Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - A-Rahman Dhaly

Pages: 1 ... 4 5 [6]
76
এই পাতার লেখাগুলি যখন তৈরি করছি তখন এক ভাইয়ের ফোন এল যে, একটি শিশুর জন্মের সময় তার মা ইন্তেকাল করেন। (আল্লাহ তাআলা তাঁর মাগফিরাত করুন এবং তাঁকে জান্নাত নসীব করুন এবং তাঁর সন্তানের উত্তম প্রতিপালনের ব্যবস্থা করে দিন। আমীন।) এখন তাকে দুধ পান করানোর মতো কেউ নেই। শুধু বড় বোন তাকে দুধ পান করাতে পারে কিন্তু এটা তো সম্ভবত জায়েয না? এখন তার জন্য কী করা যায়? আমি আরজ করলাম, শিশু তার বোনের দুধ পান করতে পারে না, তা আপনাকে কে বলেছে? তিনি বললেন, সবাই তো এমনই মনে করে। আমি আরজ করলাম, সবাই যদি এমন মনে করে থাকে তবে তা প্রচলিত ভুলের অন্তর্ভুক্ত। সঠিক বিষয় এই যে, দুধ পানের মেয়াদের ভিতরে শিশুকে যে কোনো মহিলার দুধ পান করানো যায়, তিনি শিশুর মাহরাম হোন অথবা গায়র মাহরাম। তবে এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ যে, শিশুর দুধ-মা হিসেবে দ্বীনদার মহিলা নির্বাচন করা আবশ্যক, ফাসিক-ফাজির নারীর দুধ পান না করানো উচিত। কেননা, শিশুর স্বভাব-চরিত্র তৈরির পিছনে দুধেরও ভূমিকা থাকে।
-মাসিক আলকাউসার_

77
একটি গ্রামের মহিলাদের প্রায় সকলকেই বলতে শোনা গেছে, ‘শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বানালে আরশের নিচে ছায়া পাওয়া যাবে।’ এটিকে রাসূলের হাদীস হিসেবেই বলা হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই।

এটি এমন একটি ভিত্তিহীন কথা যার জাল হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি জাল হাদীসের উপর লেখা কিতাবাদিতেও এর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।

কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, ওহুদ যুদ্ধে যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানদান মোবরক শহীদ হয়েছিল, তখন কিছুদিন কোনো প্রকার শক্ত খাবার খেতে পারতেন না। সেই ঘটনার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এই দিনে ঘটা করে হালুয়া রুটি খাওয়া হয়। কিন্তু ওহুদ যুদ্ধ তো শাবান মাসের ১৫ তারিখে হয়নি তা হয়েছে শাওয়ালের ৭ তারিখে। সুতরাং যদি সে কেন্দ্রিক কোনো বিষয় থাকত তাহলে তা শাওয়াল মাসের ৭ তারিখে থাকত শাবানের ১৫ তারিখে নয়।

শাবানের পনের তারিখের রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (এ রাতের ফযীলত বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন, আলকাউসারের সেপ্টেম্বর ২০০৫ সংখ্যায় ‘‘বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান শবে বরাত’’ শিরোনামে) হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫৬৬৫; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৮৩৩) কিন্তু এই রাতের সাথে হালুয়া-রুটির কী সম্পর্ক?

এ রাতের যতটুকু ফযীলত প্রমাণিত আছে শুধু ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। রসম-রেওয়াযের পিছে পড়ে এর মূল ফযীলত থেকে বঞ্চিত হওয়া ঠিক নয়।

আর আলোচ্য বিষয়টি মূলত এই রাতের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন রসমের অন্যতম, যার কোনো ভিত্তি নেই। এ ধরণের কাজ এবং এ রাত কেন্দ্রিক আরো যত রসম-রেওয়ায আছে এগুলে থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
আর এ ধরনের ভিত্তিহীন কথাকে রাসূলের হাদীস হিসেবে বলা অনেক মারাত্নক গুনাহের কাজ। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। দ্বীনের সকল বিষয়ে সহীহ কথা ও সহীহ কাজ করার তাওফিক দিন।------মাসিক আলকাউসার---------

78
মুহতারাম,

এশার সালাতের ওয়াক্ত শুরু হয় শাফাক অন্তর্হিত হলে। তো যাঁরা শাফাক অর্থ গ্রহণ করেছেন লালিমা তাঁদের মতে সূর্যাস্তের পর যখন সূর্যের লালিমা অন্তর্হিত হবে তখন থেকে এশার সালাতের ওয়াক্ত শুরু হবে। আর যাঁরা শাফাক অর্থ গ্রহণ করেছেন সাদা রেখা তাঁদের মতে লালিমার পরে দৃশ্য সাদা রেখাও যখন অন্তর্হিত হবে তখন এশার সালাতের ওয়াক্ত শুরু হবে। এই অনুচ্ছেদে আমাদের আলোচ্য লেখক এশার সালাতের ওয়াক্ত কখন শেষ হয় সেই আলোচনাকেই প্রাধান্য দান করেছেন। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হল, সকল মারফূ হাদীস এবং আছারে সাহাবাকে একত্রিত করলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত তিনভাগে বিভক্ত। এক: শাফাক অন্তর্হিত হওয়ার পর থেকে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। আর এই এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিলম্বিত করে আদায় করা সর্বোত্তম। দুই: এক তৃতীয়াংশ হতে মধ্যরাত পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত। তবে মধ্যরাত পর্যন্ত বিলম্বিত করে আদায় করা ফযীলতের দিক দিয়ে প্রথমটির তুলনায় নিম্ন পর্যায়ের। তিন: মধ্যরাতের পর থেকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। বিনা ওযরে এই সময়ে এশার সালাত আদায় করাটা মন্দকর্ম অথবা মাকরূহ। তবে এটি মন্দ হলেও এই সময়ে সালাত আদায় করলে তার সালাত ‘আদা’ হিসাবেই গণ্য হবে ‘কাযা’ হিসাবে নয়। কারণ, এশার সালাতের ওয়াক্ত অবশিষ্ট থাকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। এবার আসা যাক লেখকের লেখা ও তা নিয়ে পর্যালোচনার পর্বে।   

লেখক লিখেছেন, ‘এশার ছালাতের সময় সম্পর্কেও কিছু জাল ও যঈফ হাদীস প্রচলিত আছে।’ এরপর তিনি লিখেছেন, ‘আবু হুরায়াহ (রাঃ) বলেন, এশার ছালাতের শেষ সময় হল ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত। তাহক্বীক: যাকরিয়া বিন গোলাম কাদের এবং শায়খ আলবানী বলেন, এর কোন ভিত্তি নেই। ‘হেদায়া’র ভাষ্যকার আল্লামা ইবনুল হুমাম বলেন, ছালাতের ওয়াক্ত সংক্রান্ত হাদীছের মধ্যে কোথাও এটা পাওয়া যায় না। আল্লামা যায়লাঈ বলেন, গরীব বা ভিত্তিহীন। ইবনু হাজার আসক্বালানীও  অনুরূপ বলেছেন। কিন্তু ইমাম তাহাবী মাযহাবী মোহে এর পক্ষে মত দিয়েছেন যা কাম্য নয়।’

আমার বক্তব্য

লেখক বহু জায়গায় পাঠককে সতর্ক করেছেন এই বলে যে, তাঁরা আল্লাহর নিকট কী জবাব দেবেন যদি তাঁরা সহীহ হাদীস অনুযায়ী আমল না করেন? কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, আল্লাহর নিকট তিনি কী জবাব দেবেন যখন আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার কৈফিয়ত তলব করবেন। তা-ও আবার  শরীয়তের বিধি বিধান সম্পর্কিত বিষয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার কৈফিয়ত?

আবু হুরায়রা রা.-এর যে বক্তব্য লেখক এখানে উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ এশার সালাতের ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত থাকে- এটা না জাল, না ভিত্তিহীন আর না যঈফ। বরং বক্তব্যটি আবু হুরায়রা রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত। পাঠক সামনে এ আছারের একাধিক উদ্ধৃতি দেখতে পাবেন।

লেখক ‘তাহকীক’ শিরোনামে যতগুলো উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন, তার কোনোটিতেই এ কথা বলা হয়নি যে, আবু হুরায়রা রা.-এর উল্লিখিত বক্তব্যটি জাল, ভিত্তিহীন কিংবা  যঈফ। উদ্ধৃতিগুলোতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে যে, ‘এশার সালাতের ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত থাকে’ এ কথাটি সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস কি না? যাইলাঈ, ইবনে হাজার ও ইবনে হুমাম (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেছেন, এ কথাটি  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস হিসেবে আমরা পাইনি।

তাহলে মারফ‚ হাদীসটিকেও তারা জাল কিংবা ভিত্তিহীন বলেননি। তবে এটা ঠিক যে, গোলাম কাদের এটিকে ভিত্তিহীন বলে দাবী করেছেন। তিনি একজন সাধারণ আলেম, মুহাদ্দিস নন। তবে আবু হুরায়রা রা.-এর যে আছারটি লেখক উল্লেখ করেছেন, এই মুহাদ্দিসগণ এর উল্লেখই করেননি, ভিত্তিহীন বলা তো দূরের কথা। আর সহীহ বর্ণনাকে তারা কীভাবেই বা ভিত্তিহীন বলবেন?

তো লেখক আখেরাতে এ ভুল ব্যাখ্যার কী জবাব দেবেন?

এরপর লেখক ইমাম তাহাবী রহ. -এর ব্যাপারে যে অপবাদ আরোপ করেছেন, সে জন্য ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’র হাওয়ালা দিয়েছেন। অথচ ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ গ্রন্থের প্রণেতা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী রাহ. মিথ্যাবাদীও নন এবং বেয়াদবও নন যে, তিনি ইমাম তাহাবী সম্পর্কে লিখবেন যে, ইমাম তাহাবী মাযহাবী মোহে এর পক্ষে মত দিয়েছেন। ইমাম তাহাবী রাহ. দালীলিক ভিত্তিতেই বলেছেন যে, এশার সালাতের সময় সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। তাঁর উপস্থাপিত দলীল নিয়ে মুবারকপুরী সাহেব বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং ইমাম তাহাবীর সঙ্গে সহমত পোষণ না করে তিনি তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। ব্যস, এই পর্যন্তই।

‘মাযহাবী মোহে’ কথাটি দ্বারা প্রচ্ছন্নভাবে একটি দাবী করা হল যে, মাযহাবের ভিত্তি কুরআন ও হাদীস নয়, বরং মাযহাব হচ্ছে মাযহাবের ইমামগণের নিজস্ব মত। আর মাযহাব অবলম্বনকারীরা ইমামগণের ঐ নিজস্ব মতের অনুসারী। এটিই বর্তমানকালের লা মাযহাবীদের ধারণা। এটিকে ধারণা না বলে অপপ্রচার বলাই ভালো। কারণ, তারাও জানে যে, কুরআন ও হাদীস গবেষণা করে মুজতাহিদগণ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেটিকেই মাযহাব বলে। যেমন আমীন নিঃশব্দে বলা উত্তম, না সশব্দে বলা উত্তম- এই বিষয়টি নিয়ে যখন মুজতাহিদগণ হাদীসের ভাণ্ডার নিয়ে গবেষণা করেছেন তখন কারও কারও গবেষণা তাঁকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, আমীন নিঃশব্দে বলা উত্তম। তখন তিনি তদনুসারে আমল করেছেন। ফলে বলা হয়েছে যে, আমীন নিঃশব্দে বলা অমুকের মাযহাব। অর্থাৎ এটি তাঁর দালীলিক বিচার-বিশ্লেষণলব্ধ মত ও সিদ্ধান্ত। তাঁর মনগড়া সিদ্ধান্ত নয়।

মুহতারাম,

আপনি জানেন যে, ইজতিহাদ একটি সুকঠিন বিষয়। ইজতিহাদের জন্য প্রয়োজন হাদীস ও কুরআনসহ শরীয়ত সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় মুজতাহিদের সামনে স্পষ্ট থাকা। প্রয়োজন অগাধ পাণ্ডিত্য এবং সেই সঙ্গে আল্লাহ প্রদত্ত ফিক্হ ও অন্যান্য প্রতিভার সঙ্গে সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি। আর এই কারণেই বহু বিখ্যাত সব মুহাদ্দিস নিজেরা ইজতিহাদ করে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেয়ে ঐরূপ কোনো মুজতাহিদের ইজতিহাদের উপর নির্ভর করাকেই নিরাপদ মনে করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ, ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীনসহ বিখ্যাত ও প্রবাদপুরুষ মুহাদ্দিসগণও ইমাম আবূ হানীফার ইজতিহাদের উপর নির্ভর করেছেন এবং শাখা প্রশাখাগত মাসআলা মাসায়েলে তাঁরা তাঁর অবলম্বিত মত ও পথকে অবলম্বন করেছেন। তদ্রƒপ কেউ ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলের মত ও পথকে অবলম্বন করেছেন। কেউ ইমাম শাফিঈর মত ও পথকে, কেউ ইমাম মালেকের মত ও পথকে। (রাহিমাহুমুল্লাহ)। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার জায়গা এটা নয়।

আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে আসি। এশার সালাতের শেষ ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত থাকে, এ ব্যাপারে যদি শুধু আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহুর উল্লেখিত বাণীই থাকত এবং ত্বহাবী রহ. এর ভিত্তিতে এই মাযহাবকে প্রাধান্য দিতেন তারপরও আপত্তির কোন সুযোগ ছিল না। অথচ ত্বহাবী রাহ. তো আরো দলীল-প্রমাণ উল্লেখ করেছেন। এরপরও  তাঁর প্রতি এই অপবাদ! কেন এই মিথ্যাচার?!

লেখক এরপর লিখেছেন : মূলতঃ মধ্য রাত পর্যন্ত এশার ছালাতের সময় থাকে। ফজর পর্যন্ত নয়।

মধ্যরাত পর্যন্ত এশার ছালাতের সময় থাকে- এই কথাটির বরাত তিনি দিয়েছেন মুসলিম শরীফের ১৪১৯ নং হাদীসের। সে সম্পর্কে পরে আলোচনা করব। লেখক এরপর একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, যে হাদীসটিতে একই কথা বলা হয়েছে যে, এশার সালাত মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু লেখক হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন এবং ইমাম তিরমিযীর বরাতে ইমাম বুখারী রাহ.-এর মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। আসরের সালাতের ওয়াক্ত প্রসঙ্গে হাদীসটি নিয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করে এসের্ছি।  সেই আলোচনার সারসংক্ষেপ হল, ইমাম বুখারী রাহ.সহ একাধিক মুহাদ্দিসের বক্তব্য হল, হাদীসটিকে মারফূরূপে বর্ণনার ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইল ভুল করেছেন। প্রকৃতপক্ষে হাদীসটি মুজাহিদের মুরসাল বর্ণনা। মুজাহিদ বলেছেন যে, সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এই কথার চর্চা ছিল যে, প্রতিটি সালাতের একটি আউয়াল ওয়াক্ত আছে আর একটি আখের ওয়াক্ত আছে। এরপর তিনি প্রতিটি ওয়াক্তের আউয়াল ও আখের ওয়াক্তের বিবরণ দান করেছেন। আসরের সালাতের আলোচনায় আমি বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি যে, হাদীসটি মারফূ হিসাবে সহীহ না হলেও মুজাহিদের মুরসাল বর্ণনা হিসাবে তা সহীহ এবং দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য। আসরের ওয়াক্তের আলোচনাটি পুনরায় পাঠ করা যেতে পারে। লেখক শুধু এতটুকু জেনেছেন যে, মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইল হাদীসটি বর্ণনা করতে গিয়ে ভুল করেছেন। কিন্তু ভুলটা কী তা লেখক জানার চেষ্টা করেননি বা জানার চেষ্টা করেও জানতে পারেননি বা সূক্ষ্ম বিষয়টি বুঝতে তাঁর মেধা ব্যর্থ হয়েছে।

যা হোক, একটি কথা না বললেই নয়। সেটি হল, লেখকের দাবী হল, এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে। মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইলের হাদীসেও একই কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু লেখক এটিকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, হাদীসটি যঈফ। তদ্রƒপ মাগরিবের ওয়াক্ত সম্পর্কে লেখক যেই মত পোষণ করেন সেই মত সমর্থনকারী কিছু ভিত্তিহীন ও যঈফ হাদীসও তিনি উদ্ধৃত করেছেন। আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করাকে লেখক মুস্তাহাব বলে দাবি করছেন। আবার আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় মুস্তাহাব সম্পর্কে বেশ কিছু ভিত্তিহীন হাদীসও তিনি উল্লেখ করেছেন।  তাহলে তাঁর এই সব মত কি জাল হাদীস দ্বারা আক্রান্ত? ঐসব ভিত্তিহীন জাল ও যঈফ হাদীসের কারণে তাঁর সালাত কি জাল হাদীসের কবলে আবদ্ধ? লেখক নিশ্চয়ই বলবেন যে, না আমাদের সালাত জাল হাদীস দ্বারা আক্রান্ত নয়। আমাদের সালাত জাল হাদীসের কবলে পড়েনি। কারণ, আমাদের ঐসব মতের পক্ষে সহীহ হাদীস বিদ্যমান। তা-ই যদি হয়ে থাকে তাহলে লেখক এ দেশের মানুষের সালাতকে জাল হাদীসের কবলে আখ্যায়িত করলেন কেন? এ দেশের মানুষ যে পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে সেই পদ্ধতির পক্ষেও তো সহীহ হাদীস বিদ্যমান। তাঁদের সালাতের কোনো একটি বিষয়ও এমন নাই যার ভিত্তি শুধুই জাল হাদীস। লেখক এরূপ একটি মাসআলা উপস্থাপন করুন যে মাসআলার পক্ষে কোনো সহীহ দলীল নেই, শুধুই ভিত্তিহীন হাদীস রয়েছে।

এশার ছালাতের সঠিক সময়

এই শিরোনামে লেখক লিখেছেন, মাগরিবের ছালাতের সময়ের পর থেকে এশার ওয়াক্ত শুরু হয় এবং মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে। সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে। তবে রাসূল (ছাঃ) এশার ছালাত দেরী করে পড়াকে উত্তম মনে করতেন তাই মাগরিবের পরপরই এশার ছালাত পড়া উচিত নয়, যা এ দেশে চালু আছে।

এতে চারটি দাবী করা হয়েছে।

এক : এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে।

দুই : এশার সালাত সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে।

তিন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার সালাত দেরী করে পড়াকে উত্তম মনে করতেন।

চার : এ দেশে মাগরিবের পরপরই এশার সালাত পড়ার রীতি চালু আছে

মন্তব্য ও পর্যালোচনা

প্রথম ও দ্বিতীয় দাবীর মধ্যে স্ববিরোধিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে কথাটি দ্বারা বোঝা যায় যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত বহাল থাকে। মধ্যরাত পর্যন্ত নয়। লেখক যদি বলেন যে, যেহেতু মধ্যরাত পর্যন্ত এশার ওয়াক্ত থাকে ফজর পর্যন্ত নয় সেই কারণেই তো আমি ‘মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে’ কথাটির সঙ্গে ‘সমস্যাজনিত কারণে’ শর্তটি যুক্ত করিনি। ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে কথাটির সঙ্গে ঐ শর্তটি যুক্ত করেছি। কারণ, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত ওয়াক্ত থাকে না। লেখকের বিরুদ্ধে তখন প্রশ্ন দাঁড়াবে যে, তাহলে ‘সমস্যাজনিত কারণে পড়া যাবে’ কথাটিকে  ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করে দিলেন কেন? সমস্যাজনিত কারণে কেউ যদি ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যেও সালাত আদায় করতে না পারে তাহলে কি সে ফজরের ওয়াক্ত চলে আসলে আর এশার সালাত আদায় করতে পারবে না বা আদায় করবে না? সহীহ হাদীস তো এ কথা বলে যে, নিদ্রার কারণে বা ভুলে যাওয়ার কারণে কেউ যদি ওয়াক্তের মধ্যে সালাত আদায় করতে না পারে তাহলে যখন সে জাগ্রত হবে বা তার স্মরণ হবে তখনই সে সালাত আদায় করবে। ঐ হাদীস অনুযায়ী সমস্যাজনিত কারণে তো ফজরের পরেও এশার সালাত আদায় করতে পারবে এবং আদায় করবে। তাহলে ‘ফজরের পূর্ব পর্যন্ত’ শর্তটি কেন জুড়ে দিলেন? এ কথা কেন লিখলেন না যে, সমস্যাজনিত কারণে পরের দিন যোহর পর্যন্ত আদায় করা যাবে বা পরের দিন মাগরিবের পূর্ব পযন্ত আদায় করা যাবে বরং জীবনের যে কোনো দিন যে কোনো সময়ে আদায় করা যাবে? ‘সমস্যাজনিত কারণে’ কথাটির সঙ্গে  লেখকের বিশেষ এক প্রেম রয়েছে বলে অনুমিত হয়। কারণ, তিনি না বুঝেই ফজর এবং  আসরের ওয়াক্তের আলোচনাতেও এই একই কথা বলেছেন। ঐ দুই জায়গাতেও আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি এবং লেখকের ভ্রান্তি তুলে ধরেছি। আসলে ‘সমস্যাজনিত কারণে পড়া যাবে’ কথাটির মর্ম কী তা হয়তো লেখক জানেন না ও বোঝেনই না। অথবা তিনি জেনে শুনেও শুধু মাযহাবের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে এবং নিজ মতের পক্ষে হঠকারিতা ও গোঁড়ামিবশত স্পষ্টভাষায় স্বীকার করতে চান না যে, আসরের ওয়াক্ত সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকে এবং এশার ওয়াক্ত ফজরের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। কোনো ইমামের মাযহাব ও মতের পক্ষাবলম্বনে গোঁড়ামি নিন্দনীয় আর লেখকের নিজের মতের পক্ষাবলম্বনে তাঁর গোঁড়ামি প্রশংসনীয়? লেখক স্পষ্টভাষায় স্বীকার না করলেও প্রকারান্তরে কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আসরের ওয়াক্ত সূর্যাস্ত পর্যন্ত এবং এশার ওয়াক্ত ফজরের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। সুতরাং ফজরের পূর্ব পর্যন্ত এশার ওয়াক্ত থাকার পক্ষে দলীল কী তা নিয়ে আমার আর আলোচনার প্রয়োজন থাকে না। তবে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য একটু আলোচনা করা যেতে পারে।

দেখুন, লেখক মুসলিম শরীফের যে হাদীসের প্রেক্ষিতে দাবী করেছেন যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত নয় সেই হাদীসের তিনটি হাদীস পূর্বে ১৪১৬ নং হাদীসের  আলোচনায় মুসলিম শরীফের প্রখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা ইমাম নববী রাহ. হাদীসের فإنه وقت إلى نصف الليل  (তো এটা এশার ওয়াক্ত, মধ্যরাত পর্যন্ত)-এই অংশের ব্যাখ্যায় লিখেছেন,

معناه وقت لأدائها اختيارا أما وقت الجواز فيمتد إلى طلوع الفجر الثاني لحديث أبي قتادة الذي ذكره مسلم بعد هذا في باب من نسي صلاة أو نام عنها إنه ليس في النوم تفريط إنما التفريط على من لم يصل حتى يجيء وقت الصلاة الأخرى وسنوضح شرحه في موضعه إن شاء الله.

অর্থাৎ, এটা এশার পছন্দনীয় ওয়াক্ত। বাকী রইল বৈধ ওয়াক্ত। তো তা ফজর পর্যন্ত প্রলম্বিত। আবূ কাতাদাহ্র ঐ হাদীসের কারণে, ইমাম মুসলিম যেটাকে পরে উল্লেখ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সালাতের কথা ভুলে গেল বা সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে পড়ল’ এই অধ্যায়ে। হাদীসটি হল, নিদ্রায় কোনো ত্রুটি নাই। ত্রুটি হল, ঐ ব্যক্তির যে সালাত আদায় করল না অন্য আরেকটি সালাতের ওয়াক্ত আসা পর্যন্ত। যথাশীঘ্রই হাদীসটির মর্ম যথাস্থানে স্পষ্ট করব ইনশাআল্লাহ।

ইমাম নববী রাহ. বলতে চাচ্ছেন যে, এই হাদীসে যে মধ্যরাত পর্যন্ত এশার সালাতের কথা বলা হয়েছে তার দ্বারা এই কথা বোঝানো উদ্দেশ্য যে, মধ্যরাত পর্যন্ত ওয়াক্তটি এশার সালাতের জন্য পছন্দনীয় ওয়াক্ত। এই ওয়াক্তের মধ্যেই এশার সালাত আদায় করা উচিত। তবে বৈধ ওয়াক্ত আরও দীর্ঘ। আর তা সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। অতএব মধ্যরাতের পরে সালাত আদায় করলেও ব্যক্তির সালাত আদায় হয়ে গেছে বলা হবে। বলা হবে না যে, তার সালাত কাযা হয়ে গেছে। কারণ সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এশার সালাত আদায় করা বৈধ। তাঁর এই দাবীর পক্ষে দলীল হিসাবে তিনি আবূ কাতাদাহ রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেটি মুসলিম শরীফেই বিদ্যমান রয়েছে এবং সেই হাদীসটির পূর্ণ ব্যাখ্যা কী তা তিনি সেখানেই উল্লেখ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন। হাদীসটি মুসলিম শরীফের ১৫৯৪ নং হাদীস। যা উপমহাদেশীয় ছাপা কিতাবের ২৩৯ নং পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত হয়েছে। হাদীসটি এই:

ليس في النوم تفريط إنما التفريط على من لم يصل حتى يجيء وقت الصلاة الأخرى

‘নিদ্রায় কোনো ত্রুটি নেই। ত্রুটি ঐ ব্যক্তির যে আরেকটি সালাতের ওয়াক্ত আসার পূর্ব পর্যন্তও সালাত আদায় করেনি।’

এই হাদীসের আলোচনায় ইমাম নববী রাহ. বলেন,

فى الحديث دليل على إمتداد وقت كل صلاة من الخمس حتى يدخل وقت الأخرى وهذا مستمر على عمومه في الصلوات كلها إلا الصبح فإنها لاتمتد إلى الظهر بل يخرج وقتها بطلوع الشمس لمفهوم قوله صلى الله عليه وسلم من أدرك ركعة من الصبح قبل أن تطلع الشمس فقد أدرك الصبح وأما المغرب ففيه خلاف سبق بيانه فى بابه والصحيح المختار امتداد وقتها إلى دخول وقت العشاء للأحاديث الصحيحة السابقة في صحيح مسلم وقد ذكرنا الجواب عن حديث إمامة جبريل صلى الله عليه وسلم في اليومين في المغرب في وقت واحد.

وقال أبو سعيد الإصطخري من أصحابنا: تفوت العصر بمصير ظل الشيء مثليه وتفوت العشاء بذهاب ثلث الليل أو نصفه وتفوت الصبح بالإسفار وهذا القول ضعيف والصحيح المشهور ما قدمناه من الامتداد إلى دخول الصلوة الثانية.

অর্থ: ‘এই হাদীসে এই কথার পক্ষে দলীল রয়েছে যে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রতিটির ওয়াক্ত প্রলম্বিত হয় যতক্ষণ না অপর সালাতের ওয়াক্ত আসে। আর এটা তার ব্যাপকতার কারণে প্রতিটি সালাতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ফজর ব্যতীত। কেননা ফজরের ওয়াক্ত যোহর পর্যন্ত প্রলম্বিত হয় না। বরং ফজরের ওয়াক্ত সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়। আর এর কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উক্তি-‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজরের এক রাকআত পেল সে ফজর পেল।’ আর মাগরিবের ব্যাপারে মতভেদ আছে। মাগরিবের আলোচনায় মতভেদটির বিবরণ গত হয়েছে। সহীহ ও গ্রহণযোগ্য মত হল, মাগরিবের সালাতের ওয়াক্তও এশার ওয়াক্ত আসা পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়। আর তা ঐ সকল সহীহ হাদীসের কারণে, মুসলিম শরীফে যা পূর্বে বিবৃত হয়েছে। আর হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম কর্তৃক দুইদিন একই সময়ে মাগরিবের সালাত আদায় করণের কারণ কী, পূর্বেই আমি তার জবাব দিয়ে এসেছি। আমাদের একজন আলেম আবূ সাঈদ আল-ইসত্খরী বলেন, আসরের সালাত ফউত হয়ে যাবে বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হলে। এশার সালাত ফউত হয়ে যাবে রাতের এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক অতিক্রান্ত হলেই এবং ফজরের সালাত ফউত হয়ে যাবে পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে গেলেই। এই মতটি যইফ। সহীহ ও প্রসিদ্ধ মত তা-ই যা আমি বর্ণনা করে এসেছি। আর তা হল, এক সালাতের ওয়াক্ত প্রলম্বিত হয় অপর সালাতের ওয়াক্ত আসার পূর্ব পর্যন্ত।’

মুহতারাম,

আপনার সামনে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, সহীহ হাদীস আমাদেরকে জানান দেয় যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজরের পূর্ব পর্যন্ত বহাল থাকে। সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যাবে- এই কথা বলে লেখক প্রকারান্তরে তা স্বীকারও করে নিয়েছেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহর উপরিউক্ত বক্তব্যটি পাঠ করার পর আমার সামনে নতুন একটি বিষয় খোলাসা হয়েছে। আর তা হল, আমাদের আলোচ্য লেখক মূলত আবূ সাঈদ আল ইসতাখরীর এই যঈফ ও শায বা উম্মাহ-বিচিছন্ন মতটিকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আবূ সাঈদ আল ইসতাখরীর মতকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে সাহস পাননি উম্মাহ-বিচ্ছিন্ন মত হওয়ার কারণে। ফলে তিনি প্রতিটি জায়গাতেই আবার বলেছেন, তবে সমস্যাজনিত কারণে অমুক সময় পর্যন্ত আদায় করা যাবে। আর এরই ফলে তাঁর বক্তব্য হয়ে গেছে স্ববিরোধী।

ইমাম নববী রাহ. কর্তৃক পেশকৃত আবূ কাতাদাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু-এর হাদীস ছাড়াও হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু এবং হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর  উক্তি প্রমাণ করে যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর তথা সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত থাকে। ইব্ন আব্বাস রা.-এর আছর বা উক্তিটি বর্ণিত হয়েছে এই সনদে, এইভাবে:

حدثنا إسحاق عن عبد الرزاق عن معمر عن الثوري عن ليث عن طاووس عن ابن عباس قال: وقت المغرب إلى العشاء ووقت العشاء إلى الفجر.

ইব্ন আব্বাস রা. বলেন, মাগরিবের ওয়াক্ত এশা পর্যন্ত এবং এশার ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত।

এই একই সনদে ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. তাঁর ‘কিতাবুল হুজ্জাহ আ’লা আহলিল মাদীনাহ’ গ্রন্থে ইব্ন আব্বাস রা-এর উক্তিটি বর্ণনা করেছেন এইভাবে :

أخبرنا سفيان الثوري قال حدثنا ليث بن ابي سليم عن طاووس عن ابن عباس قال: وقت الظهر إلى العصر، ووقت العصر إلى المغرب، ووقت المغرب إلى العشاء، ووقت العشاء إلى الفجر.

অর্থ: ইব্ন আব্বাস রা. বলেন, যোহরের ওয়াক্ত আসর পর্যন্ত, আসরের ওয়াক্ত মাগরিব পর্যন্ত, মাগরিবের ওয়াক্ত এশা পর্যন্ত এবং এশার ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত।   

হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তিটি বর্ণিত হয়েছে এই সনদে এইভাবে:

حدثنا إسحاق عن عبد الرزاق عن الثوري عن عثمان بن موهب قال: سمعت أبا هريرة وسأله رجل عن التفريط في الصلاة، فقال: أن تؤخروها إلى وقت التي بعدها، فمن فعل ذلك فقد فرط.

অর্থ: উসমান ইব্ন মাওহিব বলেন, আবূ হুরায়রা রা.-কে এক ব্যক্তি সালাতে চরম ত্রুটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তাঁকে আমি বলতে শুনেছি, ‘চরম ত্রুটি হল, সালাতকে তার পরবর্তী সালাতের ওয়াক্ত আসা পর্যন্ত বিলম্বিত করা। যে ব্যক্তি এরূপ করল সে চরম ত্রুটি করল।

হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তিটি হযরত আবূ কাতাদাহ রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের মর্মকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। এছাড়া শরহু মা’আনিল আছারে (ত্বাহাবী শরীফে) আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তিটি আরও স্পষ্ট শব্দে ব্যক্ত করে যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত। ইমাম ত্বাহাবী বলেন,

حدثنا يونس قال ثنا عبد الله بن يوسف قال ثنا الليث ح وحدثنا ربيع المؤذن قال ثنا شعيب بن الليث قال ثنا الليث عن يزيد بن أبي حبيب عن عبيد بن جريج أنه قال لأبي هريرة: ما إفراط صلاة العشاء قال: طلوع الفجر.

অর্থাৎ ইব্ন জুরাইজ আবূ হুরায়রা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন, এশার সালাতে কোন কর্মটি চরম ত্রুটি? হযরত আবূ হুরায়রা রা. বললেন, ফজর উদিত হওয়া।

অর্থাৎ ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্তও যদি কেউ এশার সালাত আদায় না করে তাহলে তার এই কর্মটি চরম ত্রুটি হিসাবে পরিগণিত হবে। কারণ, তখন এশার সালাত কাযা হয়ে যাবে। বুঝা গেল যে, ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত এশার সালাতের ওয়াক্ত থাকে। এই বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, ওয়াক্তের বিষয়টি ‘মুদরাক বিল কিয়াস’ নয়; যুক্তি ও বুদ্ধি দ্বারা অবগত হওয়ার মত বিষয় এটি নয়। সুতরাং হযরত ইব্ন আব্বাস রা. ও হযরত আবূ হুরায়রা রা. বিষয়টি নিশ্চয়ই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই জেনেছেন। অতএব তাঁদের বক্তব্যটি মারফূয়ে হুকমী বা পরোক্ষ মারফূ হাদীস হিসাবে বিবেচিত হবে।

হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. তাঁর খেলাফতকালে হযরত আবূ মূসা আশআরী রা.-এর উদ্দেশে একটি পত্রে লিখেছিলেন। এক বর্ণনা অনুযায়ী এই পত্রের সংশ্লিষ্ট অংশের পাঠ নিম্নরূপ:

 وَصَلِّ الْعِشَاءَ أَيَّ اللَّيْلِ شِئْتَ وَلَاتُغْفِلْها 

‘এবং এশার সালাত আদায় করবে রাতের যে কোনো অংশে তুমি আদায় করতে চাও, তবে এশার সালাতকে তোমার অবহেলার শিকার বানাবে না।’

হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর أَيَّ اللَّيْلِ شِئْتَ  কথাটি স্পষ্টরূপেই ব্যক্ত করে সমস্ত রাত-ই এশার সালাতের ওয়াক্ত।

মুহতারাম,

সন্দেহ নেই যে, ফুকাহায়ে কেরামের অনেকেই বলেছেন যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু তাঁদের এই কথার অর্থ এই নয় যে, মধ্যরাতের পরে এশার ওয়াক্ত থাকে না। বরং তাঁরা বলতে চেয়েছেন যে, এশার সালাতের মাকরূহবিহীন বা দোষবিহীন ওয়াক্ত হল মধ্যরাত পর্যন্ত। বিনা ওযরে মধ্যরাতের পরে এশার সালাত আদায় করা মাকরূহ এবং গুরুতর অন্যায়। তবে বিনা ওযরে মধ্যরাতের পরে এশার সালাত আদায় করা অন্যায় হলেও তার সালাত ‘আদা’ হিসাবেই গণ্য হবে, ‘কাযা’ হিসাবে নয়। কারণ এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকে। আর এই কারণেই ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, কোনো ব্যক্তি যদি মধ্যরাতের পরে ইসলাম গ্রহণ করে বা কোনো বালক যদি মধ্যরাতের পরে বালেগ হয় বা কোন ঋতুবতী নারীর ঋতু যদি মধ্যরাতের পরে বন্ধ হয়ে যায় তবে তাদের উপর এশার সালাত আদায় করা ফরয হয়ে যাবে। যদি ফজর পর্যন্ত এশার সালাতের ওয়াক্ত বহাল না থাকত তাহলে এশার সালাত আদায় করা  এদের উপর ফরয হত না। ঠিক আমরাও তা-ই বলি। আমরা বলি যে, এশার সালাত আদায় করতে হবে মধ্যরাতের পূর্বেই। বিনা ওযরে মধ্যরাতের পর পর্যন্ত এশার সালাত বিলম্বিত করা মাকরূহ ও গুনাহের কারণ। কিন্তু কেউ যদি তা করে তবে বলব না যে, তার সালাত কাযা হয়ে গেছে। কারণ, এশার সালাতের ওয়াক্ত থাকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। জনাব মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবও বলেছেন যে, এশার সালাত সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে। আমরাও তা-ই বলি। তাহলে বিরোধ কোথায়?  হাঁ বিরোধ এতটুকু যে, তাঁর বক্তব্য ও  মতের মধ্যে রয়েছে স্ববিরোধিতা । আমাদের বক্তব্য ও মতের মধ্যে তা নেই, আছে সংগতি ও পরিপূর্ণ ভারসাম্য।

মুহতারাম,

এরপর দেখুন যে, তিনি লিখেছেন, তাই মাগরিবের পরপরই এশার সালাত পড়া উচিত নয় যা এ দেশে চালু আছে। এবার বলুন, লেখককে আপনি কী অভিধায় অভিহিত করবেন? বিকৃত মস্তিষ্ক, না দুগ্ধপোষ্য অবোধ শিশু? মাগরিবের পরপরই এ দেশের কোন্ মসজিদে এশার সালাত আদায় করা হয়? মাগরিবের পর এক ঘন্টা আঠারো মিনিট পরে সাধারণত শাফাক অদৃশ্য হয়। এরপর এ দেশে আযান দেওয়া হয় এবং আযানের আধা ঘন্টা পরে এশার সালাত আদায় করা হয়। আজ (২১ নভেম্বর) মাগরিবের আযান হবে পাঁচটা পনের মিনিটে এবং আযানের পরপরই মাগরিবের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। আর শাফাক অদৃশ্য হবে তথা এশার সালাতের ওয়াক্ত হবে ছয়টা একত্রিশ মিনিটে। কোনো কোনো মসজিদে সাতটায় আযান হবে এবং সাড়ে সাতটায় জামাত হবে; কোনো কোনো মসজিদে আরও পরে আযান হবে এবং জামাত হবে। এরই নাম কি মাগরিবের পরপর?

আজকে এ পর্যন্তই। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দুআ চাই। দুআ করি, আপনি ভালো থাকুন।

মাআসসালাম।

বিনীত আব্দুল গাফ্ফার, শহীদবাগ জামে মসজিদ।

২১ নভেম্বর, ২০১৪; ২৭ মুর্হারম, ১৪৩৬। -মাসিক আলকাউসার

79
মুহতারাম,

এশার সালাতের ওয়াক্ত শুরু হয় শাফাক অন্তর্হিত হলে। তো যাঁরা শাফাক অর্থ গ্রহণ করেছেন লালিমা তাঁদের মতে সূর্যাস্তের পর যখন সূর্যের লালিমা অন্তর্হিত হবে তখন থেকে এশার সালাতের ওয়াক্ত শুরু হবে। আর যাঁরা শাফাক অর্থ গ্রহণ করেছেন সাদা রেখা তাঁদের মতে লালিমার পরে দৃশ্য সাদা রেখাও যখন অন্তর্হিত হবে তখন এশার সালাতের ওয়াক্ত শুরু হবে। এই অনুচ্ছেদে আমাদের আলোচ্য লেখক এশার সালাতের ওয়াক্ত কখন শেষ হয় সেই আলোচনাকেই প্রাধান্য দান করেছেন। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হল, সকল মারফূ হাদীস এবং আছারে সাহাবাকে একত্রিত করলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত তিনভাগে বিভক্ত। এক: শাফাক অন্তর্হিত হওয়ার পর থেকে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। আর এই এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিলম্বিত করে আদায় করা সর্বোত্তম। দুই: এক তৃতীয়াংশ হতে মধ্যরাত পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত। তবে মধ্যরাত পর্যন্ত বিলম্বিত করে আদায় করা ফযীলতের দিক দিয়ে প্রথমটির তুলনায় নিম্ন পর্যায়ের। তিন: মধ্যরাতের পর থেকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। বিনা ওযরে এই সময়ে এশার সালাত আদায় করাটা মন্দকর্ম অথবা মাকরূহ। তবে এটি মন্দ হলেও এই সময়ে সালাত আদায় করলে তার সালাত ‘আদা’ হিসাবেই গণ্য হবে ‘কাযা’ হিসাবে নয়। কারণ, এশার সালাতের ওয়াক্ত অবশিষ্ট থাকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। এবার আসা যাক লেখকের লেখা ও তা নিয়ে পর্যালোচনার পর্বে।   

লেখক লিখেছেন, ‘এশার ছালাতের সময় সম্পর্কেও কিছু জাল ও যঈফ হাদীস প্রচলিত আছে।’ এরপর তিনি লিখেছেন, ‘আবু হুরায়াহ (রাঃ) বলেন, এশার ছালাতের শেষ সময় হল ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত। তাহক্বীক: যাকরিয়া বিন গোলাম কাদের এবং শায়খ আলবানী বলেন, এর কোন ভিত্তি নেই। ‘হেদায়া’র ভাষ্যকার আল্লামা ইবনুল হুমাম বলেন, ছালাতের ওয়াক্ত সংক্রান্ত হাদীছের মধ্যে কোথাও এটা পাওয়া যায় না। আল্লামা যায়লাঈ বলেন, গরীব বা ভিত্তিহীন। ইবনু হাজার আসক্বালানীও  অনুরূপ বলেছেন। কিন্তু ইমাম তাহাবী মাযহাবী মোহে এর পক্ষে মত দিয়েছেন যা কাম্য নয়।’

আমার বক্তব্য

লেখক বহু জায়গায় পাঠককে সতর্ক করেছেন এই বলে যে, তাঁরা আল্লাহর নিকট কী জবাব দেবেন যদি তাঁরা সহীহ হাদীস অনুযায়ী আমল না করেন? কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, আল্লাহর নিকট তিনি কী জবাব দেবেন যখন আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার কৈফিয়ত তলব করবেন। তা-ও আবার  শরীয়তের বিধি বিধান সম্পর্কিত বিষয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার কৈফিয়ত?

আবু হুরায়রা রা.-এর যে বক্তব্য লেখক এখানে উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ এশার সালাতের ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত থাকে- এটা না জাল, না ভিত্তিহীন আর না যঈফ। বরং বক্তব্যটি আবু হুরায়রা রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত। পাঠক সামনে এ আছারের একাধিক উদ্ধৃতি দেখতে পাবেন।

লেখক ‘তাহকীক’ শিরোনামে যতগুলো উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন, তার কোনোটিতেই এ কথা বলা হয়নি যে, আবু হুরায়রা রা.-এর উল্লিখিত বক্তব্যটি জাল, ভিত্তিহীন কিংবা  যঈফ। উদ্ধৃতিগুলোতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে যে, ‘এশার সালাতের ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত থাকে’ এ কথাটি সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস কি না? যাইলাঈ, ইবনে হাজার ও ইবনে হুমাম (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেছেন, এ কথাটি  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস হিসেবে আমরা পাইনি।

তাহলে মারফ‚ হাদীসটিকেও তারা জাল কিংবা ভিত্তিহীন বলেননি। তবে এটা ঠিক যে, গোলাম কাদের এটিকে ভিত্তিহীন বলে দাবী করেছেন। তিনি একজন সাধারণ আলেম, মুহাদ্দিস নন। তবে আবু হুরায়রা রা.-এর যে আছারটি লেখক উল্লেখ করেছেন, এই মুহাদ্দিসগণ এর উল্লেখই করেননি, ভিত্তিহীন বলা তো দূরের কথা। আর সহীহ বর্ণনাকে তারা কীভাবেই বা ভিত্তিহীন বলবেন?

তো লেখক আখেরাতে এ ভুল ব্যাখ্যার কী জবাব দেবেন?

এরপর লেখক ইমাম তাহাবী রহ. -এর ব্যাপারে যে অপবাদ আরোপ করেছেন, সে জন্য ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’র হাওয়ালা দিয়েছেন। অথচ ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ গ্রন্থের প্রণেতা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী রাহ. মিথ্যাবাদীও নন এবং বেয়াদবও নন যে, তিনি ইমাম তাহাবী সম্পর্কে লিখবেন যে, ইমাম তাহাবী মাযহাবী মোহে এর পক্ষে মত দিয়েছেন। ইমাম তাহাবী রাহ. দালীলিক ভিত্তিতেই বলেছেন যে, এশার সালাতের সময় সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। তাঁর উপস্থাপিত দলীল নিয়ে মুবারকপুরী সাহেব বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং ইমাম তাহাবীর সঙ্গে সহমত পোষণ না করে তিনি তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। ব্যস, এই পর্যন্তই।

‘মাযহাবী মোহে’ কথাটি দ্বারা প্রচ্ছন্নভাবে একটি দাবী করা হল যে, মাযহাবের ভিত্তি কুরআন ও হাদীস নয়, বরং মাযহাব হচ্ছে মাযহাবের ইমামগণের নিজস্ব মত। আর মাযহাব অবলম্বনকারীরা ইমামগণের ঐ নিজস্ব মতের অনুসারী। এটিই বর্তমানকালের লা মাযহাবীদের ধারণা। এটিকে ধারণা না বলে অপপ্রচার বলাই ভালো। কারণ, তারাও জানে যে, কুরআন ও হাদীস গবেষণা করে মুজতাহিদগণ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেটিকেই মাযহাব বলে। যেমন আমীন নিঃশব্দে বলা উত্তম, না সশব্দে বলা উত্তম- এই বিষয়টি নিয়ে যখন মুজতাহিদগণ হাদীসের ভাণ্ডার নিয়ে গবেষণা করেছেন তখন কারও কারও গবেষণা তাঁকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, আমীন নিঃশব্দে বলা উত্তম। তখন তিনি তদনুসারে আমল করেছেন। ফলে বলা হয়েছে যে, আমীন নিঃশব্দে বলা অমুকের মাযহাব। অর্থাৎ এটি তাঁর দালীলিক বিচার-বিশ্লেষণলব্ধ মত ও সিদ্ধান্ত। তাঁর মনগড়া সিদ্ধান্ত নয়।

মুহতারাম,

আপনি জানেন যে, ইজতিহাদ একটি সুকঠিন বিষয়। ইজতিহাদের জন্য প্রয়োজন হাদীস ও কুরআনসহ শরীয়ত সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় মুজতাহিদের সামনে স্পষ্ট থাকা। প্রয়োজন অগাধ পাণ্ডিত্য এবং সেই সঙ্গে আল্লাহ প্রদত্ত ফিক্হ ও অন্যান্য প্রতিভার সঙ্গে সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি। আর এই কারণেই বহু বিখ্যাত সব মুহাদ্দিস নিজেরা ইজতিহাদ করে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেয়ে ঐরূপ কোনো মুজতাহিদের ইজতিহাদের উপর নির্ভর করাকেই নিরাপদ মনে করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ, ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীনসহ বিখ্যাত ও প্রবাদপুরুষ মুহাদ্দিসগণও ইমাম আবূ হানীফার ইজতিহাদের উপর নির্ভর করেছেন এবং শাখা প্রশাখাগত মাসআলা মাসায়েলে তাঁরা তাঁর অবলম্বিত মত ও পথকে অবলম্বন করেছেন। তদ্রƒপ কেউ ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলের মত ও পথকে অবলম্বন করেছেন। কেউ ইমাম শাফিঈর মত ও পথকে, কেউ ইমাম মালেকের মত ও পথকে। (রাহিমাহুমুল্লাহ)। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার জায়গা এটা নয়।

আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে আসি। এশার সালাতের শেষ ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত থাকে, এ ব্যাপারে যদি শুধু আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহুর উল্লেখিত বাণীই থাকত এবং ত্বহাবী রহ. এর ভিত্তিতে এই মাযহাবকে প্রাধান্য দিতেন তারপরও আপত্তির কোন সুযোগ ছিল না। অথচ ত্বহাবী রাহ. তো আরো দলীল-প্রমাণ উল্লেখ করেছেন। এরপরও  তাঁর প্রতি এই অপবাদ! কেন এই মিথ্যাচার?!

লেখক এরপর লিখেছেন : মূলতঃ মধ্য রাত পর্যন্ত এশার ছালাতের সময় থাকে। ফজর পর্যন্ত নয়।

মধ্যরাত পর্যন্ত এশার ছালাতের সময় থাকে- এই কথাটির বরাত তিনি দিয়েছেন মুসলিম শরীফের ১৪১৯ নং হাদীসের। সে সম্পর্কে পরে আলোচনা করব। লেখক এরপর একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, যে হাদীসটিতে একই কথা বলা হয়েছে যে, এশার সালাত মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু লেখক হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন এবং ইমাম তিরমিযীর বরাতে ইমাম বুখারী রাহ.-এর মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। আসরের সালাতের ওয়াক্ত প্রসঙ্গে হাদীসটি নিয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করে এসের্ছি।  সেই আলোচনার সারসংক্ষেপ হল, ইমাম বুখারী রাহ.সহ একাধিক মুহাদ্দিসের বক্তব্য হল, হাদীসটিকে মারফূরূপে বর্ণনার ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইল ভুল করেছেন। প্রকৃতপক্ষে হাদীসটি মুজাহিদের মুরসাল বর্ণনা। মুজাহিদ বলেছেন যে, সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এই কথার চর্চা ছিল যে, প্রতিটি সালাতের একটি আউয়াল ওয়াক্ত আছে আর একটি আখের ওয়াক্ত আছে। এরপর তিনি প্রতিটি ওয়াক্তের আউয়াল ও আখের ওয়াক্তের বিবরণ দান করেছেন। আসরের সালাতের আলোচনায় আমি বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি যে, হাদীসটি মারফূ হিসাবে সহীহ না হলেও মুজাহিদের মুরসাল বর্ণনা হিসাবে তা সহীহ এবং দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য। আসরের ওয়াক্তের আলোচনাটি পুনরায় পাঠ করা যেতে পারে। লেখক শুধু এতটুকু জেনেছেন যে, মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইল হাদীসটি বর্ণনা করতে গিয়ে ভুল করেছেন। কিন্তু ভুলটা কী তা লেখক জানার চেষ্টা করেননি বা জানার চেষ্টা করেও জানতে পারেননি বা সূক্ষ্ম বিষয়টি বুঝতে তাঁর মেধা ব্যর্থ হয়েছে।

যা হোক, একটি কথা না বললেই নয়। সেটি হল, লেখকের দাবী হল, এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে। মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইলের হাদীসেও একই কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু লেখক এটিকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, হাদীসটি যঈফ। তদ্রƒপ মাগরিবের ওয়াক্ত সম্পর্কে লেখক যেই মত পোষণ করেন সেই মত সমর্থনকারী কিছু ভিত্তিহীন ও যঈফ হাদীসও তিনি উদ্ধৃত করেছেন। আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করাকে লেখক মুস্তাহাব বলে দাবি করছেন। আবার আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় মুস্তাহাব সম্পর্কে বেশ কিছু ভিত্তিহীন হাদীসও তিনি উল্লেখ করেছেন।  তাহলে তাঁর এই সব মত কি জাল হাদীস দ্বারা আক্রান্ত? ঐসব ভিত্তিহীন জাল ও যঈফ হাদীসের কারণে তাঁর সালাত কি জাল হাদীসের কবলে আবদ্ধ? লেখক নিশ্চয়ই বলবেন যে, না আমাদের সালাত জাল হাদীস দ্বারা আক্রান্ত নয়। আমাদের সালাত জাল হাদীসের কবলে পড়েনি। কারণ, আমাদের ঐসব মতের পক্ষে সহীহ হাদীস বিদ্যমান। তা-ই যদি হয়ে থাকে তাহলে লেখক এ দেশের মানুষের সালাতকে জাল হাদীসের কবলে আখ্যায়িত করলেন কেন? এ দেশের মানুষ যে পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে সেই পদ্ধতির পক্ষেও তো সহীহ হাদীস বিদ্যমান। তাঁদের সালাতের কোনো একটি বিষয়ও এমন নাই যার ভিত্তি শুধুই জাল হাদীস। লেখক এরূপ একটি মাসআলা উপস্থাপন করুন যে মাসআলার পক্ষে কোনো সহীহ দলীল নেই, শুধুই ভিত্তিহীন হাদীস রয়েছে।

এশার ছালাতের সঠিক সময়

এই শিরোনামে লেখক লিখেছেন, মাগরিবের ছালাতের সময়ের পর থেকে এশার ওয়াক্ত শুরু হয় এবং মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে। সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে। তবে রাসূল (ছাঃ) এশার ছালাত দেরী করে পড়াকে উত্তম মনে করতেন তাই মাগরিবের পরপরই এশার ছালাত পড়া উচিত নয়, যা এ দেশে চালু আছে।

এতে চারটি দাবী করা হয়েছে।

এক : এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে।

দুই : এশার সালাত সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে।

তিন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার সালাত দেরী করে পড়াকে উত্তম মনে করতেন।

চার : এ দেশে মাগরিবের পরপরই এশার সালাত পড়ার রীতি চালু আছে

মন্তব্য ও পর্যালোচনা

প্রথম ও দ্বিতীয় দাবীর মধ্যে স্ববিরোধিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে কথাটি দ্বারা বোঝা যায় যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত বহাল থাকে। মধ্যরাত পর্যন্ত নয়। লেখক যদি বলেন যে, যেহেতু মধ্যরাত পর্যন্ত এশার ওয়াক্ত থাকে ফজর পর্যন্ত নয় সেই কারণেই তো আমি ‘মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে’ কথাটির সঙ্গে ‘সমস্যাজনিত কারণে’ শর্তটি যুক্ত করিনি। ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে কথাটির সঙ্গে ঐ শর্তটি যুক্ত করেছি। কারণ, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত ওয়াক্ত থাকে না। লেখকের বিরুদ্ধে তখন প্রশ্ন দাঁড়াবে যে, তাহলে ‘সমস্যাজনিত কারণে পড়া যাবে’ কথাটিকে  ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করে দিলেন কেন? সমস্যাজনিত কারণে কেউ যদি ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যেও সালাত আদায় করতে না পারে তাহলে কি সে ফজরের ওয়াক্ত চলে আসলে আর এশার সালাত আদায় করতে পারবে না বা আদায় করবে না? সহীহ হাদীস তো এ কথা বলে যে, নিদ্রার কারণে বা ভুলে যাওয়ার কারণে কেউ যদি ওয়াক্তের মধ্যে সালাত আদায় করতে না পারে তাহলে যখন সে জাগ্রত হবে বা তার স্মরণ হবে তখনই সে সালাত আদায় করবে। ঐ হাদীস অনুযায়ী সমস্যাজনিত কারণে তো ফজরের পরেও এশার সালাত আদায় করতে পারবে এবং আদায় করবে। তাহলে ‘ফজরের পূর্ব পর্যন্ত’ শর্তটি কেন জুড়ে দিলেন? এ কথা কেন লিখলেন না যে, সমস্যাজনিত কারণে পরের দিন যোহর পর্যন্ত আদায় করা যাবে বা পরের দিন মাগরিবের পূর্ব পযন্ত আদায় করা যাবে বরং জীবনের যে কোনো দিন যে কোনো সময়ে আদায় করা যাবে? ‘সমস্যাজনিত কারণে’ কথাটির সঙ্গে  লেখকের বিশেষ এক প্রেম রয়েছে বলে অনুমিত হয়। কারণ, তিনি না বুঝেই ফজর এবং  আসরের ওয়াক্তের আলোচনাতেও এই একই কথা বলেছেন। ঐ দুই জায়গাতেও আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি এবং লেখকের ভ্রান্তি তুলে ধরেছি। আসলে ‘সমস্যাজনিত কারণে পড়া যাবে’ কথাটির মর্ম কী তা হয়তো লেখক জানেন না ও বোঝেনই না। অথবা তিনি জেনে শুনেও শুধু মাযহাবের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে এবং নিজ মতের পক্ষে হঠকারিতা ও গোঁড়ামিবশত স্পষ্টভাষায় স্বীকার করতে চান না যে, আসরের ওয়াক্ত সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকে এবং এশার ওয়াক্ত ফজরের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। কোনো ইমামের মাযহাব ও মতের পক্ষাবলম্বনে গোঁড়ামি নিন্দনীয় আর লেখকের নিজের মতের পক্ষাবলম্বনে তাঁর গোঁড়ামি প্রশংসনীয়? লেখক স্পষ্টভাষায় স্বীকার না করলেও প্রকারান্তরে কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আসরের ওয়াক্ত সূর্যাস্ত পর্যন্ত এবং এশার ওয়াক্ত ফজরের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। সুতরাং ফজরের পূর্ব পর্যন্ত এশার ওয়াক্ত থাকার পক্ষে দলীল কী তা নিয়ে আমার আর আলোচনার প্রয়োজন থাকে না। তবে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য একটু আলোচনা করা যেতে পারে।

দেখুন, লেখক মুসলিম শরীফের যে হাদীসের প্রেক্ষিতে দাবী করেছেন যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত নয় সেই হাদীসের তিনটি হাদীস পূর্বে ১৪১৬ নং হাদীসের  আলোচনায় মুসলিম শরীফের প্রখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা ইমাম নববী রাহ. হাদীসের فإنه وقت إلى نصف الليل  (তো এটা এশার ওয়াক্ত, মধ্যরাত পর্যন্ত)-এই অংশের ব্যাখ্যায় লিখেছেন,

معناه وقت لأدائها اختيارا أما وقت الجواز فيمتد إلى طلوع الفجر الثاني لحديث أبي قتادة الذي ذكره مسلم بعد هذا في باب من نسي صلاة أو نام عنها إنه ليس في النوم تفريط إنما التفريط على من لم يصل حتى يجيء وقت الصلاة الأخرى وسنوضح شرحه في موضعه إن شاء الله.

অর্থাৎ, এটা এশার পছন্দনীয় ওয়াক্ত। বাকী রইল বৈধ ওয়াক্ত। তো তা ফজর পর্যন্ত প্রলম্বিত। আবূ কাতাদাহ্র ঐ হাদীসের কারণে, ইমাম মুসলিম যেটাকে পরে উল্লেখ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সালাতের কথা ভুলে গেল বা সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে পড়ল’ এই অধ্যায়ে। হাদীসটি হল, নিদ্রায় কোনো ত্রুটি নাই। ত্রুটি হল, ঐ ব্যক্তির যে সালাত আদায় করল না অন্য আরেকটি সালাতের ওয়াক্ত আসা পর্যন্ত। যথাশীঘ্রই হাদীসটির মর্ম যথাস্থানে স্পষ্ট করব ইনশাআল্লাহ।

ইমাম নববী রাহ. বলতে চাচ্ছেন যে, এই হাদীসে যে মধ্যরাত পর্যন্ত এশার সালাতের কথা বলা হয়েছে তার দ্বারা এই কথা বোঝানো উদ্দেশ্য যে, মধ্যরাত পর্যন্ত ওয়াক্তটি এশার সালাতের জন্য পছন্দনীয় ওয়াক্ত। এই ওয়াক্তের মধ্যেই এশার সালাত আদায় করা উচিত। তবে বৈধ ওয়াক্ত আরও দীর্ঘ। আর তা সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। অতএব মধ্যরাতের পরে সালাত আদায় করলেও ব্যক্তির সালাত আদায় হয়ে গেছে বলা হবে। বলা হবে না যে, তার সালাত কাযা হয়ে গেছে। কারণ সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এশার সালাত আদায় করা বৈধ। তাঁর এই দাবীর পক্ষে দলীল হিসাবে তিনি আবূ কাতাদাহ রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেটি মুসলিম শরীফেই বিদ্যমান রয়েছে এবং সেই হাদীসটির পূর্ণ ব্যাখ্যা কী তা তিনি সেখানেই উল্লেখ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন। হাদীসটি মুসলিম শরীফের ১৫৯৪ নং হাদীস। যা উপমহাদেশীয় ছাপা কিতাবের ২৩৯ নং পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত হয়েছে। হাদীসটি এই:

ليس في النوم تفريط إنما التفريط على من لم يصل حتى يجيء وقت الصلاة الأخرى

‘নিদ্রায় কোনো ত্রুটি নেই। ত্রুটি ঐ ব্যক্তির যে আরেকটি সালাতের ওয়াক্ত আসার পূর্ব পর্যন্তও সালাত আদায় করেনি।’

এই হাদীসের আলোচনায় ইমাম নববী রাহ. বলেন,

فى الحديث دليل على إمتداد وقت كل صلاة من الخمس حتى يدخل وقت الأخرى وهذا مستمر على عمومه في الصلوات كلها إلا الصبح فإنها لاتمتد إلى الظهر بل يخرج وقتها بطلوع الشمس لمفهوم قوله صلى الله عليه وسلم من أدرك ركعة من الصبح قبل أن تطلع الشمس فقد أدرك الصبح وأما المغرب ففيه خلاف سبق بيانه فى بابه والصحيح المختار امتداد وقتها إلى دخول وقت العشاء للأحاديث الصحيحة السابقة في صحيح مسلم وقد ذكرنا الجواب عن حديث إمامة جبريل صلى الله عليه وسلم في اليومين في المغرب في وقت واحد.

وقال أبو سعيد الإصطخري من أصحابنا: تفوت العصر بمصير ظل الشيء مثليه وتفوت العشاء بذهاب ثلث الليل أو نصفه وتفوت الصبح بالإسفار وهذا القول ضعيف والصحيح المشهور ما قدمناه من الامتداد إلى دخول الصلوة الثانية.

অর্থ: ‘এই হাদীসে এই কথার পক্ষে দলীল রয়েছে যে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রতিটির ওয়াক্ত প্রলম্বিত হয় যতক্ষণ না অপর সালাতের ওয়াক্ত আসে। আর এটা তার ব্যাপকতার কারণে প্রতিটি সালাতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ফজর ব্যতীত। কেননা ফজরের ওয়াক্ত যোহর পর্যন্ত প্রলম্বিত হয় না। বরং ফজরের ওয়াক্ত সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়। আর এর কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উক্তি-‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজরের এক রাকআত পেল সে ফজর পেল।’ আর মাগরিবের ব্যাপারে মতভেদ আছে। মাগরিবের আলোচনায় মতভেদটির বিবরণ গত হয়েছে। সহীহ ও গ্রহণযোগ্য মত হল, মাগরিবের সালাতের ওয়াক্তও এশার ওয়াক্ত আসা পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়। আর তা ঐ সকল সহীহ হাদীসের কারণে, মুসলিম শরীফে যা পূর্বে বিবৃত হয়েছে। আর হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম কর্তৃক দুইদিন একই সময়ে মাগরিবের সালাত আদায় করণের কারণ কী, পূর্বেই আমি তার জবাব দিয়ে এসেছি। আমাদের একজন আলেম আবূ সাঈদ আল-ইসত্খরী বলেন, আসরের সালাত ফউত হয়ে যাবে বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হলে। এশার সালাত ফউত হয়ে যাবে রাতের এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক অতিক্রান্ত হলেই এবং ফজরের সালাত ফউত হয়ে যাবে পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে গেলেই। এই মতটি যইফ। সহীহ ও প্রসিদ্ধ মত তা-ই যা আমি বর্ণনা করে এসেছি। আর তা হল, এক সালাতের ওয়াক্ত প্রলম্বিত হয় অপর সালাতের ওয়াক্ত আসার পূর্ব পর্যন্ত।’

মুহতারাম,

আপনার সামনে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, সহীহ হাদীস আমাদেরকে জানান দেয় যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজরের পূর্ব পর্যন্ত বহাল থাকে। সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যাবে- এই কথা বলে লেখক প্রকারান্তরে তা স্বীকারও করে নিয়েছেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহর উপরিউক্ত বক্তব্যটি পাঠ করার পর আমার সামনে নতুন একটি বিষয় খোলাসা হয়েছে। আর তা হল, আমাদের আলোচ্য লেখক মূলত আবূ সাঈদ আল ইসতাখরীর এই যঈফ ও শায বা উম্মাহ-বিচিছন্ন মতটিকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আবূ সাঈদ আল ইসতাখরীর মতকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে সাহস পাননি উম্মাহ-বিচ্ছিন্ন মত হওয়ার কারণে। ফলে তিনি প্রতিটি জায়গাতেই আবার বলেছেন, তবে সমস্যাজনিত কারণে অমুক সময় পর্যন্ত আদায় করা যাবে। আর এরই ফলে তাঁর বক্তব্য হয়ে গেছে স্ববিরোধী।

ইমাম নববী রাহ. কর্তৃক পেশকৃত আবূ কাতাদাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু-এর হাদীস ছাড়াও হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু এবং হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর  উক্তি প্রমাণ করে যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর তথা সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত থাকে। ইব্ন আব্বাস রা.-এর আছর বা উক্তিটি বর্ণিত হয়েছে এই সনদে, এইভাবে:

حدثنا إسحاق عن عبد الرزاق عن معمر عن الثوري عن ليث عن طاووس عن ابن عباس قال: وقت المغرب إلى العشاء ووقت العشاء إلى الفجر.

ইব্ন আব্বাস রা. বলেন, মাগরিবের ওয়াক্ত এশা পর্যন্ত এবং এশার ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত।

এই একই সনদে ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. তাঁর ‘কিতাবুল হুজ্জাহ আ’লা আহলিল মাদীনাহ’ গ্রন্থে ইব্ন আব্বাস রা-এর উক্তিটি বর্ণনা করেছেন এইভাবে :

أخبرنا سفيان الثوري قال حدثنا ليث بن ابي سليم عن طاووس عن ابن عباس قال: وقت الظهر إلى العصر، ووقت العصر إلى المغرب، ووقت المغرب إلى العشاء، ووقت العشاء إلى الفجر.

অর্থ: ইব্ন আব্বাস রা. বলেন, যোহরের ওয়াক্ত আসর পর্যন্ত, আসরের ওয়াক্ত মাগরিব পর্যন্ত, মাগরিবের ওয়াক্ত এশা পর্যন্ত এবং এশার ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত।   

হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তিটি বর্ণিত হয়েছে এই সনদে এইভাবে:

حدثنا إسحاق عن عبد الرزاق عن الثوري عن عثمان بن موهب قال: سمعت أبا هريرة وسأله رجل عن التفريط في الصلاة، فقال: أن تؤخروها إلى وقت التي بعدها، فمن فعل ذلك فقد فرط.

অর্থ: উসমান ইব্ন মাওহিব বলেন, আবূ হুরায়রা রা.-কে এক ব্যক্তি সালাতে চরম ত্রুটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তাঁকে আমি বলতে শুনেছি, ‘চরম ত্রুটি হল, সালাতকে তার পরবর্তী সালাতের ওয়াক্ত আসা পর্যন্ত বিলম্বিত করা। যে ব্যক্তি এরূপ করল সে চরম ত্রুটি করল।

হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তিটি হযরত আবূ কাতাদাহ রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের মর্মকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। এছাড়া শরহু মা’আনিল আছারে (ত্বাহাবী শরীফে) আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তিটি আরও স্পষ্ট শব্দে ব্যক্ত করে যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত। ইমাম ত্বাহাবী বলেন,

حدثنا يونس قال ثنا عبد الله بن يوسف قال ثنا الليث ح وحدثنا ربيع المؤذن قال ثنا شعيب بن الليث قال ثنا الليث عن يزيد بن أبي حبيب عن عبيد بن جريج أنه قال لأبي هريرة: ما إفراط صلاة العشاء قال: طلوع الفجر.

অর্থাৎ ইব্ন জুরাইজ আবূ হুরায়রা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন, এশার সালাতে কোন কর্মটি চরম ত্রুটি? হযরত আবূ হুরায়রা রা. বললেন, ফজর উদিত হওয়া।

অর্থাৎ ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্তও যদি কেউ এশার সালাত আদায় না করে তাহলে তার এই কর্মটি চরম ত্রুটি হিসাবে পরিগণিত হবে। কারণ, তখন এশার সালাত কাযা হয়ে যাবে। বুঝা গেল যে, ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত এশার সালাতের ওয়াক্ত থাকে। এই বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, ওয়াক্তের বিষয়টি ‘মুদরাক বিল কিয়াস’ নয়; যুক্তি ও বুদ্ধি দ্বারা অবগত হওয়ার মত বিষয় এটি নয়। সুতরাং হযরত ইব্ন আব্বাস রা. ও হযরত আবূ হুরায়রা রা. বিষয়টি নিশ্চয়ই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই জেনেছেন। অতএব তাঁদের বক্তব্যটি মারফূয়ে হুকমী বা পরোক্ষ মারফূ হাদীস হিসাবে বিবেচিত হবে।

হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. তাঁর খেলাফতকালে হযরত আবূ মূসা আশআরী রা.-এর উদ্দেশে একটি পত্রে লিখেছিলেন। এক বর্ণনা অনুযায়ী এই পত্রের সংশ্লিষ্ট অংশের পাঠ নিম্নরূপ:

 وَصَلِّ الْعِشَاءَ أَيَّ اللَّيْلِ شِئْتَ وَلَاتُغْفِلْها 

‘এবং এশার সালাত আদায় করবে রাতের যে কোনো অংশে তুমি আদায় করতে চাও, তবে এশার সালাতকে তোমার অবহেলার শিকার বানাবে না।’

হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর أَيَّ اللَّيْلِ شِئْتَ  কথাটি স্পষ্টরূপেই ব্যক্ত করে সমস্ত রাত-ই এশার সালাতের ওয়াক্ত।

মুহতারাম,

সন্দেহ নেই যে, ফুকাহায়ে কেরামের অনেকেই বলেছেন যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু তাঁদের এই কথার অর্থ এই নয় যে, মধ্যরাতের পরে এশার ওয়াক্ত থাকে না। বরং তাঁরা বলতে চেয়েছেন যে, এশার সালাতের মাকরূহবিহীন বা দোষবিহীন ওয়াক্ত হল মধ্যরাত পর্যন্ত। বিনা ওযরে মধ্যরাতের পরে এশার সালাত আদায় করা মাকরূহ এবং গুরুতর অন্যায়। তবে বিনা ওযরে মধ্যরাতের পরে এশার সালাত আদায় করা অন্যায় হলেও তার সালাত ‘আদা’ হিসাবেই গণ্য হবে, ‘কাযা’ হিসাবে নয়। কারণ এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকে। আর এই কারণেই ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, কোনো ব্যক্তি যদি মধ্যরাতের পরে ইসলাম গ্রহণ করে বা কোনো বালক যদি মধ্যরাতের পরে বালেগ হয় বা কোন ঋতুবতী নারীর ঋতু যদি মধ্যরাতের পরে বন্ধ হয়ে যায় তবে তাদের উপর এশার সালাত আদায় করা ফরয হয়ে যাবে। যদি ফজর পর্যন্ত এশার সালাতের ওয়াক্ত বহাল না থাকত তাহলে এশার সালাত আদায় করা  এদের উপর ফরয হত না। ঠিক আমরাও তা-ই বলি। আমরা বলি যে, এশার সালাত আদায় করতে হবে মধ্যরাতের পূর্বেই। বিনা ওযরে মধ্যরাতের পর পর্যন্ত এশার সালাত বিলম্বিত করা মাকরূহ ও গুনাহের কারণ। কিন্তু কেউ যদি তা করে তবে বলব না যে, তার সালাত কাযা হয়ে গেছে। কারণ, এশার সালাতের ওয়াক্ত থাকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। জনাব মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবও বলেছেন যে, এশার সালাত সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে। আমরাও তা-ই বলি। তাহলে বিরোধ কোথায়?  হাঁ বিরোধ এতটুকু যে, তাঁর বক্তব্য ও  মতের মধ্যে রয়েছে স্ববিরোধিতা । আমাদের বক্তব্য ও মতের মধ্যে তা নেই, আছে সংগতি ও পরিপূর্ণ ভারসাম্য।

মুহতারাম,

এরপর দেখুন যে, তিনি লিখেছেন, তাই মাগরিবের পরপরই এশার সালাত পড়া উচিত নয় যা এ দেশে চালু আছে। এবার বলুন, লেখককে আপনি কী অভিধায় অভিহিত করবেন? বিকৃত মস্তিষ্ক, না দুগ্ধপোষ্য অবোধ শিশু? মাগরিবের পরপরই এ দেশের কোন্ মসজিদে এশার সালাত আদায় করা হয়? মাগরিবের পর এক ঘন্টা আঠারো মিনিট পরে সাধারণত শাফাক অদৃশ্য হয়। এরপর এ দেশে আযান দেওয়া হয় এবং আযানের আধা ঘন্টা পরে এশার সালাত আদায় করা হয়। আজ (২১ নভেম্বর) মাগরিবের আযান হবে পাঁচটা পনের মিনিটে এবং আযানের পরপরই মাগরিবের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। আর শাফাক অদৃশ্য হবে তথা এশার সালাতের ওয়াক্ত হবে ছয়টা একত্রিশ মিনিটে। কোনো কোনো মসজিদে সাতটায় আযান হবে এবং সাড়ে সাতটায় জামাত হবে; কোনো কোনো মসজিদে আরও পরে আযান হবে এবং জামাত হবে। এরই নাম কি মাগরিবের পরপর?

আজকে এ পর্যন্তই। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দুআ চাই। দুআ করি, আপনি ভালো থাকুন।

মাআসসালাম।

বিনীত আব্দুল গাফ্ফার, শহীদবাগ জামে মসজিদ।

২১ নভেম্বর, ২০১৪; ২৭ মুর্হারম, ১৪৩৬। -মাসিক আলকাউসার

80
ভাষা আল্লাহ তাআলার অন্যতম সেরা দান। আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নিআমতের মাঝে এক মহান নিআমত । কুরআনে কারীমে তিনি ইরশাদ করেন: (তরজমা) ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশ-মণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। -সূরা রূম : ২২

সুতরাং এই নিআমতের শুকরিয়া আদায় করা সকলের একান্ত কর্তব্য। এই নিআমতের শুকরিয়া আদায়ের পদ্ধতি শুধু ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা নয়; বরং এই নিআমতের শুকরিয়া আদায়ের সঠিক পদ্ধতি হল প্রত্যেকের নিজ নিজ ভাষাকে আপন করে নেওয়া এবং সেই ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করা। লেখা ও বলায় সেই ভাষার বিশুদ্ধ রূপটি ব্যবহার করা। সুস্পষ্ট ও সুন্দর করে কথা বলা। অশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।

সমস্ত নবী-রাসূল, সাহাবা, তাবেয়ীন এবং প্রত্যেক দেশের আলেম-ওলামা, জ্ঞানী-গুণীরা এভাবেই এই নিআমতের শুকরিয়া আদায় করেছেন। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেছেন। বিশুদ্ধ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। সুন্দর ও সুস্পষ্ট বাচন-ভঙ্গি আর আকর্ষণীয় ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান বাণী সকলের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন।

বিশুদ্ধ ভাষাই পারে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে। একজন মানুষের ব্যক্তিত্বকে  অর্থবহ করে যেসব গুণ, সেগুলোর মাঝে বিশুদ্ধ ভাষা ও সুস্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলা অন্যতম। নেতৃত্বের অন্যতম গুণ বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা। কারণ এর মাধ্যমে শ্রোতা ও অধীনদের উপর সহজেই প্রভাব ফেলা যায়। মূলত বিশুদ্ধ ভাষা প্রাণ-মনকে দেয় তৃপ্তি আর চিন্তাচেতনাকে দেয় দীপ্তি।

বিশুদ্ধ ভাষায় খুতবা প্রদান করা, সুন্দর উচ্চারণে ও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারা  আমাদের নবীজীর অনুপম সুন্নত। আমাদের আকাবির ও আসলাফের ঐতিহ্য। তাদের আলোচনা, বক্তৃতায় বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজও বিদ্যমান। তাদের লেখনী ও রচনায় রয়েছে ভাষার সাহিত্য ও আলংকারিক উচ্চমান।

বিশুদ্ধ ভাষার সম্মোহনী শক্তি আর মন-মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তারের উচ্চমানসম্পন্ন ক্ষমতার বিষয়টির সত্যতা, ও বাস্তবতা বুঝে আসে যখন দেখতে পাই যে, আল্লাহ তাআলা সমস্ত নবী ও রাসূলকে তাঁদের আপন সম্প্রদায়ের ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেন: (তরজমা) ‘আমি প্রত্যেক নবীকেই তার জাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি যাতে তাদের সামনে তারা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।’ -সূরা ইবরাহীম ১৪ : ৪

আর বাস্তবেই দেখা গেছে যে, নবী-রাসূলগণ তাঁদের স্বজাতির ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ সুভাষী হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। বাগ্মী ও সুবক্তা ছিলেন।

বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব আরো সুন্দর বুঝে আসে যখন দেখতে পাই মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর ভাইয়ের বিশুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। (‘আমার ভাই হারুনের যবান আমার চেয়ে বেশি স্পষ্ট।’ -সূরা আলকাসাস ২৮ : ৩৪)

এ থেকে বোঝা যায় যে, নসীহত, ওয়ায ও প্রচারকাজে বিশুদ্ধ ভাষা, ভাষার প্রাঞ্জলতা ও প্রশংসনীয় বর্ণনাভঙ্গি কাম্য। আঞ্চলিক ও অশুদ্ধ ভাষা ছেড়ে এই গুণ অর্জনের চেষ্টা করা একটি মহৎ ও উচুঁমার্গের কাজ; একটি নববী আদর্শ।

আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করতেন। আরবী ভাষায় তাঁর এমন দক্ষতা ও নিপুণতা ছিল যে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করতেন, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ শুদ্ধভাষী। তাঁর ভাষা ছিল বিশুদ্ধ, উচ্চারণ ছিল সুস্পষ্ট এবং বাচনভঙ্গি ছিল প্রাঞ্জল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইরশাদ করেছেন-أعطيت جوامع الكلم

অর্থাৎ ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৩

বিশুদ্ধ ভাষায় সুন্দর ও সুস্পষ্টভাবে কথা বলা আমাদের প্রিয় নবীর সুন্নাত। আমাদের বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে। আলোচনায় সকলকে মুগ্ধ করতে বিশুদ্ধ ভাষার বিকল্প নেই।

সাহাবা-তাবেয়ীন ও আমাদের আকাবির বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। তালীম ও তাদরীসের ক্ষেত্রে সর্বদা অশুদ্ধ ভাষা বর্জন করতেন।

নাফে রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইবনে ওমর রা. তাঁর সন্তানকে অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার কারণে প্রহার করতেন’। ইমাম বুখারী আল আদাবুল মুফরাদে ‘অশুদ্ধভাষা ব্যবহারে প্রহার’ অনুচ্ছেদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহ. বলেন-وكان السلف يؤدبون أولادهم على اللحن

‘পূর্বসূরীরা ভাষায় ভুল করলে তাদের সন্তানদের শাসন করতেন।’ -মাজমূউল ফাতাওয়া ৩২/২৫২

সাহাবায়ে কেরামসহ আমাদের আসলাফের নিকট সম্মান-অসম্মান, মান-মর্যাদা ও আভিজাত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড ছিল ভাষার ব্যবহার। প্রাচীন আরবদের মাঝেও বিশুদ্ধভাষীরাই ছিল বিশেষ আভিজাত্যের অধিকারী।

ইমাম যুহরী রাহ. বলেন- ما أحدث الناس مروءةً أعجب إليَّ من الفصاحة

‘আমার মতে বিশুদ্ধ ভাষার চেয়ে বড় আভিজাত্যের বস্তু আর কিছু নেই।’ -হিলইয়া ৩/৩৬৪; আলমুরুআ, আবু বকর মারযুবান, ৪৩

 তিনি আরো বলেন, الفصاحة من المروءة

‘বিশুদ্ধ ভাষা আভিজাত্যের অন্তর্ভুক্ত।’ -বাহজাতুল মাজালিস ২/১/৬৪৩

ইবনুল  মুবারক বলেন-

إقامة اللسانِ والسدادُ المروءةُ العظمى

অর্থাৎ ভাষার সংশোধন ও তার সঠিক ব্যবহার সবচেয়ে বড় আভিজাত্য। -আলমুরুআ,আবু বকর মারযুবান, ৭০

আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান তার সন্তান ওয়ালিদের মুখে অশুদ্ধ ভাষা শুনে অনেক ব্যথিত ও মর্মাহত হন এবং বলেন এটা ওয়ালিদের জন্য অশোভনীয়। তিনি আরো বলেন-اللحن في الكلام أقبح من التفتيق في الثوب، والجدري في الوجه

‘ভাষার ভুল কাপড়ের ছিদ্র বা ছিন্নতা ও মুখে গুটিবসন্তের চেয়েও জঘন্য’। -আলফাখরী, আলআদাবুস সুলতানিয়া, ১/৪৫

এরপর গ্রন্থকার নিজে বলেন-وكان اللحن عندهم في غاية القبح

‘অশুদ্ধ ভাষা তাদের নিকট অতি ঘৃণ্য বিষয় ছিল।’

একবার যিয়াদ তার সন্তান উবায়েদকে মুআবিয়া রা.-এর নিকট পাঠালেন। সার্বিক পর্যবেক্ষণের পর মুআবিয়া রা. যিয়াদের কাছে চিঠিতে লেখেন-إن ابنك كما وصفت، و لكن قوم من لسانه

‘তোমার ছেলে যেমন বলেছিলে ঠিক তেমনি, তবে একটু ভাষাটা ঠিক করে দিও।’ -আলবয়ান ওয়াত-তাবয়ীন ১/১৪৫

শায়খ আব্দুর রহমান সুদাইসি হারাম শরীফে জুমার খুতবায় বলেন-اللغةُ تُعلِي الرفيعَ عن الوضيع

‘ভাষা মানুষকে নিচু থেকে উঁচু শ্রেণীতে উন্নীত করে’।

অশুদ্ধ ভাষা এতই নিন্দিত যে, একে একপর্যায়ে রোগ বলা হয়েছে-

وقد أراد ابن السكيت مؤلف كتاب "إصلاح المنطق " أن يعالج أيضا داء " اللحن " والخطأ الذي كان قد استشرى وترسخ في لغة العرب التي هي لغة القرآن. (ترتيب إصلاح المنطق صـ٨)

পূর্বসূরী ওলামায়ে কেরাম সাধারণ ও বিশেষ ব্যক্তিদের অশুদ্ধ কথনের বিভিন্ন দিক নিয়ে  ‘ইসলাহুল মানতিক’ ‘লাহনুল আওয়াম’ ‘তাকভীমুল লিসান’ ও ‘আলআখতাউশ শায়িআ’ শিরোনামে অনেক কিতাব রচনা করেছেন, যা মূলত বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বোঝায় এবং এ ব্যাপারে তাদের কতটা সতর্কতা ছিল তা নির্দেশ করে।

ফিকহ ও হাদীসের ইমামগণের জীবনী অধ্যয়নে দেখা যায়, তাঁরা সবাই বিশুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী ছিলেন। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ রাহ. ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী।

ভারত-পাকিস্তানে আমাদের আকাবির তাদের মাতৃভাষায় ছিলেন প্রতিষ্ঠিত। যেমন  লেখায় তেমন বক্তৃতায়। বিশুদ্ধভাষা ব্যবহারে এবং সাহিত্যের সর্ব শাখায় তাদের ছিল দৃপ্ত পদচারণা। মাওলানা শিবলী নোমানী, আব্দুল মাজেদ দরয়াবাদী, মাওলানা আব্দুল হাই, মুফতী মুহাম্মাদ শফী ও মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

শুদ্ধভাষায় কথা বলার এ সুন্নতকে অনুসরণ করা আমাদের  কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন 
লেখক : অধ্যয়নরত, আরবী ভাষা- বিজ্ঞান বিভাগ, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়---মাসিক আলকাউসার

81
মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকে। এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। এতেও কারও দ্বিমত নেই যে, মাগরিবের ওয়াক্ত বহাল থাকে শাফাক অদৃশ্য হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। শাফাক অদৃশ্য হয়ে গেলে মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায় এবং এশার ওয়াক্ত শুরু হয়। আর এই সবই  সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে শাফাক কাকে বলে তা নিয়ে দ্বিমত আছে। কেউ বলেন, শাফাক অর্থ সূর্যের লালিমা। কেউ বলেন, শাফাক অর্থ সাদা রেখা; যে রেখাটি সূর্যের লালিমা অন্তর্হিত হওয়ার পর আকাশের প্রান্তে দেখা যায়। এই সাদা রেখা অন্তর্হিত হওয়ার পর আকাশের প্রান্ত কালো হয়ে যায় এবং দৃষ্টি থেকে তখন আকাশের প্রান্ত আর দৃশ্যযোগ্য থাকে না। আকাশের প্রান্ত তখন দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

এবার দেখুন, লেখক কী বলেছেন। লেখক বলেছেন, মাগরিবের ছালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কেও কিছু যঈফ ও জাল হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর এই দাবীর পক্ষে উদাহরণ পেশ করতে গিয়ে তিনি চারটি হাদীস এনেছেন এবং হাদীস চারটি সম্পর্কে তিনি ‘তাহক্বীক্ব’ শিরোনামে হাদীসের মান নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি আপনার সুবিধার্থে লেখকের লেখাগুলো হুবহু তুলে ধরছি। উদাহরণ পেশ করতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, যেমন-

(1)     أوَّلُ وَقْتِ الْمَغْرِبِ حِيْنَ تَغْرِبُ الشَّمسُ وَآخِرُهُ حِيْنَ يَغِيْبُ الشَّفَقُ

(1)      রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, মাগরিবের প্রথম ওয়াক্ত হ’ল যখন সূর্য ডুবে যায়। আর শেষ সময় যখন শাফাকব ডুবে যায়।

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, ‘আমি এরূপ বর্ণনা পাইনি।’ আল্লামা যায়লাঈ বলেন, ‘এটি গরীব। অর্থাৎ ভিত্তিহীন।

(2)  رُوِيَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلًّمَ أَنَّهُ قَالَ آخِرُ وَقْتِ الْمَغْرِبِ إِذَا أَسُوْدَ الْاَفَقِ

(2)    রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মাগরিবের শেষ সময় হল, যখন কালো রেখা দেখা যাবে।

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, ‘আমি এরূপ বর্ণনা পাইনি।

(3)      عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَال قٌالَ رَسُوْلُ الله صَلًّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلشَّفَقُ اَلْحُمْرَةُ فَإِذَا غَابَتِ الشَّفَقُ وَجَبَتِ الصَّلَاةُ

(৩)  ইবনু ওমর রাঃ বলেন, শাফাক্ব হল, লালিমা। যখন লালিমা দূরীভূত হবে তখন ছালাত ওয়াজিব হবে।

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে আতীক্ব ইবনু ইয়াকুব নামে ত্রুটিপূর্ণ রাবী আছে। তাছাড়া উক্ত বর্ণনা এশার ছালাতের জন্য প্রযোজ্য, মাগরিবের জন্য নয়।

মূলতঃ লালিমা দূর হওয়ার পর মাগরিবের ওয়াক্ত থাকে না। কিন্তু উক্ত বর্ণনাগুলোতে দাবী করা হয়েছে।

(4)  عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلًّمَ الشّفَقُ الْحُمْرَةُ

(৪) ইবনু ওমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, শাফাক্ব হল লালিমা।

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যইফ।

 

পর্যালোচনা : প্রথম হাদীসটি যে শব্দে বর্ণিত হয়েছে সেই শব্দে হাদীসটি আল্লামা যাইলাঈ পাননি বলে মত ব্যক্ত করেছেন। আল্লাম যাইলাঈ-র ভাষায় হাদীসটি গরীব। উল্লেখ্য, গরীব বলে তিনি  বোঝাতে চান যে, আমি হাদীসটি  পাইনি। এটি তাঁর নিজস্ব পরিভাষা। তবে ঐ শব্দে হাদীসটি পাওয়া না গেলেও হাদীসটির মর্ম সহীহ। তাই আল্লামা যাইলাঈ সঙ্গে সঙ্গে এও বলেছেন,

وبمعناه ما رواه مسلم من حديث عبد الله بن عمرو بن العاص ...

অর্থাৎ ‘তবে এর মর্ম রয়েছে সহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত হাদীসে ...।’ (নাসবুর রায়াহ, ১/২৩০)

মুসলিম শরীফের সেই হাদীসে বলা হয়েছে : وَوَقْتُ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ مَالَمْ يَغِبِ الشَّفَقُ ‘এবং মাগরিবের সালাতের ওয়াক্ত থাকে যতক্ষণ না শাফাক অন্তর্হিত হয়।’ (সহীহ মুসলিম,[1] হাদীস: ১৪১৯)

লেখক ইব্ন হাজার আসকালানী-র দিরায়াহ কিতাবের বরাত দিয়ে বলেছেন যে, ইব্ন হাজার আসকালানী বলেন,‘আমি এরূপ বর্ণনা পাইনি’। কিন্তু ইব্ন হাজার আসকালানীর পরের কথাটুকু তিনি উদ্ধৃত কেন করলেন না তা বুঝতে পারলাম না। ইব্ন হাজার আসকালানী রাহ. বলেছেন:

 لم أجده هكذا، لكن من فعل النبى صلى الله عليه وسلم  (كذا في المطبوع، والصواب: قول النبي صلى الله عليه وسلم) في حديث عبد الله بن عمرو قال: سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن وقت الصلوات فذكر الحديث، وفيه "ووقت صلاة المغرب إذا غابت الشمس ما لم يسقط الشفق" وفي رواية "مالم يغب الشفق".

 অর্থাৎ হাদীসটি আমি এইভাবে পাইনি। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইব্ন আমরের হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীরূপে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল সালাতসমূহের ওয়াক্ত সম্পর্কে। আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর অতপর হাদীসটি বর্ণনা করেন। হাদীসটিতে আছে : ‘এবং মাগরিবের সালাতের ওয়াক্ত যখন সূর্য ডুবে যায়, (আর থাকে ততক্ষণ) যতক্ষণ না শাফাক ডুবে যায়।’ অন্য বর্ণনায় আছে : ‘যতক্ষণ না শাফাক অদৃশ্য হয়ে যায়।’ (আদ-দিরায়াহ ১/১০২)

তো ইব্ন হাজার আসকালানী রাহ. বলছেন যে, হাদীসটিকে ঐ শব্দে না পেলেও হাদীসটির মর্ম ভিন্ন শব্দে আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বিবৃত হয়েছে। লেখক ইব্ন হাজার আসকালানী এবং যাইলাঈ রাহ. উভয়ের বক্তব্যকে আংশিক উদ্ধৃত করেছেন। ফলে পাঠক ভুল বার্তা পাবে যে, এই কথাটিই সহীহ নয়। অথচ কথাটি সহীহ। উপরের আলোচনা দ্বারা তা প্রমাণিত হয়েছে। তো এইরূপ অসম্পূর্ণ উদ্ধৃতি ও অসম্পূর্ণ আলোচনা সম্বলিত লেখা -যা পাঠককে ভুল বার্তা দেয়-  লেখকের পক্ষে লেখা কতটুকু সমীচীন হয়েছে তা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

কোনো কথা সহীহ হাদীসে বিদ্যমান থাকলে ঐ কথার পক্ষের জাল ও যঈফ হাদীসকে অবশ্যই জাল ও যঈফ বলে চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানাতে হবে যে, বিশেষ শব্দে বা বিশেষ সনদে ঐ মর্ম বা কথাসম্বলিত হাদীসটি যঈফ বা জাল হলেও মর্মটি বা কথাটি সহীহ সনদ তথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কারণ, কোনো কথা সহীহ সনদে বর্ণিত হলে মুহাদ্দিসগণ  সেটিকে সহীহ হাদীস বলেন। কিন্তু ঐ একই কথা যখন যঈফ সনদে (একই শব্দে বা ভিন্ন শব্দে) বর্ণিত হয় তখন তাঁরা সেই হাদীসটিকে যঈফ বলেন। তখন তাঁদের কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ঐ বিশেষ সনদটি যঈফ; এই নয় যে, হাদীসের মূল কথাটিই যঈফ। বরং ঐ বিশেষ সনদে হাদীসটি যঈফ হলেও  কথাটি সহীহ। কারণ, কথাটি সহীহ সনদেও বর্ণিত হয়েছে।

তদ্রূপ ঐ একই কথা কিংবা একই মর্ম (একই শব্দে বা ভিন্ন শব্দে) যখন মিথ্যাবাদী রাবীসম্বলিত কোনো সনদে বর্ণিত হয় তখন মুহাদ্দিসগণ বলেন, হাদীসটি জাল ও বানোয়াট। তখন তাঁদের কথার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, এই বিশেষ সনদটির কারণে হাদীসটি জাল বা ঐ ভিন্ন শব্দটি জাল। কিন্তু কথাটি সহীহ বা মর্মটি সহীহ। কারণ, কথাটি বা মর্মটি সহীহ সনদেও বর্ণিত হয়েছে।

আরেকটি বিষয়ও সংক্ষিপ্তরূপে বলার প্রয়োজন বলে মনে করছি। আর তা হল, মুহাদ্দিসগণ ও গবেষকগণ যখন বলেন যে, এই হাদীসটি আমি পাইনি তখন এর অর্থ এই দাঁড়ায় না যে, হাদীসটি জাল। কারণ, কোনো হাদীসকে জাল বলে আখ্যায়িত করার অর্থ হল, যেসব নিদর্শন দ্বারা হাদীস জাল বলে প্রমাণিত হয় সেসব নিদর্শনসমূহের কোনো নিদর্শন তাতে বিদ্যমান আছে। আর কোনো হাদীস না পাওয়ার অর্থ হল, না পাওয়ার কথা যিনি বললেন, তিনি হাদীসটির সন্ধান লাভ করতে পারেননি। হতে পারে আসলেই হাদীসটির কোনো অস্তিত্ব নাই। আবার এও হতে পারে যে,  কোথাও না কোথাও হাদীসটি আছে; তা সে সহীহ সনদেই হোক কিংবা যঈফ সনদে; কিংবা এমন কোনো সনদে যা দ্বারা হাদীসটি জাল বলে প্রমাণিত হয়। উদাহরণত আল্লামা যায়লাঈ যেসব হাদীস সম্পর্কে বলেছেন যে, হাদীসটি গরীব তথা হাদীসটি আমি পাইনি, সেসবের অনেক হাদীস পরবর্তীতে মুহাদ্দিসগণ পেয়েছেন এবং সেগুলোর সংকলনও তৈরী  হয়েছে। সেরূপ একটি সংকলন তৈরী করেছেন আল্লামা কাসেম ইব্ন কুতলূবুগা। তাঁর ঐ সংকলনটির নাম

 منية الألمعي فيما فات من تخريج أحاديث الهداية للزيلعي

অতএব, হাদীসকে ‘জাল’ আখ্যায়িত করতে শুধু আল্লামা যায়লাঈ বা ইবন হাজার আসকালানীর ‘আমি পাইনি’ কথাটিকে ভিত্তি বানানো লেখকের পক্ষে সমীচীন হয়নি। তাছাড়া আল্লামা যায়লাঈ যখন বলেন হাদীসটি ‘গরীব’  তখন তার অর্থ হল, হাদীসটির সন্ধান তিনি পাননি। যেমনটা আমি পূর্বে বলে এসেছি। লেখক ‘অর্থাৎ ভিত্তিহীন’’ বলে আল্লামা যায়লাঈ-র ‘গরীব’ কথাটির অর্থ করেছেন ‘ভিত্তিহীন’। সুতরাং বুঝতেই পারছেন,  লেখকের জ্ঞানের ভিত্তি কতটা দুর্বল।   

দ্বিতীয় হাদীসটি সম্পর্কে ইব্ন হাজার আসকালানী রাহ. বলেছেন,

 لم أَجِدهُ، لكِن فِي حَدِيث أبي مَسْعُود عِنْد أبي دَاود وَيُصلي الْمغرب حِين تسْقط الشَّمْس وَيُصلي الْعشَاء حِين يسود الْأُفق.

অর্থাৎ ‘হাদীসটি আমি পাইনি। তবে আবূ দাঊদে আবূ মাসঊদের হাদীসে আছে, ‘এবং তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাগরিব আদায় করতেন যখন সূর্য অস্ত যেত এবং এশা আদায় করতেন যখন আকাশের প্রান্ত কালো হয়ে যেত।’

আবূ দাঊদের যে হাদীসটির উদ্ধৃতি হাফেজ  ইবনে হাজার দিলেন সেই হাদীসটি সম্পর্কে ফজরের ওয়াক্তের আলোচনায় বলে এসেছি যে, হাদীসটি উসামা ইব্ন যায়দ আল-লাইছীর শায বা দল-বিচ্ছিন্ন বর্ণনা। আমরা হাদীসটিকে দলীল হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার উপযুক্ত মনে করি না। কিন্তু লেখক যেহেতু  হাদীসটিকে তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে দলীল হিসাবে উল্লেখ করেছেন সেহেতু এখানেও তাঁর উচিত ছিল দ্বিতীয় হাদীসটির পরে এটিকে উল্লেখ করা। সম্ভবত উল্লেখ করেননি হাদীসটি এখানে তাঁর মতের বিপক্ষে যায় বলে। কারণ, এই হাদীসে লালিমার পরে সাদা রেখাও যখন অন্তর্হিত হয়ে আকাশের প্রান্ত কালো হয়ে যাবে তখন এশার সালাত আদায় করার কথা বলা হয়েছে: যদ্দারা বোঝা যায় যে, মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয় আকাশের সাদা রেখা অন্তর্হিত হলে। আর এটি লেখকের মতের বিরুদ্ধে যায়।  পূর্ব থেকেই একটি মত ও ধারণা নির্দিষ্ট করে রেখে সুবিধামত সেই মত ও ধারণার পক্ষে হাদীস ব্যবহার করার এই মানসিকতা পরিহার করা উচিত। কারণ, এইরূপ মানসিকতা শরীয়ত-অনুসরণের দ্বারকে রুদ্ধ করে দেয় এবং প্রবৃত্তির অনুসরণের সহস্র দ্বারকে উন্মুক্ত  করে দেয়।

উল্লেখ্য, দ্বিতীয় হাদীসের শেষ শব্দদুটোতে লেখক যেভাবে হরকত লাগিয়েছেন আমি হুবহু তার অনুসরণেই হরকত লাগিয়েছি। কিন্তু সঠিক হরকত হবে এইরূপ: إِذَا اسْوَدَّ الْاُفُقُ 

তৃতীয় ও চতুর্থ হাদীসে ব্যক্ত হয়েছে যে, শাফাক অর্থ লালিমা এবং তা রাসূলের উক্তি হিসাবে বর্ণিত হয়েছে,  ইব্ন ওমরের নয়। অথচ লেখক তৃতীয় হাদীসের তরজমা করেছেন এইভাবে: ইবনু ওমর রা. বলেন, শাফাক্ব হল লালিমা। যখন লালিমা, দূরীভূত হবে তখন ছালাত ওয়াজিব হবে। তরজমাটি ভুল। তরজমা হবে এইরূপ: ইবনু ওমর বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, শাফাক্ব হল লালিমা।  লেখকের  তরজমায় পাঠক ভুল বার্তা পাবে। কারণ, হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি হিসাবে সহীহ না হলেও ইবন ওমর রা.-এর উক্তি হিসাবে সহীহ। হযরত ইব্ন উমর রা.-এর মতে শাফাক হল লালিমা।  তো লেখক যখন তরজমায় ‘ইবন্ ওমর রাঃ বলেন’ লেখার পর মন্তব্যে  হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন তখন পাঠক মনে করবে যে, ইবন ওমর রা.-এর উক্তি হিসাবেও কথাটি সহীহ নয়।

লেখক যেসব কিতাবের বরাত দিয়ে থাকেন সেগুলোও তিনি ভালোরূপে পাঠ করেন না, বা বোঝেন না। তানকীহুল কালামের লেখক বলেছেন, ‘হাদীসটিকে মারফূ‘রূপে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে আতীক বিন ইয়াকূব ভুল করেছেন। সঠিক হল, উক্তিটি  ইব্ন ওমরের ।’

তারপর দেখুন, লেখক  মন্তব্য করেছেন : ‘বর্ণনাটি যঈফ।...। তাছাড়া উক্ত বর্ণনা এশার ছালাতের জন্য প্রযোজ্য মাগরিবের জন্য নয়।’  আমার বক্তব্য হল, এরূপ কোনো নির্বোধ আছে নাকি যিনি হাদীসটিকে মাগরিবের সালাতের জন্য প্রযোজ্য বলে বলতে পারেন বা বলেছেন? সূর্যাস্তের পর শাফাক দূরীভূত হওয়ার পর যে সালাত ওয়াজিব হবে তা যে এশার সালাত তা একজন ইবতিদায়ী শ্রেণীর ছাত্রেরও বোঝার কথা। তাছাড়া হাদীসটি মাগরিবের সালাতের জন্য যখন প্রযোজ্য নয় এবং সেইরূপ দাবীও কেউ করেননি তখন  হাদীসটিকে মাগরিবের সালাতের অনুচ্ছেদে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য কী? নিজের পান্ডিত্য জাহির করা? তাহলে লেখকের জন্য তা বুমেরাং হয়ে গেছে। সচেতন পাঠক তাঁর পান্ডিত্যের পরিমাপ ঠিকই করে ফেলেছেন।

এরপর লেখক ‘মাগরিবের ছালাতের সঠিক সময়’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘সূর্য ডুবার পরেই মাগরিবের ছালাতের সময় শুরু হয়। আর সূর্যের লালিমা থাকা পর্যন্ত এর সময় অবশিষ্ট থাকে।’ তাঁর এই কথার বরাত তিনি দিয়েছেন মুসলিম শরীফের ১৪১৯ নং হাদীসের। আমার প্রশ্ন হল, মুসলিম শরীফের ঐ হাদীসে কোথায় বলা হয়েছে যে, লালিমা থাকা পর্যন্ত এর সময় অবশিষ্ট থাকে? হাদীসটিতে শাফাকের কথা বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে লালিমার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে :

 وَوَقْتُ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ مَا لَمْ يَغِبِ الشَّفَقُ 

(এবং মাগরিবের সালাতের ওয়াক্ত থাকে যতক্ষণ না শাফাক অন্তর্হিত হয়।)

লেখক শাফাকের অর্থ গ্রহণ করেছেন লালিমা। কিন্তু এর পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস তিনি উদ্ধৃত করেননি। যেসব হাদীসে লালিমার কথা বলা হয়েছে সেসব হাদীসকে তিনি যঈফ বলেছেন। তাহলে শাফাক অর্থ যে লালিমা তা তিনি কোত্থেকে পেলেন?

মুহতারাম,

আসলে শাফাকের অর্থ লালিমাও হতে পারে এবং লালিমার পরে দৃশ্য সাদা রেখাও হতে পারে। শব্দটি ঐসকল শব্দের একটি যেগুলো একাধিক অর্থ দান করে। অভিধান বিশারদদের কেউ কেউ  শাফাকের অর্থ ব্যক্ত করেছেন লালিমা। কেউ কেউ এর অর্থ ব্যক্ত করেছেন সাদা রেখা। শাফাক বলে এখানে লালিমা বোঝানো হয়েছে না সাদা রেখা বোঝানো হয়েছে তা নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও মতভেদ ছিল। ইব্ন ওমর রা.-এর মতে শাফাক হল লালিমা। কিন্তু হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর মতে শাফাক হল সাদা রেখা।  এ সম্পর্কে বিশদ বিবরণে না গিয়ে আল্লামা খাত্তাবী রাহ.-এর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। আল্লামা খাত্তাবী রাহ.  বলেন :

 وَلَمْ يَخْتَلِفُوْا فِيْ أَنَّ أَوَّلَ وَقْتِ الْعِشَاءِ الآخِرَةِ غَيْبُوْبَةُ الشَّفَقِ، إِلَّا أَنَّهُمْ اخْتَلَفُوْا فِي الشَّفَقِ مَاهُوَ، فَقَالَتْ طَائِفَةٌ : هُوَ الْحُمْرَةُ، رُوِيَ ذلِكَ عَنْ ابْنِ عُمَرَ وَ ابْنِ عَبَّاسٍ، وَهُوَ قَوْلُ مَكْحُوْلٍ وَطَاؤسٍ، وَبِهِ قَالَ مَالِكٌ وَسُفْيَانُ الثَّوْرِي وَابْنُ أَبِي لَيْلَى وَ أَبُوْ يُوْسُفَ وَمُحَمَّدٌ وَالشَّافِعِيُّ وَأَحْمَدُ وَإِسْحَاقُ، وَرُوِيَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّهُ قَالَ : الشَّفَقُ الْبَيَاضُ، وَ عَنْ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيْزِ مِثْلُهُ ، وَ إِلَيْهِ ذَهَبَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ وَهُوَ قَوْلُ الْأَوْزَاعِي، وَحُكِيَ عَنِ الْفَرَّاءِ أَنَّهُ قَالَ : الشَّفَقُ الْحُمْرَةُ ، وَأَخْبَرَنِي أَبُوْ عُمَرَ عَنْ أَبِي الْعَبَّاسِ أَحْمَدَ بْنِ يَحْيى قَالَ : الشَّفَقُ الْبَيَاضُ وَأَنْشَدَ لِأَبِي النَّجْمِ : حتى إذا الليل جلاه المجتلي = بين سماطي شفق مهوّل ، يُرِيْدُ الصُّبْحَ، وَقَالَ بَعْضُهُمْ الشَّفَقُ إِسْمٌ لِلْحُمْرَةِ وَالْبَيَاضِ مَعًا، إِلَّا أَنَّهُ إِنَّمَا يُطْلَقُ فِي أَحْمَرَ لَيْسَ بِقَانِي وَأَبْيَضَ لَيْسَ بِنَاصِعٍ ، وَإِنَّمَا يُعْلَمُ الْمُرَادُ مِنْهُ بِالْأَدِلَّةِ لَا بِنَفْسِ اللَّفْظِ، كَالْقُرْءِ الَّذِي يَقَعُ إِسْمُهُ عَلَى الطُّهْرِ وَالْحَيْضِ مَعًا وَكَسَائِرِ نَظَائِرِهِ مِنَ الْأَسْمَاءِ الْمُشْتَرِكَةِ.

    অর্থাৎ এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই যে, এশার শুরু ওয়াক্ত শাফাক অন্তর্হিত হওয়া। তবে তাঁরা দ্বিমত করেছেন এই ব্যাপারে যে, শাফাক কী? তো একদল বলেন, শাফাক হল লালিমা। মতটি বর্ণিত হয়েছে ইব্ন ওমর ও ইব্ন আববাস হতে। মাকহূল ও তাঊসের মতও তা-ই। এই মতই পোষণ করেছেন মালেক, সুফইয়ান ছাওরী, ইব্ন আবূ লায়লা, আবূ ইউসুফ, মুহাম্মাদ, শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাক। পক্ষান্তরে আবূ হুরায়রা হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, শাফাক হল সাদা রেখা। ওমর ইব্ন আব্দুল আযীয হতেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। এই মতের পক্ষে গিয়েছেন আবূ হানীফা। আওযাঈ-র মতও তা-ই। ফার্রা হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, শাফাক হল লালিমা। আর আবূ ওমর আমাকে জানিয়েছেন যে, আবুল আববাস আহমাদ ইব্ন ইয়াহ্ইয়া বলেছেন, শাফাক হল, সাদা রেখা এবং এর পক্ষে তিনি আবুন নাজমের একটি কবিতাংশ আবৃত্তি করেছেন। তা হল :

حتى إذا الليل جلاه المجتلي

بين سماطي شفق مهول

এবং কেউ বলেন, শাফাক হল লালিমা ও সাদা রেখা উভয়টির নাম। তবে তা টকটকে লাল নয় এবং ধবধবে সাদা নয়। তবে শব্দটি কোথায় কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা জানা যাবে প্রাসঙ্গিক লক্ষণ দ্বারা। শুধু শাফাক শব্দ দ্বারা নয়। যেমন القرء  শব্দটি হায়েয ও পবিত্রতা উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। (দ্রষ্টব্য: মাআলিমুস সুনান, ১৩৫ নং হাদীসের অধীনে আলোচনা)

শেষ কথা

শাফাক অর্থ লালিমা না সাদা রেখা তা যখন কোনো সহীহ মারফূ হাদীসে নির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত হয়নি তখন শাফাকের অর্থ লালিমা গ্রহণ করে শুধূ ‘শাফাক’ শব্দ সম্বলিত মুসলিম শরীফের ঐ হাদীসের বরাত দেওয়াকে যথেষ্ট মনে করা লেখকের জন্য সঠিক হয়নি। আমার বক্তব্য হল, যেহেতু শাফাক অর্থ লালিমাও হতে পারে এবং সাদা রেখাও হতে পারে এবং এখানে কোন অর্থটি উদ্দেশ্য তা নিয়ে যেহেতু মতভেদ আছে সেহেতু সতর্কতার দাবী হল, মাগরিবের সালাত আদায় করা উচিত লালিমা ডুবার পূর্বেই। আর এশার সালাত আদায় করা উচিত লালিমার পর সাদা রেখাও যখন অন্তর্হিত হয়ে যাবে তার পরে।

হযরত আবূ হুরায়রা রা. ও হযরত ওমর ইব্ন আব্দুল আযীযের মতে শাফাক্ব হল সাদা রেখা। ইমাম আওযাঈ ও ইমাম আবূ হানীফার মতও তা-ই। অন্যান্যদের মতে শাফাক হল লালিমা। যা-ই হোক সহীহ হাদীসে শাফাক অন্তর্হিত হওয়াকে মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার নিদর্শন বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। যাঁরা শাফাক অর্থ লালিমা গ্রহণ করেছেন, আর যাঁরা সাদা রেখা গ্রহণ করেছেন তাঁদের সকলেরই উদ্দেশ্যও  সেই কথাই ব্যক্ত করা। তথা মাগরিবের ওয়াক্ত কখন শেষ হয় তা ব্যক্ত করা। কিন্তু তাঁদের সকলের অভিমত হল, মাগরিবের সালাত আদায় করা মুসত্মাহাব সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরেই। সহীহ হাদীস যেমনটা আমাদেরকে জানান দেয়। আমাদের দেশে হানাফী মাযহাবের অনুসারীরা  মাগরিব আদায় করে থাকে সূর্যাসেত্মর অব্যবহিত পরেই। সুতরাং মাগরিবের সালাতও এই দেশে সহীহ হাদীস অনুযায়ীই আদায় করা হয়। তাদের মাগরিব আদায় জাল বা যঈফ হাদীসের কবলে পড়েনি। আমাদের আলোচ্য লেখকের নিকট জিজ্ঞাসা, তিনি কি বলবেন, তাহলে কেন তিনি তাঁর বইয়ের জন্য ঐ উদ্ভট নাম নির্বাচিত করলেন?  -মাসিক আলকাউসার-চলতি সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০২ .

82
সকল ডি আ্ই ইউ স্টুডেন্টরা : যখন আপনার টিউশন ফি/রেজিঃ ফি মানি রিসিটে জমা করেন, প্রায় অধিকাংশ স্টুডেন্টই কমন কয়েকটা ভুল করেন
যেমন:
০১) সেমিস্টার শুরুর আগে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ এমাউন্টটা (সেমিস্টার ফি , লেব ফি, ক্যা্ম্পাস ডেভঃ ফি, এক্সটা কারি: ফি: ইত্যাদি-)প্রত্যেকটি ঘরে আলাদা করে এমাউন্ট না লিখে!
শুধুমাএ সেমিস্টার ফি বা অন্য যে কোন ঘরে ইচ্ছে মত লেখেন।

০২) মিড টার্ম/ ফাইনাল পরীক্ষার আগে যে এমাউন্টটা হবে টিউশন ফি-র ঘরে।
এখানেও একই ভুল করেন অনেকেই অন্য যে কোন ঘরে ইচ্ছে মত লেখেন।

সমস্যা: মানি রিসিটে আপনারা যেই ঘরে লিখে জমা করেন একাউন্টসও(অফিস)ঐ ঘরেই এন্ট্রি করে করে।
দেখা যাবে টিউশন ফি, সেমিস্টার ফি , লেব ফি, ক্যা্ম্পাস ডেভ: ফি এক্সটা কারি: ফি: ইত্যাদির একটাও সঠিক ঘরে জমা না হওয়ার কারনে, আপনাদের একাউন্টস স্টেটমেন্টও সঠিক হবে না!
এছাড়াও টাকার পরিমান কথায়, ফ্যাকাল্টি, প্রোগাম, তারিখ, ক্যা্ম্পাস, স্বাক্ষর, এমনকি আইডি বা নামেও ভুল করেন!

যেহুতু আর্থিক লেনদেন তাই একটু সতর্কতার সাথে মানি রিসিটে পূরন করুন।এতে আপনার পরবর্তী যে কোন সমস্যায় ভোগান্তি লাগব হবে।

83
Bangladesh Civil Service-BCS / Follow Notice Board
« on: March 11, 2014, 04:00:58 PM »
Assalamualikum!
Students generally used to not following the Notice either Academic or Administrative. This is not a good habit! In thus way we are the officials also fall on Problem. All most all the students have a Face book ID or check his Face book Account, but didn't have time to see Notice board.  To avoid this Problems a Face book page may be opened for Notice. In permanent campus students are very unconscious about this.

84
BBA Discussion Forum / 12th Foundation day
« on: February 17, 2014, 03:03:10 PM »
Assalamualikum! thanks Almighty Allah for successfully finishing the program.
On the occasion of 12th Foundation day, the situation of DIU Permanent Campus team was so busy & active. We every employee Of DIU PC worked without/exceed daily regular works, The development team works day & night.
thanks everyone for visiting our Campus.

Pages: 1 ... 4 5 [6]