সেই ১৯৫০ সালের ঘটনা। তখন শ্রীলঙ্কায় হাজার হাজার অন্ধ ব্যক্তি জীবনের কোনো আলোর কথা চিন্তা করতে পারতেন না। তখন যেসব কয়েদির ফাঁসি দেয়া হতো তাদের চক্ষু নিয়ে রোগীদের সেবা দেয়া হতো। কিন্তু এরকম ফাঁসি তো আর হরহামেশা হয় না। তখন হাডসন সিলভা নামে শ্রীলঙ্কার একজন ডাক্তার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। যেসব রোগী শুধুমাত্র কর্নিয়ার অভাবে অন্ধ থাকতেন একজন ডাক্তার হিসেবে ডা. হাডসন তা মেনে নিতে পারতেন না। ১৯৫০ সালেরই শেষের দিকে তিনি জাতীয় একটি পত্রিকায় কলাম লিখলেন, শিরোনাম ছিল ‘লাইফ টু এ ডেড আই’ মানে ‘একটি মৃত চোখকে জীবন দাও’।. এই কলামে তিনি নিজের চক্ষুদানে কথা প্রকাশ করে দেশের জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চক্ষুদানের আহ্বান জানান। এতেই কাজ হয়ে গেল! প্রথমে ডা. হাডসন এবং তার স্ত্রী ইরানগানি ডি সিলভা কোনো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যাবরেটরি ছাড়াই নিজেদের বাসার ফ্রিজে চক্ষু সংরক্ষণ করতে শুরু করেন। তখন থেকেই ‘আই ডোনেশান সোসাইটি’র যাত্রা শুরু। ১৯৬৪ সালে প্রথম তারা বিদেশে কর্নিয়া পাঠান। তখন হাতে করে একটি আইসব্যাগে কর্নিয়া নিয়ে বিমানে করে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। তারপর থেকে প্রায় ৬০ হাজার কর্নিয়া দান করা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় শ্রীলঙ্কায় চক্ষুদান এখন একটি অলিখিত গৌরব ও রীতি হয়ে আসছে। কর্নিয়া সরবরাহে এ দ্বীপ দেশটি পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। শ্রীলঙ্কায় ‘আই ডোনেশান সোসাইটি’ বা ‘চক্ষুদান সমাজ’ নামের এ সংগঠনটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের আওতায় থেকে এ মহান কাজটি করে যাচ্ছে। সংগঠনটি বছরে ৩ হাজার কর্নিয়া দান করে। প্রায় ৫০ বছর ধরে বিশ্বের ৫৭টি দেশে এরা চক্ষু বা কর্নিয়ার টিস্যু সরবরাহ করে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাকিস্তান চক্ষু আমদানি করে বলেও সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় আই ডোনেশান সোসাইটি প্রায় ১শ’ বছর ধরে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও এখনও সংগঠনটি অব্যবস্থাপনা এবং নির্ধারিত মান বিবেচনায় পিছিয়ে আসে। শ্রীলঙ্কায় চক্ষুদানের হার এতই বেশি যে সরকারের সহযোগিতায় এবং সিঙ্গাপুর সরকারের অর্থায়নে গত বছর সেখানে একটি চক্ষু-ব্যাংক খোলা হয়েছে। বছরে নতুন আরও ২ হাজার কর্নিয়া সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই এই চক্ষু ব্যাংকটি চালু করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই ৯ লাখ শ্রীলঙ্কান জনগণ সেখানে নিজেদের নিবন্ধিত করেছে মৃত্যুর পর তারা চক্ষু দান করবে বলে। শ্রীলঙ্কার জনগণ চক্ষুদানকে এমনই মহত্ কাজ হিসেবে বিবেচনা করে যে ওদের অনেকেই জীবিত থাকতেই চক্ষুদান করতে চান। রাজধানী কলম্বোয় ন্যাশনাল আই হসপিটালের ডাক্তার সিসিরা লিয়ানাগে বলেন, অনেকেই এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার তো দুইটা চোখ, আমার একটি থাকলেই যথেষ্ট, আমি কি আমার বাকি একটা চোখ অন্যকে দান করতে পারব?’ তবে এই চক্ষুদানের পিছনে কোনো বাণিজ্যিক কারণ নেই। যারা এখানে চক্ষুদান করতে আসেন তাদের কেউ বিনিময় দাবি করেন না। বরং এই চক্ষুদান ধনী গরিবের মধ্যে আরও বিভেদ কমিয়েছে। এখানে দেশের প্রধানমন্ত্রীও যেখানে চক্ষুদান করেন, সেখানে দেশের সবচেয়ে গরিব একজন চা শ্রমিকও চক্ষুদান করেন।
সূত্রঃ:দেহ:: জীবনের ঠিকানা।