প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) প্রত্যেক বছর রজব মাস এলেই রমজানুল মোবারকের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। তাঁর ইবাদত বন্দেগী সব কিছুতেই একটি পরিবর্তন সূচিত হতো। আর তিনি নতুন একটি দোয়া শুরু করতেন। বলতেন- আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রজাবা ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা রমাজানা অর্থাত্ হে রাব্বুল আলামীন আপনি আমাকে রজব ও শাবানে বরকত দিন এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। এই দোয়া বারবার তার মুখে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতো। তাঁর সঙ্গে সাহাবা আজমাঈনও এই দোয়া করতেন
সেই কারণে যারা রসূলের (স.) সত্যিকারের আশেক ও উম্মত হতে চায় এবং তাঁর প্রত্যেকটি সুন্নতের অনুসরণে জীবন যাপন করে আল্লাহর রিজামন্দি হাসিল করতে চায় তারা এই রজব মাস থেকে উপরোল্লেখিত দোয়াটির আমল শুরু করবেন। অনেকে মনে করেন শাবান মাস থেকেইতো রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের সময়। তাদেরকে এই হাদীসের অনুসরণে এখন থেকে রজব মাস থেকেই মন মানসিকতার আমূল পরিবর্তন করে পবিত্র রমজানুল মোবারকের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার আহ্বান করছি।
কারণ এটি এমন একটি মাস যে মাসে এই পৃথিবীর সব চেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। যা পৃথিবীবাসিকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে ফেলে। রসূল (স.)কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই সময় মক্কা থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে নেন। সেখান থেকে উদ্ধালোকে উত্থান ঘটান। যা মানব কল্পনারও বাইরে। যা ছিল রক্তমাংসের একজন মানুষের জন্য সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রসূল (স.)কে দিয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর প্রিয় এই হাবিবকে নিয়ে প্রথম আসমান, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমান পার করে সিদরাতুল সুনতাহায় নেন। সেখান থেকে বায়তুল মামুর। তার পর সাতটি সমতল মাঠ পেরিয়ে একেবারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্যে পৌঁছান। এতো কাছে পৌঁছান, যা কুরআনের সূরা নজমে বলা হয়েছে— "ছুম্মা দানা ফাতাদাল্লা ফা-কানা কা'বা কাওছাইনে আও আদনা" অর্থাত্ তারপর সে কাছে এলো, অতপর সে আরো কাছে এলো, এসময় তাদের উভয়ের মাঝে ব্যবধান থাকলো মাত্র দুই ধনুকের সমান কিংবা তার চাইতেও কম।
এরপর আল্লাহ তাকে কিছু আদেশ নিষেধ করলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিষয়টি। রসূল (স.)কে এদিন প্রথমত: পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ দেয়া হয়েছিল তারপর ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ.) এর সঙ্গে সাক্ষাত হলে তিনি তাকে আল্লাহর কাছে নামাজের ওয়াক্ত কমানোর জন্য দরখাস্ত করতে বলেন। সেই মোতাবেক রসূল (স.) আল্লাহর সমীপে দরখস্ত করায় পাঁচ ওয়াক্ত হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আপনার ও আপনার উম্মতদের জন্য স্থিরিকৃত হলো। কিন্তু যারা এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সঠিক সময়ে নিয়ম মাফিক পড়বে তাকে পূর্বঘোষিত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের পূণ্য দান করা হবে।
রসূল (স.)কে এই রজনীতে আল্লাহ তাঁর বেহেশত দর্শন করান। দোযখ দর্শন করান। রসূল (স.) দুনিয়ায় এসে সাহাবীদের বলেছিলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে জান্নাত ও জাহান্নাম সবই দেখিয়েছেন। আমি দেখলাম জান্নাতের চতুষ্পার্শে কষ্ট কঠোরতা, দুঃখ, জ্বরাগ্রস্থতা, রোগ, শোক, বিপদ-আপদ মুছিবত দিয়ে ঘেরা। আর জাহান্নাম দেখলাম, তার চতুষ্পার্শে সুখ-শান্তি, আরাম আয়েশ ভোগ বিলাসিতা দিয়ে ঘেরা। সুতরাং যারা দুনিয়ায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে দুনিয়াবিক আরাম আয়েশ ভোগ বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলবে তারা এই বিলাসিতার দেয়াল টোপকিয়েই আল্লাহর জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
পক্ষান্তরে যারা দুনিয়ায় আল্লাহর আনুগত্য করতে গিয়ে বিপদ-আপদ মুসিবতে আবর্তিত হবে তারা এই মুসিবতের দেয়াল পার হয়েই আল্লাহর জান্নাতে প্রবেশ করবে। রসূল (স.) এই মিরাজের ঘটনা যখন মানুষের কাছে বলছিলেন তখন কাফেরেরা নতুন একটা ইস্যু পেয়ে গেল। তারা বললো, আমরা এতোদিন যে, মুহাম্মদ (স.)কে পাগল উম্মাদ বলেছি এখন তার বাস্তব প্রমাণ আমরা এখন হাতে পেয়েছি। তারা মানুষের কাছে বলতে লাগলো মুহাম্মদ (স.) সত্যিকারের পাগল হয়ে গেছে, সে নাকি একরাতে বায়তুল মোকাদ্দাসে গিয়েছে এবং উদ্ধালোকে গিয়েছে ও তাঁর রবের সঙ্গে সাক্ষাত করে এসেছে।
কেউ কেউ তখন বলতে লাগলো তোমরা আবু বকরকে খোজো এবং তাকে এই কথা বলো। নিশ্চয়ই আবুবকর এই ঘটনা বিশ্বাস করবেনা। তারা খুজে আবুবকর (রা.) কে পেলো এবং তাকে বললো আবুবকর, তুমিতো মুহাম্মদের অন্ধ ভক্ত। তুমি কি এই কথা বিশ্বাস করবে? যে, মুহাম্মদ (স.) এক রাতে বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে আবার মক্কায় ফিরে এসেছে? আবুবকর (রা.) নি:শঙ্কচিত্তে বললেন, এই কথা কি সত্যিই মুহাম্মদ (স.) বলেছেন? তারা বললো—হ্যাঁ বলেছেন। তুমি যেয়ে দেখ তিনি এখনো কাবার সামনে বসে এই কথা মানুষদের বলছে: আবুবকর (রা.) বললেন, আমি যাচ্ছি তবে তোমরা শুনে রাখ, এই কথা যদি মুহাম্মদ (স.) সত্যিই বলে থাকেন তাহলে অবশ্যই মিরাজ সত্য। অত:পর আবুবকর (রা.) হন্তদন্ত হয়ে কাবার সামনে গেলেন। দেখলেন সেখানে রসূল (স.)কে অনেক মানুষেরা ঘিরে রেখেছে। আবুবকর (রা.) বলছেন, অত:পর আমি লোকদের সরিয়ে তার কাছে গেলাম। বললাম, কাফেরেরা যা বলছে আপনি কি সত্যিই এই সব কথা বলেছেন? রসূল (স.) বললেন, হ্যাঁ আবুবকর আমি বলেছি।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে দিয়ে মিরাজ করিয়েছেন। আবুবকর (রা.) বললেন, আমি বিশ্বাস করলাম- আপনি সত্য বলেছেন। আপনার মিরাজ সত্য। যে ঘটনাটি আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (স.)কে দিয়ে ঘটিয়েছেন সেই ঘটনাটি যখন কেউ বিশ্বাস করছিলনা। তখন সীমাহীন কষ্ট যন্ত্রণায় রসূল (স.) অস্থির চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় ছিলেন। এমতাবস্থায় আবুবকর (রা.) যখন মিরাজের ঘটনা স্বীকার করে নিলেন তখন রসূল (স.) এর মাথা থেকে যেন একটা বোঝা নেমে গেলো। স্বস্থির নি:শ্বাস ফেললেন। চোখ ফেটে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি আবুবকর (রা.)কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আর বললেন, আবুবকর, আজ থেকে তুমি শুধু আবুবকর নও। আবুবকর সিদ্দিক। আল্লাহর কাছে চার শ্রেণির লোক নেয়ামতপ্রাপ্ত তাঁরা হলেন— আল্লাজিনা আনআমাললাহু মিনান নাবিয়্যিনা ওয়াস সিদ্দিকিনা ওয়াশ শুহাদায়ে ওয়াস ছালেহীন অর্থাত্ যারা নেয়ামতপ্রাপ্ত।
তাঁরা হলেন নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ ও সালেহীনগণ। রসূল (স.) মাদানী জীবনের একদিন বলেছিলেন, যে সময় মক্কার সব মানুষেরা আমার মিরাজের বিষয় নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করছিল। সেই সময় আবুবকরই সর্বপ্রথম মিরাজের ঘটনা স্বীকার করে নেন। দুনিয়ার সব মানুষের ঈমান যদি এক পাল্লায় রাখা হয় আর কেবল আবুবকর (রা.) এর ঈমান আর এক পাল্লায় রাখা হয় তাহলে আবু বকরের ঈমানের পাল্লা ভারি হয়ে যাবে। রসূল (স.) বলেছিলেন- আবুবকর আমার দুনিয়ার সাথী বেহেশতেরও সাথী।
রসূল (স.) মিরাজের ঘটনার বিবরণ দেয়ার পর বলেছিলেন, আস সলাতু মিরাজুল মু'মিনীন অর্থাৎ নামাজ হলো মমিনদের জন্য মেরাজ। কারণ একজন মু'মিন ব্যক্তি নামাজের মধ্যে আল্লাহর যত নিকটবর্তী হয় এতো নিকটবর্তী আর কখনো হয় না। কুরআনে বলা হয়েছে, অসজুদু ওয়াক তারিব অর্থাৎ তোমরা সেজদা দাও এবং আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়ে যাও। সুতরাং পবিত্র রমজানুল মোবারকের প্রস্তুতির মাস হিসেবে এই রজব মাস হতেই প্রিয় নবীজীর মত আমরাও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার কাছে দোয়া করি যেন তিনি আমাদের রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমজানুল মোবারকে সমার্পণ করান। রসূল (স.) সকল সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতেন। এমনকি তার মৃত্যুর সময় যখন জিব্রাইল (আ.) এসে বলেছিলেন আল্লাহ আপনাকে এই পৃথিবীতে থাকার এবং চলে যাওয়ার এখতিয়ার দিয়েছেন। তখন তিনি জীবনের শেষ জুমআর খুত্বায় বলেছিলেন, আল্লাহুম্মার রফিকুল আলা অর্থাত্ আমি আমার পরম বন্ধু আল্লাহর সান্নিধ্যই বেছে নিয়েছি। সেই রসূল (স.) কেবলমাত্র রমজান মাস পাওয়ার জন্য দুই মাস পূর্ব হতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করতেন।
তাহলে কী আছে সেই পবিত্র মাহে রমজানে? সে বিষয়ে রসূল (স.) বলেছেন, যে রমজান পেলো এবং তার জীবনের গোনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারলোনা তার চেয়ে হতভাগ্য ব্যক্তি এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কারণ রমজান হলো জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতির মাস ও জান্নাত লাভের মাস।