বর্তমান সময়ের আলোচিত সংবাদ হচ্ছে টেলিটকের পরিক্ষামূলক থ্রিজি সংযোজন। ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও’ স্লোগান নিয়ে বাজারে এসেছে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মুঠোফোন অপারেটর টেলিটকের থ্রিজি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে চীন সরকারের সহায়তায় সংযোজিত টেলিটকের পরীক্ষামূলকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আধুনিক থ্রিজি প্রযুক্তি সেবার উদ্বোধন করেন। দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে উন্মোচিত হলো এক নতুন দিগন্ত। এর মাধ্যমে তৃতীয় প্রজন্মের এই প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর স্তরে উঠে এল বাংলাদেশ এবং স্থাপিত হলো এক নতুন মাইলফলক। নতুন এই সংযোজন তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প ও সেবার বিকাশ ঘটানোর পাশাপাশি শিক্ষা, গবেষণা, শিল্প, কৃষি, সেবা খাতসহ সব ক্ষেত্রেই এর ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করবে। এতে দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ও জনগণের ক্ষমতায়নে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত হবে।
থ্রিজিতে আপগ্রেডেশনের অনুমোদন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোসহ তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের সরকার ২০০৮ সালের মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। থ্রিজিকে বলা হয় তৃতীয় প্রজন্মের তারবিহীন প্রযুক্তি। এককথায় থ্রিজি প্রযুক্তি হচ্ছে উচ্চগতির মোবাইল ইন্টারনেট সুবিধাযুক্ত একটি প্রযুক্তি। থ্রিজি প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় সুবিধা হলো, এই প্রযুক্তি কার্যকর থাকলে মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে ভয়েস সুবিধার পাশাপাশি ব্যবহারকারী উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া টিভি দেখা, খেলা দেখা, ভিডিও ক্লিপস আদান-প্রদান, ভিডিও কনফারেন্স, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) যার মাধ্যমে নিখুঁত পথনির্দেশনা পাওয়া সম্ভব। থ্রিজি বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের একমাত্র সমাধান। গণ ব্রডব্যান্ড ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন অবান্তর। কেননা ডিজিটাল বাংলাদেশে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট হবে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার। মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়া অন্য কোনো নেটওয়ার্কে যে কোনো লোকেশনে ব্রডব্যান্ড দেয়া প্রায় অসম্ভব। বর্তমান সময়ে ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের জন্য পৃথিবীতে সাধারণত তিন ধরনের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো ব্যবহার করা হচ্ছে -১. ফাইবার অপটিক ক্যাবল; ২. ওয়াইম্যাক্স ও ৩. থ্রিজি মোবাইল নেটয়ার্ক।
বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান (ওয়েব ইন্ডেক্স বটম টেন) একেবারে শেষের দিকে। গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালের সূচকে (২০১২ ওয়েব ইন্ডেক্স), সু্ইজারল্যান্ড ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ফাউন্ডেশন ৬১টি উন্নত ও উন্নয়শীল দেশের মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ ও ব্যবহার, এবং সমাজ ও রাজনীতিতে এর বহুমাত্রিক প্রভাব সম্পর্কে চালানো এক জরিপের পরে এ কথা বলেছে। সূচকে একটি দেশের মানুষ ও পুরো জাতির মধ্যে ইন্টারনেটের ব্যবহার, উপযোগিতা এবং প্রভাব কতটা সে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব -এর উদ্ভাবক স্যার টিম বার্নারের ফাউন্ডেশনের ওয়েব ইন্ডেক্সে ৬১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বোপরি অবস্থান ৫৫তম (র্যাংক-৫৫, কান্ট্রি-বাংলাদেশ, ওয়েব ইন্ডেক্স-১৩.৬, ইম্পেক্ট-১৯.৬৯, ইকনোমিক-১৬.৪৪, পলিটিক্যাল-৮.৩৮, সোস্যাল-৩৫.৬৫, রেডিনেস-১৪.৯৮, কমিউনিকেসন্স-২৬.১, ইন্সটিটিউশনাল-১৩.৯৭, দি ওয়েব-৩.৭, ইউজ-১.৬২, কনটেন্ট-৬.৬)। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশ। আর বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ৩৩তম, পাকিস্তান ৪৪তম এবং নেপাল ৫২ তম অবস্থানে রয়েছে।
বর্তমান সরকারের অন্যতম বড় একটি প্রতিশ্রুতি ছিল দেশকে তথ্যপ্রযুক্তি সেবার আধুনিকায়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে 'ডিজিটাল বাংলাদেশে' রূপান্তর করা। যথাসময়ে সে লক্ষ্যে পৌছাতে হলে কার্যকরভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ এখনো এর সূচনা পর্যায়েই রয়েছে বলাযায়। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট সেবার আওতায় আছেন বলে ধারনা করা হচ্ছে। ইন্টারনেটের গতির মান বিবেচনা করলে এটা কত শতাংশে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল। কারণ ইন্টারনেটের ফলপ্রসু ব্যবহার তখনই সম্ভব, যখন তার গতির মান সন্তোস জনক পর্যায়ে থাকবে। যাকে আমরা ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি/ইন্টারনেট বলি। বাংলাদেশের বিদ্যমান টেলি আইনে ২৫৬ কিলো বিট পার সেকেন্ড বা এর অধিক গতির কানেক্টিভিটিকে ব্রডব্যান্ড বলা হয়েছে। যদিও বর্তমান সময়ে ১ মেগা বিট পার সেকেন্ড (অর্থাৎ ১০২৪ কিলো বিট পার সেকেন্ড) এর নিচের গতিকে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটিই বলা হয় না। ন্যাশনাল ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কে অস্ট্রেলিয়া ২৪তম অবস্থানে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ইন্টারনেটের গড় গতি ৪.৯ মেগা বিট পার সেকেন্ড। প্রযুক্তিগত বিভেদ (ডিজিটাল ডিভাইড) রোধ কল্পে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিতে হবে গ্রাম-গঞ্জ, শহর নির্বিশেষে দেশের সর্বত্র। তবেই ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব নাগরিকের জন্য প্রযুক্তি বিভেদমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। থ্রিজি মোবাইল নেটওয়ার্ক এ ক্ষেত্রে অগ্রণীভূমিকা পালন করতে পারে।
দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে গত আগস্ট মাস পর্যন্ত টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪ লাখ। তৃতীয় প্রজন্মের (থ্রিজি) জন্য থ্রিজিবান্ধব নয়া নেটওয়ার্ক কাঠামো প্রয়োজন। তাই প্রাথমিকভাবে ঢাকা শহরের প্রায় চার লাখ টেলিটক গ্রাহক থ্রিজি ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন। বর্তমানে কেবল ঢাকায় থ্রিজি সুবিধা চালু থাকলেও এ বছরের শেষ নাগাদ চট্টগ্রামে এবং যথাশিঘ্রই দেশব্যাপী থ্রিজি নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা হবে বলে জানানো হয়েছে। বর্তমানে যেকোনো টু-জি গ্রাহক নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করে নতুন সিম ছাড়াও পুরোনো সিমে থ্রিজি সেবা উপভোগ করতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে শুধু কথা বলার জন্য যে খরচ তা দিয়েই থ্রিজিতে কথা বলা যাচ্ছে। থ্রিজির সব সেবাতেই আছে ১০ সেকেন্ড পালসের সুবিধা। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), সময় টিভি, জিটিভি (গাজী টিভি), আরটিভি ও মাইটিভি দেখা গেলেও। পর্যাক্রমে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের সব টিভি চ্যানেল দেখা যাবে। তবে থ্রিজি নেটওয়ার্ক সুবিধা উপভোগ করতে গ্রাহকদের প্রয়োজন উন্নত (থ্রিজি সেবা দিতে স্বক্ষম) মোবাইল ফোন সেট। তাছাড়া ডঙ্গলের মাধ্যমে কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপে থ্রিজি ইন্টারনেট ব্যবহার করার বিষয়ে নির্দেশনা প্রয়োজন। টেলিটকের থ্রিজি সিস্টেম আপগ্রেডেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রথমদিকে কিছু সমস্যা দেখাদিতেই পারে। অপরদিকে নতুন এ প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ গ্রাহকদের খুব বেশি তথ্য (এ প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকগুলো) জানা না থাকার বিষয়টি থ্রিজির কাটতিতে বড় ধরনের প্রভাব রাখতে পারে। সকলের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাই পারে এ ধরণের একটি শুভ উদ্যোগকে সাফল্য মণ্ডিত করতে। একটি নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়নে গ্রাহকেরা কিছুটা সমস্যা/ভোগান্তিতে পড়েতেই পারেন। থ্রিজি সংক্রন্ত তথ্য সেবাদিতে টেলিটকের প্রধান কার্যালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হচ্ছে।
গ্রাহক সংখ্যার বিচারে টেলিটক অন্যান্য মোবাইল অপারেটরের তুলনায় অনেক ছোট হলেও শুধুমাত্র তাদেরকেই এই সেবা চালুর সুযোগ দেওয়া নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক অসন্তোষ ও সমালোচনা শোনা গেছে। তবে সরকারের পক্ষ হতে বলা হয়েছে, টেলিটককে দিয়ে এই প্রযুক্তির বানিজ্যিক ভিত্তিতে চালানোর পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভারতেও রাষ্টায়ত্ব কোম্পানীর মাধ্যমে ছয় মাস ধরে পরীক্ষা করা হয়েছিল। থ্রিজি সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত হলেই সবার জন্য তা উন্মুক্ত করা হবে।
লেখকঃ মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন,
প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি),
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।