শবে মেরাজে ফরজ হয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ

Author Topic: শবে মেরাজে ফরজ হয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ  (Read 1204 times)

Offline shilpi1

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 135
    • View Profile


মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের (স.) নবুয়ত প্রাপ্তির দশম বছরে তাঁর মানসিক ও দৈহিক কষ্ট চরমে পৌঁছে যায়।

ওই সময় দুনিয়াতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ ও সমর্থনকারী চাচা আবু তালিব ও প্রাণপ্রিয় স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং এ বছরকে শোকের বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সেই সঙ্গে তায়েফের হৃদয় বিদারক ঘটনা ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ব্যথিত করে তুলেছিল। বলা যায় ব্যথিত হৃদয়কে মহান আল্লাহ্‌ অসীম মমতা দিয়ে প্রিয় হাবীবকে তাঁর সৃষ্টি রহস্য অবলোকন করিয়ে সান্তনা দিয়েছিলেন,

যা মিরাজ নামে পরিচিত।

পবিত্র কোরআনে সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ্‌ সে ভ্রমণকে বর্ণনা করেছেন এভাবে, “পবিত্র ও মহামহিম তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন আল-মসজিদুল হারাম থেকে আল-মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বস্রোতা,সর্বদ্রষ্টা”।

পূর্ববর্তী নবীরা যে সব বিষয় সম্পর্কে তাঁদের উম্মতদের বলেছিলেন যেমন আল্লাহ্‌ সম্পর্কে,আরশ-কুরসি, বেহেশত-দোজখ, নেক-বদ আমলের শাস্তি ও প্রতিদান ইত্যাদি। যা তাঁরা মহান আল্লাহ্‌র কাছ থেকে জ্ঞাত হয়েছিলেন ওহীর মাধ্যমে। ওহী অকাট্য সত্য। আল্লাহ্‌ তায়ালা সর্বশেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ মস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংস্কার সুদৃঢ়, চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা করার নিমিত্তে তাঁর অপার সৃষ্টি রহস্য চাক্ষুস দেখাবার জন্য এই পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন।

মিরাজ শব্দের অর্থ সিঁড়ি বা সোপান যা দ্বারা ঊর্ধ্বে আরোহণ করাকে বোঝায়। যার দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশকে ইসরা বলা হয় যার অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। যা মহান আল্লাহ্‌ তাঁর অসীম কুদরতের মাধ্যমে তাঁর প্রিয় হাবীবকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে সপ্ত আকাশ, মহান আরশ, বরজখি জগত, লওহে মাহফুজ, বায়তুল মা’মুর, হাউজে কাউসার, সিদরাতুল মুনতাহা, আরশ কুরসিসহ বহু রকমের অলৌকিক নিদর্শন দেখিয়েছিলেন।

অধিকাংশের মতে ২৬শে রজব দিবাগত রাতে এ ঐতিহাসিক ভ্রমণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই রাতে আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে হাতিমে কা’বায় উপনীত হন যখন তিনি ভাঙ্গা ঘুমে ভারাক্রান্ত ছিলেন। এরপর হযরত জিবরাঈল (আ.) এসে আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জমজম কুপের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি মহানবীর বক্ষ বিদারণ করে তাঁর দিল বা হৃদপিণ্ডকে একটি স্বর্ণ পাত্রে (যেটি সত্যিকার জ্ঞান বর্ধক ঈমানে পরিপূর্ণ ছিল) নিয়ে জমজমের পানি দ্বারা ধুয়ে পুনঃস্থাপন করা হয়। অতঃপর খচ্চর হতে একটু ছোট গাধা হতে একটু বড় সাদা রঙের একটি বাহন উপস্থিত করা হয় যা স্বর্গীয় যান “বোরাক” নামে অভিহিত যার প্রতি পদক্ষেপ দৃষ্টির শেষ সীমায়। অর্থাৎ অতি দ্রুত গতি সম্পন্ন। এবং তাতে আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চড়িয়ে জিবরাঈল (আ.) প্রথমে নিয়ে যান খেজুর গাছ ভরা এক প্রান্তরে। সেখানে আল্লাহ্‌র হাবীব দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন এবং তাঁকে জানানো হয় যেখানে আপনি নামাজ পড়লেন সে জায়গার নাম হচ্ছে ইয়াসরিব যা আপনার হিজরতের স্থান। অর্থাৎ আজকের মদিনা শরীফ। এর পর আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল লাহাম বা বেথলেহেম যেখানে হযরত ঈসা (আ.) এর জন্ম হয় সেখানে দু’রাকাত নামাজ পড়েন। এভাবে ভ্রমণের এক পর্যায়ে সফরসঙ্গী হযরত জিবরাঈলসহ (আ.) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

উপস্থিত হন বাইতুল মুকাদ্দাসে। সেখানে মসজিদুল আকসার সামনে বোরাক বেঁধে রেখে তিনি তাতে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলকে দেখতে পান এবং জাহান্নামের রক্ষী ফেরেশতা মালেককেও উপস্থিত দেখতে পান। আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমাম হয়ে সেখানে উপস্থিত সবাইকেসহ দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। আর ঈমামতির মধ্য দিয়ে আল্লাহ্‌র হাবীবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়। ভ্রমণের এই অংশটুকু ইসরা নামে পরিচিত যা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।

বায়তুল মুকাদ্দাসের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আল্লাহ্‌র নবী ঊর্ধ্বপথে রওনা হয়ে প্রথম আসমানের “বাবুল হাফায়া” নামক দরজায় এসে পৌঁছান। সেখানে দাররক্ষী ইসমাইল ফেরেশতার সঙ্গে কথপকথনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রথম আসমানে পৌঁছে আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর দেখা পান তিনি। আদম (আ.) সেখানে মহানবীকে খোশ আমদেদ জানান এবং ‘সুযোগ্য পুত্র ও সুযোগ্য নবী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহহিয়া (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দেখা হয়, তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ.) এর দেখা হলে তাঁদের সবার সঙ্গে সালাম বিনিময় হয় এবং সবাই আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সুযোগ্য ভাই ও নবী বলে খোশ আমদেদ জানান। ষষ্ঠ আসমান ত্যাগের সময় মুসা (আ.) কেঁদেছিলেন। তাঁকে এই কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেন আমার বেহেশতি উম্মতের চাইতে এই নবীর বেহেশতি উম্মতের সংখ্যা বেশি হবে অথচ তিনি বয়সের দিক দিয়ে যুবক ও দুনিয়াতে প্রেরিত হয়েছেন আমার পরে। সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সঙ্গে বংশের আদি পিতা হিসেবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেখানে তিনি ও তাঁকে খোশ আমদেদ জানান এবং সুযোগ্য পুত্র ও সুযোগ্য নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

অতঃপর আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিদরাতুল মোনতাহার কাছে পৌঁছালেন যা মূলতঃ একটি প্রকাণ্ড কুল গাছ। যার এক একটি কুল বড় মটকার মতো এবং এক একটি পাতা হাতির কানের মতো। সেখানে তিনি চারটি প্রবাহিত নদী দেখতে পেলেন। যার দু’টি বাইরের দিকে ও দু’টি ভেতরের দিকে প্রবাহিত। জিবরাঈল (আ.) বললেন, ভেতরের দু’টি জান্নাতের সালসাবিল ও কাওসার নামক নদী আর বাইরের দু’টি ভূ-পৃষ্ঠের নীল নদ (মিসর) ও ফোরাত (ইরাক) নদী। অতঃপর বায়তুল মা’মুর পরিদর্শন করানো হলো যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা এবাদতের সুযোগ পান। যারা কেয়ামত পর্যন্ত কেউ আর দ্বিতীয়বার এবাদতের সুযোগ প্রাপ্ত হন না। অতঃপর আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সৃষ্টিগত স্বভাবের স্বচ্ছতা ও নির্মলতা প্রকাশ করে দেখানোর উদ্দেশে তাঁর সামনে তিনটি পাত্র উপস্থিত করা হয়, যার একটিতে ছিল মদ, একটিতে দুধ আর একটিতে মধু ছিল। আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলেন। তখন জিবরাঈল (আ.) বললেন দুধ সত্য ও খাঁটি স্বভাবগত ধর্ম ইসলামের স্বরূপ। সুতরাং আপনি দুধের পাত্র গ্রহণ করে এটাই প্রমাণ করেছেন যে আপনি সত্য ও স্বভাবগত ধর্ম ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছেন আপনার উসিলায় আপনার উম্মতও এর ওপর থাকবে।

এরপর আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শরিয়তের পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার বিধান নিয়ে মুসা (আ.) নিকটবর্তী পথ অতিক্রম করার সময় তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো বিশেষ আদেশ লাভ করেছেন কি? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ। তখন মুসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে পারবে না। আমি সাধারণ মানুষ সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছি এবং বনি ঈসরাইলকেও বিশেষভাবে পরীক্ষা করেছি আপনি মহান আল্লাহ্‌র কাছে আপনার উম্মতের জন্য এই আদেশ আরও সহজ করার জন্য আবেদন করুন। এভাবে কয়েকবার আসা যাওয়া করার পর যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নির্ধারিত হলো তখন হযরত মুসা (আ.) এর কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আবারও বললেন আপনার উম্মত এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেরও পাবন্দি করতে পারবে না। আমি মানুষের স্বভাব অনেক দেখেছি ও বনি ঈসরাইলকেও অনেক দেখেছি। আপনি নামাজ আরও কম করার আবেদন জানান। তখন আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসাকে (আ.) বললেন আল্লাহ্‌র দরবারে বার বার আসা যাওয়া করেছি,এখন আবার যেতে লজ্জা বোধ হচ্ছে, তাই আর যাবো না বরং পাঁচ ওয়াক্তের ওপর সন্তুষ্ট রইলাম এবং তা বরণ করে নিলাম। তখন মহান আল্লাহ্‌ তায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষণা হলো-“বান্দাদের প্রাপ্য সওয়াবের দিক দিয়ে আমার নির্ধারিত সংখ্যা পঞ্চাশ ওয়াক্তেরই পাবে। আমার পক্ষে আমার বাক্য অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে পাঁচ ওয়াক্ত কিন্তু সওয়াবের ক্ষেত্রে পাঁচই পঞ্চাশ বলে পরিগণিত হবে। এটিই হলো আমাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার দিন।

এভাবে মহান আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর সৃষ্টির রহস্যের সাগরে অবগাহন করিয়ে তাঁর প্রতাপ ও সান দেখিয়ে মহাসম্মানে সম্মানিত করেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ার দিকে প্রত্যাবর্তন করেন এবং মক্কার কাছে জি’তুয়া নামক স্থানে অবতরণ করেন। এভাবেই মি’রাজ সম্পন্ন হয়।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ভ্রমণ সাধারণের ধারণার বাইরে। তাই যখন তিনি ভ্রমণ বৃত্তান্ত কাবা শরীফে গিয়ে উপস্থিত লোকদের সামনে বলেন তখন মক্কার কাফেররা নানা রকম বিদ্রূপাত্মক প্রশ্ন করতে থাকেন। সব প্রশ্নের উত্তর ও কাফেরদের সন্দেহের অবসান আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রমাণ করতে সমর্থ হন এবং পরবর্তীকালে অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকেও মি’রাজ শরীফের প্রমাণ পাওয়া যায়। মক্কার লোকেরা অবিশ্বাস করে যখন এই কথা হযরত আবু বকরকে (রা.) বলেন, তখন এক বাক্যে উত্তর দেন যদি আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যিই  এ কথা বলে থাকেন তবে তা অবশ্যই ঠিক বলেছেন এবং তাঁর এই কথার প্রতি আমি দ্বিধাহীন চিত্তে ঈমান আনছি। যখন মি’রাজের ঘটনা বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা সত্য হিসেবে সাধারণের কাছে প্রমাণিত হয় সেই জের ধরেই হযরত আবু বকর (রা.) সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত হন।