361
Business & Entrepreneurship / গোলমেলে বিশ্ব অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে
« on: November 23, 2015, 11:41:20 AM »
লেখকঃ শওকত হোসেন মাসুম
বিশ্ব অর্থনীতি এখন যথেষ্ট গোলমেলে অবস্থায় আছে। একদিন হয়তো শেয়ারবাজারে ধস নামল, পরদিনই জ্বালানি তেলের দাম নেমে গেল ৪০ ডলারের নিচে। আরেক দিন হয়তো সোনার দাম কমে নতুন রেকর্ড তৈরি করে ফেলল। আবার দেখা গেল, বিশ্বের বড় বড় মুদ্রার মূল্যমান হারিয়ে যা-তা অবস্থা। বিশ্ব অর্থনীতির এই ওঠানামার সঙ্গে তাল মেলানোই মুশকিল। বড় অর্থনীতির দেশগুলোর নীতিনির্ধারকদের অবস্থা তো আরও খারাপ। মন্দা ঠেকাতেই তারা ব্যস্ত। ইউরোপের অর্থনীতি অনেক দিন ধরেই মন্দায়। সাম্প্রতিক গ্রিস-সংকট ইউরোপের অর্থনীতির দুর্বলতাকে আরও প্রকট করেছে। তবে গ্রিস সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে ততটা ধাক্কা দিতে পারেনি, যতটা পেরেছে এশিয়ার দেশ চীন। চীনের চাহিদা ও জোগানের ওপর এখন নির্ভর করছে বিশ্ব অর্থনীতির ওঠানামা। সোনার দাম কেন কমল? কারণ, চীনের চাহিদা কমেছে, তারা সোনা কেনা কমিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, বিশ্বের সব ধরনের ধাতব পণ্যের দাম ৭ শতাংশ কমে গেছে, কারণ চীনের চাহিদা কম। জ্বালানি তেলের দাম কমার পেছনেও চীনের গতি-মন্দা খানিকটা দায়ী। সুতরাং বলা যায়, বিশ্ব অর্থনীতির সব পথ গিয়ে মিশেছে চীনে। যা কিছু হারায় কেষ্টা বেটাই চোর-এর মতো বিশ্ব অর্থনীতির চোর এখন ‘কেষ্টা’ চীন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘোষিত নীতি হচ্ছে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে রপ্তানিনির্ভর। আসলে এই নীতির সবচেয়ে সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছে চীন। আলপিন থেকে শুরু করে হেন কিছু নেই, যা চীন রপ্তানি করে না। বিশ্বের এক নম্বর রপ্তানিকারক দেশ এখন চীন। বিশ্বের মোট রপ্তানির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশই চীনের। আবার বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। সুতরাং এ রকম একটি দেশের যেকোনো ধরনের সংকট যে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
রপ্তানিনির্ভর চীনের প্রবৃদ্ধি কতখানি টেকসই, এ নিয়ে প্রশ্ন আগে থেকেই ছিল। কমছিল দেশটির রপ্তানি। কেবল জুলাই মাসেই কমেছে ৮ শতাংশ। রপ্তানির এই পতন ঠেকাতে অনেকটা আকস্মিকভাবেই বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি চীন আগস্টে পরপর দুই দিন তাদের মুদ্রা ইউয়ানের অবমূল্যায়ন ঘটায়। এর মধ্যে ১১ আগস্ট অবমূল্যায়ন করা হয় ১ দশমিক ৯ শতাংশ, পরের দিন আরও ১ শতাংশ। চীনের মুদ্রা পুরোপুরি ভাসমান বা ফ্লোটিং নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ব অর্থনীতির সুবাতাস বইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে। তারাই এখনো বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তির দেশ। ফলে ডলারও এখন তেজি। ডলার হয়তো এখন আরও তেজি হবে। ফলে প্রায় প্রতিটি দেশকেই ডলারের মূল্যমানের সঙ্গে নিজেদের মুদ্রার মানকে বিবেচনায় রাখতে হবে।
ইউয়ানের অবমূল্যায়নের কারণে চীনা রপ্তানিযোগ্য পণ্য আরেকটু সস্তা হবে। দেশটির আশা, এর ফলে রপ্তানিও বাড়বে। বিশ্বের অনেক দেশকেই চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রপ্তানি-বাণিজ্যে টিকে থাকতে হয়। অবমূল্যায়নের ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এখন অন্য দেশগুলোকেও অনুসরণ করতে হবে চীনকে, তা করেছেও।
কিন্তু অবমূল্যায়নের রেশ না কাটতেই আরও বড় ধাক্কা লাগল বিশ্ব পুঁজিবাজারে। ২৪ আগস্ট, সোমবার বড় ধস নামে চীনের শেয়ারবাজারে। ২০০৭ সালের পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় পতন। চীন সরকারের মুখপত্র দ্য পিপলস ডেইলি এটিকে বলছে আরেক ‘ব্ল্যাক মানডে’। ১৯৮৭ সালের ১৯ অক্টোবরও ছিল সোমবার। ওই দিনের বিশ্ব পুঁজিবাজারের ধসকে এত দিন বলা হতো ‘ব্ল্যাক মানডে’। নতুন কালো সোমবারের রেশ এখনো কাটেনি। এর প্রভাবে সারা বিশ্বে পুঁজিবাজারের নিত্য ওঠানামা লেগেই আছে। কবে তা থামবে, পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারছে না।
পুঁজিবাজারের ওই ধস নতুন করে ধাক্কা দিয়েছে মুদ্রাবাজারকে। জ্বালানি তেলের দামও কমে হয়ে গেছে সাড়ে ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, ২২ ধরনের পণ্য নিয়ে যে পণ্যসূচক ব্লুমবার্গ করে, সেটিও এখন ১৯৯৯ সালের পর সর্বনিম্ন। সোনার দাম আরেক দফা কমেছে। কেবল লাভে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি যেসব সরকারি বন্ড বাজারে ছেড়েছে সেগুলো। সামগ্রিকভাবে ১১ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ব পুঁজিবাজার থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ স্রেফ বাতাসে হাওয়া হয়ে গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এর শেষ কোথায়? বিশ্ব অর্থনীতি কি আবার একটি দীর্ঘস্থায়ী মন্দার দিকে যাচ্ছে? অনেক কিছুই নির্ভর করছে বড় বড় অর্থনীতির নীতিনির্ধারকদের ওপর। তবে অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকেরা কিন্তু আশাবাদী। তাঁরা মনে করেন, অর্থনীতি মন্দার দিকে যাবে না। কারণ, চীনের স্টক মার্কেট সাংহাই কম্পোজিট সূচক কমলেও এটাও মনে রাখতে হবে যে গত এক বছরে এটি বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। সুতরাং বাজার সংশোধনের একটি সুযোগ ছিলই। আবার শেয়ার বা বন্ডের মতো কাগজের তুলনায় চীনা বিনিয়োগ বেশি সম্পদের বাজারে, যা এখনো স্থিতিশীল। এর আগে এশিয়ায় সংকট দেখা দিয়েছিল ১৯৯৭ সালে। প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট-এর বিশ্লেষণ হচ্ছে, সে সময়ের তুলনায় দেশগুলোর সরকারেরা এখনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে। দেশগুলোর মুদ্রার মজুত অনেক ভালো, বিনিময় ব্যবস্থাও আগের চেয়ে অনেক বেশি ভাসমান। ব্যাংকিং খাতও ভালো অবস্থায় আছে। ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ এখন খুবই কম। ফলে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির গোলমেলে অবস্থা হয়তো বেশি দিন আর থাকবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
এ রকম একটি আশাবাদ দিয়ে লেখাটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু তারপরেও কথা বাকি থেকে গেল। কারণ, সবার চোখ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বা দ্য ফেড-এর দিকে। ২০০৬ সালের পর এই প্রথম তারা সুদহার বাড়ানোর কথা বলছে। চলতি মাসেই তা করা হবে। সর্বশেষ তারা সুদহার বাড়িয়েছিল ২০০৬ সালের জুনে, ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরপর ২০০৮ সালের পর তা কমতে কমতে শূন্য থেকে দশমিক ২৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়। মনে করা হচ্ছে, ১৬-১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম দফায় সুদহার দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে আরও দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, টালমাটাল এই বিশ্ব অর্থনীতিতে ফেড অজনপ্রিয় এই কাজটি কেন করতে যাচ্ছে। তারা মূলত দুটি লক্ষ্য সামনে রেখে মুদ্রানীতি পরিচালনা করে। একটি হচ্ছে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান, অন্যটি স্থিতিশীল মূল্যস্তর। সাধারণত অর্থনীতি যখন দুর্বল থাকে, তখন মূল্যস্ফীতিও কমতে থাকে। আবার অর্থনীতি যখন সর্বোচ্চ কর্মসংস্থানের দিকে যায়, তখন মজুরি বাড়ানোর চাপ তৈরি হয় এবং এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। অর্থনীতি খুব দ্রুতগতিতে আগাতে থাকলে ফেড তার বেঞ্চমার্ক সুদহার বাড়িয়ে দেয়। তাতে মানুষ খরচ কমিয়ে দেয় এবং সঞ্চয় বেশি করে। এর ফলে অর্থনীতি একটু শ্লথ হয় এবং মূল্যস্ফীতির চাপ কমে যায়। আবার অর্থনীতি বেশি শ্লথ হয়ে গেলে ফেড তখন সুদহার কমিয়ে দেয়। যেমন ২০০৮ সালের মন্দার পর কমাতে কমাতে প্রায় শূন্য হারে নিয়ে আসা হয়েছিল।
দ্য ফেড মনে করছে, সময় হয়েছে সুদহার বাড়ানোর। মূল্যস্ফীতি যদিও এখন কম। তেলসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কম থাকায় হয়তো চাপটি কমই থাকবে। তবে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি যথেষ্ট চাঙা। ইকোনমিস্ট বলছে, গত ১২ মাসে ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ফেড মনে করছে, এখন সুদহার কম থাকায় মানুষ হয়তো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, যা ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। সুতরাং যেহেতু এখন মূল্যস্ফীতির চাপ কম, সুতরাং সুদহার অল্প বাড়ালেও তাতে বড় সমস্যা হবে না। এই যে ফেড এখন অর্থনীতি কিছুটা টেনে ধরতে চাইছে, তাতে কিন্তু বাকি বিশ্ব শঙ্কিত। এতে উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোর সমস্যা বাড়তে পারে। এতে পুঁজিপ্রবাহ কমে যাবে। ডলারের দাম এতে আরও বাড়বে, কমতে পারে পণ্যের দামও। সুতরাং চীনের হঠাৎ অবমূল্যায়নের হাত ধরে বিশ্ব অর্থনীতির যে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি, এখন দেখা যাক ফেডের সুদহার বৃদ্ধি তাকে কোথায় নিয়ে যাবে।
বিশ্ব অর্থনীতি এখন যথেষ্ট গোলমেলে অবস্থায় আছে। একদিন হয়তো শেয়ারবাজারে ধস নামল, পরদিনই জ্বালানি তেলের দাম নেমে গেল ৪০ ডলারের নিচে। আরেক দিন হয়তো সোনার দাম কমে নতুন রেকর্ড তৈরি করে ফেলল। আবার দেখা গেল, বিশ্বের বড় বড় মুদ্রার মূল্যমান হারিয়ে যা-তা অবস্থা। বিশ্ব অর্থনীতির এই ওঠানামার সঙ্গে তাল মেলানোই মুশকিল। বড় অর্থনীতির দেশগুলোর নীতিনির্ধারকদের অবস্থা তো আরও খারাপ। মন্দা ঠেকাতেই তারা ব্যস্ত। ইউরোপের অর্থনীতি অনেক দিন ধরেই মন্দায়। সাম্প্রতিক গ্রিস-সংকট ইউরোপের অর্থনীতির দুর্বলতাকে আরও প্রকট করেছে। তবে গ্রিস সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে ততটা ধাক্কা দিতে পারেনি, যতটা পেরেছে এশিয়ার দেশ চীন। চীনের চাহিদা ও জোগানের ওপর এখন নির্ভর করছে বিশ্ব অর্থনীতির ওঠানামা। সোনার দাম কেন কমল? কারণ, চীনের চাহিদা কমেছে, তারা সোনা কেনা কমিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, বিশ্বের সব ধরনের ধাতব পণ্যের দাম ৭ শতাংশ কমে গেছে, কারণ চীনের চাহিদা কম। জ্বালানি তেলের দাম কমার পেছনেও চীনের গতি-মন্দা খানিকটা দায়ী। সুতরাং বলা যায়, বিশ্ব অর্থনীতির সব পথ গিয়ে মিশেছে চীনে। যা কিছু হারায় কেষ্টা বেটাই চোর-এর মতো বিশ্ব অর্থনীতির চোর এখন ‘কেষ্টা’ চীন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘোষিত নীতি হচ্ছে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে রপ্তানিনির্ভর। আসলে এই নীতির সবচেয়ে সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছে চীন। আলপিন থেকে শুরু করে হেন কিছু নেই, যা চীন রপ্তানি করে না। বিশ্বের এক নম্বর রপ্তানিকারক দেশ এখন চীন। বিশ্বের মোট রপ্তানির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশই চীনের। আবার বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। সুতরাং এ রকম একটি দেশের যেকোনো ধরনের সংকট যে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
রপ্তানিনির্ভর চীনের প্রবৃদ্ধি কতখানি টেকসই, এ নিয়ে প্রশ্ন আগে থেকেই ছিল। কমছিল দেশটির রপ্তানি। কেবল জুলাই মাসেই কমেছে ৮ শতাংশ। রপ্তানির এই পতন ঠেকাতে অনেকটা আকস্মিকভাবেই বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি চীন আগস্টে পরপর দুই দিন তাদের মুদ্রা ইউয়ানের অবমূল্যায়ন ঘটায়। এর মধ্যে ১১ আগস্ট অবমূল্যায়ন করা হয় ১ দশমিক ৯ শতাংশ, পরের দিন আরও ১ শতাংশ। চীনের মুদ্রা পুরোপুরি ভাসমান বা ফ্লোটিং নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ব অর্থনীতির সুবাতাস বইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে। তারাই এখনো বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তির দেশ। ফলে ডলারও এখন তেজি। ডলার হয়তো এখন আরও তেজি হবে। ফলে প্রায় প্রতিটি দেশকেই ডলারের মূল্যমানের সঙ্গে নিজেদের মুদ্রার মানকে বিবেচনায় রাখতে হবে।
ইউয়ানের অবমূল্যায়নের কারণে চীনা রপ্তানিযোগ্য পণ্য আরেকটু সস্তা হবে। দেশটির আশা, এর ফলে রপ্তানিও বাড়বে। বিশ্বের অনেক দেশকেই চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রপ্তানি-বাণিজ্যে টিকে থাকতে হয়। অবমূল্যায়নের ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এখন অন্য দেশগুলোকেও অনুসরণ করতে হবে চীনকে, তা করেছেও।
কিন্তু অবমূল্যায়নের রেশ না কাটতেই আরও বড় ধাক্কা লাগল বিশ্ব পুঁজিবাজারে। ২৪ আগস্ট, সোমবার বড় ধস নামে চীনের শেয়ারবাজারে। ২০০৭ সালের পর এটাই ছিল সবচেয়ে বড় পতন। চীন সরকারের মুখপত্র দ্য পিপলস ডেইলি এটিকে বলছে আরেক ‘ব্ল্যাক মানডে’। ১৯৮৭ সালের ১৯ অক্টোবরও ছিল সোমবার। ওই দিনের বিশ্ব পুঁজিবাজারের ধসকে এত দিন বলা হতো ‘ব্ল্যাক মানডে’। নতুন কালো সোমবারের রেশ এখনো কাটেনি। এর প্রভাবে সারা বিশ্বে পুঁজিবাজারের নিত্য ওঠানামা লেগেই আছে। কবে তা থামবে, পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারছে না।
পুঁজিবাজারের ওই ধস নতুন করে ধাক্কা দিয়েছে মুদ্রাবাজারকে। জ্বালানি তেলের দামও কমে হয়ে গেছে সাড়ে ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, ২২ ধরনের পণ্য নিয়ে যে পণ্যসূচক ব্লুমবার্গ করে, সেটিও এখন ১৯৯৯ সালের পর সর্বনিম্ন। সোনার দাম আরেক দফা কমেছে। কেবল লাভে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি যেসব সরকারি বন্ড বাজারে ছেড়েছে সেগুলো। সামগ্রিকভাবে ১১ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ব পুঁজিবাজার থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ স্রেফ বাতাসে হাওয়া হয়ে গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এর শেষ কোথায়? বিশ্ব অর্থনীতি কি আবার একটি দীর্ঘস্থায়ী মন্দার দিকে যাচ্ছে? অনেক কিছুই নির্ভর করছে বড় বড় অর্থনীতির নীতিনির্ধারকদের ওপর। তবে অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকেরা কিন্তু আশাবাদী। তাঁরা মনে করেন, অর্থনীতি মন্দার দিকে যাবে না। কারণ, চীনের স্টক মার্কেট সাংহাই কম্পোজিট সূচক কমলেও এটাও মনে রাখতে হবে যে গত এক বছরে এটি বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। সুতরাং বাজার সংশোধনের একটি সুযোগ ছিলই। আবার শেয়ার বা বন্ডের মতো কাগজের তুলনায় চীনা বিনিয়োগ বেশি সম্পদের বাজারে, যা এখনো স্থিতিশীল। এর আগে এশিয়ায় সংকট দেখা দিয়েছিল ১৯৯৭ সালে। প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট-এর বিশ্লেষণ হচ্ছে, সে সময়ের তুলনায় দেশগুলোর সরকারেরা এখনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে। দেশগুলোর মুদ্রার মজুত অনেক ভালো, বিনিময় ব্যবস্থাও আগের চেয়ে অনেক বেশি ভাসমান। ব্যাংকিং খাতও ভালো অবস্থায় আছে। ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ এখন খুবই কম। ফলে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির গোলমেলে অবস্থা হয়তো বেশি দিন আর থাকবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
এ রকম একটি আশাবাদ দিয়ে লেখাটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু তারপরেও কথা বাকি থেকে গেল। কারণ, সবার চোখ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বা দ্য ফেড-এর দিকে। ২০০৬ সালের পর এই প্রথম তারা সুদহার বাড়ানোর কথা বলছে। চলতি মাসেই তা করা হবে। সর্বশেষ তারা সুদহার বাড়িয়েছিল ২০০৬ সালের জুনে, ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরপর ২০০৮ সালের পর তা কমতে কমতে শূন্য থেকে দশমিক ২৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়। মনে করা হচ্ছে, ১৬-১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম দফায় সুদহার দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে আরও দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, টালমাটাল এই বিশ্ব অর্থনীতিতে ফেড অজনপ্রিয় এই কাজটি কেন করতে যাচ্ছে। তারা মূলত দুটি লক্ষ্য সামনে রেখে মুদ্রানীতি পরিচালনা করে। একটি হচ্ছে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান, অন্যটি স্থিতিশীল মূল্যস্তর। সাধারণত অর্থনীতি যখন দুর্বল থাকে, তখন মূল্যস্ফীতিও কমতে থাকে। আবার অর্থনীতি যখন সর্বোচ্চ কর্মসংস্থানের দিকে যায়, তখন মজুরি বাড়ানোর চাপ তৈরি হয় এবং এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। অর্থনীতি খুব দ্রুতগতিতে আগাতে থাকলে ফেড তার বেঞ্চমার্ক সুদহার বাড়িয়ে দেয়। তাতে মানুষ খরচ কমিয়ে দেয় এবং সঞ্চয় বেশি করে। এর ফলে অর্থনীতি একটু শ্লথ হয় এবং মূল্যস্ফীতির চাপ কমে যায়। আবার অর্থনীতি বেশি শ্লথ হয়ে গেলে ফেড তখন সুদহার কমিয়ে দেয়। যেমন ২০০৮ সালের মন্দার পর কমাতে কমাতে প্রায় শূন্য হারে নিয়ে আসা হয়েছিল।
দ্য ফেড মনে করছে, সময় হয়েছে সুদহার বাড়ানোর। মূল্যস্ফীতি যদিও এখন কম। তেলসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কম থাকায় হয়তো চাপটি কমই থাকবে। তবে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি যথেষ্ট চাঙা। ইকোনমিস্ট বলছে, গত ১২ মাসে ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ফেড মনে করছে, এখন সুদহার কম থাকায় মানুষ হয়তো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, যা ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। সুতরাং যেহেতু এখন মূল্যস্ফীতির চাপ কম, সুতরাং সুদহার অল্প বাড়ালেও তাতে বড় সমস্যা হবে না। এই যে ফেড এখন অর্থনীতি কিছুটা টেনে ধরতে চাইছে, তাতে কিন্তু বাকি বিশ্ব শঙ্কিত। এতে উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোর সমস্যা বাড়তে পারে। এতে পুঁজিপ্রবাহ কমে যাবে। ডলারের দাম এতে আরও বাড়বে, কমতে পারে পণ্যের দামও। সুতরাং চীনের হঠাৎ অবমূল্যায়নের হাত ধরে বিশ্ব অর্থনীতির যে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি, এখন দেখা যাক ফেডের সুদহার বৃদ্ধি তাকে কোথায় নিয়ে যাবে।