে। “আমার ধারণা আমি সুখী, কোনো ঝামেলা নেই।” এই হচ্ছে তার বক্তব্য।

সে তখন অবাক হয়ে ভাবে, তাই যদি হয় তাহলে তুমি কেন আমার সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছ ? এ নিয়ে অনেক ভেবেছে ছেলেটি; কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। কথাটা তাকে জিজ্ঞেস করার কথাও ভেবেছে সে। কীভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারেনি। বলেই বা কেমন করে ? “এতই যখন সুখে আছ তাহলে আমার সঙ্গে শুতে আস কেন” একথা কী করে জিজ্ঞেস করে। সে জানে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হলে নির্ঘাৎ কেঁদে ফেলবে ও।

হামেশাই বিস্তর কাঁদে সে, অনেকক্ষণ ধরে, খুব কম শব্দ করে। ছেলেটি বলতে গেলে জানেই না কেন সে কাঁদে। এক বার শুরু করলে থামতেই চায় না। সে অবশ্য তাকে সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করে; কিন্তু নির্দিষ্ট একটা সময় পার না-হওয়া পর্যন্ত কান্না থামায় না সে। কেন মানুষ একে অন্য থেকে এত আলাদা? অবাক হয়ে ছেলেটি ভাবে। অনেক মেয়ের সঙ্গে মিশেছে সে। সবাই কেঁদেছে অথবা রাগ করেছে, তবে সবারই একটা বিশেষ ভঙ্গিমা ছিল। মিলও ছিল বিস্তর, সেগুলো অমিলের তুলনায় অনেক কম। ওখানে অবশ্য বয়সের কোনো তারতম্য ছিল না। বয়স্ক কোনো নারীর সঙ্গে এই তার প্রথম; কিন্তু বয়সের পার্থক্য ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি সে। বয়সের পার্থক্যের চেয়ে বেশি অর্থবহ ছিল প্রতিটি রমণীর নানা ঝোঁক বা প্রবণতা। সে না ভেবে পারেনি। জীবনের রহস্য খোলার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ চাবি।

কান্না শেষ হলে সাধারণত তারা রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। কান্নার পরে মেয়েটিই সব সময় উদ্যোগটা প্রথমে নেয়, অন্য সময় ছেলেটি এগিয়ে আসে। কখনো মেয়েটি কোনো কথা না বলে শুধু মাথা ঝাকিয়ে প্রত্যাক্ষান করে। তখন তার চোখ দুটো সকালের আকাশে ভাসমান সাদা চাঁদের মতো দেখায়। সে যখন ওই চোখের দিকে তাকায় তার মনে হয়, তাকে আর কিছু বলা মোটেও সম্ভব নয়। রাগ কিংবা অসন্তোষ কোনোটাই আসে না। এভাবে হয়ে যায় সবকিছু, ভাবে সে। কখনো-কখনো খুব স্বস্তি অনুভব করে। ধীরে ধীরে গল্প করতে করতে কফি পান করে। অধিকাংশ সময়ই তাদের কথাবার্তা থাকে অসম্পূর্ণ। দুজনের একজনও বাকপটু নয়, তবে কিছু কিছু ব্যাপারে তাদের অভিন্ন বক্তব্য থাকে।

তাদের যৌন মিলন ঘটে খুবই স্তব্ধতার ভেতর। একে কোনো ভাবেই শরীরী আনন্দ বলে অভিহিত করা যায় না। তবে একথা বললে ভুল হবে যে, ওই মিলনে যে-সুখানুভূতি সে সম্পর্কে অবহিত নয় তারা। দেহ-মিলনের মধ্যমে ছেলেটি যে-আনন্দ লাভ করে আগে সে তা পায়নি কখনো। ওটা তাকে ছোট্ট একটা সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঘরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা একটা আরামদায়ক স্থান।… পরিস্থিতির এই অদ্ভুত অবস্থাটা তার জন্য একটু বেশিই। তার বিশ্বাস নিজের বিচার বিবেচনা দিয়েই জীবনের পথ চলছে সে। কিন্তু যখন সে এই ঘরে বসে আছে, ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ শুনছে আর নিজের বাহুতে আকড়ে ধরে আছে তারচেয়ে বেশি বয়সের এক মহিলাকে তখন সে বিভ্রান্তি অনুভব না করে পারে না। বার বার নিজেকে প্রশ্ন করে, আমি কি তার প্রেমে পড়েছি? কিন্তু পুরো দৃঢ়তা নিয়ে কোনো কোনো সদুত্তর খুঁজে পায় না।

শরীরের খেলা শেষ হলে মেয়েটি ঘড়ির দিকে তাকায়। ছেলেটির বাহুর ওপর শুয়ে মুখখানি একটু ওঠায় এবং ঘড়িঅলা রেডিওটার দিকে দৃষ্টি দেয়। তখন বাইরের রেলসড়ক দিয়ে একটা ট্রেন দ্রুত চলে যায়। কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্সের মতো: সে তাকায়, একটা ট্রেন চলে যায়।

মেয়েটি বার বার ঘড়ি দেখে নিশ্চিত হয় তার মেয়ের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়নি। একবারই মাত্র ছেলেটি তার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়েছিল। তার কাছে মনে হয়েছে মেয়েটি ফুটফুটে সুন্দর। সে ওর অপেরা-প্রেমী স্বামীকে কোনো দিন দেখেনি, ভাগ্যক্রমে যে একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করে।

মে মাসের এক বিকেলে সে প্রথম নিজের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারটি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করেছিল। সেদিনও কেঁদেছিল মেয়েটি তারপর সঙ্গমে রত হয়েছিল। কেন সে কেঁদেছিল মনে নেই ওর। তার মাঝে-মাঝে মনে হয় কারও বাহুবন্ধনে কাঁদতে পারবে বলেই সে ওর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছে। হতে পারে সে একা কাঁদতে পারে না, সেজন্য ওকে বেছে নিয়েছে।

সেদিন সে দরজায় তালা লাগাল, পর্দা নামাল, টেলিফোন সেটটি বিছানার পাশে এনে রাখল তারপর মিলিত হলো; আগের মতোই ধীরেসুস্থে, নীরবে। তখন ডোরবেল বাজল। উপেক্ষা করল সে। চমকালো না, অবাকও হলো না। শুধু মাথা নাড়াল একটুখানি, যেন বলতে চাইল, “ও কিছু না ঘাবড়াবার কিছু নেই।” বেল বাজল আরও কয়েক বার। যে-ই বাজাচ্ছিল না কেন, ক্ষান্ত দিয়ে চলে গেল। কোনো সেলস্্ম্যানট্যান হতে পারে। কিন্তু সে কী করে এত নিশ্চিন্ত থাকছে? একটু আগে একটা ট্রেন চলে গেল গুড় গুড় করে। দূর থেকে ভেসে এলো পিয়ানোর সুর। খুব অস্পষ্টভাবে সুরটা আঁচ করতে পারল ছেলেটি। অনেক দিন আগে সঙ্গীতের ক্লাসে সুরটি শুনেছিল সে, কিন্তু ঠিক ঠিক মনে করতে পারল না। সবজি বোঝাই একটা ট্রাক ঠন ঠন শব্দ তুলছিল। চোখ বন্ধ করে মেয়েটি গভীর শ্বাস টানল, প্রশান্তি নেমে এলো ছেলেটির মধ্যে।

সে বাথরুমে ঢুকল গোসল করতে। ফিরে এসে টাওয়েলে মাথা মুছতে-মুছতে লক্ষ করল বিছানায় মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে সে। তার পাশে বসে ওর পশ্চাৎ দেশ ডলাই মলাই করতে করতে অপেরা-রেকর্ডগুলোর নাম পড়তে লাগল।

মেয়েটি উঠে কাপড়-চোপর ঠিক করল, তারপর কফি বানাতে রান্নাঘরে ঢুকল। তার কিছুক্ষণ পরে সে জিজ্ঞেস করল, “নিজের সঙ্গে ও রকম কথা বলাটা কি তোমার পুরনো অভ্যাস?”

“ও-রকম? তার মানে তুমি কি বলতে চাইছো ওটা করার সময়…?”

“না না, সে সময় না, যে-কোনো সময়। এই ধরো যখন গোছল করছ কিংবা আমি যখন কিচেনে, তুমি একা বসে খবরের কাগজ পড়ছ, ওই রকম আর কী…”

মাথা নাড়িয়ে সে বলল, “জানি না, কখনো খেয়াল করিনি। নিজের সঙ্গে কথা বলি আমি?”

ছেলেটির লাইটারটা নিয়ে খেলতে-খেলতে সে বলল, “সত্যি তুমি নিজের সঙ্গে কথা বল।”

“তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না।” বলল সে। এ কথার অস্বস্তি তার কণ্ঠস্বরে ধরা পড়ল। তার হাত থেকে লাইটারটা নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল সে। অল্প কিছু দিন আগে সেভেন স্টার ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতে শুরু করেছে সে, ওর স্বামীর ব্র্যান্ড। আগে তার ব্র্যান্ড ছিল হোপ। তার কথায় সে ব্র্যান্ড বদলায়নি, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সে নিজেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। এতে সহজ হবে সব কিছু, টিভির ওই মেলোড্রামার মতো…।

“শোন, আমিও নিজের সঙ্গে কথা বলতাম,” বলল সে, “তবে যখন ছোট ছিলাম।”

“ও, তাই নাকি?”

“মা আমার ওই অভ্যাসটা গাঢ় হতে দেননি। প্রায়ই তিনি বলতেন, বাচ্চা মেয়েদের নিজের সঙ্গে কথা বলতে নেই।” যখনই আমি কাজটা করতাম ভীষণ ক্ষেপে যেতেন তিনি। একবার তো একটা বড় বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে রেখেছিলেন আমাকে। জায়গাটা ছিল অন্ধকার, দুর্গন্ধে ভরা, এমন বাজে জায়গার কথা ভাবাই যায় না। মাঝে মাঝে রুলার দিয়ে আমার হাঁটুর ওপর বারিও মারতেন। কাজ হয়েছিল তাতে। নিজের সঙ্গে কথা বলার রোগটি সারতে বেশি সময় লাগেনি।”

কোনো কিছু বলার কথা ভাবতে পারেনি সে, বলেও নি। মেয়েটি শুধু ঠোঁট কামড়িয়েছিল।

“এখনও যদি কোনো কিছু একটা বলতে চাই আপন মনে, বাক্যটা বেরুনোর আগেই গ্রাস করে ফেলি। কিন্তু নিজের সঙ্গে কথা বলা এত খারাপ কেন, বুঝি না আমি। মুখ থেকে বেরুনো স্বাভাবিক বচন বই তো নয়! মা জীবিত থাকলে জিজ্ঞেস করতাম তাকে।”

একটা কফির চামচ নাড়ানাড়া করছিল মেয়েটি। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকাল। ঠিক সেই সময় একটা ট্রেন চলে গেল। তারপর সে বলল, “কখনো-কখনো আমার মনে হয় মানুষের হৃদয় গভীর কূপের মতো, তলায় কী আছে কেউ জানে না। কখনো ক্ষণিকের জন্য তার একটুখানি ওপরে ভেসে উঠলে খানিকটা আঁচ-অনুমান করা যায় সে সম্পর্কে।”

দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য সেই কূপের কথা ভাবল।

“নিজের সঙ্গে যখন কথা বলি তখন কী বলি? একটা উদাহরণ দেবে?” ছেলেটি জিজ্ঞেস করল।

কয়েক মিনিট মাথাটা নাড়াল সে, যেন বিচক্ষণতার সাথে ঘাড়ের নড়াচড়া পরীক্ষা করছে। “বেশ শোন তাহলে, ওখানে উড়ো জাহাজের ব্যাপার আছে…”

“উড়োজাহাজ?”

“হ্যাঁ দেখোনি, আকাশে ওড়ে।”

হাসল সে। “এতো কিছু থাকতে উড়োজাহাজ নিয়ে কথা বলতে যাব কেন আমি?”

সে-ও হাসল। তর্জনী ব্যবহার করে আকাশে কল্পিত একটা বস্তু মাপল। এটা তার একটা অভ্যাস।

“তোমার উচ্চারণ কিন্তু খুব স্পষ্ট। তুমি কি নিশ্চিত যে, নিজের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারটা একেবারেই মনে পড়ে না তোমার?”

“একটুও না।”

একটা বলপেন তুলে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড খেলল সে, তারপর আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ি তার নিজের কাজ করে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট আগে যখন সে তার দিকে তাকিয়েছিল এখন তার চেয়ে পাঁচ মিনিট এগিয়ে গেছে।

“নিজের সঙ্গে কথা বলার সময় মনে হয় তুমি কবিতা আবৃত্তি করছ।”

একথা বলার সময় মেয়েটির মুখে লালের আভাস ছড়িয়ে পড়ল। তখন এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটির সন্ধান পেল সে: আমার নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার ব্যাপারটিতে সে কেন রক্তিম হচ্ছে?

ছন্দ দিয়ে বাক্যগুলো প্রকাশ করতে চাইলে: “নিজের সঙ্গে কথা বলি আমি/ প্রায় যেন/ করছিলাম আবৃত্তি /একটা কবিতা।”

বলপেনটা আবার তুলে নিল মেয়েটি। হলুদ রঙ্গের প্লাস্টিকে তৈরি। কোনো একটা ব্যাংকের দশম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বের করা হয়েছে।

কলমটার প্রতি নির্দেশ করে সে বলল, “এর পরে যখন আমি নিজের সঙ্গে কথা বলি, আমি কী বলি তা শুনে-শুনে তুমি লিখে রাখবে। লিখবে তো ?”

সে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকাল। “সত্যিই তুমি তা জানতে চাও?”

ছেলেটি সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল।

মেয়েটি এক টুকরো কাগজ তুলে নিয়ে তাতে কী যেন লিখতে লাগল। ধীরে ধীরে লিখলেও কোনো বিরতি নিল না। ছেলেটি চিবুকে হাত রেখে সারাক্ষণ তাকিয়ে রইল ওর চোখের পাতার লোমের দিকে। আর মেয়েটি কয়েক সেকেন্ড পর পর চোখ পিট পিট করতে লাগল। সে যত বেশি ওই চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে রইল (কিছুক্ষণ আগেও যা ছিল অশ্রুজলে ভেজা) সে ততবেশি বুঝতে পারল না ওর সাথে বিছানায় যাওয়ার সত্যিকার অর্থ কী। তখন সবকিছু হারানোর একটা অনুভূতি তাকে গ্রাস করে ফেলল। তার মনে হলো সে হয়ত কোনো দিন আর কোথাও যেতে পারবে না। এই ভাবনা তার মধ্যে এমন অতঙ্কের সৃষ্টি করল যে, তা সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল তার জন্য। তার অস্তিত্ব আর নিজস্বতা গলে পড়তে যাচ্ছে। হ্যাঁ একথা তো সত্যি: নতুন কাদামাটির মতোন সে তরতাজা আর সে নিজের সঙ্গে কথা বলে, যেন কবিতা আবৃত্তি করে চলেছে…।

লেখা শেষ করে মেয়েটি কাগজটি তার দিকে বাড়িয়ে দিল। ছেলেটি তুলে নিল কাগজখানা।

মেয়েটি বলল, “এর সবটা আমি হৃদয় দিয়ে জেনেছি — যা তুমি বলেছিলে।”

সে জোরে-জোরে পড়ল শব্দগুলো:

উড়োজাহাজ, উড়োজাহাজ, উড়ছি আমি উড়োজাহাজে। উড়োজাহাজ উড়ছে বটে, তবে স্থির, যদিও ওড়ে উড়োজাহাজটাই আকাশ?

সে অবাক। “এই সব আমি বলেছি?”

“হ্যাঁ, একেবারে পুরোটা।”

“অবিশ্বাস্য। নিজেকে আমি এইসব বলেছি আর এর এক বর্ণও মনে নেই আমার?”

ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে মেয়েটি বলল, “তুমি বলোনি তো কে বলেছে আবার। যেমনটা বললাম ওই রকমই ছিল তোমার কথা।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ছেলেটি। “রহস্যজনক একটা ব্যাপার। জীবনে কোনো দিনও উড়োজাহাজের কথা ভাবিনি। এর কোনো স্মৃতিও নেই আমার জীবনে। তাহলে হঠাৎ কেন উড়োজাহাজ চলে আসছে।”

“জানি না। তবে একেবারে ঠিক ঠিক ওই কথা বলছিলে তুমি, ওই যে স্নান করার আগে। তুমি হয়ত উড়োজাহাজের কথা ভাবছিলে না; কিন্তু গহিন কোনো বনের ভেতর অনেক দূরে তোমার মন ভাবছিল তাদের কথা।”

“কে জানে? হতে পারে গভীর কোনো জঙ্গলের ভেতর বসে আমি নিজেই একটা উড়োজাহাজ বানাচ্ছিলাম।”

বলপয়েন্টটা টেবিলে রেখে মেয়েটি তার চোখ তুলল আর ওর দিকে তাকাল।

কিছুক্ষণের জন্য তারা কোনো কথা বলল না। তাদের কাপের কফি মেঘের রঙ ধারণ করে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। পৃথিবী তার অক্ষের দিকে ফিরল; সেই সময় চাঁদের ভর ক্রমশ সময় বদলালো। সময় এগিয়ে চলল নীরবে, আর রেললাইন ধরে দ্রুত চলে গেল ট্রেন।

ছেলেটি আর মেয়েটি একই জিনিস নিয়ে ভাবছিল, জিনিসটি আর কিছুই নয়: উড়োজাহাজ, যা ছেলেটির হৃদয় গভীর অরণ্যে বসে তৈরি করছে। কত বড় ওটা, এর আকারই বা কী, কী তার রঙ, কোথায় চলেছে ওই উড়োজাহাজ, তাতে চড়বেই বা কারা?

একটু পরেই মেয়েটি আবার কাঁদতে লাগল। এই প্রথম বারের মতো সে একই দিনে দুবার কাঁদল। এটা একই সাথে শেষবার। এটা ছিল তার জন্য বিশেষ একটা জিনিস। টেবিল উজিয়ে ছেলেটি মেয়েটির কেশ স্পর্শ করল। আশ্চর্যজনক ভাবে ওগুলো তার কাছে একই সঙ্গে শক্ত ও পেলব মনে হলো। আর মনে হলো ওগুলো অনেক দূরে…।
source....http://arts.bdnews24.com/?p=2752#more-2752

Pages: [1] 2 3