মুনমুন শবনম বিপাশা
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার দোহাই দিয়ে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়ার ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অথচ এ দেশ থেকে লোক না নিলেও নেপাল থেকে লোক নেওয়া বন্ধ হয়নি। বরং দেখা যায়, নেপাল
সরকার মালয়েশিয়ায় চাহিদা মোতাবেক শ্রমিক সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। আবার দেখা যায়, গত দেড় বছরের মধ্যে কুয়েতে গেছে
মাত্র ২১ জন। অথচ এক সময় এ দেশে বাংলাদেশের কর্মী যাওয়ার
হার ছিল প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে 'শ্রমবাজার' একটা বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। এর কারণ হলো, এ বাজার থেকে যেসব বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, তার ১০০ ভাগ আমাদের দেশের মধ্যেই থাকে। আর অন্যান্য খাত থেকে যে মুদ্রা আসে, তার বেশির ভাগ খরচ হয় উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত কাঁচামাল কিনতে। শ্রমবাজার থেকে অর্জিত অর্থ আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বাড়াতে সাহায্য করে, যা যে কোনো দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাব অনুযায়ী মোট প্রবাসী জনশক্তির মধ্যে সৌদি আরবে রয়েছেন ২৫ লাখ ২০ হাজার বাংলাদেশি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছেন প্রায় ১৮ লাখ। এ ছাড়া কুয়েতে প্রায় ৫ লাখ, ওমানে ৪ লাখ, বাহরাইনে ২ লাখসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে বড় অংকের বাংলাদেশি কাজ করছেন।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। স্বাধীনতার পর থেকে, মূলত ১৯৭৬ সাল থেকে প্রবাসে শ্রমিক যেতে শুরু করে। ২০০৭-২০০৮ সালে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক বিদেশে যায়। প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের অর্থ অর্থাৎ রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে বর্তমান সময়ে জনশক্তি রফতানি কমে গেছে। আবার নতুন শ্রমবাজারও তৈরি হয়নি। রেমিট্যান্স আয়ের হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ২০০৭ সালে ৮ লাখ ৩৩ হাজার জন বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যায়। এর পর ২০০৮ সালে ৫ লাখ ৭৫ হাজার, ২০০৯ সালে ৪ লাখ ৭৫ হাজার এবং ২০১০ সালে ৩ লাখ ৯২ হাজার জনশক্তি রফতানি হয়েছে। জনশক্তি রফতানি কমে যাওয়ার ফলে শুধু যে জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তাই নয়; আমাদের ব্যাংকগুলোতেও ডলার সংকট দেখা দিচ্ছে। প্রতি বছরই রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় কম হচ্ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২২ শতাংশ রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হয়। এর পর ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৩ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ।
প্রায় ৭৫ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের ৮০ শতাংশ কাজ করে মধ্যপ্রাচ্যে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ হলো সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০০৮ থেকে বর্তমান সময়ের পরিসংখ্যান দেখলেই সুস্পষ্ট বোঝা যায়, দিন দিন শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া দক্ষ শ্রমিকের জোগানও বাংলাদেশ থেকে খুব কম। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশের জনশক্তি যারা প্রবাসে কাজের উদ্দেশ্যে গেছেন, তাদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক ২৩ শতাংশ, আধা দক্ষ ৩ শতাংশ এবং সামান্য দক্ষ ৭৪ শতাংশ। অদক্ষ শ্রমিকের অনেকেই বিদেশে গিয়ে বেকার থাকেন। অনেকে আবার খুব কম পারিশ্রমিকে কাজ পান, যা দিয়ে নিজেদের জীবনযাত্রা অতিবাহিত করাই কষ্টকর । দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে না পারলে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি আরও কমতে থাকবে, যা অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার দোহাই দিয়ে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়ার ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অথচ এ দেশ থেকে লোক না নিলেও নেপাল থেকে লোক নেওয়া বন্ধ হয়নি। বরং দেখা যায়, নেপাল সরকার মালয়েশিয়ায় চাহিদা মোতাবেক শ্রমিক সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। আবার দেখা যায়, গত দেড় বছরের মধ্যে কুয়েতে গেছে মাত্র ২১ জন। অথচ এক সময় এ দেশে বাংলাদেশের কর্মী যাওয়ার হার ছিল প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার। কূটনৈতিক দুর্বলতার কারণে জনশক্তি রফতানিতে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। জনশক্তি রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব। অথচ বিগত তিন বছরে সেখানে গেছেন ৩০ হাজার এবং ফেরত এসেছেন ৫০ হাজার বাংলাদেশি। অথচ ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর দেড় থেকে দুই লাখ এ দেশটিতে কাজ করতে যেতেন।
সরকারি সব ধরনের প্রচারে বিদেশে যাওয়ার জন্য কোনো দালাল বা মধ্যস্থতাকারী না ধরে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার কথা বলা হয়। এই প্রচার কোনো কাজে আসছে না। এখনও গ্রামগঞ্জ ও শহরে রয়েছে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ দালাল। সহজ- সরল মানুষ প্রায়ই দালালদের প্রতারণার শিকার হয়। টাকা রসিদ না থাকায় এই প্রতারকদের বিরুদ্ধে তারা মামলাও করতে পারে না। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার খরচ পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। এ অবস্থার প্রধান কারণ হলো দালাল প্রথা। বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা বিদেশে কর্মরত শ্রমিকের সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট নন। বিভিন্ন সমস্যায় পড়লে এ সব কর্মী দূতাবাসের সাহায্য চাইলেও পান না।