ইসলামি শরিয়তের আরো একটি মূলনীতি হল এমন কোনো কাজ না করা যার দ্বারা নিজের ধ্বংস ডেকে আনা হয়। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ. البقرة : 195
"তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসে নিপতিত করো না†[সূরা আল-বাকারা : ১৯৫]
ধূমপান যেহেতু সর্বসম্মতিক্রমে ধ্বংসাত্মক, সে কারণে ধূমপান উল্লিখিত মূলনীতির আওতায়, নিষিদ্ধ বিষয় বলে বিবেচিত হবে।
ইসলামি শরিয়তের আরেকটি মূলনীতি হল, যা কিছু তাইয়েব বা পবিত্র, তা হালাল আর যা কিছু খাবিস বা অপবিত্র-ক্ষতিকর , তা হারাম। আল কুরআনে এসেছে:
وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ. (الأعراف : 157 (
"তিনি তোমাদের জন্য হালাল করেন যা পবিত্র, এবং হারাম করেন যা অপবিত্র-খারাপ" [সুরা আল-আরাফ : ১৫৭ ]
এ আয়াত থেকে অপবিত্র ও খারাপ বিষয় হারাম হওয়ার যে মূলনীতি পাওয়া যায় তার ভিত্তিতেও ধূমপান হারাম বলে বিবেচিত। কেননা ধূমপান যে খারাপ ও ক্ষতিকর এ ব্যাপারে কোন স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী দ্বি-মত পোষণ করেছেন বলে কেউ বলতে পারবে না। তারপরও যদি কেউ বলে ধূমপান শরিয়তের নিষিদ্ধ বস্তুর মধ্যে পড়ে না, তা হলে তাকে ঐ ডায়াবেটিস রোগীর সাথে তুলনা করতে হবে, যিনি ডাক্তারের নির্দেশ মত চিনি ত্যাগ করলেন ঠিকই কিন্তু রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশ সবই খেলেন আর বললেন, কই ডাক্তার তো এগুলো নিষেধ করেন নি!
(দেখুন: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান,
www.islamhouse.com/p/144554)
বলে রাখা ভাল যে কোনটি পবিত্র আর কোনটি অপবিত্র বা খাবিস তা ব্যক্তিগত রুচি অনুযায়ী নির্ণীত হবে না। তা নির্ণয়ে বরং কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস ইত্যাদির আশ্রয়ে যেতে হবে। প্রাজ্ঞ ওলামাদের স্মরণাপন্ন হতে হবে। ধূমপানের ক্ষতিকারক দিকগুলোর বিবেচনায় কুরআন সুন্নাহর মূলনীতি অনুযায়ী এবং বর্তমান বিশ্বের ফেকাহবিদদের ইজমা অনুযায়ী বিষয়টি যে খাবিস অপবিত্র-ক্ষতিকর তাতে কোনো দ্বিমত নেই। অন্যান্য হারাম খাদ্য-খাবারের উপর কেয়াস করেও ধূমপান যে হারাম তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
ধূমপান হারাম হওয়ার আরো কিছু প্রমাণ
আল্লাহ তাআলা মদ ও জুয়া বিষয়ে বলেন :
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا. (البقرة : 219(
"তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে ৷ বল, এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ ৷ আর তার মধ্যে মানুষের জন্য উপকারিতাও আছে৷ তবে এগুলোর পাপ উপকারের চেয়ে বড়। [সূরা আল-বাকারা:২১৯]
আল কুরআনের এ আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে যে মদ জুয়ার মধ্যে উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও তা হারাম করা হয়েছে; কেননা মদ ও জুয়ায় উপকারিতার চেয়ে ক্ষতির দিকটাই প্রবল। আর ধূমপানে তো আদৌ কোনো উপকারের দিক নেই, বরং একশ ভাগই ক্ষতি ৷ তাই কেয়াস বা ডিডাকশন মূলনীতির দাবি অনুযায়ী ধূমপান হারাম না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ধূমপানে অর্থ অপচয় হয়, আর অপচয়কারি শয়তানের ভাই
ইরশাদ হয়েছে:
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
"নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই†৷ [সুরা আল-ইসরা :২৭]
ধূমপান একটি অপচয় ৷ অবশ্য এমন অনেক অপচয় আছে যাতে মানুষের লাভ-ক্ষতি কিছু নেই ৷ তবু সেগুলো সকলের কাছে অন্যায় ও অপচয় বলে গণ্য ৷ কিন্তু ধূমপান এমন একটি অপচয় যাতে ক্ষতি ভিন্ন অন্য কিছু নেই ৷
অযথা ব্যয় আল্লাহর কাছে একটি ঘৃণিত বস্তু বলে বিবেচিত, হাদিসে এসেছে,
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إن الله كره لكم ثلاثا : قيل وقال وكثرة السؤال وإضاعة المال
"আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাদের জন্য তিনটি বিষয়কে ঘৃণা করেন ৷" (এক) ভিত্তিহীন কথা-বার্তা৷ (দুই) অধিকহারে প্রশ্ন করা ৷ (তিন) সম্পদ নষ্ট করা ৷ [ বুখারি ও মুসলিম ]আর ধূমপানকারী ধূমপান করে যে অযথা সম্পদ নষ্ট করে এ ব্যাপারে কারো দ্বি-মত নেই ৷
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া ইমানের দাবি বহির্ভূত
ধূমপানের দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া হয়, আর প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া ইমানের দাবি বহির্ভূত।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন :
من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فلا يؤذي جاره
"যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়৷" [বুখারি]ধূমপানকারী ধূমপানের দ্বারা স্ত্রী-পরিজন সহযাত্রী, বন্ধু - বান্ধব ও আশে-পাশের লোকজনকে কষ্ট দেয়। তাই ধূমপান নিঃসন্দেহে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসের দাবি বহির্ভূত একটি গর্হিত বিষয়।
খ্যাতনামা মুফতিদের ফতোয়া
সৌদি আরবের প্রয়াত গ্রান্ড মুফতি শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায রা. ধূমপান হারাম বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে বলেন:
( أن التبغ بكل أنواعه محرم كالخمر لكونه خبيثا ويشتمل على أضرار كثيرة ولا يجوز بيعه ولا تدخينه ولا التجارة فيه(
(সকল প্রকার তামাক হারাম। ঠিক মদের মতোই। কেননা তা খাবিস বা মন্দ, এবং এর রয়েছে বহু অনিষ্টকারিতা। তামাক বিক্রি করা, সেবন করা, তামাকের ব্যবসা-বানিজ্য সবই অবৈধ।) তিনি আরো বলেন : ‘যারা তামাক সেবন করে অথবা তামাকের ব্যবসা করে তাদের তাওবা করে ফিরে আসা উচিত, যা ঘটে গেছে তার জন্য লজ্জিত হওয়া উচিৎ। কোনো দিন আর এ কাজে ফিরে যাবে না বলে দৃঢ়চিত্ত হওয়া জরুরি। [ দৈনিক আল কাবাস, কুয়েত:২.৬.১৯৯৪ ইং]
ফেকাহবিদ ড. ইউসুফ আল কারদাবি বলেন: ‘
)إنه حرام، لأنه مضر بالصحة، مسبب للسرطان، وهو قتل بطيء للنفس، والله تعالى يقول: (ولا تقتلوا أنفسكم إن الله كان بكم رحيما) وهو حرام، لأنه يضر بمن يجالس المدخن، ويشركه في التدخين رغما عنه، والحديث النبوي يقول: «لا ضرر ولا ضرار.
وهو حرام، لأنه خبيث في رائحته وفي أثره، والإسلام جاء ليحل الطيبات ويحرم الخبائث.. وهو حرام، لأنه من باب الإسراف أو التبذير وإضاعة المال فيما لا ينفع في الدنيا والآخرة.. وهو حرام لأنه يضر الضرورات الخمس: يضر بالدين، ويضر بالنفس، ويضر بالنسل، ويضر بالعقل، ويضر بالمال، لهذا كان تعاطيه محرما، واستيراده محرما، وبيعه محرما، والترويج له والإعلان عنه محرما(
ধূমপান হারাম; কারণ তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, ক্যানসারের কারণ, এটা হল মন্থর গতিতে মানব হত্যা। ইরশাদ হয়েছে : { তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর দয়াশীল।} [ ১৯৫ ] ধূমপান হারাম; কেননা ধূমপানরত ব্যক্তির কাছে গিয়ে যে বসে তাকে তা ক্ষতি পৌঁছায়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরোক্ষভাবে তাকে ধূমপান করায়। হাদিসে এসেছে, (নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার স্থান ইসলামে নেই)
ধূমপান হারাম ; কেননা তা গন্ধে ও প্রভাবে খারাপ। আর ইসলাম এসেছে যা কিছু পবিত্র-উত্তম তা হালাল করতে। ধূমপান হারাম, কারণ ধূমপানে এমন একটি খাতে সম্পদ অপচয় ও নষ্ট করা হয় যার দুনিয়া আখেরাতে আদৌ কোনো ফায়দা নেই। ধূমপান হারাম, কারণ তা পাঁচটি প্রয়োজনীয় বিষয়ের ক্ষতিসাধন করে, দীন-ধর্মের ক্ষতি করে, নাফসের ক্ষতি করে, নসল তথা বংশানুগতির ক্ষতি করে, বুদ্ধিমত্তার ক্ষতি করে এবং অর্থের ক্ষতি করে। এ কারণেই তামাক সেবন হারাম, তা ইম্পোর্ট করা, বিক্রি করা, ধূমপানের পক্ষে প্রচারণা ও এ্যাডভারটাইসম্যান্টও হারাম।
ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার ব্যক্তিগত লাভ
১- একটি হারাম ও গর্হিত কাজ বর্জন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হবে।
২- নবী রাসূল ও সৎ লোকদের কেউই ধূমপান করেন নি, তাই ধূমপান বর্জন করে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ সম্ভব হবে।
৩-ফুসফুসের রোগ-ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে।
৪- হার্টের অসুখ বা ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে ৷
৫- হার্টে চাপ কম পড়বে ৷
৬- আপনার ধোঁয়া থেকে আপনার প্রিয়জন ও প্রতিবেশীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বেঁচে যাবে ৷
৭- সর্দি, কাশি, শ্লেষ্মা ইত্যাদি থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া যাবে ধূমপান বর্জনের সাথে সাথে ৷
৮- মুখের যাবতীয় ক্যানসার থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
৯- দাঁত আরও সাদা আরও পরিষ্কার হবে।
ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার সামাজিক লাভ
১- আপনি নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, সিগারেট আপনাকে আর নিয়ন্ত্রণ করবে না ৷
২- আপনার নিজের সম্বন্ধে ধারণা ও আত্মবিশ্বাসের উন্নতি হবে ৷
৩ - আপনি আজ ও আগামী দিনে আপনার সন্তানের একজন সুস্থ অভিভাবক হতে সক্ষম হবেন ৷
৪- অন্যান্য উপকারী খরচার জন্য আপনার হাতে আরো বেশি টাকা থাকবে ৷
৫ - ধূমপান না করার কারণে আপনি আলাদা সামাজিক মর্যাদায় ভূষিত হবেন।
ধূমপান বর্জনে সহায়ক কিছু টিপস
১- ধূমপান হারাম এ বিষয়টি হৃদয়ে জাগ্রত রাখুন।
২- আল্লাহর কাছে বেশি-বেশি দুআ-প্রার্থনা করুন যাতে তিনি ধূমপানের বদভ্যাস ছাড়তে তাউফিক দেন, সাহায্য করেন।
৩ - চুরুট, সিগারেট, অ্যাশট্রে হাতের কাছে না রেখে লুকিয়ে রাখুন। দেখতে না পেলে মনেও পড়বে না ৷ এটা একটা সহজ কিন্ত কার্যকর উপায় ৷
৪ - সিগারেট এমনভাবে রাখুন, যাতে সহজেই পাওয়া না যায় ৷ সিগারেট ইত্যাদি এমন জায়গায় রাখুন যেখান পৌঁছুতে হলে আপনাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে ৷ যেমন অন্য ঘরে, যেসব জায়গায় আপনি বিশেষ যান না এমন কোথাও, বা আলমারির ভিতর তালা বন্ধ করে ৷
৫ - কী থেকে আপনার ধূমপান করতে ইচ্ছা জাগে তা ভেবে বের করুন ও তা কাটানোর উপায় চিন্তা করুন ৷ যাঁরা ধূমপান করেন তাঁদের সান্নিধ্যে এলে কি এমনটা হয়? তাহলে প্রথম প্রথম যারা সিগারেট খান বা খাচ্ছেন তাদের থেকে দূরে থাকুন, তাহলে তাদের দেখে খেতে ইচ্ছা করবে না ৷
৬ - মুখে কিছু রাখার চেষ্টা করুন যেমন লজেন্স, মিষ্টি বা চুইংগাম বা পেপারমিন্ট ইত্যাদি রাখুন ৷
এবং জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিন ৷
৭ - যখনই ধূমপান করতে ইচ্ছা করবে তখনই বসা বা দাঁড়ানো অবস্থাতে গভীরভাবে নিশ্বাস নিন ৷ এক গ্লাস পানি খেলে ও ব্যায়াম করলেও ইচ্ছেটা কমে যাবে।
৮ - তামাক বা সিগারেট খাবার ইচ্ছে হলে আপনার সন্তানের সম্বন্ধে ভাবুন এবং আপনার কোনো তামাক ঘটিত ভয়ঙ্কর অসুখ হলে তাদের ভবিষ্যতের উপর কী প্রভাব পড়বে তা চিন্তা করুন ৷
৯ - একটি দিন ঠিক করুন যেদিন থেকে তামাক সেবন বন্ধ করবেন ৷
১০ - কারোর সাহায্য নিন ৷
১১ - সিগারেট ছাড়ার পর প্রথম দিনটি কি করে কাটাবেন তার পরিকল্পনা করুন ৷
১২ - যখনই ধূমপান বা তামাক সেবনের ইচ্ছা হবে তখনই এই চারটি জিনিস করুন:
*১*অন্য কিছু করুন *২ *পরবর্তী সিগারেট বা তামাক সেবনটি পিছিয়ে দিন
*৩* গভীরভাবে শ্বাস নিন *৪* পানি পান করুন
o ইতিবাচক কথায় নিজেকে বোঝান ৷
o নিজেকে পুরস্কার দিন ৷
o মন শান্ত রাখার জন্য প্রতিদিন ব্যায়াম করুন বা হাঁটুন, দুআ-যিকির, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি করুন ৷
o এ ছাড়াও, সব সময়ে সক্রিয় থাকুন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান ৷
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র:
--------------
দৈনিক ইনকিলাব তারিখ ১৫-১২-২০০০ ইং
সাপ্তাহিক আরাফাত বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ১, ১৮ই আগস্ট ২০০৩
কারিমা বিন্তে খামিস আল বু সাইদিয়াহ, আল ইনহিরাফ আল খুলুকি
http://www.islamhouse.com/p/144554www.qaradawi.net