‘এ লড়াই আপনার জন্য নয়...’ শীর্ষক একটি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর টেলিটক। বিজ্ঞাপনটি বারবার পড়েও ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই। টেলিটকের এই লড়াই আসলে কার জন্য তা নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে।
টেলিটক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি হওয়ায় প্রত্যাশা একটু বেশি। অথচ সেবার নামে দুর্বোধ্য বিজ্ঞাপন দিচ্ছে টেলিটক। বিজ্ঞাপনটি একদিকে যেমন বোঝা সহজ নয়, অন্যদিকে আকর্ষণহীন। থ্রিজি সেবা কোন ধরনের মোবাইল সেট সাপোর্ট করবে, তা বিজ্ঞাপনে বলা হয়নি। এই সংযোগ পাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে যে চার মাস সময় লাগবে, তাও খোলাখুলি বলা হয়নি। তাই থ্রিজি সেবার নামে অস্বচ্ছ এ প্যাকেজ নিয়ে জনমনে দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন।
থ্রিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চগতিতে তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব হওয়ায় মোবাইল ফোনেই টিভি দেখা, জিপিএসের মাধমে পথ নির্দেশনা পাওয়া, উচ্চ গতির ইন্টারনেট ব্যবহারসহ ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেওয়া সম্ভব হবে। কিন্ত টেলিটকের দুর্বল সেবার মাধ্যমে গ্রাহকদের এসব স্বপ্ন কতটুকু পূরণ হবে তা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন।
দেশের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে সীমিত আকারে থ্রিজি সেবা নিবন্ধন শুরু করেছে দেশিয় মোবাইল সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড। এই সেবা প্রাথমিকভাবে ঢাকা, টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট এবং কক্সবাজার শহরের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এই প্যাকেজ নিয়ে সাধারণের কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখেনি টেলিটক।
অনেকেই অভিযোগ করেছেন, টেলিটক একমাত্র সরকারি মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর হওয়ার কারণে তারা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করে চলেছে। গ্রাহকদের ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা দেবার ব্যাপারেও তারা বিশ্বস্ত নয়। আমলাতান্ত্রিক মানসিকতারই জয়জয়কার এখানে। সেবার মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি। এই আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা ও অদক্ষতারই ফল এই ধরণের অস্বচ্ছ অফার। এবারের গ্রাভিটি প্যাকেজটিও সে কারণে একটি অস্বচ্ছ প্যাকেজ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রজেক্ট অফিসের সহকারী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান বলেন, “নতুন একটি প্রযুক্তি দেশে আনছে। সেটা কোন ধরনের হ্যান্ডসেটে সাপোর্ট করবে তার কোনো উল্লেখ নেই। আমি টাকা খরচ করে রেজিস্ট্রেশনের চেষ্টা করলাম, তখন দেখা গেল সেট সাপোর্ট করে না। অথচ আমার টাকা কাটা হলো। এ ধরনের হলে যে টাকা ফেরত দেওয়া হবে, সেটাও আগে থেকে বলে দেওয়া হয়নি।â€
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হোসাইন সাজ্জাদ অভিযোগ করেন টেলিটক বাংলাদেশের প্রথম থ্রিজি প্রযুক্তি সরবরাহকারী মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হতে যাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ টেলিটক থেকে অনেক কিছু আশা করে। কোনোটাই পূরণ হয় না। টেলিটকের এখন ২.৫ জি প্রযুক্তি রয়েছে। তারা তো এই সেবাই সবাইকে ভালোভাবে দিতে পারছে না। আবার থ্রিজি নিয়ে জটিল বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এই বিজ্ঞাপন বুঝতে পণ্ডিত হতে হবে। সাধারণ মানুষ এত জটিল প্যাকেজ বুঝবে না। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা বিজ্ঞাপনের কিছু বুঝতে পারেনি।â€
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. জুনায়েদ বাংলানিউজকে বলেন, “তরুণ প্রজন্মের জন্য থ্রিজি সবচেয়ে জরুরি সেবা। কিন্তু একজন ছাত্রে জন্য প্রতিমাসে ৫০০ টাকা খরচ করা কঠিন। তাও ৩ মাস ব্যবহারের পর গ্রাহক পাবে কী না নিশ্চিত না। এই হিসেবেও গরমিল আছে, আসলে ৩ মাস নয় ৪ মাস । প্রথম একমাসে ৫০০ টাকা কেটে গ্রাভিটি ক্লাবে মেম্বার করা হবে। পরবর্তী মাসের জন্য আরও ৫০০ টাকা ব্যালেন্স থাকা নিশ্চিত করতে হবে। পরবর্তী ২ মাসের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। এভাবে চারমাসে কমপক্ষে ২ হাজার টাকা লাগবে। ১ মাসে টাকার সমস্যা হলে পুরো টাকাই লস। তারপরও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ রিচার্জকারী সংযোগ পাবে। স্টুডেন্টরা এত ব্যয় কিভাবে করবে। আসলে টেলিটক হিডেন শর্ত দিয়ে জিলাপির প্যাঁচ তৈরি করেছে।â€
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, “টেলিটকের সিম ২০০৫ সালে ভোরে লাইন ধরে ব্যাংক থেকে কিনেছি। কিন্তু আমাদের জন্য টেলিটক কি করলো? গ্রাভিটি প্যাকেজ আরো সহজ হতে পারতো। প্রয়োজনে একবারেই পুরো টাকা নিতে পারতো। দেশি কোনো সুন্দর নাম দিয়েও প্যাকেজটা হতে পারতো। আসলে টেলিটক কার স্বার্থ দেখে তা বোঝা মুশকিল।â€
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমি টেলিটক ব্যবহার করি আমাদের জন্য ১ মাসের জন্য সুযোগ দিতে পারতো। যারা নতুন ইউজার তাদের আর প্রথম থেকে যারা গ্রাহক তাদের সবারই একই একই সুবিধা। পুরনোদের জন্য বিশেষ অফার দেওয়া উচিত ছিলো।â€
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আব্দুল্লাহ বলেন, “প্যাকেজ আরেকটু সহজ হলে ভালো হতো। যেহেতু এরপর ৫টি অপারেটর এই সেবা দেবে। শুরুতেই টেলিটক ঝামেলা তৈরি করেছে। বিস্তারিত জানতে যে নম্বর (১২৩৪) দেওয়া হয়েছে, সেখানে কল করেও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।â€
নর্থ সাউথ বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র অভিজিৎ ঘোষ বলেন, “টেলিটক বোধহয় চায় না সাধারণ মানুষ থ্রিজি ব্যবহার করুক। তারা অফারের ধাঁধায় ফেলে অন্য অপারেটরদের ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে এখনো টেলিটকের নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাওয়া যায় না।â€
একটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার সরোজ মেহেদী বলেন, “আসলে টেলিটক দেখার কেউ নেই। এখানে খারাপ অফার দিয়ে বিদেশি কোম্পানির ব্যবসাকেই জনপ্রিয় করা হয়। টেলিটকের আমলারাই এসব জটিলতা তৈরি করেন। এর পিছনের কারণ বের করা উচিত।â€
আইটি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রংপুর সফটের কাস্টমার সাপোর্ট এক্সিকিউটিভ বলেন, “দেশের একমাত্র সরকারি মালিকানাধীন মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক নিয়ে অভিযোগের কোনো শেষ নেই। হেল্প লাইনে ফোন করলে মিনিট গুনে ‘পয়সা’ কেটে নিলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সমাধান দিতে পারছে না তারা। গ্রাহকদের জন্য সুযোগ সুবিধার সব দরজা কৌশলগতভাবে বন্ধের `পণ` বোধহয় করেই রেখেছে টেলিটক। সব কিছু মিলে টেলিটক গ্রাহকের দুর্ভোগের মাত্রা সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে।â€
গত ১৯ জুলাই ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু রাজধানীর বারিধারায় ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস) ক্যাম্পাসে ইলেক্ট্রোফেস্ট ২০১২ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, “সবার জন্য সহজ অফারের মাধ্যমে টেলিটকের থ্রিজি জনপ্রিয় করা হবে।â€
কিন্ত মন্ত্রীর কথারও বাস্তবায়ন করেনি টেলিটক। তারা কোনো সহজ অফার দেয়নি।
টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে পাওয়া যায়নি।
টেলিটকের জেনারেল ম্যানেজার হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের থ্রিজির সংযোগ সবাই পেতে চাইবে। তাই আমরা ছোট তালিকা (শর্ট লিস্ট) তৈরি করবো। যারা বান্ডেল অফার ব্যবহার করবেন, তারাই ক্রমান্বয়ে থ্রিজি সুবিধা পাবেন। সবাইকে একসাথে এই সুযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ধীরে ধীরে সবার জন্য থ্রিজি দেওয়া হবে। আমাদের বিজ্ঞাপন জটিল নয়, বরং সহজ। কেউ না বুঝলে আমাদের কিছু করার নেই।â€
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম