কাঠমান্ডু থেকে ট্যুরিস্টবাসে পোখারা। সাত ঘণ্টার পথ। পথ মানে শুধু পথ নয়, যেন নিসর্গের সঙ্গে আলাপ করতে করতে এগিয়ে চলা। এই ভোরেই জেগে উঠেছে কাঠমান্ডু। প্রাচীনতার পরশ মেখে আধুনিকতার দিকে তাকিয়ে আছে শহরটা। পুরোনো-নতুনের ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
একটা ঢালু পথ পার হওয়ার পরই আমরা যেন চলে এলাম অন্য জগতে। এলিস যেমন বুঝতে পারেনি, কী করে এসে হাজির হলো ‘ওয়ান্ডারল্যান্ডে’, তেমনি আমরাও হঠাৎ দেখি, ধুলোমলিন কাঠমান্ডুর জায়গায় এখন আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু, খাড়া-ঢালু এক আশ্চর্য পথ, যার একদিকে সুউচ্চ পাহাড়, অন্যদিকে গিরিখাদ। আর মাঝে মাঝেই বাসের ডানে বা বাঁয়ে এসে হাজির হচ্ছে খরস্রোতা নদী—একবার ত্রিশুলি, একবার মারশিংডি।
বাসেই দিয়ে দেওয়া হয়েছিল সকাল-দুপুরের খাবারের টিকিট। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর একটি রেস্তোরাঁয় নাশতার জন্য থামলাম আমরা। বুফে ব্যবস্থা। সবজিরই রকমফের। সঙ্গে মুরগিও আছে। রেস্তোরাঁ-লাগোয়া একটি মুদি দোকান। পাহাড়ি এক নারীর হাতে দাঁড়িপাল্লা। চাল-ডালের পাশাপাশি পাহাড়ি পেয়ারা আর নাশপাতিও বিক্রি করছেন তিনি। তখনো আমাদের হাতে নেপালি টাকা নেই। ডলারে কেনা হলো ফল। ডাঁসা কচকচে নাশপাতিগুলো মুখে দিতেই পাওয়া গেল অমৃতের স্বাদ। আর পেয়ারা! সত্যিই, এ রকম সুস্বাদু পেয়ারাও চোখে পড়েনি অনেক দিন।
নেপাল মানেই মোমোআপনি যদি ভ্রমণপিয়াসী হয়ে থাকেন, তাহলে নৈসর্গিক সৌন্দর্য আপনার দুচোখ বন্ধ করতে দেবে না। পাহাড়, নদী আর অরণ্য আপনাকে মোহিত করে তুলবে।
পোখারার বাসস্ট্যান্ডটি ছোট। আমরা যে সময় গিয়েছিলাম, সেটা ‘সিজন’ ছিল না। তাই পর্যটক দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে হোটেলের এজেন্টরা। কার হোটেল কত ভালো আর কত সস্তা, তা বর্ণনা করে যাচ্ছে। ঠিক করা ছিল ল্যান্ডমার্ক হোটেলে উঠব আমরা। ফেউয়া লেক ঘেঁষেই হোটেল। লিফট নেই। আমাদের ঠাঁই হলো একদিককার পঞ্চমতলায়। পঞ্চমতলায় বাসযোগ্য দুটো রুম। দুটোই আমাদের দখলে। ঘর দুটোর সামনে বিশাল ছাদ। সেখানে দোলনা। আর সেই ছাদ থেকে সামনের দিকে তাকালেই লেকের ওপর পাহাড়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মেঘ চোখে পড়বে।
পোখারায় পৌঁছে কোথায় পালাল ক্লান্তি। হোটেলের পাশেই টাকা ভাঙানোর বুথ। অল্পকিছু ডলার ভাঙিয়ে রাস্তার ধারের সারি সারি দোকান পর্যবেক্ষণে বের হই। সমৃদ্ধ বইয়ের দোকান দেখে মন ভরে যায়। দুটি বই কেনা হয়। নেপালের নামকরা পাশমিনা (শীতে গায়ে পরার চাদরবিশেষ) দেখে বিমোহিত হই। এত হালকা, অথচ কী গরম ধরে রাখে চাদরগুলো! বুদ্ধের কারুকাজ করা কাঠের মূর্তি, মুক্তা, পাথরের মালা, নেপাল কিংবা পোখারা লেখা টি-শার্ট, কতকিছুই না এই বাজারে! আর নেপালি খাবার! খাবার বলতে প্রথমেই মোমো। একটু চাটনি দিয়ে এইমাত্র চুলা থেকে নামানো গরম গরম মোমো খাওয়ার মজা তুলনাহীন।
ফেউয়া লেকে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ তুলনাহীন। লেকের অন্য পাড়টি পাহাড়-ঘেরা। পাহাড় বেয়ে চুইয়ে নামছে জল। আর তরুণ-তরুণীরা তাদের নৌকা থামিয়ে সেখানেই করছে পিকনিক।
পরদিন একটি গাড়িতে করে পোখারা দেখতে বেরিয়ে পড়ি আমরা। একটি মন্দিরে কিছুটা সময় কাটিয়ে চলে আসি সেতি নদীতে। এটাকে নদী বলব না গিরিখাদ, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। একটি সেতুর মতো করে দেওয়া হয়েছে। তার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দুধসাদা জল। কিন্তু সেই সেতুর রেলিং থেকে নিচের দিকে তাকালে আতঙ্কিত হয়ে উঠতে হয়। গিরিখাদটি দিয়ে বহু নিচে প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। মনে হলো, ধন্য হলো চোখ দুটো।
এরপর পোখারা জাদুঘর ঘুরে পৌঁছে গেলাম ডেভিস ফলসে। ওপর থেকে নেমে আসা প্রচণ্ড বেগে ধাবমান জলরাশি দেখে পর্যটকেরা মুগ্ধ হয়। দেবী নাকি ডেভিড, কার নামে এই জলপ্রপাত তা নিয়ে খোদ নেপালেই সংশয় আছে। কোন কিংবদন্তি কে বিশ্বাস করবে, সেটা তার নিজের ব্যাপার।
গুপ্তেশ্বর গুহায় ঢোকার আগে বুঝিনি, স্যাঁতসেঁতে এই গুহাটি আমাদের নিয়ে যাবে মাটির ১০০ ফুট তলদেশে। মাথার ওপরে মাটির যে ছাদ, তা থেকে চুইয়ে নামছে পানি। কিছুটা দূর নামার পর বুঝতে পারি, এ রকম জায়গায় অনায়াসে ভৌতিক চলচ্চিত্র তৈরি করা সম্ভব। ৪০ ফুট নামার পর একটি মন্দির দেখি। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন একজন, খেলনা কামধেনু নিয়ে। সেই কামধেনুর কাছে পয়সা দিলে দুধের নহর বয়ে যায়।
উঠে এলাম আমরা। ১০০ ফুট নামার অনুমতি ছিল না সে সময়। শীতকালে মানে এখন গেলে যে কেউ গুপ্তেশ্বর গুহার শেষ দেখে আসতে পারবেন।
নাগরকোট যেমন এভারেস্ট দেখার জন্য, পোখারা তেমনি অন্নপূর্ণা দেখার জন্য। ভোররাতেই গাড়িতে করে চলে যাওয়া যায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। সূর্য ওঠার সময় অপার্থিব সোনালি আভা যখন প্রকৃতি আর মন ছুঁয়ে যায়, তখন সত্যিই মনে প্রশ্ন জাগে, জগতে এত হানাহানি, এত বৈষম্য কেন?
কিছুদিনের জন্য হানাহানিবিহীন নিসর্গের মধ্যে বসবাসের কথা যদি কেউ ভাবেন, তাহলে অনায়াসে বেছে নিতে পারেন পোখারাকে। পাহাড়, অরণ্য ও খরস্রোতা নদী আপনাকে পরিণত করবে নতুন মানুষে।