শিশুদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ (স.) এর ভালবাসা
মাহমুদুর রহমান
শিশুরা হলো আল্লাহর প্রদত্ত আমাদের জন্য নেয়ামত ও বরকত স্বরুপ। অন্য হাদীসে আছে নবী করিম (স.) বলেন "শিশুরা আল্লাহর ফুল" (তিরমিযী)। এই ফুল একদিন প্রস্ফুটিত হয়ে সমাজকে করবে মুখরিত, আলোকিত ও আন্দোলিত। আর এ জন্য শিশু বয়স থেকেই সন্তানের দিকে বিশেষ খেয়াল করা দরকার। আপনার সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক তার দিকে আপনার সমান দৃষ্টি দিতে হবে। আপনার সন্তান কখন, কোথায় এবং কাদের সাথে সময় কাটায় সে দিকে আপনার বিশেষ খেয়াল দেয়া দরকার।
শিশুকাল থেকেই আমাদের সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন "সন্তানকে আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়া সম্পদ দান করা অপেক্ষা উত্তম" (বায়হাকি)। রসূল (স.) আরও বলেন "তোমরা তোমাদের সন্তানকে উত্তম করে গড়ে তোলো এবং তাদের নৈতিকতা তথা শিষ্টাচার শিক্ষা দাও " (মুসলিম)।
শিশুদের প্রতি রসূল (স.) ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। শিশুদের প্রহার করা সম্পর্কে রসূল (স.) অত্যন্ত কঠোর হুশিয়ারি করেছেন। রসূল (স.) শুধু শিশুদের আদরই করতেন না, বরং তাদের সাথে খেলাধুলা, হাসি ঠাট্টা করতেন এবং তাদের সালাম ও দিতেন। হযরত আনাস (রা.) একবার শিশু কিশোরদের কাছে দিয়ে যাবার সময় সালাম দিলেন এবং বললেন রসূল (স.) ছোটদের সালাম করতেন (বুখারী ও মুসলিম)। রসূল (স.) শুধু উপদেশই দেননি বরং বাস্তব জীবনে তার নমুনা পেশ করেছেন।
হযরত আনাস (রা.) ছোট কাল থেকেই রসূল (স.) এর কাছে থাকতেন। একদিন হযরত আনাস (রা.) বলেন "আল্লাহর কসম করে বলছি দীর্ঘ দশ বছরে আমি রসূল (স.) যতটা খেদমত করেছি তার চেয়ে বেশি খেদমত পেয়েছি এবং দীর্ঘ দশ বছরে তিনি আমার কোন কথা ও কাজে বিরক্তি প্রকাশ করেননি , বরং তিনি ছিলেন আমার প্রতি খুব বেশি সদয়। শিশুদের প্রতি রসূল (স.) এর ভালোবাসা সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করছে। আয়শা (রা.) বলেন" একবার এক বেদুইন রসূল (স.) এর কাছে উপস্থিত হয়। তখন রসূল (স.) একটা শিশুকে চুমু দিচ্ছিলেন। লোকটি বলেন, আপনারা বাচ্চাদের চুমু খান? আমরা তো এমনটা করি না। তখন রসূল (স.) বললেন : আল্লাহ তাআলা যদি তোমার হৃদয় থেকে দয়া ও ভালোবাসা কেড়ে নেন, তবে আমি কি করতে পারি"? (বুখারী ও মুসলিম)।
একবার নবী করিম (স.) এর কাছে একটা শিশু আনা হলো। তিনি তাকে চুম্বন করলেন। প্রিয়নবী শিশুদের এত বেশি ভালোবাসতেন যে, শিশুরা তাদের আপনজনদেরও ভুলে যেত। তার বাস্তব নমুনা হলো— রসূল (স.) এর পালিত পুত্র যায়েদের পিতা একদিন তাকে ফেরত নিতে আসলে তিনি পিতার সাথে যাননি বরং পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন "প্রিয় আব্বাজান আমি রসূল (স.) এর ভেতর যা দেখেছি এবং তার কাছ হতে যা পেয়েছি এই জগতে আমার আর কিছু পাওয়ার নাই।"
শিশুদের প্রতি রসূল (স.) এর ব্যবহার ছিল সর্বকালের এবং সর্বযুগের মানুষের জন্য শিক্ষনীয় এবং অনুকরণীয়। তিনি শিশুদের সাথে খেলতেন এবং তাদের পছন্দের বিষয় নিয়ে শিশুদের সাথে শরীক হতেন। আনাস (রা.) বলেন "রসূল (স.) আমাদের সাথে সহজ- সাধারণভাবে মেলামেশা করতেন এবং নিজেকে আলাদা করে রাখতেন না। এমনকি তিনি আমার ছোট ভাই উমায়রকে বলতেন : হে উমায়ের! তোমার নুগায়েরের কি হলো? উমায়রের একটা ছোট নুগায়ের (পাখি) ছিলো। সে পাখিটিকে নিয়ে খেলা করতো। সেই পাখিটি মরে গিয়েছিলো। তখন নবী করিম (স.) তাকে একথা বলেন (বুখারী, মুসলিম)।
একবার আবিসিনিয়া হতে একদল সাহাবী মদিনায় তাশরিফ আনলেন। তাদের সাথে ছোট শিশুরা ছিল। তখন রসূল (স.) অতি সহজেই মত শিশুদের সাথে মিশে গেলেন, খেলাধুলা করলেন এবং তাদের আদর যত্ন করলেন। এর ফলে শিশুরা অনেক আনন্দ বোধ করলো। রসূল (স.) শিশুদের অনেক বেশি স্নেহ করতেন, যার নমুনা আমরা হাদিস হতে পাই: হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (স.) হাসান ইবনে আলীকে চুমো খেলেন। তা দেখে আকরা ইবনে হাবিস বললেন, আমার তো দশটি সন্তান আছে, কিন্তু তাদের এক জনকেও চুমো খাইনি। রসূল (স.) জবাবে বললেন, যে অন্যের প্রতি স্নেহ মমতা করেনা তার প্রতিও স্নেহ মমতা করা হয়না" (বুখারী ও মুসলিম)।
রসূল(স.) সব সময় শিশুদেরকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করতেন এবং তাদের কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেন। একদিন রসূল (স.) মসজিদের মিম্বরে খুতবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় তার দৌহিত্রদ্বয় দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে গিয়ে পা পিছলে পরে যাচ্ছিল এমন সময় রসূল (স.) খুতবা বন্ধ করে তাদের কে কোলে তুলে নিলেন এবং তাদের আদর করলেন। এছাড়াও রসূল (স.) শিশুদের কান্নার আওয়াজ শুনলে নামায সংক্ষিপ্ত করতেন।
রসূল (স.) এর মত শিশুদের প্রতি এত ভালবাসা কেউ কোন দিন দেখায়নি এবং দেখাতে পারবেও না। তিনি শুধু মুসলিম শিশুদের নয়, অমুসলিম শিশুদেরও ভাল বাসতেন, আদর দিতেন এবং স্নেহ করতেন। তাই রসূল (স.) যথার্থই বলেছেন "ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে এমন ব্যবহার কর যাতে তাদের মধ্যে আত্মসম্মান বোধ জাগ্রত হয়।
অন্য এক হাদীসে প্রিয়নবী (স.) বলেন "যে ছোট ছেলেমেয়েদের প্রতি সদয় নয় সে আমাদের দলভুক্ত নয়।" রসূল (স.) শিশুদের প্রতি ভালোবাসার বিশ্ব নজির স্থাপন করেছেন। তাই আসুন নবী করিম (স.) এর এই মহান সুন্নতকে আমরা আঁঁকড়ে ধরি এবং এই বিশ্বকে একটা আদর্শ উপহার দেই।