এবার সাপের বিষ দিয়ে রক্তের ক্যানসার (লিউকেমিয়া) সারানোর ওষুধ বের করেছেন কলকাতার বিজ্ঞানীরা। আর স্বর্ণের গুঁড়া দিয়ে চলবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঠেকানোর কাজ।
দীর্ঘ গবেষণার ধারাবাহিকতায় সাপের বিষ দিয়ে লিউকেমিয়া নিরাময়ের পথ আবিষ্কারের দাবি করলেন ভারতের বিজ্ঞানীরা। শুধু তাই নয়, রোগ সারাতে গিয়ে কোনও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাতে রোগীকে কাবু করতে না পারে, সে পন্থাও ঠিক করে দিয়েছেন তারা।
মরণব্যাধি ক্যানসার প্রতিরোধে কত না গবেষণা চলছে বিশ্বময়। রক্তের ক্যানসার ‘লিউকেমিয়া’ একটি ভয়ানক মরণব্যাধি। এ রোগে আক্রান্তদের জীবনের আশা ক্ষীণ হয়ে আসে।
কেমোথেরাপির কথা অনেকেই শুনেছেন। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় সংকুল পথে এগোতে হয় লিউকেমিয়া রোগীকে নিয়ে। তারপরও খুব বেশি সাফল্য জোটে না।
এ যাত্রা শুধু রক্তের ক্যানসারের (লিউকেমিয়া) উপর তাদের আবিষ্কৃত ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছেন বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
কেউটে, চন্দ্রবোড়া, খরিষের মতো সাপের বিষ থেকে ক্যানসার ঠেকানোর যৌগ আবিষ্কারের এই দাবি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানীদের।
শারীরবিজ্ঞানীদের ওই গবেষণাপত্র ‘নেচার ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশের পর সাপের বিষ ও সোনার গুঁড়োর যৌথ আক্রমণে ক্যানসারের মতো মরণব্যাধিকে পরাস্ত করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে।
তবে ক্যানসার চিকিৎসকদের মতে, এটা একেবারেই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অ্যান্টনি গোমস জানান, ১৯৯৫ সাল থেকে তাদের বিভাগে এ নিয়ে কাজ শুরু হয়। ২০০৫ সালে চন্দ্রবোড়ার বিষের প্রোটিন যৌগ ক্যানসার আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করে সেটা প্রমাণিত হয়। গবেষণার মাধ্যমে কেউটের বিষেও এই ক্ষমতার কথা তারা প্রকাশ করেন।
তবে তারা বলছেন, যে কোনো কেমোথেরাপির ওষুধের মতো প্রোটিন যৌগেরও কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, হৃৎপিণ্ড এবং স্নায়ুর ওপরে এই যৌগের বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। সে কারণেই এই যৌগ থেকে ওষুধ তৈরির বিষয়টি নিয়ে বেশি দূর এগোনো বিপজ্জনক হতে পারে।
কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিজ্ঞানীদের দাবি, সোনার গুঁড়ো ব্যবহার করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানোর পন্থাও তারা আবিষ্কার করেছেন। ইঁদুরের উপরে তা প্রয়োগও হয়েছে।
সেটা কিভাবে? অ্যান্টনি গোমস বলেন, ‘এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয়েছে ন্যানো প্রযুক্তি। সোনার ন্যানো পার্টিকেল তৈরি করে তা মেশানো হয়েছে সাপের বিষ থেকে আহরিত যৌগের সঙ্গে। তার পরে তা ইঁদুরের উপরে প্রয়োগ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ক্যানসার আক্রান্ত কোষ মরে যাচ্ছে, কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনায় অনেকটাই কম।’
তথ্য মতে, এর আগে কাঁকড়া বিছার বিষ থেকে যৌগ নিয়ে ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কারের কাজ হয়েছে। সাপের বিষ থেকে ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কারের ব্যাপারে কাজ শুরু হয় ১৯৩৩ সাল থেকে। এক ফরাসী বিজ্ঞানী এই কাজ শুরু করেছিলেন। পরে ভারতেও একাধিক গবেষণা শুরু হয়।
কলকাতার বিজ্ঞানীরা রক্তের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পারলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই পরের দফায় কিভাবে এই যৌগের বিষক্রিয়া কমানো যায়, তা নিয়ে কাজ চলছিল। উদ্দেশ্য ছিল মূলত দুটি। ক্যানসারকে ধ্বংস করার পাশাপাশি বিষক্রিয়া ঠেকানো।
বিজ্ঞানীদের দাবি, ‘গোল্ড ন্যানো পার্টিকল’ তৈরি করে ওই যৌগের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ায় সুফল মিলেছে। বিজ্ঞানী অমিয় কুমার হাটি জানান, সাপের বিষ থেকে শুধু ক্যানসার নয়, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্রের নানা রোগের ওষুধ তৈরি হয়।
সাপের বিষ-সোনার গুঁড়ায় ক্যানসার নিরাময়!
তিনি বলেন, ‘সাপের বিষে অনেক ধরনের প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, এনজাইম রয়েছে। সবটাই যে ক্ষতিকর তাতো নয়। ক্ষতিকর বিষয়গুলো বাদ দিয়ে কিভাবে সাপের বিষকে ওষুধ তৈরির কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা নিরন্তর কাজ করে চলছেন।
অন্যদিকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের বক্তব্য, সোনা থেকেও কিছু বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। কিন্তু সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ক্যানসারের মতো মরণরোগের কাছে নগণ্য বলে তাদের অভিমত।
ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘যদি এমন কিছু হয়, তা হলে স্বাগত। কিন্তু চার দফার ট্রায়ালের পরে সাফল্য পেলে তবেই এ নিয়ে আশান্বিত হওয়া যাবে।’
একই ধরনের মন্তব্য করেছেন ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘এর ডোজ, সহনক্ষমতা সবটাই বিচার্য। রোগীর শরীরে এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল কী, সেটাও জানতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘গবেষণাগারে এটা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের দেহে প্রয়োগের পরেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।’