বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তথ্যকে ভিত্তি ধরে নতুন পদ্ধতিতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হিসাব করা শুরু করেছে, যাতে বার্ষিক এক হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বুধবার পরিসংখ্যান ভবনে এক অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, এখন থেকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হবে।
“এই হিসাবে ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাথাপিছু জাতীয় আয় বছরে ৯২৩ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৪ ডলার।”
এর আগে পরিসংখ্যান ব্যুরোর যুগ্ম পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জিডিপি প্রবৃদ্ধির ভিত্তিবছর পরিবর্তন সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
এতে বলা হয়, ২০০৫-০৬ এর তথ্যকে ভিত্তি ধরে প্রাথমিক হিসাবে ২০১২-১৩ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। আর পুরনো, অর্থ্যাৎ ১৯৯৫-৯৬ ভিত্তি বছরের হিসাবে এ হার ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ।
নতুন ভিত্তি বছরের হিসাবে জিডিপির আকার পুরনো ভিত্তি বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালকে ভিত্তি বছর ধরে সর্বপ্রথম জিডিপি প্রাক্কলন শুরু হয়। এরপর ১৯৯৩ সালে ১৯৮৪-৮৫ সালকে ভিত্তি ধরে শুরু হয় জিডিপির হিসাব। ২০০০ সাল থেকে ১৯৯৫-৯৬ বছরকে ভিত্তি ধরে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিত্তি বছর পরিবর্তনের ফলে কৃষি খাতের শস্য উপ খাতে ২৪টি নতুন শস্যসহ মোট ১২৪টি শস্যের উৎপাদনের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে কৃষি খাতে ‘গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড (জিভিএ) প্রায় ৯ শতাংশ বাড়বে।
এছাড়া শিল্প খাতে জিভিএ ৫ শতাংশ এবং সেবা খাতে ১৬ শতাংশ বাড়বে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অর্থমন্ত্রী ছাড়াও পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, জিডিপি ভিত্তি বছর পরিবর্তন সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক গোলাম মোস্তফা কামাল অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “সামাজিক নিরাপত্তা খাতসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে গত কয়েক বছর ধরে আমরা ভাল করছি। তারই ইতিবাচক ফল হচ্ছে মাথাপিছু আয়ের এই উন্নতি।”
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার পরিসংখ্যানকে সব সময় ‘রাজনীতির ঊর্ধ্বে’ রাখার চেষ্টা করেছে বলেও মন্তব্য করেন মুহিত।
মুহিত বলেন, ভিত্তি বছর পরিবর্তনের ফলে অনেক নতুন নতুন খাত যোগ হয়েছে। এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কিছুটা বাড়তে পারে।
সরকার চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে (আগের ভিত্তি বছরের হিসাবে) ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা করছে।
মাথাপিছু আয় হাজার ডলার ছাড়ালেও এ দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান এখনো চতুর্থ।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি, ২ হাজার ৯২৩ ডলার। আর বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫২৭ ডলার। আর ১ হাজার ৩৮০ ডলার মাথা পিছু আয় নিয়ে পাকিস্তানের অবস্থান সার্কে তৃতীয়।
মাথাপিছু আয় ১১৯০ ডলারে উন্নীত করতে পারলে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসার তিনটি শর্তের একটি পূরণ হবে বাংলাদেশের। এছাড়া অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মানব সম্পদ সূচকেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে হবে বাংলাদেশকে।
এসব শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশের ‘স্বল্পোন্নত’ দেশের তকমা ঘোঁচাতে এরইমধ্যে একটি ‘কর্মপরিকল্পনা’ অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।
সামাজিক নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচনে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্যের তথ্য বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।
গত জুনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ পোভার্টি অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়, দারিদ্র্য বিমোচনে চলতি বছরের মধ্যেই জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে ছিল। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালে তা কমিয়ে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে গত এক দশকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্ব ব্যাংক মনে করছে, নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ধারাবাহিকভাবে কমে এসেছে। ২০০০ সালে যেখানে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৫ সালে তা কমে সাড়ে ৫ কোটি এবং ২০১০ সালে তা আরো কমে ৪ কোটি ৭০ লাখে নেমে এসেছে।
হালের তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ২০১৫ সাল নাগাদ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ২ শতাংশ পয়েন্ট কমে আসবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের হার তখন দাঁড়াবে ২৬ শতাংশের কাছাকাছি। বর্তমানে দেশে দারিদ্রের হার ২৭ শতাংশের নিচে।
বিশ্ব ব্যাংক বলছে, প্রধানত দুটি কারণে বাংলাদেশ এই সফলতা অর্জন করেছে। এর একটি হলো- মজুরি বৃদ্ধি। সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই শ্রমের মজুরি বেড়েছে গত এক দশকে।
আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে এসে ‘নির্ভরশীল লোকের’ সংখ্যা কমে যাওয়াও এই সাফল্যের একটি কারণ।
বর্তমানে তা বেড়ে ৯২৩ ডলারে উন্নীত হয়েছে। গ্রামে কর্মসংস্থান ও মজুরি বেড়েছে। দেশের ভেতরে চাহিদা বেড়েছে। স্থানীয় বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে।
২০০৮ সালে যেখানে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ৬৩০ ডলার ছিল, পাঁচ বছরের মাথায় তা ৪১৪ ডলার বেড়েছে।