বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। কিন্তু সেই খাদ্যই আজ ভেজাল মুক্ত নয়। ফলের দোকানে থরে থরে রং বেরঙের ফল, বাজার ভরা হরেক রকমের তরতাজা সবজি, মাছ, গোস্ত। পকেট ভারি থাকলে বাজারের ব্যাগও ভরে যেতে পারে। কিন্তু এগুলোতে যে গণহারে বিষ মেশানোর প্রতিযোগিতা চলছে তা খালি চোখে দেখে চট করে বোঝার উপায় আছে কি?
আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ইষ্ট, ছত্রাক অর্থাৎ বিভিন্ন ধরণের জীবাণু সুযোগ পেলেই খাদ্যের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এর ফলে খাদ্য পচে নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই খাদ্য সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নিতে হয়। সবজি, মাছ, তরকারি সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ বা হিমাগারে রাখা হয়। আগে বাজারে বড় বড় বরফের চাঁই প্রায়ই চোখে পড়ত। মাছ ও মাংসে লবন মাখিয়ে শুটকি বানিয়ে সেগুলো দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায়। আচার তৈরি করাও এক ধরনের সংরক্ষণ ব্যবস্থা। তাছাড়া বায়ো সংরক্ষণ জীবাণু দিয়েও খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। অনেক সময় সঠিক মাত্রায় ভিনেগার, সোডিয়াম বেনজয়েট, পটাসিয়াম সরবেট, সাইট্রিক এসিড, অ্যাসকরবিক এসিড ইত্যাদি কেমিক্যাল ব্যবহার করেও খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু খাদ্য সংরক্ষণের নামে তাতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশালে জীবাণুর সাথে সাথে খোদ মানুষই অক্কা পেতে বাধ্য। আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের লোভে এই সর্বনাশা খেলায় দশহাত এগিয়েই বলতে হবে।
ফসলের ক্ষেতে ও ফলের গাছে পোকামাকড় দমনের জন্য নিয়ন্ত্রিত মাত্রার পরিবর্তে অধিক মাত্রায় কীটনাশক মেশানো হচ্ছে। এর ফল হিতে বিপরীত হচ্ছে। পোকামাকড়ের সাথে সাথে কচি শিশুদের প্রাণ হরণের ঘটনাও ঘটছে। দিনাজপুরে লিচু বাগানে খেলতে গিয়ে অতিমাত্রায় কীটনাশক মিশ্রিত লিচু খেয়ে কয়েকজন অবুঝ শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা সেই সাক্ষ্যই বহন করে। যা মেনে নেয়া সত্যি কঠিন। ফসল ও ফলে কৃত্রিম রং মিশিয়ে রঙিন বানানো হচ্ছে। বিশেষ করে বাচ্চারা যে সস ছাড়া কোন খাবারই খেতে চায় না তা ঘন দেখানোর জন্য এমাইলাম মেশানো হচ্ছে। কেইন সুগার মিশিয়ে মধুর প্রকৃত স্বাদ ও গুণকে বিকৃত করে দেয়া হচ্ছে। তৃণভোজী প্রাণী গরুকে মোটাতাজা করার জন্য প্রানীদেহের হাড়ের গুড়ো খাইয়ে এবং শুধু গো-খাদ্যেই নয়, মানুষের প্রধান খাদ্য চালে ইউরিয়া মিশিয়ে চকচকে ও মুড়িকে সাদা ধবধবে দেখিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। আর ফার্মের মুরগীগুলো খাঁচায় ভরে কৃত্রিম খাদ্য হিসেবে ব্লাড-মিল, ট্যানারির ক্যামিকেল মিশ্রিত বর্জ খাইয়ে নাদুস নুদুস বানানো হয়। ফলে এগুলোর মাংস ও ডিমে যে বিষ জমা হচ্ছে তা আমরা নানা স্বাদের আইটেম বানিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে থাকি। যা আমাদের দেহের বাহ্যিক অবয়বকে বৃদ্ধি করছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরের মূল্যবান অঙ্গগুলো যে তিলে তিলে ক্ষয় করে দিচ্ছে তা হয়ত আমরা অনেকেই জানিনা। তাছাড়া সবজি, ফল, দুধ ও ছানা থেকে তৈরি মিষ্টিতে, মাছ ও মাংসে ফরমালিন মিশিয়ে বেশিদিন ধরে সেগুলো টাটকা দেখানোর অপকৌশল নেয়া হয়। জেনেই হোক বা না জেনেই হোক খাদ্যরূপ এই অখাদ্যই আমাদেরকে দিনের পর দিন গলাধঃকরণ করতে হচ্ছে। এর ফলে চর্মরোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কলা এখন বছরের সব সময়ই কম-বেশি পাওয়া যায় বলে তা আমরা প্রায়ই খেয়ে থাকি। কিন্তু এই কলা সহ আম ও অন্যান্য ফল পাকানোর মোক্ষম ও সর্বনাশা হাতিয়ার হলো ক্যালশিয়াম কার্বাইড। ওয়েল্ডিং করার কাজে, আতশবাজি ও বোমা বানানোর জন্য যা ব্যবহৃত হত, আজ ফল ব্যবসায়ীরা সেই বিষ মানুষকে খাইয়ে কিডনি ও লিভারের মত অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ ধ্বংস করার খেলায় মেতেছে। যারা এমনটি করছে, শুধু অজ্ঞতার দোহাই তুলে তাদেরকে বার বার মাফ করে দিলে তাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের লাভ হতে পারে। কিন্তু এর জন্য জনগনকে যে ক্ষতি গুনতে হচ্ছে তার দায় কে নেবে? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় এর দায় এড়াতে পারবেন না।
ক্ষুধা নিবারণ ও জীবন বাঁচানোর জন্য আমরা যে খাদ্য খাই তাতে বিষ মেশাতে গিয়ে মানুষ নামের অমানুষেরা কি একটি বারও ভাবছে না? একজন প্রকৃত ও সাধু ব্যবসায়ী কখনই এমনটি করতে পারেন না। সত্যিই অবাক লাগে! আমরা যেন এই লোভীদের হাতে জিম্মি হয়ে গেছি। এসব জেনে বুঝেও বাজার থেকে পয়সা দিয়ে বিষ কিনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তা নির্বিঘ্নে খেয়ে চলেছি। হায়! আমাদের করোরই কি কিছুই করার নেই? না, মনুষ্যত্ব বিবর্জিত এই অন্যায়কে আর এক মুহূর্ত মেনে নেয়া যায় না। আসুন! এই বাংলার প্রতিটি খাদ্য, ফল ও ফসলকে বিষ-মুক্ত করার জন্য দৃপ্ত শপথ নেই। আমরা সবাই একসাথে গর্জে উঠি। প্রতিবাদে সোচ্চার হই। বিষ মুক্ত বাজার গড়তে সময়োচিত ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করি।
খাদ্যে বিষ ও ভেজাল মেশানোর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা জড়িত, তারা যে কতবড় অপরাধ ও ক্ষতি করছে তা বোঝার মত বোধটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে। মৌসুমের শুরুতে মাঝে মাঝে বুলড্রজার দিয়ে কয়েক টন আম পিষ্ট করার ছবি সহ খবর ছাপা হয় ঠিকই। কিন্তু তারপর সব তথৈবচ। আসলে বুলড্রজারের নিচে আম নয়, বরং খাদ্যে বিষ মেশানোর সাথে জড়িতদের কয়েকজনকে পিষ্ট করার মত পদক্ষেপ দরকার। কথাটা কঠিন মনে হলেও একটু ভেবে দেখবেন। কারন শুধু আমাদের জন্য নয়, ভবিষ্যত বংশধরদের কথা ভেবে এখুনি যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে আমাদের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে সাধারন শিক্ষিত জনগণকে সোচ্চার হতে হবে, অজ্ঞদের সচেতন করে তুলতে হবে এবং খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর বস্তু মেশানোর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে পাড়ায় মহল্লায়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা থেকে শুরু করে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিষযুক্ত খাদ্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সভা সমাবেশ করার মাধ্যমে ছাত্র-জনতার মাঝে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে বাজার বিষমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বিষ মেশানোর মত সন্দেযুক্ত খাদ্য সামগ্রী যতটুকু সম্ভব বর্জন করার মাধ্যমে প্রথম প্রতিবাদ শুরু করা যেতে পারে। অর্থাৎ গো-গ্রাসে খাবার জন্য বাঁচা নয় বরং বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু না খেলেই নয় সেই অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সেইসাথে সরকারকে অতিসত্বর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য এবং প্রয়োজনে আইনের সংস্কার করে তা প্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। অভিযুক্তদের জন্য কঠিন সাজার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে মূল হোতাদেরকে জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।
(Collected)