দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলাম

Author Topic: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলাম  (Read 1326 times)

Offline shilpi1

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 135
    • View Profile
 দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে দেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর অন্যতম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। অধিকাংশ নিত্যপণ্যের মূল্যই এখন নিম্ন-আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্য হরদম বেড়েই চলেছে।

 

বিশদ পর্যালোচনার মাধ্যমে দেশের ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যে কারণগুলো বেরিয়ে আসে, তা নিম্নরূপ

 

১. ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। এক শ্রেণীর অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে। সরকারও বিভিন্ন সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছে।

 

২. শিল্প মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের ওপর মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। ব্যবসায়ী এবং উৎপাদকরা চাঁদাবাজদের প্রদত্ত চাঁদার ক্ষতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে পুষিয়ে নেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ ভোক্তারা।

 

৩. আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারেও পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাভাবিকভাবেই এর মূল্য বেড়ে যায়।

 

৪. শুল্ক বৃদ্ধির কারণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকির ক্ষেত্রে সরকারের অমনোযোগিতা ও ব্যর্থতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি বিরাট কারণ।

 

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে বিভিন্ন সময় দায়ী করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় খুব কমই। ফলে শুল্ক কমানো সত্ত্বেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দ্রব্যমূল্য কমে না।

 

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের এমন সব কালজয়ী কল্যাণধর্মী সুচিন্তিত নীতিমালা ও সুদূরপ্রসারী বাজার পরিকল্পনা রয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যস্ফীতি রোধ এবং সর্বোপরি বাজারের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ও অস্থিতিশীলতা দূর করা সম্ভব। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরার জন্য ইসলামের সেই ব্যবসায়িক নীতিমালা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

 

মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। ইসলাম অধিক মুনাফার লোভে মজুদদারি নিষিদ্ধ করেছে।

 

হযরত মা’মার ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ফাযালা (রা.) বলেন, ‘আমি হুযুর (সা.)কে বলতে শুনেছি, পাপাচারী ছাড়া অন্য কেউ মজুদদারি করে না।’ (তিরমিজি)

 

অন্য হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি ৪০ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখে, আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না।’

 

অন্যত্র বর্ণিত হচ্ছে, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।’ ( দারেমি, হাদিস নম্বর-২৪৩৩)

 

ইবনে মাজাহ শরিফে বর্ণিত একটি হাদিসে রয়েছে, ’যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যদ্রব্য ৪০ দিন পর্যন্ত মজুদ করে রাখে, আল্লাহ তায়ালা তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ)

 

মজুদদারের ঘৃণ্য মানসিকতার নিন্দা করে হুযুর (সা.)বলেছেন, ‘মজুদদার কতই না নিকৃষ্ট! দ্রব্যমূল্য হ্রাসের খবর তার কাছে খারাপ লাগে, আর মূল্যবৃদ্ধির খবরে সে আনন্দিত হয়।’

 

অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘মজুদদারের ওপর আল্লাহ তা’আলা, ফেরেশতাকুল ও মানবজাতির লানত। আল্লাহ তায়ালা তার কি ফরজ, কি নফল কোনো ইবাদতই কবুল করেন না।’ (শামি ৬/৩৯৮)

 

ফিকহে হানাফির সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হিদায়া’য় উল্লেখ রয়েছে, ‘মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্য মজুদ করা মাকরূহ, যদি তাতে শহরবাসীর ক্ষতি হয়। যদি শহরবাসীর ক্ষতি না হয়, তাহলে মাকরূহ নয়। (হিদায়া, ৪/৪৭০)

 

‘ফতোয়া-ই-আলমগীরি’তে উল্লেখ রয়েছে, ‘ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, ‘নগরবাসী বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সরকার মজুদদারকে বাধ্য করবে, যেন সে তার মাল সাধারণ মূল্যে বা যতটুকু বেশি মূল্যে মানুষ মেনে নেয়, সেই মূল্যে বিক্রি করতে।’ (আলমগীরি, ৩/২১৪)

 

অন্যত্র উল্লেখ রয়েছে, মজুদদার সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করা হলে সরকার তাকে তার এবং তার পরিবারের প্রয়োজনাতিরিক্ত খাদ্য বিক্রির আদেশ দেবে এবং মজুদ করতে নিষেধ করে দেবে। যদি সে বিরত না হয়, তাহলে উপদেশ দিতে হবে, সতর্ক করতে হবে। এরপরও যদি বিরত না হয়, তার বিরুদ্ধে আবার মজুদদারির অভিযোগ ওঠে, তাহলে তাকে বন্দি করবে। (আল-মুহিত)

 

‘আল-মুযারাআত’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ‘ফক্বিহগণ এ ব্যাপারে একমত, প্রয়োজনে মজুদদারদের সম্মতি ছাড়াই বিচারক মজুদকৃত খাদ্য বিক্রি করতে পারবেন।

 

ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীদের অপতৎপরতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই মধ্যস্বত্বভোগীদের এহেন অপতৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

 

এ প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘হুযুর পাক (সা.)স্বল্পমূল্যে কেনার জন্য বহিরাগত বিক্রেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করেছেন। (তিরমিজি)

 

অর্থাৎ পণ্যের মালিক বা তেজারতি (বাণিজ্যিক) কাফেলা শহরে পৌঁছার আগেই তাদের কাছ থেকে অধিক মুনাফার লোভে পণ্য কেনাকে হুযুর (সা.) নিষিদ্ধ করেছেন। কারণ, এতে সাধারণ ক্রেতা ও ভোক্তাদের স্বার্থ বিনষ্ট হয় এবং দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়।

 

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হুযুর (সা.) বলেছেন, কোনো শহরবাসী কোনো গ্রামবাসীর পক্ষ হয়ে বিক্রি করবে না। মানুষকে তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দাও, যেন আল্লাহ তা’আলা তাদের একের দ্বারা অন্যের রিজিকের ব্যবস্থা করেন। (তিরমিজি)।

 

অর্থাৎ সাধারণত গ্রামবাসীই অনেক খাদ্যের উৎপাদনকারী। গ্রামবাসী সরাসরি শহরে এসে সেসব খাদ্য বিক্রি করলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে, শহরবাসীকে উচ্চমূল্য দিতে হয় না। কিন্তু ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীরা গ্রামবাসীর কাছ থেকে নিয়ে নিজেরা দালালি করে বাজারদর বাড়িয়ে ফেলে। তাই (সা.) এহেন তৎপরতা নিষিদ্ধ করেছেন।

 

হাদিস শরিফে বর্ণিত রয়েছে, হুযুর (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মূল্য বৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপ করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তাকে আগুনের হাড়ে বসিয়ে শাস্তি দেবেন।’ (তাবরানি, ৮/২১০)

 

অনেক সময় কেনার উদ্দেশ্যে নয়, বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে দালাল চক্রকে অধিক মূল্যে দর-দাম করতে দেখা যায়। হুযুর (সা.) সেটাও নিষিদ্ধ করেছেন। হাদিসে এটাকে ‘নাজাশ’ বলা হয়েছে।

 

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হুযুর (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নাজাশ (ক্রেতাকে প্রতারিত) করার জন্য দর-দাম করবে না।’ (তিরমিজি)

 

ইসলামি শরিয়তের বিধান হচ্ছে- সাধারণত সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেবে না।

 

এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, “হুযুর (সা.)-এর যুগে একবার দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেল। লোকেরা বলল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন’। হুযুর (সা.) বললেন, ‘মূলত আল্লাহ তা‘আলাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী, রিজিক সংকীর্ণকর্তা, প্রশস্তকর্তা ও রিজিকদাতা। আমি আমার রবের সঙ্গে এভাবে সাক্ষাতের আশা রাখি, তোমাদের কারো যেন আমার বিরুদ্ধে রক্ত বা সম্পদ, কোনো বিষয়ে কোনোরূপ দাবি না থাকে। (তিরমিজি, ১/২৪৫)

 

এই হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতেই ফক্বিহগণ বলেন, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেবে না; তবে ব্যবসায়ীরা যদি অতিরিক্ত মূল্য নেয়। দ্রব্যমূল্য যদি এতই বেড়ে যায় যে মূল্য নির্ধারণ না করলে জনসাধারণের ভোগান্তি হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সরকার দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারবে। সর্বসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবের উদ্দেশ্যে সরকার তখন দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়াটাকে কল্যাণকর বলেই বিবেচনা করবে। (হিদায়া, আলমগীরি)

 

ফক্বিহগণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, ব্যবসায়ীরা যেন যোগসাজশ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে, সেদিকে সরকারকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যদি তারা পরস্পর যোগসাজশ করে মূল্যবৃদ্ধি করে, তাহলে মুসলিম সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে পারবে, যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। (তাকমিলাহ, ১/৩১২)।

 

আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল-যাওয়াযিয়্যা (রহ.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায় এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ শুধু বৈধই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে জরুরিও বটে।’ (আত-তুরুক, ১/৩৫৫)

 

দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের নীতিমালা বর্ণনা করতে গিয়ে ‘বাহরুর রায়েক’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরকার যখন দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে চাইবে, তখন সংশ্লিষ্ট পণ্যের বাজারের গণ্যমান্য লোকদের একত্রিত করবে। ক্রেতাসাধারণকে সরকার উপস্থিত করবে। বিক্রেতারা কী দামে বিক্রি করছে এবং ক্রেতারা কী দামে কিনছে, তা জিজ্ঞেস করে সত্যতা যাচাই করবে। এরপর উৎপাদক-আমদানিকারক-ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয় না, আবার ক্রেতাসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে না যায়- এমনভাবে মূল্য নির্ধারণ করে দেবে। সরকার কর্তৃক দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের পর নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে কেউ তা বিক্রি করলে সরকার বা বিচারক প্রথমত তাকে উপদেশ দেবেন। আবার তার ব্যাপারে একই অভিযোগ পাওয়া গেলে আবারো তাকে উপদেশ দেবেন। তৃতীয়বার তার সম্পর্কে একই অভিযোগ পাওয়া গেলে তাকে বন্দি করবেন, যাতে সে এহেন তৎপরতা থেকে বিরত হয় এবং জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হয়।’