পবিত্র মাহে রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস। রোজা মানুষকে মুত্তাকি, খোদাভীরু ও পরহেজগার হতে সাহায্য করে। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কঠোর সংযমের সিঁড়ি বেয়ে তাকওয়ার শিখরচূড়ায় আরোহণই পবিত্র রমজান মাসের অন্বিষ্ট অভীষ্ট লক্ষ্য। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ রমজানের রোজার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে সে কথা সুস্পষ্ট বলেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা মুত্তাকি-খোদাভীরু হতে পার।’ (বাকারা-১৮৩)
প্রকৃতপক্ষেই তাকওয়া-খোদাভীতি যার মধ্যে থাকবে সে কোনো দুর্নীতি ও অপরাধে লিপ্ত হবে না, হতে পারবে না। ফলে মুসলমানরা যথার্থভাবে রমজানের এক মাস রোজা রেখে তাকওয়া-খোদাভীতি অর্জন করতে সক্ষম হলে এবং সারা বছর সে তাকওয়ার ওপর অধিষ্ঠিত থাকতে সচেষ্ট হলে অনায়াসেই সমাজ থেকে দুর্নীতি ও অপরাধ দমন হবে। এটা কোনো বাড়িয়ে বলা নয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) অপরাধ দমনের জন্য রোজার প্রেসক্রিপশন করেছেন বলে হাদিসে প্রমাণও পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করতে সক্ষম তারা যেন বিয়ে করে। আর যারা বিয়ে করতে অক্ষম তারা যেন রোজা রাখে। কারণ রোজা তার যৌনক্ষুধা দমনকারী।’ (ফলে রোজা রাখলে সে ব্যভিচার বা এ ধরনের কোনো ধরনের অপরাধে লিপ্ত হবে না) (বুখারি, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৫) অপর এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘হে যুব সমাজ! তোমাদের কর্তব্য বিয়ে করা। কেননা তা চক্ষু অবনত রাখা ও লজ্জাস্থান রক্ষার অধিকতর সহায়ক। তবে তোমাদের মধ্যে যাদের বিয়ের সামর্থ্য নেই তার উচিত রোজা রাখা। কেননা, রোজা তার যৌন প্রবৃত্তিকে অবদমিত করে।’ (তিরমিযি, ১ম খণ্ড)।
রোজার মাধ্যমে কুপ্রবৃত্তি দমন হয় কঠোরভাবে। রোজার মাধ্যমে যৌন ক্ষুধা দমনের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। রোজার দিনে পানাহার বর্জনের, রসনা সংযমেরও এক কঠোর প্রশিক্ষণ হয়। পানাহার বর্জন তো রোজার জন্য আবশ্যক। রসনা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে সংযমও রমজানে হওয়া উচিত। মিথ্যা, অপবাদ, পরনিন্দা, পরচর্চা, গালিগালাজ, অশ্লীল কথাবার্তা ইত্যাদি দোষণীয় বিষয় ও গুনাহগুলো বিশেষভাবে রমজানে বর্জন একান্ত জরুরি। হজরত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং সে অনুসারে কাজ করা বর্জন করল না তার পানাহার বর্জনের (রোজার) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৫)। যদি কেউ রোজাদারকে গালমন্দ করে তাহলে সে যেন তাকে বলে—আমি রোজাদার। (প্রাগুক্ত) রমজানে পরনিন্দা-পরচর্চা বর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ; যতক্ষণ না রোজাদার নিজেই ঢালটি ফাটিয়ে ফেলে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ঢাল ফাটাবে কীভাবে? হজরত রাসুল (সা.) জবাব দিলেন, মিথ্যা কথা ও পরনিন্দা দ্বারা (নাসাঈ শরীফ) পবিত্র রমজানে সামগ্রিক কুপ্রবৃত্তি দমনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে হজরত জাবির (রা.) বলেন, তুমি যখন রোজা রাখবে তখন তোমার চোখ, কান, জিহ্বাও যেন মিথ্যা এবং হারাম কাজ থেকে রোজা রাখে। পড়শি-প্রতিবেশীকে কষ্ট দিও না। তোমার মাঝে রোজার দিনে যে গাম্ভীর্য ও স্থিরতা থাকে। রোজার দিন আর অন্যদিন সমান করে ফেল না। দৃশ্যমান কিছু বিধি-নিষেধের মধ্যে রোজাকে সীমাবদ্ধ করে ফেললে তা দিয়ে দুর্নীতি ও অপরাধ যেমন দূর হবে না. তেমনি পূর্ণ সওয়াবও পাওয়া যাবে না। এজন্য কোনো এক মনীষী বলেছেন, সহজ রোজা হলো পানাহার বর্জন করা। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘অনেক রোজাদারের রোজা তার জন্য তৃষ্ণা, পিপাসা ও ক্ষুধা ছাড়া আর কোনো সার্থকতাই বয়ে আনতে পারে না।’
দুর্নীতি ও অপরাধ দমনে ধৈর্য, সহনশীলতা ও সহমর্মিতার ভূমিকা অসামান্য। পবিত্র রমজান মাসে সেই ধৈর্য, সহনশীলতা ও সহমর্মিতার প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) রমজানকে ধৈর্য ও সহমর্মিতার মাস বলেছেন। সব মুসলমান যখন রোজা রাখেন তখন একটি অপরাধ ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ গড়ে ওঠে এবং সে পরিবেশে তাবত্ অপরাধ ও দুর্নীতি দমন সহজ হয়ে ওঠে, যা অন্য সময় কঠিনই হয়। তদুপরি অপরাধ, অনাচার, অন্যায় ও দুর্নীতিপ্রবণ পরিবেশে অপরাধ ও দুর্নীতি থেকে আত্মরক্ষার কঠোর প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন রমজানের রোজার মাধ্যমে হয়ে থাকে।
প্রতিবছর মাসব্যাপী রোজা রাখা সত্ত্বেও আমাদের সমাজ থেকে দুর্নীতি ও অপরাধ দূর না হওয়াটা রোজার দোষ নয়। দোষ রোজাদারদের। যথার্থ রোজা রাখা হচ্ছে না বলেই দুর্নীতি ও অপরাধ দমন হচ্ছে না। ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেছেন, রোজার তিনটি স্তর রয়েছে—১. সর্বসাধারণের রোজা আর তা হচ্ছে পানাহার ও কামভাব বর্জন করা। ২. বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রোজা, তা হচ্ছে হাত-পা, চোখ-কান, জিহ্বা ও অপরাপর ইন্দ্রিয়কে পাপকর্ম থেকে বিরত রাখা। তৃতীয় ও সর্বোচ্চ স্তরের রোজা হচ্ছে পানাহার ও কামভাব থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়কে পাপ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা। যাবতীয় কুচিন্তা বৈষয়িক ভাবনামুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর ধ্যানমগ্ন হওয়া। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, মানুষকে পাশবিকতা ও জৈবিক অভ্যাসমুক্ত করা। রোজা সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি অর্জন করে। মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পশুত্ব নিস্তেজ হয়। মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। বলাবাহুল্য, রোজা উপরোক্ত উদ্দেশ্য যখন সাধিত হবে, তাকওয়া বর্মে যখন সজ্জিত হবে রোজাদাররা তখন দুর্নীতি ও অপরাধ নিমিষেই দমন হবে।