মানব সভ্যতার রত্ন "কায়রো"
ঈজিপ্ট বা মিশরের রাজধানী কায়রো। মিশর নামটা শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে ধুলোয় ঢাকা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা স্ফিংস, পিরামিড আর ফারাও তুতানখামেনের ঐশ্বর্যপূর্ণ সমাধি। কিন্তু পিরামিড আর স্ফিংস কিন্তু কায়রো শহরের মূল বৈশিষ্ট্য নয়। পিরামিড আর স্ফিংস হলো মৃত্যুর নগরী “নেক্রোপোলিস” এর পাহারাদার।
আর কায়রো হলো এমন এক শহর যেখানে জীবন প্রস্ফুটিত হয়েছে প্রায় শুন্য থেকে। প্রাচীন এই নগরীর ইতিহাস এতই বিস্তৃত যে রাতের পর রাত পার হয়ে যাবে কিন্তু এর গল্প শেষ হবে না।
নীলনদের তীরে গড়ে ওঠা এই শহরের সূচনা হয় একেবারে প্রস্তর যুগে। জলপথে যোগাযোগ স্থাপনের সুবিধার্থে বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই অঞ্চলটি। কিন্তু এটি সত্যিকারের উন্নতির মুখ দেখে প্রথম ফারাও মেনেস এর সময়ে। মিশর তখন ছিল দুইটি অংশে বিভক্ত। উচ্চ মিশর এবং নিম্ন মিশর। নীল নদের উজান অঞ্চল, অর্থাৎ উত্তর দিকে ছিল নিম্ন মিশর। আর ভাটি অঞ্চল, অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে ছিল উচ্চ মিশর। এই দুই অঞ্চলের মাঝে যেন বৈষম্য সৃষ্টি না হয়, সেই জন্য মেনেস এই দুই অঞ্চলের সীমানায় তৈরি করেন তার রাজধানী “মেমফিস”, কায়রো থেকে ১৫ মেইল দক্ষিণের এই নগরী ছিল যথেষ্টই প্রভাবশালী। আর নীল নদের অপর পাড়ে ছিল ধর্মীয় কেন্দ্র “অন”।
খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ সালের দিকে পারস্য আক্রমণকারীরা মিশর দখল করে ফেলে এবং মেমফিসের উত্তরে ব্যাবিলন-অন-দ্যা-নাইল দুর্গ স্থাপন করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সাল পর্যন্ত এখান থেকেই তারা মিশর শাসন করে। এর পর আলেক্সান্ডার দখল করেন মিশর। তার সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে স্থাপিত হয় আলেক্সান্দ্রিয়া এবং ব্যাবিলনের গুরুত্ব কমে যায়।
আলক্সান্ডারের আগমনের সাথে সাথে মিশরে বর্ণমালার ধারণা আসে। এর আগে শুধুমাত্র হায়ারোগ্লিফ ব্যবহার করা হত। এ সময়ে নতুন এক মিশরীয় বর্ণমালার উদ্ভব হয় যার নাম কপ্টিক।
গ্রিক সাম্রাজ্যে কায়রোর ব্যাবিলন দুর্গের তেমন একটা গুরুত্ব না থাকলেও, রোমানরা মিশর দখল করার পর এটি ব্যবহার করা শুরু করে। বাণিজ্য পথের কাছে স্থাপিত এই দুর্গ থেকে পাহারাদারি করা অনেক সহজ ছিল। ফারাওদের তৈরি করা লোহিত সাগর খাল নতুন করে খনন করানো হয় রোমান সেনাপতি ট্রাজানের সময়ে। এর সাহায্যে লোহিত সাগর থেকে পাড়ি দেওয়া যেতো ব্যাবিলন এবং এর পর ভূমধ্যসাগরে।
রোমান সময়ে ব্যাবিলন ছিল একটি প্রভাবশালী অঞ্চল এবং একে ঘিরে গড়ে উঠেছিল একটি নব্য খ্রিস্টান সমাজ। সেইন্ট মার্ক এখানে বসবাস করতেন এবং রোমের গির্জা থেকে এখানে শুভেচ্ছা পাঠান সেইন্ট পিটার।
কিন্তু পরবর্তীতে মিশরের কপ্টিক গির্জা বাকি পৃথিবীর খ্রিস্টধর্ম থেকে আলাদা হয়ে পড়ে এবং তাদের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে আরব্য মুসলিমরা যখন ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে মিশরে আসে তখন ব্যাবিলন দখল করা তাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়। রোমানদের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পুরো মিশর তাদের হাতে এসে পড়ে। এখান থেকেই শুরু হয় মিশরে আরব্য মুসলিমদের সময়কাল।
মিশরে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হবার পরে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দের দিকে আরব্য সেনাপতি আমর ইবনে আল ‘আস একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন। আজ যেখানে কায়রো দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই ছিল “আল-ফুস্তাত” নামের এই নগরী। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মাঝে এই নগরী উন্নত হয় এবং এক পর্যায়ে হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী। ৯৬৯ সালের দিকে “ফাতিমিদ” নামের আরেকটি মুসলিম গোষ্ঠী মিশরে আসে। আল-ফুস্তাতের কাছেই আরেকটি নগরী স্থাপন করে যার নাম ছিলো আল-মানসুরিয়াহ। আল ফুস্তাত যেখানে ছিল অরক্ষিত, সেখানে আল-মানসুরিয়াহ ছিল চৌকোণা, সুরক্ষিত দেয়ালে ঘেরা। পরবর্তীতে এর নাম হয় আল-কাইরাহ(যার অর্থ হলো বিজয়ী) বা কায়রো। ফাতিমিদরা মিশরের শাসনভার গ্রহণ করে এবং তা বজায় থাকে প্রায় দুই শতাব্দী। এ সময়েই কায়রো হয়ে ওঠে মিশরের রাজধানী।
আল-ফুস্তাত এবং আল-কাইরাহ পাশাপাশি অবস্থান করে ১১৬৮ সাল পর্যন্ত। এর পর খ্রিস্টীয় ধর্মযোদ্ধা বা ক্রুসেডারদের আক্রমণ হয় এ অঞ্চলে। এ সময়ে তাদেরকে পরাজিত করার জন্য আগুনে পুরিয়ে দেওয়া হয় অরক্ষিত আল-ফুস্তাত নগরী কিন্তু আল-কাইরাহ বেঁচে যায়। সিরিয়া থেকে আসা এক সেনাদল যুদ্ধে ক্রুসেডারদের পরাজিত করে এবং এর সেনাপতি, সালাদিন মিশরের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং সুচনা হয় “আইয়ুবি” শাসনামলের। ১৩শ শতাব্দীতে মামলুক নামের তুর্কি সেনাদল এদেরকে পরাজিত করে মিশর দখল করে নেয়।
১২৬০ থেকে ১৫১৬ শতাব্দিতে মামলুক শাসনের অধীনে প্রভূত উন্নতি হয় কায়রো নগরীর। মুসলিম বিশ্বে সবচাইতে শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে কায়রোর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়। মশলার ব্যবসায় নেতৃত্বে চলে আসে কায়রো। এ ছাড়াও এ সময়েই কায়রোর সবচাইতে প্রসিদ্ধ কাঠামোগুলো তৈরি হয়। ১৫শ শতাব্দির শেষ দিকে অবশ্য মশলা ব্যবসায় তাদের এই নেতৃত্ব চলে যায়। ১৫১৭ সালে মামলুকদের হারিয়ে অটোম্যান সুলতান সেলিম মিশর দখল করে নেন। মিশর তার পূর্ব মহিমা হারিয়ে ফেলে এবং হয়ে যায় শুধুই একটি প্রাদেশিক রাজধানী। ১৮শ শতকের মাঝে এর নাগরিক সংখ্যা কমে মাত্র তিন লাখের মতো হয়ে আসে। ১৭৯৮ থেকে ১৮০১ সাল পর্যন্ত নেপোলিয়নের সৈনিকদের অধীনে ছিলো কায়রো। কিন্তু এর পর তা আবার তুর্কি শাসনে চলে আসে।
কায়রোর আধুনিকীকরণ শুরু হয় মোহাম্মদ আলি’র শাসনামলে। প্রায়শই তাকে "father of modern Egypt" বলা হয়ে থাকে। প্রায় অর্ধশতক ধরে মিশর শাসন করেন তিনি এবং এ সময়ে মিশর হয়ে ওঠে আধুনিক এবং শক্তিশালী। ইসমাইল পাশা’র শাসনামলেও অব্যাহত থাকে এই উন্নতির ধারা। কায়রো নগরীর প্রাচীন অঞ্চলের পশ্চিম দিকে গড়ে উঠতে থাকে বিস্তৃত পথ এবং তার পাশে চক্রাকার সব প্লাজা, অনেকটা ইউরোপীয় নগরীগুলোর অনুকরণে। ধারণা করা হয়, এ সময়ে মিশরে ফরাসি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব রয়েছে কায়রো নগরীর এই আধুনিকীকরণের পেছনে।
বিংশ শতাব্দীতে এসে সেতু এবং বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় কায়রোতে। এত সব উন্নতির কারণে এ নগরীর জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১৯২৭ সালের মাথায় এক মিলিয়ন হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এখানে ব্রিটিশ সেনাদলের ঘাঁটি স্থাপিত হয়। ১৯২০ সালে তাদের সংখ্যা কমে এলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আবারো তারা ফিরে আসে।
১৯৫২ সালে মিশরীয় বিপ্লবের সময়ে কায়রো এবং পুরো মিশরেই ঔপনিবেশিক শক্তির পতন ঘটে। এর পর থেকেই মিশরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে মিশরিয়রা কায়রোতে চলে আসতে শুরু করে। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামলাতেই কায়রোকে আরও বড় করে তলা হয় এবং নগরীতে পুরনো কায়রো এবং নতুন কায়রো এই দুই অংশের মাঝে পার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে।
নতুন কায়রোর অংশ হিসেবে রয়েছে নাসর সিটি, মুকাত্তাম সিটি এবং এঞ্জিনিয়ারস’ সিটি। বেশ পরিকল্পিত এবং উন্নত এই এলাকাগুলো। কিন্তু কায়রোর সৌন্দর্য, কায়রোর মহিমা এই নতুন অংশে নয়, পাওয়া যাবে শুধুই পুরনো অংশে। কায়রো অতীত স্পর্শ করা যায় এই এলাকাগুলোতে গেলে, যেখানে এখনও আল-ফুস্তাত, কপ্টিক চার্চ, ব্যাবিলন তাদের গৌরবের চিহ্ন রেখে গেছে।
Source-www.priyo.com