বিবাহের সর্বাধুনিক সংজ্ঞাঃ চিরাচরিত ধারণা থেকে আধুনিকতা - প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে- মেয়েদের বিবাহ পূর্ব যৌন মেলামেশা 'বিবাহ' বলে পরিগণিত হবেঃ মাদ্রাজ হাইকোর্ট—
আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি তখন অমূল্য চন্দ্র নামক একটি মামলা পড়েছিলাম। মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই যে, অমূল্যের মা’ যখন শয্যাশায়ী তখন পাশের বাড়ির এক মেয়ে তাঁর মাকে দেখাশোনা করার প্রাক্কালে ওই মেয়ের সাথে অমূল্যের প্রণয় সংগঠিত হয় এবং ধূর্ত অমূল্য মেয়েটিকে শুধু মাত্র মালা বদল করে বোকা মেয়েটাকে এই বোঝায় যে, মালা বদলের মাধ্যমে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে সুতরাং তাদের মাঝে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে আর কোন বাধা নেই। মেয়েটিও এই বিশ্বাসে তার সাথে মেলামেশা করে এবং এক পর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে যায়। মেয়েটি তখন বিবাহের স্বীকৃতি দাবি করলে এই প্রশ্নে আদালত বলেন, শুধুমাত্র মালা বদলের মাধ্যমে কোন হিন্দু বিবাহ সংগঠিত হয় না- সাত পাক ঘোরা, অগ্নি স্বাক্ষী ইত্যাদি হিন্দু বিবাহের অপরিহার্য শর্ত। (Mere Exchange of garland does not constitute a valid marriage).
গত দু-দিন আগে কেরালা হাইকোর্টের সদ্য প্রদত্ত একটি রায় পেলাম যা 'অমূল্য চন্দ্র’ মামলায় প্রদত্ত রায় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন যেখানে লিভ-টুগেদারকে বিবাহ বলে ধরে নিতে হবে বলে আদালত তাঁর রায়ে বলেছেন। উক্ত মামলার ঘটনা ছিল এরকম, ভারতের একটি পারিবারিক আদালতে এক মহিলা ভরণ পোষণ অধিকারের দাবিতে এক মামলা দায়ের করেন যেখানে তাঁরা বিবাহ বহির্ভূত পন্থায় এক ছাদের নিচে স্বামী-স্ত্রী’র ন্যায় বসবাস করছিলেন। নিন্ম আদালত মামলাটি এই মর্মে খারিজ করে দেন যে, বিবাহ সম্পর্কিত কোন দালিলিক প্রমাণ উক্ত মহিলা আদালতে দাখিল করতে পারেন নি। কিন্তু কেরালা হাইকোর্টে বিচারপতি সি, এস, কারনান নিন্ম আদালতের এই সিদ্ধান্তকে নাকচ করে বিবাহের সংজ্ঞায় যুগান্তকারী ও যুগোপযোগী এক সিদ্ধান্ত দেন যা আজকের আলোচ্য বিষয়।
রায়ের মূল বিষয় হচ্ছে, আইন সংজ্ঞায়িত প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে যদি বিবাহ পূর্ব কোন শারিরীক সম্পর্কে মিলিত হয় এবং একত্রে বসবাস করে সেক্ষেত্রে এটিকে 'বিবাহ' হিসাবে চিহ্নিত করার ঘোষনা দিয়েছেন ভারতীয় মাদ্রাজ হাইকোর্ট। এবং একত্রে বসবাসকারী ছেলে মেয়েদের 'স্বামী-স্ত্রী' হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
যদি কোন অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ে যথাক্রমে ২১ এবং ১৮ বছর অতিবাহিত করে এবং একত্রে বসবাস করতে চায়- তাহলে 'ফ্রিডম অব চয়েজ' অনু্যায়ী এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার তবে এ সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত সকল ফলাফল দ্বারাও তারা বাধ্য কারণ কোন 'কাজ' বা' আচরণ' দ্বারা দায়িত্বশীল পক্ষ তাঁর ফলাফল অনুসরণ করবে এটাই স্বাভাবিক।
আদালতের মতে, বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা প্রতিটি সমাজে ভিন্ন হতে পারে কিন্তু বিয়ের কিছু কমন ফলাফল আছে। বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন- মালা বা আংটি বদল অথবা বিয়ের রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা যা প্রায় প্রতিটি সমাজে ভিন্ন রুপ পরিগ্রহ করতে পারে কিন্তু বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী’র একে অপরের প্রতি বাধ্যবাধকতা, উৎপাদিত সন্তানের প্রতি দায় দায়িত্ব বা সামাজিক গ্রহণ যোগ্যতা- এগুলো বিয়ের ফলাফল, যা প্রায় প্রতিটি সমাজে অভিন্ন। দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে যখন একত্রে বসবাস করে তখন তারা নিজেদের মধ্যে সম্মতির ভিত্তিতে একই ছাদের নিচে থাকে বলে ধরে নেওয়া যায়। সুতরাং সমাজে বিবাহপূর্ব অরাজকতা রোধে ও ছেলে-মেয়েদের পারস্পরিকভাবে একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল হবার ক্ষেত্রে তাদের একত্রে বসবাসকে বিবাহ ভিন্ন অন্য কোন সংজ্ঞায় ফেলা সমাজের শৃংখলার জন্য মারাত্নক হুমকি বলে মনে করা যেতে পারে। সুতরাং জেনে শুনে প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েরা একত্রে বসবাস করবে, বিবাহের সমস্ত সুবিধা ভোগ করবে অথচ এর দায়িত্ব নিবে না, এমনটি হতে দেওয়া অনুচিত। তাই যখন তারা একই ছাদের নিচে বসবাস করবে তখন বিবাহের অনুমান নীতির উপর ভিত্তি করে তাদের স্বামী-স্ত্রী বলে গন্য করাই অধিক সমীচীন।
আদালত তাঁর রায়ে আরো বলেন, যখন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েরা এরুপ পন্থায় একে অপরের সাথে বসবাস করবে তখন তারা বা তাদের মধ্যে যে কোন পক্ষ তাদের উক্ত বসবাসকে বিবাহ বিবাচনায় ঘোষনা করার মানসে ঘোষনা মূলক মোকাদ্দমা দায়ের করতে পারবে। এবং সে অনুযায়ী সরকারী সব রেজিস্ট্রারে তাদের নাম উক্ত পন্থায় স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গণ্য করতে হবে যেখানে স্বামী-স্ত্রী’র সমস্ত অধিকার ও দায় দায়িত্ব তাদের উপর বর্তাবে। অর্থাৎ বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত ব্যাপারে তারা আইনের অধীনে সমস্ত দায় দায়িত্বের মুখোমুখি হবে।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, বিবাহের চিরাচরিত যে সংজ্ঞা আমরা জানি অর্থাৎ মুসলিম আইনে বিবাহ হল দেওয়ানি চুক্তি যা সম্মতির ভিত্তিতে দুজন ছেলে-মেয়ের মধ্যে সন্তান জন্ম দান ও বংশ বৃদ্ধির মানসে সংগঠিত হয় ।হিন্দু আইনে বিবাহকে ধর্ম চর্চার একটি অংশ ধরা হয়; এবং আমরা জানি যে, হিন্দু আইনে ধর্ম চর্চা অনেকাংশে আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর। সেই হিসাবে বিবাহ ও আনুষ্ঠানিক রীতি নীতির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে সেটাই হিন্দু আইনের ভাষ্য। কিন্তু কেরালা হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্ত হিন্দু আইনে প্রদত্ত বিবাহের ধারণা থেকে অনেকাংশে বিচ্যুত ধারণা। উল্লেখ্য, পশ্চিমা দেশগুলোতে আনেক জায়গায় সেক্স বদলের মাধ্যমে বা সমজাতীয় সেক্সের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অর্থাৎ, বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার সময় এখন এসেছে যা হবে মানুষের কল্যাণের মানসে এবং শুধুমাত্র সমাজের প্রয়োজনের তাগিদে। বিচার বিভাগ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় এরুপ প্রো- পিপল সিদ্ধান্ত দিবে যার মাধ্যমে জুডিশিয়াল এক্টিভিজম অনেকাংশে তরান্বিত হবে। উচ্চ আদালতের বিচারকগণ জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রিটেশনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।