Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - 710001113

Pages: [1] 2 3 ... 11
1
ডাইনোসরদের কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?

Uzzal Hossen
https://roar.media/bangla/main/plants-animals/is-it-possible-to-bring-dinosaur-back
ডাইনোসর নিয়ে নির্মিত সিনেমা অনেকেই দেখে থাকবে। সেসব দেখতে অনেকেরই ভালো লাগে। দেখতে দেখতে হয়তো ভাবনা আসে, এত প্রভাবশালী প্রাণীগুষ্ঠি, এদের প্রায় সকলেই এখন বিলুপ্ত। এককালে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে কিন্তু এদের কাউকে আমরা দেখতে পাই না। কেমন হতো যদি নিজ চোখে সেসব ডাইনোসর দেখা যেত!

ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে আজ থেকে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। তাহলে ডাইনোসরদের দেখা সম্ভব হবে না? কোনো উপায়ে কি ডাইনোসরদের আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যাবে না? বিজ্ঞান কী বলে?


বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো প্রাণীকে ফিরিয়ে আনার পদ্ধতি হচ্ছে ক্লোনিং। এছাড়াও রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমেও ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। ক্লোনিং করতে হলে অবশ্যই ডাইনোসরের ডিএনএ লাগবে। সম্পূর্ণ ডিএনএ পাওয়া গেলে বিজ্ঞানীরা সেই প্রাণীকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। কিন্তু ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ডাইনোসরেদের ডিএনএ কি আদৌ পাওয়া সম্ভব? হয়তো সম্ভব, নয়তো না। ডিএনএ পাওয়া গেলে আবারো হয়তো পৃথিবীর বুকে দেখা যাবে ডাইনোসরদের। না পাওয়া গেলে তো আর সম্ভব না।


জুরাসিক পার্ক সিনেমা অনেকেই দেখেছে। এ সিনেমায় দেখা যায়, অ্যাম্বার পাথরে কয়েক কোটি বছর আগে আটকে যাওয়া একটি মশা খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা। মশাটি কোনো এক ডাইনোসরের রক্ত খেয়েছিল। আর সেই মশা থেকে বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের ডিএনএ সংগ্রহ করেন। এরপর সেই ডিএনএ থেকে জন্ম দেন নতুন ডাইনোসরের। সিনেমার মতো করে বাস্তবে কি এরকম মশা, মাছি বা অন্যান্য প্রাণী থেকে ডাইনোসরের রক্ত/ডিএনএ পাওয়া সম্ভব?


গাছ থেকে নিঃসৃত অ্যাম্বারে আটকে থাকতে পারে মশার মমি; Image Source: Dietmar Down Under/Flickr
অ্যাম্বার হচ্ছে বিশেষ গাছ নিঃসৃত আঠালো পদার্থ। এই আঠালো পদার্থে কোনো ছোট পতঙ্গ বা প্রাণী আটকে গেলে সময়ের বিবর্তনে সেটি মমিতে পরিণত হয়। ফলে তার দেহে যদি রক্ত অবশিষ্ট থাকে তাহলে সেই রক্তে ডাইনোসরের ডিএনএ ভালো থাকলেও থাকতে পারে। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা যদি এই সময়ে এসে প্রাচীন যুগের সেই অ্যাম্বার খুঁজে পান আর তাতে যদি কোনো ডাইনোসরের ডিএনএবাহী প্রাণী বা পতঙ্গ পাওয়া যায় তাহলে ডাইনোসর অধ্যায়ের এক নতুন দিক উন্মোচিত হতেও পারে।

শুধু অ্যাম্বারই শেষ ভরসা নয়। ডাইসোরদের ফসিল বা কোনো হাড়ের খোঁজ পেলেও তাতে মিলতে পারে ডিএনএ। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রচীন প্রাণীর হাড় থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে ডাইনোসরদের বসবাস ছিলো আজ থেকে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। এত আগের প্রাণীর অক্ষত হাড় খুঁজে পাওয়া কষ্টকরই বটে।

তবে আশার কথা হলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিজ্ঞানীই দাবি করেছেন ডাইনোসরের হাড় পাওয়ার কথা। যদি হাড় পাওয়াও যায় তাতে কি ডিএনএ মিলবে? কোটি কোটি বছর আগের মৃত কোনো প্রাণীর হাড়ে ডিএনএ’র খোঁজ পাওয়া আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই।


সম্পূর্ণ ডিএনএ পাওয়া গেলে ডাইনোসর যুগের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হতে পারে; Image credit Creations Shutterstock.com
৬৬ মিলিয়ন আগেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ডাইনোসররা। তাহলে এত বছর পর তাদের হাড় বা ফসিল পাওয়া গেলেও তাতে ডিএনএ অক্ষত থাকবে তো? বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো প্রাণীর ডিএনএ সেই জীবের মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকেই ক্ষয় হতে শুরু করে। কারণ বিভিন্ন এনজাইম (যেমন: মাটির জীবাণু, দেহের কোষ, অন্ত্রের কোষ) ডিএনএ’র ক্ষয় করে। একই কাজ করে আল্ট্রাভায়োলেট বিকিরণ। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবেশবিজ্ঞান এবং বিবর্তন জীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বেথ শাপিরো বলেন, অক্সিজেন এবং পানি রাসায়নিকভাবে ডিএনএ’র প্রান্তগুলো ভেঙে দিয়ে এর পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অ্যানজাইমগুলো ডিএনএকে ছোট ছোট টুকরায় ভাঙতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না কিছু অবশিষ্ট থাকে।


 
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন যে ডিএনএ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তার বয়স ৭ লক্ষ বছর। কানাডার যুকন শহরের একটি হিমায়িত সোনার ক্ষেত্রে পাওয়া ঘোড়ার ফসিল থেকে এই ডিএনএ পাওয়া গিয়েছিল। তবে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন ৮ লক্ষ বছর আগের মানুষের দাঁত থেকে তারা জিনোম সিকোয়েন্স করতে পেরেছেন।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, সাধারণত কোনো ডিএনএ ১ মিলিয়ন থেকে ৫/৬ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তাহলে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ডাইনোসরদের ডিএনএ কি আর টিকে নেই? নিশ্চিত করে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কোনো বিজ্ঞানী। তারা এখনও সন্দিহান যে, ডিএনএ কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। কারণ গরম আবহাওয়ায় ডিএনএ খুব তারাতারি নষ্ট হয়। আবার ঠান্ডা আবহাওয়ায় বহু বছর টিকে থাকতে পারে। তাহলে ডাইনোসরদের ডিএনএ যদি উপযুক্ত পরিবেশ এবং আবহাওয়া পায় তাহলে বর্তমান সময় পর্যন্ত টিকে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজ্ঞানীরা যদি ডাইনোসরের হাড়ে থাকা ডিএনএ নিয়ে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত নেন তবুও এটা বলা সম্ভব হবে না যে সে প্রাণীটি স্বভাবের দিক থেকে ডাইনোসর ছিল কি না। ৭ লক্ষ বছর আগের ঘোড়ার হাড় থেকে ডিএনএ’র যে খন্ডাংশ পাওয়া গিয়েছিল তা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। তবে আধুনিক ঘোড়ার জিনোমের সাথে সে জিনোমের মিল পাওয়ায় বুঝা যায় যে সে ডিএনএটি ঘোড়ার উৎস থেকেই এসেছে।

অন্যদিকে দেখতে গেলে, ডাইনোসরদের জীবিত আত্মীয়রা হচ্ছে পাখি। ডাইনোসরদের অনেক গ্রুপ রয়েছে। দ্বিপদ, মাংশাসী টাইরানোসরাস রেক্স এবং ভেলোসিরাপ্টর ডাইনোসরদের থেকে বিবর্তিত হয়ে পাখিগুলো বিকশিত হয়েছে। ডাইনোসরদের অন্যান্য গ্রুপ যেমন- হ্যাড্রোসরাস (ডাক-বিল্ড ডাইনোসর), সিরাটোপসিয়ান (ট্রাইরাসেরাটোপস), স্টিগোসোর এবং অ্যাঙ্কিলোসোরদের কোনো জীবিত আত্মীয় নেই। তারপরও যদি ডাইনোসরের কোনো ডিএনএ এই সময়ে পাওয়া যায় তা হবে খুব ভগ্ন এবং বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।


Hypacrosaurus stebingeri ডাইনোসরের ফসিল; Image Source: auctionzip.com
সাম্প্রতিক সময়ে একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন তারা ডাইনোসরের ফসিল পেয়েছেন যেটি খুব ভালোভাবে সংরক্ষিত ছিল। ন্যাশনাল সায়েন্স রিভিউতে প্রকাশিত তাদের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, তারা মূলত ৭৫ মিলিয়ন বছর আগের তৃণভোজী Hypacrosaurus stebingeri ডাইনোসরের খুলির হাড় পেয়েছেন। তারা মনে করছেন এই ফসিলে হয়তো ডাইনোসরের ডিএনএ পাওয়া যাবে।

 
নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির মলিকুলার জীবাশ্ববিদ মেরি সোয়াইটজার জানান, তিনি সম্ভবত ডাইনোসরের হাড়ে ডিএনএ’র সন্ধান পেয়েছেন। তবে এখনো তিনি সেটার জিনোম সিকোয়েন্স করেননি। ফলে সেটি ডাইনোসরের কিনা বা তার বৈশিষ্ট্যই বা কেমন তা এখনো জানা যায়নি। ৬৬ মিলিয়ন বছর পরে এসে ডাইনোসরের ডিএনএ’র সন্ধান মিললে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ এখনো ডাইনোসরের ডিএনএ পাওয়া সম্ভব।

ডাইনোসর ক্লোনিং
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, গবেষকরা ডাইনোসরের ডিএনএ’র সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স পেয়ে গেছেন। এর মানে হলো গবেষকদের কাছে সম্পূর্ণ জিনোমটাই (প্রাণীর ডিএনএ’র সম্পূর্ণ সেট) আছে। আর এতে জাঙ্ক ডিএনএ এবং ভাইরাল ডিএনএ দুটোই থাকবে। ভাইরাল ডিএনএ যদি উদ্ভিদ এবং প্রাণীর দেহে আক্রমণ করে বসে তাহলে সেটি একটি বড় সমস্যা তৈরি করবে।


দৈত্যাকার ডাইনোসরের পুণঃনির্মিত কাল্পনিক রূপ; Image Source: scitechdaily.com
আধুনিক যুগে অনেক প্রাণীকেই ক্লোন করে জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ডাইনোসরের সঠিক ডিএনএ পাওয়া গেলে সেটিকে জন্ম দিতে সক্ষম হতেও পারেন বিজ্ঞানীরা। জিনোম পেয়ে গেলে তা থেকে ডাইনোসর ক্লোন করতে হলে বিজ্ঞানীদের দরকার পড়বে একটি হোস্ট জীবের। এক্ষেত্রে সঠিক হোস্ট হতে পারে পাখি। কারণ সকল পাখিই ডাইনোসরদের থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। এছাড়া ব্যাঙ, পায়রা এবং কুমিরের মতো সরীসৃপের কথাও ভেবে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এগুলো এখন কেবলই চিন্তা। কারণ এখনো ডিএনএ পাওয়া যায়নি। তার মানে এই মুহুর্তে দাড়িয়ে ক্লোনিংয়ের কথা ভাবাও যাচ্ছে না যেহেতু ডিএনএ নেই। ডিএনএ পাওয়া গেলেই ক্লোনিংয়ের পরবর্তী ধাপগুলোতে যেতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করেতেই হবে।

রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং
যদি কোনোভাবেই ডাইনোসরের ডিএনএ না পাওয়া যায় তাহলে কি ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনার পথ বন্ধ হয়ে যাবে? না, আরেকটি পথ অবশ্য আছে। সেটি রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রাণীর ক্ষেত্রে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবিত কোনো প্রাণীর ডিএনএ ধরে অতীতের দিকে যেতে হবে। ৬৬ মিলিয়ন বছর অতীত পর্যন্ত যেতে পারলে সেই প্রাণীকে ডাইনোসরে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে।

কিন্তু বাস্তবে তার কাজ কতটুকু এগিয়েছে? ২০১৫ সালে বিজ্ঞানী জ্যাক হর্নার এবং তার দল ঘোষণা দেন যে, তারা পাখির ঠোঁটকে ডাইনোসরের মুখের মতো রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। এটি হচ্ছে অনেকগুলো মডিফিকেশনের মধ্যে মাত্র একটা মডিফিকেশন। এভাবে নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা মুরগিকে ডাইনোসরে রূপ দিতে পারবেন। এটিকে বলা হচ্ছে ‘চিকেনোসরাস’। আর এ পদ্ধতিতে যে চিকেন জন্ম নেবে তাকে বলা হবে ডাইনো-চিকেন।



রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে চিকেন থেকে ডাইনোসর; Image Source: sciencevibe.com
মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটির জীবাশ্মবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জ্যক হর্নার জানান, তারা প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ করে ফেলেছেন। তবে এ পদ্ধতিতে যে চিকেন জন্ম হবে সেটি শুধুমাত্র ডাইনোসরের মতো দেখতে হবে। ডাইনোসরের মতো বৈশিষ্ট্য নাও থাকতে পারে তাতে।

জীবিত কোনো প্রাণীকে মডিফিকেশন করতে করতে ডাইনোসরের চেহারা প্রদান করা গেলেও তা দেখতে হয়তো কিছুটা ডাইনোসরের মতো হবে। কিন্তু তার আচরণ, বৈশিষ্ট্য, খাদ্যাভ্যাস কিংবা হিংস্রতা কোনোটাই ডাইনোসরের মতো নাও হতে পারে।

লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মেরুদণ্ডী প্রাণীর জীবাশ্মবিদ সুসি মেইডমেন্ট বলেন, অ্যাম্বারের মধ্যে আমরা ডাইনোসর যুগের মশা বা মাছি পেতেই পারি। কিন্তু যখন অ্যাম্বারের মধ্যে কোনো কিছু আটকে যায় তখন সেটি শুধু ওই পোকার খোসা সংরক্ষণ করতে পারে। তার নরম টিস্যু সংরক্ষণ করতে পারে না। ফলে অ্যাম্বারের মধ্যে কোনো মশা বা মাছি পাওয়া গেলেও তা থেকে রক্ত পাওয়া সম্ভব নয়। আর রক্ত না পেলে ডিএনএ ও পাওয়া যাবে না, ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনা যাবে না।


ডাইনোসর; Image Source: enriquelopezgarre/Pixabay
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ নর্দাম্পটনের প্রজননবিদ্যা বিশেষজ্ঞ জামাল নাসির ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনার ধারণা এবং সম্ভাবনাকে ইতিবাচকভাবেই দেখেন। তার মতে বিবর্তন কখনো স্থির নয় এবং এটি পরিকল্পনা মাফিকও ঘটে না। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। বিবর্তন অনির্ধারিত এবং এটি যে সবসময় সামনের দিকে এগুবে এমনটিও নয়। এর একাধিক দিক থাকতে পারে। বিবর্তনের পেছনের দিকে হেটে ডাইনোসর সদৃশ কোনো প্রাণীতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

তবে তিনি মনে করেন, ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনা গেলেও তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিয়ে ভাবতে হবে। এমন কোনো ভাইরাল মহামারি যদি আসে যেটি আমাদের জিনোম, শরীরবিদ্যা, আচরণকে ব্যাহত করবে এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে হয়তো ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনা এবং বাঁচিয়ে রাখার মতো পরিবেশ তৈরি হলে হতেও পারে।

 
তবে সুসি দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, বিশেষ অর্থে বিবর্তনের বিভিন্ন দিক নাও থাকতে পারে। আমাদের জানা মতে, একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো প্রাণী নতুন করে আর সামনে আসেনি। উদাহরণস্বরূপ: ইকথিয়াসোরাস ছিল সামুদ্রিক প্রাণী যার লম্বা বিন্দুযুক্ত নাক-মুখ এবং ডলফিনের মতো দেহ ও লেজ ছিল। আজকের দিনে ডলফিনও ইকথিয়াসোরাসের মতো একই পরিবেশে থাকে। তাই বলে ডলফিনকে আমরা ইকথিয়াসোরাস বলতে পারি না। কারণ ডলফিন এবং ইকথিয়াসোরাসের শারীরিক বৈশিষ্ট্য এক নয়।


পাখিদের আদি বংশধর ডইনোসর; Image Source: Davide Bonadonna
তিনি আরো বলেন, ডাইনোসররা এখনো আমাদের সাথেই আছে। ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে তবে সেটি উড়তে না পারা ডাইনোসর। পাখিরা হচ্ছে বিলুপ্ত না হওয়া ডাইনোসর। মাংশাসী ডাইনোসরদের থেকে বিবর্তিত হয়ে পাখিরা আজকের অবস্থানে এসেছে। তারা এখনো টিকে আছে। এমনকি নতুন প্রজাতির পাখিদেরও দেখতে পাচ্ছি। এই নতুন পাখিরা হচ্ছে নতুন প্রজাতির ডাইনোসর।

ডিএনএ থেকে ডাইনোসর জন্ম দেওয়া গেলেও ওই প্রাণীর বৃদ্ধির জন্য অনেক কিছুই করতে হবে। ধরে নিলাম যেকোনো ডিএনএ’র মাধ্যমে হোস্ট জীব থেকে ডাইনোসরের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সেই ডাইনোসরটি হতে পারে অর্ধেক পাখি, অর্ধেক ডাইনোসর। কিংবা পুরোটাই যদি ডাইনোসর হয় তাহলে তাকে বাঁচিয়ে রাখাও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

কারণ ৬৬ মিলিয়ন বছর আগের আবহাওয়া, পরিবেশ আর এখনকার আবহাওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তখন ডাইনোসররা যা খেতো এখন তা প্রদান করা বেশ চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। ফলে ক্লোন করে ডাইনোসর জন্ম দেওয়া গেলে তাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। যেমন: ২০০৯ সালে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে ‘Pyrenean ibex’ নামক বিলুপ্ত প্রজাতির একটি প্রাণীর জন্ম দেয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৭ মিনিটের মাথায় প্রাণীটি মৃত্যুবরণ করে।

৬৬ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরের জিন এবং প্রোটিন ভিন্ন পরিবেশে টিকে ছিল। তখন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, অক্সিজেনের মাত্রা ভিন্ন রকম ছিল। তাপমাত্রা ভিন্ন রকম ছিল। তার উপর প্রাণীটির হজমের এনজাইমগুলো আধুনিক প্রাণী বা উদ্ভিদের উপর কাজ করতে নাও পারে।



দৈত্যাকার প্রাণীগুলো এখন শুধুই অতীত; Image Source: David Mark/Pixabay

ডাইনোসরের প্রতিকৃতি দেখছেন দর্শনার্থীরা; Image Source: wyrk.com
সোয়াইটজার বলেন, আমাদের বিনোদনের জন্য যদি আমরা একটি ডাইনোসরকে ফিরিয়ে আনি তবে সেটি নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত হবে। জেনেটিক বৈচিত্র্যসহ একটি টেকসই ডাইনোসর কলোনি বানাতে হলে অন্তত পাঁচ হাজার ডাইনোসরকে ক্লোন করে জন্ম দিতে হবে। কিন্তু পাঁচ হাজার ডাইনোসর ক্লোন করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আবার পাঁচ হাজার ডাইনোসর জন্ম দেওয়া গেলেও তাদের কোথায় রাখা হবে, কেমন পরিবেশে রাখা হবে তাও কিন্তু ভাবতে হবে।

এতসব সমস্যার আগে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো ডাইনোসরের ডিএনএ পাওয়া যেটির সন্ধান এখনো মেলেনি।

2
সিংহ কেন বনের রাজা?

Tasin Nur Rahim

https://roar.media/bangla/main/plants-animals/why-lion-is-called-the-king-of-the-jungle
সিংহই কেন বনের রাজা এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নিয়ে কিছু বলা উচিত। ঠিক কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে কোনো প্রাণীকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানো হয়? প্রকৃতপক্ষে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি প্রসঙ্গভেদে এবং ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। তাই এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া যাবে। তো এখানে সম্ভাব্য সবগুলো উত্তর নিয়েই আমরা অগ্রসর হবো। উদঘাটন করব সিংহের বনের রাজা হবার পেছনের কারণ নিয়েও।

শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে অনেকে এগিয়ে রাখবেন বুদ্ধিমত্তাকে। উন্নত বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে যেকোনো প্রাণীকে শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়ে এগিয়ে রাখবে। কিন্তু সিংহ বনের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী নয়। শিম্পাঞ্জি, বানর, টিয়া, শেয়ালসহ জঙ্গলের অনেক প্রাণীই সিংহের চেয়ে বুদ্ধিমান। তাই বুদ্ধিমত্তাই যদি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হতো তাহলে নিশ্চিতভাবেই সিংহ রাজা হবার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ত। মস্তিষ্কের আকার বিবেচনা করলে জঙ্গলের প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মস্তিষ্ক হাতির, সিংহের নয়।


দৈহিক আকার অবশ্যই জঙ্গলের প্রাণীদের প্রভাব বিস্তারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জঙ্গলে তো সিংহের চেয়েও বিশালাকার প্রাণীর বাস রয়েছে। বিশালাকারের হাতিকে ছাড়িয়ে জঙ্গলের রাজা হওয়ার জন্য সিংহের দৈহিক আকারের বিশেষ কোনো অবদান নেই। তাছাড়া পুরুষ সিংহের ওজন যেখানে গড়ে ১৯০ কেজি, সেখানে একটি এশিয়ান হাতির ওজন গড়ে ৪,০০০ কেজি। আফ্রিকান হাতির গড় ওজন আরো বেশি। প্রায় ৬,০০০ কেজি। তাই দৈহিক আকার কিংবা ওজন কোনোটাই সিংহের শ্রেষ্ঠত্বের পক্ষে যুক্তি দিতে ব্যর্থ।


আফ্রিকান হাতি; Image: National Geographic
এবার আসা যাক শক্তিমত্তায়। সিংহ কি বনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী? গণ্ডার, হাতি, গরিলা কিংবা বাঘ- এসব প্রাণী অবশ্যই সিংহের চেয়ে শক্তিশালী। একটি সিংহ যেখানে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৬৫০ পাউন্ডের কামড় বসাতে পারে, সেখানে একটি বাঘ বসাতে পারে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১,০৫০ পাউন্ড। বাঘ তার নিজের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি ওজনের শিকার ধরতে পারে। অন্যদিকে সিংহ নিজের দৈহিক ওজনের দ্বিগুণ পরিমাণ পর্যন্ত শিকার ধরতে পারে।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহিষের প্রজাতি হলো গোর, যেটা ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায়। একেকটি গোরের ওজন প্রায় এক হাজার কেজির কাছাকাছি হয়ে থাকে। এসব মহিষ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বেশ পছন্দের শিকার। তাই শক্তিমত্তা বিবেচনায় সিংহের চেয়ে বাঘ বেশি শক্তিশালী। তাই বাঘ কিছুটা এগিয়েই থাকবে।

বাঘ আর সিংহের মধ্যে লড়াইয়ের আয়োজনও করা হয়েছিল। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ভারতের বারোদার রাজা বাঘ আর সিংহের ভেতর যুদ্ধ বাধিয়েছিলেন। এমনকি এই যুদ্ধে বাজিও ধরেছিলেন সিংহের পক্ষে ৩৭ হাজার রূপি। কিন্তু যুদ্ধে সিংহ হেরে যায়। ফলে বিশাল অংকের টাকা গচ্চা যায় রাজার।

বাঘ আর সিংহের কিছু তুলনামূলক তথ্য দেওয়া যাক। বাঘের পা সিংহ থেকে ছোট, তাই কম সেন্টার অফ গ্র্যাভিটির কারণে বাঘ নিচু হয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে এবং ভারসাম্য ভালোভাবে বজায় রাখতে পারে। এছাড়াও লাফিয়ে বাঘ অনেক উঁচুতে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু সিংহ বাঘের মতো দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আক্রমণে ততটা সক্ষম নয়। বাঘের মস্তিষ্কের আকারও সিংহের চেয়ে বড়। সিংহ থেকে প্রায় ১৬ শতাংশ বড়।

এবার মজার একটি তথ্য দিয়ে রাখি। সিংহকে বনের রাজা বলা হলেও সিংহ কিন্তু মোটেই বনে বাস করে না। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির সাভানা অঞ্চলে এদের বসবাস। সিংহ বলতে মূলত আফ্রিকান সিংহকেই বোঝানো হয়। তবে আফ্রিকার বাইরেও কিছু সিংহ দেখা যায়।



বাঘ তার শিকারের শরীরে কামড় বসাতে পারে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১,০৫০ পাউন্ড; Image: The Guardian
রাজা হওয়ার জন্য যে বিষয়টা সিংহকে সবচেয়ে এগিয়ে রেখেছে সেটা হলো তার চেহারা। আগে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী কথাটা এক্ষেত্রে একদম ফলে যায়। সিংহের কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত কেশর যেন বারবার তার রাজকীয়তার জানান দেয়। নিঃসন্দেহে কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত কেশরের কারণে জঙ্গলের যেকোনো প্রাণীর থেকে সিংহের চেহারা বেশি রাজকীয়। সেই সাথে সিংহের চলাফেরাতেও একটা রাজকীয় হালচাল আছে। সিংহের ভয়ডরহীন চাহনী ও চলাফেরা নিঃসন্দেহে একটি রাজকীয় বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও এদের গর্জন জঙ্গলের অন্য যেকোনো প্রাণী থেকে এদের আলাদা করেছে। একেকটি সিংহের গর্জন প্রায় ৮ কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়। গর্জনের মাধ্যমে সিংহরা অন্যদেরকে নিজেদের সীমানার জানান দিয়ে থাকে। তাই রাজকীয় গর্জন কিংবা হুংকার সিংহের পশুরাজ হওয়ার পেছনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তবে এগুলো ছাড়াও সিংহের রাজা হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এদের পরিবারতন্ত্রের। এরা অতিশয় সামাজিক একটি প্রাণী। অন্যান্য বিড়ালের প্রজাতি থেকে এরা বেশ আলাদা। এরা দলবেধে বসবাস করে। সিংহের একেকটি দলকে বলা হয় প্রাইড। একটি প্রাইডে প্রায় ৩০টির মতো সিংহ থাকে। যার ৩-৪টি পুরুষ সিংহ, ১০-১৫টি স্ত্রী সিংহ এবং বাকিসব সিংহ শাবক। একেকটা প্রাইডের আকার নির্ভর করে খাদ্য, পানি ও শিকারের যোগানের উপর। শিকার ও পানি বেশি হলে দলের আকার বড় হয়, কম হলে দলের আকারও ছোট রাখতে হয়।

একজন রাজার যেমন নির্দিষ্ট রাজ্য থাকে, তেমনই একটি প্রাইডেরও একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা টেরিটোরি থাকে। এই টেরিটোরি প্রায় ১০০ বর্গ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। প্রাইডের পুরুষ সিংহেরা এই টেরিটোরি রক্ষার কাজ করে থাকে। অন্য কোনো সিংহের দল যাতে তাদের সীমানায় ঢুকতে না পারে সেই কাজ করে থেকে পুরুষ সিংহেরা। পুরুষ সিংহ শাবককে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তার বাবার এলাকা ত্যাগ করে একটি নতুন টেরিটোরিতে আক্রমণ চালিয়ে নিজের নতুন সীমানা প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

সিংহের একটি দল বা প্রাইড ( source: wikimedia commons)
source: wikimedia commons
রাজা বাদশাহদের সাথে ভোগ-বিলাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সিংহের প্রাইডেও এই বিষয়টি স্পষ্ট। সাধারণত দলের স্ত্রী সদস্যরাই শিকার ধরার কাজ করে থাকে। তবে শিকার স্ত্রীরা করলেও প্রথম অধিকার প্রাইডের নেতা পুরুষ সিংহের। তাই শিকারের পর প্রথমে পুরুষ সিংহ তার আহার শেষ করে, তারপর বাকি অংশ স্ত্রী সিংহরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।

বাঘেদের মধ্যে এমন অসম বণ্টন নীতি দেখা যায় না। সাধারণত বাঘেরা দলবেধে শিকার করে না, এমনকি করলেও খাবারের ক্ষেত্রে সমান সমান অধিকার থাকে। তাই সিংহের পরিবারের এই প্রথা নিশ্চিতভাবে রাজতন্ত্রের কথাই সমর্থন করে।



প্রাচীনকাল থেকেই রাজকীয় প্রতীক হিসেবে সিংহের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়; source: Wikimedia commons
এই রাজকীয় পরিবারতন্ত্র জঙ্গলের অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। একজন রাজার বেশভূষা ও পরিবারতন্ত্র সিংহের মধ্যেই প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে বলেই হয়তো প্রাচীনকাল থেকেই রাজা-বাদশাহরা তাদের রাজকীয় পতাকায় সিংহের অবয়বের আধিক্য রেখেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের মতো এলাকায়, যেখানে সিংহের চেয়ে বাঘ সহজপ্রাপ্য ও জনপ্রিয়, সেখানেও রাজাদের রাজকীয় পতাকায় বাঘের চেয়ে সিংহের উপস্থিতিই বেশি লক্ষ্যণীয়। সেজন্যেই হয়তো প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মুখে মুখে 'বনের রাজা' হিসেবে চলে এসেছে সিংহের নাম!

শেষ করার আগে একটি বিষয়, 'দ্য লায়ন কিং' এর মুফাসা কিংবা সিমবার মতো সিংহদের মধ্যে কিন্তু কোনো রাজা নেই। একটি প্রাইডের সকল পুরুষ সিংহই সমান অধিকার ভোগ করে। নিজেদের মধ্যে রাজা-প্রজা জাতীয় কোনো শ্রেণীবিভাগ নেই এদের!

3
যে গাছেরা ছোঁয় না একে অপরকে
Uzzal Hossen

https://roar.media/bangla/main/plants-animals/crown-shyness
বিশেষ প্রজাতির এই গাছগুলোর শীর্ষ প্রতিবেশী গাছের শীর্ষকে স্পর্শ করতে চায় না। ফলে এক গাছ থেকে আরেক গাছের মধ্যে ফাঁকা স্থান তৈরি হয়। এভাবে একাধিক গাছের মধ্যকার ফাঁক দেখতে যেন অনেকটা পাজলের মতো দেখায়। এই শূন্যস্থানগুলো যেন ফাঁকা জায়গারই একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। গাছদের মধ্যে এ ধরনের দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন 'ক্রাউন শাইনেস'।


বলে রাখা ভালো, সব গাছের ক্ষেত্রে ক্রাউন শাইনেস ঘটে না। আবার সব বনে ক্রাউন শাইনেসের দেখা নাও পাওয়া যেতে পারে। ব্ল্যাক ম্যানগ্রোভ (Avicennia germinans), পাইন গাছ (Pinus contorta), জাপানিজ লার্চ (Larix kaempferi), ইউক্যালিপ্টাসের কিছু প্রজাতি ছাড়াও আরো কিছু প্রজাতির মধ্যে ক্রাউন শাইনেস দেখা যায়। সাধারণত একই প্রজাতির একাধিক গাছের মধ্যে ক্রাউন শাইনেস দেখা গেলেও কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গাছের মাঝেও এটি দেখা যায়। আবার একই গাছের একাধিক ডালের মধ্যেও এটি দেখা যেতে পারে।

 
এক গাছের সাথে আরেক গাছের এ ধরনের দূরত্ব বজায় রাখার দৃশ্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেই দেখা যায়। কোস্টারিকার ম্যানগ্রোভ থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ার কর্পূর গাছেও এ ধরনের দূরত্ব চোখে পড়ে।

যেভাবে আলোচনায় এলো
১৯৮২ সালের কথা। জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস জ্যাক পাটজ দুপুরের তীব্র গরম থেকে বাঁচতে কোস্টারিকার গুয়ানাকাস্টে ন্যাশনাল পার্কের ব্ল্যাক ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে হাঁটছিলেন। কয়েক ঘণ্টার ফিল্ডওয়ার্ক আর দুপুরের খাবার শেষে ভাতঘুমের কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, গাছের নিচে একটু ঘুমিয়ে নেবেন।


Image Source: sciencehalimah.blogspot.lt
ঘুমানোর সময় তিনি যখন উপরের দিকে তাকালেন, তখন খেয়াল করলেন, বাতাসের কারণে এক গাছের ডাল আরেক গাছের দিকে হেলে পড়লেও গাছগুলোর পাতা আরেক গাছের পাতার সাথে দূরত্ব বজায় রাখছে। যেন এক গাছ আরেক গাছের পাতাকে ছুঁতে আগ্রহী নয়।

চল্লিশ বছর আগে পাটজ যখন এ দৃশ্য দেখেছিলেন, তখন তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, যে গাছেরও ব্যক্তিগত জায়গার প্রয়োজন আছে। বর্তমান সময়ে এসে তার এই পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খোঁজার জন্য অনেক বিজ্ঞানী কাজ করছেন। তবে ১৯২০ সাল থেকে বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে ক্রাউন শাইনেসের কথা উঠে এসেছে অনেকবার।

ক্রাউন শাইনেসের কারণ
গাছদের মধ্যে এ শূন্যস্থান সৃষ্টি হওয়ার আসল কারণ এখনো বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করতে পারেননি। একেক বিজ্ঞানী একেক ধরনের তত্ত্ব দিয়েছেন। তবে তাদের বেশিরভাগই স্বীকার করেছেন, ক্রাউন শাইনেসের পেছনে একক কোনো কারণ না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে।


গাছেদের ক্রাউন শাইনেস; Image Source: 500.px
কিছু বিজ্ঞানী প্রথমদিকে অনুমান করেছিলেন যে, সালোকসংশ্লেষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আলোর অভাবের কারণে গাছগুলো তাদের মধ্যকার এই শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে পারে না।


 
জীববিজ্ঞানী এবং ট্রি ফাউন্ডেশনের পরিচালক মেগ লোম্যানের মতে, এ ধরনের ক্রাউন শাইনেস স্যোশাল ডিসট্যান্সিংয়ের বৃক্ষ-সংক্রান্ত সংস্করণও হতে পারে। তিনি বলেন, যে মুহুর্ত থেকে আপনি গাছগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে পারবেন, তখন থেকে আপনি গাছগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারবেন। আইসোলেশনের (বিচ্ছিন্নতা) এটাই সৌন্দর্য। গাছগুলো আসলে তাদের নিজেদের স্বাস্থ্যরক্ষা করে চলেছে।

১৯৫৫ সালে উত্তর-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় ইউক্যালিপ্টাসের এক জাতের গাছের ওপর এক গবেষণা করা হয়। এতে বলা হয়, এখানে প্রচণ্ড বাতাসের কারণে এক গাছ আরেক গাছের সাথে ধাক্কা খায়। এতে গাছগুলোর শীর্ষের পাতা এবং ডাল ভেঙে যায় এবং এক গাছের সাথে আরেক গাছের মধ্যে জায়গা তৈরি হয়।


Image Source: flickr.com
১৯৮৪ সালে এসে পাটজ এবং তার দল তাদের প্রকাশিত গবেষণায় দেখান যে, কিছুক্ষেত্রে বায়ুর প্রভাবে গাছের মধ্যে যে দোলা লাগে, তার কারণে ক্রাউন শাইনেস তৈরি হতে পারে। তাদের গবেষণামতে, যত বেশি বাতাস ম্যানগ্রোভে প্রবাহিত হচ্ছিল, গাছগুলোর শীর্ষের মধ্যে দূরত্বও তত বাড়ছিলে।

পাটজের দুই দশক পরে এসে মিশিগান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী মার্ক রুদনিকির নেতৃত্বে একটি দল কানাডার আলবার্তায় বাতাসের প্রভাবে পাইন গাছের ধাক্কা দেওয়ার বল পরিমাপ করেন। তারা দেখতে পান, যেসব বনে বাতাস বেশি এবং সমান উচ্চতার লম্বা গাছ বেশি, সেসব বনে ক্রাউন শাইনেস বেশি ঘটে। কিন্তু প্রতিবেশী পাইন গাছের সাথে ধাক্কা এড়াতে রুদনিকি ও তার দল যখন নাইলনের দড়ি ব্যবহার করে দেখলেন, গাছগুলোর পাতা তাদের মধ্যকার শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলছে। তখন আর ক্রাউন শাইনেস থাকছে না।

রুদনিকির মতে, কিছু গাছ শিখে নিয়েছে যে, আগায় গিয়ে আর নিজেদের শরীর (ডালপালা, পাতা) বৃদ্ধি করা যাবে না। এ বিষয়ে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিদ্যা-বিশেষজ্ঞ ইনেস ইব্যানেজ বলেন, গাছগুলো তাদের বৃদ্ধি একটা পর্যায়ে গিয়ে থামিয়ে দেয়, যাতে গাছের ডাল ভেঙে না পড়ে। গাছেদের ক্ষেত্রে নতুন টিস্যু উৎপাদন করা বেশ কষ্টসাধ্য। এটা অনেকটা এরকম যে, গাছগুলো নিজেরাই বুঝে নেয়- আর বৃদ্ধি পাওয়ার দরকার নেই, বেশি বৃদ্ধি পেলে নিজেরই ক্ষতি হতে পারে।

 
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টার এবং উদ্যানতত্ত্ববিদ মারলিইজি ডুগেড বলেন, অনেক গাছই নিজেদের বৃদ্ধির বিষয়ে এ ধরনের বিচক্ষণতা আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারে। এজন্য গাছগুলো আশেপাশের গাছপালা হতে উদ্ভূত রাসায়নিক পদার্থ শনাক্ত করতে একটি বিশেষ সংবেদক সিস্টেম ব্যবহার করে। বৃক্ষের এ ধরনের রাসায়নিক যোগাযোগ বেশ জটিল এবং অল্প মাত্রায় ঘটে। কিন্তু এক গাছ যদি আরেক গাছকে বুঝতে পারে, তবে একে অন্যকে স্পর্শ করার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই তারা নিজেদের শীর্ষের ডাল এবং পাতার বৃদ্ধি বন্ধ করে দিতে পারে।


Image Source: demilked.com
ক্রাউন শাইনেসের পেছনে গাছের নিজস্ব সুবিধার বিষয়টি জড়িত বলে মনে করেন লোম্যান। তিনি বলেন, গাছের অন্যতম একটি অঙ্গ হচ্ছে তার পাতা। গাছ চায়, যেকোনো মূল্যে তার পাতাকে রক্ষা করতে। যদি বাতাসের কারণে এর কোনো একটি ডাল আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তা গাছটির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এজন্যও গাছেরা দূরত্ব বজায় রেখে বসবাসের চেষ্টা করে।

মিগেল ফ্র্যাংকোর একটি তত্ত্বে বলা হয়েছে, প্রতিটি গাছ তার প্রতিবেশীদের এমন একটি প্যাটার্নে বা ছাঁচে যেতে বাধ্য করে, যা সম্পদ সংগ্রহকে সর্বাধিক করে তোলে এবং ক্ষতিকারক প্রতিযোগিতা হ্রাস করে। বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত মিথস্ক্রিয়া বেশ জটিল বিষয়। ফলে ক্রাউন শাইনেসের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে।

সুবিধা
মেগ লোম্যান মনে করেন, নিজেদের সুবিধার জন্যই এই বিশেষ গাছগুলো নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখে। বেঁচে থাকার উপাদান যেমন- পরিপোষক পদার্থ, পানি, জায়গা এবং আলো সংগ্রহের জন্য গাছকেও অন্যান্য গাছ এবং প্রাণীর সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়। ঘন বনাঞ্চলে আলোর জন্য উদ্ভিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। ক্রাউন শাইনেসের এই শূন্যস্থানগুলো গাছগুলোকে সঠিক আলো পেতে এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া নিজের অনুকূলে রাখতে সাহায্য করে।


সৃষ্ট শূন্যস্থানের কারণে সূর্যের আলো বনের মাটিতে পৌঁছাতে পারে। ফলে নিচে অবস্থানকারী ছোট উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনধারণ সহজ হয়, যা ঘুরেফিরে পরোক্ষভাবে ওই বড় গাছের জীবনধারণেই সাহায্য করে।

4
ইসলামের ইতিহাস: সংক্ষিপ্ত পরিসরে চৌদ্দশ বছরের গৌরবময় যাত্রাকাহিনী

Muhaiminul Islam Antik
ইতিহাস হলো জ্ঞানের এমনই এক শাখা যা মানুষকে তার শেকড় সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে, শেকড়ের সাথে বন্ধন মজবুত করে তার মস্তিষ্করূপী বৃক্ষে দরকারি পুষ্টিদ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করে, এবং সবশেষে ইতিহাস থেকে অর্জিত শিক্ষা মানুষকে বলে দেয় তার কোন পথে যাওয়া উচিত, আর কোন পথ ভুলেও মাড়ানো উচিত নয়।

মাসখানেক আগে অনলাইন সার্ফিংয়ের সময় নজরে আসে আরবের বিখ্যাত আলেম ড. মুহাম্মাদ ইবরাহীম আশ-শারিকি রচিত ‘ইসলামের ইতিহাস – নববী যুগ থেকে বর্তমান’ বইটি। মূল বইয়ের নাম ‘আততারিখুল ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের ইতিহাস। সেখান থেকেই বাংলা ভাষায় রূপান্তর করেছেন বিশিষ্ট অনুবাদক কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, সম্পাদনায় ছিলেন শাইখ মীযান হারুন।



'ইসলামের ইতিহাস – নববী যুগ থেকে বর্তমান' বইটির প্রচ্ছদ; Background: Wallpaper Cave; প্রচ্ছদের ছবি: মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক
বইয়ের নামের নিচে সাবটাইটেল অংশটিই বলে দিচ্ছে এর আলোচনার পরিধি। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা (৩৫২) এটাও জানান দেয় যে, এখানে কোনো কিছু নিয়েই আলোচনার গভীরে যাওয়া হয়নি, তবে সংক্ষেপে সম্ভাব্য ও গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুকেই স্পর্শ করা হয়েছে। পাশাপাশি আবুল ফাতাহ মুন্নাহর চমৎকার প্রচ্ছদ ডিজাইন, যেখানে গোল্ডেন এজ অভ ইসলাম তথা ইসলামের স্বর্ণালী যুগের আবহ ফুটিয়ে তুলতে তার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না, এই বইটি কেনার সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 
বইটি খোলার পর ভিন্নভাবে সজ্জিত ১৭ পৃষ্ঠার সূচিপত্র পাঠককে অসাধারণ এক যাত্রার হাতছানিই দেবে, যার শুরুটা হয়েছে ‘ইতিহাসশাস্ত্রের ইতিকথা’ অধ্যায়ের মাধ্যমে। এই অংশে ইতিহাস বলতে কী বোঝায়, এর আলোচনার পরিধি, এই শাস্ত্র পাঠের উপকারিতা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের মতামত ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী যে কাউকে অধিকতর আগ্রহী করে তুলবে। উদাহরণ হিসেবে ‘তারিখুল ইয়ামান’ গ্রন্থের ভূমিকায় খাযরাজির বক্তব্যের একটি অংশ উল্লেখ করা যায় যেখানে তিনি লিখেছেন,

যে ব্যক্তি পূর্ববর্তীদের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে, সে যেন সুপ্রাচীনকাল থেকেই বেঁচে আছে। আর যে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রশংসনীয় কিছু রেখে যায়, সে যেন পৃথিবীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুখানুভূতি লাভ করে।

একই অধ্যায়ে আলোচিত ইতিহাসশাস্ত্রের নীতিমালা, ইসলামী ইতিহাস বিষয়ক প্রসিদ্ধ বইগুলোর নামের তালিকা একজন পাঠককে জ্ঞানের এক মহাসাগরের দিকেই হাতছানি দিয়ে ডাকবে, যার চর্চার ক্ষেত্র আসলে তৈরি করে দিচ্ছে এই বই।

এরপর বইটিতে একে একে এসেছে:

ইসলাম-পূর্ব সময়ে আরব সমাজের অবস্থা;
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর আগমনের মধ্য দিয়ে আরব-ভূমিতে ইসলামের অভ্যুদয়;
এই মহামানবের ওফাতের পর খোলাফায়ে রাশেদীনের দক্ষ নেতৃত্ব ও পরিচালনায় বিশ্বের বুকে মুসলিম সভ্যতার অবস্থান সুদৃঢ়করণ ও সম্প্রসারণ;
উমাইয়া ও আব্বাসী খেলাফতের উত্থান-পতনের প্রেক্ষাপট, সাম্রাজ্য বিস্তার সংক্রান্ত আলোচনাসহ তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত আলোচনা;
ফাতিমি, হামদানি, আইয়ুবি, ওসমানী, মোঘল সাম্রাজ্যসহ ইসলামের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে যে সাম্রাজ্যগুলোর নাম অবধারিতভাবেই উঠে আসবে সেসব সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা;
মঙ্গোলদের বর্বরতায় ছিন্নভিন্ন মুসলিম বিশ্ব এবং ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সেই মুসলিমদের হাতে সেই মঙ্গোলদেরই গুঁড়িয়ে দেবার দুঃখ-গৌরবের মিশ্র ইতিহাস;
ক্রুসেড কেন শুরু হলো, কীভাবে ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করল, সেই সময়কার মুসলিম ও খ্রিস্টান শাসকবর্গ এই সংঘাত সম্পর্কে কেমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন, এবং প্রতিটি ক্রুসেডের ফলাফল সংক্ষেপে আলোচনা;
সর্বশেষে আরব দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা, সৌদি আরবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থা প্রভৃতি।
উপরে মোট আটটি পয়েন্ট ধরে সংক্ষেপে বইটির আলোচ্য বিষয়গুলোর কথা বলা হলেও একজন পাঠক, যিনি কিনা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করতে চাচ্ছেন কিংবা পড়াশোনা শুরু করলেও একেবারেই শৈশবকাল পার করছেন, তার জন্য বইটি নিঃসন্দেহে চমৎকার এক সূচনাপর্ব হতে পারে; হতে পারে এমন এক ভিত্তিপ্রস্তর, অধ্যবসায়ের বলে যার উপর গড়ে উঠতে পারে ইসলামী ইতিহাস বিষয়ক জ্ঞানের সুউচ্চ ভবন।


কাবা; Image Source: Adli Wahid/Wikimedia Commons
মূল বইটির কাজ ১৩৮৯ হিজরি মোতাবেক ১৯৬৯ সালেই সমাপ্ত হয়েছিল। ওদিকে বাংলায় অনূদিত বইটি পাঠকদের হাতে এসেছে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে। বইটির ভাষা যেন পাঠকদের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহজবোধ্য হয়, এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখিত ইতিহাসের অজস্র তথ্য যেন পাঠকের বিরক্তি ও একঘেয়েমির কারণ না হয়ে ওঠে, সেজন্য অনুবাদক ও সম্পাদকের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। বইটির নানা জায়গায় তাদের দুজনের আলাদাভাবে সংযোজিত সুবিশাল টীকা, যা কখনও মূল লেখকের বক্তব্যকে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে আরও স্পষ্ট করার জন্য, কখনও আবার তার আলোচনায় না আসা বিষয়কে তুলে আনার জন্য, তাদের এই কঠিন পরিশ্রমেরই স্বাক্ষর বহন করে।


 
পাশাপাশি বইটির পুনঃনিরীক্ষণে ছিলেন ইসলামী ইতিহাস বিষয়ক জনপ্রিয় লেখক ইমরান রাইহান, যিনি ইতোমধ্যেই মৌলিক গ্রন্থ সুলতান আলপ আরসালান ও আব্বাসি খিলাফাহ, এবং সংক্ষিপ্ত অনুবাদ-গ্রন্থ সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ-এর মতো তিনটি বই দিয়ে ইতিহাসপ্রেমী পাঠকদের মনে খুব চমৎকার এক আস্থার স্থান তৈরি করে নিয়েছেন।

বইটির পাঠ-পর্যালোচনা করতে গিয়ে এতক্ষণ ধরে এর ইতিবাচক দিকগুলো নিয়েই বলা হলো কেবল, এবার আসা যাক উন্নতির দিক সংক্রান্ত আলোচনায়। নেতিবাচক দিক বলছি না এ কারণেই যে মানুষ নিজে এবং তার হাত ধরে আসা কোনোকিছুই কখনও শতভাগ নিখুঁত থাকেনি, বরং সময়ে সময়ে নানাজনের ‘উন্নতির দিক’ সংক্রান্ত পরামর্শই তাকে এবং তার সৃষ্টিকে পারফেকশন তথা পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।

১) বইটিতে নামসংক্রান্ত বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে মাঝে মাঝেই। এর মূল কারণ আরবের অধিবাসীদের নামগুলোর বিশালাকৃতি। কখনও নামের এক অংশ, আরেক জায়গায় নামের অন্য অংশ- এমন করার ফলে মাঝে মাঝেই বুঝতে অসুবিধা হয়েছে যে আসলে কার কথা বলা হচ্ছে। ফলে বেশ কয়েকবারই পেছনে গিয়ে খুঁজে খুঁজে যোগসূত্র বের করে আবার সামনে এগোতে হয়েছে, যা ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক নবীন পাঠকদের জন্য কষ্টসাধ্য কাজ। না, নাম খুঁজে আনাটা না, বরং একই ব্যক্তির নামের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার। হয়তো মূল লেখকই এমনটা রেখেছেন, তবে অনুবাদক-সম্পাদকের প্রতি অনুরোধ থাকবে এই সহজীকরণের দিকে নজর দিতে, একই নাম ব্যবহার করতে।

২) একই ব্যক্তির একই নামের দু’রকম উল্লেখের বিষয়টিও নজরে এসেছে। যেমন- বাইজান্টাইন সম্রাট নিকিফোরাসের নাম একবার ‘নিকিফোরাস’ (পৃষ্ঠা: ১৮৪) ও পরের পৃষ্ঠাতেই ‘নাইসিফোরাস’ হিসেবে এসেছে। একই বিষয় দেখা গিয়েছে তুর্কি সেনাপতি আফশিন/আশফিনের বেলাতেও, যাকে ‘আফশিন’ (পৃষ্ঠা: ২০৮-০৯) ও ‘আশফিন’ (পৃষ্ঠা: ২০৯) উভয় নামেই সম্বোধন করা হয়েছে। এই ভুলগুলো কম্পিউটারে টাইপ করার সময়ের ভুল হবার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে এগুলো খুব সহজেই সংশোধনযোগ্য।

৩) সাল অর্থাৎ কোনো একটি ঘটনা সংঘটনের সময় সংক্রান্ত কিছু জায়গাতেও খটকা লেগেছে। উদাহরণস্বরুপ দুটো দিকের কথাই বলা যাক।


 
ক) ‘উসমানি সাম্রাজ্য’ অধ্যায়ের ‘মাগরিবে আরবী নিয়ন্ত্রণ’ (পৃষ্ঠা: ৩১১) অংশে দুটো স্থানে ১৯০০ এর পরবর্তী সালের কথা উল্লেখ আছে, যা সম্ভবত ভুলক্রমে লেখা হয়েছে। যেমন- এই অংশে উল্লেখ করা সিনান পাশার জীবদ্দশা ১৫০৬ থেকে ১৫৯৬ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও তার তিউনিশিয়া জয়ের সময় হিসেবে ১৯৭৪ এর কথা লেখা আছে। যদি আমি ইন্টারনেট থেকে ভুল সিনান পাশাকে বেছে না নিয়ে থাকি, তাহলে এখানে সাল সংক্রান্ত একটি ভুল হয়েছে।

খ) একই রকমের একটি বিচ্যুতি দেখা গিয়েছে ‘আরব দেশগুলোর পরিস্থিতি’ অধ্যায়ের ‘জামাল উদ্দিন আফগানি’কে নিয়ে আলোচনাতেও। তার জীবদ্দশা ১৮৩৯ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত বিস্তৃতি হলেও তাকে মিশর থেকে বিতাড়নের সাল হিসেবে ১৭৮৯ লেখা (পৃষ্ঠা: ৩২০) রয়েছে।

৪) হতাশ হয়েছি মূল লেখকের বইয়ে মোঘল সাম্রাজ্য নিয়ে মাত্র একটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকায়, যেখানে এই সাম্রাজ্যের তিন শতাধিক বছরের ঘটনাবলীও বইটির সংক্ষিপ্ত আলোচনার নীতিতে অন্তত কয়েক পৃষ্ঠা আলোচনার দাবিদার।

৫) যে লেখক এত চমৎকার একটি বই লিখতে পারেন, তার সম্পর্কে জানবার আগ্রহ হবে যেকোনো পাঠকেরই। দুর্ভাগ্যবশত, বইয়ের পেছনে ‘আরবের বিখ্যাত আলিম’ শব্দত্রয় ছাড়া ড. মুহাম্মাদ ইবরাহীম আশ-শারিকি সম্পর্কে পুরো বইয়ে জানবার আর কোনো উপায়ই নেই। তাই লেখক পরিচিত যুক্ত হওয়াটা নিঃসন্দেহে অনুসন্ধানী পাঠকদের মনকে শান্ত করবে; এই লেখক সম্পর্কে, তার কর্মপরিধি সম্পর্কে আরও জানার সুযোগ করে দেবে।

৬) পুরো বইয়ের হিসেবে বলতে গেলে বিভিন্ন অংশেই ছোটখাট বানান ভুল নজরে এসেছে। এই দিকটিও অবশ্যই উন্নতির দাবিদার।


 
উন্নতির দিক সংক্রান্ত এই পরামর্শগুলো প্রথম সংস্করণ (প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২০) এর ভিত্তিতে দেয়া। বইটির সাথে যুক্ত দায়িত্ববান সকলের প্রতিই বিনীত অনুরোধ থাকবে এই দিকগুলো নিয়ে যত্নসহকারে কাজ করার, যা চমৎকার এই বইয়ের মানোন্নয়ন ও একে আরও আকর্ষণীয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বইয়ের উন্নতির দিক নিয়ে যে পরামর্শগুলো দেয়া হলো, একজন পাঠক হিসেবে সেগুলোকে অতিরিক্ত আমল দিয়ে বইটি সংগ্রহের চিন্তা থেকে আবার সরে আসবেন না যেন! কারণ এগুলো বইয়ের মূল আবেদন, মূল বক্তব্যে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই আমার অভিমত। বরং এগুলো দেয়া হলো যেন এর ‘গুড’ থেকে ‘বেটার’ এর পথে যাত্রাটা আরও সহজ হয়।


অটোম্যান তথা ওসমানী সাম্রাজ্যের মানচিত্র (১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ); Image source: Wikimedia Commons
বইয়ের একেবারে শেষে সংযুক্ত চাররঙা মানচিত্রগুলোর কথা যদি না বলা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বইটি ও এর পেছনে জড়িত ব্যক্তিবর্গের প্রতি অবিচার করা হবে। চমৎকারভাবে এখানে মানচিত্রের মাধ্যমে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে:

উমাইয়া খেলাফতের সময়কার খেলাফতের বিস্তার
আব্বাসী খেলাফতের বিস্তার
সেলজুক ও ফাতিমি সাম্রাজ্য
উসমানী সাম্রাজ্যের উত্থান
উসমানী সাম্রাজ্যের পতন
বিশেষত শেষ দুটো মানচিত্রে উসমানী সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের রঙিন মানচিত্রটি একবুক দীর্ঘশ্বাসই কেবল নিয়ে আসে…

5
Heritage/Culture / ইলিশনামা
« on: November 21, 2020, 12:37:53 PM »
ইলিশনামা

Arafat Hossain
বাঙালির কাছে অতি পছন্দের মাছের কথা জিজ্ঞেস করলে ইলিশের কথা আসবেই। বিশ্বের ৮৬% ইলিশ এককভাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। সেই হিসেব ইলিশের একচ্ছত্র অধিকার বাংলাদেশের দখলে। ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে ইলিশ পছন্দ করে না, এমন বাঙালি সম্ভবত পাওয়া যাবে না।

শব্দে জব্দ ইলিশ
উৎপত্তিগতভাবে 'ইলিশ' শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃতে বলা হয় 'ইলীশ'। ইল+ঈশ- এই হলো সন্ধি-বিচ্ছেদ। 'ইল' মানে জলের মধ্যে, আর 'ঈশ' মানে রাজা। তাহলে 'ইলীশ' মানে দাঁড়ায় 'জলের রাজা'। যদিও ইলিশ শব্দটি এখন ইলিশ হিসেবে লেখা হয়। ইলিশ যে জলের রাজা তা যেকোনো রসনাবিলাসী বাঙালি স্বীকার করবেই, তবে অবাঙালিদের কথা ভিন্ন!



ইলিশের বসতবাড়ি
বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর এবং তৎসংলগ্ন নদ-নদীতে ইলিশের দেখা পাওয়া যায়। সেই হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, থাইল্যান্ড এসব দেশে ইলিশের চারণভূমি। বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের খ্যাতি তো জগৎজোড়া। বিশ্বের সিংহভাগ ইলিশের যোগানদার বাংলাদেশ। সেই মোতাবেক বলা যায় ইলিশ বাংলাদেশেরই ভূমিপুত্র। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষের দেয়া ইলিশের জিআই (Geographical Indication) স্বীকৃতিও বাংলাদেশের দখলে।

 
শ্রেষ্ঠ ইলিশ
বিনা তর্কে বলা যায়, পদ্মার ইলিশই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু কীভাবে এই শ্রেষ্ঠত্ব এলো সেদিকে এখন চোখ ফেরানো যাক। ইলিশ মূলত সাগরের মাছ। নোনা জলে ডিম নষ্ট হয়ে যায় বিধায় ডিম ছাড়তে ইলিশকে নদীর মোহনায় আসতে হয়।

এ সময় ইলিশকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। ইলিশের বেগ ঘন্টায় প্রায় ৬০ কি.মি.। নদীমুখী ইলিশ স্রোতের বিপরীতে চলে। নদীতে জমে থাকা শ্যাওলা খেয়ে বাঁচে। ইলিশের খাদ্যের জন্য উৎকৃষ্ট শ্যাওলা পদ্মার মোহনাতে পাওয়া যায়। এই শ্যাওলা ইলিশের পেটে চর্বি হিসেবে জমা হয়, যা ইলিশের স্বাদ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। ডিম ছাড়ার আগপর্যন্ত ইলিশের স্বাদ বেশি থাকে। পেটে ডিম হলে স্বাদ কিছুটা কমে যায়, আর ডিম ছাড়লে আরো কমে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাগরের চেয়ে নদীর ইলিশ সুস্বাদু। তবে সাগরের ইলিশও ফেলনা নেয়। মূলত একেক রকম ইলিশ একেক স্বাদের। আর যেকোনো রসনাবিলাসীর কাছে পদ্মার ইলিশই যে শ্রেষ্ঠ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিলিশ কথা
ডিম ছাড়ার উদ্দেশ্যে ইলিশ যখন সাগর ছেড়ে নদীতে আসে, তখন কিছু ইলিশ পথ ভুলে বা বন্যায় খালে-বিলে ঢুকে পড়ে। খাল-বিলের পানিতে ইলিশের স্বাদ কয়েকগুণ কমে যায়। এসব ইলিশকে বলা হয় বিলিশ। তবে বিলিশ সচরাচর পাওয়া যায় না।

ইলিশের খাদ্যগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে ফ্যাট আছে ১৯.৪ গ্রাম, প্রোটিন ২১.৮ গ্রাম, শর্করা ২.৯ গ্রাম, মিনারেল ২.২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৮০ মিলিগ্রাম, আয়রন ২ মিলিগ্রাম, এবং ২৭৩ ক্যালরি এনার্জি আছে। ইলিশ মাছে আছে ওমেগা ৩ ফ্যাট, যা হার্টের রোগ ও ক্যান্সার নিরাময়ে ভূমিকা রাখে। তবে অতিরিক্ত কোনো কিছুই স্বাস্থ্যকর নয়, যা ইলিশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।



সাহিত্য সংস্কৃতির ইলিশ
বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ আর পান্তা ইলিশ একরকম সমার্থক হয়ে গেছে। সত্যিকারার্থে চৈত্র, বৈশাখ মাস ইলিশ ধরা বা খাওয়ার সময় নয়। ইলিশ ধরার সেরা সময় ভাদ্র মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমা।

মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকারের অন্নদামঙ্গলকাব্যের একটি কবিতায় একত্রিশটি মাছের নাম আছে, তার মধ্যে সর্বশেষটি ইলিশ।

বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে ইলিশ রান্নার উপায় বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে...

আনিয়া ইলিশ মৎস
করিল ফালা ফালা
তাহা দিয়া রান্ধো ব্যঞ্জণ
দক্ষিণ সাগর কলা।

বুদ্ধদেব বসু তার 'ইলিশ' কবিতায় ইলিশকে 'জলের উজ্জ্বল শস্য' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইলিশ নিয়ে আছে গোপাল ভাড়ের গল্প। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে বাজার থেকে ইলিশ কিনে সবাইকে দেখিয়ে দরবারে আসতে বলেন, যদি কেউ দাম না জিজ্ঞেস করে তবে গোপাল পুরস্কৃত হবে। বুদ্ধিমান গোপাল ইলিশ মাছ হাতে ধরে, ধুতিটা উল্টো করে পরে দরবারে এলো। লোকজন দাম না জিজ্ঞেস করে বলতে লাগল, পাগলের আবার ইলিশ খাওয়ার শখ হলো!

সৈয়দ মুজতবা আলীর ইলিশপ্রীতির কথা না বললেই নয়। একবার এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সাথে তার তর্ক বাঁধে কোন খাবার শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে। আলী সাহেবের মতে শ্রেষ্ঠ খাবার হলো সরু চালের ভাতের সাথে পদ্মার ইলিশ। অন্যদিকে পাঞ্জাবি অধ্যপক বলেন, বিরিয়ানি। রাগ করে তিনি অধ্যাপকের সাথে সাতদিন কথা বলা বন্ধ করে দেন। একেই বলে সত্যিকারের ইলিশরসিক!

ইলিশ নিয়ে গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছড়া, কবিতা, শ্লোক, প্রবাদ, কথকতা, উপকথা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ববাংলায় একটি ছড়া বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, "ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি/ ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে/ শেখ মুজিবের বাড়ি।"

 
অর্থনীতিতে ইলিশ
দৈনিক বণিক বার্তা জানাচ্ছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২.৯০ লাখ টন। এর এক দশক পর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছটির উৎপাদন বেড়ে ৫.৩৩ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। শিগগিরই উৎপাদন সাড়ে পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১২.১৫ শতাংশই আসে শুধু ইলিশ থেকে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ শতাংশেরও বেশি।

একসময় বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০% বাংলাদেশে উৎপাদিত হত। ২০২০ সালে মোট ইলিশের ৮৬%-ই এদেশে উৎপাদন হয়,  জানাচ্ছে দৈনিক প্রথম আলো। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে ইলিশের ভৌগলিক নির্দেশক স্বত্ব লাভ করে আন্তর্জাতিক মেধাসত্ব কর্তৃপক্ষ থেকে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বিজ্ঞানী ইলিশের জীবন রহস্য উন্মোচন করেন। বাংলাদেশে ইলিশের ৬টি অভয়াশ্রম আছে, অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের ২২ দিন ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা নিষেধ, এছাড়াও সারা বছর তো জাটকা ধরা নিষেধ থাকেই। নিষিদ্ধ সময়ে সরকার জেলেদের জন্য বিকল্প আয় ও সাহায্যের ব্যাবস্থা করেছে, যার ফলাফল মিলছে ইলিশ উৎপাদনে, ১০ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ৮৪% বেড়েছে।

ইলিশ শিকারীদের যাপিত জীবন
ইলিশ নিয়ে এত কথা, এত নাম-ডাক, কিন্তু কেমন আছে ইলিশের জেলেরা সেটাও তো খতিয়ে দেখা দরকার। ইলিশ মাছ সাধারণত দুভাবে ধরা হয়- নৌকা বা ট্রলারে করে। ট্রলারযাত্রায় নদীতে একটানা ১০-১৫ দিন থাকতে হয়, তাই মাঝনদীতে যাওয়া-আসা আর থাকার বন্দোবস্ত করা লাগে। অন্যদিকে নৌকায় ইলিশ ধরতে গেলে ৩-৪ ঘন্টা পর ফেরত আসা যায়।

মাছ বিক্রির টাকা থেকে নৌকা বা ট্রলারের মালিক পায় ৩৮-৪০ ভাগ, বাকিটা জেলেরা ভাগাভাগি করে নেয়। জেলেদের থেকে মাছগুলো নৌকা বা ট্রলারের মালিক কিনে নেয়। সেখান থেকে আবার কিছু মাছ ফাও দিতে হয়। জেলেদের অভিযোগ- যখন তারা বেশি মাছ ধরে, ব্যবসায়ীরা তখন ইচ্ছে করে মাছের দাম কমিয়ে দেয়। অবশ্য মালিকপক্ষ বলে, ট্রলারের মেরামত, নদীতে থাকা-খাওয়ার খরচ, জালের খরচ সবই তাকে বহন করতে হয়। তার ভাগে যে বেশি পড়ে এ অভিযোগ সত্য নয়। তাছাড়া ইলিশ ধরার জাল দুই বছরের বেশি টেকেও না।


মৎসজীবীদের ইলিশ ধরার নিজস্ব ধর্মীয় রীতির অচার অনুষ্ঠানও আছে। মুসলমান জেলেরা নতুন নৌকা বা ট্রলার নামানোর আগে কোরআন খতম দেয়, মিলাদ পড়ায়। আর হিন্দু জেলেরা নৌকায় জল ছিটিয়ে পূজার মতো আয়োজন করে। প্রথম ইলিশ ধরা পড়লে থালায় সিঁদুর দিয়ে সাজিয়ে বরণ করে নেয়। জেলেরা মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিয়ে নৌকা বা ট্রলার নামায় নদীতে, এটাকে বলা হয় দাদন। অনেক সময় দাদনের সুদের ভার প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করতে হয়।

6
মহামারীতে কেমন আছেন কৃষকেরা?

Fatima Nujhat Quaderi
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান করোনা পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক এবং মানবিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। করোনার ভয়াবহতার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, এটি সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এবং এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কবে নাগাদ সম্ভব হবে, সেটি এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই মনে হচ্ছে ভ্যাকসিন ছাড়া করোনার নির্মূল করা সম্ভব নয়। ভ্যাকসিন নিয়ে আশার আলো দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকটি গবেষণাগার থেকে, যেগুলোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সেসব আলোর মুখ দেখতে এখনো দেরি। এই আশা নিরাশার মাঝে মাঝে কেমন আছেন আমাদের বাংলাদেশের কৃষকেরা?


সর্বত্রই হতাশার ছাপ; Image Source: Daily Inquilab
ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্য সংকট থেকে বিশাল অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা থেকে দেখা দিতে পারে অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য সংকট এবং দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে খাদ্য সংকট দেখা দিলে।


আমাদের দেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ চাল উৎপাদনকারী দেশের মাঝে চতুর্থ অবস্থানে অবস্থান করছে। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়টা ধানের জন্য অন্যতম অনুকূল আবহাওয়াতে থাকে। মার্চ থেকে মে মাসের মাঝে পাকা ধানে সোনালি হয়ে যায় পুরো হাওর অঞ্চল, এই সময়টা দক্ষিণাঞ্চল থেকে ধান কাটার জন্য লোক নিয়োগ করা হয়। এবার করোনা পরিস্থিতে লকডাউনের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ থাকাতে নিয়োগকৃত শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে পারেননি, তাতে ধান নষ্ট হয়ে যাবার একটা আশঙ্কা ছিল। পরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক প্রয়োজনের আবেদনের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোরো ধান কাটতে চলনবিল অঞ্চলে কুষ্টিয়া, রাজশাহী, গাইবান্ধা সহ প্রায় ১৭টি জেলা থেকে প্রায় ১৪ হাজার শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 
সামাজিক দূরত্ব এবং নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে এ সকল শ্রমিকদের দিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রমিকদের চলাচল এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই সকল শ্রমিকের নদীর ধারে অস্থায়ী বসবাসের জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে এবং নিজেদের রান্নাবান্না করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। বোরো ধানের মৌসুমে এই ধান যেন নষ্ট না হয়, তার জন্য সরকারি সকল মহল থেকে প্রয়োজনীয় প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

গত এপ্রিল মাসের শুরুতে সরকারি এক সভায় বোরো এবং আমন ধানের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যেন কৃষকদের বঞ্চিত না হতে হয়। এছাড়া, সরকার লটারির ভিত্তিতে বিভিন্ন কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে প্রচুর কৃষক লাভবান হবেন। এছাড়া ধান-গম মজুদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। চলতি করোনা পরিস্থির সাথে বন্যা পরিস্থিতে খাদ্য সংকট যেন দেখা না দেয়, তার জন্য সরকার আগে থেকেই এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে।


তবুও থেমে নেই কাজ; Image Source: Cimmyt
করোনাভাইরাসের কারণে বোরো পরবর্তী কৃষিকে ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ জন্য আউশ ধান, হাইব্রিড ধান, পাট, শাক-সবজি, ডালজাতীয় শস্য ও ফলমূল আবাদে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বর্তমান পরিস্থিতি এবং বন্যা পরিস্থিতির অবনতি সবকিছু মিলিয়ে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবার যে সম্ভাবনা রয়েছে, সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গত এপ্রিল-মে থেকে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, বাজারজাতকরণ ও বিপণনে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে যেন খাদ্য সংকট না হয়, দেশে যেন দুর্ভিক্ষের মতো কোনো অবস্থা সৃষ্টি না হয়, মানুষ যেন খাদ্যকষ্টে না ভোগে, সেজন্যই এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষি উদ্যোগে সবচেয়ে বড় অর্থায়ন করে থাকে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দেশে কৃষিখাতে করোনা পরিস্থিতির সম্ভাব্য পরিস্থিতে নিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। সেখানে করোনা সংক্রমণের ফলে মার্চ-এপ্রিল মাসের কৃষিখাতের সংকটের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়,

"আগামী জুন থেকে আগস্ট, এ সময়ে কৃষির বিপদের প্রভাব আরও স্পষ্ট হবে। দেশের সামগ্রিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে। ফলে, সম্ভাব্য ওই প্রভাব মোকাবিলায় সরকারকে এখনই করণীয় ঠিক করতে হবে।"

করোনা পরিস্থিতিতে শাকসবজির বাজারজাতকরণ ও কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, শাকসবজি ও পচনশীল কৃষিপণ্যের চলাচল নির্বিঘ্ন করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত ত্রাণসামগ্রীতে আলু, সবজি, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষিপণ্যের ভ্রাম্যমাণ বাজার পরিচালনা শুরু করেছে। পাশাপাশি, লকডাউন এলাকার উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য ঘাটতি এলাকায় প্রেরণের ক্ষেত্রে ট্রাক চলাচলের জন্য জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। ফলে, শাকসবজির বাজারজাতকরণ কিছুটা সহজতর হয়েছে।


কৃষিখাত আমাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র; Image source: heifer.org
তিনি আরও জানান, আলোচনা সভায় পাওয়া সুপারিশ অনুয়ায়ী বিআরটিসির ট্রাক ব্যবহার, বিদেশে রপ্তানির জন্য কার্গো ভাড়া, দেশের সুপারশপ খোলা রাখার সময়সীমা বাড়ানো এবং সমন্বয়ের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে।

সভায় জানানো হয়, বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ভোলা ইত্যাদি হচ্ছে সবজির জন্য উদ্বৃত্ত জেলা। এসব জেলা থেকে ট্রাকযোগে শাকসবজি অন্য জেলায় প্রেরণ করা হচ্ছে।

এতসব ব্যবস্থাপনার মাঝেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। করোনাকালীন পরিস্থির প্রভাব অনেকটা সময় ধরে ভোগাবে বলে ধারণা করছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। তাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বিকল্প নেই।

7
ব্যাটল অফ কোরাল সি (পর্ব-১): ২য় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের প্রথম বড় নৌযুদ্ধ

Abdullah Al Masud
১৯৪১ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা তখন পুরোদমে বাজছে।

জাপান একের পর এক প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলো দখল করে নিচ্ছে দেখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন মিত্র ব্রিটেনকে সাহায্য করলেও যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়নি। জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তি আলোচনা চালিয়ে নিলেও হঠাৎ করে ৭ ডিসেম্বর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের অন্যতম নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবারে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। একইসাথে মিডওয়ে, গুয়াম, ওয়েক আইল্যান্ড মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, সাংহাইয়ে আক্রমণ করা হয়। ফলে পরদিনই যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪১ এর ১৫ ডিসেম্বর একটি জাপানী বাণিজ্যিক জাহাজ ও ২৭ জানুয়ারি, ১৯৪২ সালে জাপানের একটি সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয় আমেরিকা।


এরপর ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ (CV-6) ও ইয়র্কটাউন (CV-5) থেকে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমান প্রথমবারের মতো গিলবার্ট এবং মার্শাল দ্বীপে জাপানি সেনাদের উপর হামলা করে তিনটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। সেই বছরের মে মাসের আগপর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে দুই দেশের নৌ ও বিমানবাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিল। তবে বড় ধরনের নৌ-যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ব্যাটল অফ কোরাল সি এর মাধ্যমে। এরপর একে একে সংগঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের বাক বদলে দেয়া ব্যাটল অফ মিডওয়ে, আজ অবধি হওয়া সবচেয়ে বড় নৌ-যুদ্ধ ব্যাটল অফ লেইতে গালফ, দু'পক্ষের ২৪টি এয়ারক্রাফট নিয়ে হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যারিয়ার বনাম ক্যারিয়ার যুদ্ধ 'ব্যাটল অফ ফিলিপাইন সি', দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে সংগঠিত হওয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ 'ব্যাটল অফ ওকিনওয়া'। সব মিলিয়ে ৫টি প্রধান নৌযুদ্ধসহ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৌ-যুদ্ধে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছিল জাপান-যুক্তরাষ্ট্র।

আজকের লেখাটি ব্যাটল অফ কোরাল সি নিয়ে। বাকি যুদ্ধগুলো নিয়েও আর্টিকেল পেতে চোখ রাখুন রোর বাংলায়।


গিলবার্ট-মার্শাল দ্বীপে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের একটি ডাইভ বোম্বার; Image source : wikipedia.org

যুদ্ধের কারণ
আগেই বলা হয়েছে, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই Greater East Asia Co-Prosperity Sphere (大東亜共栄圏, Dai-tō-a Kyōeiken) নীতির আলোকে শক্তিশালী নৌবাহিনীর জোরে একটু একটু করে পুরো প্যাসিফিক অঞ্চল দখল করে নিচ্ছিল। চীনে আক্রমণের পাশাপাশি ফিলিপাইন, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া), ওয়েক আইল্যান্ড, গিলবার্ট আইল্যান্ড, গুয়াম আইল্যান্ড, নিউ ব্রিটেন (পাপুয়া নিউগিনির অন্তর্গত) দখল করে নেয়াসহ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া (ভারতবর্ষ) করায়ত্বের পরিকল্পনা করেছিল!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই জাপানের নেভাল জেনারেল স্টাফ ব্রিটিশরা যেন তাদের মিত্রের সহায়তা না পায় সেই ব্যবস্থার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় অভিযান চালানোর মত দিয়েছিলেন। কিন্তু এত দূরে গিয়ে একবারে সৈন্য পরিবহন করে যুদ্ধ করা সম্ভব না বিধায় তার বিরোধিতা করেন আর্মি জেনারেলগণ। একই সময়ে জাপানের প্যাসিফিক অঞ্চলের ফোর্থ ফ্লিটের কমান্ডার ভাইস এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ি বিকল্প প্রস্তাব দেন। তিনি সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত তুলাগি এবং নিউ গুয়েনার পোর্ট মোর্শবি দখল করার কৌশলগত সুবিধা নিয়ে আলোচনা করেন। অস্ট্রেলিয়া দখল না করে দেশটির সাথে মিত্রবাহিনীর সাপ্লাই লাইন (সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল রুট) কেটে দিতে পারলে জাপানের জন্য 'সাপ মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না'।

তাই শেষ পর্যন্ত তুলাগি এবং পোর্ট মোর্শবি দখল করার সিদ্ধান্ত হয় এর নাম দেয়া হয় Operation Mo। ১০ মে এই অপারেশনের পরপরই ১৫ মে নাউরু ও ওসেন আইল্যান্ড দখল করার জন্য Operation RY এবং পরের মাসে ফিজি, সামোয়া ও নিউ ক্যালিডোনিয়া দখল করার জন্য Operation FS এর পরিকল্পনা করা হয়। এডমিরাল ইনোয়ি চাচ্ছিলেন এডমিরাল ইয়ামামোতোর আসন্ন মিডওয়ে আইল্যান্ড অপারেশনের আগেই যেন তার অপারেশনগুলো শেষ হয়।


ভাইস এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ি, কোরাল সি যুদ্ধের জাপানের কমান্ডার ইন চীফ; Image source : wikipedia.org

১৯৪২ এর এপ্রিলে সেনাদের ল্যান্ডিং করার স্থান নির্বাচন করতে গোপন মিশনে সাবমেরিন RO-33 ও RO-34 কে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় সাবমেরিনের নাম কি পরিচিত মনে হচ্ছে? জ্বী, এই সাবমেরিনটিকে আলু মেরে ডুবিয়ে দিয়েছিল মার্কিন নাবিকরা।  যা-ই হোক, জাপান আক্রমণ করতে যাচ্ছে- এই মর্মে খবর পায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌ গোয়েন্দারা। মার্কিন কোডব্রেকারগণ পার্ল হারবার আক্রমনের পর জাপানীদের রেডিও ডিক্রিপশন কোডবুকের ৮৫% কোডের অর্থ উদ্ধার করে ফেলেছিল!

দুটো দ্বীপই যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রবাহিনীর জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে জাপান বিমানঘাঁটি করলে আশেপাশের কয়েকশো কিলোমিটারের মধ্যে থাকা মার্কিন নৌ ও বিমানঘাঁটিগুলো তাদের হামলার আওতাভুক্ত হয়ে যাবে। একইসঙ্গে অস্ট্রেলিয়াতেও দরকার হলে হামলা করা জাপানের লংরেঞ্জ বোম্বারের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ডার চেস্টার নিমিটজ জাপানি এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ির পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে পাল্টা নৌবহর প্রেরণের সিধান্ত নেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দেয় অস্ট্রেলিয়ার নৌ ও বিমানবাহিনী। কিন্তু ৩-৪ মে, ১৯৪২ সালে জাপানের ইনভেশন ফোর্স সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত তুলাগি অঞ্চলে অবতরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র তাতে বাধা দিয়েও ব্যর্থ হয়।


প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিস্তৃতি; Image source : wikipedia.org

ব্যাটল ফর্মেশন
মূল যুদ্ধের ঘটনায় যাওয়ার আগে কার শক্তি কেমন ছিল সেটি নিয়ে আগেই বলে নেয়া উত্তম। পাঠক হিসেবে আপনি যেন এই যুদ্ধের গুরুত্ব ও ভয়াবহতা ও দুই পক্ষের শক্তির তারতম্য অনুধাবন করতে পারেন সেজন্য এই আয়োজন।

জাপান
দ্বীপরাষ্ট্র জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের দিকে মনোযোগ দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান নিজেদের নৌ-শক্তি আরো বৃদ্ধি করে। এই যুদ্ধে জাপানের 'শকাকু' এবং 'যুইকাকু' নামের দুটি ফ্লিট ক্যারিয়ারের নেতৃত্বে মূল স্ট্রাইক ফোর্স ও 'শহো' একটি লাইট ক্যারিয়ার ইনভেশন ফোর্সের জন্য এয়ার সাপোর্ট প্রদান করে। ফ্লিট ক্যারিয়ার, লাইট ক্যারিয়ার ইত্যাদি শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে 'এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার: আধুনিক নৌবাহিনীর তুরুপের তাস (পর্ব-১)' শিরোনামের লেখাটিতে।

পার্ল হারবারে আক্রমণের সময় এয়ারক্রাফট ক্যারিকার 'শকাকু' ফ্লাইট ডেকে উড্ডয়ন প্রস্তুতি নিচ্ছে একটি জাপানি যুদ্ধবিমান; Image source : wikipedia.org

জাপানিদের তিনটি ক্যারিয়ার মিলিয়ে মোট ১৩৯টি বিমান ছিল। ১২টি সৈন্য পরিবহনকারী জাহাজকে প্রটেকশন ও ভূমিতে হামলার জন্য ৯টি ক্রুজার ও ১৫টি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ বহরে যোগ দেয়। এছাড়া নেভাল মাইন অপসারণের জন্য ৫টি মাইন সুইপার, শত্রুর জন্য মাইনের ফাঁদ পাততে ২টি মাইন লেয়ার, শত্রুর সাবমেরিন ধাওয়া ও ধ্বংস করতে দুটি সাবমেরিন চেজার, মাঝসাগরে যুদ্ধজাহাজে প্রয়োজনীয় তেল সাপ্লাই দিতে একটি অয়েল ট্যাংকার ও শত্রু জাহাজের উপর গোয়েন্দাগিরি করতে একটি লংরেঞ্জ সি-প্লেন ক্যারিয়ার (এসব বিমান পানিতে ল্যান্ড করতে পারে) জাপানি বহরে যোগ দেয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে প্রশান্ত মহাসাগরের রাজা রাজার বেশেই হামলা করতে এসেছিল কোরাল সাগরে। তাদের কমান্ডার ছিল যথাক্রমে রিয়ার এডমিরাল তাকেও তাকাগি ও রিয়ার এডমিরাল চুইচি হারা।


রিয়ার এডমিরাল তাকেও তাকাগি (বামে) ও চুইচি হারা (ডানে) এই যুদ্ধে জাপানকে নেতৃত্ব দেন; Image source : wikipedia.org

যুক্তরাষ্ট্র
পার্ল হারবার আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ৫টি ব্যাটলশিপসহ ১৮টি যুদ্ধজাহাজ হারিয়ে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই তারা ১২৮টি যুদ্ধবিমান বহনকারী দুটি বিশাল আকারের ফ্লিট ক্যারিয়ারের প্রটেকশনের জন্য ৮টি ক্রুজার ও ১৪টি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে এসেছিল। এছাড়া জরুরি তেল সরবরাহের জন্য দুটি ট্যাংকার জাহাজ মার্কিন বহরে ছিল।

ঐ সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ছিল। ভাইস এডমিরাল হ্যালসির অধীনে থাকা ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ও ইউএসএস হরনেট নামের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দুটো কেবলমাত্র জাপানের মেইনল্যান্ডে বোম্বিং মিশন শেষ করে ঘাঁটিতে ফিরেছে বিধায় তড়িঘড়ি করে আবার যুদ্ধে পাঠানো সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সারাটোগা নামের আরেকটি ক্যারিয়ার কিছুদিন আগেই জাপানী সাবমেরিনের টর্পেডো হামলার শিকার হয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রে মেরামত করতে পাঠানো হয়েছে। তাই ইউএসএস ইয়র্কটাউন ও লেক্সিংটন নামের দুটো ফ্লিট ক্যারিয়ার পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। তাদের কমান্ডার ছিল যথাক্রমে রিয়ার এডমিরাল ফ্যাংক জে. ফ্লেচার ও রিয়ার এডমিরাল অব্রে ফিচ।
 
প্রিয় পাঠক, লেখার এই পর্যায়ে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো ও তাদের কমান্ডারদের নামগুলোর দিকে আবার খেয়াল করার অনুরোধ করছি। কেননা পরবর্তীতে কাহিনী বর্ণনার সুবিধার্থে এই নামগুলো বারবার আপনার সামনে উপস্থাপন করা হবে।


রিয়ার এডমিরাল ফ্লেচার (বামে) ও অব্রে ফিচ (ডানে) মার্কিনীদের নেতৃত্ব দেন; Image source : wikipedia.org

রিকনসিস মিশন
আগেই যেন মার্কিন ক্যারিয়ারের উপস্থিতির কথা জানা যায় সেজন্য জাপান ৪টি বাড়তি সাবমেরিন I-22, I-24, I-28 ও I-29 কে মোতায়েন করে। এরা ৮৩০ কিলোমিটার এরিয়া স্কাউটিং করার কথা ছিল। কিন্তু মার্কিন ক্যারিয়ার টাস্কফোর্স যে আগেই ঐ এলাকা পাড়ি দিয়ে ফেলেছে তা কে জানতো! এমনকি ঐ অঞ্চলে আগে থেকেই থাকা I-21 সাবমেরিন (যে কিনা নতুন ৪টিকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল ) ২ মে ইয়র্কটাউনের একটি বিমান থেকে হামলার শিকার হয়। কিন্তু সে নিজেও জানতো না যে হামলাটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে হয়েছে। তাই কোরাল সি এর যুদ্ধে সাবমেরিনের কোনো ভূমিকা ছিল না। অন্যথায় জাপানিরা আগেই যদি টের পেত জার্মান ইউবোটের ন্যায় সম্মিলিত হাঙ্গরের ন্যায় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো।


ইউএসএস ইয়র্কটাউন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দিতে ভূমিকা রেখেছে; Image source : wikipedia.org

এরই মধ্যে ৩ মে টাস্কফোর্স ১১ (ইউএসএস লেক্সিংটন) ও টাস্কফোর্স ১৭ (ইউএসএস ইয়র্কটাউন) নিউ ক্যালিডোনিয়া দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে একত্রিত হয়। লেক্সিংটনের রিফুয়েলিং শেষ না হওয়ায় তাকে অস্ট্রেলিয়ান নেভির টাস্কফোর্স ৪৪ এর সাথে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন এডমিরাল ফ্লেচার। ইতিমধ্যে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফোর্সের একদল কমান্ডো তুলাগিতে ল্যান্ড করে এবং জাপানি ইনভেশন ফোর্স আক্রমণ করা মাত্রই তারা পূর্বনির্দেশ মোতাবেক পিছু হটে। খবরটি প্যাসিফিক হেডকোয়ার্টারে এডমিরাল নিমিটজের কাছে পৌঁছে গেলেও তিনি রেডিও সাইলেন্স না ভাঙার কারণে ইয়র্কটাউনের রিয়ার এডমিরাল ফ্লেচারকে সেটি দিতে পারছিলেন না। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একদিন পিছিয়ে আছে মার্কিন বাহিনী!

 
ফলে তিনি টাস্কফোর্স ১১ তথা রিয়ার এডমিরাল অব্রে ফিচের ক্যারিয়ার লেক্সিংটনের এর আশায় বসে না থেকে কোর্স পরিবর্তন করে গুয়াডালক্যানেল দ্বীপ এলাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন যেন পরদিন সকালে তিনি একাই তুলাগি ইনভেশন ফোর্সের উপর হামলা করতে পারেন!


ইউএসএস লেক্সিংটন কিছুটা পুরনো হলেও এই যুদ্ধে দারুণ ভূমিকা পালন করে; Image source : wikipedia.org

মূল যুদ্ধ - প্রথম দিন
একটা সময় নৌযুদ্ধ বলতে কেবলমাত্র দুই দেশের শক্তিশালী জাহাজ পরস্পরকে নিজেদের ভারী ভারী কামানের রেঞ্জে এনে গোলাবর্ষণ করাকে বোঝাতো। কিন্তু 'ব্যাটল অফ কোরাল সি'-তে এসে নতুন যুগের নৌযুদ্ধের সূচনা হয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই দেশের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের মধ্যে যুদ্ধ হয়। দুই দেশের বিমানবাহী রণতরীগুলো পরস্পরের ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়ে। তখনকার দিনে আজকের মতো এত উন্নত রাডার ছিল না। তাই শত্রু জাহাজ না দেখেই নেভি শিপের কমান্ডার আক্রমণ করছেন- এমন যুদ্ধের প্রথাও ছিল নতুন।


মার্কিন আইওয়া ক্লাস ব্যাটলশিপের ১৬" ব্যাসের ৯টি কামানের একযোগে ফায়ারিং এর ভয়ংকর সৌন্দর্য; Image source : wikipedia.org

অপারেশন পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের চেয়ে একদিন পিছিয়ে ছিল। ১৯৪২ সালে ৩-৪ মে তারিখে জাপান সফলভাবে তুলাগিতে সৈন্য অবতরণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রথম হামলা করা হয়। ইউএসএস ইয়র্কটাউন থেকে ৪ মে সকালে লঞ্চ করা ৬০টি বিমানের সারপ্রাইজ এয়ার অ্যাটাকে তুলাগি ইনভেশন ফোর্সের ডেস্ট্রয়ার 'কিকিজুকি'সহ ৩টি মাইন সুইপার জাহাজ ডুবিয়ে দেয় এবং আরো ৪টি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্যাপক হামলার মুখেও ইনভেশন ফোর্স তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে এবং দ্রুতগতিতে তুলাগিতে সি-প্লেন বেজ নির্মাণের কাজ শুরু করে। ৬ মে এই ঘাঁটি থেকে প্রথম রিকনসিস বিমান উড্ডয়ন করে।


Kawanishi H6K দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বহুল ব্যবহৃত সি-প্লেন; Image source : wikipedia.org

এদিকে ভাইস এডমিরাল তাকেও তাকাগির ক্যারিয়ার স্ট্রাইক ফোর্স অপারেশন এম-ও এর টাইমটেবিল গড়বড় হয়ে যাবে দেখে রাবাউল ঘাঁটিতে ৯টি বাড়তি জিরো ফাইটারের ডেলিভারি দেয়ার মিশন বাতিল করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুর রিফুয়েলিং শুরু করেন। তিনি মূলত খারাপ আবহাওয়ার কারণে দুবার চেষ্টা করেও ফাইটারগুলোর ডেলিভারি দিতে পারেননি। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি শিডিউল থেকে দেড় দিন পিছিয়ে পড়েন। তা না হলে মার্কিন হামলার সময় তিনি তুলাগির একদম কাছেই থাকতেন। ইয়র্কটাউনের হামলার কথা শুনে রিফুয়েলিং বাতিল করে তুলাগির ৬৫০ কিলোমিটার উত্তরে থাকা ক্যারিয়ার  স্ট্রাইক ফোর্স নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুর স্কাউট বিমানগুলো এডমিরাল ফ্লেচারের ইয়র্কটাউনকে খুঁজে পায়নি। আর পাবেই বা কীভাবে? তিনি তো টাস্কফোর্স ১১ ও ৪৪ এর সাথে মিলিত হতে গুয়াডালক্যানেলের দক্ষিণে আরো ৫৯০ কিলোমিটার দূরে সরে গেছেন।


৫ মে অর্থাৎ কোরাল সি যুদ্ধ চলাকালে জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুর ফ্লাইট ডেকে ডাইভ বোম্বার; Image source : wikipedia.org

তবে জাপানিরা তার অবস্থান অনুমান করে ফেলতে সক্ষম হয়। কারণ জাপান অধিকৃত শর্টল্যান্ড আইল্যান্ড থেকে আসা একটি রিকনসিস বিমান দুটো মার্কিন ক্যারিয়ার গ্রুপের সাথে অস্ট্রেলিয়ান টাস্কফোর্সকে দেখে ফেলে বিধায় একে শুটডাউন করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর এটি খবর না পাঠানোয় এবং বেজে ফেরত না আসায় ধরে নেয়া হয় এটি মার্কিন ক্যারিয়ারের কোনো বিমানের হাতে ভূপাতিত হয়েছে। এরই মধ্যে পার্ল হারবার থেকে খবর আসে যে পোর্ট মোর্শবিতে আক্রমণ করা হবে ১০ মে।

প্রত্যাশিত স্থানে জাপানি ক্যারিয়ারকে না পেয়ে পুনরায় রিফুয়েলিং শেষে বুগেনভাইল দ্বীপাঞ্চলে দিকে রওনা দেন ফ্লেচার। কেননা ইনভেশন ফোর্সের সাপোর্ট হিসেবে সেখানে অবশ্যই জাপানি ক্যারিয়ার থাকবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু এডমিরালের ফ্লেচারের অনুমান ছিল ভুল। পরদিন মার্কিনীদের পাশাপাশি জাপানিরাও এমন সব ভুল করতে শুরু করে যা ইতিহাসে কোরাল সি যুদ্ধকে 'Most confused battle in world history'-তে পরিণত করেছে। 

8
বলপয়েন্ট কলমের কথা: মানুষের লেখালেখির ইতিহাস বদলে দেওয়া যন্ত্র

Shah MD. Minhajul Abedin
কলম ছাড়া আজকের একটি দিন কল্পনা করাও কঠিন, ইলেকট্রনিক সামগ্রীর প্রভাব যতই হোক কলম আমাদের হাতের কাছে খুঁজে পাওয়া যাবেই। তবে গত শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না, কলম ছিল তখনো বিলাসদ্রব্যের তাকে। কলম বানাতে ব্যবহৃত উপাদান আর কালি দুইটারই দাম বেশি হওয়ার কারণে প্রভাবশালী না হলে কারো টেবিলে দুই চারটা কলম থাকবে তা ভাবা ছিল দুষ্কর।

বলপয়েন্ট কলম এই দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে, মানুষের লেখার গতিশীলতা বেড়েছে, বেড়েছে কলমের গতিশীলতা, পকেটে করে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিচ্ছে আজকের কলম। গত শতাব্দীর শুরুতে কালির দোয়াতের ব্যবহার কমে আসতে শুরু করার সাথে সাথে লেখার জন্য পেন্সিল বাদে ‘ফাউন্টেন পেন’ বা ‘ঝর্ণা কলম’ই হয়ে উঠে একমাত্র কলম। সময়ের সাথে সেই ফাউন্টেন পেন বলপয়েন্ট কলমের কাছে জায়গা হারিয়ে এখন আভিজাত্য এবং শৌখিনতার প্রতীক।



প্রতিদিনের কাজে ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করে এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ এখন; Image Source: Borja Buenafente/BBC
ফাউন্টেন পেনের অসুবিধা
ফাউন্টেন কলমে যেহেতু তরল কালি ব্যবহার করা হয় তা শুকাতে সময় লাগে, লেখার জন্য কাগজকে হতে হয় একটু পুরু। আবার লেখার পরে কোনোভাবে যদি এতে হাতের ঘষা লাগে তবে কালি ছড়িয়ে যায়, আরেকটি অসুবিধা হলো তরল কালি ব্যবহারের কারণে একে ধরতে হয় একটু কায়দা করে, এই কলম যারা ব্যবহার করে অভ্যস্ত তারা বলে থাকেন সমতলের সাথে ৪০-৫৫ ডিগ্রী কোণ করে ধরতে। অনেকেই একে ‘Sweet Spot of Fountain Pen’ বলে থাকেন।


ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখতে দরকার একটু কায়দা কানুন; Image Source: pentemple.com
কলম, কালি ও হাতের গঠন অনুযায়ী একটু আলাদা হতে পারে এই কোণ, তবে কালির অবিচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে হলে একে ধরতে হবে একটু কায়দা করে। হাতে সময় থাকলে শখের বশে এই কলমে ক্যালিগ্রাফি বেশ ভালো করা যায়। তবে পৃথিবীর গতিশীলতা বাড়ার সাথে সাথে ফাউন্টেন পেন ছিটকে পড়তে থাকে কক্ষপথের বাইরে। দ্রুত লিখতে ফাউন্টেন কলম বাদ দিয়ে অনেকেই পেন্সিল ব্যবহার শুরু করেন। তবে পেন্সিলের লেখা দীর্ঘদিনে পরে ঝাপসা হয়ে যায়, তাই কাগজে দ্রুত এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে লেখতে ফাউনন্টেন কলমের বিকল্প কলম নিয়ে অনেকেই চিন্তা করেছেন।

বলপয়েন্ট দেখছে আলোর মুখ
১৮৮৮ সালে বলপয়েন্ট কলমের প্রথম প্যাটেন্ট দাখিল করেছিলেন জন লাউড। আমেরিকান এই আইনজীবী আইনচর্চার পাশাপাশি যন্ত্রাংশের খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন। যন্ত্র খুলে ভেঙে নাড়াচাড়া করতে তার পারদর্শিতা ছিল। আইনজীবী হওয়ার সুবাদে ফাউনন্টেন পেন দীর্ঘদিন ব্যবহার করেছেন, কালি চটকেছে কাগজে, বারবার কালির রিফিল খুলতে লাগাতে গিয়ে দেখলেন এর নকশায় আছে ঝামেলা। পাশাপাশি তিনি এমন একটি কলম তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা দিয়ে কাঠ, কাগজ, চামড়ায় খুব সহজেই লেখা যাবে।

আমরা এখন যে বলপয়েন্ট কলম ব্যবহার করি, তার মাথায় একটি ছোট স্টিলের বল ঘুরতে থাকে। কাগজে লেখা চালিয়ে যাবার সাথে সাথে এই ঘুরতে থাকা বল কালির সংস্পর্শে এসে নিজেই বারবার কালি বের করে আনতে পারে। এই ডিজাইনটি মূলত জন লাউডের করা। তবে এই ডিজাইনের আরেকটি চমৎকার ব্যবহার আছে, আমরা যে 'রোল-অন ডিওডোরেন্ট' ব্যবহার করে থাকি সেটিও এই ডিজাইন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, বলের পেছনে কালির বদলে থাকে তরল ডিওডোরেন্ট। কলমের ক্ষেত্রে ঘুরতে থাকা স্টিল বলের পেছনে থাকবে তরল পদার্থটি, তবে স্টিল বল এবং সকেট এমন মাপের হবে যাতে কালি কোনোভাবে আবার বাইরে ছড়িয়ে না যায়। এই ডিজাইনে কালি খরচাও কমবে।


লাউডের প্যাটেন্ট, একই মডেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে রোল-অন ডিওডোরেন্ট-এ; Image Source: commons.wikimedia.org
লাউড প্যাটেন্টে তার কলমকে ফাউন্টেন পেনের একটু উন্নত সংস্করণ হিসেবেই দেখিয়েছিলেন, তার কলমে কালি ছিল ঐ ফাউন্টেন পেনের মতোই তরল। তাই এটি দিয়ে চামড়া কিংবা কাঠে লেখা গেলেও সাধারণ পাতলা কাগজে লেখা কঠিন ছিল। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের কাজে বা পাতলা কাগজে যেহেতু লেখা যাচ্ছে না, তাই ধীরে ধীরে এই প্যাটেন্ট তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারায়। তবে এই নকশাকে আরেকটু উন্নত করতে কাজ করেছেন অনেকেই। ১৯৩০ সালে অস্ট্রিয়ান-আর্জেন্টাইন লাজলো বিরো নামের এক সাংবাদিক বলপয়েন্ট কলম নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। সাংবাদিকতার খাতিরে প্রতিনিয়ত ফাউনন্টেন কলম তিনিও ব্যবহার করে অভ্যস্ত, লাউডের মতো তিনিও চাইতেন এর সমস্যাগুলো সমাধান করতে।

বদলে গেল দৃশ্যপট
তিনি বুঝতে পারলেন, বল পয়েন্ট কলমে যদি ঐ একই তরল কালি ব্যবহার করা হয় তাহলে তার আলাদা কোনো গুরুত্ব থাকবে না। লেখার কাজ একটু সহজ হলেও ঐ একই মোটা কাগজ ব্যবহার করতে হবে এবং কালি ছড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ কলমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কালিকে একটু পরিবর্তন করতে হবে। ঘটনাক্রমে লাজলো বিরোর ভাই ছিলেন একজন দন্ত চিকিৎসক এবং রসায়নবিদ। ভাইয়ের সাথে আলাপ করে বুঝতে পারলেন কালিকে করতে হবে একটু ঘন। অর্থাৎ, রসায়ন মিলিয়ে বললে দাঁড়ায় কালির সান্দ্রতা বাড়াতে হবে।

 
সান্দ্রতার ব্যাপারটি সহজে বুঝা যাবে পানি আর মধুর উদাহরণ দিয়ে, কাঁচের থালার উপরে পানি সহজে ছড়িয়ে যায় কিন্তু মধু ছড়ায় না সহজে। মধু যে ধর্মের কারণে তরল হয়েও ছড়িয়ে যায়না তা হল তার সান্দ্রতার মাত্রা। সান্দ্রতার মাত্রা যত বেশি তার ছড়িয়ে যাওয়ার মাত্রা তত কম। লাজলো আর তার ভাই মিলে কলমের কালির সান্দ্রতা বাড়ানোর ব্যাপারে চিন্তা শুরু করলেন।

কালির সাথে বিভিন্ন ধরনের আঠা মিশিয়ে এর সান্দ্রতার মাত্রা পরীক্ষা করা হলো। বেশি আঠালো কালি আবার কলমের নিব দিয়ে বের না হয়ে জমাট বেঁধে যায়, আবার বেশিদিন রাখলে কালি শুঁকিয়ে যায়। তাই সান্দ্রতা নিয়ে লাজলো বিরো এবং তার ভাই যে কাজ যুগান্তকারী কাজ শুরু করেছিলেন তা পরবর্তীতে বলপয়েন্ট কলম শিল্পের বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।


অস্ট্রিয়ান-আর্জেন্টাইন উদ্ভাবক লাজলো বিরো বলপয়েন্ট কলমের গতিপথ বদলে দিলেন; Image Source: Borja Buenafente/BBC
বিরোর কলমে আঠালো কালিকে রাখা হবে একটি নলে, নল থেকে মধ্যাকর্ষণের টানে ধীরে ধীরে কলমের নিবের কাছে এসে জমা হবে। আর বাইরে থাকা চাকার মতো বল কাগজের উপর ঘুরতে থাকবে, ঘুরতে থাকার সময়ে সেই চাকা কালির সংস্পর্শে আসবে। যেহেতু একটু আঠালো ধরনের কালি তা পাতলা কাগজেও লিখে ফেলা মাত্রই শুকিয়ে যাবে, অর্থাৎ ঘষা লেগে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। লাজলো বিরো এবং তার দন্ত চিকিৎসক ভাইয়ের পুরো কলমের প্যাকেজটি ছিল লাউডের থেকে আলাদা। সুতরাং বিরো তার কাজের জন্য নতুন প্যাটেন্ট নিলেন ১৯৩৮ সালে।

ইউরোপে যুদ্ধের ঘনঘটা
১৯৩৮ সালে প্যাটেন্ট নিলেও এই কলমের বিশালাকার উৎপাদনের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি দুই ভাইয়ের। ইহুদী হওয়ার কারণে লাজলো বিরো ও তার ভাই নিজ দেশে নিপীড়নের শিকার হয়ে ১৯৪১ সালে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান। সেখানে তিনি চালু করেন ‘বিরোম’ নামের বলপয়েন্ট কলম। সেই কলম নজর কাড়ে ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের, অধিক উচ্চতায় যেখানে ফাউন্টেন পেন কাজে আসে না সেখানে পেন্সিলের জায়গা নিতে শুরু করে ‘বিরোম’।


আর্জেন্টাইন পত্রিকায় 'বিরোম' কলমের বিজ্ঞাপন; Image Source: Revista Leoplán, Argentina, año 1945
রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পক্ষ থেকে ত্রিশ হাজার কপির অর্ডার দেওয়া হয় এই কলমের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরে এই বলপয়েন্ট কলম হয়ে উঠে ব্যাপক জনপ্রিয়। লাজলো বিরোর প্যাটেন্টে এক আধটু পরিবর্তন শুরু হয়, কেউ কলমের আকারে, কেউ কালিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন। সুতরাং এই প্যাটেন্ট নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজনীয়তা কমে আসে, বরং সহজে কম দামে কীভাবে মানুষের কাছে কলম পৌঁছে দেওয়া যায় সেই চিন্তা শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে আমেরিকান ব্যবসায়ী মিল্টন রেনল্ডস আমেরিকাতে এই বল পয়েন্ট কলম বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন, পত্রিকায় পত্রিকায় ছাপা হয় কলমের বিজ্ঞাপন। সাড়ে বারো ডলার খরচ করে নতুন এক কলম কিনতে দোকানগুলোর সামনে দেখা যায় লম্বা লাইন। সেই আমলের সাড়ে বারো ডলারকে এখনের হিসাবে নিলে তা দাঁড়াবে একশো আশি ডলারে, অর্থাৎ এই টাকা খরচা করে এখনের দিনে হাজারখানেকের বেশি কলম কিনে ফেলা যাবে।

 
ফাউন্টেন পেনের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা
একদম প্রথম দিকের বলপয়েন্ট কলম আসলে ফাউন্টেন কলমের ছায়া থেকে খুব একটা বের হয়ে আসতে পারেনি। শুরুতে এটিকে বানানো হতো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবেই, যেহেতু কলমের দামও বেশি তাই মানুষের কাছে কলমের অন্যতম উপযোগীতা ছিল এর স্থায়িত্ব। তাই টেকসই কলম তৈরিতে ধাতব পদার্থের ব্যবহার ছিল বেশি। রেনল্ডস কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনেই বলতো, দুইবছর রিফিল করা ছাড়াই যেকোনো স্থানে লিখতে পারবে যে কেউ, ফাউন্টেন পেন বারবার রিফিল করার ঝামেলা তাই এটি এড়িয়ে যেতেও বলপয়েন্ট ভালো সমাধান। ধীরে ধীরে ‘পার্কার’ সহ আরো বিখ্যাত ফাউন্টেন কলম নির্মাতা কোম্পানিও বলপয়েন্ট কলমের বাজারে প্রবেশ করে। কলম যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী, তাই একটি কলম কিনে দীর্ঘদিন যাবৎ তার রিফিল কিনে নিলেই হচ্ছে। তাই পঞ্চাশের দশকের মাঝেই দেখা গেলো মানুষ আর কলম না কিনে বরং রিফিল কিনছে, অর্থাৎ কলম কোম্পানির বাজারে দেখা দিল নতুন সংকট।


রেনল্ডস কোম্পানির কলমের বিজ্ঞাপন, ১৫ বছর রিফিল করা লাগবে না এমন দাবী বিজ্ঞাপনের; Image Source: imgur.com
ফ্রেঞ্চ-ইতালিয়ান ব্যবসায়ী মার্সেল বিক কলমের বাজারকে দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এখনো কলম সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য হয় উঠলেও এর উচ্চদামের কারণে এটি সে বারবার পরিবর্তন করতে পারছে না। অনেকটা বর্তমান দিনের স্মার্টফোনের মতো, অনেক কাটখড় পুড়িয়ে কেনা একটি স্মার্টফোন যতদিন না বিকল হচ্ছে সে ব্যবহার করছে, কলমই তখন অনেকটা সেরকমই ছিল।

অনেকক্ষেত্রে কলম আভিজাত্যও প্রকাশ করছে। কলমকে যদি আরো সস্তা করা যায়, এবং এর ব্যবহারকাল সীমিতও হয় তাহলেই কলমের বাজারে আসবে পরিবর্তন,  এই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু করেন মার্সেল বিক। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে সুলভে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার কলমকে আরো সহজলভ্য করে, বাজার থেকে কাঁচ, ধাতু কিংবা কাঠের কলম হারিয়ে যেতে শুরু করে।


কলমের সস্তা হয়ে উঠার পেছনে অবদান আছে মার্সেল বিকের; Image Source: BIC Cristal Story
বিকের নির্মিত কলমের অনুসরণ করে দুনিয়াজুড়ে প্রায় সব কলম নির্মাতা কোম্পানি প্লাস্টিকের দিকে ঝুঁকে। বিকের ডিজাইন করা কাঁচের মতো দেখতে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কলম ‘Cristal’ কে ধরা হয়ে থাকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ব্যবসা সফল কলম। ২০০৬ সাল নাগাদ এই কলম বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয়ে ১০০ বিলিয়ন কপিরও বেশি।


বিকের বেস্টসেলার কলম ‘Cristal’; Image Source: commons.wikimedia.org
মজার ব্যাপার হলো, স্বচ্ছ হওয়ার কারণে এই কলমের কালি শেষ হয়ে যাবার আগেই দেখা যায় এবং কালি যত নীচের দিকে নামে ততই মানসিকভাবে নতুন কলম কেনার জন্য আগ্রহী হয়ে পড়ে। কলমের রিফিল কিনে ব্যবহারের চেয়ে নতুন কলম কিংবা কলমের পুরো একটি প্যাকেট কিনে ফেলাই হয়ে উঠে সংস্কৃতির অংশ। সত্তরের দশকে এসে প্লাস্টিকের একটি বলপয়েন্ট কলমের দাম দাঁড়ায় পেন্সিলের চেয়ে কমে।

মোটাদাগে বলপয়েন্ট কলমের দাম এত কমে এসেছে যে বিভিন্ন দেশে নামীদামী ব্র্যান্ড তাদের আধিপত্ব হারিয়েছে। কলম নিত্য ব্যবহার্য হয়ে উঠে উঠার সাথে সাথে এর গায়ে কোন কোম্পানির নাম লেখা তা গুরুত্ব হারিয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থানীয় কলম নির্মাতা কোম্পানিগুলোর কাছে বাজার হারিয়েছে নামীদামী কোম্পানিগুলো। তাই বর্তমানে কলমের বাজারে একক আধিপত্য বিস্তার হয়ে উঠেছে কঠিন, তাই নামীদামী কোম্পানিরা হাঁটছে পুরাতন পথে, কলমে এবার নতুন করে বিলাস দ্রব্য বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা।

ফাউন্টেন পেন থেকে বলপয়েন্ট
ফাউন্টেন কলম যখন ব্যবহার করা হতো তখন মানুষের লেখার ধরন ছিল আলাদা, লেখার ধারাটা বজায় রাখার জন্য একটি অক্ষরের সাথে আরেকটি অক্ষরের যুক্ত করে দেওয়ার ব্যপারটি ছিল খুবই সাধারণ। লেখার এই ধরনকে বলা হয়ে থাকে 'Palmer Method', এবং লেখালেখির কাজটি ছিল ধীরেসুস্থে করার কাজ। অভিজাত স্কুলগুলোতে বা বাড়িতে শিক্ষকও রেখে অনেকেই এ ধরনের লেখা শিখতেন।


'Palmer Method' এ লেখা চিঠির উদাহরণ, দেখতে খানিকটা অভিজাত দেখায় বলে আমেরিকার শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল এই স্টাইল, এই আভিজাত্য ভেঙে দিয়েছে বলপয়েন্ট কলম; Image Source: commons.wikimedia.org
ফাউন্টেন পেনের কালির কারণেই একে এমনভাবে কাগজের সাথে ধরতে হয় যাতে করে এই প্যাচানো লেখার ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই অনুপ্রাণিত হত। আর প্রতিষ্ঠানগুলো লেখালেখিতে এই বিশুদ্ধতাকেও একটি আভিজাত্যের কাতারে ফেলে দিত। তবে ইউরোপ আমেরিকায় বলপয়েন্ট কলম আসার সাথে সাথে বরং লেখালেখির স্রোত উল্টোদিকে বইতে শুরু করে। বলপয়েন্টের নিবকে খাতার পৃষ্ঠার সাথে কোণ করে রাখার একান্তই কোনো দরকার নেই, তবে চাইলে কেউ একে ফাউন্টেন পেনের মতোও ব্যবহার করতে পারবেন। কলম উঠিয়ে যেকোনো কোণ থেকে লেখা শুরু করা যায়, অর্থাৎ কলম ব্যবহারের স্বাধীনতা একটু বেড়ে যায়। ফলে লেখালেখিতে এক্ক কয়েকটি স্টাইলের আভিজাত্য উঠে গিয়ে বিচিত্র সব স্টাইলের সৃষ্টি হয়। কোনো চমৎকার উদ্ভাবন সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হলে তারা পুরো সমাজকেই বদলে দিতে পারে এর একটি উদাহরণ হলো বলপয়েন্ট কলম।

ফেলে দেওয়া কলমে নতুন সমস্যা
পৃথিবীজুড়ে বিশাল কলমের বাজার, এর বিপুল ব্যবহার জন্ম দিয়েছে বেশ কিছু সমস্যার। কোটি কোটি সস্তা কলম যাদের রিফিল করা যায় না তারা জন্ম দিচ্ছে প্রচুর পরিমাণ বর্জ্যের। পৃথিবীজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ১০০ বিলিয়ন বলপয়েন্ট কলমের শেষ ঠিকানা হয় বর্জ্যস্তুপে, আর প্লাস্টিক বর্জ্যের বড় অংশের শেষ ঠিকানা সমুদ্রে। সেখানে কলমের প্লাস্টিক অন্যদের মতোই তাপে চাপে ভেঙে ক্ষতিকর 'মাইক্রো প্লাস্টিক পার্টিকেল' জন্ম দিচ্ছে। মানুষ এবং সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই মাইক্রো প্লাস্টিক পার্টিকেল। বিক তাদের কলম বানাতে ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত রিসাইকেল করা প্লাস্টিক ব্যবহার করছে। নিজেদের ব্র্যান্ড মূল্য বাড়াতে অনেক বড় কোম্পানিই এই কাজ করছে, তবে বেশিরভাগ কোম্পানিই সমস্যার মূলে যেতে চায় না।


আমাদের ফেলে দেওয়া কলম জন্ম দিচ্ছে নতুন সমস্যার; Image Source: eastcoastdaily.in
অর্থাৎ, রিসাইকেল করা প্লাস্টিক ব্যবহার করে এমন কলম বানাচ্ছে যা এক সপ্তাহ পুরোদমে ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসেবে আবার ছুঁড়ে ফেলতে হবে। তাই পরিবেশ সচেতন আর গবেষকরা বলছেন ভোক্তাদের সচেতন হওয়া জরুরী, দীর্ঘদিন ধরে আমরা ব্যবহারের পর কলম ফেলে দিতে অভ্যস্ত। কিংবা একসাথে ডজন ডজন কলম কিনতে অভ্যস্ত। সেই অভ্যাস বাদ দিয়ে রিফিল করে বারবার ব্যবহার করা যায় এমন কলম ব্যবহার করা জরুরী। বর্তমান কলমের বাজারে কলমের আয়ুষ্কাল কম, পাশাপাশি এর রিফিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই সাধারণ ভোক্তারা চাপ না দিলে সেই রিফিলও বাজারে যে সহসাই চলে আসবে তা ভাবা কঠিন। তাই বারবার ব্যবহার করা যায় এমন কলম হতে পারে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে একটি ছোট সচেতন পদক্ষেপ, বিশ্বজুড়ে লক্ষ কোটি মানুষ যদি নিজেদের কলম থেকেই এই পরিবর্তন শুরু করতে পারেন।

9
অতীত মহামারিগুলো থেকে নেওয়া ৫টি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
Sabiha Rahman

বর্তমান সময়কে বলা হচ্ছে নিউ নরমাল। কোভিড-১৯ মহামারির পূর্বের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। মানবজীবন এবং সমাজ ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবে যুক্ত হচ্ছে নতুন কিছু অভ্যাস। পূর্বের বিভিন্ন সময়ের মহামারি নানাভাবে বদলে দিয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা। মানুষ মহামারির সাথে লড়াই করতে গিয়ে শিখেছে নতুন সব বিষয়, যা কখনো সক্রিয়ভাবে রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজে এসেছে, তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহস জুগিয়েছে, কখনো বা জাগিয়েছে বাঁচার নতুন অনুপ্রেরণা।

কোয়ারেন্টিন
'কোয়ারেন্টিন' শব্দটি ইতালীয় 'কোয়ারেন্টা' শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ '৪০'। ১৩৭৭ সালের ২৭ জুলাই ব্যাধির ইতিহাসে প্রথম বন্দরনগরী রাগুসারের (বর্তমান ডাব্রোভনিক) আইনে কোয়ারেন্টিন যুক্ত করা হয়। তখন এই শহরটিতে বুবোনিক প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ মহামারির তাণ্ডব চলছে। নগরীর জনগণের জীবন রক্ষার্থে তৈরি করা এই নতুন আইনে বলা হয়েছিল, "জীবাণু ছড়িয়ে পড়া অঞ্চল থেকে যারা আসবে তারা (রাগুসা) বা এর অন্য কোনো জেলায় প্রবেশ করতে পারবে না, যদি না তারা জীবাণুমুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ম্রকান দ্বীপে বা কাভাত শহরে একমাস অবস্থান করে।"
১৩৭৭ এর দশকে উদ্ভূত সেই কোয়ারেন্টিন পরবর্তীতে বহু রোগের বিস্তার রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকান শহরগুলোতে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত সৈনিকরা ফিরে আসছিল, তখন এখানে চলছিল স্প্যানিশ ফ্লু। সান ফ্রান্সিসকোতে, নৌপথে আগমনকারীদের শহরে প্রবেশের আগেই পৃথক করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি সান ফ্রান্সিসকো এবং সেন্ট লুইসে সামাজিক জমায়েত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। একইসাথে এই অঞ্চলের থিয়েটার ও স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শুধু স্প্যানিশ ফ্লুতে নয়, চতুর্দশ শতকের পরের সময় থেকে আজ পর্যন্ত ইয়েলো ফিভার, বুবোনিক প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু, কোভিড-১৯ সহ বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির গতি রোধে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।

ওয়াইন উইন্ডো
চতুর্দশ শতাব্দী থেকে আঠারো শতক অবধি বিশ্ব এক ভয়াবহ মহামারির কবলে পড়ে; যার নাম বুবোনিক প্লেগ, ব্ল্যাক ডেথও বলা হয় একে। ভয়াবহ এই মহামারির কবলে পড়ে ইউরোপের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই মহামারির পরবর্তী সময় বিশ্ব চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যসেবাতে খুব দ্রুত এগিয়ে গেছে, তবে সেকালে মহামারির বিস্তৃতি রোধে যে সকল ব্যাবস্থা বা সতর্কতা গ্রহণ করা হয়েছিল তার চর্চা বর্তমান সময়েও লক্ষ্য করা যায়।

শুধু বর্তমান সময়ের কোভিড-১৯ নয়, ষোড়শ শতকে যখন প্লেগ মহামারির প্রকোপ ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখন ইতালিও এ থেকে মুক্ত ছিল না। বরং এখানে মহামারির সংক্রমণ ছিল ভয়াবহ। এই সময় ইতালির লোকেরা 'ওয়াইন উইন্ডো' বা 'বুচেটে দেল ভিনো' ধারণাটি নিয়ে আসে। সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করে মদ ক্রয়-বিক্রয় কাজে মদের দোকানের প্রাচীরে এই ছোট জানালা তৈরি করা হয়েছিল।

সমগ্র ফ্লোরেন্স এবং টাস্কানি শহর জুড়ে এখনও সেকালের প্রায় শতাধিক ওয়াইন উইন্ডো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যদিও এগুলোর বেশিরভাগ বন্যাসহ নানা কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে এই ওয়াইন উইন্ডোর ধারণা মানুষের সামনে পুনরায় ফিরে এসেছে। দোকান-মালিক এবং ব্যবসায়ীরা নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এগুলোকে আবার ওয়াইন এবং ককটেল বিক্রির কাজে ব্যবহার করছেন।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ওয়াইন উইন্ডো অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাত্তেও ফাগলিয়া বলেন, "আমরা সমস্ত ওয়াইন উইন্ডো দ্বারা একটি মাইলফলক স্থাপন করতে চাই, যখন লোকেরা এটি কী এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝতে পারবে, তখন তারা এর আরো বেশি কদর করবে।"
মাস্ক পরিধান
প্লেগ চলাকালে রোগীদের চিকিৎসা করার সময়ে চিকিৎসকরা দীর্ঘ, পাখির মতো চিটযুক্ত একপ্রকার মুখোশ পরিধান করতেন। এটি তাদের মুখ এবং নাককে আংশিকভাবে ঢেকে রাখত। রোগী এবং নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে চিকিৎসকরা এই উপায় অবলম্বন করতেন। কিন্তু এর পেছনে তারা যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখা দাঁড়া করিয়েছিলেন তা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। মিয়াসমা তত্ত্বে বিশ্বাসী সেই সময়কার চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন, বাতাসের গন্ধের সাথে রোগ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যা ছিল তাদের মাস্ক পরিধানের কারণ। তাদের চিটযুক্ত এই মুখোশে সুগন্ধযুক্ত একপ্রকার ঔষধি মিশ্রিত থাকত।
কিন্তু ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি চলাকালে মুখোশগুলো জনসাধারণের মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করার একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সান ফ্রান্সিসকোতে মুখোশ পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি যারা মুখোশ পরিধান করবে না তাদের জরিমানা, কারাবাস থাকে শুরু করে তাদের নামগুলো সংবাদপত্রগুলোতে 'মাস্ক স্ল্যাকার' হিসাবে ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সময় সংবাদপত্রগুলো কেবল তাদের লজ্জা দেবার জন্য নয়; তারা ঘরে কীভাবে মুখোশ বানাবেন সেই সম্পর্কে নির্দেশাবলীও ছাপিয়েছিল।

ব্যক্তিগত সুরক্ষা-সামগ্রী
প্লেগ মহামারি চলাকালীন চিকিৎসকরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য এক বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করতেন। তারা বিশ্বাস করতেন- এই পোশাকগুলো তাদের বায়ুবাহিত রোগ থেকে রক্ষা করবে। সপ্তদশ শতকে ফ্রান্স এবং ইতালিতে এর প্রচলন হয়।
প্লেগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসকরা প্রায় গোড়ালি পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের ওভারকোট এবং পাখির ঠোঁটের ন্যায় চাঁদযুক্ত মুখোশ, একজোড়া গ্লাভস, বুট, এবং প্রশস্ত ডানাযুক্ত টুপি পরিধান করতেন। কালের পরিক্রমায় সেই বিশেষ পোশাক পরিবর্তিত হয়ে আজ আমাদের সামনে এসেছে এক নতুন রূপে, যাকে আমরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা-সামগ্রী বা পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট নামে চিনি।

সতেজ বায়ু এবং ভিন্নধর্মী শিক্ষা কার্যক্রম
বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বর্তমান মহামারিকালে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোথাও সাময়িক, আবার কোথাও দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু মহামারিকালীন শিক্ষা কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়ার ঘটনা এবারই নতুন নয়।
১৬৬৫ সালে প্লেগের প্রকোপ চলাকালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তখন সবাই বিশ্বাস করত, তাজা বাতাস, বিশুদ্ধ বায়ু চলাচল এবং প্রকৃতির সান্নিধ্য স্বাস্থ্যের উন্নতিতে অবদান রাখে। তাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় যাতে তারা সতেজ বায়ু থেকে বঞ্চিত না হয়।
মুক্ত এবং সতেজ বায়ুর ধারণার প্রেক্ষিতে জার্মানিতে প্রথম ওপেন-এয়ার স্কুলের সূচনা হয়। ১৯১৮ সাল নাগাদ ১৩০টিরও বেশি আমেরিকান শহর সেগুলো মেনে চলা আরম্ভ করে। স্প্যানিশ ফ্লু প্রাদুর্ভাবের সেকেন্ড ওয়েভে শিকাগো এবং নিউ ইয়র্কের সরকারি বিদ্যালয়গুলো তাদের পাঠদান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় নিউ ইয়র্ক সিটির স্বাস্থ্য কমিশনার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, "শিশুরা বিদালয়ের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে তাদের বাড়ি চলে যায়, কিন্তু ওপেন-এয়ার স্কুলগুলোতে সর্বদা শিক্ষার্থীদের পরিদর্শন এবং রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।"

সতেজ বায়ু রোগ নিরাময়ে সক্ষম- এমন ধারণা থেকে জন্ম নিয়েছিল ওপেন-এয়ার স্কুল। আর ওপেন-এয়ার স্কুলের হাত ধরে মহামারিকালে জন্ম নেয় ভিন্নধর্মী শিক্ষা কার্যক্রম।

10
Monem Ahmed
একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। একবার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বেশ খেপে গেলেন একটি কাকের ওপর। কাকটি তার প্রাসাদের ওয়াচটাওয়ারে বাসা বানিয়েছিল। ভদ্রলোক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন, “যে করেই হোক এ বজ্জাত কাকটিকে শেষ করেই ছাড়ব।” সমস্যা হলো তিনি যতবারই ওয়াচটাওয়ারে যান, কাকটি উড়ে পাশের একটি গাছের ডালে গিয়ে বসে থাকে। তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে চলে আসার আগ পর্যন্ত সে আর বাসায় ফেরে না।

বারবার ব্যর্থ হয়ে তিনি একটি বুদ্ধি বের করলেন। তিনি ওয়াচটাওয়ারে তার দুজন লোক পাঠালেন। কাকটি স্বভাবত উড়ে গেল। এরপর একজন লোক ওয়াচটাওয়ার ছেড়ে ফিরে আসলো। অন্যজন লুকিয়ে রইল সেখানে। দেখা গেল কাকটি তবুও বাসায় ফিরছে না। অর্থাৎ সে জানে দুজনের একজন তখনো আছে ওয়াচটাওয়ারে। দুজন ব্যক্তি আর একজন ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা রয়েছে তার।
কাক এবং ওয়াচটাওয়ার; Image Source: pinterest.com/TravelingVardo/

পরেরবার তিনজন লোক পাঠানো হলো। দুজন ফিরে আসলো, লুকিয়ে রইল একজন। কাকটি এবারও বুঝতে পারলো বিষয়টি। তবে বেশিদূর আর এগোতে পারবে না সে। পাঁচ/ছয় জন লোক পাঠালেই ধরা পড়ে যাবে। কারণ চার-এর বেশি পরিমাণের ক্ষেত্রে মধ্যে গুলিয়ে ফেলে কাকেরা। পাঁচজন আর ছয়জন লোকের মধ্যে পার্থক্য করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। 

অধিকাংশ পশু-পাখির অবস্থা এ কাকের মতোই। তাদের তো আর মানুষের মতো সংখ্যা-পদ্ধতি নেই যে জটিল সব অঙ্ক কষবে। তবে একধরনের নাম্বার-সেন্স বা সংখ্যা-বোধ আছে বলা যায়। অনেক প্রাণী এক, দুই,তিন, চার পর্যন্ত বুঝতে পারে। এরপর যা-ই আসুক তা ‘বেশি’ হয়ে যায় তাদের জন্যে।

যেমন- সিংহের কথা বলা যায়। তারা দলবদ্ধ প্রাণী। নিজেদের পরিবার-পরিজন নিয়ে একসাথে থাকতে পছন্দ করে। অন্য কোনো গোত্র কিংবা দলকে তারা তখনই আক্রমণ করে, যখন নিজেরা সংখ্যায় বেশি থাকে। অর্থাৎ ছোট-বড় পরিমাণের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা রয়েছে তাদের।
Newsletter

Subscribe to our newsletter and stay updated.
অন্য গোত্রকে আক্রমনের পূর্বে হিসেব কষে নেয় সিংহরা; Image Source: Anup Shah/NPL

লাউড-স্পিকার থেকে সিংহের গর্জন বাজিয়ে তাদের এই আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন গবেষকরা। দেখা গেল, স্পিকারে গর্জন শুনে তারা বুঝতে পারে, কতটি সিংহের কণ্ঠ ভেসে আসছে। তারপর তারা তাকায় নিজেদের দলের দিকে। সংখ্যায় নিজেরা বেশি থাকলেই কেবল এগিয়ে আসে। তবে গবেষকদের মতে, গর্জনের সংখ্যা পাঁচ-ছয়ের ঘরে গেলে এটি আর ঠিকঠাক করতে পারে না তারা। সিংহের সীমিত সংখ্যা বোধ গুবলেট পাকিয়ে ফেলবে এর পর।

এদিক দিয়ে পোষা কুকুরের অবস্থা আরো খারাপ। তারা ০ ও ১ সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে কেবল। হয়তো ধরুন কোনো পাত্রে খাবার আছে নাকি নেই এটুকুই বুঝতে পারে তারা। এর বেশি পরিমাণে গেলে তাদের পক্ষে আর আলাদা করা সম্ভব হয় না। অনেকের মতে, কুকুরকে পোষ মানানোয় তারা সংখ্যা-বোধ হারিয়ে ফেলেছে। কারণ তাদের নিকটতম প্রজাতি নেকড়ের মধ্যে যথেষ্ট উন্নত সংখ্যা-বোধ দেখা যায়।

এ দাবি যৌক্তিক, কারণ গণনার বিষয়টি প্রাণীজগতে প্রয়োজনীয়তা থেকেই এসেছে। যেমন ধরুন ব্যাঙ; স্ত্রী ব্যাঙ তাদের যোগ্য সঙ্গী বাছাই করার জন্যে পুরুষ ব্যাঙের ডাকের স্পন্দন সংখ্যা গুনে থাকে। অবশ্য ডাকের সময়কাল, স্বরও বিবেচনায় রাখে। তবে স্পন্দন গণনা তাদের মিলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিংবা মৌমাছির কথা ধরুন, পথ চেনার জন্যে তাদের রাস্তায় বিভিন্ন চিহ্নের হিসেব রাখতে হয়। এভাবে বিভিন্ন প্রাণী প্রয়োজনের তাগিদেই গণনার চর্চা জারি রেখেছে। কিন্তু কুকুর পোষা প্রাণী বনে যাওয়ার পর হয়তো সেরকম প্রয়োজন পড়েনি তার। তাই এ দক্ষতায় তারা পিছিয়ে পড়েছে অন্যান্যদের থেকে।
গণনা বেশ প্রয়োজনীয় বিষয় তাদের জন্য; Image Source: Chris Mattison/NPL

পাখিদের সংখ্যা বোধের বলতে গেলে অ্যালেক্স নামের একটি টিয়া পাখির গল্প দিয়ে শুরু করা উচিৎ। মনস্তত্ত্ববিদ আইরিন পেপারবার্গ তার প্রিয় এ পাখিটিকে দশকের পর দশক ধরে অনেক বিষয় শিখিয়েছিলেন। তন্মধ্যে ছিল গাণিতিক দক্ষতাও। সে সর্বোচ্চ ছয় পর্যন্ত গণনা করতে পারতো।

তাকে পরীক্ষার জন্যে আইরিন একটি ট্রেতে বিভিন্ন রঙ ও আকৃতির বস্তু রাখতেন। ধরুন, গোলাপী রঙের চারটি বল, পাঁচটি সবুজ ফলক এবং তিনটি গোলাপী ফলক রাখা হলো। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কয়টি গোলাপী বল আছে ট্রেতে? সে ঠিকঠাক জবাব দিতে পারতো। এজন্য তাকে স্রেফ গণনা করলেই চলতো না, ভিন্ন রঙ ও আকৃতির মধ্যেও তফাৎ করতে হতো।

তবে ভুলে গেলে চলবে না, কয়েক দশকের প্রশিক্ষণ ছিল অ্যালেক্সের ঝুলিতে। কিছু পাখিকে দেখা যায় জন্মগতভাবেই তার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতা পেয়ে থাকে। যেমন- মুরগীর বাচ্চা স্রেফ তিনদিন বয়স থেকেই গুনতে শিখে যায়। তারা সমান ও ছোট-বড় পরিমাণ চিহ্নিত করতে পারে। এটুকু তো মানা যায়, কিন্তু ইতালিয়ান গবেষক রোজা রুগানি যে দাবি করেছেন তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। তিনি বলেন, মুরগীর ছানাদের মানুষের মতো সংখ্যারেখার ধারণা রয়েছে।
আইরিন ও অ্যালেক্স; Image Source: youtube/ World Science Festival

সংখ্যারেখার কথা মনে আছে তো? যেটি সংখ্যাকে বাম থেকে ডানে সাজায়। রুগানি ষাটটি মুরগীর বাচ্চার ওপর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। প্রথমে পাঁচটি ডট সম্পন্ন একটি কার্ডের সাথে পরিচয় করানো হয় তাদের। এরপর তাদের যখন দুটি ডট সম্পন্ন কার্ড দেখানো হয়, তখন তারা বাঁ দিকে হাঁটতে শুরু করে। আটটি ডট সম্পন্ন কার্ড তাদের নিয়ে যায় ডানে। এখান থেকেই রুগানি ধারণা করেন তারা সংখ্যারেখায় দেখে সংখ্যাকে।

কিন্তু অনেকেই রুগানির এ দাবির সাথে একমত হতে পারেননি। সমালোচকদের মতে, মুরগী-ছানাদের ডানে বা বাঁয়ে যাওয়ার প্রতি স্বাভাবিক ঝোঁক থাকে। সেটিকে সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত করেও এ ধরনের উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব। গবেষকদের এ মতবিরোধের ফলে এখনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না, মুরগী-ছানারা সংখ্যারেখা কল্পনা করতে পারে কী না। তবে এটি সত্যি হলে বুঝতে হবে, আমরা মানুষেরাও সংখ্যারেখার ধারণা জন্মগতভাবেই পেয়েছি।

অনেক প্রমাণ বলে গণনা করার দক্ষতা প্রাইমেটরা জন্মগতভাবেই পায়। তন্মধ্যে একটি হলো আমাদের নিকটাত্মীয় কিছু প্রাণীর চমৎকার গননার দক্ষতা। আই (Ai) নামের একটি জাপানি শিম্পাঞ্জির কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রথম প্রাণী হিসেবে সে আরবি সংখ্যাপদ্ধতি (0, 1, 2, …, 9) শিখতে সক্ষম হয়। কম্পিউটারের পর্দায় পাঁচটি ডট দেখে সে ‘5’ সংখ্যাটি চাপতে জানে। এটি বিশাল কৃতিত্বের বিষয়। গণনা ছাড়াও ছোটখাট গাণিতিক সমস্যারও সমাধান করতে পারে শিম্পাঞ্জীরা। অবশ্য সেজন্যে আপনাকে কিছু চকলেট উপহার দিতে হবে।
গবেষকের সাথে শিম্পাঞ্জি Ai; Image Source: Jensen Walker/Aurora Select

১৯৮৭ সালে গবেষকরা এমন একটি পরীক্ষা চালান। শিম্পাঞ্জির সামনে দুই জোড়া পাত্র রাখেন তারা। প্রত্যেকটিতে কিছু সংখ্যক চকলেট ছিল। পুরষ্কার জেতার জন্যে শিম্পাঞ্জিদের প্রথমে প্রত্যেক জোড়া পাত্রে কতটি চকলেট আছে তা যোগ করতে হতো। এরপর তুলনা করতে হতো কোন জোড়ায় বেশি চকলেট রয়েছে। এরপর বাছাই করতে হতো সেট। দেখা গেল ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তারা সঠিক পাত্র জোড়া বাছাই করতে সক্ষম হয়েছে।

এসব তথ্য থেকে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়, পশু-পাখিদের সংখ্যাজ্ঞান সম্পর্কে। কিন্তু এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলা গল্পটিই বলা হয়নি এখনো, যে ঘটনার পর থেকে গবেষকরা প্রাণীদের সংখ্যাজ্ঞান নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিলেন।

এ গল্পের নায়ক ‘ক্লেভার হ্যান্স’ নামের একটি ঘোড়া। ১৮৯১ সালের কথা। জার্মান স্কুল শিক্ষক উইলহেম ভন ওস্টেন ঠিক করলেন, তার ঘোড়াকে গণিত শেখাবেন। যোগ-বিয়োগ দিয়ে শুরু করলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই অপ্রত্যাশিত উন্নতি লক্ষ্য করলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই ঘোড়াটি গুন, ভাগ, এমনকি ভগ্নাংশ পর্যন্ত শিখে গেল।ঘোড়াটির সামনে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের মতো করে প্রশ্ন দেওয়া থাকতো। খুর দিয়ে সে বাছাই করতো সঠিক উত্তরটি। ক্লেভার হ্যান্স নামে পরিচিত হয়ে উঠলো ঘোড়াটি।
ক্লেভার হ্যান্স যথেষ্ট বুদ্ধিমান হলেও অঙ্ক কষার ক্ষমতা ছিল না তার; Image Source: BBC

হ্যান্সের সুখ্যাতি ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে সময় নিলো না। দলে দলে মানুষ ভিড়তে লাগলো গণিতবিদ ঘোড়াটিকে দেখার জন্য। প্রশ্নও উঠলো- ঘোড়াটি কি আসলেই অঙ্ক কষতে সক্ষম? নাকি কোনো চালাকি রয়েছে এতে? বিষয়টি তদন্ত করার জন্যে তেরোজন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জার্মান শিক্ষা বোর্ড।

তদন্ত কমিটি মনস্তাত্ত্বিক অস্কার ফাংস্টকে নিয়ে আসে ঘোড়াটির সক্ষমতা বিচারের জন্যে। বারবার পরীক্ষার পর একটি সন্দেহজনক বিষয় নজরে পড়ে তার। ঘোড়াটিকে যিনি প্রশ্ন করছেন, তার সঠিক উত্তর জানা থাকলেই কেবল ক্লেভার হ্যান্স সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হয়। ফাংস্ট দেখান যে, ঘোড়াটি আসলে প্রশ্নকর্তার থেকে পাওয়া কিছু সূক্ষ্ম সংকেতকে কাজে লাগাচ্ছে। যখনই সে সঠিক উত্তরের দিকে যায়, কাছে দাঁড়ানো প্রশ্নকর্তার শারীরিক ভাষায় অবচেতনভাবেই কিছু সংকেত ফুটে ওঠে। সেগুলো ব্যবহার করেই সে সঠিক উত্তর বাছাই করে। এ বিষয়টি হ্যান্সের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেও তার গাণিতিক সক্ষমতার প্রমাণ কিন্তু মেলে না এতে।

অবশ্য এসব বলে ওস্টেনকে দমিয়ে রাখা যায়নি। তার গণিতবিদ ঘোড়াটিকে নিয়ে তিনি জার্মানি ঘুরে বেড়াতে থাকেন। উৎসাহী জনতাকে দেখাতে থাকেন তার কৃতিত্ব। কিন্তু এ ঘটনাটি নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছিল গবেষকদের। পশু-পাখিদের সংখ্যা-বোধ নিয়ে আগ্রহী গবেষকরা নতুন করে শুরু করেছিলেন তাদের অনুসন্ধান।

জীবজগত সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো

১) বিস্ময়কর প্রাণী
২) ক্ষুদে বুদ্ধিমান প্রাণী

11
Sadia Islam Bristi
প্লাস্টিক কবে আবিষ্কার করা হয়েছিল? এই যে এত হাসি-ঠাট্টা যাকে নিয়ে, সেই চীনেই কি প্লাস্টিকের শুরু? প্লাস্টিকের গল্পটা এত নতুন নয়। খ্রিস্টের প্রায় দেড় শতক আগে মেক্সিকোতে ব্যবহার করা হয় পলিমারের বল। এরপর আরও কতশত বছর পর আসে প্লাস্টিকের মতোই আরেকটি উপাদান 'পারকেসিন'। মজবুত রাবার আর নানারকম উপাদান তখন ডুবোজাহাজেও ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে, এতকিছুতেও কিছু একটা কমতি যেন ছিল সবসময়। যেজন্য নিয়মিত নতুন কিছু আনার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা। তবে সেসব আবিষ্কার নিয়ে নয়, আজ আমরা কথা বলব আজ যে প্লাস্টিককে চিনি, তার শুরুটা নিয়ে। অনেকটা না চাইতেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এই প্লাস্টিক।
বিজ্ঞানী লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ড; Image Source: YouTube

১৯০৭ সালের ১১ জুলাই। ৪৩ বছর বয়সী বিজ্ঞানী লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ড তখন সবে নতুন এক পদার্থ আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানী দারুণ খুশি। একটি জার্নালে নিজের সদ্য উদ্ভাবিত এই পদার্থ নিয়ে গর্ব করেন লিও। তিনি লেখেন,

    "যদি আমি ভুল না করে থাকি, আমার এই উদ্ভাবন ভবিষ্যতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হবে"।

কিন্তু বিজ্ঞানী তো একজন সামান্য মানুষ ছিলেন। তিনি কীভাবে ভবিষ্যতকে জানবেন? সেদিনের সেই উদ্ভাবন প্লাস্টিক হিসেবে বর্তমানে আমার সবার জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেলজিয়ামে জন্ম নেওয়া লিও'র বাবা পেশায় ছিলেন একজন মুচি। বাবা নিজে পড়াশোনা করেননি। লিও কেন যে এত পড়াশোনা করতে চান, সেটাও বুঝে উঠতে পারেননি। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই ছেলেকে তিনি ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন। তবে লিওর মা একটু অন্যভাবেই ভাবছিলেন ছেলেকে নিয়ে।
মিস্টার প্লাস্টিকখ্যাত লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ড; Image Source: Amazon

মায়ের উৎসাহেই কাজের পাশাপাশি নৈশ বিদ্যালয়ে পড়ে স্কলারশিপ পান লিও। মাত্র ২০ বছর বয়সে রসায়নে ডক্টরেটও করেন। জীবন বেশ ভালোই চলছিল তার। বিয়ে করে নিউ ইয়র্কে এসে নিজের আবিষ্কৃত ফটোগ্রাফিক প্রিন্টিং পেপার বিক্রি করে বেশ ভালো আয় করেন লিও। কাজ করার আর প্রয়োজন ছিল না এই বিজ্ঞানীর। তবে রসায়নের প্রতি ভালোবাসা থেকেই হাডসন নদীর পাশে নিজের ঘর, আর সাথে একটা গবেষণাগার নির্মাণ করেন তিনি। সেবার সেখানেই ফরমালডিহাইড এবং ফেনল নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন।
Newsletter

Subscribe to our newsletter and stay updated.

না চাইতেই তার এই পরীক্ষা নতুন এক আবিষ্কারের সূচনা করে দেয়। টাইম ম্যাগাজিনে পরবর্তী সময়ে বড় বড় করে ছাপা হয় তার এ আবিষ্কারের কথা। সেদিনই প্লাস্টিকের আবিষ্কার করেছিলেন লিও। নিজের নতুন এই আবিষ্কারের নাম দিয়েছিলেন 'বেকলাইট'। প্লাস্টিকের গুরুত্ব নিয়ে খুব একটা ভুল বলেননি লিও। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তার এই আবিষ্কার। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের দৌরাত্ম্য এতটাই বেশি যে, সুজান ফ্রেইনকেল যখন এ নিয়ে নিজের বই 'প্লাস্টিক: আ টক্সিক লাভ স্টোরি' লেখেন, তাতে তিনি একটি গোটা দিনে তার ব্যবহৃত সব প্লাস্টিকের উপাদানের নাম লেখেন। আর তাতে দেখা যায় যে, একটি দিনে তার ব্যবহার করা ১৯৬টি জিনিসই প্লাস্টিকের তৈরি। অন্যদিকে প্লাস্টিক নয়, এমন জিনিসের সংখ্যা মাত্র ১০২!
সুজান ফ্রেইনকেলের বই ; Image Source: Amazon

প্লাস্টিকের পূর্ববর্তী রকম সেলুলয়েড তখনো রাজত্ব করছিল। সেটি সরিয়ে দিয়ে সে জায়গা দখল করে প্লাস্টিক। তবে বায়েকল্যান্ডের বুঝতে বেশি দেরি হয়নি যে, প্লাস্টিক সেলুলয়েডের চাইতেও অনেক বেশি ভিন্নতা ধারণ করতে সক্ষম। তিনি প্রচারণা শুরু করেন ভিন্ন ধারায়। এই একই উপাদানের হাজারটা ব্যবহার আছে, এমনটা বলে খুব একটা ভুল বলেননি লিও। টেলিফোন, বন্দুক, কফি মেকার- সবকিছুতেই একটু একটু করে প্রবেশ করে প্লাস্টিক। আর বেকলাইটের এ সাফল্যের পরই মানুষের মধ্যে চিন্তা কাজ করে, প্রকৃতিতে নেই এমন উপাদান তৈরি করার।

ইতোমধ্যে, ১৯২০-১৯৩০ এর মধ্যে প্লাস্টিক গবেষণাগার থেকে শুরু করে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় প্লাস্টিক ছিল পলিস্টিরিন, পলিথিলিন ও নাইলন আকারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানুষ প্লাস্টিকের ওপর অনেক বেশি ঝুঁকে পড়ে। আর সেখান থেকেই যুদ্ধের পরে জন্ম নেয় টাপারওয়্যারের মতো নিত্যনতুন সব পণ্য।

১৯৬৭ সালে 'দ্য গ্রাজুয়েট' নামক একটি চলচ্চিত্র বেশ পরিচিতি লাভ করে। সেখানে এক বয়স্ক নাগরিক একজন তরুণকে উপদেশ দিতে গিয়ে প্লাস্টিকের কথা বলেন। সেখানে প্লাস্টিক তখনো আগের প্রজন্মের কাছে নতুনত্ব আর নতুন সম্ভাবনার প্রতীক ছিল। আর এখন, এখনও সেটা ঠিক আগের মতোই আছে। আমাদের মানসিক দিক দিয়ে না হলেও, পরিমাণগত দিক দিয়ে প্রতি বছর প্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। যা বিশ বছর পর গিয়ে পরিমাণে দ্বিগুণ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্লাস্টিক- ভালো, না খারাপ?

আপনার মনে হতেই পারে যে, প্লাস্টিক পরিমাণে অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে এবং এর হাত থেকে এখনই মুক্তি না পেলে সেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর ফলাফল বয়ে আনবে। হ্যাঁ, কথাগুলো একেবারে মিথ্যে নয়। প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো কোনো বস্তু নয়। এটি পানিতেও মিশে যায় না। ফলে প্রাণীদের উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে আনা থেকে শুরু করে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে নিয়ে আসে প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক দিকের কারণে একজন মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাও তৈরি হয়। আবার, প্লাস্টিকের আছে ভালো দিকও। এই যে বড় বড় গাড়ি চলছে পথে, প্লাস্টিকের ব্যবহার হয় বলেই এরা এত হালকা হতে পারে এবং জ্বালানি খরচ কমে আসে।
এই প্লাস্টিকের বোতল পানিতেও মিশে যায় না; Image Source: magazine.columbia.edu

ভঙ্গুর গ্লাসের বদলে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করাটা নিরাপদ। এছাড়া, খাবার অনেকটা সময় ভালো থাকে প্লাস্টিকের কারণেই। কিন্তু এই ভালোগুলো তখনই নেওয়া সম্ভব, যখন বাড়তি প্লাস্টিক রিসাইকেল করা হয়। এ লক্ষ্যে কাজ করছে অনেকগুলো দেশ। প্লাস্টিকের গায়ে তিনকোনা একটি চিহ্ন নিশ্চয় দেখেছেন? সেখানে এক থেকে সাত পর্যন্ত সংখ্যা দেওয়া থাকে। এটি হলো রেজিন আইডেন্টিফিকেশন কোড। এ অনুযায়ী প্রতিটি দেশ তাদের প্লাস্টিককে কমিয়ে আনার বা রিসাইকেল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সমস্যা হলো, সবগুলো দেশে এ পরিমাণ এক নয়।

অনেক দেশ অবশ্য এক্ষেত্রে সফল হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তাইওয়ানের তাইপে-কে দেখা যায়। যেখানে, প্লাস্টিককে রিসাইকেল করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নাগরিকদের জন্য। রিসাইকেলের পদ্ধতিটি সহজ। আর এমনটা না করলে জরিমানা দিচ্ছেন নাগরিকেরা। প্রোটোসাইক্লার নামক এই যন্ত্রটি বেশ অভিনব। আপনি একদিন দিয়ে প্লাস্টিক প্রবেশ করালে যন্ত্রটি সেটাকে থ্রিডি প্রিন্টারের ফিলামেন্টে পরিণত করে দেবে।
প্লাস্টিক রিসাইকেলের নতুন পদ্ধতি প্রোটোসাইক্লার; Image Source: popsci.com

অনেক বাধাবিপত্তি এসেছে এবং আসছে এই গবেষণায়। প্লাস্টিক নিয়ে নতুন কী করা যায়, তা ভাবছেন সবাই। প্লাস্টিক বর্তমানে খুব অবহেলার একটি ব্যাপার হয়ে পড়েছে। তবে একটা সময় এটি মোটেও এমন ছিলো না। আশা করা যায় যে, প্লাস্টিককে ফেলে দেওয়ার জিনিস না ভেবে নতুন করে ব্যবহার করার উপায় হিসেবে ভাবতে শুরু করবেন একটা সময় সবাই। আর লিও বায়েকল্যান্ড? এমনটা সম্ভব হলে তিনিও হয়তো খুশিই হবেন!

12
Zahid Hasan Mithu
১৯১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন অন্তিমদশায়। সেসময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডেভিড লয়েড জর্জ। মিত্রশক্তির সাফল্যে তিনি তখন বেশ উল্লসিত। দেশে অবস্থানরত সৈন্য এবং যুদ্ধোপকরণ তৈরির নারী কর্মীদের সাময়িক ছুটি দিয়ে তাদের সাথে নিয়ে ম্যানচেস্টার সফরে যান লয়েড জর্জ। পিকাডিল্লি স্টেশন থেকে আলবার্ট স্কয়ারের পুরো যাত্রাপথে তারা উল্লাস করতে করতে যান।

কিন্তু সন্ধ্যায় হঠাৎ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর জ্বর ও গলাব্যথা শুরু হয়। ধীরে ধীরে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর লয়েড জর্জকে টানা ১০ দিন ম্যানচেস্টারের টাউন হলে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়েছিল। এত বেশি অসুস্থ ছিলেন যে তাকে হাসপাতালের নেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। টাউন হলে তাকে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল।

লয়েড জর্জের বয়স তখন ৫৫ বছর। ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান থেকে শুরু করে অধিকাংশ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের ধারণা ছিল তার অসুস্থতার পেছনে জার্মানির হাত রয়েছে। তাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসকরা সেই দাবি নাকচ করে দেন। পরবর্তীতে জানা যায় তিনি স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ; Image Source: BBC

স্প্যানিশ ফ্লুর নাম তখনও নির্ধারণ করা হয়নি। এই নামকরণ হয়েছিল অনেক পরে। তবে সে যাত্রায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ভাগ্যবান ছিলেন। এবং কোনোক্রমে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটেনের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ তার মতো ভাগ্যবান ছিলেন না। তারা স্প্যানিশ ফ্লু নামক সেই ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুবরণ করেন, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যাওয়া মোট ব্রিটিশ সেনা ও সাধারণ নাগরিকের চেয়ে অনেক বেশি।

বৈশ্বিকভাবে এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ছিল কল্পনাতীত। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, সেই সময় পুরো বিশ্বে স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষ, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মৃতের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। ধারণা করা হয়, প্রকৃত সংখ্যা উভয় বিশ্বযুদ্ধের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি।
Newsletter

Subscribe to our newsletter and stay updated.
কোথা থেকে স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তি

শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, স্প্যানিশ ফ্লু সম্ভবত কোনো ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হচ্ছে। স্পেন থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক সংবাদমাধ্যমই এমন খবর প্রকাশ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, এই তথ্য ভুল। স্প্যানিশ ফ্লুর জন্য দায়ী ছিল এক নতুন ধরনের ভাইরাস। পরবর্তীতে গবেষণার মাধ্যমে সনাক্ত করে যার নাম দেওয়া হয় 'এইচ ওয়ান এন ওয়ান ভাইরাস (H1N1), তবে প্রাথমিকভাবে এর নাম ছিল স্প্যানিশ ফ্লু।
স্প্যানিশ ফ্লু সৃষ্টিকারী এইচ ওয়ান এন ওয়ান ভাইরাসের বিবর্ধিত ছবি; Image Source: SPL/Fotostock

১৯১৭ সালের ৬ এপ্রিল, মিত্রপক্ষে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ছিল তুলনামূলক ছোট। কিন্তু যুদ্ধে যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মাথায় তারা বিশাল এক সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলে, যার মধ্যে থেকে প্রায় দুই মিলিয়ন সেনা ইউরোপে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়।

বিশাল সৈন্যবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল না। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন ক্যাম্প তৈরি করে। এর মধ্যে একটি ছিল কানসাসের ফোর্ট রাইলি। সেখানে সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নতুন করে ক্যাম্প ফান্সটন তৈরি করা হয়।

ক্যাম্প ফান্সটনে মোট ৫০ হাজার সেনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে ১৯১৮ সালের মার্চের শুরুতে প্রথমে এক সৈন্য জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এর কয়েক ঘণ্টার মাথায় আরো শতাধিক সেনা একই কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে এই সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মূলত এটি ছিল স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তি, যার মূল কারণ ছিল পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব।
কানসাসের ক্যাম্প ফান্সটনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত রোগীরা; Image Source: AP/National Museum of Health

একই জায়গায় বহু সংখ্যক সেনা থাকার কারণে সেখানে খুব সহজেই রোগের বিস্তার ঘটেছিল। পরবর্তীতে এপ্রিলে যখন মার্কিন সেনারা নিজ দেশ ছেড়ে ইউরোপের যুদ্ধের ময়দানে আসে, তখন তারা সাথে করে সেই ভাইরাসও নিয়ে আসে। এরপর তাদের থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। স্প্যানিশ ফ্লুর হাত থেকে পৃথিবীর কোনো অংশই ছাড় পায়নি। এশিয়া, আফ্রিকাসহ প্রশান্ত মহাসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল।
স্প্যানিশ ফ্লু নাম হওয়ার কারণ

স্প্যানিশ ফ্লুর ৩০ বছর আগে ইউরোপে রাশিয়ান ফ্লুর সংক্রমণ হয়েছিল, যার উৎপত্তিস্থল ছিল উজবেকিস্তানের বুখারা। উজবেকিস্তান সেই সময় রাশিয়ার অংশ ছিল। যে কারণে সেই ভাইরাসের নাম হয়েছিল রাশিয়ান ফ্লু। কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লুর নামকরণ হয়েছিল অন্যায়ভাবে। কারণ এই ভাইরাসের উৎপত্তি স্পেনে হয়নি। আবার তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কোনো পক্ষের হয়ে যুদ্ধেও জড়ায়নি। কিন্তু তাদের এই নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণেই ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়ের সাথে তাদের নাম জুড়ে গেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া দেশগুলোর সরকার তাদের সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেনও ছিল। সরকারের অনুমতি ছাড়া সেসব দেশের সংবাদমাধ্যম সংবেদনশীল কোনো খবর প্রকাশ করতে পারতো না। কিন্তু স্পেন যেহেতু নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিল তাই তাদের সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

যার ফলে রাজা ত্রয়োদশ আলফানসো এবং তার মন্ত্রীসভার বেশ কয়েকজন সদস্য যখন বিশেষ সেই ভাইরাসে সংক্রমিত হন, তখন স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম সেই খবর বেশ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমের কারণে তখন ইউরোপে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাসের কথা শোনা যায়। যদিও এর আগেই ইউরোপে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল।
Image Source: National Photo Company/ Library of Congress

কিন্তু ব্রিটেন, ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার চায়নি তাদের জনগণ নিজ দেশে এমন রোগের কথা জানতে পারুক। ফলে নিজেদের যুদ্ধের যৌক্তিকতাকে ধরে রাখার জন্য তারা এই খবর গোপন করেছিল। এরপর স্পেনের সংবাদপত্র যখন তাদের রাজার অসুস্থ হওয়ার খবর প্রকাশ করে, তখন ব্রিটেনের ও ফ্রান্সের নেতারা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে স্পেনের নাম প্রচার করে। যার ফলে তখন ভাইরাসটির হয়ে যায় 'স্প্যানিশ ফ্লু'।

কিন্তু স্প্যানিশরা জানতেন তারা এই ভাইরাসের জন্য দায়ী নন। এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য তারা ফরাসি সেনাদের সন্দেহ করেছিল। কিন্তু তাদের হাতে শক্ত কোনো প্রমাণ ছিল না। তখন তারা এই মিথ্যা অপবাদ ঘুচানোর জন্য অভিনব এক উপায় বের করে। রাজধানী মাদ্রিদের জারজুয়েলা থিয়েটারে ডন জুয়ানের একটি মিথ মঞ্চায়নের সময় 'দ্য সোলজার অব নেপলস' নামে একটি গান খুবই জনপ্রিয় হয়। যে গানটি সেই ভাইরাসের মতোই দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে স্প্যানিশরা ভাইরাসটিকে 'সোলজার অব নেপলস' নাম দেয়।

কিন্তু বিশ্বজুড়ে শতবর্ষ আগের সেই মহামারী ভাইরাসের আসল পরিচয় এখনো 'স্প্যানিশ ফ্লু'। স্পেনে ভাইরাসটির উৎপত্তি না হলেও সেখানকার লাখ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। এমনকি স্পেনে মৃত্যুর হার ব্রিটেনের চেয়ে দ্বিগুণ ছিল। আর ডেনমার্কের চেয়ে তিনগুণ বেশি ছিল।

স্প্যানিশ ফ্লুতে সবচেয়ে বেশি জীবনহানি ঘটেছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। এখানকার দেশগুলোতে মৃত্যুর হার ইউরোপের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ছিল। অথচ ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই হার ছিল সর্বনিম্ন।
এভাবেই আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়া হয়েছে; Image Source: Library of Congress/ Interim Archives

স্প্যানিশ ফ্লুর আক্রমণে সবচেয়ে বেশি মারা যান ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুর হার ছিল তুলনামূলকভাবে কম। যদিও গর্ভবতী নারীদের সংক্রমিত হবার আশঙ্কাই অধিক ছিল। তবে পরিণত বয়সের নারী ও পুরুষ উভয়ই সংক্রমণের শিকার হয়েছেন এবং মারা গেছেন। একই ধরনের ঘটনা সারাবিশ্বেই লক্ষ্য করা গেছে।

মৃতের হার শহরের তুলনায় গ্রামে তুলনামূলক কম ছিল। তবে কিছু শহর একেবারে জনশূন্য হলেও পাশের কোনো শহরে ক্ষতির হার কম হওয়ার নজিরও ছিল।
ভয়ঙ্কর গতিতে জীবনহানি

স্প্যানিশ ফ্লু যে দ্রুততার সাথে মানুষকে সংক্রমণ করেছিল তা এর আগে এবং পরে কখনোই দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে এমনও হয়েছে যে, কেউ সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় অসুস্থবোধ করেছেন। এরপর নাস্তা সেরে অফিস যাওয়ার পথেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

এই রোগের লক্ষণগুলোও ছিল ভয়ঙ্কর। প্রথমে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হতো। দেহে অক্সিজেনের অভাবে কিছুটা নীলবর্ণ ধারণ করতো। এরপর শ্বাসযন্ত্রে রক্ত জমে বমি ও নাক দিয়ে রক্তপড়া শুরু হতো। অনেকেই নিজেদের রক্তে গড়াগড়ি খেয়ে মারা যেতেন।

এই ভাইরাস অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন- ১৯১৮ সালে পারস্য তথা ইরান ছিল বিশ্বের অন্যতম এক ব্যর্থ রাষ্ট্র। রাশিয়া ও ব্রিটেনের প্রতিযোগিতার কারণে সেখানকার সরকার দুর্বল ও প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। ফলে সেখানে সঠিক কোনো স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল না।

১৯১৮ সালের আগস্টে যখন ইরানের উত্তর-পূর্বের মাশাদ শহরে স্প্যানিশ ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে, তখন এক রাতের মাথায় মহামারী আকার ধারণ করে। এবং দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। কিন্তু এরপরও চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা না দেয়ায় তা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। যখন অবস্থার উন্নতি হয় তখন দেখা যায় শহরের শতকরা ৮ থেকে ২২ ভাগ মানুষ মারা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অকল্যান্ডের এক অস্থায়ী হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে; Image Source: Underwood Archives/Getty Images

১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে স্প্যানিশ ফ্লু সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে মোট ১৩ সপ্তাহে পৃথিবী জুড়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রাণহানি ঘটায় এই ভাইরাস। শুধু অক্টোবর মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ লাখ মানুষ মারা যায়, যেখানে পুরো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মারা গিয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজারের কিছু বেশি।

এত বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। সেই সাথে কবর খননকারী ও সৎকার ব্যবসায়ীরাও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যান। ফলে অনেক মানুষকে একসাথে গণকবর দিতে বাধ্য হন তারা।

১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে স্প্যানিশ ফ্লু শেষবারের মতো আঘাত হানে। প্রথমভাগে এই ভাইরাসের গতি কম ছিল। তবে দ্বিতীয় ভাগে তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। এরপর শেষ ধাপে এসে ভাইরাসটির ক্ষিপ্রতা অনেকাংশে কমে যায়। কিন্তু এরপরও ১৯২০ সালের মার্চে বিদায় নেওয়ার আগে ব্রিটেনে ২ লাখ ৫০ হাজার, যুক্তরাষ্ট্রে ৬ লাখ ৭৫ হাজার, জাপানে ৪ লাখ এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ সামোয়ার এক-পঞ্চমাংশ লোক মৃত্যুবরণ করেন।
সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে

১৯১৮ সালে ইউরোপ ও আমেরিকায় স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী আকার ধারণ করে। তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ভারত। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রচুর সংখ্যক সেনা ব্রিটেনের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, যাদের মাধ্যমে পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী আকার ধারণ করে।

ব্রিটিশ ভারতে মানুষের স্যানিটেশন ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ পর্যায়ে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতাও বেশি ছিল না। স্প্যানিশ ফ্লু সবচেয়ে বেশি প্রাণহানী ঘটায় উপমহাদেশে। সংখ্যায় যা ছিল প্রায় ১৮ থেকে ২০ মিলিয়ন। অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল শুধুমাত্র এক ভাইরাসের আক্রমণে। একক দেশ হিসেবে যা ছিল সর্বোচ্চ। তবে সঠিক সংখ্যা কখনোই জানা যায়নি। সঠিক হিসাব করলে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনা; Image Source: The Print Collector

তবে বিশ্বব্যাপী স্প্যানিশ ফ্লুর ভয়াবহতা ছড়ানোর জন্য দায়ী হলো যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুদ্ধে অংশ নেওয়া দেশগুলো। ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিবায়োটিকের পূর্ববর্তী সময়ে রোগ ছড়ানো ছিল খুবই সাধারণ এক বিষয়। এর মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকা সত্য জানার পরেও গোপন রেখেছিল, যা এই ভাইরাসকে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছিল।

যুদ্ধের ময়দানে বুলেটের আঘাতে যত মানুষ প্রাণ দিয়েছেন তার চেয়ে বেশি নিরপরাধ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে যুদ্ধের ময়দানে সৃষ্ট এক ভাইরাসের কারণে। এ কারণেই আমাদের যুদ্ধের পথ পরিহার করা উচিত। যুদ্ধ শুধু একটি সভ্যতাকে ধ্বংস করে না। সেই সাথে কেড়ে নেয় কোটি মানুষের প্রাণ।

13
Musavvir Mahmud Seazon
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অক্সিজেনের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাবার। সেই প্রাচীনকাল থেকেই একমুঠো খাবারের আশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজ করে অসংখ্য মানুষ। তবে অর্থনীতি আর সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে খাবারের ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। আগে দরকারের বাইরে সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত খাবার কথা চিন্তাই করত না, অথচ আজকাল প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষই রেস্টুরেন্টে খাবার খায়। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি রেস্টুরেন্টের বদৌলতে নানা দেশের নানা স্বাদের খাবারও আজকাল খাবার সুযোগ মিলছে। কিন্তু এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে খাবার নষ্ট আর অপচয় হওয়া। অথচ বিশ্বে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খাবারের চাহিদা, প্রচুর খাবার নষ্ট হবার পরেও অভুক্ত থেকে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে প্রচুর খাবার; Image:  Shutterstock
খাদ্য নষ্ট ও অপচয়ের সংজ্ঞা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (FAO) হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত খাবারের এক-তৃতীয়াংশ খাবার নষ্ট কিংবা অপচয় হচ্ছে! খাদ্য অপচয় কিংবা খাদ্য নষ্ট হওয়ার সংজ্ঞা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বিভিন্নভাবে দিলেও পাঠকদের পড়ার সুবিধার্থে দুটি সহজ সংজ্ঞা এই লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে। খাবার নষ্ট বলতে বোঝানো হয় উৎপাদন থেকে গ্রাহকের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবহনের সমস্যা কিংবা সঠিকভাবে মজুদ না করার কারণে খাবার ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর আগেই নষ্ট হতে পারে। অন্যদিকে খাবারের অপচয় হচ্ছে যখন গ্রাহক বা ভোক্তার কারণে খাবার নষ্ট হয়। সম্পূর্ণ ভালো একটি খাবার শুধুমাত্র পছন্দমত রঙ বা আকারের না হওয়ায় অনেকে ফেলে দেন। আবার একসাথে অনেক খাবার কিনে খেতে না পারার ফলে অপচয় করেন অনেক গ্রাহক। আর রেস্টুরেন্টে কিংবা রান্না করা খাবার নষ্ট করা তো আজকাল খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে। 
খাদ্য নষ্ট ও অপচয় হয় যেভাবে

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে খাবার নষ্ট বা অপচয় বাসা-বাড়িতেই বেশি হয়। কিন্তু বাস্তবে খাবার ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকে নষ্ট হওয়া শুরু হয়। খাদ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত বেশ লম্বা একটি প্রক্রিয়া কাজ করে। আর সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয় এই পর্যায়েই। তবে যেসব দেশ প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে তাদের এই ক্ষেত্রে নষ্ট হবার পরিমাণ অন্যান্য দেশগুলোর থেকে কম স্বাভাবিকভাবেই।

খরা, বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচুর ফসল নষ্ট হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় পোকামাকড় কিংবা অণুজীবের আক্রমণে ফসলের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। অনুন্নত দেশে সঠিকভাবে ফসলের যত্ন নিতে না পারার কারণে উৎপাদন কম হতে পারে। পশুপাখির খামারেও বিভিন্ন সময় রোগ দেখা দেয়। ফলে খাদ্য নষ্ট হওয়া একেবারে খাদ্য উৎপাদনের প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু হয়। ফসল সঠিকভাবে উৎপাদন হলেও ভোক্তা পর্যন্ত যাবার জন্য স্বল্পস্থায়ী কিংবা দীর্ঘস্থায়ী মজুদ করতে হয়। সঠিক উপায়ে মজুদ না করার কারণেই প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। এরপরে রয়েছে পরিবহনের সময় খাবার নষ্ট হওয়া। রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে খাবার নষ্ট হয়, পরিবহনের জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুত না করায় গরমে বা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় কাঁচা ফল বা সবজি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মাছ-মাংস পরিবহন করা গাড়ির রেফ্রিজারেটর নষ্ট হয়ে মাছ-মাংস নষ্ট হতে পারে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হয় প্রচুর খাবার; Image: sapei.com

উৎপাদন পর্যায়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা পরিবহন দুর্ঘটনার কারণে নষ্ট হলেও ভোক্তাদের হাতেও খাবার কম অপচয় হয় না। উন্নত দেশে অনেকেই খাবারের রঙ বা আকার একটু অন্যরকম হলেই আর কিনে না! ফলে একটু বেখাপ্পা দেখতে সবজি বা ফলগুলো শেষপর্যন্ত ময়লার ঝুড়িতেই যায়। আবার অনেকে বাসায় অতিরিক্ত খাবার কিনে রেখে দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলো না খেয়ে ফেলে দেয়। দাওয়াত কিংবা রেস্টুরেন্টে অতিরিক্ত খাবার নিয়ে না খাওয়া তো আজকাল খুবই সাধারণ কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার প্যাকেটজাত খাবার কিনে মেয়াদ কতদিন আছে খেয়াল না করায় মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ফেলে দিতে হয়। আমাদের বাসা বাড়িতেই আমরা না খাওয়া যে খাবার ময়লার ঝুড়িতে ফেলি সেটি আমাদের দৃষ্টিতে অনেক কম মনে হলেও সামগ্রিকভাবে এভাবে প্রচুর পরিমাণে খাবার অপচয় করছি আমরা সবাই, প্রায় প্রতিদিনই!
Newsletter

Subscribe to our newsletter and stay updated.

খাদ্য উৎপাদন আর ভোক্তার মাঝামাঝি পর্যায়েও অনেক সময় খাবার নষ্ট হয়। হঠাৎ করে কোনো ফসলের দাম বেড়ে গেলে সেটি অনেক সময় বিক্রি কমে যায়। ফল বা সবজি যেহেতু পচনশীল, তাই এরকম পরিস্থিতিতে অনেক সময় খাবার নষ্ট হয়। আবার ফসলের দাম কমে গেলেও অনেক সময় কৃষকরা প্রতিবাদস্বরূপ ফসল নষ্ট করে। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় ফসলের দাম কমে গেলে কৃষকরা রাস্তায় ফসল ফেলে প্রতিবাদ করেন। আবার অনেক বড় বড় খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি তাদের কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে খুবই খুঁতখুঁতে হয়। এতে দেখা যায় তারা একজন কৃষকের উৎপাদিত সব ফসল না নিয়ে কিছু অংশ নেয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনগুলোতে প্রায়ই বলতে শোনা যায় "বিশেষভাবে বাছাইকৃত … দিয়ে তৈরি’'। এই বিশেষভাবে বাছাইয়ের পর বেঁচে যাওয়া ফসল বা ফলগুলোর বেশিরভাগই নষ্ট হয়। আর এভাবেই উৎপাদন পর্যায়ে বা ভোক্তার দ্বারা খাবার নষ্ট বা অপচয় না হয়েও খাবার নষ্ট হচ্ছে।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পকারখানায় নষ্ট হয় প্রচুর খাবার; Image: nutraingredients.com
খাবার অপচয়ের কিছু পরিসংখ্যান

খাবার অপচয় সবচেয়ে বেশি হয় উৎপাদন পর্যায়ে, সেটি পৃথিবীর সব অঞ্চলেই। তবে গ্রাহক পর্যায়ে অপচয় ধনী ও উন্নত দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি। FAO এর তথ্য অনুসারে, শিল্পোন্নত দেশগুলো অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ খাবার নষ্ট ও অপচয় করে। আর সব অঞ্চলেই নষ্ট খাবারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফল আর শাকসবজি। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, ধনী দেশগুলোতে প্রতিবছর যে পরিমাণ খাবার অপচয় হয় সাব-সাহারা অঞ্চলের মোট খাদ্য উৎপাদন প্রায় একই পরিমাণ! ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ধনী দেশগুলো যে পরিমাণ জনপ্রতি যে খাবার নষ্ট ও অপচয় হয় তা আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার জনপ্রতি খাবার নষ্টের প্রায় ১০ গুণ বেশি! সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে অর্থের সাথে সাথে খাবার নষ্ট ও অপচয়ের পরিমাণও বাড়তে থাকে। 
ধনী দেশগুলো খাদ্য অপচয়ে সবচেয়ে এগিয়ে; Image: FAO
খাদ্য অপচয় রোধে আমাদের করণীয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রোগ-জীবানুতে নষ্ট হওয়া কিংবা পরিবহনের সময় নষ্ট হওয়া খাবারের ব্যাপারে আমরা ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি কিছু করতে না পারলেও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের খাবারের অপচয় কিন্তু আমরা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

    শুরুটা বাজার করা দিয়েই করা যাক। অনেকেই বাজারে গেলেই একগাদা বাজার করে বাসায় ফেরেন, অথচ এত খাবার কেনার কিন্তু কোনো দরকারই ছিল না। এতে দেখা যায় সপ্তাহ শেষে কিছু খাবার ফ্রিজেই নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট হবার পথে। সুতরাং বাজার করার সময় অতিরিক্ত বাজার করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
    অনেক সময় বাজার পরিমিত পরিমাণে করলেও সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কোন খাবার কোথায়, কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয় এ ব্যাপারে জ্ঞান থাকাটাও জরুরি। যেমন- আলু, পেঁয়াজ খোলা জায়গায় রাখলে কিংবা শাক-সবজি ফ্রিজে বায়ুরোধক ব্যাগে রাখলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
    এরপর রয়েছে রান্না করা খাবার নষ্ট করা। আমরা কে কতটুকু খাবার খেতে পারি এ ব্যাপারে সবারই ধারণা আছে। কিন্তু তারপরেও ‘চোখের ক্ষুধা’ মেটানোর জন্য আমরা অতিরিক্ত খাবার প্লেটে নেই যার অনেকটাই শেষে নষ্ট হয়। এটি সবচেয়ে বেশি হয় বিয়ে বাড়ি কিংবা দাওয়াতে। অনেকে তো দাওয়াতে অন্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে খেতে বসেন। এতে খাবার যেমন অপচয় হয়, নিজের স্বাস্থ্যেরও কিন্তু ক্ষতি হয়। অতিরিক্ত এবং অকারণে খাবার কারণে আজকাল খুব অল্প বয়সেই অনেকের হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগ হচ্ছে। তাই খাবার সময় আমরা যতটুকু খেতে পারব ততটুকুই নেয়া উচিত। প্রথমেই অনেকগুলো না নিয়ে অল্প অল্প করে নিয়েও অনেক বেশি খাওয়া যায়- খেতে বসে এ কথাটি মাথায় রাখলেই খাবারের অপচয় অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।
    প্যাকেটজাত খাবার কেনার ক্ষেত্রেও সচেতন হওয়া উচিত। পাউরুটির মতো স্বল্পমেয়াদী খাবার কেনার সময় অবশ্যই মেয়াদ কতদিন বাকি আছে দেখে কেনা উচিত। সেই সাথে এই মেয়াদের ভেতরে খাবারটি পুরোটি শেষ করা সম্ভব হবে কি না সেটিও মাথায় রাখা উচিত। যদি এমন হয় যে মেয়াদ শেষ হলেও রান্না করে বা অন্য কোনো উপায়ে সংরক্ষণ করা যায় তাহলে সেই ব্যবস্থাও নেয়া উচিত।
    বিয়ে বা দাওয়াতের বেঁচে যাওয়া খাবার এতিমখানা বা পথশিশুদের দিয়ে দেয়া যায়। বর্তমানে বেশ কিছু সংগঠন আছে যারা এ রকম বেঁচে যাওয়া খাবার সংগ্রহ করে।
    নষ্ট হয়ে যাওয়া সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আজকাল অনেকেই বাসায় ফুল কিংবা সবজি চাষ করেন। কোনো খাবার ফেলে না দিয়ে সেটি দিয়ে কম্পোজিট সার বানিয়ে সহজেই গাছে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে খাবার নষ্ট হলেও অন্য কাজে ঠিকই লাগলো আবার গাছের যত্ন নেয়ার জন্য আলাদা খরচও করতে হলো না।
    খাবারের অপচয় রোধ এখন সময়ের দাবি; Image: nicolscales.com

খাবারের অপচয় বন্ধ করা জরুরি কেন

শুধুমাত্র গরীবেরা খাবার পাচ্ছে না তাই খাবার অপচয় বন্ধ করা বা কমানো দরকার এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। খাবার অপচয় শুধু খাবারের অপচয় না, একই সাথে অর্থ, শ্রম, শক্তির অপচয়। ফসল ফলানো থেকে খাবার কেনা পর্যন্ত প্রচুর মানুষ জড়িত। এতে তারা তাদের অর্থ দেন, শ্রম দেন। কিন্তু তাদের দেয়া অর্থ আর শ্রমের খাবার যদি নষ্ট হয় তাহলে সেই অর্থ আর শ্রমও নষ্টই হয় শেষ পর্যন্ত। ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ পরিবহন, ট্রাক্টর কিংবা ফসল পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ি জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে খাবার প্রক্রিয়াজাত কারখানা থেকে নিঃসরিত হচ্ছে বিভিন্ন গ্রীনহাউস গ্যাস। রান্না করা খাবার তৈরিতেও কিন্তু জ্বালানী ও পানির প্রয়োজন হয়। খাবার যদি নষ্টই হয় শেষ পর্যন্ত তাহলে একই সাথে প্রচুর জ্বালানী নষ্ট হচ্ছে আর সাথে বায়ুমন্ডলে যোগ হচ্ছে গ্রীনহাউস গ্যাস। আবার অন্যদিকে খাবার সাথে পানিরও অপচয় হচ্ছে। ফলে একদিকে খাবার যেমন নষ্ট হলো, পরিবেশেরও ক্ষতি হলো। খাবার নষ্ট না হলে অন্তত একদিক থেকে তো লাভ ছিল! সবদিক বিবেচনা করলে খাবার নষ্ট বা অপচয় হলে শুধু খাবারই নষ্ট হয় এমন না, বরং অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতিও যুক্ত হয়।
খাবারের অপচয় পরিবেশ দূষণের ভূমিকা রাখছে; Copyright: James P. Blair

পৃথিবীতে প্রচুর মানুষ খাবার না পেয়ে মারা যাচ্ছে, অথচ এরপরেও প্রতিদিন খাবার নষ্ট হচ্ছে। আবার সমন্বয়হীনতা, সদিচ্ছা, দুর্নীতির কারণে উৎপাদিত খাবারও সবার কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।উৎপাদন পর্যায়ের কথা বাদ দিলেও ভোক্তা পর্যায়ে যে পরিমাণ অপচয় হয় তা দিয়েও অনেক পরিবারের সারা বছরের খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু আমরা ব্যক্তিপর্যায়ে অন্তত নিজেদের সংশোধিত করতেই পারি। এতে হয়তো দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলের মানুষেরা সরাসরি খাবার পাবে না, কিন্তু নিজের লাভটাও কম হবে না। নিজের খাবার নষ্ট করা মানে নিজের কষ্টার্জিত টাকারই অপচয়। তাই খাবার অপচয় রোধে সবারই সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

14
Uchsash Tousif
বিস্মৃত এগারো জন বাঙালি বিজ্ঞানীকে নিয়ে অমর একুশে বইমেলা ২০১৯ এ প্রকাশিত হয় 'মেঘে ঢাকা তারা: বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া বাঙালি বিজ্ঞানী'। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত এই বইটি লিখেছেন অতনু চক্রবর্ত্তী।

বইটিতে যে এগারোজন বাঙালি বিজ্ঞানীর কথা উঠে এসেছে, তাদের প্রায় কারো নামই এখন আর সেভাবে শোনা যায় না। প্রতিবছর গুগল হয়তো এদের কারো কারো প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ডুডল করে, কিন্তু সেই মানুষটির কাজ, বা তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না বললেই চলে।
'মেঘে ঢাকা তারা' বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: Atonu Chakrabortty

দুঃখজনক হলেও সত্যি, তাদের না চিনলেও তাদের কাজের সঙ্গে আমরা পরিচিত। এর অনেকগুলো আমাদের চোখের সামনেই আছে, আবার কিছু কাজ থেকে আমরা প্রতিদিনের জীবনে প্রচুর সুবিধাও ভোগ করছি। শুধু কাজগুলোর সঙ্গে মানুষগুলোর নাম নেই দেখে আমরা তাদেরকে চিনতে পারি না। যে মানুষগুলো এদেশে বিজ্ঞান চর্চার ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন, আবিষ্কার করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত বেশ কিছু জিনিস, তাদের এভাবে আড়ালে পড়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ, তারা বাঙালি।

নির্মম এই সত্যটি আমাদের জন্য বড় লজ্জার। আশার কথা হলো, একেবারে ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যাওয়ার আগেই লেখক অতনু চক্রবর্ত্তী এই বিজ্ঞানীদের জীবন ও কাজ তুলে আনার চেষ্টা করেছেন দুই মলাটে। নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করে দিতে চেয়েছেন তাদের সাথে। বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

    মেঘে ঢাকা তারা একটি ভিন্ন ধরনের বই। আমরা যখন কোনো শিল্পী, সাহিত্যিক বা বিজ্ঞানীকে নিয়ে বই লিখি, সবসময়ই তখন বিখ্যাত কাউকে বেছে নেই। আমরা ধরেই নিয়েছি কারো জীবনী লিখতে হলে এমন কাউকে বেছে নিতে হবে যাকে সবাই এক নামে চেনে। অতনু চক্রবর্ত্তী কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কাজ করেছেন। তার বইটি লিখেছেন এগারোজন বাঙালি বিজ্ঞানী নিয়ে, যাদের সবাই বিস্মৃতপ্রায়। নূতন প্রজন্ম যদি এদের কাউকে চিনতে না পারে আমি একটুও অবাক হব না, কিন্তু তাঁদের কয়েকজন সম্পর্কে একটুখানি বলা হলেই তাঁরা বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে যাবে।
    Newsletter

    Subscribe to our newsletter and stay updated.

কারা এরা, যাদের সম্পর্কে জানলে অভিভূত হয়ে যেতে হবে? চলুন, দেখে নেওয়া যাক।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা বই 'আমার দেখা পোকা-মাকড়'; Image Source: munirhasan.com
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য

ভারতীয় উপমহাদেশে কীট আচরণ বিদ্যার পথিকৃৎ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। পিপড়ার লিঙ্গ নির্ধারণের পরীক্ষা এবং এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। ইংরেজিতে পেপার লিখেছেন ২২টি। এই ২০২০ সালে এসেও ২০টি পেপার লিখেছেন, এমন বাঙালি বিজ্ঞানী খুঁজে পাওয়াটা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না!
মধুসূদন গুপ্ত

ভারতীয় উপমহাদেশের গোঁড়ামি ভেঙে দেওয়ার কাজটি খুব ভালোভাবে করেছিলেন তিনি। প্রাচীন চিকিৎসাবিজ্ঞানী সুশ্রুতের পরে প্রথম ভারতীয় হিসেবে শবব্যবচ্ছেদ করেন তিনি। এর মাধ্যমে ভারতে সার্জারী করার প্রচলনও ঘটান মধুসূদন। প্রাচীনপন্থী হিন্দুরা প্রয়োজন হলেও অস্ত্রোপাচার করতে রাজি হতেন না। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের চিকিৎসা দিতেন মধুসূদন।

সতীদাহ প্রথা ভেঙে বিদ্যাসাগর যেমন ভারতীয় অনেক নারীর জীবন বাঁচিয়েছেন, তেমনি মধুসূদনও বাঁচিয়ে দিয়েছেন অনেক প্রাণ। তিনি না হলে কবে এসে ভারতে অস্ত্রোপচার বা সার্জারির প্রচলন হতো, আর কে-ইবা সেটা করতে রাজি হতেন, কে জানে!
রাধানাথ শিকদার; Image Source: Alok Bhatt
রাধানাথ শিকদার

বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গের নাম কী, বলুন তো? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, মাউন্ট এভারেস্ট। আপনি কি জানেন, এটি কে আবিষ্কার করেছিলেন? কে প্রথম এটি মেপে, হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন, এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতশৃঙ্গ? একজন বাঙালি। রাধানাথ শিকদার।

তাঁর ঊর্ধ্বতন ইংরেজ কর্মকর্তা কর্নেল ওয়া নিজের পুরনো প্রভু জেনারেল এভারেস্টকে খুশি করার জন্য হিমালয় পর্বতের শৃঙ্গ 'পিক ফিফটিন'-এর নাম দিয়ে দেন মাউন্ট এভারেস্ট। আসলে, এভারেস্ট কর্নেল ওয়াকে এই পদ পাইয়ে দিয়েছিলেন। সেই কৃতজ্ঞতাই জানালেন ওয়া। মাঝখান থেকে হারিয়ে গেলেন রাধানাথ শিকদার।

নেচারে মাউন্ট এভারেস্ট নিয়ে ১৯০৪ সালে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। সেই প্রবন্ধে জেরাল্ড বারার্ড লিখেছেন,

    ১৮৫২ নাগাদ কলকাতার দফতরে কর্মরত প্রধান গণক দেরাদুনে অবস্থানরত সার্ভেয়র জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়াকে জানালেন, 'আ পিক ডেজিগনেটেড 'XV' (ফিফটিন) হ্যাড বিন ফাউন্ড টু বি হায়ার দ্যান এনি আদার হিদারটু মেজারড ইন দ্য ওয়ার্ল্ড'।

হ্যাঁ, রাধানাথ শিকদারের কথা এখানে প্রধান গণক হিসেবে এসেছিল। কিন্তু তাঁর নাম আর আসেনি।

ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন জরিপের কাজও করেছেন রাধানাথ। হায়দ্রাবাদের বিদর থেকে মুসৌরির ব্যানোগ পর্যন্ত ৮৭০ মেইল দূরত্বের গ্রেট আর্কটিও তিনি জরিপ করেছিলেন। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এটাও তিনি করেছেন এভারেস্ট সাহেবের অধীনে। তাঁর এই দক্ষতা ছিবড়ে নেওয়ার জন্য এভারেস্ট এবং ওয়া রাধানাথ যেন আর কোথাও যেতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা করেছিলেন। বারবার তাঁর বদলির আবেদন পর্যন্ত নাকচ করে দিয়েছেন। এমনকি এভারেস্ট তো তাঁর বাবাকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ছেলেকে দেখতে চাইলে এখানে চলে আসুন। ছুটিতে গেলে ওর কাজে বাধা পড়বে।

এই কৃতি বাঙালিকে পৃথিবী মনে রাখেনি। আমরাও কি রেখেছি?
রাধাগোবিন্দ চন্দ্র

বাঙালি এই জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট ছিল না। অথচ সেই আমলে, ১৯২০ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে ৩৮ হাজার ভ্যারিয়েবল স্টার পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। ভ্যারিয়েবল স্টারের বাংলা করেছিলেন 'বহুরূপ তারা'। জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক পারিভাষিক শব্দের এত সহজ বাংলা তো আমাদের এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরাও করতে পারেন না!

তাঁর কাজের জন্য তিনি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ভ্যারিয়েবল স্টার অবজার্ভার থেকে সম্মান পেয়েছেন। ওরা তাঁকে সদস্যও করে নিয়েছিল। সম্মান পেয়েছেন ফ্রান্স সরকারের কাছ থেকেও। এমনকি ব্রিটেন অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনেরও সদস্য ছিলেন তিনি।

জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে এদেশে যারা বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের জন্য রাধাগোবিন্দ চন্দ্র অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন আজীবন।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র

তালিকার এই মানুষটি সম্ভবত অনেকের পরিচিত। তবে নামে চিনলেও তাঁর কাজের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না আমরা।

খুলনার মানুষ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র। শুধু গবেষকই না, সফল উদ্যোক্তাও ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকতেই দেশি-বিদেশি জার্নালে তাঁর লেখা ১০১টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে! ৮০০ টাকা মূলধনে গড়ে তুলেছিলেন বেঙ্গল ক্যামিকেলস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস। সেই উদ্যোগের বর্তমান মূল্য আট কোটি টাকার কাছাকাছি!

প্রফুল্লচন্দ্রের জীবন, গবেষণা ও সামাজিক কাজকর্ম দারুণভাবে উঠে এসেছে এই বইতে।
অসীমা চট্টোপাধ্যায়; Image Source: anandabazar.com
অসীমা চট্টোপাধ্যায়

নারী হওয়ায় সমাজের সাথে কী ভীষণ লড়াই করতে হয়, সেটা আজকের নারীরা ভালোভাবেই জানেন। আর, অসীমা ছিলেন বিশ শতকের মানুষ। কিন্তু সব বাধা ঠেলে নিজেকে টেনে নিয়ে গেছেন তিনি।

সে সময় রসায়ন বিভাগে স্নাতক শিক্ষার্থী ছিলেন মাত্র তিনজন। তার একজন ছিলেন তিনি। ছেলে-মেয়েরা একসাথে পড়ত, এই নিয়ে কম ঝামেলা সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। এর মধ্য দিয়েই অনার্স শেষ করেছেন, পেয়েছেন স্বর্ণপদক।

মাস্টার্স শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করেছেন আমৃত্যু। বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং এদের মধ্যকার রাসায়নিক নিয়ে চমৎকার সব কাজ আছে তাঁর। স্টেরয়ডাল এলকালয়েড নিয়েও কাজ করেছেন। পাশাপাশি, 'ভারতীয় বনৌষদি' নামে ছয় খণ্ডের ঢাউস গ্রন্থ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
অসীমা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে ডুডল; Image Source: anandabazar.com

বিজ্ঞানী সত্যেন বোস তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন,

    বিজ্ঞান কলেজে যখন সব ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন যে একটা ঘরে দেখবে আলো জ্বলছে, সেটা অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের ঘর।

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী

কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছিলেন উপেন্দ্রনাথ। তাঁর একার চেষ্টায় এই মহামারীকে পৃথিবীর বুক থেকে নির্মূল করা গিয়েছিল। তিনি যখন এন্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করেছেন, তখনও পেনিসিলিনও আবিষ্কার হয়নি!
মৃণাল কুমার দাশগুপ্ত

দেশে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলেন মৃণাল। এর আগে শিশির কুমার মিত্রের অধীনে কিছুদিন গবেষণা করেছিলেন। পরে তাঁর সুপারিশে 'জডরেল ব্যাংক এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন' নামে বিখ্যাত গবেষণাগারে অধ্যাপক লোভেলের অধীনে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। এখানে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছিলেন রোজার জেনিসন।

তাঁদের গবেষণার মধ্য দিয়েই প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়!
হাবিবুর রহমান

গণিতজ্ঞ ও পেশায় শিক্ষক হাবিবুর রহমান একাত্তরে হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন।

২৫শে মার্চের ভীষণ নির্মমতার পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনের বেশিরভাগটাই খালি হয়ে যায়। কিন্তু হাবিবুর রহমান নিজের বাসায় কালো পতাকা উত্তোলন করেন এবং সেখানেই অবস্থান করেন।

সেই কালে বাংলায় গণিত নিয়ে চমৎকার সব কাজ করেছিলেন তিনি। পঞ্চম-ষষ্ট শ্রেণী থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীর জন্যেও গণিত নিয়ে বই লিখে গেছেন। আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার পেছনেই তাঁর অবদান নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি হল আছে। কিন্তু সেখানকার কেউই তাঁকে গণিতজ্ঞ হিসেবে চেনেন না, চেনেন বুদ্ধিজীবী হিসেবে। এটা লেখক নিজেই সেখানে গিয়ে যাচাই করে দেখেছেন। একজন বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধির ব্যবহার, মানে তাঁর কাজের ব্যাপারে না জানলে যে তাঁকে জানা হয় না, সেটা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

শুধু সেই হলের শিক্ষার্থীরাই নয়, আমরা কয়জনই বা তাঁকে চিনি?
শম্ভুনাথ দে

কলেরা নিয়ে গ্রাম বাংলায় তখন ভীষণ ভয়। মহামারিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে গ্রামের পরে গ্রাম। কেউই আসলে সমস্যাটা শনাক্ত করতে পারছিল না, চিকিৎসা কীভাবে করবে? লোকে ততদিনে কলেরার নামও দিয়ে দিয়েছে। ওলাবিবি। একবার আসলেই হয়েছে, সব শেষ!

শম্ভুনাথ এই রোগ নিয়েই গবেষণা করেছেন। কারণ উদঘাটন করে দেখিয়েছেন, সমস্যাটা কী। মোটামুটি তাঁর একার চেষ্টাতেই ভারতীয় উপমহাদেশ ওলাবিবির হাত থেকে মুক্তির সুযোগ পেয়েছিল।
আব্দুস সাত্তার খান

আব্দুস সাত্তার খান নিজ দেশে কখনোই সেভাবে স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত সব দেশে তাঁকে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। স্বাভাবিক। যে মানুষ চল্লিশটির বেশি সংকর ধাতু তৈরি করেছেন, মার্কিন যুদ্ধবিমান এফ-১৫ ও এফ-১৬ এর ইঞ্জিনের সমস্যা মেটানোর জন্য উদ্ভাবন করেছেন নিকেলভিত্তিক সংকর ধাতু; তাঁকে শ্রদ্ধা না করে উপায় কী?

এই হলেন বইয়ের এগারোজন বিজ্ঞানী। বইতে তাঁদের প্রত্যেকের জীবন বিস্তৃত কলেবরে উঠে এসেছে।
পর্যালোচনা

'মেঘে ঢাকা তারা' আসলেই আড়ালে পড়ে যাওয়া নক্ষত্রদের নিয়ে কথা বলেছে। দুই মলাটে তুলে এনেছে তাঁদের জীবন ও কর্ম। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাঙালি বিজ্ঞানীদের পৌঁছে দেওয়ার এই প্রচেষ্টার জন্য লেখক অতনু চক্রবর্ত্তী অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন।

লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে এই বই নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। এই বিজ্ঞানীদের নিয়ে অন্তর্জালে কোথাও সেভাবে বিস্তারিত তথ্য নেই। সেজন্য যেখানেই তথ্যের খোঁজ পেয়েছেন, ছুটে গেছেন। নিজে যাচাই করে দেখেছেন সেসব তথ্য। কিন্তু নিজের রেফারেন্সে তো আর সরাসরি তথ্য দেওয়া যায় না। তাই কষ্ট করে বিভিন্ন ডকুমেন্ট ঘেঁটে বের করেছেন রেফারেন্স। সত্যি বলতে, এই বইটি নিজেই হয়তো অদূর ভবিষ্যতে রেফারেন্স হিসেবে গণ্য হবে।

বইটিতে বানান ভুল নেই বললেই চলে। ঐতিহ্য প্রকাশনী এ ব্যাপারে দারুণ যত্নশীল ছিল। তবে বইটির মেকআপ বা সাজানোর কাজটি আরো যত্ন করে করা যেত। অধ্যায়ের মাঝের কিছু পৃষ্ঠা ছবির বিন্যাসের জন্য এমনভাবে খালি রয়ে গেছে যে, চোখে লাগে।
টোকিয়োতে ডঃ রাধা বিনোদ পালের স্মারক ছবির সামনে লেখক অতনু চক্রবর্ত্তী;  Image Source: Atonu Chakrabortty
লেখক পরিচয়

অতনু চক্রবর্ত্তীর জন্ম নড়াইলে। বর্তমানে কোরিয়ার পুসান বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন। সেই সঙ্গে একই বিভাগে সহকারী গবেষক হিসেবে প্যান্ট মাইক্রোবায়োলজি গবেষণাগারে কাজ করে যাচ্ছেন।

বিজ্ঞান ভালোবাসেন ও এ নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে চান সবার মাঝে। তাই বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগে যে কয়দিন সুযোগ পেয়েছিলেন, কাজ করেছেন বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কমিটিতে।

এছাড়াও, বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করেন। সম্প্রতি জীববিজ্ঞান নিয়ে তাঁর লেখা 'জীববিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসা' বইটি প্রকাশিত হয়েছে। অমর একুশে বইমেলা ২০২০-এ 'মেঘে ঢাকা তারা'-এর দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশ পাবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

তাঁর হাত ধরে আধুনিক প্রজন্ম বাঙালি বিজ্ঞানীদের সাথে পরিচিত হবে, তাঁদেরকে হৃদয়ে লালন করবে, আগ্রহী হয়ে উঠবে গবেষণায়-এটুকু আশা বোধ হয় করা যায়।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে সংগ্রহ করে নিতে পারেন এই বইগুলো:

১) জীববিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসা
২) মেঘে ঢাকা তারা: বিস্মৃতির মেঘে ঢেকে যাওয়া বাঙালি বিজ্ঞানী

15
Iqbal Hossain Porosh
গত ২৯ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের একটি জনবহুল শহর উহানে মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে। প্রথমদিকে ব্যাপারটি তেমন গুরুত্ব না পেলেও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে করোনা মহামারি আকার ধারণ করে। বর্তমানে উহান ছাড়িয়ে চীনের সবগুলো প্রদেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করেছে সেখানকার স্বাস্থ্য বিভাগ।

কর্মব্যস্ত উহানে হঠাৎ করেই নেমে এসেছে নীরবতা। নাগরিক ছন্দপতন ঘটায় এক ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেখানে। মানুষের পাদচারণায় পরিপূর্ণ সব জায়গাও জনশূন্য, চলছে না কোনো গাড়ি, দোকানপাট বন্ধ করে সবাই ঘরে বসে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু একটার প্রহর গুনছে।

করোনা ছোঁয়াচে ভাইরাস হওয়ায় সহজেই একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীব্যাপী জরুরী অবস্থা জারি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভাইরাসের দৌরাত্ম্য কোটি মানুষের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে তারপর থামবে। করোনা ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক তৈরি না হওয়ায় আপাতত সতর্ক থাকা ছাড়া উপায় নেই।

২৯ বছর বয়সী গুও জিং সামাজিক আন্দোলনের একজন কর্মী। তিনিও অন্য সবার মতো বাড়তি সতর্কতার জন্য বাড়িতে অবস্থান করছেন। এমন নাজুক পরিস্থিতির চিত্র লিপিবদ্ধ করেছেন নিজের ডায়েরিতে। সে কথাগুলোই বিবিসির মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিতে চান তিনি। তার কথাগুলো হুবহু তুলে ধরছি এখানে।

বৃহস্পতিবার, ২৩শে জানুয়ারি: আপাত গৃহবন্দি!

আমি সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং তখনই প্রথম লক-ডাউন সম্পর্কে জানতে পারি। বুঝতে পারছিলাম না আমি কী করব; কারণ লক-ডাউন এর মানে বুঝতাম না আমি। এই পরিস্থিতি কতদিন ধরে চলবে এবং আমাকে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ; তার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
Newsletter

Subscribe to our newsletter and stay updated.

তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নজর রাখছিলাম, যাতে সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারি। সেখানে অনেকেই মন্তব্য করছে, “ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরও অনেকে জায়গার অভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। তাই তারা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।’’ আমার বন্ধুরা আমাকে পর্যাপ্ত মাস্ক মজুদ করার পরামর্শ দিল। এদিকে দোকানগুলোতে চাল এবং নুডলসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এই শহর আবার জেগে উঠবে কবে? Image Source: wallpapercraft.com

একজন লোক ইচ্ছেমত লবণ কিনে নিচ্ছিল! তা দেখে অন্যরা অবাক হয়ে এত লবণ কেনার কারণ জানতে চাইল। জবাবে লোকটি বলল, "যদি লকডাউন পুরো এক বছর ধরে চলে!’’

আমি একটি ফার্মেসিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে মাস্ক আর জীবাণুনাশকের মজুদ শেষ হয়ে গিয়েছে। ক্রমেই শহরে গাড়ি এবং পথচারীদের আনাগোনা কমে আসছিল। হঠাৎ করেই সেখানে রাজ্যের নীরবতা নেমে এলো। এই শহর আবার জেগে উঠবে কবে?

শুক্রবার, ২৪শে জানুয়ারি: সাদামাটা নববর্ষের প্রস্তুতি 

আমার কাছে মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী যেন থমকে আছে, এমন নীরবতা ভয়ের জন্ম দিচ্ছে মনের ভেতর। যেহেতু আমি একা থাকি তাই করিডোর ধরে যখন কেউ হেঁটে যায়, তখন মনে হয় পৃথিবীতে এখনও মানুষ আছে!

কীভাবে টিকে থাকব- সেটা ভাবার যথেষ্ট সময় রয়েছে, কিন্তু যথেষ্ট রসদ কিংবা আলাপচারিতা করার মতো মানুষ নেই।

আমাকে যেভাবেই হোক সুস্থ থাকতে হবে, সেজন্য দরকার নিয়মিত অনুশীলন। আর অনুশীলনের পর প্রয়োজন হবে খাবারের। তাই সবগুলো দিক বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে আমাকে।
আমাকে যেভাবেই হোক সুস্থ থাকতে হবে; Image Source: vox.com

সরকার চলমান অচলাবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানাচ্ছে না আমাদের। লোকজন বলাবলি করছে, এটি মে মাস পর্যন্ত স্থায়ী হবে।

আশপাশের ফার্মেসি এবং খাবারের দোকানগুলো বন্ধ রয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, হোম ডেলিভারি সার্ভিসগুলো এখনও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

আজ আমি বাজারে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে রসুনের অঙ্কুর আর ডিম কিনে এনেছি। বাজারে নুডলসের কোনো নতুন চালান আসেনি, তবে চালের যোগান রয়েছে এখনও। বাড়িতে ফিরেই ভালো করে গোসল সেরে নিয়েছি। আর কিছু ধরার পরই হাত পরিষ্কার করে নিচ্ছি। এই সময় ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

বাইরে বেরোতে পারার কারণেই মনে হচ্ছে পৃথিবীর সঙ্গে এখনো আমার যোগাযোগ বজায় রয়েছে। বৃদ্ধ আর প্রতিবন্ধীরা কীভাবে যে এমন পরস্থিতি সামাল দিচ্ছে কে জানে!

আজকের রাতটিই চীনা বর্ষপঞ্জির শেষ রাত। তাই বিশেষ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আয়েশ করার মতো অবস্থায় নেই। তাই প্রয়োজনের বেশি রান্না করিনি।

রাতে খাওয়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছিলাম। তাদের অনেকেই উহানের পার্শ্ববর্তী শহরে ছিল। বাড়িতে ফিরে আসতে ভয় পাচ্ছিল তারা, আবার কয়েকজন এত কিছুর পরও একসঙ্গে আড্ডা দিতে উদগ্রীব ছিল। আমরা প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে অনলাইনে মজা করেছি। তখন নিজেকে অনেক সুখী মনে হয়েছে।

কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার পর বিগত কয়েকদিনের ঘটনা মনে করে আর ঘুমাতে পারলাম না। অনেক অসহায় লাগছিল ভেতর থেকে; কান্না করে নিজেকে কিছুটা হালকা করতে চাইলাম। কষ্ট আর হতাশায় আমি মৃত্যুর কথাও ভেবেছিলাম কয়েকবার। কিন্তু নিজের কাছে আমার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আমার জীবনটা যথেষ্ট অর্থবহ, তাই আমি সময়ের আগেই মরতে চাই না।

শনিবার, ২৫শে জানুয়ারি: একাকী নববর্ষ পালন

আজ চীনা নববর্ষ। দিবস উদযাপনের ব্যাপারে আমার কখনোই তেমন আগ্রহ ছিল না। এবারের নববর্ষ তো আরও বেশি অর্থহীন।

সকালবেলা হাঁচির সঙ্গে কিছুটা রক্ত বেরিয়েছিল। আমি প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তবে ভাইরাসের উপসর্গগুলো প্রকাশ না পাওয়ায় সাহস পেলাম মনে। বাইরে বের হবো না ভেবেছিলাম, কিন্তু অবশেষে বেরিয়ে পড়লাম। আমার মুখে দুটো মাস্ক পরা ছিল, কারণ পণ্যগুলো নকলও হতে পারে। যার জন্য এই বাড়তি সতর্কতা। যদিও সবাই এটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। বাইরে গিয়ে তেমন মানুষজনের দেখা পেলাম না।

ফুলের দোকানগুলোর প্রবেশমুখে এমন কিছু ফুল সোভা পাচ্ছিল, যেগুলো কেবল শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে সাজানো হয়। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না তারা কেন এরকম সাজিয়েছে!
তরিতরকারি বিক্রির তাকগুলো একদম খালি ছিল; Image Source: creativebonito.com

সুপার শপে তরিতরকারি বিক্রির তাকগুলো একদম খালি ছিল, সেই সঙ্গে এবারও নুডলসের দেখা পেলাম না। ক্রেতাহীন অলস সময় পার করছিল দোকানীরা।

আমি চাইছিলাম প্রতিবার বাইরে বেরোনোর সময় বেশি করে জিনিসপত্র কিনে বাসায় ফিরতে। তাই আরও আড়াই কেজি চাল কিনলাম, যদিও বাসায় যথেষ্ট মজুদ ছিল। সেই সঙ্গে মিষ্টি আলু, মটরশুঁটি, সসেজ, লবণের প্রলেপ দেওয়া ডিম কিনে নিলাম। যদিও নোনতা ডিম খেতে আমার খুব একটা ভালো লাগ না। তাই ভাবলাম অচলাবস্থা কেটে গেলেই এগুলো বন্ধুদের দান করে দেব!

বাসায় ফিরে দেখলাম আমার ১ মাস চলার মতো খাবার মজুদ হয়ে গিয়েছে! এভাবে খাবারের স্তুপ জড়ো করার ব্যাপারটা পাগলামি মনে হচ্ছিল আমার কাছে। কিন্তু নিজেকেই বা কীভাবে দোষ দেই?

নদীর ধারে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম; দেখলাম অনেকগুলো জুটি সেখানে হাঁটছে। সঙ্গে তাদের পোষা কুকুরকে আনতেও ভোলেনি। আমি এই রাস্তায় তেমন একটা আসতাম না। তাই ভাবলাম আমার মতো তারাও চার দেয়ালে অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে চাইছিল না।

রবিবার, ২৬শে জানুয়ারি: নিজের অস্তিত্বের জানান দাও

আমি চলমান অচলাবস্থার প্রথমদিন থেকেই অনলাইন সেন্সরশিপের কারণে তেমন কিছুই লিখতে পারিনি। চীনে অনলাইনে অনেক আগে থেকেই কড়াকড়ি রয়েছে, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন মনে হচ্ছে আমার কিছুই বলার অধিকার নেই!

আপনার জীবন যখন ওলটপালট হয়ে যায়, তার প্রভাব দৈনন্দিন সব কাজের উপর পড়ে। আমি মোবাইলে অ্যাপ ব্যবহার করি ব্যায়াম করার জন্য। কিন্তু এখন কোনো কাজেই ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারি না।

আমি আজ আবার বাইরে গিয়েছি। যাত্রাপথে কতজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে সেটার হিসাব রেখেছি। বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে নুডলসের দোকান, যাত্রাপথে কেবল ৮ জনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে!
আমাকে আরও বেশি পরিমাণে মানুষের সঙ্গে দেখা দিতে হবে; Image Source: henri matisse\wikiart

উহানে এসেছি আজ ২ মাস হলো, তাই শহরটা ভালো করে না ঘুরেই বাড়ি ফিরতে চাইনি। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার মানুষজন এবং বেশিরভাগ স্থান আমার অচেনা।

আজ সর্বমোট ১০০ জনকে রাস্তায় বের হতে দেখেছি। আমাকে আরও বেশি পরিমাণে মানুষের সঙ্গে দেখা দিতে হবে, যাতে তারা আমার ব্যাপারে জানতে পারে। বন্ধুরা, আমি আশা করি ভবিষ্যতে আমরা আবার দেখা করতে পারব, যাতে নিজেদের গল্পগুলো একসঙ্গে বসে বলা যায়।

রাত ৮ টার দিকে হঠাৎ মানুষের সম্মিলিত চিৎকার শুনতে পেলাম ‘’গো উহান!’  নিজেদের জানালাগুলো খুলে দিয়ে তারা কথাটা বারবার বলছিল। এটা শহরের নাগরিকদের মাঝে আশা জাগানোর সংকেত। আমরা কেউ একা নই- এই অনুভূতি ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য।   

মঙ্গলবার, ২৮শে জানুয়ারি: অবশেষে আলোর দেখা পেলাম

আতঙ্কগ্রস্ত হলে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। সবার জন্য বাইরে বেরোলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটা ভালো একটা উদ্যোগ, কিন্তু কখনো কখনো এমন নিয়ম ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ করে দেয়।

বেশ কয়েকজনকে মাস্ক না পরার কারণে গণপরিবহন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি জানি না কেন তারা মাস্ক পরেনি! হয়তো তারা সামর্থ্যবান নয়, কিংবা তারা ভাইরাসটি নিয়ে কোনো ঘোষণা শুনতে পায়নি।
অনেকদিন পর নিজের মনমতো সূর্যের আলোর দেখা পেয়েছি; Image Source: nytimes.com

অনলাইন ভিডিওতে দেখেছি, যাযাবর গোছের লোকদের তাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ঘরগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে কিছু পরিবার ভবঘুরে কয়েকজন মানুষকে থাকার জায়গা করে দিয়েছেন।

সরকার চাইলেই প্রতিটি ঘরে মাস্কের যোগান দিতে পারত। এমনকি নাগরিকদের ঘরে অবস্থানের জন্য পুরস্কৃতও করা যায়।

আজ অনেকদিন পর নিজের মনমতো সূর্যের আলোর দেখা পেয়েছি। আমার কমপ্লেক্সের লোকজনদের দেখা পেলাম অবশেষে। কয়েকজন কমিউনিটি কর্মী এসেছেন কমপ্লেক্সের অনাবাসিক নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে।

শহর জুড়ে অচলাবস্থা চলার কারণে মানুষের বিশ্বাস আর মনোবল ভেঙে পড়েছিল প্রায়। উহান আজ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত; নিজের ভারই বহন করতে পারছে না যেন। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায়  নিজেকে সতর্ক থাকা ছাড়া বেশি কিছু করার নেই আমার।

প্রতিনিয়ত নিজেকে শহরের আরও গভীরে নিয়ে যেতে হবে। নইলে জীবনের কোনো অর্থ থাকবে না। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে আরও বেশি করে অংশগ্রহণ করা দরকার। প্রত্যেককেই সমাজের দায়িত্ব নিতে হবে জীবনকে অর্থবহ করে তোলার জন্য। আর এই নিঃসঙ্গ শহরে আমাকে আমার ভূমিকা খুঁজে নিতে হবে শীঘ্রই।

Pages: [1] 2 3 ... 11