Daffodil International University

Entertainment & Discussions => Story, Article & Poetry => Topic started by: kekbabu on February 18, 2019, 01:26:07 PM

Title: ড. জোহার আত্মত্যাগ এবং জাতির দায়বদ্ধতা (যুগান্তর, তারিখ: ১৮/০২/২০১৯; পৃষ্ঠা ৫)
Post by: kekbabu on February 18, 2019, 01:26:07 PM
ড. জোহার আত্মত্যাগ এবং জাতির দায়বদ্ধতা

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আজ ড. জোহা দিবস। এ দিনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষক সমাজের কাছে এক স্মরণীয় দিন। ১৯৬৯ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও প্রক্টর সর্বজনশ্রদ্ধেয় ড. শামসুজ্জোহা পাকবাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে সেদিন তিনি তার ছাত্রদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। ড. জোহা সেদিন শহীদ হয়ে ইতিহাসের পাতায় ছাত্রপ্রীতির এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থিত চত্বরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ড. শামসুজ্জোহা। ড. জোহার আত্মদানের মধ্য দিয়েই তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠেছিল। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল বাঙালি, যা বেগবান করেছিল দেশমাতৃকার মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিকে।


ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় ১৯৩৪ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন ড. শামসুজ্জোহা। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় পরিবারসহ চলে আসেন বাংলাদেশে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে অনার্স এবং ১৯৫৪ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। কর্মজীবনের শুরুত ড. জোহা পাকিস্তানের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে আইয়ুব খানের লোকেরা হত্যা করলে এর প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। একই সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় জেলা প্রশাসন রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করে। ওইদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মুক্তিকামী জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের উদ্দেশ্যে শোভাযাত্রা বের করেন। শোভাযাত্রাটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে পৌঁছলে আইয়ুব খানের পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকসহ মুক্তিকামী জনতার সংঘর্ষ বাধে। এতে অনেকেই আহত হন, অনেকে হন কারাবন্দি। এ খবর শোনামাত্র ড. শামসুজ্জোহা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং আহত মুক্তিকামী জনতাকে নিয়ে হাসপাতালে যান।

এ ঘটনার পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি নেন। অপরদিকে সশস্ত্র বাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইনগেটে প্রস্তুত রাখাসহ গেট তালাবদ্ধ করে রাখা হয়- যেন ছাত্র-জনতা বের হতে না পারেন। এরপর আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সব প্রতিরোধ ও বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে মেইনগেটের সীমানা প্রাচীর টপকে বের হওয়া শুরু করলে শিক্ষকরা মেইনগেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীকে গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। এহেন সংকটময় মুহূর্তে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে সামরিক জান্তার দোসররা রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করার প্রস্তুতি নিতে থাকলে ছাত্ররা পাকবাহিনীর পার্ক করা একটি গাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ড. জোহা পাকসেনা অফিসার ক্যাপ্টেন হাদির সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যান এবং তাকে অনুরোধ করেন যেন সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কোনো ধরনের উসকানিমূলক পদক্ষেপ নেয়া না হয়। আস্তে আস্তে মেইনগেট সংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ছাত্র-জনতার ঢল নামতে শুরু করলে সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের ওপর গুলি করতে প্রস্তুত হয়। এ অবস্থায় ড. জোহা হাত উঁচু করে পাকসেনাদের উদ্দেশে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলতে থাকেন, ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার; আমার ছাত্ররা এখান থেকে এখনই চলে যাবে...।’ কিন্তু পাক হায়েনারা সেদিন ড. জোহার সেই অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। অল্প কিছুক্ষণ পরই খুব কাছ থেকে মার্ক ফোর রাইফেলের ছোড়া গুলি জোহার পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাকে ভ্যানে করে দ্রুত শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন পথে পথে ব্যারিকেড থাকার কারণে তাকে হাসপাতালে নিতে বেলা গড়িয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পর অপারেশন টেবিলেই মৃত্যু হয় সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার।

তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিক্ষুব্ধ জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ প্রতিরোধ প্রকট আকার ধারণ করলে পাকসেনারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। শহীদ আসাদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুতে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা পূর্ব বাংলা। দেশবাসী পাকবাহিনী ও আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে গড়ে তোলে কঠোর আন্দোলন। ফলস্বরূপ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও হয়ে ওঠেন সোচ্চার। সারা দেশে পশ্চিমাদের শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দাবানল জ্বলে ওঠে। স্বাধীনচেতা, গণতন্ত্রকামী মানুষ এক হয়ে তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হন পূর্ব বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ।

ড. শামসুজ্জোহার শাহাদতবরণের ঘটনার মধ্য দিয়ে ছাত্রপ্রীতি ও কর্তব্যপরায়ণতার যে মহান দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় স্থাপিত হয়েছে, তা এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। ড. শামসুজ্জোহা ইচ্ছে করলে সেদিন মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে থেকে পারতেন নিজের জীবন বাঁচাতে। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ তার কাছে নিজের জীবনের চেয়ে তার ছাত্রছাত্রীদের জীবন বড় ছিল।

প্রশ্ন হচ্ছে, ড. জোহার এ মহান অবদানের কতটুকু স্বীকৃতি দিয়েছি আমরা? প্রতি বছর এ দিনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করা হলেও এখন পর্যন্ত দিবসটিকে সরকারিভাবে পালন করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কিছু করার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করি আমরা। ড. জোহাকে বাঙালি জাতির মণিকোঠায় ঠাঁই দিতে পারলে লাভ হবে আমাদের জাতিরই। কারণ এতে অনুপ্রেরণা পাবেন বুদ্ধিজীবী সমাজসহ দেশের জনগণ। পাশাপাশি যে কোনো স্বৈরাচারী শক্তি, অপশক্তি ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা পাবেন দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, তরুণ সমাজ, বুদ্ধিজীবীসহ সবাই।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com