Daffodil International University

Faculty of Allied Health Sciences => Public Health => Topic started by: Mohammad Mahedi Hasan on December 02, 2018, 12:24:42 PM

Title: শিক্ষকতা, সহৃদয়তা ও আমরা
Post by: Mohammad Mahedi Hasan on December 02, 2018, 12:24:42 PM
যারা শিক্ষার্থী তাদের দুঃখ বোঝার জন্য অন্তত কয়েক হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু শিক্ষকদের কষ্ট বোঝে কে? আধা ঘণ্টা মাত্র ব্রেক নিয়ে একটানা ছয় ঘণ্টা ক্লাস করা যেমন সুখকর কিছু নয়, ক্লাস নেওয়াটাও কি এমন মধুর হাঁড়ি! জীবনের এক সময় আপনি থাকবেন ডেস্কের ওপাশে আর বেলা বাড়লে চলে আসবেন এপাশে—চিরন্তন নিয়ম। কিন্তু আমি যখন ওপাশে ছিলাম তখন এপাশের শিক্ষকের মনে মনে কী চলত সেটা এখন বুঝতে পেরে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। সামনে বসে কেউ হাই তুললে যে এত হতাশ লাগে সেটা তো আগে বুঝিনি! তার চেয়েও হতাশ হই যখন আমার নিজের ঘুম ঘুম লাগে অথচ ভাব করতে হয় যে নিউরোলজির মতো এমন মধুর বিষয় পৃথিবীতে আর দুটি আসেনি।

মানুষের মেমোরি গোল্ডফিশের মেমোরি থেকেও খারাপ। এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যাওয়া মাত্র চটজলদি সে ভুলে যায় সেও একসময় বিপরীতে বসা মানুষটির স্থানেই ছিল। এ কারণে শিক্ষকতা যেবেলা শুরু করেছিলাম সেবেলা ঝালিয়ে নিয়েছিলাম নিজের অতীত। ঠিক তেমন একজন হতে চেয়েছিলাম যেরকম শিক্ষক আমি চেয়েছিলাম আমার ছাত্রজীবনে। বজ্র আঁটুনি ফসকে গেরো নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমার কাজ কারবার পাস করা ডাক্তারদের নিয়ে। ফার্স্ট ইয়ারের তারুণ্যে ভরা ছেলেমেয়ে পড়ানো এক ব্যাপার, আর বিশ বছরের প্র্যাকটিস করা ডাক্তারকে পথ দেখানো আরেক। প্রথম যে হোঁচটটা খেলাম তা হচ্ছে, যেভাবে সে সবকিছু জানে, তাকে পড়ানোর মতো কঠিনতর কাজ পৃথিবীতে আর নাই।

আমি এএমসি (অস্ট্রেলিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল পরীক্ষা; যেটা অস্ট্রেলিয়াতে ডাক্তারি করতে হলে ভিন্ন দেশে এমবিবিএস করা সকল ডাক্তারদের পাস করতে হয়) পড়ানো শুরু করেছি ২০১৬ থেকে। হাসপাতালের চাকরি সামলে পড়াতে যেতে কষ্ট হয়। তাও ছাড়িনি কারণ পড়াতে আমার ভালো লাগে। সুতরাং বলা যায় প্রায় আড়াই বছর ধরে পড়াচ্ছি। ছাত্র সবাই আমার মতো বিদেশি ডাক্তার, অর্থাৎ যারা অস্ট্রেলিয়াতে এমবিবিএস পাস করেনি। যেহেতু ইউকে অথবা উন্নত আরও দেশ থেকে বলতে গেলে প্রায় সরাসরি অজিল্যান্ডে কাজ করার পারমিশন আছে (শুধু পার্ট ওয়ান পাস করলেই হয়) তাই পার্ট টুতে আমার বেশির ভাগ সময় কাজ করতে হয় অনুন্নত বা আধা উন্নত দেশের ডাক্তারদের নিয়ে। আরও খোলাসা করে বললে, আমার মতো গায়ের চামড়ার মানুষদের নিয়ে। বিভিন্ন দেশের মানুষদের সঙ্গে মিশে আমি খেয়াল করলাম, পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি বোঝা মানুষেরা হচ্ছেন আমাদের উপমহাদেশের মানুষ। কারণ তারা যখন ক্লাসে ঢোকেন এবং তাদের চেয়ে বয়সে ছোট একজনকে টিউটর হিসেবে দেখেন, তারা প্রথমেই ধরে নেন, ‘এ কি আমার থেকে বেশি জানে?’ বরং উত্তর আমেরিকা, ভেনেজুয়েলা, চৈনিক দেশ ইত্যাদি থেকে আসা ডাক্তারেরা অনেক সহনশীল। তারা তর্ক করেন কম, রেফারেন্স চান বেশি। আমার সহগোত্রের ভাই ব্রাদাররা নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তর্ক করেন, রেফারেন্সের ধার ধারেন না।

এক ভারতীয় ডাক্তার আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেন আমি রয়্যাল চিলড্রেনের গাইড লাইনে যা লেখা সব বিশ্বাস করব?’ এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রয়্যাল চিলড্রেন হাসপাতালের গাইডলাইনকে বাইবেল ধরে এখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ রকম উদ্ভুট্টি কথা জিজ্ঞেস করার মতো মানুষ আছে বলেই অস্ট্রেলিয়ায় হেলথ সিস্টেম সম্পর্কে এত দুর্নাম। এরা নিজেদের দোষ স্বীকার করেন না, বদনাম দেন যে, এএমসি পরীক্ষা কঠিন অথবা একচোখা। যা হোক, আমি হাসতে হাসতে সেই ডাক্তারকে বলেছিলাম, যে দেশের গাইডলাইনে তার আস্থা নেই সে দেশকে সর্বাগ্রে পরিহার করে তার নিজ দেশে ফিরে যাওয়া দরকার। এতে করে দুই দেশেরই জীবন বাঁচে। দ্বিতীয় ক্লাসে তিনি আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন, আমি যে টিপসটি তাকে দিচ্ছি কেন সেটি তিনি বিশ্বাস করবেন, নিজ প্র্যাকটিস তো উনি অন্যটি করেন। আবারও হাসতে হাসতেই বললাম, আমার কাজ হচ্ছে ছাত্রদের সেই পথ দেখানো যেটাতে তাদের এএমসি পাস হবে। ডাক্তারি শেখানোর দায়িত্ব তাদের মেডিকেল স্কুলের। আমি আমার কাজ করে যাব, আপনার ইচ্ছে হলে পাস করবেন নতুবা বছর বছর পরীক্ষা দেবেন। আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। বলাই বাহুল্য ভদ্রলোক এরপর থেকে আমার আর একটি ক্লাসেও কোনো উদ্ভট প্রশ্ন করেননি। কারণ আমাদের চামড়ার আরেকটি বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে আমরা শক্তের ভক্ত নরমের যম। ভদ্রতাকে দুর্বলতা ভাবা আমাদের জন্মগত অভ্যাস।

তো পড়াতে পড়াতে আরেকটি জিনিস আবিষ্কার করলাম। ঠিক আবিষ্কার করলাম বলা ঠিক হবে না। কারণ আমার ডাক্তার বাবা আমাকে এই কথা আগেও বলেছিলেন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। কথাটা হচ্ছে, বেশির ভাগ ডাক্তার ডাক্তারি ছাড়া কিছু জানে না এবং জানার আগ্রহও নাই। পড়াতে গেলে উদাহরণের প্রয়োজন হয়। উদাহরণের জন্য দরকার হয় মজার মজার ঘটনা, নতুবা ক্লাসটা ঠিক উপভোগ্য হয় না। তখনই আমি আবিষ্কার করলাম, উপমহাদেশের ডাক্তারেরা না পড়েন কোনো বই, না দেখেন তেমন কোনো সিনেমা। গানের কথা তো বাদই দিলাম। সান বার্নের স্টেজ পড়াতে পড়াতে ঠিকমতো বোঝানোর জন্য বললাম হ্যাং ওভার সিনেমার রোদে পুড়ে চিমসে হওয়া নায়কের অবস্থা। ক্লাসে উপস্থিত পঁচিশজনের মাঝে শুধু একজন খিকখিক করে হাসলেন, বাকিরা তব্দা খেয়ে বসে রইলেন। দু-একজনকে দেখলাম মোবাইলে সার্চ দিচ্ছেন। একজনকে ধরে বললাম, ‘শেষ মুভি কবে দেখেছ?’ তিনি আমতা-আমতা করে বললেন, ‘এএমসি পড়ার চাপে কিছু করার সময় পাই না’। শুনে আমি তব্দা খেয়ে গেলাম। ভয়ে আর জিজ্ঞেস করতে পারলাম না যে, বইটই কিছু পড়ার সুযোগ হয় কিনা।

একদিন ক্লাসে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ায় আড়মোড়া ভেঙে বই পড়ছিলাম। এক পাকিস্তানি ডাক্তার ক্লাসে ঢুকে আমাকে পড়তে দেখে খুব আগ্রহ নিয়ে শুধালো যে, কী বই পড়ি। বইয়ের নাম শুনে তিনি খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘দিস ইজ নট আ মেড বুক।’ আমি তার চেয়ে অবাক ভাব গলার স্বরে ফুটিয়ে বললাম, ‘খেয়ে কাজ নাই আমি বগলে করে মেডিসিনের বই নিয়ে ঘুরব কেন?’ তিনি মাথা চুলকে বললেন, ‘লাভ কি পড়ে?’ আমি হেসে দিয়েছিলাম। যে জন প্রশ্ন করেন বই পড়ে কি লাভ, তাকে কী উত্তর দেওয়া যেতে পারে? কারণ তিনি যে লাভের আশা করছেন, তা কিছুই এই বই থেকে আসবে না। স্টিফেন কিং–এর বইয়ে দুঃখ আছে, হতাশা আছে, ভালোবাসা আছে, অশরীরী প্রেতাত্মার রক্তজল করা হুংকার আছে—কিন্তু এতে লাভ নেই একবিন্দু।

সমস্ত দিন লাভযুক্ত বইপত্র পড়ে আর অসংখ্য মানুষের দুঃখকষ্টের কথা শুনে শুনে আমরা যে মানসিক অত্যাচারের ভেতর দিয়ে যাই তা আমরা কেউ স্বীকার করি না। একটি মানুষকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করা এবং তার পরিবারকে গিয়ে সেই খবরটি দেওয়া যে কী পরিমাণ মেন্টাল স্ট্রেস সৃষ্টি করে, সে সম্পর্কে আমরা কোনো কথাই বলি না। একটি ক্রিটিক্যাল রোগী আমাদের দায়িত্বে থাকলে ডিউটি শেষে ঘরে গিয়েও যে ছটফট করে মরি, তাতে কেউ আমাদের সান্ত্বনা দেয় না। যদি কোনো ডাক্তার ভুলেও স্বীকার করে বসেন, তবে বাকি সবাই তাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে আরও দগ্ধ করে মারি। তাকে বলা হয়, ‘এই প্রফেশন তোমার জন্য না।’ আসুন আপনাদের একটি তথ্য দিই, রেফারেন্সসহ। ২০১৮ সালের মে মাসের ওয়েব মেড এবং ডেইলি মেইলের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে আমেরিকায় প্রতিদিন অন্তত একজন করে ডাক্তার আত্মহত্যা করেন স্ট্রেস সামলাতে না পেরে। মেডিকেল পেশা বর্তমানে পেশার জন্য আত্মহত্যার কারণের মাঝে শীর্ষস্থানে আছে। ২০১৭ সালের মায়ো ক্লিনিকের একটি গবেষণা অনুযায়ী ডাক্তারেরা কখনো তাদের মেন্টাল স্ট্রেসের কথা স্বীকার করেন না, পাছে তাদের দুর্বল ভেবে বসে। কী ভয়াবহ কথা! সবার দুঃখের কথা শুনতে বসে আছি, কিন্তু আমার জন্য কেউ নেই।

আমরা অনেকে অনেক অধিকার নিয়ে কথা বলি; এর মাঝে মানবাধিকারটাই চাপা পড়ে যায়। ডাক্তারি একটি পেশা বই অন্য কিছু নয়। এই পেশাতে মানুষেরাই কাজ করে। সুতরাং অন্যদের যা যা সমস্যা হয় তার প্রত্যেকটিই আমাদের সঙ্গে হতে পারে। নিজেকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিন। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগাকেও বিবেচনায় আনুন। আজ মন ভালো না লাগলে দুই ঘণ্টার ছুটি নিন, একটা বইয়ের পাতা উলটাতে। আপনার সহকর্মীর চেহারাটা বিষণ্ন দেখালে তার হাত ধরে প্রশ্ন করুন, ‘ঠিক আছ তো?’ কেউ পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে তার পাশে গিয়ে ব্যর্থতাকে সফলতায় পালটে দেওয়ার গল্প করে তাকে অনুপ্রাণিত করুন, সে কি আপনার ভাই নয়? আপনার একটি ডিগ্রি বেশি বলে কম ডিগ্রির সহকর্মীকে চায়ের কাপটি আপনিই এগিয়ে দিন। তাকে বুঝতে সাহায্য করুন যে, ডিগ্রি কখনোই সম্মানের সমানুপাতিক নয়, প্রতিটি মানুষ তার নিজ গুণে সম্মানিত। জুনিয়রেরা বোকার মতো কোনো প্রশ্ন করলে খোঁচা না দিয়ে তাদের উত্তরটি কোথায় খুঁজে পেতে হবে বলে দিন। আপনার সিনিয়র ভাই কোনো ভুল কথা বললে বন্ধুদের আড্ডায় তাকে তুলোধুনো না করে ভাইকে আড়ালে ডেকে জানিয়ে দিন যে এখনকার গাইডলাইন কী বলছে।

আমি যখন প্রথম এখানে চাকরি শুরু করি, তখন আমার পক্ষে সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল সর্ব সম্মুখে স্বীকার করা যে আমি এই কাজটি পারি না। চাকরির প্রথমদিকেই কনসালট্যান্টকে এক রোগীকে বলতে শুনলাম, ‘আমার কোনো আইডিয়া নাই তোমার কী হয়েছে। অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো গতি নাই।’ বাইরে বের হয়ে কনসালট্যান্টকে ভয়ে ভয়ে বললাম আমার তো সব শুনে সিলিয়াক ডিসিজ মনে হচ্ছে, লেট প্রেজেন্টেশন। কনসালট্যান্ট খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘তাই তো। আসলে আমি সিলিয়াক সম্পর্কে তেমন কিছু জানিই না। তা তোমার যেহেতু মনে হচ্ছে, টেস্ট করে জিপির সঙ্গে দেখা করতে বলো।’ এ কথাটা তিনি বলেছিলেন কোনো দ্বিধা ছাড়া। তৎক্ষণাৎ বুঝলুম পৃথিবীর কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না সবকিছু জানা, ডাক্তারদের পক্ষে কীভাবে সব জানা সম্ভব? তাহলে কেন একজন ডাক্তার কোনো সাধারণ জিনিস না জানলে সবাই মিলে তাকে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন? সিলিয়াক ডিজিজ সম্পর্কে না জানাটা অপরাধ না। অপরাধ হচ্ছে অহংবোধে অন্য কারও কথা না শোনার মনমানসিকতা বা অন্য কারও সাহায্য নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করা।

তেরো ঘণ্টা ডিউটির এক ভয়াবহ রাতে আমার একবার মনে হয়েছিল আমি পালিয়ে যাব এবং আর কোনো দিনও হাসপাতালে ফিরে যাব না। এক নার্স কারণ ছাড়াই এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কী পরিশ্রমটাই না করেছ আজ রাতে! আমি কি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?’ নিশ্চিত জানি তিনি আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না, কিন্তু তারপরেও সেটা আমাকে পরের দিন রাতেই আবার আনন্দ নিয়েই কাজে ফেরত যেতে সাহায্য করেছিল। ইট ওয়াজ আ সিম্পল অ্যাক্ট অব কাইন্ডনেস। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমার মনে হয়েছিল অন্তত কেউ একজন বুঝতে পারছে আমার স্ট্রেসটা।

এটা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। শুধু আপনি রোগীর পাশাপাশি নিজেকে এবং আপনার সহকর্মীকেও মানুষ হিসেবে ভাববেন, ডাক্তার না। ব্যাস, শুধু এইটুকুই। পেশা দিয়ে নয়, মানবিকতা দিয়েই সবাই পরিচিত হোক, এটিই কাম্য।Source:সামারা তিন্নি, মেলবোর্ন (অস্ট্রেলিয়া) থেকে (Prothomalo.com)