সমস্ত প্রশংসা এক আল্লাহর জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যার পরে আর কোন নবী নেই এবং শান্তি বর্ষিত হউক তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীবৃন্দ ও যারা কিয়ামত পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁর আনুগত্য করবেন তাদের প্রতি।
১. ঈমান ও সৎকর্ম: সৌভাগ্যময় জীবন লাভের অন্যতম প্রধান ও আসল উপায় হল ঈমান ও সৎকর্ম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ﴾ [النحل:97]
মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।”— [ সূরা আন-নাহল: ৯৭]
সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমান ও সৎ আমলের সমন্বয় সাধন করতে পারবে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ইহকালে পবিত্রময় জীবনের এবং ইহকালে ও পরকালে উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আর এর কারণ সুস্পষ্ট। কেননা, মুমিনগণ আল্লাহর প্রতি বিশুদ্ধ ঈমানের ফলে সৎকাজ করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য মন-মানসিকতা ও নৈতিক চরিত্রকে সংশোধন করে। তাদের সাথে মৌলিক নীতিমালা রয়েছে, যার দ্বারা তারা তাদের নিকট উপস্থাপিত সকল প্রকার হাসি-আনন্দ, অস্থিরতা ও দুঃখ-বেদনার কারণসমূহ উপলব্ধি করতে পারে।
এই নীতিমালা গ্রহণ, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও উপকারী ক্ষেত্রে তার যথাযথ ব্যবহার দ্বারা তারা রাগ-বিরাগ ও অন্যায়-অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে তারা যখন তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করবে, তখন এর দ্বারা তাদের জন্য আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তার স্থায়িত্ব ও বরকতের ব্যাপারে আশা জাগবে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীদের সাওয়াবের প্রত্যাশা তৈরি হবে। এর ফলে সৃষ্ট এই আনন্দের কল্যাণ ও বরকতের দ্বারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিষ্ঠিত হবে।
আর তারা উপলব্ধি করতে পারবে দুঃখ-কষ্ট, ক্ষয়-ক্ষতি ও দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে। এ ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব হলে পরিপূর্ণ প্রতিরোধ করবে; তার কিছুটা লাঘব করা সম্ভব হলে লাঘব করবে এবং প্রতিরোধের কোন উপায় না থাকলে সর্বোত্তম ধৈর্য ধারণ করবে। আর এর দ্বারা তাদের দুঃখ-কষ্টের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসার যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও শক্তি-সামর্থ সঞ্চয় হবে। ধৈর্য এবং প্রতিদান ও সওয়াবের আশা পোষণ করা বড় মর্যাদাপূর্ণ কাজ, যার সাথে দুঃখ-কষ্ট মিশে আছে। আর তার থেকে উত্তরণের উপায় হল আনন্দে থাকা, উত্তম আশা-আকাঙ্খা পোষণ করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সওয়াবের প্রত্যাশা করা। যেমন বিশুদ্ধ হাদিসে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ».
“মুমিনের কর্ম-কাণ্ডে অবাক হওয়ার বিষয় হল তার সকল কাজই মঙ্গলজনক। সে সুখ-শান্তি লাভ করলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর দুঃখ-কষ্টে পতিত হলে সে ধৈর্য ধারণ করে; ফলে তাও তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর এই সুযোগ মুমিন ব্যতীত অন্য কারও ভাগ্যে জুটে না।”— [মুসলিম, যুহুদ, বাব-১৪, হাদিস নং-৭৬৯২]
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিলেন যে, মুমিনের প্রাপ্তি ও কল্যাণ দিগুণ। হাসি-আনন্দ ও দুঃখ-কষ্ট সকল অবস্থায়ই সে তার কর্ম-কাণ্ডের সুফল ভোগ করবে। এ জন্যই আপনি দু’টি জিনিস পাবেন, যেগুলো কল্যাণ বা অকল্যাণের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার উভয়ের অর্জন পদ্ধতির মধ্যে ব্যবধানও অনেক। আর এই ব্যবধানটি হবে ঈমান ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে উভয়ের পার্থক্য অনুযায়ী। এই গুণের অধিকারী ব্যক্তি এ দু’টি গুণ দ্বারা কল্যাণ ও অকল্যাণ লাভ করে, যা আমরা আলোচনা করেছি; যেমন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ধৈর্য ধারণ ইত্যাদি। এতে করে তার জন্য আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হবে; দূর হয়ে যাবে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, হৃদয়ের সংকীর্ণতা ও জীবনের দুঃখ-কষ্ট এবং ইহজগতে তার জীবন হয়ে উঠবে অর্থবহ ও সুখময়।
আর অপর ব্যক্তি অপকর্ম, দাম্ভিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা দ্বারা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠে। ফলে তার নৈতিকতা বিনষ্ট হয় এবং অধৈর্য ও অতি লোভের কারণে তার নৈতিক চরিত্র পশুর চরিত্রের মত গড়ে উঠে। এতদ্ব সত্ত্বেও সে মানসিকাবে অশান্ত ও অস্হির। তার এই অস্থিরতার পিছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে; যেমন তার প্রিয়াদেরকে হারানোর আশঙ্কা ও তাদের পক্ষ থেকে নতুন নতুন বহু দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আশঙ্কা; আরও একটি কারণ হচ্ছে নফসের অস্থিরতা, যা অর্জন করুক আর নাই করুক সার্বক্ষণিক আরও কিছু পেতে আগ্রহবোধ করে। সে যদি নির্ধারিত অংশ পেয়েও যায়, তবুও সে উল্লেখিত কারণে (নতুন নতুন পেতে) অস্থির হয়ে উঠে। আর এসব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক ও অসন্তুষ্টির কারণে সে দুঃখ-কষ্ট অনুভব করে। সুতরাং তার দুর্ভাগ্যময় জীবন, স্বজনপ্রীতি ও চিন্তারোগ এবং ভয়-ভীতি যা তাকে খারাপ অবস্থা ও বীভৎস কষ্টের দিকে ঠেলে দিয়েছে; তার এমন পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন করো না। কারণ, সে সওয়াবের আশা করে না। আর তার নিকট ধৈর্যের মত এমন সম্পদও নেই যা তাকে শান্তনা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেবে।
আর এ ধরনের প্রত্যেকটি বর্ণনাই অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তব উদাহরণ। যেমন এই শ্রেণীর একটি বিষয়কে নিয়ে যখন আপনি চিন্তা-ভাবনা করবেনে এবং তাকে মানুষের বাস্তব অবস্থার সম্মুখে উপস্থাপন করবেন, তখন ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমলকারী মুমিন ব্যক্তি ও যে ব্যক্তি এমন কাজ করেনি তাদের উভয়ের মধ্যে অনেক বড় ব্যবধান দেখতে পাবেন। আর সে বিষয়টি হল, আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক ও তিনি তাঁর বান্দাদেরকে বিভিন্ন প্রকারের যেসব অনুগ্রহ ও সম্মান দান করেছেন, তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে দীন-শরীয়ত অনেক বেশি উৎসাহ প্রধান করেছে।
সুতরাং মুমিন যখন অসুস্থতা অথবা দারিদ্র অথবা অনুরূপ কোন মান-সম্মান বিনষ্টকারী বিপদ-মুসিবত দ্বারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তখন তার ঈমান ও আল্লাহ প্রদত্ত রিযিকের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার কারণে আপনি তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক দেখতে পাবেন এবং সে আন্তরিকভাবে এমন কিছু চাইবে না, যা তার ভাগ্যে নেই। এ অবস্থায় সে তার চেয়ে খারাপ অবস্থাশালী ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে শান্তনা অনুভব করে; তার চেয়ে ভাল অবস্থাশালী ব্যক্তির দিকে তাকায় না। কোন কোন সময় তার আনন্দ-ফুর্তি ও মনের প্রফুল্লতা আরও বৃদ্ধি পায় ঐ ব্যক্তির অবস্থা দেখে, যে ব্যক্তি দুনিয়াবী সকল উদ্দেশ্য হাসিল করেও পরিতৃপ্ত হতে পারেনি।
অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির নিকট ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমল নেই, তাকে যখন অভাব-অনটন দ্বারা অথবা দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার কিছু থেকে বঞ্চিত করার দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হয়, তখন তাকে আপনি দুঃখ-কষ্টে চরম বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পাবেন।
অপর আরেকটি দৃষ্টন্ত হল: যখন ভয় ও আতঙ্কের কারণসমূহ প্রকাশ পায় এবং মানুষ নানান অসুবিধা দ্বারা কষ্ট অনুভব করে, তখন তার মধ্যে বিশুদ্ধ ঈমান, দৃঢ় মনোবল, মানসিক প্রশান্তি এবং উদ্ভূত এই সঙ্কট মোকাবিলায় চিন্তায়, কথায় ও কাজে সামর্থবান হওয়ার মত গুণাবলী বিদ্যমান থাকে, তবে সে নিজেকে এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। আর এই পরিস্থিতি মানুষকে আনন্দ দেবে এবং তার হৃদয়কে মজবুত করবে।
অনুরূপভাবে আপনি ঈমান হারা ব্যক্তিকে পাবেন সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায়। যখন সে ভয় ও আতঙ্কের অবস্থায় পতিত হবে, তখন তার হৃদয় অস্বস্তি অনুভব করবে; স্নায়ুতন্ত্রগুলো দুশ্চিন্তায় উত্তেজিত হয়ে উঠবে; তার অভ্যন্তরে বিরাজ করবে ভয় ও আতঙ্ক এবং তার মধ্যে বিরাজ করবে বাহ্যিক আতঙ্ক ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা। ফলে তার বাস্তব অবস্থা উদ্ঘাটন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এ শ্রেণীর মানুষের যদি স্বভাবগত উপায়-উপকরণ বা উদ্দেশ্যসমূহ হাসিল না হয়, যা অর্জনে অনেক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন; তবে তাদের শক্তি-সামর্থ ভেঙ্গে পড়বে এবং স্নায়ুতন্ত্রগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠবে। আর এরূপ হবে ঈমানের ঘাটতির কারণে, যা ধৈর্যধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রখে। বিশেষ করে সঙ্কটকালে ও দুঃখ-দুর্দশার সময়ে।
সুতরাং পুণ্যবান ও পাপী, মুমিন ও কাফির উভয়ে অর্জনীয় বীরত্ব অর্জনে অংশগ্রহণ করে। আরও অংশীদারিত্ব রয়েছে এমন স্বভাব-চরিত্রে, যা ভয়ানক পরিস্থিতিতে সদয় হয় এবং বষয়টিকে সহজ করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মুমিন ব্যতিক্রম তার ঈমানী শক্তি, ধৈর্য, আল্লাহর উপড় ভরসা ও নির্ভরশীলতা এবং তার সওয়াবের প্রত্যাশার কারণে। এসব বিষয়ের কারণে তার সাহস ও বীরত্ব আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে, আতঙ্কের চাপ কমতে থাকে এবং তার নিকট কঠিন কাজগুলো সহজ হতে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِن تَكُونُواْ تَأۡلَمُونَ فَإِنَّهُمۡ يَأۡلَمُونَ كَمَا تَأۡلَمُونَۖ وَتَرۡجُونَ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا يَرۡجُونَۗ ﴾ [النساء:104]
“যদি তোমরা যন্ত্রণা পাও, তবে তারও তো তোমাদের মতই যন্ত্রণা পায় এবং আল্লাহর নিকট তোমরা যা আশা কর, তারা তা আশা করে না।” — [ সূরা আন-নিসা: ১০৪]
আর তারা আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভ করে এবং তার সাহায্য সকল প্রকার ভয়-ভীতিকে ওলট-পালট করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ﴾ [الأنفال:46]
“তোমরা ধৈর্যধারণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” —[সূরা আল-আনফাল: ৪৬]
২. সৃষ্টির প্রতি ইহসান: উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করার অন্যতম উপায় হচ্ছে কথা, কাজ ও বিভিন্ন প্রকারের সদ্ব্যবহার দ্বার সৃষ্টির প্রতি ইহসান করা। উল্লেখিত প্রতিটি কাজই উত্তম ও ইহসান। এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা পুণ্যবান ও পাপীর কর্ম-কাণ্ড অনুসারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা দূর করেন। কিন্তু তার থেকে মুমিনের জন্যই পরিপূর্ণ অংশ রয়েছে। আর সে ব্যতিক্রম এই জন্য যে, তার ইহসানের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ইখলাসের সাথে সওয়াবের প্রত্যাশায়। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য সহজ করে দেন তার প্রত্যাশিত কল্যাণকর কাজের মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করতে। আর তিনি তার ইখলাস ও আন্তরিকতার কারণে সকল দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ لَّا خَيۡرَ فِي كَثِيرٖ مِّن نَّجۡوَىٰهُمۡ إِلَّا مَنۡ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوۡ مَعۡرُوفٍ أَوۡ إِصۡلَٰحِۢ بَيۡنَ ٱلنَّاسِۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ ٱبۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ ٱللَّهِ فَسَوۡفَ نُؤۡتِيهِ أَجۡرًا عَظِيمٗا ﴾ [النساء:114]
“তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই, তবে কল্যাণ আছে যে নির্দেশ দেয় দান-খয়রাত, সৎকাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের; আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমি মহাপুরস্কার দান করব।” —[সূরা আন-নিসা: ১১৪]
সুতরাং তার থেকে সংঘটিত এ ধরনের সকল কর্মকাণ্ডকে আল্লাহ তা‘আলা কল্যাণময় বলে ঘোষণা করেছেন। আর কল্যাণ মানেই কল্যাণকে স্বাগত জানায় এবং অকল্যাণকে প্রতিরোধ করে। আর সওয়াবের প্রত্যাশী মুমিনকে আল্লাহ মহাপুরস্কার দান করবেন। আর সকল প্রকার বড় পুরস্কারের মধ্যে অন্যতম পুরস্কার হচ্ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি দূর করে দেয়া।
৩. কাজ-কর্ম ও উপকারী জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত থাকা: স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনা জনিত অস্থিরতা ও পাপ-পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবে থাকা মনকে দূরে রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে কাজ-কর্ম ও উপকারী জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত থাকা। কেননা, তা মনকে ঐসব কর্ম-কাণ্ড থেকে বিরত রাখে, যা তাকে অস্থির করে তোলে। এ কারণে সে কোন কোন সময় ঐসব কারণকে ভুলে থাকবে, যা তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে বাধ্য করে। ফলে সে মানসিকভাবে আনন্দ অনুভব করবে এবং তার মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু মুমিন অন্যান্যদের থেকে ব্যতিক্রম তার ঈমান ও ইখলাসের সাথে সওয়াবের প্রত্যাশায় জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষাদান ব্যবস্থায় কর্মতৎপর হওয়ার পাশাপাশি উত্তম আমল করার কারণে। যদি তা ইবাদত কেন্দ্রিক হয়, তবে তা ইবাদত হিসেবেই গণ্য হবে। আর তা যদি দুনিয়াবী অথবা প্রকৃতিগত কোন কর্ম-কাণ্ড হয়ে থাকে, তবে তার ফলাফল নিয়তের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করবে। আর সে যদি এর দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে সাহায্য কামনা করে, তবে তার এ কাজের প্রভাবে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর হবে। সুতরাং মনের অস্থিরতা ও পাপ-পঙ্কিলতা দ্বারা পরীক্ষা করা হয়; অতঃপর এর কারণে সে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তার প্রতিষেধক ঔষধ হচ্ছে: “ঐ কারণটিকে ভুলে থাকা, যা তাকে পাপ-পঙ্কিলতা ও অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রাখা।”
৪. সকল চিন্তাকে দৈনন্দিন কাজের গুরুত্বের উপর ঐক্যবদ্ধ করা: দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করার অন্যতম আরও একটি উপায় হল সকল চিন্তাকে চলমান (বর্তমান) দিনের কাজের গুরুত্বের উপর ঐক্যবদ্ধ করা এবং ভবিষ্যতকালীন ও অতীতকালীন কর্ম-কাণ্ড নিয়ে বেশি চিন্তা-ভাবনা বন্ধ করা। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট সকল প্রকার দুশ্চিন্তা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. বর্ণিত হাদিসে রয়েছে। সুতরাং অতীতের কোন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই, যা কোন দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আর ভবিষ্যতকালে কোন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় মগ্ন থাকাও ক্ষতিকর। অতএব বান্দার দায়িত্ব ও কর্তব্য হল তার আজকের দিন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ঐ দিন তথা বর্তমান সময়কে ভাল করার কাজে ব্যয় করা। কারণ, এই দিকে মনোযোগ দিলেই তার কর্ম-কাণ্ডসমূহ পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ হবে এবং তার দ্বারা বান্দা দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করতে পারবে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন দো‘আ করতেন অথবা তাঁর উম্মতকে দো‘আ করতে বলতেন, তখন তিনি আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ কামনার সাথে সাথে যা পাওয়ার জন্য দো‘আ করা হয়, তা অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানোর জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন। আর যা দূর করার জন্য দো‘আ করা হত, তা থেকে দূরে সরে থাকতে উৎসাহ দিতেন। কারণ, দো‘আ আমলের মতই। সুতরাং বান্দা দীন ও দুনিয়ার ক্ষেত্রে তার উপকারী বিষয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে এবং তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করবে। আর এই ব্যাপারে তাঁর নিকট সাহায্য চাইবে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِى كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ ».
“দূর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে; যা তোমার জন্য উপকারী, তা তুমি কামনা কর এবং আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। আর অক্ষমতা প্রকাশ করো না। কোন বস্তু অর্জন করার পর এ কথা বলো না যে, যদি আমি এরূপ এরূপ কাজ করতাম। বরং বল, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন; যদি তুমি শয়তানের কাজের উপর বিজয় লাভ করতে চাও।” —[মুসলিম, কদর, বাব-৮, হাদিস নং- ৬৯৪৫]
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক অবস্থায় উপকারী কর্মের কামনা করতে আদেশ করেছেন। তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহর সাহায্য চাইতে এবং দূর্বলতা ও অক্ষমতার নিকট আত্মসমর্পন না করতে, যা ক্ষতিকারক অলসতা। তিনি আরও আদেশ করেছেন অতীতকালের বাস্তবায়িত বিষয় এবং আল্লাহর ফয়সালা ও তার নির্ধারিত ভাগ্যকে মেনে নেয়ার জন্য।
আর তিনি সকল কর্ম-কাণ্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন: এক প্রকার কাজ হল বান্দা তা পুরাপুরি বা অংশবিশেষ অর্জনের চেষ্টা-প্রচেষ্টায় অথবা তা প্রতিরোধ করতে বা কিছুটা লাঘব করতে সক্ষম। সুতরাং এই ক্ষেত্রে বান্দা তার চেষ্টা-প্রচেষ্টার শুরু করবে এবং মাবুদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে। আরেক প্রকারের কাজ হল, এই ব্যাপারে তার ক্ষমতা নেই। সতরাং তার ব্যাপারে শান্ত ও সন্তুষ্ট থাকবে এবং তা মেনে নেবে। আর কোন সন্দেহ নেই যে, কোন বান্দা এই নীতি মেনে চললে, তা তার আনন্দ অনুভব করা ও দুশ্চিন্তা দূরের কারণ হবে।
৫. বেশি বেশি আল্লাহর যিকির: হৃদয়ের উদারতা ও মনের প্রশান্তির বড় উপায় হল বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করা। কারণ, হৃদয়ের প্রশস্ততা ও মনের প্রশান্তি কায়েম করতে এবং তার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করতে যিকিরের আশ্চর্য ধরনের প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ ﴾ [الرعد: 28]
“জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।” —[সূরা আর-রা‘দ: ২৮]
সুতরাং বান্দার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের লক্ষ্য অর্জন ও তার প্রত্যাশিত সওয়াব ও প্রতিদান পেতে আল্লাহর যিকির বা স্মরণের বিরাট প্রভাব রয়েছে।
৬. আল্লাহর নিয়ামতের আলোচনা: অনুরূপভাবে (সৌভাগ্যময় জীবনের অন্যতম উপায় হল) আল্লাহর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল প্রকার নিয়ামতের আলোচনা করা। কারণ, তাঁর নিয়ামত সম্পর্কে জানা এবং তার আলোচনা দ্বারা তিনি বান্দার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করেন। আর তিনি বান্দাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করেন; যেহেতু বান্দা সর্বোচ্চ মরতবা ও মর্যাদার অধিকারী, যদিও সে অভাব-অনটন, অসুস্থতা প্রভৃতি প্রকারের বালা-মুসিবতে থাকে। কারণ, বান্দা যখন তার উপর আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের মুখোমুখি হয়, তখন তা গণনা বা হিসাব করা সম্ভব হবে না। আর তিনি সাধারণত বান্দা যেসব অপছন্দনীয় ও কষ্টকর কর্ম-কাণ্ডের শিকার হয়, তাও বর্ণনা করে দিয়েছেন; যে অপছন্দনীয় বস্তু বা বিষয়ের সাথে নিয়ামতের কোন সম্পর্ক নেই। বরং বিপদ-মুসিবত দ্বারা যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করেন; বান্দও সেই ব্যাপারে ধৈর্য, সন্তুষ্টি ও মেনে নেয়ার মত দায়িত্ব পালন করে, তখন বিপদের সেই চাপটি সহ্য করা সহজ হয়ে যায়। আর বান্দার সওয়াব ও প্রতিদানের আশা এবং ধৈর্য ও সন্তুষ্টির কর্তব্য পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করার দ্বারা সে তিক্ত বস্তুকে মিষ্টি বস্তু মনে করে। ফলে প্রতিদানের স্বাদ তাকে ধৈর্যের তিক্ততার কথা ভুলিয়ে দেয়।
সংকলন: শাইখ আব্দুর রহমান বিন নাসের আস-সাদী