Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Messages - Mashud

Pages: [1] 2 3 ... 14
1
ছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিমানবাহিনী ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন অর্থশাস্ত্রের পড়াশোনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ার সময় যুক্ত হন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও। ১৭ বছর বয়সে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। পাকিস্তান সরকারের অধীনে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মোহাম্মদ নুরুল কাদের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাবনার জেলা প্রশাসক। এই সময়ে সরাসরি অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। খান সেনাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের অংশ হিসেবে নুরুল কাদের নিজের নাম থেকে ‘খান’ পদবিটি বাদ দেন। তাঁর

নুরুল কাদের, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
নুরুল কাদের, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
যুদ্ধকালীন গঠিত মুজিবনগর সরকারের তিনি ছিলেন সংস্থাপনসচিব। অতএব তিনিই বাংলাদেশের প্রথম সংস্থাপনসচিব। নুরুল কাদেরের স্বাক্ষরে বাংলাদেশ সরকার নামাঙ্কিত রাবার ট্যাম্প ব্যবহার করেই বাংলাদেশ সরকারের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়। ছিলেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের প্রথম চেয়ারম্যান। যদিও তখন সেটি ছিল পর্যটন ব্যুরো। নুরুল কাদেরই এটিকে করপোরেশনে রূপ দেন। বর্তমানে করপোরেশনের যে লোগোটি রয়েছে, সেটি সম্প্রতি প্রয়াত চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারকে দিয়ে করিয়েছিলেন তিনি।

স্বাধীন দেশে খুব বেশি দিন সরকারি চাকরি করা হয়নি তাঁর। ১৯৭৩ সালে ইস্তফা দিয়ে ব্যবসায় উদ্যোগী হন। শুধু পোশাকশিল্পের পথিকৃৎ নয়, বাংলাদেশের অনেক শুরুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নুরুল কাদেরের নাম। প্রথমে শুরু করেন ইনডেনটিং ব্যবসা। এরপর ছোটখাটো আরও কিছু ট্রেডিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন দেশের প্রথম তৈরি পোশাক রপ্তানির কারখানা ‘দেশ গার্মেন্টস’। তাঁর হাত ধরে শুরু হয় এ দেশে তৈরি পোশাকের বিদেশযাত্রা। বর্তমানে এ দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের, যার ভিত তৈরি করেছিল ‘দেশ গার্মেন্টস’।

আশির দশকের শেষ ভাগে এসে যুক্তরাষ্ট্র পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা চালু করে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের রপ্তানি সীমিত হয়ে পড়ে। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের উৎপাদন ও রপ্তানি। ওই সময় দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি করেন নুরুল কাদের।

দ্বিপক্ষীয় ওই চুক্তিতে বলা হয়, দাইয়ু করপোরেশনের হয়ে বাংলাদেশে পোশাক বানাবে দেশ গার্মেন্টস। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় কারখানা চালু করতে গিয়ে। কারণ এ দেশে তখনো পোশাক তৈরির দক্ষ কোনো জনবল ছিল না। আর তাই চুক্তি অনুযায়ী, কারখানা শুরু করতে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির জন্য এ দেশ থেকে কিছু লোককে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে শ্রমিক হিসেবে কাজের জন্য সংগ্রহ করা হয় ১৩৬ জন কর্মী, যার মধ্যে ১৬ জন ছিলেন নারী। এই ১৩৬ জনকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণে পাঠানো হয় কোরিয়ায়।

রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানায় কাজ চলছে।
বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মিবাহিনী তৈরির পরও দেশ গার্মেন্টসের যাত্রাটি মসৃণ ছিল না। উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে অর্থসংকটে পড়েন নুরুল কাদের। কারখানাটি শুরুর জন্য ১৮ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছিল ব্যাংক। কিন্তু কারখানা শুরু করতে গিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে পান মাত্র ২৪ লাখ টাকা। এ টাকায় কারখানা সচল রাখা ছিল প্রায় অসম্ভব। তখন নুরুল কাদেরের মাথায় আসে ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধার বিষয়টি। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ছিলেন এম নূরুল ইসলাম, যিনি ছিলেন নুরুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।তাঁরই সহায়তায় ব্যাক টু ব্যাক এলসি–সুবিধা চালুর ব্যবস্থা করেন। তাতেই টিকে যায় তাঁর ব্যবসা। কেবল ব্যাক টু ব্যাক এলসি নয়, বন্ডেড ওয়্যার হাউস, আমদানি প্রাপ্যতা বা ইউডি সনদ ইত্যাদি ব্যবস্থার ওপর ভর করে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। আর এসব ব্যবস্থাই চালু হয় নুরুল কাদেরের হাত ধরে।

১৯৯৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নুরুল কাদেরের সব স্বপ্নজুড়ে ছিল ‘দেশ’ আর এ দেশের তৈরি পোশাক খাত। বর্তমানে ‘দেশ গার্মেন্টস’ চলছে দেশ গ্রুপের অধীনে। যার চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন প্রয়াত নুরুল কাদেরের স্ত্রী রোকেয়া কাদের। আর একমাত্র পুত্র ওমর কাদের খান এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একমাত্র মেয়ে ভিদিয়া অমৃত খান পালন করছেন পরিচালকের দায়িত্ব। গ্রুপের পক্ষে দেশ গার্মেন্টসের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন বিদ্যা অমৃত খান।

দ. কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ চলাকালে তৈরি প্রথম শার্ট
দ. কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ চলাকালে তৈরি প্রথম শার্ট
নুরুল কাদেরের জন্ম ময়মনসিংহে। কিন্তু ‘দেশ’ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেছেন চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। চট্টগ্রামে কারখানা করার কারণ সম্পর্কে ভিদিয়া জানান, রপ্তানির ক্ষেত্রে বন্দর–সুবিধার কারণেই চট্টগ্রামে কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছিল। বর্তমানে ৯০০ শ্রমিক কাজ করেন এ গার্মেন্টস কারখানায়।

দেশের প্রথম রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস হলেও গত প্রায় ৪১ বছরে এটির উৎপাদন কার্যক্রমের তেমন একটা সম্প্রসারণ হয়নি। কারণ হিসেবে ভিদিয়ার অভিমত, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূল কারখানাটি। তখন কারখানার কার্যক্রম আগ্রাবাদে স্থানান্তর করা হলেও মূল কারখানাটি বন্ধ ছিল প্রায় পাঁচ বছর। ধাক্কা কাটিয়ে ১৯৯৬ সালে পুনরায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হলেও দুই বছরের মাথায় এসে ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে কারখানার স্বপ্নদ্রষ্টা মোহাম্মদ নুরুল কাদের মারা যান। আবারও ধাক্কা খায় প্রতিষ্ঠানটি। আর্থিকভাবে চরম দুর্দিনের পাশাপাশি নুরুল কাদেরের মৃত্যুর পরও কারখানাটি বন্ধ করেনি তারা। কারণ এটির সঙ্গে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ইতিহাস জড়িত। সব প্রতিকূলতা জয় করে এখন কারখানাটি একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এখন নতুন করে সম্প্রসারণে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।

দেশ গ্রুপের চেয়ারম্যান রোকেয়া কাদের বলেন, শুরুতে যেসব কর্মীকে কোরিয়ায় প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছিল তাঁদের অনেকে এখন নিজেরাই পোশাক খাতের উদ্যোক্তা।


2

প্রথম আলো: রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকের ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?

রুবানা হক: তিন মাস ধরে পোশাক রপ্তানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। আসলে যেটা হচ্ছে, বৈশ্বিক চাহিদায় একধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিদেশের ক্রেতারা বেছে বেছে কিনছেন, কম কিনছেন। তাঁরা ভ্যালু অ্যাডেড (মূল্য সংযোজন বেশি) পোশাক চাচ্ছেন। সেটির জন্য হয়তো আমরা এখনো প্রস্তুত না। তা ছাড়া ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠতেও আমাদের সমস্যা হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করব ও ব্যবসা কীভাবে বাড়াব, সেসব আমাদের ঠান্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করে সামনের দিকে এগোতে হবে।

প্রথম আলো: পোশাক খাতের বর্তমান সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য কী করা দরকার? এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে কি কোনো ধরনের সহায়তার প্রয়োজন আছে?

রুবানা হক
রুবানা হক
রুবানা: কিছু নীতিসহায়তা এখনই দরকার। কারণ আমাদের পণ্য বহুমুখীকরণে যেতে হবে। যাঁরা নতুন পণ্যে যাবেন কিংবা বেশি মূল্য সংযোজিত হয় এমন পণ্য উৎপাদন করবেন, তাঁদের প্রণোদনা দরকার। ক্ষুদ্র–মাঝারি কারখানারও সহযোগিতা দরকার। গত ৯ মাসে ৫৯টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়েছে। তাতে ২৯ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। যেহেতু অনেক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত, তাই এই শিল্পকে নিয়ে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে এবং দূরদর্শী হতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, যেসব রাজস্ব নীতি নেওয়া হচ্ছে, তা পোশাকশিল্পবান্ধব কি না? আশপাশের প্রতিযোগী সব দেশ ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। আমরা ধরে রেখেছি। এটি আমাদের একধরনের গর্ব। তবে আমাদের তো প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমাদের রপ্তানি আয়ের পুরোটার ওপর না দিলেও যেটুকু অর্থ দেশে থাকে, সেটির ওপর ডলারে ২ টাকা বেশি দেওয়া হতো তাহলেও একধরনের সমাধান আসত।

প্রথম আলো: যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে ভালো অবস্থানে পৌঁছেছেন, তাঁরা ভ্যালু অ্যাডেড বা বেশি মূল্যের পণ্য তৈরির দিকে যাচ্ছেন?

রুবানা: খুব অল্প। প্রথমে যখন শিল্পটি গড়ে ওঠে, তখন অনেকে কারখানা করে ফেলেছেন। ক্রয়াদেশেরও কমতি ছিল না। বৈশ্বিক চাহিদাও দ্রুত বদলাচ্ছিল না। এখন টেকসই পণ্যের দিকে সবাই নজর দিচ্ছে। সবাই এখন পরিবেশবান্ধব পণ্য চায়। সবকিছু মিলে চাহিদা বদলে গেছে। এটির জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। খুব যে হিসাব করে আমরা ব্যবসা বাড়িয়েছি, তা–ও না। সবাই ১০০–২০০ লাইনের কারখানা করে বসে আছি। তারপর একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নেমে গেছি, দাম কমানোর জন্য। সব মিলিয়ে আমরা সুখকর অবস্থায় নেই। এখনো সময় আছে, আমরা একটু ঘুরে দাঁড়াতে পারলে হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। চীন–যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে, তা থেকে আমাদের সুযোগ নেওয়ার কথা। তবে আমরা খুব কমসংখ্যক সেটি পারছি।

প্রথম আলো: ভাবমূর্তি–সংকটের কথা বলেছেন। রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত হয়েছে। এক শর বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা হয়েছে। তারপরও কেন আমরা ভাবমূর্তির উন্নতি করতে পারছি না?

রুবানা: অনেক কারণেই আমরা পারছি না। ইউরোপের সঙ্গে যা–ও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারছি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারতে কষ্ট হচ্ছে। একের পর এক নেতিবাচক খবর তারা প্রকাশ করছে। যেটি হয়, কোনো নেতিবাচক সংবাদ হলে আমরা চট করে উত্তরটা দিই না। অবশ্য এখন আমরা কাজটি করছি। ভাবমূর্তির উত্তরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি।

পোশাক কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা। ছবি: হাসান রাজা
পোশাক কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা। ছবি: হাসান রাজা

প্রথম আলো: আপনি অনেক চ্যালেঞ্জের কথা বললেন। সম্ভাবনার জায়গা কেমন?

রুবানা: যত চ্যালেঞ্জ থাকে, ততই সম্ভাবনা তৈরি হয়। আমাদের ইনোভেশনে (নতুন উদ্ভাবনে) যেতে হবে। পোশাকের ডিজাইনে ইনোভেশন আনতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে চলে যাচ্ছি আমরা। সেটির জন্য প্রস্তুতি দরকার। তবে এসবের জন্য তাগিদটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রতি সপ্তাহে আমরা পোশাক রপ্তানির তথ্য নিচ্ছি। সেখানে আমরা দেখছি, আউটারওয়্যার (জ্যাকেট) অনেক বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে পণ্যটি তৈরি করে হাতে গোনা কয়েকটি কারখানা। আমরা যে দেশে যাচ্ছি, সেখানেই দেখছি তাদের প্রধান ১০টি আমদানি পণ্যের সঙ্গে আমাদের সরবরাহের একটি বড় ফাঁক রয়ে গেছে। তাঁরা হয়তো কৃত্রিম সুতার (ম্যান মেড ফাইবার) পোশাক চাচ্ছেন, আমরা করছি তুলার। কৃত্রিম সুতার কাপড় তৈরি করতে হলে টেক্সটাইলে নতুন বিনিয়োগ দরকার। সেটি কি বিদেশি নাকি দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগ হবে, সেটি আমাদের স্পষ্ট করতে হবে। যেকোনো মূল্যেই কৃত্রিম সুতা ও কাপড় উৎপাদনে যেতে হবে। না হলে আমরা হারিয়ে যাব।

প্রথম আলো: পোশাকশিল্পের বয়স চার দশক হয়ে গেছে। তারপরও শ্রম ইস্যুতে দায়িত্বশীল আচরণ দেখা যাচ্ছে না। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে মজুরি নিয়ে শ্রম আন্দোলনের ঘটনায় মামলা ও কয়েক হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে পোশাকশিল্প বেশ চাপের মধ্যে আছে। শ্রম ইস্যুতে দায়িত্বশীল কবে হবেন মালিকেরা?

রুবানা: সব মামলা তুলে নেওয়া হবে। আমরা ছয় মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। শুরু থেকেই আমরা মামলার পেছনে লেগে আছি। আমরা চাই না কোনো মামলা হোক। এগুলো দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করে। ট্রেড ইউনিয়ন যাঁরা করেন, তাঁরা অনেক সময় বোঝেনও না ঠিকমতো। এখানে শিক্ষার একটি বিষয় আছে। তাঁদের সচেতন করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ওয়ার্কার রিসোর্স সেন্টার (ডব্লিউআরসি)। এটি হচ্ছে আইএলওর অধীনে এসডিআর প্রকল্পের একটি অংশ। পোশাক কারখানায় আট শতাধিক ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে। এগুলোর গুণগত মান নিয়ে আমি চিন্তিত। যাঁরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে আসছেন, তাঁদের একটি অংশ মনে করেন, কারখানায় ঢুকে বড় হইচই বাধাতে পারলেই তিনি বড় নেতা হয়ে যাবেন। সেটি যে ঠিক না, তা বোঝানোর দায়িত্ব ফেডারেশন নেতাদের। একটি কারখানায় ছয়টি ট্রেড ইউনিয়ন আছে, সেই উদাহরণ আমাদের দেশে আছে। সেখানেই সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়। কেন হবে? ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে তো তাদের একটি সম্মিলিত কণ্ঠস্বর আছে। তার মানে হলো, ভালো ট্রেড ইউনিয়নকে আমরা পুরস্কৃত করছি না। প্রণোদনা দিচ্ছি না। যেগুলো ভালো করছে না, তাদের পুঁজি করে আমরা মালিকেরা আবার বলছি, ট্রেড ইউনিয়ন আমাদের সমস্যা করছে। দুই দিকেই সমস্যা আছে। নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে, উভয় পক্ষের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য কাউন্সেলিং করা দরকার।

3
স্বল্পোন্নত দেশের অস্বস্তিকর তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমবেশি ৭ শতাংশ।সচল রয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকা।এসব অর্জনের পেছনে নেতৃত্ব, কর্মপরিকল্পনা, বিবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি যে একক শিল্প খাত সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে, তা হচ্ছে এ দেশের তৈরি পোশাকশিল্প।

অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা আর প্রয়োজনীয় পোশাকের অপ্রাপ্যতার কারণে তিন-চার দশক আগেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মানুষ (বিশেষত পুরুষ) খালি গায়ে ঘুরে বেড়াত। শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের অনেকেই শীতের পোশাক হিসেবে বিদেশ থেকে বস্তায় করে আনা অনেকটা জীর্ণ, পুরোনো পোশাকের অপেক্ষায় থাকত। এসব আমরা অনেকেই দেখেছি। গর্ব করেই বলতে পারি, সেই বাংলাদেশের চেহারা আজ অনেকটাই পাল্টে গেছে। দেশের ক্রমবিকাশমান বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের অব্যাহত অগ্রযাত্রার ফসল হিসেবে আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কাউকে খালি গায়ে ঘুরতে দেখা যায় না। শহরেও সেই জীর্ণ পুরোনো শীতবস্ত্র কিনতে ভিড় করে না কেউ। সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের আধিপত্য। অনেক বড় বড় এবং প্রতিষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে।

 গত অর্থবছরে (জুলাই ’১৮ থেকে জুন ’১৯) বাংলাদেশ থেকে মোট ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাক সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। এ ছাড়া হোম টেক্সটাইলের বিভিন্ন খাতে ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা এবং ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকার তোয়ালে, ক্যাপ ও বিভিন্ন রকম কাপড় রপ্তানি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এটি ৩ লাখ কোটি টাকার ওপরে। গর্ব করার মতোই একটা পরিসংখ্যান।

তবে অগ্রযাত্রা বা আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর পথটা কিন্তু মোটেই মসৃণ ছিল না। আশির দশকের গোড়ার দিকে যখন পোশাক রপ্তানির যাত্রা শুরু হয়, তখন কিন্তু আমাদের কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছিল না। পোশাক তৈরির উপকরণ, যেমন তুলা, সুতা, কাপড়, রং, কেমিক্যাল, প্যাকিং সামগ্রী—এসবের কিছুই আমরা উৎপাদন করতাম না। মেশিনপত্র তো অনেক দূরের কথা। বিদেশি কিছু উৎসাহদাতা, কিছু নবীন তরুণ উদ্যোক্তার অদম্য উৎসাহ, অল্প শিক্ষিত এবং অদক্ষ কিছুসংখ্যক শ্রমিক—সব মিলিয়ে এই ছিল আমাদের সূচনাযাত্রার পুঁজি। ভাবা যায়, এ রকম একটা দল নিয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে হটিয়ে বাংলাদেশ তার জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বদরবারে।

প্রায় চার দশকের এই পথচলায় অনেক জানা-অজানা বেদনার কাহিনিও আছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনা, তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডসহ এর আগেও ঘটে যাওয়া অনেক দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের প্রাণহানির কথা আমরা সবাই জানি, যা আমাদের ব্যথিত করেছে। শোকগ্রস্ত করেছে পুরো জাতিকে। পাশাপাশি সবার অগোচরে অনেক উৎসাহী উদ্যোক্তা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এই ব্যবসার জটিল ও বিপজ্জনক বাঁক ঠিকমতো বুঝে না ওঠার কারণে, যার সর্বশেষ উদাহরণ মিরপুরের তরুণ পোশাক ব্যবসায়ী এস এম বায়েজিদ, যিনি সপরিবার আত্মহত্যা করেছেন মাসখানেক আগে।

বিদেশে পোশাক রপ্তানির ঢেউ স্থানীয় পোশাকের বাজারকেও প্রভাবিত করেছে এবং দেশের পোশাকবাজারও বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তিতে স্থানীয় বস্ত্র উৎপাদকেরা এখন অনেক আধুনিক বস্ত্র উৎপাদন করছেন। পাশাপাশি বিদেশি পোশাকের চাহিদা ও সরবরাহ—দুটোই বেড়েছে অনেক গুণে। রপ্তানির উদ্বৃত্ত বা ক্রয়াদেশ বাতিলের কাপড়গুলো আইনের ফাঁকফোকর গলে দেশের আপামর জনসাধারণের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। অনেক নামীদামি ব্র্যান্ডের পোশাক এখন ক্রেতারা কিনতে পারছেন কম মূল্যে। এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ব্র্যান্ডের নকল পণ্য বাজারজাত করছেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধমূলক যে কাজের কথা প্রায়ই শোনা যায়, তা হচ্ছে বন্ড লাইসেন্সের বিপরীতে রপ্তানির জন্য কাপড় বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় এনে স্থানীয় কালোবাজারে তা বিক্রি করে দেওয়া। যদিও অমন অসাধু কারবারির সংখ্যা খুবই সামান্য।

তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। ছবি: হাসান রাজা
তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। ছবি: হাসান রাজা
১৬ কোটি মানুষের দেশে স্থানীয় পোশাকের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বাজারে দেশীয় পোশাকের অবস্থান কতটুকু, তা নিয়েও একটা মিশ্র ধারণা আছে। পুরুষ ও নারীদের অন্তর্বাস, লুঙ্গি, টি-শার্ট, সুতি শাড়ি, সুতি সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি—এসব ক্ষেত্রে দেশীয় পোশাকের একচেটিয়া প্রাধান্য থাকলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন শার্ট, প্যান্ট, সিনথেটিক শাড়ি ও সালোয়ার কামিজ ইত্যাদি পোশাক বা পোশাকের কাপড় বিপুল পরিমাণে বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে।একসময়ের দুই ঈদভিত্তিক পোশাকের বাজার এখন প্রায় সারা বছরই কমবেশি জমজমাট থাকে। পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক পোশাকের কেনাকাটা ঈদুল আজহাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কয়েক কোটি সচ্ছল মানুষের এই বাজার কিন্তু অনেক উন্নত দেশের বাজারের চেয়েও বেশ বড়। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাস্তবায়িত হলে এ পোশাকের বাজার আরও বিস্তৃত হবে, তা দখলে নেওয়ার জন্য অনেক দেশই আগ্রহী হয়ে উঠবে। স্থানীয় উদ্যোক্তা বা উৎপাদকেরা যদি এ বাজার দখলের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেন, তাহলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় করা সম্ভব। স্থানীয় বেশ কিছু তৈরি পোশাকের ব্র্যান্ড এখন বাজারে আসছে, যা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। যেসব ব্র্যান্ড ইতিমধ্যে বাজারে এসেছে, তারা দেশব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেয় এবং নতুন আরও কিছু উদ্যোক্তা যদি এই কাতারে শামিল হয়, তবে স্থানীয় পোশাকের এই আকর্ষণীয় বাজারে বিদেশি কাপড়ের বর্তমান আধিপত্য অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই একটি বড় সুসংবাদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

এবার আসা যাক আমাদের অত্যন্ত সফল ও বিপুল সম্ভাবনাময় পোশাক রপ্তানি খাতের আগামীর পথচলার কথায়। যেটা শুরুতেই বলেছিলাম, বিগত অর্থবছরের শেষ (জুন ২০০৯) পর্যন্ত রপ্তানির চেহারাটা ছিল খুবই জ্বলজ্বলে, কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই রপ্তানির সেই ঊর্ধ্বগতিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে এবং রপ্তানিকারকেরা তাঁদের হাতের বর্তমান ক্রয়াদেশ বিশ্লেষণ করে বলছেন, অন্তত আগামী কয়েক মাস এই ভাটা অব্যাহত থাকবে। কেউ কেউ মনে করছেন, এ মন্দাভাব বেশ দীর্ঘায়িত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এর আগে আমরা এই উত্থান–পতন মোকাবিলা করেছি বেশ কয়েকবার। বিশেষ করে ২০০১ সালে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার হামলা, ২০১০ সালে সুতার দাম বিশ্ব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া, ২০১৫ সালে ইউরোর দাম রেকর্ড পরিমাণ কমে যাওয়ায় আমাদের রপ্তানি বড় ধরনের টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। এমনকি ২০১৩ সালের রানা প্লাজার ভয়াবহ বিপর্যয়–পরবর্তী সময়েও আমাদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। সুখের বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা সরকার, শ্রমিক, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে গেছেন ওই সব প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে।

চলমান যে সংকট, তা মূলত ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে পোশাক বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং আমাদের একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বীর নতুন করে বাজারে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার প্রচেষ্টার যৌথ ফলাফল। এই অবস্থা খুব বেশি দীর্ঘায়িত হবে না বলেই ধারণা করছি; তাই এ নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবে সন্তুষ্ট চিত্তে বসে থাকারও কোনো উপায় নেই। চীন যেমন অর্থনৈতিক উন্নতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পোশাক রপ্তানির বাজার হারাচ্ছে, যা আমাদের জন্য সুখকর, কিন্তু অন্যদিকে ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়ার মতো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো নিজেদের আরও কার্যকর ও প্রতিযোগিতমূলক করার নানা কৌশল অবলম্বন করছে। আবার মিয়ানমার, ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কারের মতো নতুন নতুন দেশ আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যতে যে আমাদের আরও বড় প্রতিযোগিতায় শামিল হতে হবে, তা বলাই বাহুল্য। তা ছাড়া কোনো চূড়ায় যখন আপনি উঠতে চাইবেন, তখন যত এগোবেন, তত বড় চ্যালেঞ্জ আপনাকে মোকাবিলা করতে হবে; সেটা খুবই স্বাভাবিক।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনা–পরবর্তী সময়ে আমাদের পোশাকশিল্প যে বড় ধরনের ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছিল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা আজ আমরা শুধু কাটিয়েই উঠিনি, বরং অন্য সব দেশের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে আছি। অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্সের উদ্যোগ, উদ্যোক্তাদের অভূতপূর্ব পদক্ষেপ, সরকারসহ অন্যদের সহায়তায় কারখানাগুলোর সামগ্রিক নিরাপত্তামূলক পরিবেশ এখন শুধু অনেক উন্নতই নয়, সম্ভবত তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো। এর সঙ্গে গত পাঁচ বছরে সবুজ কারখানা নির্মাণের যে বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছি, তা আমাদের সারা বিশ্বে নতুন মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। আন্তর্জাতিক মানের সবুজ কারখানার সংখ্যায় আমরা শুধু শীর্ষ অবস্থানই দখল করে আছি, তা নয়, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দেশটির তুলনায় আমাদের সবুজ কারখানার সংখ্যা ছয়-সাত গুণ বেশি।

কিন্তু দুঃখের কথা হলো, এসব ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় অর্জনের কোনো ধরনের ব্র্যান্ডিং আমরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে করতে পারিনি। ফলে এখনো বাংলাদেশের নামের সঙ্গে রানা প্লাজা কিংবা তাজরীন ফ্যাশনসের নাম যতটা উচ্চারিত হয়, সে তুলনায় আমাদের প্রশংসনীয় অর্জনগুলো অনেকটা আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে। সরকার, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ যৌথভাবে দ্রুততার সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক শিল্পের এই ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং করতে পারলে চলমান এবং ভবিষ্যতের শক্ত প্রতিযোগিতার বাজারে তা আমাদের জন্য ব্যাপক সুফল বয়ে আনবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা উদ্যোগ নিলে বিদেশি অনেক বন্ধুরাষ্ট্র এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা তাদের হাত প্রসার করবে বলেই দৃঢ়বিশ্বাস।

আরও একটা বড় ভয়ের কথা ইদানীং বিভিন্ন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে, তা হলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০। রোবটনিয়ন্ত্রিত কারখানা গড়ে পোশাকশিল্প আবার পশ্চিমা দুনিয়ায় ফেরত যাবে, কিংবা এ বিপ্লবের জোয়ারে আমাদের লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন ইত্যাদি। আলোচনার ব্যাপ্তিটা অনেক বড়, যা নিয়ে আলাদা একটি দীর্ঘ রচনা তৈরি করা দরকার, তবে সংক্ষেপে এটুকুই বলতে পারি, ওপরে বর্ণিত বিভিন্ন রকমের আপদ বা বিপদের আপাতত কোনো আশঙ্কা নেই। প্রযুক্তির উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং তাতে বিগত দিনগুলোয় আমাদের কারখানাগুলোও বিশ্বমানের আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের করেছে সদা প্রস্তুত। এতে আমাদের শিল্পের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিতই হয়েছে, কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। ভবিষ্যতের দিনগুলোয় এর ব্যতিক্রম হবে না বলেই বিশ্বাস রাখতে চাই। তবে এ ক্ষেত্রে আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং এই জায়গায় আমরা এখনো বেশ পিছিয়ে আছি বলতে হয়। শিক্ষাবিষয়ক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে শিল্পের বিজ্ঞজনদের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রুত এ ব্যাপারে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। এতে শুধু আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাই সহজ হবে না, বরং দক্ষ জনশক্তির ক্ষেত্রে বিদেশিদের ওপর আমাদের যে নির্ভরতা বিদ্যমান, তা–ও অনেকটা কমে আসবে। ফলে মূল্যবান প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক স্থানীয় লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।

শেষ করতে চাই সরকারি সহায়তা আর ভবিষ্যতের কর্মকৌশলের কথা বলে। সরকার বরাবরই তৈরি পোশাকশিল্পকে বিশেষ সমর্থন দিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। পাশাপাশি আমরা প্রায়ই বলি, আগামী এত বছর পর ৫০ বিলিয়ন বা ১০০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করব, কিন্তু কীভাবে তা অর্জন করতে পারব, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কৌশল বা কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়নি বলে কা​ঙ্ক্ষিত সময়ে ঘোষিত অর্জন সম্ভব না হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল। ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারের অনিশ্চয়তা, তীব্রতর প্রতিযোগিতা সামনে রেখে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন সময়ের দাবি। পাশাপাশি সরকারি সহায়তাকে এই কর্মপরিকল্পনায় কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করাটাও অত্যন্ত জরুরি। যেমন আমরা জানি না, ছয় মাস পর গ্যাস বা বিদ্যুতের দাম কেমন হবে। আমরা জানি না, আগামী বাজেটে উৎসে কর কত নির্ধারণ করা হবে, আর তা নিয়ে কত দিন দেনদরবার অব্যাহত থাকবে ইত্যাদি। অর্থাৎ যেসব বিষয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে একটি মূল্য বা হারে নির্ধারণ করে দেওয়া। সব মিলিয়ে যদি নীতিনির্ধারক ও শিল্পের নেতৃস্থানীয় লোকজন যৌথভাবে আগামী ৫ বা ১০ বছর মেয়াদি একটি সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে আমাদের কর্মঠ ও নিবেদিত শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে নবীন-প্রবীণ উদ্যোক্তারা এ দেশের পোশাকশিল্পের পতাকাকে নিয়ে যেতে পারবেন সবার ওপরে। এ দেশের তৈরি পোশাক রাজত্ব করবে সারা বিশ্বে, যা হবে আমাদের লাল-সবুজের গর্ব আর বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’।

 

4
স্বাধীন বাংলাদেশে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ১৯৭৩ সালে। কারণ, এ বছরেই জন্ম ফ্যাশন হাউস নিপুণের। সেই হিসাবে এই ইন্ডাস্ট্রি পেরিয়েছে সাড়ে চার দশক।

এরপর এই ইন্ডাস্ট্রির উল্লেখযোগ্য —১৯৭৮ সালে মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটির (এমসিসি) একটি প্রকল্প হিসেবে আড়ংয়ের জন্ম। ১৯৮০ সালে এসে ব্র্যাকের তত্ত্বাবধানে আড়ংয়ের একক পথচলা শুরু। এই দশকেই লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড হিসেবে সাড়া জাগায় আড়ং। আশির মাঝামাঝি পুরুষদের পশ্চিমা পোশাকের এদেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে বিপ্লব ঘটায় ক্যাটস আই। তবে আরও একটা ব্র্যান্ড দপ করে জ্বলে উঠে নিভে যায়—পিয়ারসন্স। আশির দশকে ঢাকার ফ্যাশন স্ট্রিট বলতে ছিল নিউমার্কেট ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে এলিফ্যান্ট রোড আর শাহবাগ। আর টেইলারিংয়ের জন্য ছিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। গ্রিন রোড, পল্টন, ফকিরাপুল, মিরপুর রোডেও কিছু টেইলারিং শপ ছিল ছেলেদের জন্য। এই সময়ে বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল ফ্যাব্রিক হাউস এবং বিজয়নগরের গ্যাঞ্জেসের। এ ছাড়া কারিকা ও ভূষণেরও ছিল সুনাম।

আশির দশকের শেষ দিকে টাঙ্গাইল শাড়ী কুটির আর তারই অনুসরণে কণিষ্ক দেশীয় শাড়ির হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে আরও বেগবান করে নব্বইয়ের দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় কে ক্র্যাফট, অঞ্জন’স, ওজি, রঙ (বর্তমানে দ্বিধাবিভক্ত)।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্প খাত থেকে দেশীয় ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম পা রাখে অধুনালুপ্ত সোলডান্স। এরপর অনেক হাউস এসেছে এই ধারাবাহিকতায়।

আশা জাগাচ্ছে িডজাইনার কালেকশন।
তবে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি যে খুব একটা পরিকল্পনা করে শুরু হয়েছে, তা নয়। কিংবা শুরুর দিকে যারা এসেছিল, তারাও পরিকল্পনা করে আসেনি; বরং পরিকল্পনা করে আসা পিয়ারসন্স হালে পানি পায়নি। সেই হিসেবে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. একেবারেই শখের বশে আসা। তবে সময়ের সঙ্গে পেশাদারত্বকে গ্রহণ করা। দুই. পূর্বসূরিদের অনুসরণ করা। এঁদের মধ্যে হুজুগে মেতেছেন অনেকে। আবার অনেকে এসেছেন পরিকল্পনা করেও। এবং তিন. তৈরি পোশাক খাতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, সঠিক পরিকল্পনা করে সম্ভাবনাময় বাজারে পা রাখা ব্র্যান্ড।

দেশীয় কাপড়কে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে এই ইন্ডাস্ট্রি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বিপরীত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। কারণ, বিশ্বের সর্বত্রই পোশাক সংগ্রহ মৌসুমকেন্দ্রিক, আর আমাদের এখানে উৎসবভিত্তিক। আর বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন করে বিত্তশালীরা । কিন্তু আমাদের দেশে এই ইন্ডাস্ট্রি প্রথম থেকেই মধ্যবিত্তকে ফ্যাশনেবল করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছে।

এদিকে ২০০০ সাল থেকে ক্রমেই বদলাতে থাকে বিশ্ব; বিশেষত ইন্টারনেট আমূল পাল্টে দেয়। ভুবনায়নের এই নতুন জোয়ারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রয়াস থাকলেও আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এখনো পুরোপুরি অভিযোজিত হয়ে উঠতে পারেনি।

তবে নানা চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও এই ইন্ডাস্ট্রি একটা অবস্থান তৈরি করে নিতে পেরেছে। শিল্প খাতের মর্যাদা অর্জনেরও চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে এই ইন্ডাস্ট্রিকে আরও গতিশীল করার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত হ্যাপেনিংয়ের; পাশাপাশি বিদেশি পোশাকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পোশাক তৈরি করা। তাহলে বিদেশি পোশাকের আগ্রাসন বন্ধ হওয়া সম্ভব।

উৎসবে কেনাকাটা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
উৎসবে কেনাকাটা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ফ্যাশন হাউসগুলো দেশের বড় শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) তথ্য অনুযায়ী অন্তত এক কোটি মানুষ নানাভাবে এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সারা দেশে ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফ্যাশন হাউস রয়েছে। আর এই শিল্প খাতের বার্ষিক টার্নওভার ৮ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এই খাত থেকে সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রাজস্বও পাচ্ছে।

বাংলাদেশের ফ্যাশন উৎসবকেন্দ্রিক হওয়ায় এর টার্নওভারের চিত্রটা বেশ আকর্ষক। রোজার ঈদে সবচেয়ে বেশি আয় হয়ে থাকে ফ্যাশন হাউসগুলোর। বার্ষিক টার্নওভারের ৪০ শতাংশ আসে এই সময়ে। এরপর ২০ শতাংশ আসে বৈশাখের সময়ে। বাকি ৪০ শতাংশ বিক্রি হয় বছরের বাকি সময়ে।

বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক সংখ্যায় বেশি বিক্রি হলেও অর্থাগম হয়ে থাকে তুলনামূলক কম। বছর পাঁচেক আগেও কোরবানির ঈদে বিক্রি ছিল বেশ আশাব্যঞ্জক। তবে এই ট্রেন্ড বদলে গিয়ে শীতের বিক্রি এখন অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি নতুন উপলক্ষ হয়েছে ফাল্গুন।

ফ্যাশন ক্যাটওয়াক। ছবি: হাসান রাজা
ফ্যাশন ক্যাটওয়াক। ছবি: হাসান রাজা
বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির কল্যাণে দেশীয় তাঁতজাত পণ্যের উৎকর্ষ বেড়েছে। নিয়মিত পরা না হলেও শাড়ি বিক্রি বেড়েছে। নতুন নতুন নিরীক্ষা হচ্ছে বয়নে। উন্নতি হয়েছে জামদানি বয়নশিল্পে। বাংলাদেশের তাঁত কাপড়ের মান আরও উন্নত করার অবকাশ থেকে গেছে। তা করা সম্ভব হলে এই পোশাকের চাহিদা আরও বাড়বে।

বাংলাদেশে ডিজাইনারস কালেকশনও এখন অনেক হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ব্র্যান্ড। সমাজের বিভিন্ন বৃত্তের আর বিত্তের মানুষ ফ্যাশনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে তারা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তরুণ। এঁরা প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বনাগরিক। এঁরা সব সময়ই সময়ের সঙ্গে থাকেন। আন্তর্জাতিক বাজার আর ট্রেন্ড সম্পর্কে অধিক অবগত তৈরি পোশাকশিল্প খাত থেকে দেশীয় ফ্যাশনে আসা ব্র্যান্ডগুলোর দিকে তাই বেশি ঝুঁকছেন এই তরুণেরা।

১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের গণ্ডি ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে উচ্চবিত্তের সংখ্যা। ফলে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনা দিন দিন উজ্জ্বল হচ্ছে। দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণের যথেষ্ট সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে অন্য কোনো বাজার ধরার প্রয়োজন হবে না। অবশ্য এ জন্য প্রয়োজন হবে সমসময়ের চাহিদা অনুসরণ করে সম্ভাবনাময় দেশীয় বাজারের সুফল তোলা। বিদেশি পোশাকের আগ্রাসন প্রতিরোধে এই সাফল্যই হবে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বর্ম।

5
Textile Engineering / দেশজুড়ে কাপড়ের হাট
« on: November 06, 2019, 03:27:29 PM »
বাংলাদেশ বস্ত্র বয়ন বা কাপড় বোনার জন্য সুবিদিত। বিশ্বব্যাপী এর সুনাম রয়েছে কয়েক হাজার বছর ধরে। আগে বয়ন এলাকাগুলোয় স্থানীয়ভাবেই পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা ছিল। হাট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরে তা আরও সংহত হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়ন এলাকার এমন ১১টি আলোচিত হাট পর্যালোচনায় মেলে আমাদের দেশীয় বস্ত্র বাণিজ্যের আকর্ষক চিত্র। এই ১১টি হাটের সাপ্তাহিক টার্নওভার প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রতিটি হাটের আছে জন্মইতিহাস। হাটগুলোর বাণিজ্যিক ক্রিয়াকর্মে রয়েছে নিজস্ব রীতিনীতি, সংস্কৃতি। হাট বসে সাধারণত সপ্তাহে এক দিন। কিন্তু এ সব হাট সপ্তাহে তিন–চার দিনব্যাপীও চলে। হাটবারে ক্রেতা–বিক্রেতাদের এ মিলনমেলা বিশাল কর্মযজ্ঞে মুখরিত হয়ে ওঠে। আমাদের প্রতিবেদকদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তুলে ধরা হলো দেশের আলোচিত কাপড়ের হাটগুলোর সার্বিক চিত্র।

ডেমরা বাজার জামদানি হাট, ঢাকা

ডেমরা চৌরাস্তা থেকে উত্তর দিকে লতিফ বাওয়ানি জুট মিল সড়ক ধরে এগোলেই ডেমরা বাজার। এখানেই বালু নদের পাড়ে গড়ে উঠেছে ডেমরা বাজার জামদানি হাট। এখানে শাড়ি বিক্রি করেন রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আসা জামদানি বয়নশিল্পীরা। কথিত আছে, শীতলক্ষ্যার পূর্ব পারের মসলিন কারিগরেরা শীতলক্ষ্যা ও বালু নদ পার হয়ে ডেমরা বাজারে গড়ে তোলেন এই হাট। মসলিনের পাশাপাশি এখানে একসময় জামদানিও বিক্রি শুরু হয়। ধারণা করা হয়, এই হাটের বয়স ২০০ থেকে ২৫০ বছর। আবার কারও মতে, ৩৫০ বছরের পুরোনো।

দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এই জামদানির হাট শুক্রবার ভোর পাঁচটা থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত চলে। সারা দেশ থেকে ক্রেতারা এলেও ঢাকা, যশোর, খুলনা ও চট্টগ্রামের পাইকারদের সংখ্যাই বেশি। আবার দুর্গাপূজার আগে কলকাতাসহ ভারতের বেশ কিছু পাইকার এই হাট থেকে জামদানি নিয়ে যান তাঁদের দেশে। হাটবারে দোকানপ্রতি ৩২০ টাকা হারে রাজস্ব মেলে। তবে ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য হাটে নেই সুপেয় পানি ও শৌচাগারের ব্যবস্থা।

দেশের বিভিন্ন এলাকার কাপড়ের হাটের কেনাবেচার চিত্র। ছবি: প্রথম আলো
দেশের বিভিন্ন এলাকার কাপড়ের হাটের কেনাবেচার চিত্র। ছবি: প্রথম আলো

নোয়াপাড়া জামদানি হাট, রূপগঞ্জ

রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়ায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) জামদানি শিল্পনগরী ও গবেষণা কেন্দ্রের ভেতরে নোয়াপাড়া জামদানি হাট। স্থানীয় বয়নশিল্পীদের তৈরি জামদানির সহজ বাজার সৃষ্টির জন্য বিসিক জামদানি শিল্পনগরী ও গবেষণাকেন্দ্রের উদ্যোগে ২০০১ সালে এই হাটের প্রতিষ্ঠা। এ হাটে পাওয়া যায় বাছাই করা উন্নত মানের জামদানি। প্রতি শুক্রবারের ভোর পাঁচটা সকাল আটটা পর্যন্ত চলে। সপ্তাহে গড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ শাড়ি বিক্রি হয় এই হাটে, যার অর্থমূল্য ২৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা। বিসিকের হাট হওয়ায় জামদানির এই হাট থেকে আলাদা কোনো রাজস্ব আদায় হয় না।

কুমারখালী হাট, কুষ্টিয়া

তাঁতশিল্পে সমৃদ্ধ ছোট জনপদ কুমারখালীর অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তিই হচ্ছে বয়নশিল্প। দেড় শ বছর আগে কুমারখালী পৌর এলাকায় গড়ে ওঠে এই কাপড়ের হাট। প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত চলে। হাটের ৭৫ শতাংশ তাঁতিই কুমারখালী ও খোকসা এলাকার। তবে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ থেকেও আসেন বিক্রেতারা।প্রতি হাটে কমপক্ষে চার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। আর ইজারা থেকে প্রতিবছর পৌরসভা পায় প্রায় পৌনে আট লাখ টাকা। পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা আশানুরূপ নয়, পাশাপাশি নেই আবাসিক হোটেল।

পোড়াদহ হাট, কুষ্টিয়া

প্রায় ৯০ বছরের পুরোনো কুষ্টিয়ার পোড়াদহ কাপড়ের হাট। এখানে সরু সরু গলির ভেতর ছোট ছোট দোকানে ঠাসাঠাসি করে রাখা শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও ছেলেমেয়েদের বাহারি পোশাক । হাটে প্রতি সপ্তাহে ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।

জেলার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ রেলওয়ে জংশনের সঙ্গেই প্রায় ১৫ বিঘা জমির ওপর ছোট ছোট ৬৩৪টি দোকান। আশপাশে ব্যক্তিমালিকানায় আরও ৩০ বিঘা জমির এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই কাপড়ের হাট। সেখানেও দোকানের সংখ্যা ৫৮০।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে এলাকার তৎকালীন সুতা ব্যবসায়ী নুরুদ্দীন, হাশেম আলীসহ কয়েকজন মিলে এ হাট প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কেনাবেচা হয়। শুক্রবারও কিছু হয়।

 পোড়াদহ বন্দর এলাকার এই হাট কুষ্টিয়ার বাইরের বিভিন্ন জেলার ক্রেতা-বিক্রেতাদের মিলনমেলা। হাটের ৯৫ ভাগ পণ্য দেশি। ৫ ভাগ থাকে বিদেশি। প্রতি হাটবারে কাপড়ের হাটে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি ও ব্যক্তিমালিকানা দোকানগুলোয় ৬০ কোটি টাকা কেনাবেচা হয়। এই কাপড়ের হাট থেকে প্রতিবছর গড়ে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৮ লাখ টাকা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য থাকার ভালো হোটেল নেই। ব্যাংক না থাকায় নগদ টাকা নিয়েও সমস্যায় পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের।

এনায়েতপুর হাট, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জের একটি বড় হাট এনায়েতপুর হাট। এই জনপদের বয়নশিল্পীরা তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে একসময় যেতেন যমুনাতীরের ঘাটাবাড়ি হাটে। এতে তাঁতিদের নানা অসুবিধা হতো।এলাকার পাঁচ ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয়দের তৈরি কমিটি জেলার এনায়েতপুরে এই হাট প্রতিষ্ঠা করে। হাটের বয়স প্রায় ৫০ বছর। এখানে তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও সুতা পাইকারি বিক্রি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুরু এই হাটের নাম সেই সময়ে দেওয়া হয় মুজিব হাট। হাট প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই হাটের দিন ক্রেতাদের বিনা মূল্যে গরুর মাংস-ভাত খাওয়ানো হতো। ফলে, অল্প সময়েই ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুরুতে কেবল শুক্রবার হাট বসলেও বর্তমানে সপ্তাহে চার দিন বসে।

বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্থানীয় বয়নশিল্পীরা সরাসরি তাঁত থেকে হাটে ওঠান শাড়ি ও লুঙ্গি। বৃহস্পতিবার শুধু বসে গ্রে লুঙ্গির হাট; শুক্রবার আসে প্যাকেট করা শাড়ি ও লুঙ্গি; সঙ্গে সুতা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্য। হাটের সব পণ্য দেশি। সপ্তাহে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকার শাড়ি, লুঙ্গি এবং প্রায় ১০ কোটি টাকার অন্যান্য পণ্য বিক্রি হয়। জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে হাট ইজারা হয়। এ বছর সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। হাটে পানি জমে, বৃষ্টি হলে ব্যবসায়ীদের বসার ঘরগুলোয় পানি পড়ে। কোনো শৌচাগার নেই।

শাহজাদপুর হাট, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জের আরেকটি বড় হাট শাহজাদপুর হাট। স্থানীয় তন্তুবায়রা একসময় যেতেন ঘাটাবাড়ি হাট ও পাবনার আতাইকুলা হাটে। স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা পায় শাহজাদপুর হাট। এ হাটে মূলত পাইকারি বিক্রি হয় তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, থ্রি-পিস, রং ও সুতা। সপ্তাহে চার দিন হাট বসে—শনি, রবি, মঙ্গল ও বুধবার।

সপ্তাহে ২০ কোটি থেকে ৩০ কোটি টাকার শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, থ্রি-পিস এবং প্রায় ২৫ কোটি টাকার রং ও সুতা বিক্রি হয়।

শাহজাদপুর পৌরসভা এই হাট ইজারা দিয়ে বছরে প্রায় এক কোটি টাকা পায়।

সোহাগপুর হাট, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সোহাগপুর হাট প্রায় প্রায় ৬৫ বছরের পুরোনো। একসময় উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে প্রতি বুধবার হাট বসত। ১৯৮৫ সালে গোটা সোহাগপুর এলাকা যমুনাগর্ভে বিলীন হলে হাটটি স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমানে উপজেলার মুকন্দগাতী এলাকার বেলকুচি সরকারি কলেজ এলাকায় সোম, মঙ্গল ও বুধবারে বসে। সোম ও মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার বয়নশিল্পীদের তৈরি রেডিমেড শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা বিক্রি হয়। বুধবার সুতা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি হয়। সপ্তাহে দুই দিন প্রায় ১৪ কোটি টাকার শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি হয়। বেলকুচি পৌরসভার তত্ত্বাবধানে হাটের ইজারা বাবদ সরকার এ বছর ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা রাজস্ব পেয়েছে।

বাজিতপুর হাট, টাঙ্গাইল

বাজিতপুর বটতলায় শুক্র ও সোমবার বসে বাজিতপুর শাড়ির হাট। ভোরে শুরু হয়ে সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এই হাটের মূল পণ্য তাঁতের শাড়ি। বাজিতপুরের আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম বহুকাল থেকেই তাঁতপ্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। অন্তত ১০০ বছর আগে গড়ে ওঠে এই হাট। বাজিতপুর হাটে মূলত টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বিক্রি হয়। ২০ থেকে ২৫ হাজার পেটি (প্রতি পেটিতে ৫টি শাড়ি থাকে) শাড়ি এখানে বিক্রি হয়। শাড়ি তৈরির সুতা, তাঁতের বিভিন্ন উপকরণও বিক্রি হয়।

করটিয়ার হাট, টাঙ্গাইল

ধারণা করা হয়, ব্রিটিশ আমলে করটিয়ার জমিদার পন্নী পরিবার শতবর্ষী এ হাটের প্রতিষ্ঠা করে। আগে ছিল সাধারণ হাট। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এ হাটে শাড়ি, চাদর, লুঙ্গিসহ বস্ত্রের বাজার প্রসার লাভ শুরু করে। তখন মঙ্গলবার বিকেল থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত কাপড়ের হাটের প্রচলন করা হয়। বৃহস্পতিবার চলতে থাকে আগের মতোই সাধারণ হাট। কাপড়ের হাটে মূলত টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের তাঁতের শাড়ি, গামছা, থ্রি-পিস ও চাদর বিক্রি হয়। এ ছাড়া মিলের কাপড়, লুঙ্গি, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন বস্ত্রসামগ্রীও কেনাবেচা চলে। প্রতি সপ্তাহে ১০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। ঈদের আগে এ লেনদেনের পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ বছর হাটের ইজারামূল্য উঠেছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। তবে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ভালো না, সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়।

বাবুরহাট, নরসিংদী

দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি কাপড়ের হাট এই বাবুরহাট। অবস্থান প্রাচ্যের ম্যানচেস্টারখ্যাত নরসিংদীর শেখেরচর-বাবুরহাটে। ৭৯ বছর ধরে চলা এই হাট প্রথমে ছিল এক দিনের; বর্তমানে বসে সপ্তাহে তিন দিন—বৃহস্পতি থেকে শনিবার। তাঁতসমৃদ্ধ নরসিংদী ও এর আশপাশের বিভিন্ন জেলার উৎপাদিত কাপড় ও কাপড়জাত পণ্য বিক্রি হয় এই হাটে। রুমাল থেকে জামদানি পর্যন্ত কী নেই এখানে?

ইতিহাস বলছে, মাধবদীর গোপালবাবু, প্রসাদবাবু ও বিষাদবাবু নামের তিন জমিদার ভাই মাধবদীতে একটি হাট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁরা থাকতেন কলকাতায়, কিন্তু তাঁদের হয়ে খাজনা আদায় করতেন একজন ব্যবস্থাপক। ওই ব্যবস্থাপক হাটের খাজনা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন। খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে সেই সময় শেখেরচরের জমিদার হলধরবাবু, বালাপুরের জমিদার কালীবাবু ও স্বদেশি আন্দোলনের নেতা সুন্দর আলী গান্ধী মিলে একটি নতুন হাট প্রতিষ্ঠা করেন। পাইকারেরা বলতেন বাবুদের হাট। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এর নাম হয়ে যায় বাবুরহাট।

এই হাটে ব্যবসায়ীদের দিতে হয় না কোনো টোল বা খাজনা। শুধু ঘরমালিকেরা রাজস্ব জমা দেন সরকারি কোষাগারে। এ ছাড়া হাটের ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার দোকানে বিক্রি হওয়া সব কাপড়ই দেশে উৎপাদিত; বিদেশি কাপড় নেই বললেই চলে। দেশের নিত্যব্যবহার্য কাপড়ের চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ পূরণ করছে এই হাট। বছরজুড়ে প্রতি সপ্তাহে গড়ে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় ।

 উপযুক্ত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা না থাকায় টানা বৃষ্টি হলে হাটের অনেক দোকানে পানি উঠে যায়। পাইকারদের রাতযাপনের জন্য কোনো আবাসিক হোটেল নেই।

ফুলতলা হাট, খুলনা

খুলনার একটি ঐতিহ্যবাহী হাট ফুলতলা হাট। স্থল ও নদীপথে যোগাযোগ থাকায় ব্যবসায়ীরা দুই পথেই মালামাল আনা-নেওয়ার সুযোগ পান। এ কারণেই হাটের পরিসর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ধারণা করা হয়, এই হাটের বয়স ১২০ বছরের বেশি। হাট বসে রবি ও বুধবার। ফুলতলা হাটে প্রায় সব পণ্যই পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে গামছা তৈরি হয় বলে কাপড়ের মধ্যে মূলত গামছাই পাওয়া যায় বেশি।

ফুলতলা হাটের আয়তন প্রায় ১২ একর। ওই হাটের মধ্যে ২২টি (পানের হাট, সুপারির হাট, লতার হাট, মুরগির হাট, সবজির হাট) ছোট হাট রয়েছে। গত বছর ওই হাটের ইজারামূল্য ছিল ৭০ লাখ টাকা। এর ৩৫ শতাংশ হাটের উন্নয়নে খরচ করা হয়। কয়েক বছর আগে জাইকা প্রজেক্টের আওতায় হাটের রাস্তাঘাট ও চাঁদনির উন্নয়ন ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো হয়েছে। তবে প্রয়োজন পর্যাপ্ত লাইটিংয়ের ব্যবস্থা ও টয়লেট–সুবিধা। প্রতি হাটে সমাগম হয় লক্ষাধিক মানুষের।


প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন: নারায়ণগঞ্জ থেকে গোলাম রাব্বানী, কুষ্টিয়া থেকে তৌহিদী হাসান, সিরাজগঞ্জ থেকে আরিফুল গণি, টাঙ্গাইল থেকে কামনাশীষ শেখর, নরসিংদী থেকে প্রণব কুমার দেবনাথ ও খুলনা থেকে শেখ আল-এহসান।

6
‘পেটে ভাত পরনে কাপড়’—দুটোরই অভাব ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রায় শূন্য অর্থনীতির সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। গত প্রায় পাঁচ দশকে বাংলাদেশ অন্ন ও বস্ত্র—দুটি খাতেই সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। উন্মুক্ত বাণিজ্য এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উত্থান—এ দুই কারণে বস্ত্রশিল্প উঠেছে অনন্য উচ্চতায়। এর ফলে ‘পরনের কাপড়’–এর অভাব এখন আর নেই বললেই চলে।

জানা যায়, ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮০০ কোটি মিটার কাপড় প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ ১৭ কোটি মানুষ প্রতিবছর ৩০–৩৫ মিটার কাপড় ব্যবহার করে থাকেন। এই বিপুল পরিমাণ কাপড়ের চাহিদা পূরণ হয় হস্তচালিত তাঁত বা হ্যান্ডলুম এবং বিদ্যুচ্চালিত তাঁত বা পাওয়ারলুম—এই দুই শিল্পে উৎপাদিত কাপড় থেকে।

চাহিদার জোগান: হস্তচালিত তাঁত

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বস্ত্র উৎপাদনের জন্য হস্তচালিত তাঁত বা হ্যান্ডলুম হচ্ছে প্রাচীন শিল্প। এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বয়নশিল্পীরা হস্তচালিত তাঁতযন্ত্রে উৎপাদিত মোটা ও সূক্ষ্ম কাপড় দিয়ে সুদীর্ঘকাল থেকে অভ্যন্তরীণ কাপড়ের চাহিদা পূরণ করে আসছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করত এবং এখনো করে। এ সম্প্রদায়ের মূল কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের তাঁতযন্ত্রে মূলত সুতির কাপড় তৈরি করা। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বয়নশিল্পীরা হ্যান্ডলুমেই তৈরি করতেন এবং এখনো করেন রেশমের কাপড়। তাঁতিদের একাংশ নিজেরা বস্ত্র বিপণনের কাজে যুক্ত থাকলেও বিপণনের মূল কাজের জন্য ছিল আলাদা মানুষ। ঐতিহাসিক কাল থেকে তাঁত–অধ্যুষিত বিশাল জনপদে তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মানুষের জীবনযাত্রা এবং বাণিজ্যের নিজস্ব ধরন। একসময় বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বয়নশিল্পীরা দিল্লির মোগল দরবারে যেমন জোগান দিত সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়, তেমনি সাধারণ মানুষের জন্য জোগান দিত বিভিন্ন পরিধেয় বস্ত্র।দ্বিতীয় ধারাটি এখনো প্রবহমান। হস্তচালিত তাঁতশিল্প থেকে উৎপাদিত হয় মূলত মোটা ও সরু সুতির শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ধুতি, থ্রিপিসের কাপড়, ওড়না, সিল্কের কাপড়, থান কাপড়।

মডেল: জয়া আহসান , ছবি: কবির হোসেন
মডেল: জয়া আহসান , ছবি: কবির হোসেন
অতীতের মতো সংখ্যায় ‘বিপুল’ না হলেও এখনো বয়নশিল্পী সম্প্রদায় শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, থান কাপড় এবং হোসিয়ারি পণ্য তৈরি করে অভ্যন্তরীণ কাপড়ের মোট চাহিদার একটা বড় অংশের জোগান দিয়ে চলেছে। সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা; পাবনা সদর, চাটমোহর, হরিপুর; ঈশ্বরদী উপজেলার শত শত গ্রাম; টাঙ্গাইলের কালিহাতী, দেলদুয়ার, সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম; ঢাকা বিভাগের নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ইত্যাদি জেলার শত শত গ্রামসহ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় এই যন্ত্রচালিত তাঁতশিল্পের প্রতাপের যুগেও তৈরি হয় শাড়ি, লুঙ্গি, গামছাসহ বিভিন্ন ধরনের তাঁতবস্ত্র। হ্যান্ডলুমে তৈরি এই কাপড়ই ছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য। বাংলাদেশে বসবাসকারী মণিপুরি, চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতালসহ প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব বস্ত্রবয়নের ইতিহাস রয়েছে। এখন সীমিত হলেও একসময় প্রতিটি আদিবাসী সম্প্রদায় নিজেদের ব্যবহারের কাপড় নিজেরাই তৈরি করত। কারিগরি উন্নয়নের এ যুগে সেই ধারা পুরোপুরি না থাকলেও একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণের কাপড় আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো নিজেরাই উৎপাদন করে চলেছে। উপরন্তু বাংলাদেশের মূল বস্ত্র খাতে বৈচিত্র্যময় ফ্যাশনের অংশ হিসেবে কোনো কোনো আদিবাসী সম্প্রদায় জোগান দিয়ে চলেছে তাদের তাঁতবস্ত্র।

ফ্যাশন হাউস থেকে বিদেশে

বাংলাদেশের তন্তুবায় সম্প্রদায় আবহমানকাল ধরে মোটামুটি সব ধরনের কাপড় তৈরি করত। এগুলোর মধ্যে নিত্যব্যবহার্য কাপড়চোপড় যেমন ছিল, তেমনি ছিল মলমলখাস, শবনম ইত্যাদির মতো বিলাসী বস্ত্র। ছিল রেশম, জামদানির মতো দামি কাপড়। ছিল শীত নিবারণের মোটা বস্ত্র। একুশ শতকে এসে তাঁতযন্ত্রে তৈরি কাপড়ের বৈচিত্র্য বেড়েছে। শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, থান কাপড়ে সীমাবদ্ধ না থেকে নারীদের জন্য থ্রিপিসের কাপড়, ওড়না ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার হস্তচালিত তাঁতে। ঢাকার বিভিন্ন বুটিক হাউসসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এর বড় জোগান আসে নরসিংদী, কুমিল্লা ও সিরাজগঞ্জ থেকে। সীমিত পরিমাণ আসে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। এই ফ্যাশন হাউসগুলো বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শক্তিশালী স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে। অল্প কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাদের উন্নয়ন কাঠামোয় হস্তচালিত তাঁতযন্ত্র যুক্ত করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা অনুসারে তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের কাপড়। পরিধেয় বস্ত্র বাদেও বিছানার চাদর তৈরি হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অঞ্চল কুমারখালী ও নরসিংদী। তাঁতের কাপড় যে শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটায়, তা নয়। কিছু কিছু অঞ্চল থেকে তাঁতে তৈরি স্যুটের কাপড়, জাপানি নারীদের পরিধেয় কিমোনো, থান কাপড়, বিছানার চাদর ইত্যাদি সীমিত আকারে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। নরসিংদীর কিছু অঞ্চল এবং নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া রাজশাহী, নোয়াখালীসহ দেশের কয়েকটি শহরের কিছু এনজিও এ বিষয়ে কাজ করছে।

হস্তচালিত তাঁতবস্ত্রের হাটগুলোর দিকে নজর দিলে এবং উৎপাদিত কাপড়কে টাকায় হিসাব করলে তাঁতের কাপড় অভ্যন্তরীণ কত শতাংশ চাহিদা পূরণ করে, তা মোটামুটি বোঝা যাবে। বাংলাদেশের তাঁতের কাপড়ের পুরোনো হাটগুলোর মধ্যে অন্যতম কুষ্টিয়ার পোড়াদহের হাট। প্রায় শতবর্ষী এই হাটের বর্তমানে মাসিক বাণিজ্য কমবেশি ৪০০ কোটি টাকা এবং এই টাকার ৯০ শতাংশ আসে হস্তচালিত তাঁতের কাপড়, যেমন শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি থেকে। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে হস্তচালিত তাঁত ও তাঁতির সঠিক সংখ্যা এবং উৎপাদিত বস্ত্র অভ্যন্তরীণ চাহিদার কত শতাংশ পূরণ করতে পারে, তার সঠিক পরিমাণ জানা যায় না। তবে সরকারি তথ্য মেনে নিলে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় দেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্প এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষ ও পণ্য বিষয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৮ সালের তাঁতশুমারির ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে দেশে হস্তচালিত তাঁতশিল্পে কাজ করছে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ জন বয়নশিল্পী। আর ২০০৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৮৮ হাজার ১১৫ জন। তবে ১৯৯০ সালে সংখ্যাটা ছিল ১০ লাখ ২৭ হাজার ৪০৭ জন। এ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, বার্ষিক প্রায় ৮০০ কোটি মিটার অভ্যন্তরীণ চাহিদার কাপড়ের উল্লেখযোগ্য অংশের জোগান দেওয়া হস্তচালিত তাঁতশিল্পের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এটা খুব একটা আশার কথা নয় আমাদের জন্য।

হস্তচালিত তাঁত থেকে কলের তাঁত: চাহিদা ও জোগানের রূপরেখা

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ২৭ হাজার তাঁতসহ ১১টি তাঁতের কারখানা ছিল। পাকিস্তান আমলে কাপড়ের কারখানা বাড়েনি। অটোমেটিক তাঁতে সেসব কারখানায় তৈরি হতো কাপড়। কিন্তু মোট চাহিদার তুলনায় তা ছিল নগণ্য। বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে এ কারখানাগুলোর মালিকানা পেয়েছিল। এই ১১টি তাঁত কারখানা এবং লাখ লাখ হস্তচালিত তাঁতযন্ত্র সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কাপড়ের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করেছে প্রথম পর্বে। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের আরও পাওয়ারলুম কারখানা।

বিভিন্ন কারণে একদিকে হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা যেমন ধীরে ধীরে কমেছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যন্ত্রচালিত তাঁত বা পাওয়ারলুম শিল্প। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই তৈরি পোশাকশিল্প এখন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বড় অংশের জোগানদার। শুধু তা–ই নয়, এই শিল্প এখন দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত এবং সংগত কারণে এ খাত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় খাতগুলোর অন্যতম। বিটিএমএর তথ্য জানাচ্ছে, দেশে সবচেয়ে বেশি ৮০২টি মিল রয়েছে ওভেন কাপড় তৈরির জন্য। ৩২টি মিল ডেনিম তৈরির জন্য এবং হোম টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা ২২। ২০১৭ সালে ৭৯৬টি মিলে ৩৫৮ কোটি মিটার কাপড় উৎপাদিত হয়েছে বাংলাদেশে, যেখানে ২০১১ সালে উৎপাদিত কাপড়ের পরিমাণ ছিল ২১৫ কোটি মিটার। নিবন্ধিত মিলগুলোর বাইরেও বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ছোট ছোট মিল রয়েছে। যেগুলোতেও তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের কাপড়। এই মিলগুলো স্থানীয়ভাবে ওভেন, ডেনিম ও নিট কাপড় সরবরাহ করে থাকে। এই কাপড় থেকে স্থানীয়ভাবে তৈরি হয় শার্ট, প্যান্ট, দেশীয় জিনস, টি–শার্ট, নারী ও শিশুদের পোশাক। ধারণা করা যায়, গত প্রায় দুই বছরে দেশের মিলগুলোতে কাপড় উৎপাদনের পরিমাণ কিছুটা হলেও বেড়েছে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১৭ সালের উৎপাদিত সব কাপড়ই রপ্তানি হয়নি। এর একটা বড় অংশ দেশে ব্যবহৃত হয়েছে। রপ্তানিমুখী বড় মিলগুলোর বাইরে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার মিরপুর, আশুলিয়া, সাভার, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যে ছোট ছোট মিল রয়েছে, সেগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারে কাপড় সরবরাহ করে থাকে। এ ছাড়া রপ্তানি পোশাকের উদ্বৃত্ত অংশ দেশের চাহিদা মেটায়। এর পরিমাণও খুব কম নয়। সুতি, সিনথেটিক ও ব্লেন্ডেড—এই তিন ধরনের কাপড় তৈরি হয় দেশে। এগুলো দিয়ে বানানো হয় শার্ট, প্যান্ট, টি–শার্ট, পোলো শার্ট, বিভিন্ন ধরনের অন্তর্বাস, শিশু ও নারীদের পোশাক।

জোগানের অদৃশ্য কারিগর

নরসিংদী–সিরাজগঞ্জ–পাবনা–মানিকগঞ্জসহ হস্তচালিত তাঁত–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে হ্যান্ডলুমের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে পাওয়ারলুম কারখানা। দেশের বড় বড় রপ্তানিমুখী পাওয়ারলুম কারখানার পাশাপাশি এসব পাওয়ারলুম কারখানাতেও এখন তৈরি হচ্ছে সুতিসহ বিভিন্ন কাপড়। চিত্তরঞ্জন বা সেমি অটোমেটিক যে হস্তচালিত তাঁতগুলো একসময় তাঁতের কাপড় তৈরি করত, স্থানীয়ভাবে সেগুলোর উন্নয়ন ঘটিয়ে এসব অঞ্চলে পাওয়ারলুম কারখানা তৈরি হয়েছে। এসব কারখানায় তৈরি হয় শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা। হ্যান্ডলুমে তৈরি শাড়ি–লুঙ্গির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে পাওয়ারলুমে তৈরি এই শাড়ি ও লুঙ্গি দেশের মোট কাপড়ের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এখন। বলা চলে, অভ্যন্তরীণ শাড়ি ও লুঙ্গির মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশের জোগানদাতা ‘সেমি আরবান’ এলাকায় স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এসব পাওয়ারলুম কারখানা। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী বৃহৎ পাওয়ারলুম ইন্ডাস্ট্রিতে এই কারখানাগুলোর অবস্থান নিতান্ত গৌণ হলেও দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কাপড়ের জোগানদাতা হিসেবে এগুলোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এবং শীতপোশাক

তৈরি পোশাকশিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈচিত্র্যময় শীতবস্ত্র তৈরির হার। তবে বিদ্যুচ্চালিত তাঁতের প্রসারের কারণেই শীতবস্ত্র তৈরি বেশি হয় বা হচ্ছে—ব্যাপারটা সে রকম নয়। বাংলাদেশের মানুষ প্রথাগতভাবে শীত নিবারণের জন্য ব্যবহার করে চাদর। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হস্তচালিত তাঁতে চাদর তৈরি হতো একসময়। এ ছাড়া প্রথাগত হোসিয়ারি কারখানায় বহু আগে থেকেই তৈরি হতো মাফলার, মোটা উলের সোয়েটার, হাতমোজা এবং স্টকিং বা পায়ের মোজা। তবে এর পরিমাণ ছিল কম। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাধারণ মানুষ প্রবল শীতে পাটের তৈরি চট শীত নিবারণের জন্য ব্যবহার করে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিছুটা নকশা করা এ চট তৈরি হতো কোমর তাঁতে। উত্তরবঙ্গের এসব এলাকায় পাটের তৈরি চটের পাশাপাশি হস্তচালিত তাঁতে কম্বল ও চাদর তৈরি হয়। গত ২০ বছরে নওগাঁয় তৈরি হয়েছে গার্মেন্টসের ‘ঝুট’ থেকে মোটা সুতা বের করে সেই সুতায় চাদর তৈরির এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শীতবস্ত্রের চাহিদা মেটায় এসব চাদর। যন্ত্রচালিত কারখানার প্রসারের সূত্র ধরে শীতবস্ত্রে ঢুকে পড়েছে বৈচিত্র্য। এখন দেশের বিভিন্ন পাওয়ারলুম কারখানায় তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের বৈচিত্র্যময় জ্যাকেট, সোয়েটার, চাদর এবং শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার বিশেষায়িত পোশাক। প্রথাগত মাফলারের জায়গায় তৈরি হচ্ছে ফ্যাশনেবল স্কার্ফ। এ ছাড়া ফ্যাশনেবল শীতের পোশাকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে চামড়াশিল্পের। তরুণদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত নীল জিনসের সঙ্গে মানানসই চামড়ার জ্যাকেট, চামড়ার দস্তানা।

বাংলাদেশ মূলত আবহমানকালের সমৃদ্ধ বস্ত্রশিল্পের সার্থক উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। হস্তচালিত তাঁতশিল্প এ দেশের বস্ত্রশিল্পের বনিয়াদ মজবুত করেছে শত শত বছর ধরে। সেই মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক প্রযুক্তির বিদ্যুচ্চালিত তাঁতশিল্প। এ ঘটনা তৈরি করেছে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের এক ধারাবাহিক ইতিহাস। এই ইতিহাসের হাত ধরে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বিশ্ব পোশাক খাতের অন্যতম জোগানদার।


7
পরিব্রাজক টাভারনিয়ার লিখেছেন, ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহম্মদ আলী ভারতবর্ষ থেকে দেশে ফেরার সময় সম্রাটের জন্য অনেকটা উটপাখির ডিমের মতো একটি নারকেলের খোল নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা খোলার পর দেখা গেল, এর ভেতর রয়েছে ৬০ হাত দীর্ঘ ঢাকাই মসলিন। সে সময় একটি সরু আংটির ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ৩ গজ প্রস্থ ও ২০ গজ দৈর্ঘ্যের কাপড় টেনে নেওয়া যেত—এমন গল্প প্রচলিত আছে। এসব কিংবদন্তির সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা দুরূহ। কিন্তু একটা বিষয় বেশ স্পষ্ট—বাংলার মসলিন এমন এক উৎকর্ষে পৌঁছেছিল, যা প্রায় অবিশ্বাস্য!

 প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ড যেসব কারণে পৃথিবীব্যাপী আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিল, তার অন্যতম প্রধান হলো বয়নশিল্প। খ্রিষ্টপূর্বকাল থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত কালপর্বকে বলা যায় বাংলাদেশের বয়নশিল্পের সোনালি সময়, যা আজও বাংলাদেশের মানুষকে স্মৃতিকাতর ও গৌরবান্বিত করে। শত শত বছর ধরে অতিসাধারণ স্থানীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে গর্ত তাঁতে বাংলাদেশের তাঁতিরা যেসব উৎকৃষ্ট বস্ত্র বয়ন করতেন, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। শুধু তা–ই নয়, বিভিন্ন দেশের বণিক ও পর্যটকদের বিবরণ থেকে জানা যায়, এর পরিমাণও ছিল বিপুল এবং তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। জন টেলর আঠারো শতকের মাঝামাঝি (১৭৪৭) ঢাকাই মসলিন বাণিজ্যের যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, এর পরিমাণ ছিল বছরে প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ আর্কট টাকা (আর্কট টাকা=১৭০ থেকে ১৭১ গ্রেনের খাঁটি রুপার মুদ্রা)। উল্লেখ্য, সে সময় টাকায় সোয়া এক মণ ভালো মানের চাল পাওয়া যেত। ফলে টাকার হিসাবে সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্য বটে। আর দেশি-বিদেশি বণিকদের মাধ্যমে এই বস্ত্র ছড়িয়ে পড়ত সারা পৃথিবীতে। কোনো কোনো গবেষক সে জন্য মনে করেন, সে সময় বাংলা ছিল ‘পৃথিবীর তাঁতঘর’।

হস্তচালিত তাঁতে চলছে কাপড় বোনার কাজ। ছবি: প্রথম আলো
হস্তচালিত তাঁতে চলছে কাপড় বোনার কাজ। ছবি: প্রথম আলো
অবিভক্ত বাংলায় ঠিক কবে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত হয়েছে, তা অবশ্য নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। তবে বিভিন্ন প্রত্ন-প্রমাণ, সাহিত্যিক সূত্র ইত্যাদি পর্যালোচনা করে মনে হয়, অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে এই ভূখণ্ডে তাঁতশিল্প বেশ ভালোভাবেই বিকশিত হয়েছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থ। এ ছাড়া মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা, অজ্ঞাত লেখকের দ্য পেরিপ্লাস অব ইরিথ্রায়েন সি ইত্যাদি গ্রন্থে তাঁতবস্ত্র ও বাণিজ্যবিষয়ক নানা তথ্য জানা যায়। তাঁতযন্ত্র ও তাঁতির উল্লেখ আছে চর্যাপদে। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যেও নানা ধরনের তাঁতবস্ত্রের কথা জানা যায়।

২.

খ্রিষ্টপূর্বকাল থেকে একুশ শতক—এই দীর্ঘ কালপর্বে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আজও স্বমহিমায় বিদ্যমান। আঠারো শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বৈরী বাণিজ্যনীতি ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প উনিশ শতকে সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছিল। মোটামুটি বিশ শতকের আগেই সূক্ষ্ম মসলিনের বিলুপ্তি ঘটেছিল।

কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি আত্মস্থ করেন বাংলাদেশের বয়নশিল্পীরা এই শিল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। কৃৎকৌশলের নিরিখে তেমন কোনো পরিবর্তন ছাড়াই ধারাবাহিকভাবে যা একই কৌশলে উৎপাদিত হয়, তা হলো জামদানি। নকশাদার জামদানি হলো মসলিনের একটি ধরন। এটা আজও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ-সোনারগাঁ-সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় তৈরি হয় সনাতন গর্ত তাঁতে। নকশাদার জামদানি হলো মসলিনের একটি ধরন। মোগল সম্রাটেরা, বিশেষত সম্রাজ্ঞী নুরজাহান মসলিন ও জামদানির বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সম্প্রতি ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে উৎপাদিত জামদানি ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে ইউনেসকো থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এমনকি ২০১৬ সালে জামদানির জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) বা ভৌগোলিক নির্দেশক রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে তাঁতশিল্পের উন্নতিকল্পে ঔপনিবেশিক শাসকদের উদ্যোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বয়ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি (যেমন ফ্লাই শাটল লুম বা ঠকঠকি তাঁত, কৃত্রিম রঞ্জনপদ্ধতি, ডবি, জ্যাকার্ড মেশিন ইত্যাদি) প্রচার ও প্রসারে এই বয়ন বিদ্যালয়গুলোর বিশেষ ভূমিকা আছে। আর এই নতুন প্রযুক্তি আয়ত্ত করে নান্দনিক বস্ত্রবয়নে টাঙ্গাইলের বসাক বয়নশিল্পীরা বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। টাঙ্গাইলের বয়নশিল্পীরা আসলে ঢাকা ও ধামরাই অঞ্চলের মসলিন তাঁতি, যাঁরা উনিশ শতকে বস্ত্র ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে পৃষ্ঠপোষকের সন্ধানে ভ্যাগ্যান্বেষণে টাঙ্গাইলে চলে গিয়েছিলেন। এই দেশান্তরি বয়নশিল্পীদের একটা অংশ আবার দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে (ফুলিয়া, নবদ্বীপ) চলে গিয়ে সেখানে নতুন আবাস গড়ে তুলেছে। টাঙ্গাইল শাড়ির খ্যাতি সর্বজনবিদিত। এ ছাড়া রয়েছে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ তাঁতকেন্দ্র। পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি; নরসিংদীর চাদর, গামছা, থান কাপড়; কুমিল্লার খাদি; কুষ্টিয়ার গামছা, লুঙ্গি, চাদর ইত্যাদি বিখ্যাত। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমবেশি তাঁতের প্রচলন আছে। প্রধানত বিভিন্ন হাটের মাধ্যমে এসব তাঁতপণ্য বিক্রয় ও বিপণন হয়ে থাকে। ঢাকার ডেমরা ও তারাব, নরসিংদীর বাবুর হাট, টাঙ্গাইলের বাজিতপুর ও করটিয়া, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও বেলকুচি, কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও পোড়াদহ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ তাঁতের হাট।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা একসময় নিজেরাই নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় সব বস্ত্র তৈরি করত কোমর তাঁতে। প্রায় সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আছে নিজস্ব নকশা ও মোটিফ। তাদের মধ্যে তাঁতি হিসেবে নারীদের আধিপত্য একচেটিয়া। পার্বত্য এলাকায় পুরুষেরা তাঁতের কাজ করেন না। তবে সাম্প্রতিক কালে নরসিংদী অঞ্চলের কিছু দেশান্তরি পুরুষ বয়নশিল্পী পার্বত্য এলাকায় কাজ করছেন।

সিলেটের মণিপুরিদের তাঁতের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে এবং তারা সেটা কিছু মাত্রায় এখনো চর্চা করে। তবে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ঘটেছে প্রায় সবখানেই। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলের মান্দিদের তাঁতযন্ত্রটি কিছুটা ভিন্ন। মান্দিরা ব্যবহার করে ভূমিতে সমান্তরাল তাঁত। তবে বর্তমানে (২০১৯) এই তাঁতের প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে।

৩.

আগেই বলা হয়েছে, আঠারো-উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলা ছিল ‘পৃথিবীর তাঁতঘর’। বিশ্বব্যাপী নানা এলাকায় তখন বাংলায় উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র রপ্তানি হতো। সতেরো ও আঠারো শতকে বাংলার বস্ত্রশিল্প বিপুল পরিমাণে ইংল্যান্ডের বাজার দখল করলে ব্রিটিশ তাঁতিদের ভেতর এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তাঁতিদের প্রতিবাদের মুখে আইন করে কয়েকবার কয়েক জাতের মসলিন ও রেশমবস্ত্র ব্যবহার সে দেশে নিষিদ্ধ করেছিল। এমনকি এর জন্য তারা জরিমানা ও শাস্তির বিধান করেছিল। কিন্তু উনিশ শতকেই এই রমরমা রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছিল। বরং বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষ পরিণত হয়েছিল ব্রিটেনে উৎপাদিত সুতা ও কাপড়ের বাজারে। তারপরও বিশ শতকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে বাংলাদেশের বয়নশিল্পীরা কাজ অব্যাহত রেখেছে। এর প্রমাণ আমরা দেখি জামদানি ও টাঙ্গাইল শাড়ি এবং আরও অনেক তাঁতবস্ত্রে (গামছা, লুঙ্গি, চাদর ইত্যাদি)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে ঐতিহ্যবাহী তাঁতবস্ত্রের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হয়। সত্তর ও আশির দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নাগরিক মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সমাজ বাংলার লোকশিল্প, বিশেষ করে বয়নশিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারিকা, আড়ং, কুমুদিনী, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের জন্ম ও বিকাশ ঘটেছে এই কালপর্বে। পরবর্তীকালে নব্বইয়ের দশকে (এবং তারপর) আরও অনেক নাগরিক উদ্যোক্তা (যেমন কে ক্র্যাফট, অঞ্জন’স, দেশাল, সাদা কালো ইত্যাদি) বয়নশিল্প নিয়ে কাজ শুরু করে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বয়নশিল্পে।

জামদানি শাড়িতে সূক্ষ্ম কাজ করছেন একজন বয়নশিল্পী। ছবি: প্রথম আলো
জামদানি শাড়িতে সূক্ষ্ম কাজ করছেন একজন বয়নশিল্পী। ছবি: প্রথম আলো
গত এক শ বছরের বয়ন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, যে তুলা বয়নশিল্পের জন্য অত্যন্ত জরুরি, তা উনিশ শতক পর্যন্ত দেশে উৎপাদিত হলেও এখন এর চাষ খুব কম হয়। আমরা এখন তুলা মূলত আমদানি করি। কিছু সুতা দেশের বিভিন্ন মিলে তৈরি হয় বটে, কিন্তু বেশির ভাগ সুতা আসে বিদেশ থেকে। বিশ শতকের গোড়ায় স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে চরকায় সুতা কাটার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এখন চরকায় সুতা কাটার পরিমাণ খুবই কম। বলাই বাহুল্য, মিলে সুতা উৎপাদনের প্রযুক্তিগত কৌশলটি আমরা বিদেশ থেকে ধার করেছি। একসময় বাংলাদেশে উৎপাদিত সুতা ও বস্ত্র প্রাকৃতিক রঞ্জন প্রক্রিয়ায় রং করা হতো। দেশে বর্তমানে প্রাকৃতিক রঞ্জনপদ্ধতির প্রচলন খুবই সীমিত, বরং কৃত্রিম রঞ্জনপ্রক্রিয়ায় সারা দেশে সুতা ও কাপড় রং করা হয়। এমনকি যেসব তাঁতযন্ত্র এখন বেশি ব্যবহৃত হয় (ফ্লাই শাটল বা ঠকঠকি তাঁত, ফ্রেম লুম, চিত্তরঞ্জন বা জাপানি তাঁত ইত্যাদি), সেগুলোও ঔপনিবেশিক শাসনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে প্রচলিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের বয়নশিল্প এখন ঐতিহ্যের স্মারক শুধু নয়, বরং এই শিল্পে ঔপনিবেশিক প্রভাবে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন ঘটেছে। আর এসব বিচিত্র ও বিভিন্ন পরিস্থিতি ও পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হস্তচালিত বয়নশিল্প যে এখনো টিকে আছে, এর প্রধান কৃতিত্ব দিতে হবে এ দেশের বয়নশিল্পীদের। বয়নশিল্পীরাই বাংলাদেশের বয়নশিল্পের মূল প্রাণশক্তি, যাঁদের কারণে এ দেশের গৌরবময় এই শিল্পধারা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আজও বিদ্যমান। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, বাংলাদেশে তাঁতশিল্প বিকশিত হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল এখানে প্রয়োজনীয় সব কাঁচামাল বা উপকরণ (সুতার জন্য তুলা ও রেশম; রঙের জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান, সনাতন তাঁতযন্ত্রের জন্য বাঁশ-কাঠ ইত্যাদি) সহজেই পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে তাঁতশিল্পের জরুরি উপকরণ তুলা, সুতা, রং ইত্যাদির জন্য আমাদের আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা অত্যধিক। আমাদের তাঁতিরা আজও অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে নানা রকম বস্ত্রবয়নে পারদর্শী। কিন্তু কাঁচামাল ও উৎপাদন-উপকরণ সুলভ ও সহজপ্রাপ্য না হলে কোনো শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশ সম্ভব নয়। পাশাপাশি সমকালীন বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী যে ফ্যাশন ট্রেন্ড চলছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী বৈচিত্র্যময় তাঁতপণ্য উৎপাদন করা এবং বিশ্ববাজারে এর প্রচার ও প্রমোশন অতি জরুরি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বর্তমানে জামদানির উৎপাদন ও ব্যবহার শুধু শাড়িতেই সীমাবদ্ধ। অথচ ঐতিহ্যবাহী নকশাদার এই তাঁতবস্ত্র দিয়ে আরও নানা বৈচিত্র্যময় পণ্য ও পোশাক উৎপাদন সম্ভব, যা এই শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আশার কথা, তরুণ উদ্যোক্তা ও ডিজাইনাররা এ বিষয়ে এগিয়ে আসছেন। বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পেও নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তারা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। ক্রমশ একুশ শতকে বাংলাদেশের তাঁতশিল্প হয়ে উঠেছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়।

পুনশ্চ: সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বিলুপ্ত মসলিনের পুনরুদ্ধার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যদিও এই প্রকল্প এখনো পুরোপুরি সাফল্য লাভ করেনি, তবু এ উদ্যোগ আমাদের আশাবাদী করে। এই উদ্যোগ সফল হলে, অর্থাৎ নিজেদের দেশে ফুটি কার্পাস চাষ করে তা থেকে সূক্ষ্ম সুতা হাতে কেটে হস্তচালিত তাঁতে সূক্ষ্ম বস্ত্রবয়ন সম্ভব হলে তা হবে বাঙালি জাতির জন্য একটি বড় অর্জন।


9
Faculty Sections / Re: যে শহরে যানজট নেই!
« on: July 13, 2019, 08:24:59 PM »
We need................

13
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অনেকে পুদিনা পাতার চা পান করতে পছন্দ করেন। শুধু স্বাদ বা গন্ধের জন্য নয়, অনেক অঞ্চলে এই চা ওষুধি হিসাবেও ব্যবহার করা হয।

বিভিন্ন উপায়ে পুদিনা চা শরীরের উপকার করে। এই চা শরীর শীতল করে এবং শক্তি বাড়ায়। একই সঙ্গে মাথা ব্যথা, সাইনাস এবং পেটের সমস্যার জন্য এটি দারুন উপকারী।

পুদিনা চা হজমশক্তি বাড়ায় এবং প্রদাহজনিত ব্যথা কমায়। এটি মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি দেয়। মুখের দুর্গন্ধ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও এই চা কার্যকরী।

গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল কমাতে পুদিনা চা দারুন কাজ করে। জ্বর সারাতেও এই চা উপকারী।

যেভাবে তৈরি করবেন পুদিনা চা

১. প্রথমে একটি পাত্রে পানি ফুটিয়ে নিন

২. এবার জ্বাল কমিয়ে পানিতে পুদিনা পাতা ছেড়ে দিন। পাতাগুলো শুকনো কিংবা তাজা-সবরকমই হতে পারে। এখন পাতাগুলো ৫ থেকে ১০ মিনিট ফুটান।

৩. ভালভাবে জ্বাল হলে চুলা বন্ধ করে দিন।

৪. ব্যস তৈরি হয়ে গেল পুদিনা পাতা।

স্বাদ বাড়াতে পুদিনা চায়ে মধু যোগ করতে পারেন। সূত্র : অর্গানিক ফ্যাক্টস

14

কচু দক্ষিন এশিয়া ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার সুপরিচিত একটি সবজি। এর কাণ্ড সবজি এবং পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়।কচুর কাণ্ড ও পাতা-সবকিছুতেই প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে।

কচু শাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিণ, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ডিটারেরী ফাইবার, শর্করা, বিভিন্ন খনিজ ও ভিটামিন রয়েছে।

নিয়মিত কচু শাক খেলে যেসব উপকারিতা পাওয়া যাবে-

১. কচু শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে । এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত কচু শাক খেলে কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। আরেক গবেষণা বলছে, কচু শাক স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে দারুন কার্যকরী।

২. কচু শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে। এ কারণে এটি দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া চোখ সম্পর্কিত জটিলতা কমায়।

৩. কচু শাকে থাকা স্যাপোনিনস,টেনিনস, কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্লাভোনয়েড উচ্চ রক্তচাপ কমায়।নিয়মিত কচু শাক খেলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে।

৪. যেহেতু কচু শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে এ কারণে এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

৫. কচু শাক রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে নিয়মিত এই শাকটি খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে।

৬. কচু শাক হজমশক্তি বাড়াতেও ভূমিকা রাখে।

৭. অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরী ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান থাকায় কচু শাক যেকোন ধরনের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

৮. যারা রক্তস্বল্পতায় ভূগছে তারা নিয়মিত কচু শাক খেতে পারেন। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে যা রক্তশূন্যতা দূর করতে ভূমিকা রাখে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কচু শাক খেলে কারও কারও অ্যালার্জির সম্ভাবনা বেড়ে যায় । শরীরে র্যা শ দেখা দেয়, চুলকানি হয়। এ কারণে যাদের এ ধরনের সমস্যা আছে তাদের এই শাক খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নেয়া উচিত। সূত্র : বোল্ড স্কাই

15
Textile Engineering / Re: QS World University Rankings
« on: January 13, 2019, 03:55:15 PM »
 Great Achievement.

Pages: [1] 2 3 ... 14