106
Common Forum/Request/Suggestions / বাংলা বানান নিয়ে কথা
« on: September 08, 2015, 12:36:05 PM »
‘ ী’ কার উচ্ছেদ করা হলে সেই প্রবণতা ধরে ‘ক্ষ’, ‘ঙ’, ‘জ্ঞ’ বর্ণগুলোও উচ্ছেদের স্লোগান উঠবে। তাতে ভাষার মাথা ন্যাড়া করে শীর্ণ, দরিদ্র, হতশ্রী করা হবে বলেই আমার বিশ্বাস। এসব বর্ণ আপাতত অপ্রয়োজন মনে হলেও ভাষার সামগ্রিক গাঁথুনিতে অদৃশ-অপরিহার্য সৌন্দর্যময় উপাদান হিসেবে কাজ করছে। আঙুলের মাথায় পিন ফোটালে যে ব্যথা হয়, অকারণে ভাষার শরীর থেকে একটি বর্ণ ছেঁটে ফেললে ভাষাও ব্যথায় জর্জরিত হবে।
‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’
কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছেন
‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
………………………………………………………….
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস।’
পঞ্চাশ দশকের কবি ভাষা আন্দোলনের মহত্ত্বকে সামনে রেখে পাকিস্তানি দুঃশাসকদের বিরুদ্ধে কবিতাটি লিখেছিলেন। দুঃশাসকরা বাংলা ভাষাকে গলাটিপে মারতে চেয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্ত ঢেলে সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার পর বাংলা ভাষার বর্ণমালা নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
বাংলা ভাষা জন্মেরও আগে ব্রাহ্মলিপি থেকে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব ঘটেছে। বর্ণমালা ভাষার ভিত্তি। লাখ লাখ কথাকে, ইতিহাস-বিজ্ঞান-সাহিত্যকে বর্ণমালায় সাজিয়ে তুলতে হয়। বর্ণমালা একটি জাতির ভাষার সামগ্রিক দিব্যকান্তিপূর্ণ অবয়ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। দাঁত যতো ছোটই হোক, মুখ গহ্বরের ভেতর থেকে তার একটি উপড়ে ফেললে সৌন্দর্য ক্ষুণœ হয়। উচ্চারণ ভঙ্গির লাবণ্য বিনষ্ট হয়। মুখের সব ক’টি দাঁতই কিন্তু এক রকম কাজে লাগে না। খাদ্য চিবিয়ে খেতে মাড়ির দাঁত যতো কাজ লাগে, সামনের দাঁত ততো লাগে না। তাই বলে সামনের দাঁতগুলোকে অপ্রয়োজনীয়, অপাঙ্ক্তেয় মনে করবো!
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে।’
ভাষার বেলায়ও এ কথা খাটে। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার বর্ণমালা বদলাতে চেয়েছিল বাংলা ভাষার প্রাণ কেড়ে নেয়ার জন্য। কেননা প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রাণের অপ্রতিরোধ্যতাকে ভয় পায়।
নন্দিত কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর একটি গল্পের নাম ‘গ্রীষ্মের ছুটি’। ওই গল্পে সেলিনা নামের এক উঠন্ত বালিকার মাথায় গোছা গোছা সুন্দর চুল ছিল। দেখতে মেয়েটি সুন্দরী ছিল। এক মৌলবাদী মৌলভি তাকে অপকৌশলে নষ্ট করতে চেয়েছিল। তাতে মেয়েটি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। আবার ওই মৌলভিই ফতোয়া দেয়, সুন্দর চুলের জন্য মেয়েটিকে শয়তানে ধরেছে। চুল কেটে ফেলা হোক। সেলিনার অপূর্ব, নয়নশোভন, মেঘবরণ চুল কর্তন করা হলে তাকে ন্যাড়া, রোগা, কুৎসিত দেখায়।
পাকিস্তানি মৌলবাদীরা বাংলা ভাষাকে অমনই ন্যাড়া, রোগা, কুৎসিত করার জন্য বাংলা বর্ণমালা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। প্রথমে ফতোয়া দেয়া হলো ধর্মের। তারপর বলা হলো, বাংলা বর্ণমালার মধ্যে অনেক ঝামেলা, অনেক জটিলতা আছে; একে সহজ করতে হবে। এ বক্তব্যের অন্তরালে বদমতলব আছে, তা বুঝতে পেরেছিলেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ, শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ বিদ্যান। তারা এর বিরোধিতা করেন, যৌক্তিক-ভাষাতাত্ত্বিক বক্তব্য তুলে ধরেন।
বর্ণমালা ভাষার অঙ্গ। এই অঙ্গ ছেদ করতে হলে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, ড. সুনীতি কুমার ও ড. শহীদুল্লাহর মতামত সামনে রাখতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র তার একটি কালোত্তীর্ণ প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালা ভাষায়’ বলেছেন, ‘আমরা দেখিয়াছি, সরল প্রচলিত ভাষা অনেক বিষয়ে সংস্কৃত বহুল ভাষার অপেক্ষা শক্তিমতী। কিন্তু যদি সে সরল প্রচলিত ভাষায় সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয়, তবে কাজে কাজেই সংস্কৃত বহুল ভাষার আশ্রয় লইতে হইবে। প্রয়োজন হইলে নিঃসঙ্কোচে সে আশ্রয় লইবে।’
অর্থাৎ অকারণে ভাষাকে সরল করার দরকার নেই, অকারণে গম্ভীর করারও দরকার নেই। মনের ভাব সুন্দর, সুমার্জিত করে প্রকাশ করার জন্য সংস্কৃত শব্দ পরিহার করতে হবে, আবার গ্রহণও করতে হবে। অকারণে ‘ভ্রাত’ শব্দ উচ্ছেদ করলে ভাষার ধ্বনি গাম্ভীর্য নষ্ট হবে, তাতে ভাষা দরিদ্র হবে। বরেণ্য কথাশিল্পী শওকত ওসমান আপনজনকে সর্বদা ‘ভ্রাত’ বলে ডাকতেন। শব্দটি নিষিদ্ধ হলে বিপদে পড়তেন না তিনি?
এ প্রবন্ধটি লিখতে বসেছি একজন বিদূষী লেখিকার বাংলা বানান সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ পড়ে। তাতে তিনি প্রস্তাব করেছেন, বাংলা বর্ণমালা থেকে ‘ঈ’ এবং ‘ ী’ কার উঠিয়ে দেয়ার। আমি এ প্রস্তাবে একমত হতে পারিনি। আমি মনোপলির পক্ষে নই, আমি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সরলতার পক্ষে নই। ভাষার সামগ্রিক কাঠামো থেকে বর্ণমালা বিচ্ছিন্ন নয়, তা আগেও বলেছি। সস্তার বস্তাও ভালো নয়Ñ প্রবাদে আছে। সাহিত্যকে প্রমথ চৌধুরী খেলার সঙ্গে তুলনা করতে যেতে এও বলেছেন, সাহিত্য ছেলের হাতের মোয়া নয়, গুরুর হাতের বেতও নয়। ভাষা ও বর্ণমালার ব্যাপারেও কথাটা মনে রাখা দরকার। একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বরবর্ণকে বাস্তুভিটা থেকে বিতাড়িত করার আগে ভাষাকে ন্যাড়া, হীনশ্রী এবং ছেলের হাতের মোয়া করা হচ্ছে কি না, তা ভাবতে হবে।
একটা ‘ঈ’ বর্ণ এবং ‘ ী’ কারের জন্য বাংলা ভাষা ক্লান্তিকর জটিল হয়ে পড়েছে, আমি তা মানি না। তবে আজকাল বাংলা বানানে ‘ ী’ কারের ওপর যথেষ্ট আঘাত এসেছে, ‘ি ’ কারের ব্যবহার বেড়েছে। এটা দোষের নয়। এটাকে বলে সংস্কার। ভাষার সংস্কার হতেই পারে; কিন্তু তার বিজ্ঞানমনস্ক প্রয়োজন-অপ্রয়োজন এবং সীমারেখা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
ড. মাহবুবুল হক ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে একটি অসাধারণ বই লিখেছেন। বইটি বাঙালি জাতির কাছে সমাদৃত হয়েছে। বইটি আমি ডিগ্রি ক্লাসে পড়িয়েছি। সেখানে ড. হক প্রতিটি বর্ণের এবং প্রতিটি ‘কারের’ (া, ,ি ী, ু, ূ) ব্যবহারের সঠিকতা-বেঠিকতা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বাংলা ভাষার বিদ্বানরা ড. হকের শ্রমনিষ্ঠ, শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রস্তাবনা ও বানান বিন্যাসকে মেনে নিয়েছেন। ড. হক অধুনাকালের ‘ ী’ কার ধস মেনে নিয়ে ‘ি ’ কার প্রাধান্য নিয়েছেন। যেসব শব্দে ‘ ী’ কার ও ‘ি ’ কার দুটিই শুদ্ধ, সেখানে ‘ি ’ কারকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি সুদীর্ঘ গবেষণামূলক পর্যবেক্ষণ শেষে একটা পরিসংখ্যান দিয়েছেন, কোন কোন শব্দে ‘ি ’ কার হবে এবং কোন কোন শব্দে ‘ ী’ হবে। ড. হক ‘ ী’ কার ব্যবহারের ওপর ষোলোআনা অনাস্থা দেননি।
ড. মাহবুবুল হক ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ গ্রন্থে ‘ ী’ কার লোপের যে সীমা নির্দেশ করেছেন, ‘ি ’ কার ব্যবহারের সীমা বাড়িয়ে দিয়েও সেসব বাংলা শব্দে ‘ি ’ কারের পরিবর্তে ‘ ী’ কার বহাল রেখেছেন, তাতে বিবেচনাবোধের পরিচয় রয়েছে। আমরা কোনো কোনো শব্দের অর্থের ভিন্নতা বোঝাতেও ‘ ী’ কার ব্যবহার করে থাকি। এ ক্ষেত্রে ‘ ী’ কার লোপ করলে ভাষায় ক্লান্তিকরতা বাড়বে, ভাষার চেহারা ন্যাড়া মাথার মতো হবে, অর্থের সূক্ষ্ম বিভ্রাট ঘটবে।
এবার ড. হকের বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
“কৃতি অর্থ রচনা,
কৃতী অর্থ গুণবান,
দিন অর্থ দিবস,
দীন অর্থ ধর্ম, দরিদ্র,
নিচ অর্থ নিম্ন,
নীচ অর্থ হীন,
কালি অর্থ মসি,
কালী অর্থ দুর্গা।”
বিভিন্ন সূত্র দেখিয়ে ড. হক ‘ ী’ ব্যবহারের পক্ষে রীতিমতো বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, তৎসম শব্দে ‘ ী’ কার হয়, যেমন ‘পক্ষী’; কিন্তু দেশি শব্দে হবে ‘পাখি’। তৎসম শব্দ ‘কুম্ভীর’ কিন্তু দেশি বা তদ্ভব শব্দে হবে ‘কুমির’। এ ক্ষেত্রে গায়ের জোরে তৎসম শব্দ উচ্ছেদ করা যাবে না। আবার তৎসম শব্দে গলায় ‘ি ’ কার পরানো হলে ভাষারীতির শৃঙ্খলা দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া হবে।
‘ ী’ কার উচ্ছেদ করা হলে সেই প্রবণতা ধরে ‘ক্ষ’, ‘ঙ’, ‘জ্ঞ’ বর্ণগুলোও উচ্ছেদের স্লোগান উঠবে। তাতে ভাষার মাথা ন্যাড়া করে শীর্ণ, দরিদ্র, হতশ্রী করা হবে বলেই আমার বিশ্বাস। এসব বর্ণ আপাতত অপ্রয়োজন মনে হলেও ভাষার সামগ্রিক গাঁথুনিতে অদৃশ-অপরিহার্য সৌন্দর্যময় উপাদান হিসেবে কাজ করছে। আঙুলের মাথায় পিন ফোটালে যে ব্যথা হয়, অকারণে ভাষার শরীর থেকে একটি বর্ণ ছেঁটে ফেললে ভাষাও ব্যথায় জর্জরিত হবে।
মাহমুদুল বাসার : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক।
‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’
কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছেন
‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
………………………………………………………….
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস।’
পঞ্চাশ দশকের কবি ভাষা আন্দোলনের মহত্ত্বকে সামনে রেখে পাকিস্তানি দুঃশাসকদের বিরুদ্ধে কবিতাটি লিখেছিলেন। দুঃশাসকরা বাংলা ভাষাকে গলাটিপে মারতে চেয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্ত ঢেলে সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার পর বাংলা ভাষার বর্ণমালা নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
বাংলা ভাষা জন্মেরও আগে ব্রাহ্মলিপি থেকে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব ঘটেছে। বর্ণমালা ভাষার ভিত্তি। লাখ লাখ কথাকে, ইতিহাস-বিজ্ঞান-সাহিত্যকে বর্ণমালায় সাজিয়ে তুলতে হয়। বর্ণমালা একটি জাতির ভাষার সামগ্রিক দিব্যকান্তিপূর্ণ অবয়ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। দাঁত যতো ছোটই হোক, মুখ গহ্বরের ভেতর থেকে তার একটি উপড়ে ফেললে সৌন্দর্য ক্ষুণœ হয়। উচ্চারণ ভঙ্গির লাবণ্য বিনষ্ট হয়। মুখের সব ক’টি দাঁতই কিন্তু এক রকম কাজে লাগে না। খাদ্য চিবিয়ে খেতে মাড়ির দাঁত যতো কাজ লাগে, সামনের দাঁত ততো লাগে না। তাই বলে সামনের দাঁতগুলোকে অপ্রয়োজনীয়, অপাঙ্ক্তেয় মনে করবো!
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে।’
ভাষার বেলায়ও এ কথা খাটে। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার বর্ণমালা বদলাতে চেয়েছিল বাংলা ভাষার প্রাণ কেড়ে নেয়ার জন্য। কেননা প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রাণের অপ্রতিরোধ্যতাকে ভয় পায়।
নন্দিত কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর একটি গল্পের নাম ‘গ্রীষ্মের ছুটি’। ওই গল্পে সেলিনা নামের এক উঠন্ত বালিকার মাথায় গোছা গোছা সুন্দর চুল ছিল। দেখতে মেয়েটি সুন্দরী ছিল। এক মৌলবাদী মৌলভি তাকে অপকৌশলে নষ্ট করতে চেয়েছিল। তাতে মেয়েটি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। আবার ওই মৌলভিই ফতোয়া দেয়, সুন্দর চুলের জন্য মেয়েটিকে শয়তানে ধরেছে। চুল কেটে ফেলা হোক। সেলিনার অপূর্ব, নয়নশোভন, মেঘবরণ চুল কর্তন করা হলে তাকে ন্যাড়া, রোগা, কুৎসিত দেখায়।
পাকিস্তানি মৌলবাদীরা বাংলা ভাষাকে অমনই ন্যাড়া, রোগা, কুৎসিত করার জন্য বাংলা বর্ণমালা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। প্রথমে ফতোয়া দেয়া হলো ধর্মের। তারপর বলা হলো, বাংলা বর্ণমালার মধ্যে অনেক ঝামেলা, অনেক জটিলতা আছে; একে সহজ করতে হবে। এ বক্তব্যের অন্তরালে বদমতলব আছে, তা বুঝতে পেরেছিলেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ, শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ বিদ্যান। তারা এর বিরোধিতা করেন, যৌক্তিক-ভাষাতাত্ত্বিক বক্তব্য তুলে ধরেন।
বর্ণমালা ভাষার অঙ্গ। এই অঙ্গ ছেদ করতে হলে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, ড. সুনীতি কুমার ও ড. শহীদুল্লাহর মতামত সামনে রাখতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র তার একটি কালোত্তীর্ণ প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালা ভাষায়’ বলেছেন, ‘আমরা দেখিয়াছি, সরল প্রচলিত ভাষা অনেক বিষয়ে সংস্কৃত বহুল ভাষার অপেক্ষা শক্তিমতী। কিন্তু যদি সে সরল প্রচলিত ভাষায় সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয়, তবে কাজে কাজেই সংস্কৃত বহুল ভাষার আশ্রয় লইতে হইবে। প্রয়োজন হইলে নিঃসঙ্কোচে সে আশ্রয় লইবে।’
অর্থাৎ অকারণে ভাষাকে সরল করার দরকার নেই, অকারণে গম্ভীর করারও দরকার নেই। মনের ভাব সুন্দর, সুমার্জিত করে প্রকাশ করার জন্য সংস্কৃত শব্দ পরিহার করতে হবে, আবার গ্রহণও করতে হবে। অকারণে ‘ভ্রাত’ শব্দ উচ্ছেদ করলে ভাষার ধ্বনি গাম্ভীর্য নষ্ট হবে, তাতে ভাষা দরিদ্র হবে। বরেণ্য কথাশিল্পী শওকত ওসমান আপনজনকে সর্বদা ‘ভ্রাত’ বলে ডাকতেন। শব্দটি নিষিদ্ধ হলে বিপদে পড়তেন না তিনি?
এ প্রবন্ধটি লিখতে বসেছি একজন বিদূষী লেখিকার বাংলা বানান সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ পড়ে। তাতে তিনি প্রস্তাব করেছেন, বাংলা বর্ণমালা থেকে ‘ঈ’ এবং ‘ ী’ কার উঠিয়ে দেয়ার। আমি এ প্রস্তাবে একমত হতে পারিনি। আমি মনোপলির পক্ষে নই, আমি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সরলতার পক্ষে নই। ভাষার সামগ্রিক কাঠামো থেকে বর্ণমালা বিচ্ছিন্ন নয়, তা আগেও বলেছি। সস্তার বস্তাও ভালো নয়Ñ প্রবাদে আছে। সাহিত্যকে প্রমথ চৌধুরী খেলার সঙ্গে তুলনা করতে যেতে এও বলেছেন, সাহিত্য ছেলের হাতের মোয়া নয়, গুরুর হাতের বেতও নয়। ভাষা ও বর্ণমালার ব্যাপারেও কথাটা মনে রাখা দরকার। একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বরবর্ণকে বাস্তুভিটা থেকে বিতাড়িত করার আগে ভাষাকে ন্যাড়া, হীনশ্রী এবং ছেলের হাতের মোয়া করা হচ্ছে কি না, তা ভাবতে হবে।
একটা ‘ঈ’ বর্ণ এবং ‘ ী’ কারের জন্য বাংলা ভাষা ক্লান্তিকর জটিল হয়ে পড়েছে, আমি তা মানি না। তবে আজকাল বাংলা বানানে ‘ ী’ কারের ওপর যথেষ্ট আঘাত এসেছে, ‘ি ’ কারের ব্যবহার বেড়েছে। এটা দোষের নয়। এটাকে বলে সংস্কার। ভাষার সংস্কার হতেই পারে; কিন্তু তার বিজ্ঞানমনস্ক প্রয়োজন-অপ্রয়োজন এবং সীমারেখা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
ড. মাহবুবুল হক ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে একটি অসাধারণ বই লিখেছেন। বইটি বাঙালি জাতির কাছে সমাদৃত হয়েছে। বইটি আমি ডিগ্রি ক্লাসে পড়িয়েছি। সেখানে ড. হক প্রতিটি বর্ণের এবং প্রতিটি ‘কারের’ (া, ,ি ী, ু, ূ) ব্যবহারের সঠিকতা-বেঠিকতা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বাংলা ভাষার বিদ্বানরা ড. হকের শ্রমনিষ্ঠ, শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রস্তাবনা ও বানান বিন্যাসকে মেনে নিয়েছেন। ড. হক অধুনাকালের ‘ ী’ কার ধস মেনে নিয়ে ‘ি ’ কার প্রাধান্য নিয়েছেন। যেসব শব্দে ‘ ী’ কার ও ‘ি ’ কার দুটিই শুদ্ধ, সেখানে ‘ি ’ কারকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি সুদীর্ঘ গবেষণামূলক পর্যবেক্ষণ শেষে একটা পরিসংখ্যান দিয়েছেন, কোন কোন শব্দে ‘ি ’ কার হবে এবং কোন কোন শব্দে ‘ ী’ হবে। ড. হক ‘ ী’ কার ব্যবহারের ওপর ষোলোআনা অনাস্থা দেননি।
ড. মাহবুবুল হক ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ গ্রন্থে ‘ ী’ কার লোপের যে সীমা নির্দেশ করেছেন, ‘ি ’ কার ব্যবহারের সীমা বাড়িয়ে দিয়েও সেসব বাংলা শব্দে ‘ি ’ কারের পরিবর্তে ‘ ী’ কার বহাল রেখেছেন, তাতে বিবেচনাবোধের পরিচয় রয়েছে। আমরা কোনো কোনো শব্দের অর্থের ভিন্নতা বোঝাতেও ‘ ী’ কার ব্যবহার করে থাকি। এ ক্ষেত্রে ‘ ী’ কার লোপ করলে ভাষায় ক্লান্তিকরতা বাড়বে, ভাষার চেহারা ন্যাড়া মাথার মতো হবে, অর্থের সূক্ষ্ম বিভ্রাট ঘটবে।
এবার ড. হকের বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
“কৃতি অর্থ রচনা,
কৃতী অর্থ গুণবান,
দিন অর্থ দিবস,
দীন অর্থ ধর্ম, দরিদ্র,
নিচ অর্থ নিম্ন,
নীচ অর্থ হীন,
কালি অর্থ মসি,
কালী অর্থ দুর্গা।”
বিভিন্ন সূত্র দেখিয়ে ড. হক ‘ ী’ ব্যবহারের পক্ষে রীতিমতো বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, তৎসম শব্দে ‘ ী’ কার হয়, যেমন ‘পক্ষী’; কিন্তু দেশি শব্দে হবে ‘পাখি’। তৎসম শব্দ ‘কুম্ভীর’ কিন্তু দেশি বা তদ্ভব শব্দে হবে ‘কুমির’। এ ক্ষেত্রে গায়ের জোরে তৎসম শব্দ উচ্ছেদ করা যাবে না। আবার তৎসম শব্দে গলায় ‘ি ’ কার পরানো হলে ভাষারীতির শৃঙ্খলা দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া হবে।
‘ ী’ কার উচ্ছেদ করা হলে সেই প্রবণতা ধরে ‘ক্ষ’, ‘ঙ’, ‘জ্ঞ’ বর্ণগুলোও উচ্ছেদের স্লোগান উঠবে। তাতে ভাষার মাথা ন্যাড়া করে শীর্ণ, দরিদ্র, হতশ্রী করা হবে বলেই আমার বিশ্বাস। এসব বর্ণ আপাতত অপ্রয়োজন মনে হলেও ভাষার সামগ্রিক গাঁথুনিতে অদৃশ-অপরিহার্য সৌন্দর্যময় উপাদান হিসেবে কাজ করছে। আঙুলের মাথায় পিন ফোটালে যে ব্যথা হয়, অকারণে ভাষার শরীর থেকে একটি বর্ণ ছেঁটে ফেললে ভাষাও ব্যথায় জর্জরিত হবে।
মাহমুদুল বাসার : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক।