অনেক জল্পনা-কল্পনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারে এসেছে মাইক্রোসফট উইন্ডোজের নতুন সংস্করণ উইন্ডোজ ৮।
অ্যাপল ও গুগলের কাছে হারানো সুনাম পুনরুদ্ধারের ল্য নিয়ে শীর্ষ সফটওয়্যার নির্মাতা মাইক্রোসফট করপোরেশন নিয়ে এসেছে এই অপারেটিং সিস্টেম। ২৫ অক্টোবর উইন্ডোজ ৮-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন মাইক্রোসফটের স্টিভেন সিনোফস্কি। লিখেছেন নাজমুল হোসেন
স্টিভেন সিনোফস্কির মতে, উইন্ডোজ ৮ হলো এ যাবৎকালের সেরা উইন্ডোজ। মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী স্টিভ বলমার জানিয়েছেন, উইন্ডোজ ৭ এর পুরো অভিজ্ঞতাকেই ঢেলে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে মাইক্রোসফট অপারেটিং সিষ্টেম জগতের সেরা সংস্করণ উইন্ডোজ ৮। এর আগেরবার যখন মাইক্রোসফট তাদের অপারেটিং সিস্টেমকে ঢেলে সাজিয়েছিল, সেটা ছিল উইন্ডোজ ভিসতা; যা মাইক্রোসফটকে বেশ বিড়ম্বনার মুখে ফেলে দিয়েছিল। তবে মাইক্রোসফট দ্রুতই ত্রুটিগুলো দূর করে উইন্ডোজ ৭ বের করে, যা বেশ প্রশংসা কুড়াতে সম হয়।
অনুষ্ঠান শুরুর আগে বরাবরের মতোই মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ৭-এর সফলতা তুলে ধরে। মাইক্রোসফট জানায়, ৬৭০ মিলিয়নেরও বেশি লাইসেন্স বিক্রি করা হয়েছে উইন্ডোজ ৭-এর যা একে সবচেয়ে বেশি আকারে ছড়ানো অপারেটিং সিস্টেম করে তুলেছে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানেও অত্যন্ত দ্রুত উইন্ডোজ ৭ ব্যবহার করা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে মাইক্রোসফট। এ ছাড়াও এটি উইন্ডোজের সেরা সংস্করণ হিসেবেও প্রশংসা পেয়েছে বারবার। মাইক্রোসফটের কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, উইন্ডোজ ৭ থেকে উইন্ডোজ ৮ ততটা ব্যতিক্রম নয়। উইন্ডোজ ৮-এ হয়তো স্টার্ট বাটন নেই, কিন্তু বাম দিকে নিচে লুকায়িত একটি বাটন রয়েছে যেটি ঠিক স্টার্ট বাটনের কাজ করবে। তবে যতই এক রকম হোক না কেন, দৃশ্যত অনেক পরিবর্তন এসেছে উইন্ডোজ ৮-এ। মাইক্রোসফট নিজেই বলছে, একে ঢেলে সাজানো হয়েছে, আবার তারাই বলছে, এটা ততটা ব্যতিক্রম নয়। তাই এবার ব্যবহারকারীরাই বলবেন আসলে কেমন হয়েছে মাইক্রোসফটের নতুন এই অপারেটিং সিস্টেমের সংস্করণটি। কারণ এখন ব্যবহারকারীদের হাতের নাগালেই রয়েছে উইন্ডোজ ৮।
মাইক্রোসফটের ওস-এর ইতিহাস : মাইক্রোসফট ২০০৯ সালের জুলাই মাসের ২২ তারিখে শেষ করে এখন পর্যন্ত তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভার্সন উইন্ডোজ ৭-এর ডেভেলপমেন্ট। আর ২০০৯ সালের ১ আগস্ট শুরু করে উইন্ডোজ ৮-এর ডেভেলপমেন্ট। এ সময় আইপ্যাডের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। মাইক্রোসফট টাচ বেজড অপারেটিং সিস্টেমের চাহিদা উপলব্ধি করে উইন্ডোজ ফোন ৭-এর মেট্রো স্টাইল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উইন্ডোজ ৮-এর ডিজাইন ঠিক করে। অত্যাধুনিক বৈশিষ্ট্যের নতুন এই উইন্ডোজের জন্য প্রযুক্তিপ্রেমীরা অনেক দিন ধরেই অপোয় ছিলেন। কাউড কম্পিউটিং প্রযুক্তিভিত্তিক এই অপারেটিং সিস্টেমে নানা সুবিধা থাকায় ইতোমধ্যে ব্যবহারকারীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে মাইক্রোসফট। উদ্বোধনের পর মাইক্রোসফট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিক্রি শুরু হওয়ার পর উইন্ডোজ ৮-এর চাহিদা ছাড়িয়ে গেছে ২০০৯ সালে বাজারে আসা উইন্ডোজ ৭-কে।
চারটি সংস্করণ : উইন্ডোজ ৮ অপারেটিং সিস্টেমটি ৩২ ও ৬৪ বিট দুই ধরনের হার্ডওয়্যারেই চলবে। উইন্ডোজ ৮-এ রয়েছে চারটি সংস্করণ। এর মধ্যে ‘নরমাল উইন্ডোজ ৮’ থাকছে সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, ডেভেলপার ও প্রযুক্তিমনস্ক মানুষের জন্য থাকছে ‘উইন্ডোজ ৮ প্রো’। এতে অ্যাডভান্সড কিছু সুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফাইল এনক্রিপ্ট করা, ভার্চুয়াল হার্ড ড্রাইভ থেকে বুট করাসহ মিডিয়া সেন্টার পিসিতে ব্যবহারের জন্য উইন্ডোজ ৮ প্রো এবং মিডিয়া প্যাক অ্যাড-অনের প্রয়োজন পড়বে যা সাধারণ উইন্ডোজ ৮-এ দেয়া নেই। অন্য দিকে ‘উইন্ডোজ ৮ আরটি’ ট্যাবলেট কম্পিউটার চালানোর উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। তবে এআরএম চিপের জন্য তৈরি এই উইন্ডোজের সংস্করণ আলাদা করে কেনা যাবে না। নির্দিষ্ট ট্যাবলেটেই জুড়ে দেয়া থাকবে উইন্ডোজ ৮ আরটি। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ারপয়েন্ট এবং ওয়াননোটের বিনামূল্যের একটি সংস্করণও প্রি-ইনস্টলড থাকবে উইন্ডোজ ৮ আরটি-চালিত ট্যাবলেট ডিভাইসে। আরটি বলতে কী বোঝানো হচ্ছে ‘রান-টাইম’। এই তিনটি ছাড়া আরো বড় কাজের জন্য রয়েছে ‘উইন্ডোজ ৮ এন্টারপ্রাইজ’ সংস্করণ। এতে উইন্ডোজ ৮ প্রোর সব সুবিধার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবীদের জন্য বাড়তি কিছু সুবিধা যোগ করা হয়েছে। বিশেষ করে আইটি প্রফেশনালদের জন্য বাড়তি কিছু সুবিধাও রয়েছে এতে। এর ফলে একাধিক কম্পিউটার বা নেটওয়ার্কিং আরো সহজে করা যাবে। যার যে কাজে কম্পিউটার প্রয়োজন, তাকে অপারেটিং সিস্টেমের ঠিক সেই সংস্করণ (রেগুলার, প্রো, আরটি অথবা এন্টারপ্রাইজ) ব্যবহার করার সুবিধা দিতেই মাইক্রোসফটের এ আয়োজন।
উইন্ডোজ ৮ নিয়ে মতামত : মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী স্টিভ বলমার জানান, উইন্ডোজ ৮ আবারো প্রমাণ করলো এখনো মাইক্রোসফটের উদ্ভাবনী শক্তি ফুরিয়ে যায়নি। উইন্ডোজ ৮ নিয়ে ব্যবহারকারীরা আবারো মাইক্রোসফটকে নতুন করে আবিষ্কার করতে সম হবে। কারণ উইন্ডোজ ৮ একই সাথে পিসি, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট এমনকি টেলিভিশনেও ইনস্টল করা সম্ভব হবে। আমরা চেষ্টা করছি বিশ্বকে নতুন কিছু দেয়ার। মাইক্রোসফট বরাবরই অপারেটিং বিশ্বে সেরা ছিল। উইন্ডোজ ৮ আবারো এটিই প্রমাণ করবে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক মোরহেড বলেছেন, উইন্ডোজ ৮ যদি বাজার ধরতে না পারে, তবে মাইক্রোসফটকে তাদের নতুন নেতৃত্ব নিয়ে ভাবতে হবে।
প্রচারণা : উইন্ডোজ ৮ অপারেটিংকে জনপ্রিয় করতে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছে মাইক্রোসফট। প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সারা বিশ্বে ‘উইন্ডোজ ৮’ সিস্টেমের প্রচারণায়। এর অংশ হিসেবে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থাকেও কাজ দিয়েছে। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ৪টি টিভি বিজ্ঞাপন তৈরি করেছে, যা ৪২টি দেশে প্রচারিত হবে। টিভি বিজ্ঞাপন ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রিন্ট এবং অনলাইন বিজ্ঞাপনও থাকছে। মাইক্রোসফটের পোস্টারও দেয়ালে লাগিয়ে উইন্ডোজ ৮ মডেলের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর নিউ ইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে ডিজিটাল বিলবোর্ডে উইন্ডোজ ৮ ব্যবহার করার নিয়মগুলোর ডেমো দেখানো হয়েছে।
ব্যবহারকারীরা নতুন এই উইন্ডোজে দু’টি উপায়ে যেতে পারবেন। তারা তাদের বর্তমান উইন্ডোজ ৭ কম্পিউটার থেকে উইন্ডোজ ৮ সংস্করণে আপগ্রেড করতে পারবেন অথবা উইন্ডোজ ৮ প্রি-ইন্সটলড কোনো পিসি কিনতে পারবেন। পাশাপাশি উইন্ডোজ আরটি সংস্করণ চালিত টাচস্ক্রিন ট্যাবলেট ডিভাইসও মাত্র ৪৯৯ ডলারে পাওয়া যাবে। ব্যবহারকারীরা নতুন এই উইন্ডোজে অনলাইনের মাধ্যমে হালনাগাদ করতে পারবেন। এতে প্রায় ৪০ ডলার গুনতে হবে। পুরো সংস্করণটি ডিভিডি প্যাকেও পাওয়া যাবে মাইক্রোসফটের খুচরা বিক্রয় কেন্দ্রে। আবার উইন্ডোজ ৮ ইনস্টল করা পারসোনাল কম্পিউটার বা ট্যাবলেটও কেনা যাবে। উদ্বোধনের পর মধ্যরাত থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দোকান, মাইক্রোসফটের হার্ডওয়্যার পার্টনার, মাইক্রোসফট স্টোর থেকে কেনা যাচ্ছে উইন্ডোজ ৮ এর সফটওয়্যার।
উইন্ডোজ ৮ সংবলিত সারফেস ট্যাবলেট : মাইক্রোসফট নিজ পরিকল্পনায় বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে সারফেস ট্যাবলেটকে বাজারে এনেছে। সারফেস মাইক্রোসফটকে ট্যাবলেটের বাজারে অনেকটা এগিয়ে নেবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। এটি আইপ্যাড ও আন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম-চালিত ট্যাবলেটের চেয়েও ভালো বলে অনেকে রায় দিয়েছেন। কারণ উইন্ডোজ ৮ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অপারেটিং সিস্টেম। এ ট্যাবের বৈশিষ্ট্য বর্তমানের বেশির ভাগ উচ্চমানের ট্যাবলেটের মতোই। ৯৩ মিলিমিটার পুরু ও ১৫ পাউন্ড ওজনের ট্যাবটিতে কিছু নতুনত্বও আনা হয়েছে। আলট্রা ওয়াইড ভিউয়িং অ্যাঙ্গেল, অটো অ্যাডজাস্টিং স্ক্রিন সুবিধাসহ এতে রয়েছে ১০ দশমিক ৬ ইঞ্চি টাচস্ক্রিন পর্দা। কাজের সুবিধার জন্য রয়েছে তিন মিলিমিটার পাতলা কি-বোর্ড, যা ম্যাগনেটিক স্ট্যান্ডের মাধ্যমেই ট্যাবলেটের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। সারফেসে গান শোনা বা ছবি দেখা কিংবা দাফতরিক কাজের ছবি দেখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে হাই ডেফিনেশন ডিসপ্লে প্রযুক্তি। পেছনের স্ট্যান্ডের মাধ্যমে চাইলে ছবির ফ্রেমের মতো দাঁড় করানো যাবে এটিকে। আর ব্যাটারির স্থায়িত্বকালও হবে বর্তমান ট্যাবলেটগুলোর থেকে অনেক বেশি। ৩২ গিগাবাইট তথ্য ধারণমতা ও টাচ কভার ছাড়া প্রারম্ভিক সংস্করণের মূল্য ৪৯৯ ডলার হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। টাচ কভারসহ একই মডেলের মূল্য ৫৯৯ ডলার এবং টাচ কভারসহ ৬৪ গিগাবাইটের মূল্য ৬৯৯ ডলার। অ্যাপলের জনপ্রিয় ট্যাবলেট কম্পিউটার আইপ্যাডের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে একই দিনে উইন্ডোজ ৮ চালিত ট্যাবলেট কম্পিউটার ‘সারফেস ট্যাব’ বাজারে ছেড়েছে মাইক্রোসফট।