বহুল পঠিত উপন্যাস ‘মেমসাসেহব’-এর আলোচিত মেমসাহেব চরিত্রটি একেবারেই কাল্পনিক বলে জানালেন বইটির লেখক নিমাই ভট্টাচার্য। তার মতে, ‘রিপোর্টার’ যেমন একটি বই, ‘মেমসাহেব’ও তেমনি একটি। পাঠক পড়ে যেটা ভাববে সেটাই আসল কথা।
বিখ্যাত এ লেখক-সাংবাদিক সম্প্রতি কলকাতার টালিগঞ্জের মোর এভিনিউতে নিজ বাসায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।‘মেমসাহেব’ ছাড়াও ‘রিপোর্টার’, ‘ডিপ্লোম্যাট’, ‘বংশধর’, ‘পিকাডেলি সার্কাস’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘কয়েদী’সহ অসংখ্য বই লিখেছেন নিমাই ভট্টাচার্য। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দেড়শ’র অধিক। তিনি তার লেখক ও সাংবাদিকতা জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন সাক্ষাৎকারে।
এপার এবং ওপার বাংলা মিলিয়ে তার সবচেয়ে বেশি পঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেমসাহেব’ নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি এ বছর প্রকাশের ৫০ বছর হয়েছে।
নিমাই ভট্টাচার্য জানান, ‘‘আমার ৩৫ বছর বয়সে বইটি লিখেছি। তখন আমি রিপোর্টার। এটি অসম্ভব জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বিক্রিত বই। এবারে এটি প্রকাশের ৫০ বছর হয়েছে। আমার লেখা বইয়ের মধ্যে এটি এখনও পর্যন্ত সমানভাবে জনপ্রিয় বই।’’
‘মেমসাহেব’ প্রকাশের ৫০ বছরে এসে অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘খুবই খুশি। ৫০ বছর ধরে একটা বই সমানভাবে জনপ্রিয় তা খুব একটা দেখা যায় না।’’
মেমসাহেব বইটিতে নিজের জীবনের ছায়া পড়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি সরাসারি জবাব না দিয়ে বলেন, ‘‘রিপোর্টার যেমন বই, মেমসাহেবও তেমনি। এটি পাঠক সমাজ ভেবে নিক। তবে মেমসাহেব চরিত্রটি একেবারেই কাল্পনিক ।’’
ঠিক কিভাবে উপন্যাসটি লিখেছেন জানতে চাইলে নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, তখন আমি দিল্লিতে। রিপোটিংয়ের কাজে কখনো দিল্লি, কখনো ব্যাঙ্গালোর, কখনো নেপাল বা অন্য কোথাও যেতে হতো। রিপোর্ট লিখে পাঠানোর তাড়া থাকতো। যেখানে বসে রিপোর্ট লিখতাম, এর ফাঁকে ফাঁকেই লিখেছি উপন্যাসটি।
১৯৩১ সালে জন্ম নেয়া নিমাই ভট্টাচার্য-এর পড়ালেখা ও সাংবাদিকতা জীবনের শুরু কলকাতাতেই। ১৯৫০ সালে ‘লোকসেবক’ পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। পরবর্তীতে দিল্লিতে গিয়ে বেশ কয়েকটি কাগজের পার্লামেন্ট, ডিপ্লোম্যাটিক ও পলিটিক্যাল করেসপন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের বড় অংশই কাটিয়েছেন দিল্লিতেই। আর এসময়ের মধ্যে কাজ করেছেন পাঁচটি কাগজে। যার অধিকাংশই কলকাতার বাইরের। আর রিপোর্ট লিখতে গিয়েই লেখালেখি শুরু বলে জানান নিমাই ভট্টাচার্য।
দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে জওহরলাল নেহেরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, ভি কে কৃঞ্চমেনন, মোরারজী দেশাই, ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। নির্জোট শীর্ষ সম্মেলন, কমনওয়েলথ সম্মেলনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীসহ বিখ্যাত নেতৃবৃন্দের সঙ্গী হয়ে প্রতিবেদন করেছেন। তাদের জীবনাচরণও দেখেছেন একেবারে কাছ থেকে।
একজন পুরোদস্তুর রিপোর্টারের পাশাাপাশি লেখক হয়ে ওঠা এবং রিপোর্টের বাইরে এত কিভাবে লিখেছেন জানতে চাওয়া হয়।
নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ রিপোর্ট যা লিখি তা লিখেই গেলাম, প্রায় একবারেই লেখা শেষ হয়ে যায়। সে অভ্যাসটি থাকায় উপন্যাস লিখতে গেলেও প্রায় একই রকম। উপন্যাস বা অন্য লেখাও একবারেই লিখেছি। বারবার ড্রাফট দেখা, করেকশন করার কম দরকার হতো। দেড়শর মতো বই বেরিয়েছে, যার অধিকাংশই উপন্যাস।’’
‘‘রিপোর্টারের লেখা কেমন সেটা পাঠকরাই বিবেচনা করবেন। রির্পোটিং ও লেখালেখির জীবন দুটো আলাদা জিনিস। দিল্লিতে নেহেরু-ইন্দিরাসহ বড় মানুষদের সাহচর্যে থেকে রিপোর্ট করার মধ্যে অন্যরকম উত্তেজনা ছিল। কিন্তু সাহিত্যের কাজে স্থায়ী ছাপ পড়ে, খবরের কাগজের রির্পোটিংয়ে তা কম। খবরের কাগজের রিপোর্টিং পড়ে কয়জনই বা আর দেখা করতে আসে। বই পড়েই তো আপনারা দেখা করতে এসেছেন।’’
জনপ্রিয় লেখক হলেও নিমাই ভট্টাচার্য ছিলেন একজন বড় রিপোর্টার। ১৯৫০ সাল থেকেই রিপোর্টিং জীবনের শুরু। ১৯৮০ সালে কলকাতা ফেরার পর রিপোর্টিং একেবারেই ছেড়ে দেন। আর কোন কাগজের সাথে যুক্ত ছিলেন না। পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে।
তরুণ সাংবাদিকদের নিয়ে বলতে বললে নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, তাদের ভালো রিপোর্টার হতে হবে।
‘‘আর ভালো রিপোর্টার হতে হলে দুটো জিনিস দরকার। এক. গোপন কথা বের করতে হবে সরকার ও সমাজের। আমি জানি ভদ্রলোক, কিন্তু এর পেছনে কি আছে তা বের করতে হবে। সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতে হবে। অন্যায় অবিচার প্রকাশ করতে হবে।’’
‘‘দুই. নিজের প্রচণ্ড আগ্রহ ও সততা থাকতে হবে। কেউ খাইয়ে দিল আমি ভুলে গেলাম তা হওয়া যাবে না।’’
বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতা বিষয়ে নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এখন অনেক ধরণের সাংবাদিকতা হচ্ছে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাগজে লিখছে। সে অনুযায়ী নিজেদের তৈরি করতে হবে।’’
বাংলাদেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর দিল্লিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা হবার কথা স্মরণ করেন নিমাই ভট্টচার্য। তিনি সেসময় বঙ্গবন্ধুকে ডিপ্লোম্যাটসহ চারটি বই উপহার দিয়েছিলেন। ‘‘সেসময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিকদের অবদান বিরাট।’’
বাংলাদেশে মৌলবাদীদের আস্ফালন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘মৌলবাদ বরাবরই ছিল। বাংলাদেশ হবার আগেও ছিল, পরেও ছিল। একসময় উর্দু রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা হয়েছিল। উর্দুতে বাংলা লেখার চেষ্টাও হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনেও মৌলবাদীরা ছিল।’’
‘‘মুক্তমনের প্রগতিশীল সমাজ তৈরি করতে গেলে সে ধরণের শিক্ষা-দীক্ষা দরকার। সেজন্য আন্দোলনও দরকার।’’
তিন বছর আগে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে শরীরের একাংশ অবশ হয়ে যাওয়ার পর থেকে লেখালেখি একেবারেই বন্ধ নিমাই ভট্টাচার্যের। লিখতে না পারার আফসোস রয়েছে তার। তিনি বলেন, লিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারছি না।
লেখালেখি জীবন নিয়ে তৃপ্ত কি না জানতে চাইলে নিমাই ভট্টচার্য বলেন, কিছু লিখে তৃপ্ত হলেও আরও অনেক লেখা উচিত ছিল বলে এখন এসে মনে হয়।
‘মেমসাহেব’ এর বাইরে তার লেখাগুলোর মধ্যে প্রিয় বইয়ের কথা জানতে চাইলে তিনি ‘রিপোর্টার’, ‘ডিপ্লোম্যাট’ ও ‘নাচনী’র কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি বই তার প্রিয় বলে জানান।
বাংলাদেশে তার পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিমাই ভট্টচার্য বলেন, ‘‘বাংলাদেশের ভক্তরা ভালো থাক। তারা আমার বই পড়েন এজন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’’
Source:
https://arts.bdnews24.com/?p=19220